ধরিত্রী_কথন #পার্ট৩১,৩২

0
895

#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট৩১,৩২
#পিকলি_পিকু
৩১

জোহরা জামানসহ হাসপাতালে আসলো। ধরিত্রী বেঁচে আছে। ঘুমের ঔষধ গুলো বের করা হয়েছে। এখনো জ্ঞান ফেরেনি। জোহরা সোজা তার মেয়ের কাছে গেল। কেন করল এমন? এখনো কী সেই অভিমান? আসেনি তো মাতৃত্বের দাবি নিয়ে। তাকে তার মতোই থাকতে দেওয়া হয়েছিল। তবুও কেন এমন কাজ করতে হবে? রুবাইয়া অত্যন্ত লজ্জিত। সে কাছে এসে জোহরার কাঁধে হাত রেখে বলল,

– ক্ষমা করে দিও। আমি মেয়ের খেয়াল রাখতে পারিনি।
– কখন করল?
– ভোরের দিকে।
– রাফসান কোথায় ছিল?
– সেটাই বলতে আসলাম। ধরিত্রী হয়তো কখনো আমায় ক্ষমা করবে না। আমি নিজেও বুঝতে পারিনি।
– কী?

রুবাইয়া এবার সব খুলে বলল। জোহরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে কী সত্যি তার মেয়ের আর তার কপাল একই হলো। ভুল করেছে সে। উচিত হয়নি তার ধরিত্রীর কথা শোনা। এভাবে যোগাযোগ বন্ধ করা উচিত হয়নি। কতটা একা হয়ে গেলে মেয়েটা এমন পদক্ষেপ নিতে পারে।

এদিকে জামান যাচ্ছে রাফসানকে খুঁজতে। তার সাহস হলো কী করে এমন কাজ করার। পরক্ষণেই সে দাঁড়িয়ে যায়। আজ নিজের মেয়ের সাথে হয়েছে। সে বুঝতে পারছে কেমন লেগেছিল জোহরার।

– রুবাইয়া, তুমি তোমার ছেলের অভিসন্ধি বুঝতে পারনি? ঐ অন্য মেয়েটাও সাথে এত সখ্যতা!
– ও ছোটবেলার বন্ধু। হঠাৎ করেই ওর ডিভোর্স হচ্ছিল। সংসার ভাঙছে তাই একটু নরম হয়েছিলাম। ওকে বাড়ি আসতে দিতাম কারণ ও ধরার ও বন্ধু। ভেবেছিলাম ওর ও মন ভালো থাকবে। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। জোহরা আমার ম*রে যেতে ইচ্ছে করছে। আমি পারছি না গলা চেপে আমার সন্তানকে হ*ত্যা করতে। জোহরা আমি,

জোহরা আর রুবাইয়ার কথা কান দিচ্ছে না। সে তার নিষ্পাপ মেয়েটাকে দেখছে। এখন বাইরের কেউ শুনলে এটাই বলবে ধরিত্রী জুঁইয়ের পাপের শাস্তি পাচ্ছে, জামানের অন্যায়ের শাস্তি পাচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সে কিছুই করেনি। আরো কিছু সময় পর ধরিত্রীর জ্ঞান ফিরল। চোখ খুলেই সে দেখল তার মাকে। চোখ ছল ছল করছে তার। ধরিত্রী তার দিকে তাকিয়ে বলল,

– আমি কেন বেঁচে আছি?
– কেন ম*রবি? আমি বেঁচে নেই?
– আমি তোমার মতো এত স্ট্রং না।

ধরিত্রী কান্না করতে থাকে। একটু পর বাকি সবাই আস্তে আস্তে কেবিনে ঢুকে। ধরিত্রী অনেক চিৎকার করতে থাকে। সবাই তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর সে শান্ত হয়। রুবাইয়া এসে বলে,

– তুই চিন্তা করিস না। রাফসানকে আমরা ত্যাজ্য করব চিন্তা করেছি।
– থাক। দরকার নেই। এত মিথ্যে কথা না বললেও হবে।
– মিথ্যে না। সত্যি।
– কেন করবে? আমি তোমার কে? আমার জন্য তোমার নিজের রক্ত কে আলাদা করার দরকার নেই।
– ও যা করেছে ওর শাস্তি পাওয়া উচিত।
– শাস্তি তো আমি পাচ্ছি। জন্ম নেওয়ার। বাবা, আজকে তোমার কেমন লাগছে? খুব একটা খারাপ না, তাই না? মা, আজকে তুমি আমাকে সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারবে। আমিও তোমার মতো। সব দিক থেকে, আমি তোমার মেয়ে। তবে আমি তোমার মতো শক্ত না।

জোহরা ধরিত্রীর হাত ধরে রাখে। সেখানে ধরিত্রীর মামা চাচা দুজনেই ছিল। তারা আর দেখতে পারছে না ধরিত্রী কে এভাবে। যতই সে পর হোক, জায়েদ মামা সত্যিই তাকে অনেক ভালোবাসত। বাহিরে গিয়ে তারা রাফসানকে খুঁজতে লাগলো। তার কেবিনের দিকে আসা মানা। তাই সে অন্য দিকে বসে আছে। ধরিত্রীর চাচা আমান গিয়ে সোজা রাফসানের কলার চেপে ধরে তাকে এক ঘু*ষি মারলো। এরপর আবার উঠিয়ে বলল,

– কেন এমন করলি? কেন আমাদের মেয়েটার সাথে এমন করলি!
– আমি কিছুই করিনি। এসব ই ষড়যন্ত্র। আমাকে সময় দিন আমি সব প্রমাণ করব।

জায়েদ আমানকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। ভেতরে এসে আমান ধরিত্রীর শ্বশুর বাড়ির সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলল। কিন্তু তারা যেতে চাইলো না, “আপনারা এখান থেকে বের না হলে আমরা কেস করতে বাধ্য হবো। খুব শীঘ্রই ডিভোর্স লেটার যাবে। আমাদের মেয়ের আশেপাশে ও আসবেন না।”

রুবাইয়া তাও যেতে চাইছে না, “মণি, তুই চাস আমরা চলে যাই?” ধরিত্রী রুবাইয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “আমি তোমাদের কাউকেই দেখতে চাই না। সেজন্যই চলে যেতে চেয়েছিলাম। তোমার সবার সাথে ভালো হওয়ার দরকার নেই। শুধু ছেলে আর তার নতুন বউয়ের সাথে ভালো থেকো।”

মাশরুফা রুবাইয়া কে টেনে বাইরে নিয়ে আসলো। সে অনেকক্ষণ ধরেই বুঝতে পারছিল না ধরিত্রী ঠিক কী বলল,

– মাশরুফা, রাফসান বাড়ি তে কী করছিল?
– আসলে, আজহার ওকে বাইরে থাকতে দেয়নি।
– তাই ধরিত্রী আমায় ভুল বুঝল?
– সব আমার দোষ। আমি জানতাম।
– ঐ মেয়েটা কোথায়?
– কে? মীরা?
– হ্যাঁ। ওকে আমি দয়া করে একটু মায়া দেখালাম কারণ ওর ডিভোর্স হচ্ছে। স্বামী ভালো না বলে, এতে যে এত কিছু হবে তা আমি কী করে জানবো? মণি আমায় ভুল বুঝল কেন? আমি ওকে এভাবে রেখে কী করে যাব?
– ভাবি শান্ত হও।
– বাড়ি চলো আফসার।

রাফসানের বাবা এলো,

– জ্বী রুবাইয়া।
– উকিলকে ডাকো। আজকেই আমি রাফসানকে ত্যাজ্য করব।
– ভেবচিন্তে বলো।
– ভেবেই বলছি। আমি এরকম একটা ছেলের মা ভাবতেও আমার ম*রে যেতে ইচ্ছে হয়। তুমি কী দেখনি ছবি গুলো?

রাফসান তার মায়ের কাছে গিয়ে বলে,

– আমাকে একটা সুযোগ দাও। আমি আর চাচ্চু প্রমাণ জোগাড় করছি।
– এসব দেখার পরেও? তুই কী করে পারলি? আমি তোকে এভাবে বড় করেছি?
– তুমি বড় করেছ, তোমার কী আমার প্রতি একটুও বিশ্বাস নেই?
– আমি ছবি গুলো নিজে দেখেছি। ধরিত্রী নিজে তুলেছে। ছি!
– আমরা কিড*ন্যাপ হয়েছিলাম। শোনো মা, আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। কাল থেকে মীরার ও কোনো খোঁজ নেই। আমাকে এই একটা শেষবার বিশ্বাস করো।
– তিন দিন সময় দিলাম। আমার কাছে না, ধরিত্রীর কাছে প্রমাণ দিবি। আমার মণিকে আমার কাছে আবার নিয়ে আসবি। কথা দে।
– কথা দিচ্ছি। আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করব।

রাফসান আর তার চাচা প্রমাণ জোগাড় করতে ব্যস্ত। সেই ট্যাক্সি আর হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ। এদিকে ধরিত্রীকে তার মা বাড়িতে নিয়ে গেছে। আগের মতো সে সারাদিন মাকে জড়িয়ে থাকে। মা চলে গেলেই ভয় পাচ্ছে। তার প্রথম থেকেই বোঝা উচিত ছিল, মা ছাড়া তার আর কেউই আপন না। এই ধ্বংসস্তূপ থেকে জোহরা তার মেয়ে কে কী করে বাঁচাবে? হঠাৎ ই ধরিত্রীর ফোনে অনেক কল আর মেসেজে আসতে শুরু করল। শুরুতে ফোন বন্ধ করে দিলেও পরবর্তীতে জোহরা আর জামানের ও ফোন আসতে থাকে। দুজনেই গিয়ে টিভি খুলে। ধরিত্রীর হঠাৎ মাকে ছাড়া ভয় করতে থাকে। সে ও বসার ঘরে যায়।

টিভিতে বড় বড় হেডলাইনে আলোচনা হচ্ছে, “প্রতিবাদীর সাথেই অন্যায়।” “পরকীয়ার বিরুদ্ধে জোর গলায় প্রতিবাদ করা নারীর স্বামী ই পরকীয়ায় আসক্ত।” “নারীদের শক্তিশালী হতে বলে নিজেই আত্ম*হ*ত্যা করতে গিয়েছিলেন।”

টিভি স্ক্রিনে ধরিত্রী আর রাফসানের বিয়ের ছবি, সাথে মীরা আর রাফসানের আপত্তিকর কিছু ছবি যা অস্পষ্ট করে দেওয়া। জোহরা ধরিত্রী কে দেখেই টিভি বন্ধ করে দিল। ধরিত্রী আবার মাটিতে পড়ে গেল।

বিছানায় ঘুমন্ত ধরিত্রী। জোহরা চোখ মুছতে মুছতে বলল, “দুনিয়ার সবাই মিলে আমার মেয়েটা কে মে*রেই ছাড়বে।”

এদিকে সবাই রাফসানের উপর ক্ষিপ্ত। ওকে রাস্তায় দেখেই সবাই মা*রতে তেড়ে আসলো। কোনোভাবে সে পালিয়ে বাড়িতে আসলো। একটু পর খবর আসলো তাকে আর মীরাকে হাসপাতাল থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। রাফসানের পরিবারের সবাই ফোন বন্ধ করে রেখেছে। এসব কিছু মিডিয়া জানলো কী করে?

রাফসান মাথায় হাত দিয়ে বলল, “আমি জানি এসব কে করছে।” চাচ্চু বলল,

– কে রাফসান?
– ঐ অঙ্কন শয়তানটা।
– ও তো মীরাকে ডিভোর্স দিচ্ছিল।
– দেয়নি। ঘোরাচ্ছিল। মীরা কোথায় আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।

রাফসান বের হতে যায়। ওর চাচ্চু ওকে থামিয়ে বলল,

– পাগল নাকি! এই মুহুর্তে বের হবি না। মানুষ তোকে গোটা রাখবে না। মীরার চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের চিন্তা কর। ক্যারিয়ারের চিন্তা কর।
– চাচ্চু, ও মীরাকে মেরেই ফেলবে। ওর ইগো অনেক। আর আমরা ওর ইগো হার্ট করেছি।
– তোকে কে বলেছিল এত বড় মানুষের ইগো হার্ট করতে। মীরার স্বামী কত প্রভাবশালী তুই কী জানতি না? যদি এসব ও করে থাকে তো ও শুধু তোর ক্যারিয়ার না আমাদের ক্যারিয়ার ও ধ্বংস করতে পারে। এমনিতে তো পরিবারের মান সম্মান শেষ। তুই না ভাবতি, মা বাবার কথা ভেবে অন্যের ঝামেলা থেকে দূরে থাকতি।

রাফসান বুঝতে পারছে সে ভুল করেছে। অঙ্কন তার ব্যক্তিগত জীবন ও পেশাগত জীবন সবই শেষ করে দিয়েছে। দেশের আজ সে সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যক্তি। হয়তো সে অনেক হাসছে। কিন্তু এসবে ধরিত্রীর কী দোষ ছিল?

ফরহাদ শেখর সাহেব টিভিতে এসব দেখছেন আর আনন্দিত হচ্ছেন। ধরিত্রীর পার্সোনাল লাইফ এখন সবার চর্চার বিষয়। যদিও ধরিত্রী পরকীয়ায় ধরা পড়লেই তিনি বেশী খুশী হতেন। যাই হোক, সবার আগে তার অন লাইন পত্রিকাই এই ধামাকাওয়ালা খবর ছাপিয়েছে। তাই আনন্দ হচ্ছে তার। কাল পত্রিকায় আরো বিস্তারিত ছাপাবেন। সাথে নানা অপ্রকাশিত ছবি থাকবে। খুব বেচা হবে সেই কাগজ গুলো। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার ফোন বেঁজে উঠল।

– হ্যালো।
– জ্বী, কেমন আছেন ফরহাদ সাহেব?
– খুব ভালো। আপনাদের কারণে তো আরো অনেক ভালো। বলে বোঝাতে পারব না। তো আপনারা এসব ছবি কোথায় পেয়েছেন?
– আপনি আম খান। কোন গাছ জানতে হবে না।
– আচ্ছা, এভাবে কী অন্য কোনো পার্টির পাওয়া যাবে?
– সময় হলে পেতেও পারেন।

ধরিত্রীর বাসায় সকাল হতে ওর পরিচিত অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীরই আগমন হয়েছে। অনেক সাংবাদিক ও এসেছে। সবাই ওর প্রতিক্রিয়া জানতে চায়। জোহরা কাউকে ঢুকতে দেয়নি। একা হাতে সব সামলেছে। সে যেন এক লৌহমানবী। আগে সবাই তার নরম হৃদয় নিয়ে হাসিঠাট্টা করতো। কিন্তু কতটা ইস্পাত তা কেউ জানে না।

ধরিত্রীকে দেখতে রাধা মিম রিমাও এসেছিল, তবে সবার মতো ঢুকতে পারেনি। ধরিত্রীদের বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাধা বলল,

– আমি জানতাম এরকম কিছু একটা হবে।
– মেয়েটার কপালটাই খারাপ।
– না রে মিম, কপালের দোষ না। সব দোষ কপালের না। আমি কখনো ভাবিনি রাফসান এমন করতে পারে। ওকে কিনা আমরা পছন্দ করতাম।

রিমা রাধার কাঁধে হাত রেখে বলল,

– আমরা তো তাও ভালো আছি। কিন্তু ঐ মেয়েটার সাথেই সব খারাপ হতে হয়।
– মীরা কে কাছে পেলে আমি শূলে চ*ড়াতাম।
– আর রাফসান?
– জীবিত কবর দিতাম। হ্যাঁ জীবিত! কী করে পারল ও? তাও স্ত্রী যখন এই বাজে অবস্থা দিয়ে যাচ্ছে।
– নিশ্চয়ই বলবে ও সন্তান হারিয়ে ডিপ্রেস্ড হয়ে এই কাজটা করেছে। আর কি!

মীম বলল, ” ছেলেদের তো বাহানা থাকে প্রচুর। অনেকে দেখবি এরপরেও ওকেই সাপোর্ট করবে।”

কিন্তু রাফসান এক্ষেত্রে কারোই সমর্থন পাচ্ছে না। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই রাফসানকে গাল মন্দ করছে। এই দিকে ওর তিন দিন শেষ। প্রমাণ সে জোগাড় করতে পারেনি। পুলিশ এক্ষেত্রে কিছুই করেনি। ট্যাক্সি টাও খুঁজতে পারেনি। ওর পাশে ও চাচ্চুকে ছাড়া কাউকে পায়নি। ওদিকে মীরা তার বাসায় এখনো যায়নি। রাফসান মাথায় হাত দিয়ে আছে। পরিস্থিতি ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত সে বের হতে পারছে না। বাসার বাহিরে অনেক সাংবাদিক। সবাই তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ছে। নিজেকে কী করে নির্দোষ প্রমাণ করবে সে? এই মুহুর্তে রাফসানের আত্মহ*ত্যা ছাড়া কোনো উপায় নেই। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে করেও ফেলতো। এত অপমান ভৎসর্ণা সহ্য করার মতো না। কেউ ওর পাশে নেই।

ধরিত্রী তার মায়ের কোলে শুয়ে আছে। ও জানে এসব ফরহাদ শেখর করেছে। এই অবস্থায় ও মানুষের প্রতিশোধ নিতে হয়? এতটা নির্মম কেন মানুষ?

– মা।
– বল।
– তুমি কী করে সহ্য করেছিলে?
– জানি না। দাঁতে দাঁত চেপে। এমনিতে ও আমার চামড়া মোটা।
– কী করে ক্ষমা করলে ওনাকে?
– আমি ক্ষমা করিনি। শুধুমাত্র তোর জন্য একসাথে আছি। আর তোকে ও ক্ষমা করতে হবে না। রাফসান কে ছেড়ে দিবি। তোর চাচা উকিল দেখছে। ডিভোর্স দিয়ে দে।
– এরপর? এরপর কী করে বাঁচব?
– মাথা উঁচু করে। আমি যদি তখন তোর মতো শিক্ষিত হতাম তো তোর বাবা কে ছেড়ে দিতাম। চাকরি করতাম, মা আর ভাই কে নিয়ে নিজের সংসার করতাম। আমি যা যা করতে পারিনি আমি তোকে তার ই শিক্ষা দিয়েছি। আমার বাবা আমাকে পড়ায়নি, স্বাবলম্বী করে নি। আমি করেছি। তুই এগিয়ে যাবি।
– মা, তুমিও বাবাকে ছেড়ে দাও।
– সম্ভব না এখন আর।
– কেন?
– অনেক দেরি হয়ে গেছে।

ধরিত্রী উঠে বসে পড়লো।
– কোনো দেরি হয়নি। এই লোকটা তোমার মতো জীবনসাথী ডিজার্ভ করে না। ওনাকে একা থাকতে দাও। তুমি আর আমি চলো কোথাও চলে যাই। অনেক দূরে কোথাও। সেখানে কেউ জানবে না আমি কে তুমি কে। আমার মনে পড়বে না আমার অস্তিত্ব। আমার রাফসানের দেওয়া ধোঁকা ও মনে পড়বে না। তুমিও সেভাবেই বাঁচবে যেভাবে সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছ। শুধুমাত্র আমরা মা মেয়ে।
– আমরা এই সমাজ থেকে কেন যাব? আমরা দোষ করেছি? আমরা থাকবো। তুই আবার অফিসে যাবি। বন্ধুদের সাথে ঘুরবি, আড্ডা দিবি। কত কিছু করার আছে এই দুনিয়াতে। তবে আমরা ঘুরতে যাব। সিলেটে চা বাগানে?
– না! না! ওখানে ঐ মহিলা আছে।
– আচ্ছা সমুদ্র?
– ওখানে ওনারা থাকতো।
– আচ্ছা, নেপাল যাবো। দেশের বাইরে। হুম? সব ঠান্ডা হোক আগে। দেখবি, একটা সেলিব্রিটি চার নাম্বার বিয়ে করলে টিভি চ্যানেল তখন তাদের পেছনে পড়বে। দুই তিন মাস পর কেউ মনে রাখবে না।

ধরিত্রী ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু মনকে বোঝাতে পারে না। টিভি বা সোস্যাল মিডিয়া তে শুধুই ওকে নিয়ে চর্চা। সবাই হয়তো রাফসানকে গালাগাল করছে, কিন্তু ধরিত্রীর খারাপ লাগছে কারণ এখানে বারবার ওকেও টেনে আনা হচ্ছে। এভাবে এক মাস চলে গেল। পরিস্থিতি ও স্বাভাবিক হয়ে গেল, কিন্তু ধরিত্রী স্বাভাবিক হলো না। ওর এপিলেপসি অ্যাটাকের সাথে বারবার প্যানিক অ্যাটাক ও আসে। মধ্যরাতে ও জোরে জোরে কেঁদে উঠে। কিছুতেই ভুলতে পারে না ও সব কিছু। নিজের সন্তান, জন্মের ইতিহাস বা স্বামীর অবিশ্বাস। সব যেন দুঃস্বপ্ন মনে হয়, কিন্তু সবই সত্যি। কাজের লোকটাও যখন কাজ করতে আসে তখন মনে হয় করুণা করে তাকাচ্ছে ওর দিকে। এরপর সবাইকে ওর কথা বলবে, “আহারে মেয়েটা! পাগল হয়ে গেছে।” পরবর্তীতে যখন বাইরে যাবে, আরো মানুষের সাথে দেখা হবে তখন কী হবে? মাঝে মাঝে মনে হয় উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে সে। প্রবল ঘুমের ঔষধের প্রভাবে কাতর হয়ে থাকে। ডাক্তার বলেছে সে এখনো আত্মহ*ত্যার কথা ভাবে। যখন তখন কিছু একটা করে ফেলতে পারে। জোহরা তাকে খুব চোখে চোখে রাখে। জামান ও খুব খেয়াল রাখে, যদিও ধরিত্রী জামানকে সহ্য করতে পারে না। একদিন দুপুর বেলা জোহরা গোসল করতে গিয়েছিল। জামান বাইরে একটা কাজে ছিল। ধরিত্রী তার মাকে বলেছিল, “আমার একটা বন্ধু এসেছে নিচে। একটু দেখা করতে যাই?” জোহরা সাথেই যেতে চেয়েছিল। তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করে বের হতে হতে দেখল ও নেই। একটা ফোন করতেই ধরে বলল, “আমি আছি। চিন্তা করো না।” জোহরা ভেবেছিল মেয়ে স্বাভাবিক হচ্ছে। কিন্তু সেটাই ছিল শেষ কথা। এরপর আর কোনো কথা হয়নি। থানায় মিসিং রিপোর্ট হয়েছে। সব জায়গায় ওর ছবি দেওয়া আছে।

রাফসান পাগলের মতো বাইরে বাইরে ধরিত্রী কে খুঁজছে আর মানুষের ভৎসর্ণা শুনছে। কোথায় গেল ধরিত্রী? কেন বারবার ওকে ছেড়ে চলে যায় ধরিত্রী? খুবই বাজে স্বামী সে কিন্তু তাই বলে এভাবে চলে যাবে? একদম নিরুদ্দেশ? তার অন্যান্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা ও আছে। তাদের জন্য না হয় থাকতো।

সবাই বিভিন্ন মর্গে ও দেখেছে। অনেক ছোটাছুটি করেছে তারা। রাফসান সারাদিন ধরিত্রীকে খুঁজে আবার ওর মা বাবার গালাগাল শুনেছে। এখন তো সব সহ্য হয়ে গেছে। এত কিছুর পর ও একটাই চাওয়া সে ফিরে আসুক।

ধরিত্রী নিখোঁজের আজ সতের দিন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো লা*শ সনাক্ত করতে যেতে হয়। রাফসান আর পারছে না। আজকে আবার একটা লা*শ দেখতে ডেকেছে। পরনে ওর মতোই হলুদ জামা আছে। অনেক খারাপ কিছু ভাবছে। অনেক খারাপ কিছু ভাবতে ভাবতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার বুকের বাম পাশে অনেক ব্যথা হতে থাকে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না সে। তার বাবা বুঝতে পারল, রাফসানের হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে।

(চলবে)

#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট৩২
#পিকলি_পিকু

মীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে অঙ্কন কে ডিভোর্স দেবে। সে লক্ষ্যেই সে আগে নিজের পায়ের নিচের মাটিকে শক্ত করতে চাইছে। হাসপাতালে চাকরি টা পাকাপোক্ত। মাসুদ আঙ্কেলের সাথে যোগাযোগ করে উকিল ও পেয়ে গেছে। মা কে ব্যাপারটা জানাতে হবে। একা জানানো সম্ভব না। তার আগে রাফসানকে জানানো যেতে পারে।

“তুই হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস কেন? পাগল টাগল হয়ে গেলি নাকি!” রাফসান উত্তেজিত হয়ে গেল। মীরা স্বাভাবিক হয়ে বলল,

– তোর জীবনেও অনেক টেনশন আমি জানি। তাই তোকে বলতে চাইনি। আমি সিদ্ধান্ত টা অনেক ভেবে চিন্তে নিয়েছি।
– কিন্তু কেন?
– অঙ্কন অনেক বদলে গেছে। ওর অনেক নারীর সাথে সম্পর্ক আছে। ও আমাকে মা*রধোর করে।
– কী!

মীরার মুখ থেকে সম্পূর্ণ টা জানার পর রাফসান থ হয়ে গেল। এই ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে এই শয়তান। রাফসান স্বাভাবিক হয়ে বলল,

– তুই আগে বলিসনি কেন?
– তোদের বিরক্ত করতে চাইনি। ধরা কত অসুস্থ।
– এত দিন ওসব সহ্য করে কেন বসে রইলি।
– মেয়েদের জীবনে না বাবা সবচেয়ে বড় ঢাল। যেই মেয়েটার বাবা নেই, সে ই জানে। আজকে বাবা থাকলে আমি সাহস করে বেরিয়ে আসতাম। আমার মা একা, আমি সাহস করতে পারি নি। অনেক কষ্টে সাহস করেছি। রাফসান, তুই আমার মা কে বোঝাতে পারবি?
– অবশ্যই বোঝাব। মাকে ও নিয়ে যাব।

মীরার মাকে বোঝাতে রাফসান রুবাইয়াকেও সব খুলে বলল। রুবাইয়া নিজেও অবাক। অবশেষে রুবাইয়া সহ রাফসান মীরার মাকে তার এই সিদ্ধান্তে রাজি করালো। এখন শুধু বেরিয়ে আসার পালা। যেদিন মীরা বের হবে সেদিন ওর খুব ভয় করছিলো। মীরা মাসুদ আঙ্কেল কে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আঙ্কেলের ঢাকার বাইরে কাজ ছিল। মীরা তার উকিল সহ অঙ্কনের সাথে বসলো। মীরার খুব ভয় করছিল। অঙ্কনের মাথা গরম হলে ও যা কিছু করতে পারে। তাই ও রাফসান কে ও ডেকেছিল। কারণ বেরিয়ে আসার সময় একজন অভিভাবক দরকার হয়।

অঙ্কন সেদিন অঝোরে কেঁদেছিল। মনে হচ্ছিল ও বোধহয় মীরাকে ভালোবাসে। মীরার মনটা গলেই যেত আরেকটু হলে। কিন্তু তার মনে পড়ে যায় আগের সব অত্যাচার, অঙ্কনের বিশ্বাসঘাতকতা। নিজেকে শক্ত করে বেরিয়ে আসে সে। পেছনে ফিরে তাকায়নি। কিন্তু অঙ্কন, এসে সজোরে এসে মীরাকে ধাক্কা মারে। রাফসান মীরাকে বসতে সাহায্য করে। আজ সে নিজের চোখে দেখেছে অঙ্কনের হিংস্রতা। মীরার কপাল ফেটে গেছে। রাফসান পকেট থেকে রুমাল বের করে মীরার রক্ত মুছতে থাকে। এই দৃশ্য দেখে অঙ্কন আর হিংস্র হয়ে যায়। সে আবার ছুটে আসতেই রাফসান তার গলা চেপে ধরে, “সমস্যা কী আপনার! ও থাকতে চায় না বলল না।”

অঙ্কন রাফসানকে ছাড়িয়ে বলল, “তুই আমার বউয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করিস? এর জন্যই ছাড়ছিস না আমায়? এত নষ্টা তুই! আবার একে নিয়েও এসেছিস! এর হাত ধরে চলে যাবি?”

মীরা ওর কপালে হাত দিয়ে বলল, “আমি কারো জন্য তোমাকে ছাড়ছি না অঙ্কন। তোমার জন্যই ছাড়ছি। তোমার বিশ্বাসঘাতকতা উগ্র আচরণই এর কারণ। তুমি নোংরা, তাই নোংরা ভাবতে পারো আমায় কিন্তু আমি নোংরা না। আই হে*ইট ইউ অঙ্কন! তুমি আমায় কখনো ভালোবাস নি, সম্মান ও করোনি।”

রাফসান আর উকিল সাহেব মীরাকে নিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়লো। অঙ্কন দাঁড়িয়ে দেখে ওর স্ত্রী চিরতরে চলে গেছে। মীরা ওকে ছাড়তে পারে ও তা কখনো ভাবেনি। সেদিন সারারাত মদ্যপান করে সে। প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। মীরার স্পর্ধা কী করে হয় ওকে ডিভোর্স দেওয়ার। ওদের পরিবারে মেয়েরা ছিল জুতোর তলায়, আর ও মীরাকে রেখেছিল মাথার তাজ বানিয়ে। তাই এই পরিণতি ওর। অনেক মেয়ে আসবে যাবে, কিন্তু কোনো মেয়ে ওকে না বলতে পারে নি। মীরার মতো মেয়ে ওকে ছেড়ে গেছে ঐ দুই টাকার ছেলের জন্য। ওদের দুজনকে চরম শিক্ষা দেবে সে। রাফসান ওর সংসার ভেঙেছে, ও রাফসানের সংসার ভাঙবে। বাইরে অন্যের বউ, ঘরে নিজের বউ। সব ওর কেন হবে?

রাফসান আর মীরার উপর খুব নজর রাখছে সে। বিশেষ করে মীরার বাসায়। মীরা বুঝতে পেরে বাসা বদলে নিয়েছে। বাসা বদলানোর সময় কারো সাহায্য দরকার। তাই রাফসানকেই ডেকেছে। রাফসান মানা করতে পারেনি কারণ মীরাদের বাসায় কোনো পুরুষ নেই। শুধু মীরা মা, মীরা আর একটা কাজের লোক। তাই বন্ধু হিসেবে সে এসব নিজের দায়িত্ব মনে করে। রাফসান সেই বাসায় বারবার যাতায়াত করে তা অঙ্কনের সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু ওর বউ কোথায়?

অঙ্কন খোঁজ নিয়ে জানলো ধরিত্রীর অবস্থা। বাচ্চা হারিয়ে সে কাতর। তবে ভালোই হবে। ওর মনে এখন সন্দেহের বীজ ঢোকাতে পারলে ধরিত্রী ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। এভাবেই লোক দিয়ে সে ধরিত্রীকে মেসেজ করতে থাকে অঙ্কন। নিজেই মীরাকে দেখা করার জন্য বাইরে ডাকে। মীরা একা আসতে রাজি হয়নি। অঙ্কন নিজেই রাফসানকে নিয়ে আসতে বলে। ওর লোকেরাই সেদিন ছবি তুলছিল। ধরার ফোনটা রাফসান তুলতে যাওয়ার আগেই অঙ্কন বলল,

– এখানে এসেছ ওকে বলার দরকার নেই। ওর তো আবার সমস্যা চলছে।
– হুম। আপনি তাড়াতাড়ি কথা শেষ করুন।
– তুমি আগে শেষ করো।

রাফসান রাখতেই মীরার ফোনে কল আসে। একই কথাই বলে ওরা। অঙ্কন সেদিন ডিভোর্সের পরের খরচার কথা বলে। মীরা এসব নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বেরিয়ে আসে। অঙ্কন হাসতে থাকে।

“আমাকে ছোট করলে না মীরা। আমার ভালোবাসা দেখেছ তুমি এতদিন। আমার প্রেম আমার পাগলামি দেখেছ। আমার ঘৃণা দেখনি। মাথার তাজ ছিলে, এখন পায়ের জুতো হবে তুমি।”

সেই রাতের বেলা রাফসান আর মীরা হাসপাতাল থেকে বের হচ্ছিল। রাফসানের গাড়ি টা বাসায় আছে। রাতে ও উবারেই আসে। সেই রাত উবার ডাকার আগেই ট্যাক্সি এসেছিল। সময় কম লাগবে বিধায় ওরা উঠে পড়ল।

– ধরার কী অবস্থা?
– ঐ একই। জানিস, আমার কী মনে ওর শুধু এই সমস্যা না। আরো সমস্যা আছে। দুশ্চিন্তা করে করে ও শুধু আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
– কেমন দুশ্চিন্তা?
– ওর মায়ের সাথে কিছু হয়েছে।
– মানে?
– মা ওকে ঈদেও দেখতে আসেনি, আর ও নিজেও যায়নি। আগে ওর হালকা জ্বর হলেও চলে আসতো। এখন ওর অ্যাটাকের পর অ্যাটাক আসে তবুও উনি আসেন না।
– এখন?
– কাল যাব। গিয়ে জিজ্ঞেস করব। ওকে ভালো করতে ওর মায়ের দরকার আছে।
– হুম।
কথা বলতে বলতে রাফসান খেয়াল করল গাড়ি অন্যদিকে যাচ্ছে।

“ড্রাইভার সাহেব, আপনি ভুল দিকে যাচ্ছেন। রাস্তা ঐ দিকে।”

বলতেই ড্রাইভার সজোরে ব্রেক নিয়ে ওদের কিছু একটা স্প্রে করল। এরপর ওদের আর কিছুই মনে নেই। পরক্ষণেই ওদের গাড়িতে আরো কিছু লোক উঠলো। তারা দুজনকে গভীর ঘুমে রাখতে আরো কিছু জিনিস ইঞ্জেক্ট করলো। তারপর ওদের হোটেল ব্লু মুনে নেওয়া হলো। অঙ্কনের মামার নানা ফাইভ স্টার থ্রি স্টার হোটেল থাকলেও কিছু সাধারণ আবাসিক হোটেল ও আছে। সেগুলোর মধ্যেই একটা ব্লু মুন। মীরা আর রাফসান কে সেই কক্ষে নেওয়া হলো। সেখানে একটা নাটক সাজানো হলো, যার পরিচালনা অঙ্কন নিজে করেছে। সেখানে ঘুমন্ত মীরা কে ছুঁয়ে বলল, “হীরের মতো ভালোবাসা কে তুচ্ছ জ্ঞান করলে একই দামের ঘৃণাই পাবে প্রিয়তমা।” রাফসানের দিকে প্রচন্ড ঘৃণাভরে তাকিয়ে বলে, “বউ চলে গেলে কেমন লাগে তা কাল থেকে তুই ও বুঝবি।”

এরপর অঙ্কন বেরিয়ে আসে। তারপর ধরা আসে। সেখান থেকে অঙ্কন আগেই কিছু ছবি তুলেছিল। রাফসান আর মীরা যাতে আর কখনো কাউকে মুখ দেখাতে না পারে তাই সে সেই ছবি গুলো সেই সাংবাদিক কে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সে জানতো না ধরিত্রী এমন একটা পদক্ষেপ নিবে। হঠাৎ অঙ্কনের ধরিত্রীর জন্য মায়া হলো। ততক্ষণে গুলি বন্দুক থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু অঙ্কন অনেক খুশি। রাফসানের শিক্ষা হয়ে গেছে। মনের সুখে অঙ্কন হাসছে।

রাফসান এই মুহুর্তে হাসপাতালে। চার দিন আগে ওর একটা মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। অনেক চাপে ছিল সে। তার ই প্রতিফলন। রুবাইয়া হাসপাতালের করিডরে বসে কাঁদছে। রাফসান একটু স্বাভাবিক হতেই রুবাইয়া ভেতরে গেল। ভেতরে মা কে দেখেই সে কী যেন বলতে চাইল। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। জড়তা নিয়ে তাও বলল,

– ধরাকে পেয়েছ?

রুবাইয়া আফসারের দিকে তাকালো। সে সম্মতি সূচক মাথা নাড়লো। এরপর রুবাইয়া বলল,

– না। খোঁজা হচ্ছে।
– ঐ লাশ?
– অন্য কারো। ধরিত্রীর মা শনাক্ত করে বলেছে এটা ও নয়। জোহরার থেকে ভালো তো আর কেউ চেনে না।

রাফসান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

– আমি নির্দোষ মা।
– হ্যাঁ। চুপ কর। বিশ্রাম নে। কথা বলিস না একদম।

রাফসান কাঁদতে থাকে। আফসার ওকে উত্তেজিত হতে বারণ করলো। এরপর রুবাইয়া বের হয়ে এলো। বাইরে এসে রুবাইয়া কাঁদতে লাগলো। সে পদে পদে ভুল করছে। একদিকে ধরিত্রী কে পাওয়া যাচ্ছে না আরেক দিকে রাফসান। নিজের শিক্ষার উপর তার একবার হলেও বিশ্বাস করা উচিত ছিল। কিন্তু ধরিত্রী যে ছবি গুলো তুলেছিল? সেগুলো কোত্থেকে এসেছিল? ঐ মীরা মেয়েটা কোথায়? খটকা তো আছেই। রুবাইয়া অঙ্কনের ঠিকানা জোগাড় করে তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল। অঙ্কন খুব ভালো করেই জানে ইনি কে।

– কেমন আছেন?
– তুমি এমনটা কেন করলে?
– কী করেছি? উল্টো আমার আপনার ছেলেকে বলা উচিত সে কেন করল? আমার ঘর ভাঙতে তাকে কে বলেছিল?
– তুমি জানো ও এখন হাসপাতালে!
– ও! তাই!
– তোমার মতো বেয়াদব ছেলে আমি একটাও দেখিনি। নিজের স্ত্রীর গায়ে হাত তুলো তুমি, আর ঘর ভাঙার দায় অন্যের?
– অন্যের স্ত্রীর দিকে আপনার ছেলে নজর দেয় কেন?
– সে কখনোই মীরার দিকে নজর দেয়নি। সে সবসময় তার নিজের স্ত্রীকে ভালোবেসেছে। সম্মান করেছে। তোমাকে আল্লাহ্ কখনো ক্ষমা করবে না। যেই স্ত্রীর জন্য এই কাজ করেছ তাকে কখনো পাবে না। মনে রাখবে যে পুরুষ একবার নারীর সত্যিকারের ভালোবাসা কে অবমূল্যায়ন করে, অন্য নারীর পেছনে ছুটে, সে কখনো আর সেই নারীর ভালোবাসা পায় না। সেই নারী কি, অন্য কোনো নারীই তোমাকে আর ভালোবাসবে না। এর কারণ টা তুমি নিজে। আমার ঘরের সুখ শান্তি নষ্ট করেছ, ঐ নিষ্পাপ মেয়েটার ঘর ভেঙেছ, তার শাস্তি পাবে।

অঙ্কন নীচের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ সব শুনছিল। রুবাইয়া চলে আসার আগে সে তাকে ডাক দেয়, “আন্টি!!” রুবাইয়া থেমে যায়।

“আপনার ছেলেকেও বলে দেবেন সে ও কখনো তার স্ত্রী কে আর পাবে না। সারা জীবন আমি হাহাকার করবো, আর সেও হাহাকার করবে। কারণ ওর আমাদের মধ্যে আসা উচিত হয়নি।”

রুবাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

– মীরা কোথায়?
– আমি কী করে বলব? আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন, কোথায় রেখেছে তার বান্ধবী কে?
– রাফসান ও খুঁজছিল ওকে। আচ্ছা তোমার চিন্তা হচ্ছে না ও কোথায়?
– না! কারণ আমি ওকে আর ভালোবাসি না। ঘৃণা করি। আই হে*ইট আনফেইথফুল ওমেন।
– আনফেইথফুল ওমেন! কে আনফেইথফুল?
– যেই হোক। আই ডোন্ট কেয়ার আবাউট হার অর এনিওয়ান। আপনার ছেলে যা পাচ্ছে সব তার কর্মফল।
– কে কার কর্মফল পাবে তা সময়ই বলে দেবে।

রুবাইয়া সেখান থেকে চলে আসে। সারাক্ষণ অঙ্কনের কথাগুলোই ভাবতে থাকে। সে কী বলতে চাইছিল। রাফসান কেন পাবে না ধরিত্রী কে? অঙ্কন কী ধরিত্রীর সাথে কিছু করেছে?

দুইমাস পার হয়ে গেল ধরিত্রী নিখোঁজের,

পুলিশ ও ধরিত্রী কে খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছে। তারা ভাবছে সে স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ হয়েছে। কিন্তু মীরাও নিখোঁজ। রাফসান বেড রেস্টে থাকলেও খুব দুশ্চিন্তায় কাটে তার। তার বাবা চিন্তায় আছে, আবার যদি আরেকটা অ্যাটাক আসে তো খারাপ হতে পারে। তারা একমাত্র সন্তানকে তারা হারাতে পারবে না।

রুবাইয়া জোহরার বাসায় গেল। রুবাইয়া কে দরজায় দেখে অবাক হলো জোহরা। অভদ্রতা না করে তাকে ঢুকতে দিল। বসার ঘরে তার দুজনে বসেছে। সেখানে ধরিত্রীর আঁকা সেই ছবি তিনটি। রুবাইয়া তাকিয়ে দেখছে,

– এখন সময় কীভাবে কাটে জোহরা?
– আমার আর সময়। অনেক কম সময় আমার হাতে। আমি বড় খতম ধরেছি, দোয়া ইউনুস এক লক্ষ পঁচিশ হাজার। তুনাজ্জিনা পড়ছি আর সাথে কোরআন খতম করছি। রাতে তাহাজ্জুদ পড়ি আর দিনে এসব।
– শরীরের যত্ন নাও।
– আমার মেয়েটা না জানি কেমন আছে?

জোহরা কাঁদতে থাকে। রুবাইয়া ওকে সান্ত্বনা দেয়,

– যার মা সারাদিন এত দোয়া দরূদ পড়ে তার সুরক্ষার জন্য, তার কী কিছু হতে পারে?

জোহরা অশ্রুচোখে রুবাইয়া দিকে তাকায়। সে বলতে চায় তাকে সব। ধরিত্রী কেন এত মনমরা থাকতো। অতঃপর জোহরা রুবাইয়া কে সব বলে দেয়। রুবাইয়া বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে।

– এত কিছু হলো আর তোমরা আমাকে কিছু জানাওনি?
– আমি আজ ও এসব মানতে পারি না। আমি কাউকে বলতে পারি না আমার সাথে কী হয়েছে। তবে ও যখন তোমার বাড়ি গেল তখন বলা উচিত ছিল। কিন্তু আমি একটু স্বার্থপর ছিলাম। ভেবেছি সবাই ছি ছি করবে। ওর শ্বশুরবাড়ি তে ওর মান সম্মান। মেয়েটা যে এমন হয়ে বসবে ভাবিনি। ভেবেছি এই সূত্রে রাফসান আর ও কাছাকাছি আসবে। কিন্তু রাফসান,
– ও করেনি এসব।
– ঐদিন না তুমি বললে আর আজই।
– আমার ছেলে আমাকে মৃ*ত্যু শয্যায় মিথ্যে বলবে না। এসবই ষড়যন্ত্র। মীরা নামের মেয়েটার,

জোহরা সব শুনলো,

– তাতে আমার মেয়ের কী দোষ ছিল?
– কারোরই দোষ না। একজনের দোষ, আর সে তা ঢাকতে চায়।
– আমি কোথায় খুঁজে পাব? আমার বাচ্চাটা! আমাদের জীবনটা তো শেষ হয়ে গেল না?

জোহরা আবার কাঁদতে থাকে। রুবাইয়া তাকে সান্ত্বনা দেয়। রাফসান বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করে ধরিত্রীর খোঁজের। আর অঙ্কন নিজের বিজয়ের উল্লাস করে, প্রতি মুহূর্তে…

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here