#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট ৩,০৪
#পিকলি_পিকু
০৩
“মা, মীরা বলছিল ধরিত্রীর কী কোনো বয়ফ্রেন্ড।”
রুবাইয়া ছুরি দিয়ে সবজি কাটার সময় তার ছেলের দিকে এমন করে তাকালো যেন এখনই কে*টে টুকরো টুকরো করে ফেলবে তাকে। রাফসান, রাশা আর আহসান মটরের খোসা ছাড়াচ্ছিল। ওরা হঠাৎ করে বন্ধ করে দিল। রুবাইয়া ছুরিটা রেখে বলল,
– না নেই।
– আগে ছিল কি না?
– কী দরকার?
– মীরা বলল হয়তো সেখানে ছ্যাঁকা খেল কি না।
– মনে হয় না আমার ধরিত্রীকে কেউ ছ্যাঁকা দেবে।
– তাও।
– চুপ!
রাফসান রাশা আহসান রুবাইয়ার চিৎকারে কেঁপে উঠলো। মাশরুফা বাইরে থেকে মাত্র আসলো।
– কী হয়েছে রাফসান?
– চাচি, দেখ না। আমি মা কে বললাম ধরিত্রীর এক্স ছিল কি না।
– হ্যাঁ ভাবি। জিজ্ঞেস করতেই পার। এমন তো হতে পারে কোনো ক্ষত আছে। রাফসান তবে সব সামলাতে পারবে।
রুবাইয়া ধমক দিয়ে বলল, “রাফসান! আর সামলাবে? ও তো এখনো শিওরই না মীরার কথা শুনবে না আমার কথা?”
পরদিন রুবাইয়া একটি বৃদ্ধাশ্রমে মহিলাদের ফ্রি চেক আপে গিয়েছে। ধরিত্রী সেটার ছবি তুলতে গিয়েছে। ওদের পত্রিকাতে খবর হবে এটা।
– ধরিত্রী, তোর কী কখনো কোনো এক্স ছিল?
– ছিল তো। কেন?
রুবাইয়ার যেন মন খারাপ হয়ে গেল। ধরিত্রীর এক্স ছিল আর সে তাকে এখনো এসব বলেনি।
– কে? কী করে? কী করেছে তোর সাথে!
– রিল্যাক্স রুবি।
– রুবি!
– রুবাইয়া থেকে রুবি।
– তুই আমাকে রুবি বলছিস।
– কারণ তুমি আমার বেস্টফ্রেন্ডের মতো বিহেভ করছো। এত পসেসিভ হওয়ার কী আছে। এক্স ছিল, থাকে। সবারই আছে। ইটস নরমাল।
– কী করেছে?
– কিছু না।
– তো?
ধরিত্রী চুপ করে বসে রইলো। রুবাইয়া ওর কাঁধে হাত রাখলো। অতঃপর ধরিত্রী বলতে লাগলো,
“আমি প্রেমে কখনো লাকি ছিলাম না। তাই করতেও চাই না। আমার একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল, জয়। ভার্সিটিতে। হ্যান্ডসাম অনেক। প্লেবয় টাইপের। আমি ভার্সিটিতে ঢুকতেই আমার পেছনে লেগে গেল। তিন মাস ঘুরিয়ে রিলেশনশিপে গেলাম। প্রায় চার মাসের সম্পর্ক ছিল আমাদের। আম্মু আব্বু জানে না, এখনো। তুমিই প্রথম বড় কেউ জানলে।”
ধরিত্রী চুপ হয়ে গেল। এরপর মাথা নিচু করল। রুবাইয়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
“জয় তো আগেই খারাপ। জানতাম না যদিও। ভার্সিটিতে আমার একটা ফ্রেন্ড যে ছিল পৃথা। শয়তান ছেলেটা আমার অগোচরে আমার বন্ধুকে মেসেজ করতো। পৃথা আমাকে কিছু বলেনি যদিও। একদিন মেসেজ দেখে ফেলি। পৃথা কে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পৃথা বলল ও নাকি আমার কাছেই আসতো। আমি কিছু বললাম না। জয় এবার পৃথার দোষ দিল। পৃথা জয়ের। পরে বেরিয়ে আসলো পৃথাও পছন্দ করতো জয়কে। আর জয়ের আরো গার্লফ্রেন্ড ছিল। ধরিত্রী ছাড়াও ওর আরো অনেক গ্রহ উপগ্রহ ছিল। দুই বন্ধুকেই ধোঁকা দিচ্ছিল। আমরা দুজন মিলে গেলাম। জয় উধাও। এরপর আর প্রেম করিনি।”
রুবাইয়া ধরিত্রীর হাত ধরলো। ধরিত্রী এবার হাসতে চেষ্টা করলো।
– চেষ্টা করিসনি?
– করিনি তা না। ছেলেটা আমার সাথে কথা বলতো যখন আরো মেয়েদের সাথেই বলতো। অর্থাৎ এক জায়গায় ইনভেস্টমেন্ট না। অনেক জায়গায় থাকতো। যাতে একটা না হলে আরেকটা হয়।
– এটা কী শেয়ার বাজার নাকি?
– প্রেমটাই তো বাজার এখন। তোমার যুগ আর আমার যুগ কী এক রুবি?
– তো ঘর সংসার করবি না?
– করবো। একটা এমন ছেলে এনে দাও যে চোখে আমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখবে না। আমি আর আমি। একান্তই আমি।
– যদি আনি?
– এখনই বিয়ে করে ফেলব। না না! পরিবার ও ভালো হতে হবে।
– পরিবার ও ভালো হবে।
রাফসান রাতের খাবার খাওয়ার সময় রুবাইয়া ওকে সব খুলে বলল। রাফসানের অনেকটা মন খারাপ।
– কী হলো? এক্স ছিল, থাকে। সবারই আছে। ইটস নরমাল।
– তোমার ছিল?
– আমার আর তোমার যুগ কী এক রাফসান?
– এখন ওর মন কী করে ফেরাব?
– ও চায় যে শুধু ওকে দেখবে।
– তাহলে তো আমি,
– তুই শুধু রোগী দেখবি।
– আমি কী তোমার শত্রু মা?
মীরা ফোনে সব শুনে বলল,
– আমি বললাম না আছে। ওর আর্টিস্টিক কথা শুনলেই বোঝা যায় মেয়ে ছ্যাঁকা খেয়েছে।
– ভাই, তুই চুপ কর।
– আমি চুপ করলে তুই ও খাবি।
– না। আমার ওকে চাই।
– আচ্ছা, এত যে কাহিনী করে বিয়ে করবি। ধর, ও বলল তোমার যৌথ পরিবারে আমি থাকব না। তখন কী করবি?
– অসম্ভব! ধরিত্রী এমন মেয়েই না। ধরিত্রী অনেক আলাদা।
– সব ছেলেই ভাবে ওর টা আলাদা।
– তুই ধরিত্রীর লেখা পড়লে বুঝবি। দেখিস না, মা কেমন বেস্টফ্রেন্ড হয়ে গেল এত অল্পদিনে।
– আন্টির গুণেও তো হতে পারে।
– তুই পেরেছিস মায়ের ফ্রেন্ড হতে?
মীরা চুপ হয়ে যায়।
– আমার মাকে আমি চিনি। আর ধরিত্রীকে ও। আমার মা সবার সাথে মিশতে পারে না। আর ধরিত্রী,
– সবার সাথে মিশে যায়।
– চিনির মতো।
“চিনি! তোর ফোন এসেছে। আমি বুঝি না তোর সমবয়সী কোনো বন্ধু নেই কেন? সব মায়ের বয়সী, নানির বয়সী মহিলাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ”
ধরিত্রীর মা বসার ঘরে সিরিয়াল দেখতে দেখতে চেঁচাচ্ছেন। ধরিত্রী এসে ফোনটা ধরে কথা বলতে বলতে ভেতরে চলে গেল। এরপর এসে বলল,
– রুবাইয়া আন্টি ডাকছে। ওখানে যাচ্ছি।
– চিনি! তোর মাথা ঠিক আছে। ওনার সাথে এত ঘুরিস কেন?
– কী হয়েছে ঘুরলে। অনেক ভালো মানুষ।
– বয়স্ক মানুষদের সাথে থাকতে থাকতে বয়স্ক হয়ে যাচ্ছিস। কে বিয়ে করবে তোকে?
– কী দরকার?
– ওনার ছেলে আছে? দেখেছিস? বিবাহিত? উনিও কী ডাক্তার? এই চিনি! চিনি!!
ধরিত্রী ওর ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। ধরিত্রী ছোটবেলা থেকেই অনেক মিষ্টি। তাই ওর মা ওকে আদর করে চিনি ডাকে। ওর মা বলে, ধরিত্রী নামটা ওর বাবার দেওয়া। ধরিত্রী ঘর থেকে বের হতেই ওর মা আবার,
– বল না। ছেলেটা কেমন?
– অ্যায় মেরে জোহরা জাবি, একটু চুপ করবে? তুমি কী মনে করো? আমি আমার বান্ধবীর ছেলের দিকে চোখ দেব?
– কী বেয়াদব মেয়ে! বান্ধবী কোন দুঃখে? উনি আমার বন্ধু হওয়ার বয়সী। তোর না।
– তবুও। এথিকস আছে।
ধরিত্রী বের হয়ে গেল। রুবাইয়ার হাসপাতালে যেতেই দেখলো এক গর্ভবতী মহিলা এসেছে। ধরিত্রী তার কাছে গিয়েই তার হাতের তালু মালিশ করতে লাগলো। গর্ভবতী মহিলাটি নিম্নবিত্ত পরিবারের। তার স্বামী ফরম পূরণ করতে পারছেন না। ধরিত্রী সেই ফরম পূরণ করে দিতে লাগলো। একটু পর রুবাইয়া এসে দেখলো ধরিত্রীর কাজ। এরকমই একটা একটা মেয়ে তিনি চেয়েছিলেন। “আমার মেয়েটা থাকলেও এরকমই হতো হয়তো।” ধরিত্রী রুবাইয়া কে দেখেই এগিয়ে আসলো,
– দাঁড়িয়ে আছ কেন? নিয়ে যাও।
– অন্য ডাক্তার দেখবে। আমার শিফ্ট শেষ। আমি আর ওভার ওয়ার্ক পারি না।
– তো বিশ্রাম নাও। বাসায় যাও।
– ডেকেছি বলে রাগ করেছিস?
– এটা কোনো কথা। তুমি না বললে তুমি টায়ার্ড।
রুবাইয়া আর ধরিত্রী বের হলো হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছে তারা।
– তোর ঐ ওয়ান এন্ড অনলি পেয়ছি।
– কোথায়?
– আমার ঘরে।
– কে?
– আমার ছেলে। আমার একমাত্র সন্তান।
– ছি রুবি! শেষ পর্যন্ত বান্ধবীর ছেলে! এত বাজে দিন ও আসেনি আমার।
– আরে! আমার ছেলে তোর বড় হবে।
– তারপর ও বান্ধবীর ছেলে। কেমন যেন লাগবে।
– আমি তোর বান্ধবী কে বলল?
– তুমিই তো বললে, “আমরা বন্ধু।”
– ওটা আলাদা ব্যাপার। একটা বার দেখা কর।
– না থাক। দরকার নেই। পরে না জানি কোন স্ক্যান্ডালে পড়ি। “বান্ধবীর ছেলেকে ভাগিয়ে নিয়ে গেল এক তরুণী। বন্ধুত্বের এই মূল্য দিল বন্ধু। নিজের বন্ধুর ছেলেকে ফাঁসিয়ে নিল।” এরকম শিরোনাম আমি চাইনা। তোর ছেলে মানে আমার ছেলে।
– ছি! তুই কী আমার বয়সী?
– আমি তো সবার মায়ের বয়সী। আমি ধরিত্রী। ধরিত্রী মাতা। সবাই আমার সন্তান।
এই কথা বলে ধরিত্রী হেলে দুলে হাঁটতে থাকে। রুবাইয়া মাঝ পথে দাঁড়িয়ে থাকে। বাড়ি এসে সব সে তার ছেলেকে বলে। আবার তার ছেলে সব বলল তার একমাত্র বেস্টফ্রেন্ড কে। মীরা সব ফোনে শুনে হাসতে হাসতে বলল।
– বান্ধবীর ছেলে! হাহাহ! অনেক মজার তো মেয়েটা।
– তুই চুপ কর। আমি মাকে পাঠালাম আমাদের মধ্যে ফ্রেন্ডশিপ করিয়ে দিতে। আর মা যে নিজেই ওর বান্ধবী হয়ে আমারই বারোটা বাজাবে আমি কী জানতাম?
– হাহাহ! হাহাহ! রাফসানরে! আমি হাসতে হাসতে মরে যাব। বানাতে চাইলি পত্নী, হয়ে গেল মাতা।
– মজা নিস না। আমি কিন্তু তোকেই বলেছিলাম প্রথমে ওর সাথে ফ্রেন্ডশিপ করাতে। অন্তত বান্ধবীর বেস্টফ্রেন্ড পরিচয় পেতাম। এখন তো মায়ের বান্ধবী হয়ে গেল।
– আমি কী করবো? আমি সবার সাথে মিশতে পারি না তো। তবে মেয়েটাকে আমার ইন্টারেস্টিং লাগছে। ধরিত্রী মাতা…
রাফসানের মা এই বান্ধবীর ছেলে অপমান আর নিতে পারছেন না। তিনি চিন্তা করলেন এবার ধরিত্রীর মায়ের সাথে বন্ধুত্ব করবেন। আগেই ওটা করা দরকার ছিল। তিনি কৌশলে ধরিত্রীর কলিগ থেকে ধরিত্রীর বাসার নাম্বার নিয়ে নিলেন। ধরিত্রীর মায়ের ফোন বেজেই যাচ্ছে,
– হ্যালো।
– হ্যালো, আমি ডক্টর রুবাইয়া।
– ও হ্যাঁ। এই চিনি! তোর ফোন।
– চিনি কে?
– ধরিত্রী।
– ওকে ডাকবেন না। আমি শুধু আপনার সাথে কথা বলতে চাই। ওর ব্যাপারে। প্লিজ একটু অন্য জায়গায় আসুন।
ধরিত্রী আসতেই উনি বললেন, “আমার বন্ধু ফোন করেছে। তুই গিয়ে কাজ কর।” এরপর ধরিত্রী চলে গেল।
– এখন বলুন।
– কীভাবে যে বলি। আমি ধরিত্রীকে খুবই পছন্দ করি। নিজের মেয়ের মতো। খুবই মিষ্টি মেয়ে।
– তাই তো চিনি ডাকি।
– ওর নাম চিনি আগে বলেনি তো।
– শুধু আমি ডাকি। ওর বাবাও না। ও শুধু আমার চিনি।
– ও আচ্ছা। আসল কথায় আসি। আপনারা কী ধরিত্রীর বিয়ের কথা ভাবছেন?
– আমরা তো ভাবছি। ও তো ভাবছে না।
– আমি ওর সাথে কথা বলেছি। ইচ্ছে আছে। মানুষ পাচ্ছে না। ভয় ও আছে।
– তা তো থাকেই। আপনার চোখে কী কোনো ভালো ছেলে আছে?
– আছে। আমার ছেলে।
(চলবে)
#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট৪
#পিকলি_পিকু
ধরিত্রীর মা লুকিয়ে দেখা করতে এলো রুবাইয়ার সাথে। উনি রুবাইয়াকে দেখেই চিনলেন।
– ডক্টর রুবাইয়া?
– জ্বী। ধরিত্রীর মা?
– জ্বী।
– আপনার নাম?
– জোহরা জামান। জোহরাই ডাকে সবাই।
– নাইস টু মিট ইউ।
– আপনি আপনার ছেলের ব্যাপারে কী যেন বললেন।
– ও। আমি ধরিত্রীকে আমার ছেলের জন্য পছন্দ করেছি। দুজনকে মানাবে অনেক। এইটা আমার ছেলের ছবি। ও নিউরোকেয়ারে আছে।
– মানে? ডাক্তার?
– জ্বী।
– কীসের ডাক্তার?
– মস্তিষ্কের।
– ও! বয়স তো কম লাগছে।
– তিরিশ। কিন্তু আমার মনে হয় ওর এখন বিয়ে করা উচিত।
– ছেলে তো ভালো। মানে বেশ ভালো! আমার চিনিকে কী পছন্দ করবে?
– কেন করবেনা? একশো বার করবে। পছন্দ হয়েছে তাই তো বললাম। আমি আমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেই এসেছি।
– কিন্তু রুবাইয়া আপা, আপাই বলছি। আপনারা পুরো পরিবার ডাক্তার। আমার মেয়ে তো ডাক্তার না। আপনাদের কী একটা ডাক্তার বউ হলে হতো না?
– জ্বী, আমরা সবাই ডাক্তার। সবাই সারাদিন কাজের কথা বলি। কাজের বাইরে একটা জীবন আছে। ধরিত্রীর সাথে তো ভালোই লাগে। ওর চিন্তাধারা আমার খুব পছন্দ। আমার এমন একটাই মেয়ে চাই। আমার মেয়ের মতো। ডাক্তার ম্যাটার করে না।
– কিন্তু ও তো লেখালেখি করে, নারীবাদী। ওটা আপনার ছেলে জানে? এখনকার ছেলেরা এসব পছন্দ করে না।
– জানে। ও খুব ভালো করেই জানে। এতে ওর কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আপনার মেয়েকে আমার ছেলের কথা বলতেই বলল রাফসান ওর বান্ধবীর ছেলে। ও কোনো বান্ধবীর ছেলে কে বিয়ে করবে না।
– আমাকেও বলল।
– জ্বী?
– মানে আমি কিছু না। এমনি আপনার কোনো ছেলে আছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম। বেশী কিছু না।
– ঠিক আছে। আপনি ধরিত্রীর বাবাকে একটু বলবেন। দুজনে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওকে একটু বোঝান।
– চেষ্টা করবো।
জোহরা বাড়ি এসে তার স্বামী জামানকে রাফসানের কথা বলল। তারা দুজন সিদ্ধান্ত নিল কথা বলবে রুবাইয়া আর আফসারের সাথে। তাদের প্রাথমিক সাক্ষাতে পরিবার ভালোই মনে হলো। কিন্তু ধরিত্রী এর কিছুই জানে না। জামান সাহেব রাফসানের একটা ছবি দিয়ে বলল,
– পছন্দ হয়েছে কিনা দেখ।
– কী?
– একটা ছেলে দেখলাম।
– আমি বিয়ে করব না।
– পরিবার ভালো। মা বাবা দুজনেই চাকরিজীবী।
– তো?
– অনেক ফ্রি থিংকার। লাইক ইউ।
– ছেলে?
– ছেলেও বাবা মায়ের মতো।
– কী করে?
– ডাক্তার। নিউরোকেয়ারে।
– আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। এ ধরণের লোক বোরিং হয়।
– কে বলেছে। দেখা কর একবার।
রাফসানের খুব নার্ভাস লাগছে। নার্ভাসনেসে গলা শুকিয়ে আসছে। ধরিত্রী এখনো আসেনি। আজকে যাতে কোনো গন্ডগোল না হয় তাই সে একঘন্টা আগেই এসেছে রেস্টুরেন্টে। ফোন বাজতেই ঘাবড়ে উঠলো রাফসান। মীরা করেছে।
– হ্যালো।
– এসেছে? সামনে থাকলে কেটে দে।
– আসেনি।
– যাক। নার্ভাস হবি না একদম।
– চেষ্টা করছি।
– তোর সোয়্যাগ দেখাবি।
– ফালতু ভাবে যদি?
– কী কী বলবি?
– বলবো, তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ? তোমার মেডিকেল কোচিংয়ে আমি তোমার একটা ক্লাস নিয়েছিলাম। তুমি আমাকে ধাঁধা দিয়েছিলে। আমি উত্তর পারিনি।
– বাহ! এইভাবে বলবি আর মেয়ে পেছনের দরজা দিয়ে পালাবে। এসব কথা একটাও বলবি না।
– কেন?
– মেয়ে যদি তোকে না চিনে তো বলবি না। যদি বলিস তবে ছ্যাঁচড়া ভাববে।
– কেন?
– একটা ক্লাস নিয়ে ছাত্রীর প্রেমে পড়ে গেলি? পুরাই সাইকো। ক্রাইম পেট্রলে এমন হয়। রোমান্টিক সিনেমাতে না। একটা ক্লাসেই তোমার প্রেমে পড়েছি।
– আরে আমি ওভাবে প্রেমে পড়িনি। ওকে ওখানে দেখে ইন্টারেস্টিং লাগলো। তারপর ওর ফেসবুক পেলাম। ওর পোস্ট আমার ভালো লাগতো কিন্তু ও আমাকে ফলোয়ার বানিয়ে রাখলো আজীবন।
– ডক্টর রাফসান, আপনি কী ওনাকে ইনবক্সে কিছু লিখেছেন?
– মনে হয়।
– কী লিখেছিস?
– বিগ ফ্যান, আপনার পোস্ট ভালো লাগে।
– আরে ছাগল! ডিলিট কর। মেয়ে এখান থেকে গিয়ে যখন দেখবে তুই ওর পুরনো ফলোয়ার, অনেকটা স্টকার, নেগেটিভ ইম্প্রেসন পড়বে।
– এখন?
– আইডি ডিএক্টিভেট কর। এখনই। এই মুহুর্তে। ওকে? আর চাইলেও বলবি আই ডোন্ট ইউজ ফেসবুক। তখন ইন্টেল্যাকচুয়াল ইমপ্রেশন আসবে।
রাফসান আইডি ডিএক্টিভেট করতে করতে ধরিত্রী ঢুকলো। ধরিত্রীকে দেখে রাফসান তাড়াতাড়ি করতে লাগলো। ধরিত্রী বুঝতে পারলো এটাই রাফসান। ও টেবিলের কাছে এসে বলল, “রাফসান?” রাফসান ডিএক্টিভ অপশনে শেষ পর্যন্ত চেপে মাথা নেড়ে বলল, “জ্বী।” ধরিত্রী ওর সামনে এসে বসলো।
– ইম্পরটেন্ট মেসেজ থাকলে করতে পারেন।
– না। সমস্যা নেই।
– আমি ধরিত্রী, জাগরণ পত্রিকায় আছি।
– আমি রাফসান। নিউরোকেয়ারে আছি।
ধরিত্রী পড়েছে ফুল স্লিভ সাদা কূর্তি, সাদা চুড়িদার আর লাল সাদা ওড়না। কানে পড়েছে রুপালি ঝুমকো আর গলায় রুপালি নেকলেস। চোখে হালকা কাজল আছে। আর তার সাথে ছোট্ট বিন্দুর মতো কালো টিপটা খুব ভালো যাচ্ছে। ওর লম্বা চুল গুলো পেছনে ছেড়ে রেখেছে। ধরিত্রী ওর ডান হাত পেছনে নিয়ে অর্ধেক চুল সামনে আনলো। রাফসানের নিঃশ্বাস যেন এখানেই বন্ধ হয়ে গেল।
ধরিত্রীও রাফসানের আগাগোড়া ভালো করে দেখছে। ওর হেয়ার লাইন ভালো। বোঝাই যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি টাক পড়বে না। আর এটা জেনেটিক। চোখে মোটা চশমা হলেও ডান চোখের নীচের তিলটা চেনা। নাকটা চোখা আর ঠোট জোড়া সুন্দর। খুব মোটা বা চিকন নয়। গালে হালকা দাঁড়ি আছে। ফেসিয়াল স্ট্রাকচারও ভালো। সারাদিন রোগী দেখা ব্যস্ত ডাক্তার হিসেবে অনেক হ্যান্ডসাম। সাদা শার্ট আর ধূসর ব্লেজার টা সুন্দর। হাতে খুব দামি একটা ঘড়ি। অনেকটা ওর হাতের ঘড়িটার মতো। কিন্তু হাত আর হাতের আঙুল দেখে মনে হচ্ছে খুবই নার্ভাস ইনি। এসব পর্যবেক্ষণ করে ধরিত্রী মুখে হাত দিয়ে একটু মুচকি হাসলো। ওর হাসি দেখে রাফসান আরো বিচলিত হয়ে গেল।
– আপনি নিউরলাজিস্ট?
– জ্বী।
– আপনার বাবা?
– কার্ডিয়ালজিস্ট।
– মা নিশ্চয়ই গাইনোকলজিস্ট?
– জ্বী। কী করে বুঝলেন?
– আমি অনেক এলেমধারী। বুঝতে পারি। চোখের নীচের তিল দেখলে মায়ের নাম ও বলে দিতে পারি।
– জ্বী?
– রুবি। সে আমার অনেক ভালো বন্ধু। আপনি তো আমার বান্ধবীর ছেলে রাফসান। সারাদিন তো আপনার গল্প শুনি, কেন চিনবো না?
ধরা পড়ে গেছে তাহলে। মা বলেছিল আজকে ডেটের মধ্যে ওর ওপর একটা ইম্প্রেশন ক্রিয়েট করতে। আর প্রথমেই ধরা পড়ে গেল।
– আন্টি যে এত ডেডিকেটেড আমি জানতাম না। বাবা পর্যন্ত পৌঁছাবে বুঝিনি। আমার ডক্টর রাফসান শুনেই সন্দেহ হয়েছিল। আপনার চুল দেখে আঙ্কেল আর তিল দেখে আন্টির কথা মনে পড়ে গেল।
– তাই? ও হ্যাঁ, মায়ের ও একই জায়গায় তিল।
– আপনি একদম রুবির পুরুষ ভার্শন। যে কেউ আপনার মাকে দেখলে চিনবে আপনি কার ছেলে। ডুপ্লিকেট ডক্টর রুবাইয়া।
রাফসান দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে হাসছে। ধরিত্রী সব খেয়াল করেছে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ধরিত্রী বলল,
– আপনাকে কী জোর করে পাঠিয়েছে?
– না।
– বলতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না।
– সত্যি নিজের ইচ্ছায় এসেছি।
– আপনি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ কেন করবেন? তাও আবার মায়ের বান্ধবীকে?
ধরিত্রীর এই কথা শুনে রাফসানের অনেক রাগ হলো। এক সময়ে মনে হলো সে ভুল করেছে। মায়ের সাথে ওর দেখা করানোই উচিত হয়নি। রাফসান দাঁতে দাঁত চেপে আছে। ধরিত্রী আবার প্রশ্ন করে।
– আপনি অ্যারেঞ্জ মারেজ কেন করছেন?
– এমনি। কোনো কারণ নেই।
– আপনার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই?
– না।
– এক্স? ডোন্ট মাইন্ড, কিছু কী হয়েছিল যে একদম অ্যারেঞ্জ করছেন।
রাফসান অবাক হয়ে তাকালো। কী বলবে?
– সমস্যা থাকলে না বললেও চলবে। আসলে আমরা যে কারণে দেখা করছি, আমার মনে হয় আমার জানার একটু অধিকার আছে।
– জ্বী?
– আচ্ছা, তবে উঠি। আপনি বোধহয় ঠিক নেই।
ধরিত্রী ওঠার সময় রাফসান বলে উঠল,
– এমন কোনো কিছু নেই।
– তো?
– সবার এক্স থাকে না।
– তো আপনি এতদিন সিঙ্গেল ছিলেন!
ধরিত্রী কীভাবে যেন তাকালো রাফসানের দিকে। ওর সন্দেহ হচ্ছে। এরকম একটা ছেলে এতদিন সিঙ্গেল?
– জ্বী।
– কেন?
– কেন মানে কী? পাইনি কাউকে।
– আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনার মা বাবা সেই যুগে লাভ ম্যারেজ করলো আর আপনি এই যুগেও সিঙ্গেল।
– সমস্যা কোথায়? হতেই পারে।
– স্যরি স্যরি। কিন্তু এখন হঠাৎ কেন মনে হলো বিয়ে করা দরকার।
– মনে হলো।
– সত্যি করে বলবেন। আপনার মা আমার অনেক প্রশংসা করেছে? তাই না?
রাফসান চুপ করে আছে। ঘটনা তো উল্টো। রাফসান নিজেই প্রশংসা করেছে। এত প্রশংসা করেছে যে সবাই ওকে পছন্দ করে ফেলেছে। ধরিত্রী কখনো বুঝবে না ওর মনের কথা।
– প্রশংসা করেছে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে আপনি অনেক ভালো মানুষ। তাই দেখা করতে এসেছি।
– ও আচ্ছা।
ধরিত্রী আর রাফসান অর্ডার দিতেই ভুলে গিয়েছিল। এখন অর্ডার দেওয়ার পর।
– আপনার কেমন জীবনসাথী দরকার?
– আমার?
রাফসান ভাবতে থাকে। ভাবার অভিনয় করতে থাকে। ওর তো ধরিত্রীর মতোই জীবনসাথী দরকার। ধরিত্রীকেই দরকার।
– অনেক বিচক্ষণ। আন্ডারস্ট্যান্ডিং। অর্থাৎ আমার পেশার প্রতি সম্মান থাকতে হবে।
– ডাক্তারদের কারা অসম্মান করতে পারে?
– মানে, আমি তো ব্যস্ত থাকি। বুঝতে হবে ব্যাপারটা।
– মানে আপনি এটা বলতে চাইছেন যে আপনি আপনার স্ত্রীকে সময় দিতে পারবেন না।
– তেমন না।
রাফসান বিচলিত হয়ে গেল আবার। ধরিত্রী আবার হাসতে লাগলো।
– ডোন্ট ওরি। আই ওয়াস কিডিং।
– ইটস ওকে।
অনেকক্ষণ গল্প করার পর ওরা এবার উঠলো। রাফসান বাড়ি এসে কোনো কথা বলল না। ওর এখনো স্বপ্নের মতো লাগছে। ও ধরিত্রীর সাথে কথা বলেছে। মীরা ফোন করতেই কেটে দিলো। ওর এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। মীরার তো খুব রাগ হলো। মীরার চেহারা দেখে অঙ্কন বুঝলো কিছু গন্ডগোল। মীরার মন ভালো করতে অঙ্কন ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। মীরা যেন আরো বিরক্ত হয়ে গেল।
– কী হয়েছে?
– এমন করো কেন?
– আমার স্ত্রী তুমি। অধিকার।
– সম্পত্তি? ছাড়ো!
অঙ্কন আরো জোরে জড়িয়ে ধরলো।
– এতদিন দেশের বাহিরে ছিলাম। তোমাকে একদম আদর করতে পারিনি। এখন আসার পর কী রাগ করেছ?
– না। কোনো রাগ না অঙ্কন।
– আজ রাতে সব হিসাব মিটিয়ে দেব। সুদ সহ।
– অঙ্কন, ডোন্ট টাচ মি। কাল সকালে উঠতে হবে আমার।
– আজকে তবে ঘুমাতেই দেব না। একদম সকাল।
– ছাড়ো।
মীরা বিরক্ত হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে বলল, “মুড নেই বললাম যে বোঝ না!” অঙ্কন ওর জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। মীরা ওর ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ক্রীম মাখতে থাকে। অঙ্কন মন খারাপ করে ওর জায়গায় এসে শুয়ে পড়ে। একটু পর মীরাও শুয়ে পড়ে।
বর্তমান সময়,
মীরার এবার ঘুম ভাঙলো। ওর মাথাটা খুব ব্যথা করছে। ওর শরীরে ব্ল্যাঙ্কেট জড়ানো। মীরা আস্তে আস্তে নিজের মাথাটা ধরে উঠে বসতে গিয়েই দেখল ওর শরীরে কোনো বস্ত্র নেই। ঘাবড়ে মীরা ব্ল্যাঙ্কেটটা নিজের সমস্ত শরীরে জড়িয়ে নিল। হঠাৎ করে মীরা বুঝতে পারল ওর সামনে ধরিত্রী বসে আছে। নিস্তেজ দৃষ্টিতে ধরিত্রী ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। মীরা বুঝতে পারছে না ধরিত্রী ওর সামনে কী করছে? এটা কোন জায়গা? এটা তো ওর ঘর না। পাশে তাকাতেই দেখলো রাফসানের উদাম শরীর। মীরা চমকে উঠে নিজের মুখ চেপে ধরে ধরিত্রীর দিকে তাকালো। ধরিত্রীকে ওর জায়গা থেকে উঠতে দেখে মীরা জড়োসড়ো হয়ে বসলো। ধরিত্রী মেঝে থেকে মীরার জামা নিয়ে মীরাকে বলল, “এটা তোমার?” মীরা লজ্জায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। ধরিত্রী জামাটা এনে মীরার হাতে দিয়ে বলল, “পরে নাও। অনেকক্ষণ উদাম ছিলে।” মীরা মাথা নিচু করে জামাটা ওর হাতে নেয়। রাফসান এখনো ঘুমাচ্ছে। ধরিত্রী এই ঘুমন্ত রাফসানের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্য একটা মেয়ের পাশের রাফসান কী শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। আচ্ছা, ধরিত্রীর সাথে কী ও অনেক অশান্তিতে ছিল যে শান্তি খুঁজতে অন্য নারীর কাছে আসতে হলো।
(চলবে)