#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট ১৬,১৭
#পিকলি_পিকু
১৬
ধরিত্রী বাসায় আসতে আসতে রাফসান ও চলে এসেছে। ওর হাতে ফুল ছিল। বাসার সবাই মিলে ধরিত্রীকে সেই ফুল উপহার দিল। উপহার গ্রহণের পর ধরিত্রী খুব ক্লান্ত থাকায় ঘরে চলে গেল। ঘরের ভেতর এখন রাফসান আর ধরিত্রী আছে। একটু পর ধরিত্রী গেল ড্রেসিংরুমে। সেখানে রাফসান গিয়ে ওকে সাথে সাথে জড়িয়ে ধরলো,
– প্রাউড অফ ইউ মাই ইমোশনাল কুইন।
– থ্যাংকস।
– তুমি কী হ্যাপি না?
– হ্যাপি স্যাড কিছুই না। শুধু বুঝতে পারছি না।
– কী?
– আমি কী সত্যি কারো পার্সোনাল লাইফে ইনটারফেয়ার করেছি?
– নো। মানে, কাইন্ড অফ। দরকার ছিল যদিও। নইলে ওনাদের দায়িত্ব কে নিত?
ফ্রেশ হয়ে আসার পর রাফসান আর ধরিত্রী একসাথে শুয়ে আছে। ধরিত্রী রাফসানের বুকে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরে আছে।
– ওনাদের দায়িত্ব কে নিয়েছে জানো?
– কাজী হেল্থ কেয়ার।
– হুম। কিন্তু কারা জানো?
– না।
– অঙ্কন ভাই। অনেক ভালো উনি। ওনার মন অনেক বড়। তুমি জানো, উনি অনেক চ্যারিটি করেন।
– দেখলেই বোঝা যায়। নইলে মীরা ওনাকে বিয়ে করতো না।
– আমার মনে হয় মীরা বলেছে ওদের ব্যাপারে।
– তাই? ও দেখছিল?
– হ্যাঁ। ও আমাকে ফোন করে বলেছিল ওখানে যেতে।
– যাওনি কেন?
– আমি গেলে মিসেস দিয়ার দেবরকে ফোন ধরিয়ে দিত কে?
– তুমি করেছিলে?
ধরিত্রী উত্তেজিত হয়ে বসে পড়লো। রাফসান বলল,
– আরে, এমন করার কী আছে?
– থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ!
ধরিত্রী রাফসানকে অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরে লম্বা একটা চুমু খায়। রাফসান যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ধরিত্রী রাফসানকে ছেড়ে দিল। রাফসান এখনো সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর গাল দুটো লাল হয়ে আছে। ধরিত্রী ওদের বেড সাইড লাইটি জ্বালিয়ে দিয়ে বলল,
– কী ব্যাপার?
– কিছু না।
– গাল গুলো এত লাল কেন?
– লাইট অফ করো। এত রাতে লাইট অন রাখে নাকি।
– এক মিনিট তোমাকে চুমু খেলে তোমার গাল লাল হয়ে যায়?
– না। একদম না।
– দাঁড়াও।
ধরিত্রী রাফসানের উপরে উঠে ওর গালে চুমু খেতে লাগলো। ওর চোখের নীচের তিলে, ওর নাকের উপর, কপালে। ওর দাঁড়ি বাদে সমস্ত খালি জায়গা গুলোতে ধরিত্রী ওর ঠোঁটের অবস্থান নিশ্চিত করলো।
– একদম লাল টুকটুকে বউ লাগছে।
– তাই? তোমার মুড দেখছি ভালো হয়ে গেছে।
– হ্যাঁ।
– আসো, আরো ভালো করে দেই।
এই বলে রাফসান ধরিত্রীকে আদর করতে লাগলো। সকাল বেলা ওরা একসাথে বের হলো। ধরিত্রী রাফসানের হাসপাতালে গিয়ে মিসেস দিয়ার বাচ্চা আর দেবরের সাথে কথা বললেন। ওনাকে কালই কাজী হেল্থ কেয়ারের হাসপাতালে নেওয়া হবে। ধরিত্রী ওদের সাথে যোগাযোগ রাখতে বলল। অফিসে আসার পর ওর আরো অনেক সমাদর হলো। ওকে বোনাস দেওয়া হলো। তবে ধরিত্রী সেই বোনাস মিসেস দিয়ার দেবরকে দিয়ে দিয়েছে। সবার অভিনন্দনের একটা সুন্দর উত্তর লিখে ধরিত্রী পাঠিয়ে দিল। হঠাৎ দেখলো অঙ্কনের নাম। ও কী অঙ্কন কে ফোন করবে? ওর কাছে আসা সব ফুলের মধ্যে মীরা আর অঙ্কনের তোড়াটা অনেক বড় আর সুন্দর। ধরিত্রী অঙ্কনকে কী করে ধন্যবাদ দেবে? ধরিত্রীর ফোন বেঁজে উঠল। মীরা করেছে।
– হ্যালো মীরা।
– হ্যালো ধরিত্রী। কংগ্রাচুলেশন!
– ধন্যবাদ। অনেক অনেক ধন্যবাদ। তোমরা যা করেছ আমি অনেক কৃতজ্ঞ। কিন্তু এত বড় ফুলের তোড়ার কী দরকার ছিল।
– জ্বী?
– তোমাদের এত ফরমালিটির কী দরকার আছে। মেসেজ দিয়েছ, এখন আবার এত বড় ফুলের তোড়া পাঠিয়ে অভিনন্দন।
– ওহ!
মীরা বুঝতে পারলো। হোক না হোক অঙ্কন। ওর উদ্দেশ্য টা কী? ধরিত্রীর পেছনে কেন পড়লো?
– ধরিত্রী, তোমার কী সময় হবে?
– কেন?
– একটু ঘুরলাম। গল্প করলাম।
ধরিত্রী ভেবে চিন্তে হ্যাঁ বলল। পরদিন দুপুরের পর মীরা আর ধরিত্রী হাঁটতে বেরিয়েছে। ওরা একসাথে অনেক কথা বলছে। একজন একজনকে বিভিন্ন উপহার কিনে দিচ্ছে। ধরিত্রী ওর আর মীরার জন্য একই রকম মাটির গয়না চুড়ি কিনেছে। ওরা এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে চা খাচ্ছে,
– মীরা, তোমার কী সত্যি আমাকে মনে নেই?
– সত্যি না। কিন্তু কী হয়েছিল?
– আমি একটা ধাঁধা বলেছিলাম।
– কোন ধাঁধা?
– আচ্ছা বাদ দেই।
– আমাকে মনে রাখার মতো জিনিস কী শুধু সেই ধাঁধা?
– না।
– আর?
– তুমি আমাকে বলেছিলে আমার মধ্যে তুমি ডক্টর দেখতে পাও না।
– তো?
– ক্রিয়েটিভ মানুষ দেখতে পাও। অন্য জায়গায় আরো ভালো করব।
– আর তাই তুমি আর ডক্টর হওনি?
– জ্বী।
– স্ট্রেঞ্জ। মানুষ মানুষের জীবনে অজান্তেই কত বড় প্রভাব ফেলে দেয় যা তারা নিজেরাও জানে না।
– হুম।
– তোমার কী রাফসান কে মনে আছে?
– মানে?
– ও এখনো বলেনি, তাই না?
– কী বলবে?
ধরিত্রী মীরার কথা বুঝতে পারছে না। রাফসান কে কেন মনে রাখবে?
– ধরিত্রী, রাফসান ও তোমার একটা ক্লাস নিয়েছিল।
– তাই?
– জ্বী।
– আমার মনে নেই কেন?
– যেমন করে আমার মনে নেই। এক কাজ করো, আজ ওকে জিজ্ঞেস করেই নাও।
ধরিত্রী বাড়ি ফিরে আসলো। রাফসান আজকে দেড়টায় ফিরেছে। বসার ঘরে ঢুকে জুতো খুলতেই বুঝতে পারল আজ ওর মা বসে নেই। সাদা ঢিলে সালোয়ার কামিজে এটা ধরিত্রী। ও ঘুমিয়ে পড়েছে। আজকে ও অপেক্ষা করছিল? রাফসান ওর কাছে গিয়ে ওকে পাঁজা কোলে ওঠাতেই দেখলো ও জেগে গেছে,
– কী করছ?
– ঘরে দিয়ে আসছিলাম।
– নামাও।
রাফসান ওকে নামালো। এরপর ধরিত্রী রাফসানের চেহারা স্পর্শ করে বলল,
– হাত মুখ ধুয়ে আসো। খেতে দিচ্ছি।
– খেয়ে এসেছি আজ।
– আজকাল বেশি বাইরে খাচ্ছ। অসুস্থ হলে তোমার খবর আছে।
– হাসপাতালেই রান্না হয়। বাইরে খাই নি।
– ধন্যবাদ।
রাফসান হাত মুখ ধুয়ে আসলো। এসে দেখল ধরিত্রী নেই। ও বারান্দায়। দোলনার ওপর পা তুলে বসে আছে,
– এ কী! মশা কামড়াবে তো।
– তাও আসো।
রাফসান আসলো। ধরিত্রী ওর দিকে তাকালো।
– তুমি কী আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছ?
– মানে?
– কিছু বলা বাকি আছে?
– যেমন?
– তুমি আমার মেডিকেল কোচিংয়ে ছিলে।
– কে বলল?
রাফসান হকচকিয়ে গেল। এরপর এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। অন্ধকারে বারান্দার হালকা আলোতে ধরিত্রী আর ও। ধরিত্রীর চুল উপরে খোঁপা করা। ওর পা দুটোকে ভাজ করা অবস্থায় জড়িয়ে ধরে মুখটাকে রাফসানের দিকে করে তাকিয়ে আছে। হালকা হালকা দোল ও খাচ্ছে। রাফসান এবার বলল,
– আর বাদ দিতে হবে।
– মানে?
– R. FREE থেকে R বাদ দিলে FEE থাকে।
– সিরিয়াসলি! তোমাকেও এটা ধরেছিলাম?
– পারিনি তখন। শতভাগ ডিসকাউন্ট থেকে কী বাদ দিলে শতভাগ টাকাই আবার দেওয়া লাগে। শত ভাগ ডিসকাউন্ট মানে FREE. আর FREE থেকে R বাদ দিলে FEE মানে খরচ টা। বাই দ্য ওয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছিল ব্যাপার টা।
– তখন পারোনি?
– আসলে আমি তোমার কথা আমার বন্ধু আর জুনিয়রদের থেকে শুনেছিলাম। তুমি নাকি প্রতিদিন নতুন নতুন ধাঁধা দাও। আর সবাইকে ক্লাসে অপদস্থ করে মজা নাও। আমি আসলে তোমাকে জব্দ করতে গিয়েছিলাম। উল্টো হয়ে এলাম।
– শুধু মীরাই পেরেছিল।
– হ্যাঁ। ওকে এটা বলতেই ও কিছুক্ষণের মধ্যে ক্র্যাক করেছিল।
– এরপর আমি ওনাকে একই প্রশ্ন করেছিলাম?
– হ্যাঁ। তবে এটা জানো, আমরা সবাই অপেক্ষা করছিলাম তুমি কখন মেডিকেল কলেজে আসবে। যার কলেজেই আসো, আমরা সবাই মিলে তোমাকে Rag দেব।
– সত্যি?
– পরে আর আসোনি। এরপর তোমার এফ বি পেলাম। ঘুরে দেখলাম।
– তোমার না এফ বি ছিল না?
রাফসান আবার ধরা পড়ে গেল। সত্যি বলবে? বলেই তো ফেলেছে।
– ছিল। অনেক আগে থেকে। সেখান থেকে তোমাকে ফলো করতাম। আর এই ধাঁধার উত্তর ও আমি তোমাকে পাঠিয়েছিলাম। আরো অনেক লজ্জাজনক, বাদ দাও। সেই কারণে মীরা বলেছিল আইডিটা ডিএক্টিভেট করতে।
– ওয়াওওও!
ধরিত্রী দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এরপর রাফসানের কাছে এসে বলল,
– আর কী কী করেছ?
– তোমার, শোনার সাহস আছে?
– আছে।
রাফসান গিয়ে দোলনায় বসলো। ধরিত্রী ওর সামনে
সামনে দাঁড়িয়ে।
– মায়ের সাথে তোমার দেখা টা কাকতালীয় না। আমিই ফেসবুকে তোমার পোস্ট দেখে মাকে পাঠিয়েছিলাম।
– আর ইউ সিরিয়াস!
ওরা দুজন এবার চুপ করে আছে। ধরিত্রী ইশারা করে আবার ওকে সব বলতে বলল,
– তুমি ফেসবুকে প্রায় ঐ পার্কটার ছবি দিতে। আমি দেখেছি। মীরাকে বলেছিলাম ওখানে গিয়ে বন্ধুত্ব করে পরিচয় করিয়ে দে। ও পারবে না বলে দিল। এরপর মাকেই পাঠালাম।
– তুমি অনেক বড় ধরণের স্টকার রাফসান। তোমার জেল হতে পারে।
রাফসান ধরিত্রীর হাত ধরে ওকে কাছে এনে দাঁড় করিয়ে বলল,
– আমার তোমাকে ভালো লাগতো ধরিত্রী। তাই প্রতিদিন তোমার প্রোফাইল ঘুরে দেখতাম।
– কেন?
– তুমি খুব সুন্দর করে ভাবো তাই। তোমার মনে আছে, তুমি যে কর্মজীবী মায়েদের নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলে।
– অনেক আগে। মানে সত্যিই অনেক আগে।
– মাত্র ইউনিভার্সিটিতে উঠেই। এত ছোট মেয়ের মাথায় এত সুন্দর ভাবনা দেখে আমি অনেক অবাক হয়েছিলাম। আমার অনেক ইচ্ছা ছিল, এমন কাউকে সঙ্গী করা যে আমার মাকে বুঝবে। আমার মা একজন কর্মজীবী হওয়ার কারণে আমাকে অনেকেই বলত আমি মায়ের ভালোবাসা পাইনি। মা অন্যায় করেছে। গৃহিনী মায়েরা শ্রেষ্ঠ মা। কর্মজীবী মায়েরা উদাসীন। কিন্তু মা তো মা। তুমি সেটাই লিখেছিলে। আমার মা আমার ব্যাপারে কখনো উদাসীন ছিল না।
ধরিত্রী তাকিয়ে থাকে। আর কিছুই বলে না। ওর চেহারায় এখন এটা লাজুক হাসি দেখা যাচ্ছে।
– এরকম তোমার প্রত্যেকটা লেখা আমার খুব ভালো লেগে যায়। অনেকেই সহ্য করতে পারত না তোমার চিন্তা ধারা। তোমার সব মতামতে সবাই একমত হতো না। আবার অনেকগুলোতে হতো। তবে তোমার সব ভাবনাই আমাকে ভাবাতো। এমনটা আমি চাই বা এমনটা তো ভাবিনি। হলে তো মন্দ হয় না।
– তুমি সত্যিই আমাকে চিনতে?
– আর সবার মতোই। তোমার খুব সাধারণ একজন ফলোয়ার।
রাফসান ধরিত্রীকে কাছে টেনে নিল। ধরিত্রী বলল,
– দোলনা ভেঙে যাবে।
– যাবে না। আস্তে করে আমার কোলে বসো।
– আমি কী বাচ্চা নাকি।
– আমার তুলনায় বাচ্চা তুমি। ধরো তোমাকে Rag দিচ্ছি।
রাফসানের বাম পায়ের উপরে হালকা ভর দিয়ে বসলো ধরিত্রী। কী সুন্দর লাগছে এই মুহূর্তটা। রাফসান আস্তে করে ধরিত্রীর চুলটা খুলে দিলো। ধরিত্রীর লম্বা চুল গুলো খুলতেই রাফসান ওকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে নিলো। ও ধরিত্রীকে নিজের ভেতর ধারণ করছে।
“আমি তোমাকে অনুভব করতে চেয়েছিলাম ধরিত্রী। ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। তুমি কাছ থেকে কেমন?”
ধরিত্রী এই কথা শুনে রাফসানের কাঁধে নিজেকে এলিয়ে দিতেই ধপাস! দোলনা টা ভেঙে পড়ল! ওরা দুজন সাথে সাথে মাটিতে। ধরিত্রীর গায়ের উপর রাফসান। দুজনেই আহ! উহ! করতে করতে হেসে দিল। এত রাতে শব্দতে সবাই জেগে গেলে?
– বলেছিলাম না, এটা একজনের ভারই নিতে পারে।
– আমি কী জানতাম। আমার ও ইচ্ছা করে তোমাকে নিয়ে দোল খেতে।
– এখন তো আমিও আর খেতে পারব না।
রাফসান ওর কোমরে হাত দিয়ে হালকা ব্যায়াম করে ধরিত্রীকে পাঁজা কোলে তুলে নিল।
– এই যে ! কী করছ?
– তোমার দোলনা ভেঙেছি। তাই শোধ দিচ্ছি। আমিই তোমার হিউম্যান দোলনা।
– খুউব না?
বর্তমান,
আজ ও ধরিত্রীকে পাঁজা কোলে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে রাফসান। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে সেখানেই বসে রইলো রাফসান। কাল কী হয়েছিল কেন হয়েছিল সব পরে দেখা যাবে। আগে ধরিত্রী সুস্থ হোক।
(চলবে)
#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট১৭
#পিকলি_পিকু
“তো তুমি আমার সম্পর্কে সবই জেনেছ, সোস্যাল মিডিয়া থেকে। ” ধরিত্রীর মুখে এই কথা শুনে রাফসান মুচকি হাসলো। ওরা রাফসানের হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। লাঞ্চ টাইম। ধরিত্রী এসেছে দেখা করতে।
– তুমি ফেসবুকে লিখতে।
– কী জানো?
– সব।
– না, সব না। আমি ওখানে সব দেইনি।
– পছন্দ অপছন্দ তো দিতে।
– যেমন?
– কফি, চুড়ি, শাড়ি, আলতা। আর তোমার কী ধরণের মানুষ পছন্দ এসব। তোমার ভিউস, চিন্তা ধারা।
– এককথায় সব গুণ গুলো। দোষ কিছু লিখিনি। আমি যেভাবে নিজেকে দেখি তাই লিখেছি। ভালো ভালো দিক গুলো। খারাপ কিছুই লিখিনি।
– তোমার কোনো দোষ নেই ধরিত্রী। ইউ আর ফ্ললেস! পরীর মতো।
– ভুল। আমার দোষ আছে। চাঁদের ও কলঙ্ক আছে। কেউ পারফেক্ট হয় না।
– বুঝেছি। তুমি খুব ইমোশনাল তাই? আমি জানি তো। তুমি যে এত ইমোশনাল সেটা সামনাসামনি না দেখলে বুঝতাম না।
– এটাও না। মানে এটা ঠিক আছে, কিন্তু আমার একটা দোষ আছে। উমমম! এটা বললে হয়তো আমাদের বিয়ে হতো না। এটা বলা বারণ।
– মানে?
“ডক্টর রাফসান! ইমারজেন্সি!!” রাফসান ধরিত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কী বললে ওদের বিয়ে হতো না? কী এমন দোষ ওর? ওকে আবার পেছন থেকে ডাকলো ওর কলিগেরা। রাফসান চলে গেল। ধরিত্রী মাথা নিচু করে চলে এলো। ওকে বলা কী ঠিক হবে? রাফসান তো ওর স্বামী। স্বামীর তো আগেই জানা উচিত ছিল। যদি কিছু মনে করে? আচ্ছা, রাফসানরা তো অনেক আধুনিক। ওদের কী কোনো অসুবিধা থাকতে পারে? মা তো বারণ করেছিল। এসব ভাবতে ভাবতে ধরিত্রী বাড়ি চলে আসলো। রাফসান ওর কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত করল। ও ভাবছে আবার জিজ্ঞেস করবে কি না। ভয়ে ভয়ে রাফসান ধরিত্রীর সামনে গিয়ে বসলো। ধরিত্রী শুয়েছিল। রাফসানকে দেখে ধরিত্রী বলল,
– কিছু বলবে?
– না। মানে, তুমি বলছিলে। বাকি ছিল।
– ও হ্যাঁ।
– বলো।
– আ’ম স্যরি। রাগ করবে না প্লিজ। এ বিষয়ে আমি কাউকে কিছু বলিনি। মায়ের প্রমিস ছিল। আজ ও ভাঙিনি। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো, বলি। স্বামী হিসেবে তোমার জানা দরকার। আমি তোমার দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী হতে চাইনা।
ধরিত্রী শুয়ে শুয়ে বলছে। রাফসান মাথা নিচু করে শুনছে। ও কী বলবে এখন? ওর কী শারীরিক সমস্যা আছে? কোনো জটিলতা?
– ধরিত্রী, স্পষ্ট করে বলো না। আমার ভয় করছে।
– সত্যি বলতে।
ধরিত্রী ও রাফসানের পাশে বসলো।
– আমার একটা, শারীরিক সমস্যা আছে।
– মানে?
– আমি আর সবার মতো না।
– জ্বী?
রাফসান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ওর কী খুব খারাপ অসুখ? দেখে তো মনে হয়নি ও অনেক অসুস্থ। এতদিন তো থাকছে একস্থে। ও কী কখনো মা হতে পারবে না? এমন কিছু? এই ভেবে রাফসান ধরিত্রী কে জড়িয়ে ধরলো। ওর দুশ্চিন্তার ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে ধরিত্রীর পিঠে। ধরিত্রীর আরো ভয় করছে। রাফসান কী মেনে নিতে পারবে? ওর সত্যিটা কী সত্যি ভয়ংকর হবে?
– তুমি যেমনই হও, আমার। আমার কিছুই আসে যায় না।
– আমি তোমাকে ধোঁকা দিতে চাইনি।
– না , এসব ধোঁকা না। কখন থেকে জানো?
– ছোটবেলা থেকে।
– কী করে বুঝলে?
রাফসান ধরিত্রীকে ছেড়ে ওর হাত ধরে ওর দিকে তাকালো। ধরিত্রী অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে আছে।
– একটা ঘটনা আছে।
– কী ধরনের ঘটনা?
– দুর্ঘটনা। আমরা কেউ এটা নিয়ে কথা বলি না।
ধরিত্রীর চোখ থেকে টুপ টুপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। রাফসানের হৃদস্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। কী হয়েছিল? ও কী ছোটবেলায়,
– তুমি অ্যাবিউস হয়েছিলে?
ধরিত্রী চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়তে থাকে। রাফসান কিছু বলতে পারে না। রাফসান ওর হাত ধরে বসে কাঁদতে থাকে।
– কে করেছিল? বাদ দাও, তোমাকে আর মনে করাতে চাই না।
– না , শোনো। জানা দরকার। এখন যেটা বলবো, তার সাথে সম্পর্ক আছে।
– বয়স কত ছিল?
– সাত।
– দোষীর শাস্তি?
– তাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি।
ধরিত্রী ওর চোখ মুছে বলতে শুরু করলো,
– ঐ লবঙ্গ কে চেনো? আমার মামি।
– হ্যাঁ।
– ও আর মামা তখন প্রেম করতো। আমি একদিন ওদের দেখে ফেলি আমাদের বাসার ছাঁদে। আমি এসে নানুকে বলে দিয়েছিলাম। আমি এমনি বলেছিলাম। লবঙ্গ আর লতিকাকে আমার ভালো লাগতো। কিন্তু নানু ওদের বিয়ে করাবে না বলেছিল। ওকে ডেকে অনেক অপমান করেছিল। মামাকে কিছুই বলেনি। এজন্য লবঙ্গ আমার উপর রাগ ছিল।
– তো?
– ও আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য পাশে একটা অপরিচিত গলিতে রেখে চলে আসে। বিকেল বেলা। খুব অভিমান থেকে করেছিল।
– তারপর?
– আমি রাস্তা চিনতাম না। হারিয়ে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে একটা আঙ্কেল কে পেলাম।
বলতে বলতে ধরিত্রীর হেচকি উঠে যাচ্ছিল। রাফসান গিয়ে ওর জন্য পানি নিয়ে এসে নীচে বসলো। পানি খাওয়ার পর ও আবার বলল,
– আঙ্কেল টা টাক ছিল। সাদা পাকা মোচ ছিল। কেমন যেন ছিল। উনি আমাকে বাড়ি দিয়ে আসবে বলেছিলেন।
– তোমার বাড়ির লোক?
– খুঁজছিল। সবাই খুঁজছিল। চিনি কোথায়? চিনি কোথায়? আমি একটা মাত্র মেয়ে না। এত বছর পর। আমার মাকে কে যেন বলেছিল আমি ক্ষণজন্মা হবো। এসব নিয়ে মা বাবা খুব ভয় পাচ্ছিল। আর এদিকে আমি।
রাফসান ধরিত্রীর হাত ধরে ওর কোলে মাথা রাখলো। ধরিত্রী রাফসানের হাত ধরে আছে।
– কী হয়েছিল?
– আঙ্কেল টা আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। এটা সরু গলি দিয়ে। নোংরা একটা বস্তি। সারিবদ্ধ অনেক ঘর। সেখানে একটা ঘরে বন্ধ করে দিলেন।
– তারপর?
– আমি ততক্ষণে বুঝলাম, আমি কিডন্যাপ হয়ে গেছি।
– লোকটা কী করেছিল?
– উনি কাকে যেন বলছিল বাচ্চা বিক্রির কথা। আমি খুব কাঁদছিলাম। আম্মুর কাছে যাব। লোকটা আমাকে খুব মেরেছিল। হাত পা বেঁধে তার খাটের নিচে আমাকে রেখে দিয়েছিল।
– পরে?
– আমি ওভাবে কতদিন ছিলাম জানি না। এদিকে উনি আমাকে বিক্রি করতে যাচ্ছিলেন। সেই নোংরা বদ্ধ জায়গাটায় আমি আটকা। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ভেবেছিলাম মরে যাব। বেঁচেছিলাম, কিন্তু।
– সে তোমার বাজে কিছু,
– তুমি যেটা ভাবছো ওটা করেনি। উনি একজন নেশাখোর ছিলেন। ওনার শুধু টাকা লাগতো। নেশার জন্য টাকা প্রয়োজন। আমি হয়তো একটু বেশিই ভাগ্যবান।
– তোমাকে খুঁজে পেয়েছিল?
– বাবার বন্ধু পুলিশে ছিল। ইমিডিয়েট অ্যাকশন নিয়েছিলেন তারা। আমাকে খুঁজতে প্রথমেই সেই বস্তি খুঁজতে গিয়েছিলেন। তাই ভয়ে লোকটা আমাকে রেখেই পালিয়ে যান। পুলিশ এসে আমাকে কেন যেন পায়নি। তিন দিন পর এক মধ্যবয়সী মহিলা আমাকে উদ্ধার করেন সেখান থেকে। ওনার কেন যেন সন্দেহ হচ্ছিল। উনি দরজা ভেঙে খাটের নিচে থেকে আমাকে বের করেন। ততক্ষণে যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে।
– কী?
– ওখানে বদ্ধ থাকতে থাকতে আমার খিচুনি আসতে শুরু করে। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে কয়েকবার আমার খিচুনি আসে। আমার মৃগী রোগ ধরা পড়ে।
– এপিলেপসি!
– হুম। প্রথমে অনেক অ্যাটাক আসতো। আমি একলা থাকতেই পারতাম না। আমার খিচুনি আসতো। মূলত ভয় থেকেই। আমার ক্লস্ট্রোফোবিয়া হলো। আমার মা আমাকে আগলে রাখতো। আমি আরো বেশি আদরের হয়ে গেলাম সবার। এদিকে লবঙ্গ ভয়ে ছিল। আমি যদি বলে দেই।
– তো?
– মামা ওকে ঘৃণা করবে। ও তা সহ্য করতে পারবে না। তাই ও সুই*সাইড অ্যাটেম্পট নিচ্ছিল। লতিকা বাঁচিয়ে ফেলে। লতিকা আমাকে রিকোয়েস্ট করে। মামা যদি লবঙ্গকে বিয়ে না করে তো ও মরে যাবে। তারচেয়ে খারাপ হবে যদি ওকে ঘৃণা করে। আমি চাইনি লবঙ্গ মরে যাক। আমি আজ ও বলিনি। এ কথা শুধু লবঙ্গ লতিকা আর আমি জানি।
– আর তোমার এপিলেপসি?
– দশ বছর বয়স পর্যন্ত আমার এই অ্যাটাক আসতো। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে চলতে চলে গেল।
– আর ইউ শিওর?
– হুম।
– লাস্ট অ্যাটাক কবে ছিল?
– দশ বছর বয়সে। আর আসেনি। তবুও ভয় হয়। আমার অ্যাটাক আসলে আমি বলতে পারিনা আশেপাশে কী হয়।
– তো ভয় পাচ্ছিলে কেন? আমি ভাবলাম কি না কী। মানে মৃগী রোগের জন্য। এটাতে এমন করার কী আছে?
– মৃগী অনেক খারাপ। আমার মা বলেছে। যদি কেউ শোনে।
– এটা আর পাঁচটা অসুখের মতোই। আমি একজন নিউরোলজিস্ট। আর তুমি আমাকে শেখাচ্ছ। এটা দোষের কী? তুমি কী এখন আর ঔষধ খাও না?
– পাঁচ ছয় বছর খাই না। অনেক ঘুম পেত তাই।
– কাল হাসপাতালে আসবে। তোমার চেক আপ হবে। এত ইমোশনাল। কিছু না এপিলেপসি। প্রতিদিন কতজনকে দেখি।
– মা যে বলে এটা শুনলে বিয়ে হবে না। শ্বশুরবাড়িতে ঝামেলা হয়।
– তোমার আমাদের এমন হয়? ধরিত্রী, তোমাকে এমন তো মনে হয়নি।
– না। তাও। আমার স্কুলে কয়েকজন আমাকে খুব ভয় পেত। এরপর থেকে আমি আর কাউকে বলি না।
– কুসংস্কার যত্তসব। আচ্ছা, তোমার কী ড্রেসিংরুমে,
– হ্যাঁ। ছোট জায়গা তাই। তবে তুমি থাকলে অনেক ভালো লাগে। তোমার সাথে জায়গাটা অনেক বড় লাগে। আমার ভয় লাগে না।
– শুনে খুব খুশি হলাম। তবে খারাপ লাগলে ওটা শিফ্ট করবো।
– দরকার নেই।
– আচ্ছা, ঠিক আছে। ঐ কারণেই কী তুমি বড় মহিলাদের সাথে বন্ধুত্ব করো?
– হ্যাঁ। ছোট বেলা থেকেই। আমি ঐ মহিলা কে ধন্যবাদ দিতে পারিনি। আর দেখা হয়নি।
রাফসান আবার ধরিত্রী কে আলিঙ্গন করলো। কত কিছু যে ভাবতে শুরু করেছিল। ধরিত্রী আবার জিজ্ঞেস করলো,
– আচ্ছা, আমরা কী মাকে বলব?
– কেন না? মা শুনলে কষ্ট পাবে। কিন্তু সেটা আগে কেন বলোনি সেজন্য। অন্য কারণে না।
– আচ্ছা, তুমি ঠিক কী ভাবছিলে?
– কিছু না। এখন ঘুমাও।
ধরিত্রী আর রাফসান পরদিন রাফসানের হাসপাতালে গেল। সেখানে ধরিত্রীর চেক আপ হলো। রিপোর্ট কাল আসবে। ওরা বাড়ি আসতেই রুবাইয়া আর আফসার ওদের প্রশ্ন করতে লাগলো, কী হয়েছে? ধরিত্রী ঠিক আছে কি না। হঠাৎ করে এত চেক আপ কেন? ওরা কী লুকাচ্ছে? আসলে রাফসানের হাসপাতালের প্রধান পরিচালক রাফসানের বাবার ক্লাসমেট। এভাবে রাফসানের স্ত্রী এত পরীক্ষা করছে দেখে উনি খোঁজ নিতে রাফসানের বাবাকে ফোন করে বসেন। আর সেজন্যই তারা হঠাৎ চিন্তা শুরু করেছে।
– তুই ঠিক আছিস? মা আমাকে বলছিস না কেন?
– না মা। নরমাল চেক আপ। কিছু হয়নি।
– কিছু তো হয়েছে। এত কঠিন কঠিন টেস্ট কেন করিয়েছিস। তোর কী মাথা ব্যথা করে?
– আমি ঠিক আছি।
রাফসান ধরিত্রী কে থামিয়ে দিল।
– না মা। ও ঠিক নেই। তোমাদের ও জানা দরকার।
– কী হয়েছে?
– ওর ছোটবেলায় এপিলেপসি ছিল। ও বলতে চাইছিল না। তোমরা কী ভাববে।
ধরিত্রী রাফসানকে থামিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু রাফসান সব খুলে বলতে চাইলো। রুবাইয়া আর আফসার সব শুনলো। কিন্তু বুঝলো না এতে লজ্জা পাওয়ার কী আছে। মেডিকেল কন্ডিশন লুকানো উচিত না।
– আচ্ছা ধর তোর হঠাৎ অ্যাটাক আসলো আবার, আমরা কিছুই জানি না। কী করতাম আমরা তখন?
– আসে না তো আর।
– একদম চলে যায় না। তুই বেশি বুঝিস। আমাদের কে কী তোর অশিক্ষিত মনে হয়? আমরা কী তোর আপন না?
– ব্যাপারটা তা না। আমি কখনো কাউকে জিনিসটা এক্সেপ্ট করতে দেখিনি। এটা আমার একটা দুর্বলতা।
– একদম না। আচ্ছা তোর মামিকে কোনো শাস্তি দিবি না?
– না। মামি জানে না যে আমার মনে আছে। মামি তখন ছোটই ছিল। বুঝতে পারেনি। আমি চাই না সবাই মামি কে ঘৃণা করুক। বলতে গেলে এতে নানুর ও দোষ আছে। প্রেম তো মামাও করেছে, উনি শুধু মামিকেই অপমান করেছিলেন।
– এরপর ও তুই তার সাথে এমন খুনসুটি করিস। দেখলে মনে হয় কিছুই হয়নি।
– ব্যালেন্স রাখতে। আমি আমাদের সম্পর্কটা হালকাই রাখতে চাই। আর এই কথা প্লিজ কাউকে বলো না। আমি চাইনা তোমরা লবঙ্গকে অন্য চোখে দেখ। ও না বুঝেই করেছিল।
ওরা ধরিত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো। এ মেয়েটা কত উদার সেই ছোট বয়স থেকেই। ওর সাথে যেন কখনো খারাপ কিছু না হয়। কাল ওর রিপোর্ট আসবে। এরপর সেই রিপোর্ট দেখবে সেই প্রধান পরিচালক। ওর সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হবে। কোনো ত্রুটি রাখবে না। কোথাও যেন এখনো ধরিত্রীর মাঝে অপরাধ বোধ কাজ করছে। বলা উচিত হয়নি। না আগেই বলা উচিত ছিল? এখন রিপোর্টে যদি আসে ও এখনো অসুস্থ তো রাফসান কী ওকে তখনো মেনে নেবে?
(চলবে