#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট ৫,০৬
#পিকলি_পিকু
০৫
“আমার ছেলেকে কেমন লাগলো?” রুবাইয়া প্রশ্ন করলো ধরিত্রীকে। ধরিত্রী গাছের থেকে ফুল পাড়ছিলো। প্রশ্ন টা শুনে হালকা হেসে বলল, “ভালোই।” রুবাইয়া ওর কাছে এসে দাঁড়াতেই ধরিত্রী থেমে গেল।
– ভালোই?
– মানে ভালো ছেলে। একদম তোমার মতো।
– আমার মতো?
– দেখতে তো তোমার মতো। আমি দেখতেই চিনলাম। প্ল্যানটা ভালোই ছিল।
– এখন?
– কী?
ধরিত্রী অন্যত্র তাকিয়ে রুবাইয়ার চোখকে অবহেলা করছে। রুবাইয়া তো ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়।
– পছন্দ হয়েছে?
– না।
– কেন? এই না বললি ভালো!
– ভালোই তো। ওর জন্য আরো ভালো মেয়ে পাবে।
– এসবের মানে কী ধরিত্রী! আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
রুবাইয়া এবার রেগে বসলো। ধরিত্রী রুবাইয়ার রাগ ভাঙাতে বলল,
– শোনো না, তুমি আর আমি কত ভালো বন্ধু।
– এতে সমস্যা কী?
– আমরা বউ শাশুড়ি হলে এসব থাকবে?
– কেন থাকবে না? বউ শাশুড়ি হলেই কী আমরা খারাপ হয়ে যাব?
– খারাপ না। আমাদের সম্পর্কটা এখন কত সুন্দর। বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এরপর আমি যখন তোমার ছেলের বউ হবো সেখানে মর্যাদা আসবে। একটা লেভেল লাগবে।
– এতে কী সমস্যা! মানুষ বউ শাশুড়ি বন্ধু হতে চায়। আর আমরা তো আগে থেকেই বন্ধু।
– এটাই তো সমস্যা। আমি তোমার সাথে বন্ধু হিসেবেই ফান করি। এই যে রুবি ডাকি। শাশুড়ি হয়ে গেলে তো সব সিরিয়াস হয়ে যাবে। তখন কী পারব?
– কেন পারবি না? কে বলেছে পারবি না?
– এখন তো মনে হচ্ছে না। যখন আমি তোমাকে পুরো পরিবারের সামনে রুবি বলে ডাকবো তখন ঠিকই মনে হবে।
– কিছুই মনে হবে না। বউ না, তুই আমার মেয়ে হবি।
ধরিত্রী বিষয়টা বোঝাতে পারছে না। এর জন্য ওর আরো খারাপ লাগছে। রুবাইয়া বুঝতেই চাইছে না।
– আমরা ফ্যামিলি হবো। সবাই আমাদের জাজ করবে না?
– তুই কবে থেকে সমাজের কথা ভাবছিস? চলে আয় আমার বাড়ি। আমার ছেলে তোকে খুব ভালোবাসবে। যেভাবে তুই চাস। আমাকে যদি এখন মানা করিস তো আমি আর কখনো তোর সাথে কথা বলব না।
ধরিত্রী ভেবে দেখে। হ্যাঁ বলেই দিল। রাফসান আসলো ওর মা, বাবা, চাচা, চাচি আর ভাইবোনকে নিয়ে ধরিত্রীদের বাসায়। বিয়ের তারিখ পাকা হবে। ধরিত্রীর মামা চাচা কাজিন সবাই এসেছে। রীতি অনুযায়ী ধরিত্রী শাড়ি পড়েছে। রাণী গোলাপি রঙের শাড়িতে ধরিত্রীকে পরীর মতো লাগছে। জোহরা আর জামান ওকে দেখে কেঁদেই ফেলল। মেয়ে এত বড় হয়ে গেল। আজ বিয়ের তারিখ পাকা হচ্ছে। আহসান আর রাশা ওদের ভাবিকে দেখতে ঢুকলো। আহসান আবার বলল, “ভাবি!!” রাশা ওকে আবার মার*লো। “এখনো বিয়ে হয়নি রে ছাগল।” ধরিত্রী হেসে বলল, “আচ্ছা সমস্যা নেই। ডাকতে পারো।” আহসান মন খারাপ করে বলে, “হান্ড্রেড পার্সেন্ট ভাবি হলেই ডাকবো। আমি আর রিস্ক নেব না।” আহসান সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। ভেতরের সবাই হাহা করে হাসতে লাগলো। এখন রুবাইয়া আর মাশরুফা ও ভেতরে আসলো। রুবাইয়া ধরিত্রীকে জড়িয়ে ধরলো,
– মাশাআল্লাহ! কী সুন্দর লাগছে। আমার হীরের টুকরো।
– শুধু টুকরো? বাকি হীরেটা কে?
– পুরো হীরেটা। হয়েছে?
ধরিত্রীর কথা শুনে ওর চাচি আর মামী হাসাহাসি করছে। এখনই তর্ক করছে শাশুড়ির সাথে। সামনে আর কী কী করবে কে জানে। ধরিত্রীর ওর মামীকে মুখ ভেঙচি দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল। মাশরুফা বলল, “তো, ভাবিকে কী বলে ডাকবে?” ধরিত্রী ভাবছে কী ডাকবে? রুবাইয়া বলল,
– মা ডাক।
– মা? কেমন শোনায় না?
– জোহরাকেও তো ডাকিস। আমাকে কী ডাকবি?
– মা বলতে অকওয়ার্ড লাগবে।
– পরে ডাকিস। কিন্তু আন্টি ডাকবি না।
ধরিত্রীর মামী বলল, “আপা কে তো জোহরা জাবি বলে ডাকিস। শাশুড়িকে কী ডাকবি ঠিক করেছিস?” খুব তাচ্ছিল্য করেই বলেছিল ওর মামী। এত ধৈর্য আর ওর হচ্ছে না। অতঃপর, “হ্যাঁ লবঙ্গ, রুবি ডাকি। অনেক আগে থেকেই। আর রুবি ডাকলেও ও তোমার মতো রেগে যায় না।” ধরিত্রীর মামী এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। ধরিত্রীর চাচি ওর মামীকে সামলে বলল, “ছি ধরিত্রী! বিয়ে করছো, এখনো ছোট নেই। কবে শিখবে ভদ্রতা?” “বিয়ে করছি বলেই কী পর করে দিচ্ছ লতিকা?”
রুবাইয়া আর মাশরুফা এই দৃশ্য দেখছে। কোনো একটা ঝামেলা অবশ্যই আছে। জোহরা আসতেই বুঝলো এরা দুজন আবার ধরিত্রীর পেছনে লেগেছে। ওরা বিয়ের দিন ও ওকে রাগাবে। ধরিত্রীকে সামনে নিতে হবে। সামনে এবার বর কনে কে একসাথে বসানো হয়েছে। আজকেই আঙটি পরিয়ে পাকা কথা হবে। আঙটি পরানোর পর সবাই হাততালি দিচ্ছে। এদিকে মাশরুফা গেলো ধরিত্রীর মামী আর চাচির কাছে।
– আপনি ওর চাচি?
– জ্বী।
– উনি মামী?
– জ্বী। আমরা দুজন বোন।
– আপন?
– জ্বী।
– লবঙ্গ?
ধরিত্রীর মামী আবার রেগে উঠলো। মাশরুফা একটু ভয় পেয়ে গেল। ধরিত্রীর চাচি একটু ভালো মানুষ। তিনিই বললেন, “ওর নাম লাবণ্য। আমার বড় বোন। আমার নাম লতা। ছোটবেলা থেকেই ধরিত্রী আমাদের লবঙ্গ লতিকা বলে খেপায়। দুইকূলে একমাত্র মেয়ে তো। ওর মামা চাচা কিছু বলতে দেয় না। আদর দিয়ে দিয়ে মাথায়, মানে রাজকন্যা করে রেখেছে। মামা চাচা দুজনেরই মা। ”
লাবণ্য বলল, “কী আর করবে, বোনের দশ বছর পর এই একটা মেয়ে। আর তো কেউ নেই। তার উপর অসুখ বিসুখ লেগেই থাকতো। কত জায়গায় কত মানতের পর ও হলো। এর চেয়ে বেশি জায়গায় মানতে ও বাঁচলো। সবার শুধুই ওকে হারানোর ভয়। জ্বর হলে সবাই নিউমোনিয়ার ডাক্তার খুঁজে। একটু ব্যথা পেলেও ওনারা কাঁদতে শুরু করে। আমরা যে ওকে অপছন্দ করি তা না। কিন্তু তর্ক একটু বেশি করে।” লতা লাবণ্যর হাত চেপে ধরল। “আরে না না। আসলে ও ছোট ছিল, আমাদের ও কম বয়স ছিল। আমরা ওদের পাশের বাসায় থাকতাম। আপা প্রেম করার সময় ধরিত্রী ধরিয়ে দিয়েছিল। হাহাহ! আপার শাশুড়ি ওকে বিয়ে করাবে না তাই কী কান্না। ” লাবণ্য রেগে বলল, ” শুধু আমি না তুইও ধরা পড়েছিলি। তোর শাশুড়িও তোকে বিয়ে করাবে না বলেছিল।”
দুই বোনের ঝগড়াতে মাশরুফা ফেঁসে গেল। ও সেখান থেকে চলে আসলো। এ বাড়ির আদরের মেয়ে এখন ওদের আদরের বউ হচ্ছে। ধরিত্রীকে ওর চাচা শ্বশুর আর চাচি শাশুড়ি উপহার দিলেন। সবার ওদের আশীর্বাদ শেষে ছবি তোলার প্রোগ্রাম শেষে রাফসান এলো ধরিত্রীর ঘরে। ওদের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজাটা টেনে দিল। ধরিত্রী ওর খাটে বসে আছে। রাফসান দাঁড়িয়ে আছে। সেদিন ওরা ক্যাফেতে কী স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেছিল। আজ কতো জড়তা। লজ্জায় ধরিত্রী একদম লাল লাল। রাফসানের দিকে তো তাকিয়েও দেখছে না। চোখটা নামিয়ে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর রাফসান গলা ঝাড়লো। ধরিত্রী ওর দিকে তাকালো। আজকে ওকে এভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখলো। এতক্ষণ বসেই ছিল। ভেতর থেকে অনেকবার চেষ্টা করেছে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে। পর্দার ফাঁকে হয় ডান পাশ দেখেছে নয় বাম পাশ। অর্ধেক অর্ধেকই দেখা গিয়েছিল। সাদা পাঞ্জাবি পায়জামাতে রাফসানকে মন্দ লাগছে না। খুবই সাধারণ আর স্নিগ্ধ লাগছে। পারিবারিকভাবে মেয়ে দেখতে আসলে কেউ এর বেশি সাজে না। রাফসানকে পর্যবেক্ষণ শেষে ধরিত্রী বলল,
– কিছু বলবেন?
– না।
– উমমম, এটা আমার ঘর। এটা বারান্দা। বারান্দাতে অনেক গাছপালা আছে। আমার গাছের অনেক শখ। সবই আমার পছন্দের গাছ। এদিকে জানালা। জানালা খুলে আমি লেখালেখি করি।
ধরিত্রী এসে ওর জানালা খুলে দিল। জানালা খুলতেই দমকা হাওয়ায় ধরিত্রীর জানালার সাদা পর্দা আর ওর চুল উড়তে লাগলো। রাফসান ওর দিকে তাকিয়ে আছে। “এই যে জানালা, এই জানালা দিয়ে অনেক আলো আসে। এর বিপরীতে আমি একটা আয়না রেখেছি। এ কারণেই ঘরটা অনেক আলোকিত থাকে। মাঝে মাঝে চাঁদের প্রতিফলন ও হয়।” রাফসানের মনে হলো ও যেন বাসা ভাড়া নিতে এসেছে। এভাবে এসব বলছে।
– কী?
– কিছু না।
– আপনার ঘরে এমন জায়গা হবে? আমার লেখালেখির জন্য এমন একটা পরিবেশ চাই। ন্যাচারাল। আচ্ছা, জানালা আছে?
– হ্যাঁ?
– জানালা, আয়না। এসব কিছু নেই?
রাফসান চুপ করে আছে। আয়না তো শুধুই ড্রেসিংরুমে। ঘরের মধ্যে নেই। বারান্দা আছে কিন্তু, গাছ নেই। জানালার অবস্থানও এত ভালো নয়। তাই বেশির ভাগ সময় ও বন্ধ রাখে।
– কী হলো?
– কিছু না।
ধরিত্রী ওর হাত পেছনে বেঁধে রাফসানের দিকে আস্তে আস্তে আগাতে থাকে। রাফসান বেচারা বুঝতে পারছে না ধরিত্রী এমন কেন করছে। ধরিত্রী আসতে আসতে রাফসানের অনেক কাছে এসে বলে,
– ঘরটা আমার দেখতে যাওয়ার কথা। আমি সেখানে শিফ্ট হবো। কী আশ্চর্য ব্যাপার! আপনি দেখতে এসেছেন।
– তো, আসুন না। দেখে যান।
– না থাক। দরকার নেই। আপনার চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছি।
– কী পেরেছেন?
– মনে হচ্ছে এসবের কিছুই নেই।
– সমস্যা নেই। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
ধরিত্রী রাফসানের দিকে তাকিয়ে আছে। রাফসান এখনো ভয় পেয়ে আছে। ভয়ে একদম নিঃশ্বাস আটকে আছে। এত ভয় পায় কেন? ভীতু! মদন! রুবির ছেলে একদম রুবির মতো না। ধরিত্রী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। রাফসানের দাঁড়িয়ে আফসোস করা ছাড়া কিছুই করার থাকে। ক্রাশের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিশ্বাস তো হওয়ার কথা না।
“শালা! তারিখ পাকা করলি, বললি পর্যন্ত না।” মীরা রাগে ফুঁসছে। রাফসান চুপ করে আছে। ও একদম কিছুই মীরাকে বলেনি।
– এতবড় স্বার্থপর তুই!
– স্যরি দোস্ত। ও হ্যাঁ বলছিল না প্রথমে। লজ্জা পেতে পারি তাই বললাম না। হ্যাঁ বলল আর মা দেরি করল না। তারিখ পাকা করে ফেলল।
– আমাকে বললি না কেন?
– কাল ফোন দিয়েছিলাম তো। ধরিসনি।
– ওটা তো আমি রাগ করেছিলাম।
– এখন কী আমার দোষ?
অঙ্কন এসে দেখল মীরার মন খারাপ।
– কী হয়েছে?
– রাফসান শালাটা বিয়ে করছে।
– এটা তো খুশির খবর। কষ্ট পাচ্ছ কেন?
– কেন পাব না? আমার বেস্টফ্রেন্ড বিয়ে করছে আর ওর বউ আসতে না আসতে আমাকে ভুলে গেল।
– কী করেছে?
– ডেট পাকা করলো, আর বলল ও না। ওটা তো আমি ধরিত্রীর ফেসবুক থেকে জানলাম।
– ধরিত্রী কে?
– ওর বউ। মানে হবে যে। মুডটাই খারাপ করে দিল।
মীরা মেজাজ খারাপ করে চুল বাঁধতে লাগলো। অঙ্কন বুঝতে পারছে মীরার খারাপ লাগার কথা। কিন্তু এত খারাপ কেন লাগবে? ও মাঝে মাঝে বোঝে না মীরা আর রাফসান কে। ওরা কী আদৌ বন্ধু?
দেখতে দেখতে ওদের বিয়ের তারিখ ঘনিয়ে আসলো। প্রস্তুতি চলছে জোরে সোরে। রাফসানের ঘরটা যেন ভেঙে সাজিয়েছে। সবই বদলে ফেলেছে ওরা। ড্রেসিংরুমে দুটো ক্লোসেট। ড্রেসিংটেবিল ও একদম ধরিত্রী অনুযায়ী সাজানো হয়েছে। দুজন দেখার মতো আয়না লাগিয়েছে। আর জানালা, জানালার অবস্থান এত ভালো না। সেখানে টেবিল রাখা যাবে না। তাই সত্যি সত্যি রাফসান এর বিপরীতে একটা আয়না দিয়ে আয়নার সামনে টেবিল রাখলো। যাতে জানালার প্রতিফলনটা অন্তত আসে। সেই আয়না থেকে সেকেন্ড হ্যান্ড আলোতেই ধরিত্রী লিখবে।
মীরা আসলো রাফসানের বেডরুমের নতুন সাজসজ্জা দেখতে। “ওয়াও! এটা তোর ঘর? এত আলোকিত?” রাফসান লজ্জা পেল। “তোর রুমে না তুই কালো পর্দা দিয়ে কবরস্থান বানিয়ে রাখতি। ” মীরা এবার গেল বারান্দায়। ছোট ছোট গাছ দিয়ে ওর বারান্দা সাজিয়েছে। এই সব গাছের মাঝখানে একটা দোলনা। দোলনাতে শুধু একজনই বসতে পারবে। মীরা গিয়েই সেখানে বসে দোল খেতে লাগলো।
– আমার তো এখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করছে।
– তুই কী গরীব নাকি! অঙ্কন ভাইয়ের এত টাকা, বললে তোকে এরকম একটা ফ্ল্যাট এখনই কিনে দেবে।
– ওকে বলে তোর ঘরটাই কিনে নেব। তখন থাকিস পথের উপর। তুই আর ধরিত্রী। আমি এখান থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব।
রাফসান কিছু বলল না। মীরা দোলনায় বসে ঘুরতে ঘুরতে বলল,
– পানি দিবি গাছগুলোয়? এই, সময় হবে তোর?
– ধরিত্রীর গাছ আছে ওখানে। ওর জন্যই রেখেছি।
– ও দেবে পানি?
– ও অনেক যত্ন নেয়। ওর পোস্টে দেখেছি।
– তুই ওকে সবসময় স্ক্রিন থেকে দেখেছিস তাই না?
– হ্যাঁ। সেজন্যই বিশ্বাস হচ্ছে না এখনো যে ওকেই বিয়ে করছি।
– ধরিত্রী যদি তোর ফোনের স্ক্রিনে দেখা মেয়েটার মতো না হয়?
রাফসান মীরার দিকে মন খারাপ করে তাকায়। মীরা মজা করছে না।
– ও ওরকমই। মা ও দেখেছে।
– তোর সাথে যদি না হয়। ধর, ও তোকে ভালোইবাসলো না? এত আশা, এত ভালোবাসার কী হবে?
(চলবে)
#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট৬
#পিকলি_পিকু
রাফসান আর ধরিত্রীর বিয়ের দিন। খুব সোরগোল হচ্ছে। রাফসানকে তৈরী করছে ওর চাচা আর অন্যান্য কাজিনেরা। ওর খালাতো ভাই ওর পাগড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। সবাই যেন ওকে চেপে ধরেছে। ওর মামা বলছে মালা টা এখনই পরতে। আর চাচা বলছে মালা ওখানে গিয়ে পরতে। বেচারার সাফোকেশন হচ্ছে। এদিকে মাশরুফা আসলো রাফসানকে দেখতে।
“মাশাআল্লাহ! ছেলেটাকে কী সুন্দর লাগছে। বলিউডের হিরো একদম।” রাফসান একদম লজ্জা পেয়ে গেল। কিন্তু ওর মা কোথায়? বাবাও এসেছে। মা কোথায়?
মা তো ভিডিও কলে ধরিত্রীকে দেখতে ব্যস্ত। ধরিত্রী বিয়ের পোশাক পরে রুবাইয়াকে ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে। পেছন থেকে মাশরুফা এসে বলল, “আর তো কয়েক ঘন্টা। ধরিত্রী তো এখানেই আসছে। সারাজীবন দেখবে। এখন ছেলেটা অপেক্ষা করছে।” রুবাইয়া ফোন রেখে গেল রাফসানের কাছে। সেখানে সবাই হাসাহাসি করছে।
“রুবাইয়া মেয়ে আনতে যাচ্ছে বলে বলে ছেলে কে একদম পর করে দিয়েছে। রাফসান এখন নিজের ঘরেই ঘরজামাই হয়ে যাবি।”
কথাটা শুনে রাফসানের মন খারাপ হয়ে গেল। রুবাইয়া ওর দিকে তাকিয়ে রাগ করতে বারণ করলো।
“আমার ছেলে একদম রাজপুত্র। রাজকন্যা আনতে যাচ্ছি ওর জন্য। দেখি রাজপুত্র, একটু হাস তো।”
রাফসান হাসতে হাসতেই বিয়ের ভেন্যুতে গেল। সেখানে ধরিত্রীর বন্ধুরা গেট ধরে কিছু টাকা নিয়ে গেল। স্টেজে যেতে কত কাহিনী। এসব রাফসানের একদম পছন্দ না। কখন ধরিত্রী আসবে? ওকে এখনো দেখতে পারছে না। রুবাইয়া রাফসানের কাছে আসতেই রাফসান বলল,
– মা, ধরিত্রী কখন আসবে?
– আসবে। একটু পরেই আসবে।
– ওকে কেমন লাগছে? আগে আগেই তো দেখলে।
– অনেক সুন্দর লাগছে। একটু পরই তো দেখবি।
রাফসানের আর তর সইছে না ধরিত্রীকে বধূবেশে দেখতে। একটু পর ধরিত্রী আসছে। মেরুন লেহেঙ্গায়। কী দারুন লাগছে! রাফসান উঠে দাঁড়িয়ে গেল। ধরিত্রী রাফসানের দিকে তাকাচ্ছে না। সে চোখ নামিয়ে হাঁটছে। রাফসান তো ওদিকেই তাকিয়ে আছে। অবশেষে ধরিত্রী তাকালো ওর দিকে।
পাশ থেকে কে যেন বলল, “রাফসান বিয়ে অনেক জলদি করে ফেলল না? একদম হুট করে। এত তাড়াহুড়ো করে করে নিল।”
রাফসান একদম তাড়াহুড়ো করেনি। অনেক সময় নিয়েছে। অনেক সময় নিয়ে বিয়ে টা করেছে।
“Wise men say
Only fools rush in
But I can’t help falling in love with you
Shall I stay?
Would it be a sin
If I can’t help falling in love with you?
… Like a river flows
Surely to the sea
Darling, so it goes
Some things are meant to be
… Take my hand
Take my whole life too
For I can’t help falling in love with you”
ধরিত্রী এসে রাফসানের পাশে বসলো। একটু পর কাজী সাহেব আসলেন। ধরিত্রীর বাবা আর রাফসানের বাবা ও ছিল। কাজী ধরিত্রীকে কবুল বলতে বলল। ধরিত্রী বলল না। রাফসানের হঠাৎ খুব ভয় লাগলো। এই বিয়ের আসরে যদি না বলে দেয়? ও ঢোক গিলছে। ধরিত্রী কবুল বলতেই কেঁদে উঠলো। ওর বাবা ওর হাতটা ধরে রেখেছে। মেয়েটা আজকে নিজের বাড়ি চলে যাবে। মেয়েরা এমনই হয়। ধরিত্রীর বাবাও কেঁদে উঠলো। অবশেষে বিয়েটা হয়ে গেল। ধরিত্রী আর রাফসান এখন স্বামী স্ত্রী। রাফসানের নামের পাশে এখন ধরিত্রীর নামটা সারাজীবনের জন্য লেখা হয়ে গেল।
“কংগ্র্যাটস্ পুত্রবধূ। ” রুবাইয়া এটা বলেই হেসে উঠলো। ধরিত্রী ও হাসতে হাসতে বলল, “থ্যাংকস শাশুড়িমা।” রাফসান তাকিয়ে আছে। এখনো ওনারা ওনারাই কথা বলছে। ওর সাথে বলছে না।
মীরা এখনো আসেনি। বিয়েটা হয়েই গেল। ও কী রাগ করেছে? আশ্চর্য! রাফসানের কাজ ছিল তাই সে মীরার বিয়েতে যেতে পারেনি। এখন কী মীরা এত বছর পর তার বদলা নেবে? এসব ভাবতে ভাবতেই মীরা আসলো। খুব সুন্দর লাল কালো শাড়িতে একদম হুর যেন। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। একেবারে সবাই। মীরার খোপার লাল গোলাপ আর লাল লিপস্টিকে ওকে যা মানিয়েছে না। মীরা দৌঁড়ে এসে স্টেজে উঠলো। রাফসান আর ধরিত্রীর কাছে। “কীরে শালা! আমার জন্য অপেক্ষা করলি না? আমাকে রেখে বিয়ে করে নিলি?” ধরিত্রী মীরার দিকে তাকিয়ে খুব অবাক হলো। রাফসান দাঁড়াতেই মীরা ওকে বসিয়ে রাফসানকে চেপে ধরিত্রীর দিকে পাঠালো। এরপর নিজেই বসে পড়লো রাফসানের পাশে। রাফসান অপ্রস্তুত হয়ে ধরিত্রীকে বলল, “ও হচ্ছে আমার বেস্টফ্রেন্ড, মীরা।”
“ডক্টর মারজান মোস্তাফা!” ধরিত্রীর মুখে এই কথা শুনে মীরা কপাল কুঁচকে নিল।
– তুমি কী করে জানো আমার ভালো নাম?
– আপনার মনে আছে? আপনি একটা মেডিকেল ভর্তি কোচিংয়ে পড়াতেন।
– হ্যাঁ।
– সেখানে একবার ক্লাস করেছিলাম আপনার।
– সত্যি! আমাকে মনে আছে? কেন? বকেছিলাম?
– না, পেরেছিলেন। আমার ধাঁধার উত্তর।
– তাই?
– আপনার হয়তো আমাকে মনে নেই। কিন্তু আমার আছে। আপনার সোস্যাল মিডিয়াতে কত খুঁজেছি। এই নামে তো পাইনি।
– সোস্যাল মিডিয়াতে আমি মীরা মোস্তাফা।
– ওহ! নাইস টু মিট ইউ। আপনার সাথে আবার দেখা হবে আমি ভাবতেও পারিনি।
ওরা দুজন রাফসানকে এমন ভাবে ইগনোর করছে যেন রাফসান এখানে নেই। তবে এই কারণেই মীরা এই ধাঁধার উত্তর তখন পেরেছিল? একটু পর রাফসান গলা ঝাড়লো। নিজের অস্তিত্বের জানান দিলো। মীরা বলল,
– আরে, তুই ও আছিস?
– আমি থাকবো না?
– আরে চল ছবি তুলব।
– অঙ্কন ভাই কোথায়?
– সিঙ্গাপুর।
মীরার চেহারাতে বিরক্তি দেখা যাচ্ছে। রাফসান আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না। রাফসান মাঝখানে, বউ আর বেস্টফ্রেন্ডকে দুই পাশে রেখে ছবি তুলল। স্টেজের দিকে তাকিয়ে মীম আর রিমা মুখ বিকৃত করল। মীম আর রিমা হলো রাফসান আর মীরার স্কুলের বন্ধু। যদিও ওদের রাফসানের সাথে খুব একটা যোগাযোগ নেই, কিন্তু একটা দাওয়াত পেয়েই ওর বিয়ে দেখতে এসেছে। মীম রিমার দিকে তাকিয়ে জোর করে হেসে বলল,
– দেখেছিস, এক পাশে বউ, আরেক পাশে গার্লফ্রেন্ড। এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি।
– গার্লফ্রেন্ড না। এক্স। মীরার ও লজ্জা শরম হলো না। রাফসানের বউ এসব মানবে?
– এখন তো ভালো বন্ধু মনে হচ্ছে। পরে দেখা যাবে। আমি ভাবলাম রাফসান যেমন মীরার বিয়েতে যায়নি, তেমনি মীরাও আসবে না।
– রাফসান আসেনি?
– না। শুনেছি হাত পা কে*টে হাসপাতালে ছিল।
মীম রিমার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, “সুই*সাইড অ্যাটেম্পট!” রিমা মুখে হাত দিয়ে “হাহ!” করে উঠল।
– এত প্রেম!
– জ্বী। কিন্তু মীরা তো বিয়ে করে নিল ধনীর দুলালকে।
– রাফসানরা কী গরীব নাকি?
– অঙ্কনদের মতো না। কাজী হেল্থ কেয়ার কত বড় জানিস? বাংলাদেশের ওয়ান অফ দ্য রিচেস্ট! চাইলেই সব ডাক্তার কিনে নিতে পারে। আর মীরা কিনা ওকে ছেড়ে এই একটা ডাক্তার ধরবে?
– তাও ঠিক।
– বাই দ্য ওয়ে, এত বছর পর তুই এলি কেন?
– রাফসানের বউ দেখতে। আমার চেয়ে সুন্দরী কিনা।
– কেন রে দুই বাচ্চার মা?
– তুই জানতি না?
– রাফসান তোর ক্রাশ ছিল? আমি জানি। সবারই ছিল। শুধু ঐ মীরার ভয়ে ওর কাছে ধারে যেতাম না।
– মীরা তো ওর বেস্টফ্রেন্ড ছিল। সেই ভেবে কত লাভ লেটার মীরার কাছে দিয়েছি রাফসানকে দেওয়ার জন্য। প্রতিবার উত্তর একটাই। না!
– ঐ সব লেটারের উত্তর কী আদৌ রাফসান দিত?
“না! আমি দিতাম!” মীম আর রিমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চমকে দিল মীরা। ওরা দুজন তো ভূত দেখার মতো হয়ে আছে। মীরা কী সব শুনেছে?
“আজকে যেহেতু রাফসানের বিয়ে। আমি একটা কনফেস করবো। তোরা সবাই যে রাফসানকে চিঠিপত্র দিতি, আমি সব নিজের কাছে রেখে দিতাম। একটাও ওর কাছে যেত না। আর আমিই তোদের জবাব দিতাম।”
মীম আর রিমা খুব রেগে আছে। ওদের চেহারা দেখে মীরা খুব আনন্দ পাচ্ছে। মীম রেগে বলল, ” এমনটা কেন করতি মীরা?” মীরা হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে বলল, “ওকে তোদের থেকে বাঁচাতে। আর মীম, তুই যে ওর বায়োলজি বইয়ের ভেতর চিঠি ঢুকিয়ে দিয়েছিলি, ওটাও ও দেখেনি। সেটাও আমি দেখেছিলাম। এখনো অপেক্ষা করছিস না উত্তরের?” এই বলে মীরা হাসতে থাকে। কিন্তু এসব শোনার পর মীমের খুব ইচ্ছে হলো মীরার গালে কষিয়ে দুটো চ*ড় লাগাতে। ওর কোনো অধিকার নেই ওদের অনুভূতি নিয়ে খেলার। রাফসানের জবাব না পেয়ে মীমের এত খারাপ লাগেনি যতটা আজ এসব শোনার পর লাগছে। রিমা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তখন যে কেন ম্যাসেঞ্জার ছিল না।” মীম রিমার কাঁধে হাত রেখে বলল, “থাকলেও লাভ নেই। পাসওয়ার্ডটাও ও নিয়ে রাখতো।” ওদের চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ওরা খুব কষ্ট পেয়েছে। মীরা ওদের চেহারা দেখে নিজের হাসি থামিয়ে বলল, “তোরা কী মনে করেছিলি, আমি জানি না। আমি জানি তোরা কেন রাফসানকে চিঠিপত্র দিতি। ওর রেজাল্ট ভালো সেজন্য না? ও তোদের বয়ফ্রেন্ড্ হলে তোরা ওকে ইউজ করতি। এরপর ব্যবহার শেষে ফেলে দিতি। ”
“একদম না। আমি রাফসানকে মন থেকে ভালোবাসতাম। ওর আচরণ আমাকে আকৃষ্ট করতো।” রিমা দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল। ” ঠিক। রাফসানের মতো সচ্চরিত্রবান ছেলে লাখে একটা। আমার ও ওকে সেজন্যই ভালো লাগতো।” মীম ও সুর মেলালো। মীরা ওদের দিকে চোরের মতো তাকিয়ে আছে।
“এখন যেটাই বলিস, সত্যি এটাই। ও খুব ভালো ছাত্র ছিল। তোরা সেজন্যই ওর পেছনে ঘুরতি। ওর মতো ছেলের সাথে ভবিষ্যত জড়ানো মানে ভবিষ্যত সেট। আর ওকে দূর থেকে দেখে কতই বা চিনেছিলি।”
মীরার এই উত্তর শুনে মীম বা রিমা কেউই খুশি নয়। রিমা ওর সাথে তর্কে জড়াতে না চাইলেও মীম ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। সে ও ঘুরিয়ে জবাব দিল, “কাছে যেতে পারলেই তো বুঝতাম। যেতে দিলি কখন? কেন এত পসেসিভ ছিলি? বিয়ে তো ঠিকই মায়ের পছন্দে করলো। তোকে জিজ্ঞেস করেছে?”
মীরা জোর করে হেসে বলল, “আমাকে করেছে কী করেনি তা তোকে কে বলল?”
রিমাও এবার জবাব দিল, “যদি করেও থাকে এখন তো আর তোর আঁচলে বাঁধা নয়। বউ এসে গেছে। অঙ্কনকে না হয় ভুজুংভাজুং বুঝিয়েছিস। মেয়েটা বুঝবে? দেখব, আর কয়দিন থাকিস, ওদের মাঝে।”
“আমি ওদের মাঝখানে না, রিমা।”
” ধরিত্রী তোমাদের মাঝখানে? দেখো মীরা, ভালো হয়ে যাও। বিয়ে করেছ ছয় বছর। একটা বাচ্চা নিয়ে নাও। সংসারে মন দাও। স্বামী তোমার বেশি বেশি বিদেশ ভ্রমণ করে। এসব কী ভালো দেখায়? এখনো যদি মন না দাও সংসারে অনেক দেরি হয়ে যাবে। রাফসান ও সংসারে মন দিয়ে ফেলবে।” মীম এই কথা বলতেই রিমা হাসতে হাসতে বলে, ” ঠিক। পরে দেখা যাবে, এ কূল ও নেই, ঐ কূল ও নেই।” মীম আর রিমার হাসির সাথে রাধা ও যোগ দেয়। “আরে মীরা, আর ইউ ওকে?” মীরা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মীম আর রিমা হাসিই থামাতে পারছে না। রাধা আবার বলল, “আমি এই বিয়েতে এসেছি শুধু তোকে দেখতে। এরকম গোমড়া মুখ নিয়ে কেন এসেছিস?” মীরা জোর করে হেসে বলল, “আমার মুখ গোমড়া তোকে কে বলল?” মীম তাচ্ছিল্য করে বলল, “দেখতে তো পারছে। রাধা অন্ধ তো নয়।” রিমা মীমের হাতে তালি দিয়ে বলল, “এত সুন্দর দৃশ্য আর কখনো দেখিনি। রাধা এখানে, মীরা এখানে। আর , ”
“আর কানাই রুক্মিণী কে নিয়ে ওখানে। ” রাধা এই বলে হাসতে থাকে। তিনজনের হাসি দেখে মীরা ওদের সঙ্গ ত্যাগ করে। মীরা যেতেই রাধা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “এত নির্লজ্জ মানুষ আমি কখনো দেখিনি।” রিমা বলল, “তোর না বেস্টফ্রেন্ড ছিল?” “বেস্টফ্রেন্ড না ছাঁই। আমি যখন রাফসানকে কনফেস করতে চাইতাম ও আমাকে বারণ করতো। ও যে সবার লেটার ফেলে দিত আমি জানতাম।”
মীম বলল, “আমাদের তো বলিসনি।” “আমি ভেবেছিলাম যত কম লেটার ও পাবে তত কম্পিটিশন কম। তাই আমি মীরাকে আমার লেটার দেইনি। সামনাসামনি বলতে চেয়েছিলাম। আমি বলতে চাইলেই থামিয়ে দিত। নানা বাহানা মারতো। আর রাফসান যখন বলত ওর গার্লফ্রেন্ড দরকার, মীরা ওকে ডিস্কারেজ করত যে তোর এই সমস্যা ঐ সমস্যা। মেয়েরা এমন ছেলে পছন্দ করে না হ্যান ত্যান। সারাজীবন রাফসান ভেবে এসেছে কোনো মেয়ে ওকে পছন্দই করেনি। কেউ ওকে ভালোবাসেনি। বাস্তবে তো চিত্র ভিন্ন। আমিও ভাবতাম ভালোই তো। ও জানুক কেউ ওকে ভালোবাসেনি। আমি বললে হয়তো ও রাজি হয়ে যাবে। এদিকে মীরা আমাকে এটা সেটা বুঝিয়ে চুপ করিয়ে দিত। কিন্তু ভার্সিটিতে পড়াকালীন আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। রাফসানের সাথে দেখা করতে একদিন আমি ডিএমসি চলে যাই। ভ্যালেন্টাইন্স ডে ছিল সেদিন। আমার কী হলো জানি না, আমি ওকে ভালোবাসি বলে দিলাম। ও আমাকে কিছুই বলেনি। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। জানি না সেটাই হয়তো প্রথমবার কেউ ওকে বলেছিল ভালোবাসি। বেচারা এতদিন তোদের কারো কনফেস লেটার পায়নি। তোরাও যে কেন মীরাকে লেটার দিতি। ডিরেক্ট বলতে পারতি না।”
মীম তাচ্ছিল্য করে বলল, “কে বলছে এসব? তোরা যেভাবে গার্ড দিতি ওকে। এরপর কী হলো?” “পরদিন মীরা এসে আমাকে শুনিয়ে গেল রাফসান মুসলিম, আমি হিন্দু। এসব সম্ভব না। শুধুই টাইম পাস। রাফসান ডাক্তার হবে। আমি যাতে ওর ফিউচার নষ্ট না করি। আমার ও ফিউচার আছে। আই ডিডেন্ট কেয়ার আবাউট দ্যাট। আমি ওর কাছ থেকে শুনতে চাইছিলাম। রাফসান কী উত্তর দেয়। হিন্দু, মুসলিম, ডাক্তার, ফিউচার আমার মাথায় কিছুই ছিল না। আমি রাফসানের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু মীরা আমাদের একা ছাড়ছিলই না। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর রাফসান ও একই কথা বলল। ওর শিখিয়ে দেওয়া বুলি। হিন্দু মুসলিম ব্লাহ ব্লাহ! সেদিন আমি বুঝেছিলাম মীরা কতটা টক্সিক। খুব ঝগড়া হয়েছিল সেদিন। আর এটাও বুঝেছিলাম যে মীরা ওর মাথাটা খেয়ে নিয়েছে। যদি কোনোদিন ও ওর আর আমার কিছু হয় ও, মীরা ওর পরিবারকে হলেও এসব বোঝাবে। আমাদের কিছু ও হতে দেবে না। নো ফিউচার। সত্যিই টাইম পাস। যদিও আমার টাইমপাসের ইচ্ছা ছিল না। আজ এত বছর পর আমি রাফসানকে দেখতে এলাম। আজ আমার মেয়ে আছে। আমার স্বামী অভিরূপ আমায় খুব ভালোবাসে। তোদের ও দেখছি। আমরা তো সেটেল। বাট আমি চাই ওর বউ যাতে ওকে মীরার ছত্রচ্ছায়া থেকে বের করতে পারে। ও যাতে শান্তিতে বাকি জীবনটা কাটায়।” রিমা রাধার কাঁধে হাত রেখে বলে, “আমি ও চাই।” রাধা মুখে হাসি নিয়ে বলে, “আজ আমি সত্যিই মীরাকে দেখতে এসেছি। ওর চেহারা দেখে ভালোই লাগলো। আর রাফসানকে হাসিখুশি দেখেও।”
“কত সুন্দর, আবার কত বেদনাদায়ক এই দৃশ্য। আমরা এমন একজনের বিয়েতে এসেছি যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। ” মীম এই কথা বলার পর ওরা তিনজন ধরিত্রী আর রাফসানের দিকে স্টেজে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওদের সবার এক সময়কার স্বপ্নের রাজকুমার আজ অন্য কারো সাথে। অন্তত মীরার সাথে নয়। এটাই সান্ত্বনা।
মীরাও একপাশে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ওদের দেখছে। সত্যিই কী ধরিত্রী ওকে রাফসান থেকে আলাদা করে দেবে? রাফসান কী ওর অপরিচিত হয়ে যাবে? এত যুগের বন্ধুত্বের কী অবসান হবে?
(চলবে)