ধরিত্রী_কথন #পার্ট৩৫ (অন্তিম পর্ব)

0
1505

#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট৩৫ (অন্তিম পর্ব)
#পিকলি_পিকু

মীরা হুইলচেয়ারে বসে আছে। পাশে তার কেয়ারটেকার। মেয়েটি তার পাশে মাটিতে বসে বলল,

– আপনি কেন এখানে এসেছেন?
– যারা কোনো দোষ করেনি তারা ভুক্তভোগী ছিল। তাদের বাঁচাতে এসেছি।
– তাই বলে বাঘের মুখে? এরচেয়ে ভালো আপনি ডিভোর্স ই নিতেন না। আপনি এই বাঘকে খোঁচালেন কেন?
– বাঁচতে চাওয়াটা কী পাপ? আমি তো শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম।
– সেই তো মরতে হচ্ছে। আপনার জন্য আমি ও বের হতে পারছি না। কোন অলক্ষুনে দিনে যে এখানে চাকরি নিতে এসেছিলাম। আমি এই চাকরি ছাড়তেও পারব না। না পড়েই কাগজে সই দিয়েছি। এত জরিমানা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না।
– আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।

তখনই বেল বেজে উঠলো। মেয়েটি ভয়ে ভয়ে বলল,

– এ মা! স্যার আবার এখানে মাইক লাগায়নি তো? কথা শুনে ফেলেছেন? আমাকেও কী এভাবে মারবেন?
– জানি না। ওর পক্ষে সবই সম্ভব।

মেয়েটি ভয়ে ভয়ে বের হয়ে দেখলো। একটি মেয়ে এসেছে। মেয়েটার চুল কাঁধ সমান। জামাটাও হালকা রঙের। অনুমতি নেই বলে মেয়েটি ঘর থেকে বের হতে পারছেনা। ভেতরে এসে সে মীরাকে বলল,

– স্যার না, অন্য একটা মেয়ে এসেছে।
– কী করে দেখেছ?
– এখান থেকে সিঁড়ির ফাঁক দিয়ে দেখা যায়।
– আমাকে একটু দেখাবে?
– স্যার যদি টের পায়?
– পাবে না। বললে বলব এমনি গাড়ি ঘোরাচ্ছ। আমার জায়গা পরিবর্তন করতে ইচ্ছে হচ্ছিল।

মেয়েটি হুইলচেয়ার ঠেলে ঠেলে সেই জায়গায় নিয়ে গেলে। সিঁড়ির ফাঁকে একটা মেয়ে তো দেখা যাচ্ছে কিন্তু তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মীরা তাই মেয়েটিকে বলল,

– আমাকে একটু ওপরে ওঠাবে? একটু দাঁড়াবো।
– স্যার দেখলে?
– দেখবে না। একটু মেয়েটাকে দেখেই বসে পড়ব।

মীরা মেয়েটির সাহায্যে উঠে দাঁড়ালো। খুব কষ্টে সে মেয়েটি মাথা তো দেখল, কিন্তু সে অন্য দিকে ফিরে আছে। মীরা আর দাঁড়াতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে। তবুও সে মেয়েটির চেহারা দেখতে চায়। তার কেমন যেন লাগছে। মেয়েটা একটু অন্য দিকে ফিরতেই মীরা বুঝতে পারল, এই মেয়ে আর কেউ নয়, ধরা। মীরা আবার চেয়ারে বসে পড়ল। চেয়ারে বসেই সে কাঁদতে লাগলো। তার কেয়ারটেকার তাকে প্রশ্ন করল,

– কী হয়েছে ম্যাডাম?
– ঐ মেয়েটাকে এখানে নিয়ে আসো না প্লিজ!
– পাগল হয়েছেন?
– প্লিজ! ওর সাথে কথা বলব। ওকে আমার স্যরি বলতে হবে।
– অসম্ভব! আপনি ও ম*রবেন, আর আমিও ম*রবো!
– ও সেই নির্দোষ মেয়েটা, যে আমার জন্য ভুক্তভোগী।
– সে এখানে কী করছে? অঙ্কন স্যার তো ওনার ও ক্ষতি করতে পারে।
– তাই তো!

মীরা ভেবে পাচ্ছে না। ধরা অঙ্কনের বাড়িতে কেন আসলো? ওর তো ক্ষতি হতে পারে। মীরা তার বেড সাইড ড্রয়ার এর দিকে তাকালো। তারপর তার কেয়ারটেকার কে বলল,

– আমাকে ওখানে নিয়ে যাও।
– কেন ম্যাডাম?
– একটু নিয়ে যাও।

মীরা সেখানে যাওয়ার পর একটি কাগজ আর কলম বের করে সেখানে লিখল, “এখান থেকে চলে যাও। বিপদ আছে।” এরপর সে সেই কাগজ টা মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল,

– এই কাগজ টা বাইরে ঢিল মারতে পারবে?
– পাগল হয়েছেন?
– বেশি কিছু না, একটু ছুঁড়ে মারো। ও চলে যাক।
– কিন্তু ধরুন মেয়েটি কাগজ পেল না, স্যার পেল।
– হাতের লেখা টা আমার, হয়তো আমার একটা হাত ভাঙবে। চিন্তা করো না।

মেয়েটি সেই কাগজ টা ভয়ে ভয়ে ছুঁড়ে মারলো। কিন্তু কাগজ টি কী ধরিত্রী দেখবে? ভয়ে সবার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। নীচে আরেক কাজের লোক কাগজ টি দেখে ফেলল। সে সেই কাগজটি হাতে নিয়ে চা দেওয়ার বাহানায় ধরিত্রী কে দিল। ধরিত্রী সব স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও কিছু আঁচ করতে পেরে খুলে দেখল। লেখা টা ওর চেনা। এই লেখা দেখে ওর মনে পড়ে মেডিকেল কোচিং এর সেই ক্লাস। হোয়াইট বোর্ডে মার্কার দিয়ে লেখা সেই নাম, মারজান মোস্তাফা। মাঝে মাঝে মীরা উপহারের সাথে ধরাকে কিছু চিরকুট ও দিত। এই লেখা মীরার। বিপদের কথা পড়েই ধরিত্রী কাগজ টা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে। তারমানে মীরা এখানে কোথাও আছে। ধরিত্রী নীচে থাকা কাজের লোকটির দিকে তাকায়। তারা একে অপরের চোখে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকার পর সে চোখের মণি উপরে উঠিয়ে ইশারা করলো। ধরিত্রী বুঝে ফেলল মীরা কোথায়। সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসতে লাগলো। মীরার কেয়ারটেকার ভয়ে মীরাকে বলল, “আজ আমরা শেষ। উনি উপরেই আসছেন।”

ধরিত্রী প্রতিটা ঘরেই উঁকি মেরে মেরে দেখছে। কোথাও মীরা নেই। অতঃপর একটা কোণায় সে দেখতে পেলে একটা দরজা মুখে মুখে লাগানো। ধরিত্রী কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই সেই ঘরে ঢুকে পড়লো।

ঢুকতেই সে দেখল মীরা হুইলচেয়ারে বসে তার দিকে তাকিয়ে। তার এই করুণ অবস্থা দেখে ধরিত্রী আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো। এরপর তার সামনে এসে বসে বলল, “কেমন আছো?”

এদিকে ধরিত্রী এসেছে এই খবর অঙ্কন পেয়েছে। কিন্তু সোজা বাসাতেই কেন? ওর কাজের লোকেরা ওকে ঢুকিয়ে ফেলল কেন? সব দোষ ওর। কেন যে ধরিত্রীর মা কে ওর ঠিকানা দিল। অবশেষে নিজের বাড়ি পৌঁছে সোজা লিভিং রুমে গেল। কিন্তু ধরিত্রী কে দেখতে পেল না। “এই, ঐ ম্যাডাম কই?” কাজের লোককে এই প্রশ্ন করল অঙ্কন। কাজের লোক ভয়ে ভয়ে আঙুল উপরের দিকে করল। অঙ্কন তার মাথায় হাত দিয়ে বলল, ” ড্যাম ইট!!” সে সাথে সাথে উপরে চলে গেল। আজ যদি মীরা ধরিত্রী কে সব বলে দেয় তো সে ধরিত্রীকে ও এখানে আটকে রাখবে। সে এত সহজে হারবে না।

রুমের ভেতরে ঢুকেই দেখল ধরিত্রী নীচে বসে আছে আর মীরা হুইলচেয়ারে। মীরার চেহারায় এক অজানা ভয়। ধরিত্রী অঙ্কনের চোখে চোখ রেখেছে। ওর চোখে ভয় নেই। আছে প্রতিহিংসা। অঙ্কন কিছু বলতে যাবে তখনই ধরিত্রী বলল, “ও! তো তুমিই ওকে এখানে রেখেছ।” অঙ্কন কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। সে ভাবছে আর কী কী বলেছে মীরা ওকে? সবটা?

“বেশ করেছ! ওর এই অবস্থা নিশ্চয় তুমিই করেছ?” ধরিত্রীর মুখে এই কথা শুনে অঙ্কন হকচকিয়ে গেল। “বেশ” বলতে ও কী বুঝাচ্ছে?

– দেখো ধরিত্রী, আমি ওকে আটকে রাখিনি।
– বন্দি করে রেখেছ?
– ও স্বেচ্ছায় আছে। আমার কাছে কাগজ আছে। দেখতে চাও?
– না থাক। তবে তোমার মতোন পুরুষ থেকে এটা আশা করিনি। তোমার উচিত ছিল ওকে ক্ষমা না করা। ওকে শাস্তি দেওয়া। ওকে বন্ধ করে অত্যাচার করা।
– কী?
– আমি চাই ওর শাস্তি হোক। ওর এই পা কী তুমি ভেঙেছ?
– ইচ্ছে করে না। মাতাল ছিলাম তো একসময় ভেঙে গেছে।
– বেশ! ওর মতো মেয়ে এটাই ডিজার্ভ করে।
– তুমি এখন কোথায় যাবে ধরিত্রী?
– আমি আমার বাসায় যাব। সেখান থেকে পুলিশ স্টেশনে।
– মানে?
– আমি যে মিসিং না তা জানাতে। আমি এরপর আবার পাহাড়ে চলে যাব। আর তুমি চিন্তা করো না। আমি ওর কথা কাউকে বলবনা। ইশ ! আমিও যদি রাফসান কে এভাবে শাস্তি দিতে পারতাম।

অঙ্কনের ধরিত্রীর এই ব্যবহার বিশ্বাস হচ্ছে না। ও কী করে এসব বলছে। পাগল টাগল হয়ে যায়নি তো?

– দেখো ধরিত্রী, আমি কিন্তু ওকে অন্য কাজে এনেছি।
– কী কাজ?
– উত্তরাধিকারের জন্য। আমার একটা বেবি চাই।
– সেটা তো সারোগেসি,
– ওসব নষ্টা মেয়েরা করে।
– কিন্তু সারোগেসিতে তো সারোগেট মায়ের শুধু গর্ভ টাই দরকার।
– তবুও, কাজী বংশের উত্তরাধিকারী কোনো নষ্টা মেয়ের গর্ভে থাকবে না।

ধরিত্রী অঙ্কনের কথা শুনে মুচকি হাসলো, “অঙ্কন, মীরা ও তো নষ্টা। ও আমার স্বামীর সাথে শুয়েছে। এরপর ও?”

অঙ্কন রাগ হয়ে ধরিত্রীর দিকে তাকালো। ধরিত্রী আবার বলল,

– তুমি স্বীকার করো মীরা সতী?
– দেখ ধরা,
– না না! এই নামে আমাকে আর কেউ ডাকে না। আর মীরার ব্যাপারটা আমিও দেখেছি তুমিও দেখেছ। কাজী বংশের উত্তরাধিকারী এমন একটা মেয়ে জন্ম দেবে। থাক, আমার কী। তোমার প্রতারক স্ত্রী। তুমি একটু বেশিই ভালোবাসো।

ধরিত্রী হেঁটে বেরিয়ে গেল। অঙ্কন ওর পেছনে যেতে যেতে বলল,

– দাঁড়াও! দাঁড়াও!
– কী, বলো।
– তোমাকে পৌঁছে দেব?
– না থাক। পাহাড় বাইতে পারি আর ঢাকার রাস্তা। তুমি বাড়ি যাও।

ধরিত্রী চলে গেল। অঙ্কন তার ফোন নিয়ে কাউকে ধরিত্রীর উপর নজর রাখতে বলল। এদিকে মীরা ওর ঘরে। ওর কেয়ারটেকার বলল,

– মেয়েটা তো দেখছি খুব খারাপ। এখন তো স্যার আমাদের জানে মে*রে ফেলবে।
– কিছু করবে না। শুধুই অপেক্ষা করো।

অঙ্কন আসতেই কেয়ারটেকার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অঙ্কন এসে মীরার সামনে বসলো,

– কী কী বলেছে?
– ক্ষমা চেয়েছি।
– আর?
– আমাকে ক্ষমা করতে বলেছি।
– কী জন্যে?
– ওর সংসার ভাঙার জন্য। জানো না আমি চরিত্রহীনা। আমি ওর স্বামীর সাথে অবৈধ সম্পর্কে ছিলাম। একসাথে এক বিছানায় রাত কাটিয়েছি।

অঙ্কন সাথে সাথে মীরার চুল চেপে ধরে বলে,

– চুপ কর! আমি খুব ভালো করেই জানি তুই চরিত্রহীনা না। তাই তোকে বিয়ে করেছি। তোর থেকে সন্তান চাইছি। কাজী বংশের উত্তরাধিকারী কোনো রাস্তার মেয়ের গর্ভে থাকবে না। তোর গর্ভে থাকবে।
– তো আমাকে মুক্ত করে দাও। একটা সন্তান দিয়ে মুক্ত করে দাও।
– এই তো ! এই ভাবে আমি তোর কাছে সন্তান চাইতাম। এখন তুই চাইছিস। আরো কিছুদিন অপেক্ষা কর চেঁচা। তারপর তোকে মা ডাক শোনাবো।

অঙ্কন মুচকি হাসতে থাকে। মীরার চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। এদিকে ধরিত্রীর উপর নজর রাখা হচ্ছে। সে তার বাসায় গিয়েছে। সেখান থেকে পুলিশ স্টেশনে, তারপর আবার বাসা। সর্বশেষ বাসে উঠে আবার বানদরবানে। অঙ্কন ধরিত্রীর এই প্রতিক্রিয়া মেনে নিতে পারছে না। এত স্বাভাবিক! তবে কী ধরিত্রী ও নিষ্ঠুর হয়ে গেছে? এভাবে অনেকদিন চলে গেল। মীরার কেয়ারটেকার সব আশা হারিয়ে বসে রইলো। “ম্যাডাম, আমার মনে হয় আমরা আর এখান থেকে বের হতে পারব না। ঐ মেয়েটা আমাদের ধোঁকা দিয়েছে।”

মীরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। অতঃপর একদিন অঙ্কনের পি এ তার কেবিনে দৌঁড়ে আসে,

– স্যার, আমার মনে হয় আপনার এখন বিদেশে পালানো উচিত।
– কেন? কী হয়েছে, আর কেন পালাবো?
– আপনার খুব বিপদ। ঐ মেয়েটা, ধরিত্রী আপনাকে টিভিতে এক্সপোজ করে দিয়েছে।
– কী!

অঙ্কন সাথে সাথে টিভি খুলল। টিভি একটি সিসিটিভি ফুটেজ। অঙ্কন যেদিন হোটেলে গিয়েছিল সেদিনের। কীভাবে রাফসান আর মীরাকে নেওয়া হচ্ছে আর তারপর অঙ্কন বেরিয়ে আসলো। এরপর ফরহাদ শেখর বলছেন, “আসলে ধরিত্রী কে আমি অনেক স্নেহ করি। তার স্বামীর এই কর্মকাণ্ড আমি পুরো দেশ কে দেখাতে চেয়েছিলাম। তাই অঙ্কন সাহেব আমাকে এই ছবি গুলো দিতেই নিয়ে নিলাম।” অঙ্কন হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই ফরহাদ সাহেব ও বেইমানি করলো। কাউকে ছাড়বে না ও। একটু পর মাসুদ আঙ্কেল কে দেখানো হলো,
“অঙ্কন আমার সন্তানের মতো ছিল। আর মীরা ও। আমি জানতাম অঙ্কনের চরিত্র কেমন। ও নিজেকে বদলে ফেলেছে বলার পর ও ঠিক বদলাতে পারেনি। আমিই মীরাকে সাহায্য করেছি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু অঙ্কন ওকে এত সহজে ছেড়ে দেয় নি। আমি ওর এইসব প্ল্যান সম্পর্কে বুঝতে পেরেছিলাম। তাই আগে আগেই ওর মামার সেই হোটেলে গিয়ে আমার পরিচিত লোক থেকে ফুটেজ নিয়ে রাখি মীরাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। কারণ আমি জানতাম ওরা সেই ফুটেজ ডিলিট করে দেবে। কিন্তু মীরা আর আমার সাথে দেখা করতে আসেনি। অনেক খুঁজছিলাম ওকে। অঙ্কনের বাসাতেই খুঁজিনি। মাথায় ও আসেনি ও যে সেখানে থাকতে পারে। আমি ওর সব ফার্ম হাউসে খুঁজেছি, পাইনি। এরপর ধরিত্রী এলো, সাহায্য চাইতে। আমি একা এই ফুটেজ দিয়ে কিছুই করতে পারতাম না। সবটা ধরিত্রী করেছে। আমরা অঙ্কনের শাস্তি চাই। ওর এখনই শাস্তি না হলে ও দুনিয়া ধ্বংস করে ফেলবে।”

অঙ্কন বুঝতে পারছে না মাসুদ আঙ্কেল ও মুখ ফিরিয়ে নিলো। এত কিছুর পর ও অঙ্কন বলল, ” এয়ারপোর্টে না, আমি আগে বাসায় যাব। যত বিপদই হোক, সব কিনে নেব।”

বাড়ি গিয়ে দেখল পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সমস্ত কিছু জব্দ করেছে। একটু পর হয়তো তাকেও গ্রেপ্তার করবে। কিন্তু অঙ্কনের চোখ এখনো মীরাকে খুঁজছে। মীরা ওকে ছেড়ে যাবে না। ওর এত সাহস কী করে! একটু পর সে যখন মীরাকে খুঁজে পেল তখন সে তেড়ে গেল মীরার কাছে। মীরা হুইলচেয়ারে বসে মাথা উঁচু করে আছে। অঙ্কন তার সামনে দাঁড়িয়ে তবে মাথা নিচু করে। মীরার চোখে আজ ভয় নেই। আজ অনেক লোক আছে এখানে। অঙ্কনের চোখে আছে ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ নিয়েই সে মীরাকে প্রশ্ন করলো, “চলে যাবি আমাকে ছেড়ে?”

মীরা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জবাব দিল, “হ্যাঁ।”

রাগে ঘৃণায় অঙ্কন মীরার দিকে হাত বাড়িয়ে তার চুল ধরতে গেলেই কারো হাত তাকে আটকে দেয়। অঙ্কন সেদিকে লক্ষ্য করে, এই হাত এক নারীর হাত। এই হাত ধরিত্রীর হাত। ধরিত্রী অঙ্কনের হাতকে একটি ঝাঁকুনি দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। অঙ্কন ক্ষান্ত গলায় বলে,
– হাও ডেয়ার ইউ!
– হাও ডেয়ার ইউ অঙ্কন! এত গুলো মানুষ এখানে চোখে পড়ছে না? যাই হোক, তুমি আজ জেলে যাবে। শুধু আজকেই না, সারাজীবন জেলে থাকবে।
– অসম্ভব! কাজী গ্রুপের পাওয়ার তুমি জানো না
– আর সত্যের শক্তি তুমি জানো না। তোমার বিরুদ্ধে আমার আরো প্রমাণ আছে।
– এসব প্রমাণে কিছুই হবে না।
– এত বড়াই তোমার কাজী গ্রুপের। এই কাজী গ্রুপই যদি না থাকে।

ধরিত্রী মীরার হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু অঙ্কন তা হাত দিয়ে আটকে দিল।

– ওকে যে নিয়ে যাচ্ছ, ও আমার কাছে ডিল করেছে।
– কীসের ডিল?
– বেবির ডিল।
– দেখাও।

অঙ্কন সেই কাগজ আনতে উপরে গেল। মীরা আবার ভয় পেয়ে গেল। মীরাকে এভাবে দেখে ধরিত্রী তাকে প্রশ্ন করল,

– এমন কেন করছ?
– ধরা, আমি তো সাইন করেছি।
– তো?
– সেই কাগজ ধরে যদি আমায় রেখে দেয়।
– অপেক্ষা করো।

অঙ্কন কাগজ এনে দেখালো। সেখানে থাকা ম্যাজিসেট্রট পুলিশ অফিসার সেই কাগজ দেখল। অতঃপর ধরিত্রী প্রশ্ন করল, “বাংলাদেশের আইনে এইরকম কোনো চুক্তি কতটা যৌক্তিক? এই ধরণের কোনো চুক্তি কী আসলেই গ্রহণযোগ্য? এটা কী বাচ্চা কেনা বেঁচা না?”

অঙ্কন ঘাবড়ে গেল। ম্যাজিসেট্রট বললেন, “মনে হচ্ছে ভিকটিম কে জোর করে এই চুক্তি তে স্বাক্ষর করানো হয়েছে। এ ধরণের আজগুবি চুক্তি বেআইনি।”

অঙ্কন ক্রোধে বলল, ” আমি মানি না। আমি মীরাকে জোর করিনি। ও নিজে সাইন করেছে।” পুলিশ অফিসার তার হাতকড়া বের করে অঙ্কনের হাতের কাছে এনে বললেন, “মিস্টার কাজী, একজন নারীকে জোর পূর্বক বন্দি রাখার জন্য আমরা আপনাকে গ্রেপ্তার করছি।”

পুলিশ অফিসার তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। অঙ্কন সেখানে চেঁচামেচি করতে লাগলো। ধরিত্রী মীরা কে নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসলো। বের হতে গেটের বাইরে ওদের রাফসানের সাথে দেখা হয়। রাফসান ওদের দিকে এগিয়ে আসে,

– কী করে করেছ এসব ধরা?
– আমি মায়ের কাছে সব শোনার পর একটু একটু বুঝতে পারি। তাকে প্রশ্ন করতেই অঙ্কনের বাসায় আসি। সেখানে আশা করিনি মীরার দেখা পাব। ওর চিরকুট দেখেই আমি উপরে গিয়ে ওর সাথে কথা বলি। ও আমাকে মাসুদ আঙ্কেলের ঠিকানা দেয়। আচ্ছা, তুমি মাসুদ আঙ্কেলের কাছে কেন যাওনি?
– আমার মাথায় ছিল না যে উনি আমাদের হেল্প করতে পারেন। আমি ভেবেছিলাম উনি অঙ্কনের বিশ্বস্ত।
– উনি অনেক ভালো মানুষ। ওনার কাছে অঙ্কনের সব দুর্নীতির হিসাব আছে। সেইসব তথ্য নিয়ে দুদক কাজী হেল্থ কেয়ারের বিরুদ্ধে মামলা করবে।
– তুমি মাসুদ আঙ্কেলের কাছে যে গেলে, ধরা পড়নি?
– পড়তাম যদি বুদ্ধি না খাটাতাম। আমি অঙ্কন কে বিশ্বাস করিয়েছি যে আমি খুশি হয়েছি মীরাকে এভাবে দেখে। তারপর ও ওর সন্দেহ হচ্ছিল। তাই আমি আবার পাহাড়ে ফিরে যাই। এদিকে আমার মা মাসুদ আঙ্কেলের সাথে যোগাযোগ করে আর উনি আমাদের সহায়তা করেন। তারপর আমি আমার টিভি সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আর ফরহাদ সাহেবকে ডিজিটাল আইনের মামলার ভয় দেখিয়ে আর হালকা টিআরপির লোভ দেখিয়ে আমার দলে করে নেই। আমার সাংবাদিক বন্ধুরা আমাকে অনেক সাহায্য করে এই প্রতিবেদন তৈরী করে। আমি আমার নারী অধিকার সংগঠনের সহকর্মীদের নিয়ে মীরাকে উদ্ধার করতে আসি। ঘটনা এতদূর আগাতো না যদি মাসুদ আঙ্কেলের কাছে থেকে সেই ফুটেজ নেওয়া যেত।
– আমি বুঝতে পারিনি। ধন্যবাদ ধরা।

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রাফসান প্রশ্ন করল,

– তুমি আমাদের সাহায্য কেন করলে?
– একদম ভুল ধারণা করবে না। আমি তোমার স্ত্রী বলে না, আমি একজন মানুষ হিসেবে তোমাদের সাহায্য করেছি। আমার খুব স্বাভাবিকভাবেই তোমাদের জন্য খারাপ লেগেছে। ওসব ভালোবাসার জন্য না। মীরা আর তুমি অযথাই অনেক অপমানিত হয়েছ। এসব জানতে পেরে অন্য কেউ হলেও আমি সাহায্য করতাম। তবে স্বামী হিসেবে বা বন্ধু হিসেবে তোমরা দুজনেই অনেক খারাপ। কেউ আমার কষ্টের সময় কাছে আসোনি, বা কেউ কারো কষ্টে আমাকে ডাকো নি। মীরা, তুমি আমাকে তোমার স্বামীর ব্যাপারে সব বলতে পারতে। সত্যি তো এটাই তুমি আমাকে কখনোই বন্ধু ভাবোনি।

মীরা ধরিত্রীর দিকে ফিরে বলল,

– না ধরা না! আমি কাউকেই বলিনি।
– কেন বলোনি? চুপ থাকার ফল টা পাচ্ছ তো?
– হ্যাঁ পাচ্ছি। কখনোই চুপ থাকা উচিত না। সহ্য করা উচিত না। আজ এত বড় ক্ষতি হয়ে আমার শিক্ষা হলো।
– তুমি অনেক বোকা মীরা। মানুষ একবার ভুল করে, একবার ফাঁদে পড়। তুমি বারবার পড়েছ। এতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন ও মানুষ হয়? যাই হোক, তোমাকে কিছুদিন হয়তো ভিকটিম সেন্টারে থাকতে হবে। এরপর তোমার মায়ের কাছে ফিরে যেও।

ধরিত্রী চলে যাওয়ার সময় মীরা ধরিত্রীর হাত ধরে ফেলে,

– তুমি চলে যাচ্ছ?
– হ্যাঁ। কেন যাব না?
– রাফসান? ওর তো দোষ নেই।
– ওর এই বিষয়ে দোষ নেই। ওর আর আমার মাঝে সব এমনিতেই শেষ হয়ে গেছে। ঐ কাহিনীর আগেও শেষ ছিল, এখনো শেষ।

ধরিত্রী চলে যাচ্ছে। মীরা ও ভিকটিম সাপোর্টের গাড়ির পাশে হুইলচেয়ারে। সেটাই তার নতুন গন্তব্য। বাকি শুধুই রাফসান। সে দাঁড়িয়ে রইলো। আরেকটা সুযোগ আসলে হয়তো নিজের ভুল গুলো শোধরানোর চেষ্টা করা যেত। কিন্তু সত্যি এটাই, মানুষ বারবার সুযোগ পায় না।

অঙ্কনের হাতে হাতকড়া লাগানো। তাকে গাড়িতে তোলা হবে। তার পাশে পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে। মীরা আর রাফসান দাঁড়িয়ে আছে। অঙ্কনের কী যেন হলো। সে পুলিশের কোমর থেকে গুলি নিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে লাগলো রাফসান আর মীরার দিকে। গুলির ভয়ানক শব্দে সবাই এদিক ওদিক ছুটছে। ধরিত্রীর কানেও সেই শব্দ এসেছে। এক অজানা ভয়ে ধরিত্রী দৌঁড়াতে থাকে। কী হচ্ছে সেখানে? তার কী কারো সাথে শেষ সাক্ষাৎ হয়ে গেছে?

দুই বছর পর….

ধরিত্রীর একটি নতুন বই বের হচ্ছে। আজ বইটির মোড়ক উন্মোচন। অনেকেই এসেছে তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য। বেশিরভাগ ধরার বয়সে বড় বান্ধবীরা। তবে প্রায় সমবয়সী মধ্যে আছে মীম, রিমা আর রাধা। তারা পরেছে যথাক্রমে আকাশী, গোলাপি আর সবুজ শাড়ি। ঠিক পাওয়ার পাফ গার্লসের মতো। ধরিত্রী পরেছে এক হলুদ শাড়ি। রাধা হাসতে হাসতে বলল,
– আলাদা আলাদা রঙ কেন?
– কারণ তোমরা আমার পাওয়ার পাফ গার্লস!

রিমা বলল,

– তুমি হলুদ যে?
– আমার জীবনে অনেকদিন পর সূর্য উঠেছে। সেজন্য।

তারা তিনজন মিলে ধরিত্রীকে জড়িয়ে ধরলো। সবার শুভেচ্ছায় ধরিত্রী সিক্ত হচ্ছে। জোহরা কিন্তু ওর পাশেই আছে। অনেকটা নীরব ছায়ার মতো। ধরিত্রী যা, তা জোহরা ও। ধরিত্রীর পুরো পরিবার আছে। মামা চাচার পরিবার ও। সবাই তাকে নিয়ে অনেক গর্বিত। তার জন্মদাতা পিতাও। তবে এখনো কোথাও না কোথাও ধরিত্রী তার বাবাকে আপন করে নিতে পারে না।

ধরিত্রীর একটি ব্যানার আছে পাশে। সেখানে তার ছবি আছে, আর লেখা আছে “বেস্ট সেলার রাইটার “। এক বছর আগে তার ” মাই মিসক্যারেজ জার্নি” নামক বইটি তিনটি দেশে বেস্ট সেলার হয়েছিল। শোককে শক্তি করতে পারলেই মানুষ আগাতে পারে। ধরিত্রীর ব্যানারের দিকে জোহরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর ধরিত্রী তার পাশে এসে দাঁড়ালো।

– কী দেখছ মা?
– আমার মেয়েকে। বিশিষ্ট লেখিকা ফারহিন জোহরা ধরিত্রী কে।
– মা, একটা কথা বলি?
– বল।
– অনেক হয়েছে। এবার লোকটাকে ছেড়ে দাও।
– আমি যদি বলি আমি স্বাধীন দেশের নাগরিক। তোর এই কথা আমার ব্যক্তিগত পছন্দে হস্তক্ষেপ করছে, তা তো মানবি?
– মা!
– আমার জামানের অভ্যাস হয়ে গেছে। ওকে আমি ছাড়তে পারব না। ওটাই আমার পছন্দ। আমি দুর্বল বলে না। আমি স্বাধীন বলে আমি ওকে পছন্দ করেছি। মানুষ নেশা করে, মদ্য খায়।আমার জামানের নেশা আছে।
– মানুষ আর মাদকদ্রব্য কী এক?
– হাস্যকর হলেও সত্যি, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ নেশা, মানুষের নেশা। ঐ মানুষ টা আমার নেশা। আমাকে আর ওকে ছাড়তে বলবি না।

ধরিত্রী আর তার মাকে কিছু বলল না। এরকম বাজে লোককে মানুষ কী করে ভালোবাসতে পারে? জেনেশুনে প্রতিদিন বিষ পান কী ঠিক? তবুও, যার যার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। একটু ডানে তাকাতেই সে দেখলো রুবাইয়া আর মাশরুফা এসেছে। পেছনে রাশা আর আহসান। ধরিত্রী হাসি মুখে সেখানে এগিয়ে গেল।

– রুবি তোমরা এত দেরি কেন করলে?
– আমাদের কাজ করতে করতে অনেক দেরি হলো। আমি হাসপাতাল থেকেই আসলাম। প্রোগ্রাম কী শেষ?
– না। একটু পর শুরু হবে।

একটু পর অনুষ্ঠান শুরু হলো। নারী ও শিশু মন্ত্রী ধরিত্রীর দ্বিতীয় বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করছে। বইটির নাম, “মীরার কাহিনী”। বইটি মীরার জীবন নিয়ে লেখা। তার সব গুলো ভুলকে ধরিত্রী ফুল হিসেবে তুলে ধরেছে। যে ফুল গুলো থেকে অনেক নারী শিক্ষা পাবে। মিম রিমা আর রাধা জোরে জোরে হাত তালি দিচ্ছে। আগে কত ঘৃণা করত মীরাকে। আজ ওর জন্য হাত তালি দিচ্ছে। এরপর মীম আফসোস করতে করতে বলল, ” ইশ! আজ যদি মীরা এখানে থাকত।”

মীরা এখন প্রবাস জীবন যাপন করছে। তার সাথে আছে তার মা। নিরাপত্তার স্বার্থে সে কোন দেশে আছে সব গোপন রাখা আছে। কিন্তু অঙ্কন আছে মানসিক হাসপাতালে। সেখানে সে সারাদিন মীরা মীরা করে। সে এক বদ্ধ উন্মাদ। আদালতে হাজির করার পর সে অনেক উদ্ভট আচরণ করে। পরবর্তীতে প্রমাণ হয় সে মানসিক ভাবে অসুস্থ। ছোটবেলা থেকেই সে দেখে এসেছে তার মায়ের প্রতি বাবার আচরণ। সে ভেবেছে মেয়েদের সাথে বুঝি এমন আচরণ করতে হয়। ব্যাপারটা পারিবারিক শিক্ষা। যা অঙ্কন কখনো পায়নি। তবে বড় হওয়ার পর নিজের বিবেক বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সে ভালো হতে পারত। মীরাকে সে কখনোই ভালোবাসেনি। ভালোবাসার মানে সে জানে না। সে তাকে শুধুই নিজের সম্পত্তি ভেবেছে। কোনো মানুষ কখনো অন্য মানুষের সম্পত্তি হয় না।

এদিকে অঙ্কনের বাবার দুর্নীতি ফাঁস হওয়ায় তার সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে। আর তিনি কিছুদিন জেলেও ছিলেন। এখন জামিনে আছেন। সব মিলিয়ে অঙ্কনের পুরো পরিবার শাস্তি পাচ্ছে। তাকে কেউ সেখান থেকে বের করতে পারছে না। তবুও মীরা ঠিক করেছে সে আর দেশে আসবে না। খুব ইচ্ছে হয়, তবুও না। ধরার বইয়ের একটা কপি সে পেয়েছে। নিজের কর্মস্থলে সেই বই পড়ছে সে। নিজের জীবন কাহিনী।

রিমা তার ফোন নিয়ে ধরিত্রীর বক্তব্য রেকর্ড করছে। ভিডিওটা সে ফেসবুকে দেবে। মীরা না হয় সেখান থেকেই দেখল। রাধা তার বাম পাশে তাকাতেই দেখল রাফসান কে। কালো শার্ট আর হাতে সাদা অ্যাপ্রোন হাতে ভিডিও করছে ধরার বক্তব্য। ধরিত্রীর কথা শেষে রাধা সেদিকে এগিয়ে গেল,

– তুমি এখানে?
– হ্যাঁ। তোমরাও তো এখানে।
– আমরা বন্ধু, সেজন্য এসেছি।
– বন্ধু!

এই বলে রাফসান হালকা হেসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রাফসানের ক্লাসমেটরা এখন ধরিত্রীর বন্ধু। আর তারাই ওর এখানে থাকার বৈধতা প্রশ্ন করছে।

– সোজা হাসপাতাল থেকে এসেছ?
– জ্বী। এত স্পেশাল দিনটা মিস করতে চাইনি।
– ইনভাইট করেছিল তোমায়?

রাফসান নিজেকে সামলে জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

– দেখো রাধা, আমি তোমার সব প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নই। তুমি কী ওর বডিগার্ড? আর আমি এতটা খারাপ ও নই যে শাস্তি আমি পাচ্ছি।
– স্যরি। আমি ওভাবে প্রশ্ন গুলো করিনি। বলতে চাইছিলাম, স্যরি।
– মানে?
– এত বছরে তোমাকে করা শুধু শুধু অপমান গুলোর জন্য ক্ষমা চাইনি তাই।
– ওহ! ঠিক আছে।
– আর ইনভিটেশন, রাফসান।
– জ্বী?
– তোমার সাথে ধরার সব ঠিক হচ্ছে তো?
– কেন?
– ভাবলাম তোমাকে ইনভাইট করল। মানে সব ঠিক।
– না, আমাকে ইনভাইট করেনি। আমি ওর সেরা ফ্যান হিসেবে পাস পেয়েছি। একটু পর আমাকে ডাকবে, ওর অটোগ্রাফ যুক্ত বই নিতে।

রাধার চোখ ছানাবড়া করল। রাফসান মুচকি হাসি দিয়ে সামনে গেল। একটু পর রাফসান তার পুরস্কার নিতে ধরিত্রীর কাছে গেল। এত ফ্যানের ভেতরে রাফসানকে দেখে ধরিত্রী ভ্রুকুটি করলো। রাফসান তখন তার পাস সামনে এগিয়ে ধরলো। অতঃপর ধরিত্রীর রাফসানকে অটোগ্রাফ দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। ধরিত্রী যখন অটোগ্রাফ দিচ্ছিল রাফসান তখন বলছিল,

– ম্যাম, আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান।
– ধন্যবাদ।
– অনেক আগে থেকে।
– অনেক অনেক ধন্যবাদ।

ধরিত্রী খুব স্বাভাবিকভাবেই রাফসানকে সরে যেতে বলল। ও পরের জনকে অটোগ্রাফ দিচ্ছিল। রাফসান সেই বইটি হাতে নিয়ে একপাশে দাঁড়ালো। ওর চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে ওর খুব খারাপ লাগছে। রুবাইয়া রাফসানের কাছে এসে বলল,

– কী বলেছে?
– কিছুই না।
– তুই কী করে এলি?
– লাকি ড্র।
– এত লাকি কবে থেকে।
– অনেক বার ট্রাই করে। অনেক কষ্টে একটা পেলাম। ও তো আমাকে ওর পাশেই ঘেঁষতে দেয় না।

প্রোগ্রাম শেষে জোহরা আর ধরিত্রী গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। রাফসান ওর দিকে এগিয়ে গেল। রাফসানকে দেখে জোহরা সরে গেল। ধরিত্রী রাফসানের দিকে ফিরে বলল,

– কী চাই?
– একটা প্রশ্নের উত্তর।
– কোন প্রশ্ন?
– সেদিন গোলাগুলির সময় তুমি রিস্ক নিয়ে আবার ফিরে কেন এলে?
– কী গন্ডগোল হচ্ছে তা দেখতে এসেছিলাম।
– আমি মা*রা গেছি, তোমার মায়ের কাছে এই কথা শুনে কেঁদেছিলে কেন?
– বাহ, আপনার সাথে এতদিন ছিলাম। আপনার মৃ*ত্যুর খবর শুনে একটু চোখের জল ফেলা কী পাপ?
– খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, তাই না?
– হুম।
– আর ঐ দিন গোলাগুলি শেষে আমাকে খুঁজে না পেয়ে কান্নাকাটি করে এরপর আমাকে অক্ষত দেখে যে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছিলে?
– ডক্টর রাফসান, একটা প্রশ্নের কথা বলে কয়টা প্রশ্ন করবেন?
– আমি মূলত এই প্রশ্নের উত্তর টাই চাই। আমার মনে হয় আমাদের মধ্যে এখনো কিছু বাকি আছে। উই শ্যুড ট্রাই। নইলে তুমি কেন এখনো মুভ অন করোনি? কেন আমি তোমার খোঁজ নেই? কেন আমায় ডিভোর্স দাওনি?
– তুমি ডিভোর্স চাও?

ধরিত্রী অবাক হয়ে এই প্রশ্ন করল। রাফসান কোনো দেরি না করেই বলল,
– আরেকটা চান্স চাই। আগের মতো চলো ডেট এ যাই, সময় কাটাই। আবার নতুন করে শুরু করি। কারণ আমার ধরা ছাড়া কোনো গতি নেই।
– তুমি কী সব জানো রাফসান?
– কোন ব্যাপারে?
– আমার জন্ম ইতিহাস।
– জানি। অনেক আগে থেকেই। মা ও জানে। সবাই জানে। এটা তেমন কিছুই না যা তুমি ভাবো।
– এত কিছুর পর তোমার আমার সাথে সংসার করতে ইচ্ছে হয়?
– কেন না? ভুল আমাদের ছিল। এবার আমি সেখান থেকে শিক্ষা নিতে চাই। অতীত তো অতীত। ভবিষ্যত টা আমরা চাইলে আমাদের মতো করে সাজাতে পারি। আমি এখনো তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আগের চেয়েও অনেক বেশি বেশি ভালোবাসি। আমাকে একটা সুযোগ দাও, কথা দিচ্ছি, হতাশ করব না।

রাফসানের কথা গুলো শুনে ধরিত্রীর চোখে জল চলে এসেছিল। সেই জল লুকাতে ধরিত্রী রাফসানকে জড়িয়ে ধরল। এক পাশ থেকে রুবাইয়া জোহরা আর বাকিরা খুশির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এইতো, রাফসান আর ধরিত্রী এত বছর পর আবার মিলে গেল। রুবাইয়া জোহরার উদ্দেশ্যে বলল, ” জোহরা, আমার মনে হয় ওদের নতুন করে আবার বিয়ে দেওয়া উচিত। সেই বিয়েটা অবশ্যই পুরনো হয়ে গেছে।” রুবাইয়ার কথা শুনে সবাই হাসলো।

এভাবেই ধরিত্রীর জীবনের আরেকটা অধ্যায় শুরু হলো। এভাবেই রাফসান আর ধরিত্রী তাদের বাকি জীবন সুখে শান্তিতে কাটাবে।

******* সমাপ্ত *******

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here