#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট ৭,০৮
#পিকলি_পিকু
০৭
“আহ! ব্যথা লাগছে তো! আস্তে! আহ!”
রাফসান হাত সরিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বাইরে থেকে কারো খিলখিল হাসির আওয়াজ আসছে। ধরিত্রী ও সাবধান হয়ে গেল। রাফসান আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে দরজা খুলে দেখলো ওর সব কাজিনরা আর মীরা কান পেতে আছে। রাফসানকে দেখতে পেয়ে সবাই ভয়ে এদিক ওদিক দৌঁড়াতে লাগলো।
“এসব কী অসভ্যতামি!” রাফসান গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলো। ধরিত্রী ঘাড় উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। রাফসান খুবই বিব্রত। এসব এখন কেউ করে নাকি। একটু পর মীরা এগিয়ে এসে রাফসানকে ইশারা করে বলল, “আহ! খেলাধুলা শুরু করে দিয়েছিস?” রাফসান কিছু করতে পারছেনা। নতুন বউয়ের সামনে মান সম্মান আর রইলোনা। রাত দুটো বাজে। বেচারি ঘুমে শেষ। কিন্তু মাথার খোঁপাটার জন্য ঘুমাতে পারছে না। একটু পর রুবাইয়া এসে বলল,
– দরজা খুলে বাইরে কেন দাঁড়িয়ে?
– মা, আসো না। ধরিত্রীর মাথার ক্লিপ আর এই খোঁপা আমি খুলতে পারছি না।
– তাই বের হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবি?
– এরা সবাই দরজায় কান পেতে ছিল। আজেবাজে কথা বলছে।
রুবাইয়া সবার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙলো। সবাই সবার জায়গায় চলে গেল। রুবাইয়াকে সবাই একটু হলেও ভয় পায়।
– কিন্তু বাবা, এখন তো বাসর রাত। তোমার বাসর ঘরে আমি কী করে ঢুকবো?
– অন্য কাউকে পাঠাও।
মীরা এগিয়ে এসে বলল, “আমি আসছি।” রুবাইয়া সাথে সাথে বলল, “না মীরা! ওকে করতে দাও। ওর ঘরে ঢুকবে না। বিয়ের রাতে এটাও একটা পরীক্ষা।” রুবাইয়ার কড়া আদেশ শুনে রাফসান ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। ধরিত্রী এখনো চুল খোলার চেষ্টা করছে।
– কেউ আসলো না?
– না। মা বলেছে আমাদেরই করতে হবে।
– পারবেন?
– চেষ্টা করি।
ধরিত্রীকে স্টুলে বসিয়ে রাফসান একটা একটা করে ক্লিপ খুলছে। আর ধরিত্রী, “আহ! ব্যথা! ব্যথা!” করছে। এখন ক্লান্ত হয়ে সে রাফসানের পেটে মাথাটা এলিয়ে দিল। রাফসান কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল। এরপর আবার ক্লিপ খুলতে লাগলো।
– এসব করার দরকার কী? আপনার চুল তো সুন্দর। এমনি ছেড়ে আসলেও হতো।
– এক গাদা ক্লিপ আর স্প্রে করে এই খোঁপা না করলে বউ বউ লাগে না।
– তাও। এসব তো অত্যাচার। আপনি না ফেমিনিস্ট? আওয়াজ তোলেননি কেন?
– আগে কী বিয়ে করেছি? আর এসবে ফেমিনিজমের কী আছে? কালচার এটা। ওয়েস্টার্ন বিয়েতে তো করে না। আহ!!!
রাফসান ঘাবড়ে উঠলো। ধরিত্রীর চিৎকারটা অনেক জোরে ছিল।
– লাগেনি তো।
– লাগেনি মানে? যুদ্ধ করছেন? এটা চুল আমার। ছুরি তলোয়ার নয়।
– স্যরি। স্যরি।
– সরান হাত!
প্রথম দিনেই রাগিয়ে দিল বউকে। বাসর রাতে মানুষ নাকি বিড়াল মা*রে। ও তো মনে হচ্ছে বউ মা*রছে। ড্রেসিংরুমে গিয়ে ধরিত্রীই কোনোরকমে চুলটা ঠিক করে নিলো। এরপর মেকআপ তুলে বেরিয়ে আসলো। রাফসান বাইরে অপেক্ষা করছিল। ধরিত্রী বের হবার পর ও উঠে দাঁড়ালো। কী বলবে? কী করবে? ঘোমটা তোলার পর তো চুলের ক্লিপ খুলতে বসে গেল। এখন কী করবে?
– এই পোষাকেই ঘুমাতে হবে?
– হুম!
– এত ভারী লেহেঙ্গায় কী করে ঘুমাব?
– ওখানে লাগেজ আছে। একটা পোষাক পরে নিন।
– না থাক। দরকার নেই। বাসরে সবাই তো এমন করে। একটু না হয় কষ্ট করলাম।
– আপনার ইচ্ছা।
– আচ্ছা, আমরা কী আপনি আপনিই করবো?
– জ্বী?
– তুমি বলুন না। আমি তো ছোটই হবো আপনার।
কিছুদিন আগে কে যেন মায়ের বান্ধবী মায়ের বান্ধবী করে পাকনামি করত। এখন তুমি বলতে বলছে। সে নাকি ছোট হবে।
– ওকে। তোমাকেও তুমি করে বলতে হবে।
– ঠিক আছে। আমার আপত্তি নেই। আমি তুই ও বলতে পারি। বাই দ্য ওয়ে বান্ধবীর ছেলেকে তুই বলা যায়।
রাফসানের চেহারার হাসি গায়েব হয়ে গেল। ধরিত্রী কখনো শোধরাবে না। সারাটা জীবন এই বদনাম বয়ে বেরাতে হবে রাফসানকে। বান্ধবীর ছেলে…
“তুমি আর মীরা আপু বন্ধু কী করে হলে?” ধরিত্রীর মুখে এই কথা শুনে রাফসান কিছুই বলল না। এখন বাসর রাতে বসে বসে মীরার গল্প করবে।
– বলো না। তোমাদের বন্ধুত্ব কত দিনের?
– দিন? যুগ!
– মানে?
– ছাব্বিশ বছর হবে সামনে।
– ওয়াও!!! সিরিয়াসলি।
– কিন্ডারগার্টেনের বন্ধু।
– এত দিন! আমার বয়সই তো ছাব্বিশ হবে। তোমাদের বন্ধুত্ব তো দেখছি আমার সমবয়সী।
রাফসান ভাবছে ও কী ইন্ডিরেক্টলি বুড়ো বলল ওদের? ধরিত্রী বিছানায় পা তুলে বসলো। রাফসান ওর উত্তেজনা দেখছে। হিংসে হচ্ছে ওর। ওর মীরাকেও মনে আছে। একই কোচিংয়ের রাফসানকে মনে নেই? রাফসান তো মীরার মতো দুটো নাম ও ব্যবহার করে না।
– রাফসান, এখানে বসো। বসে গল্প করি।
– সকাল হলে সবাই ডাকতে শুরু করবে। ঘুমিয়ে পড়।
– আরে না! নতুন বর বউকে কেউ এত ডিস্টার্ব করে না। একটু গল্প করি। ঘুমিয়ে পড়লে কেমন বোরিং না। বাসর রাত আমাদের।
তাই বলে মীরার গল্প? অন্য কত কিছুই তো আছে। বাসর রাতে মানুষ অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প করে। স্মরণীয় করার জন্য কত কিছু আছে। টপিক খুঁজতে হবে।
– কিছু খাবে?
– আমি মাঝরাতে কিছু খাই না। তুমি খেতে পারো।
– না আমিও খাই না।
– আচ্ছা তাহলে শোনো। মীরা আপুর বিয়ে হয়ে গেছে?
– সেই কবে। ছয় বছর।
– কী! এত বছর!
– তো?
ধরিত্রী যেন মর্মাহত হয়ে গেল। রাফসানের আগ্রহ হচ্ছে ও কেন এত মীরা মীরা করছে। কী আছে ওর মধ্যে?
– মীরা আপু বলেছিল বিয়ে করবে না। একটা পরিচয় না হলে বিয়ে করা উচিত না। উনি অনেক বড় ডাক্তার না হলে বিয়ে করবেন না। আর মাত্র এক বছরের মাথায় বিয়ে করে ফেলল?
– কী করবে? অঙ্কন ভাই অনেক ভালো ছেলে। খুব ভালোবাসত তো। অপেক্ষা করেই বা কী করবে। আঙ্কেল ও তখন অসুস্থ ছিল। তাই করে নিল।
– ও! এখন আঙ্কেল?
– আনফরচুনেটলি ওর বিয়ের পরেই ওনার ইন্তেকাল হয়।
– সো স্যাড।
– তোমার মীরাকে কেন মনে আছে?
– কিছু না। আমার মনে আছে আরকি। সবাইকেই থাকে।
মিথ্যেবাদী! সবাইকে থাকে না। রাফসানকে নেই।
– সত্যি?
– হ্যাঁ। তবে উনি অন্যরকম ছিলেন। আমার একটা অভ্যাস ছিল। ধাঁধা বানানোর। আমাদের ইন্সট্রাকটর প্রতিদিন নতুন নতুন আসতো। একজন দ্বিতীয় দিন আসতো না। আমি যেই নতুন আসতো, তাদের একটা একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করতাম।
– তারপর?
– কেউ পারতো না। একজন ও না। কিন্তু একজন পেরেছিল।
– মীরা?
– জ্বী। এরপর তিনি আমার প্রশংসা করলেন। বললেন আমার মধ্যে নাকি ডাক্তার দেখতে পান না। আমার ভেতর একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ আছে, তার নিজের মনে কথা শোনা উচিত। আর সেজন্যই আমি ঠিক করি আমি ডাক্তার হবো না। আমার সত্যি মেডিকেলে ইন্টারেস্ট নেই। আমি এমন কিছু পড়বো যেটা পড়ে আমার পছন্দের ক্যারিয়ার চুজ করতে পারবো।
– সেজন্যই তুমি পছন্দের ক্যারিয়ার গড়তে পত্রিকাতে যোগ দিলে।
– জ্বী। শি ওয়াজ অ্যান আইডল ফর মি। অনেক খুঁজেছি জানো। আজকে পেলাম। ওনাকে তুমি আবার এত কিছু বলো না। লজ্জা লাগবে আমার।
– না বলব না।
এদিকে অঙ্কন আর তার পিএ সামিনা সিঙ্গাপুরে নেমেছে। এখন ওরা গাড়িতে হোটেল যাচ্ছে। অঙ্কন ওর ফোন অন করতেই মীরার কয়েকটা ছবি রিসিভ করলো,
– কী হয়েছে অঙ্কন?
– কিছু না।
– মীরা?
– জ্বী।
– কোথায়?
– রাফসানের বাসায়।
– তুমি এখানে আর ও।
– রাফসানের বিয়ে আজ। ও সেখানে থাকবে।
– তুমি যাওনি যে?
– আমার ইচ্ছে নেই। ভেবেছিলাম ওকে বলব আসছি আসছি। এরপর সিঙ্গাপুর চলে আসব। ও আর বিয়েতে যেতে পারবে না। কিন্তু ও অফিসে ফোন দিতেই মাসুদ সব বলে দিল। আমাকে জিজ্ঞেস না করেই চলে গেছে।
– তুমি কেন চাও না ও যাক?
– ও সহ্য করতে পারবে না তো রাফসানের বিয়ে।
– হোয়াট ডু ইউ মিন!
অঙ্কন অসহায়ের মতো কান্নায় ভেঙে পড়লো। সামিনা অপ্রস্তুত ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।
– কাম ডাউন অঙ্কন।
– হাউ ক্যান আই? মাই ওয়াইফ লাভস হার বেস্টফ্রেন্ড।
– তুমি কীভাবে বুঝলে?
– শি ডাজেন্ট লাভ মি অ্যানিমোর। ছুঁতে পর্যন্ত দেয় না। আমি এত দিন দেশের বাইরে থাকি বা দেশেই থাকি। খোঁজ ও নেয় না। কিন্তু রাফসান! ওর কিছু হলেই টেনশনে পড়ে যায়। আমার সাথে তো অভিমান ও করে না। ওর সাথে সব গল্প, অভিমান। আমি যেন মূর্তি। সাজিয়ে রাখা শোপিস। আমাকে দেখতেই পারে না।
– কিন্তু ওর বেস্টফ্রেন্ড তো বিয়ে করছে।
– কতদিন অপেক্ষা করবে? করে নিল। এতদিন আমার জীবন টা নষ্ট হচ্ছিল এখন ঐ মেয়েটারও হবে। ছেলেরা কিছু না বুঝলেও এই ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি টা ঠিকই বুঝতে পারে। আমার ভালোবাসা আর আমার নেই।
রাফসান আর ধরিত্রীর বিয়ের পর এই প্রথম সকাল। দরজায় কড়া নাড়া শুরু হয়ে গেছে। ধরিত্রী পাশ থেকে ফোন নিয়ে দেখল নয়টা বাজে। খুব একটা দেরি নয়। কিন্তু সবাই যখন এত ডাকাডাকির পর ও ওদের সাড়া পাবে না তখন উল্টো পাল্টা ভাববে। ধরিত্রী রাফসানকে হাত দিয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে ডাকতে লাগলো, “রাফসান! রাফসান! ওঠো!” রাফসানের ঘুম ভাঙছে না। ধরিত্রী এবার অসহ্য হয়ে নিজে গিয়েই দরজা খুলে দিল। সবাই ওকে দেখে হাসতে লাগলো। কী বিব্রত কর অবস্থা। ওর চুল ওর পোষাক দেখে সবাই নিজেদের ইচ্ছামতো কাহিনী ভেবে নিচ্ছে। “ঐ লোকটা ঘুমাচ্ছে এখনো?” মীরা বলল। ধরিত্রী মাথা নাড়লো। সবাই মুচকি মুচকি হেসে চলে গেল। ধরিত্রী দরজা আটকিয়ে আবার রাফসানের কাছে এলো। “রাফসান! ওঠো! ওঠো!”
রাফসান এখনো ঘুমাচ্ছে। মীরা রাফসানকে সমানে নাড়িয়ে যাচ্ছে। “রাফসান ওঠ! ওঠ না!” মীরার খুব কান্না পাচ্ছে। ধরিত্রী সোফার উপর বসে আছে। কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে বলল, “থামো তো! ওকে এভাবে জাগালে ও ওঠে না। অ্যালার্মের শব্দ ছাড়া ওর ঘুম ভাঙে না। এর আগে কী ওর পাশ থেকে ওঠোনি? নাকি আগে সবসময় কাজ সেরেই কেটে পড়তে?”
মীরা অনুভূতি শূন্য হয়ে তাকিয়ে আছে ধরিত্রীর দিকে। খুবই অপমানজনক এই অবস্থা। ধরিত্রীর চোখে জল চলে এসেছে। মীরা সাথে সাথে ধরিত্রীর সামনে গিয়ে বসে পড়লো। এরপর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
– ধরা বিশ্বাস করো, তুমি যা ভাবছো তা না।
– চুপ! এই নোংরা মুখে আমাকে ধরা ডাকবে না। বোন ভাবতাম তোমাকে। ভালোবেসে অধিকার দিয়েছিলাম ধরা ডাকার। তোমার লজ্জা করে না আমার স্বামীর সাথে ঘুমাতে। তোমার কী দোষ দেব? আপন বোন তো তুমি না। স্বামীই যখন অন্য মহিলার সাথে সম্পর্ক করতে দ্বিধা করল না আর পর কী আপন হবে।
– আমরা কিছু করিনি। পুরো কথাটা শোনো।
– এসব দেখার পরেও তোমাদের এক্সপ্লেইনেশন আরো বাকি আছে। ওয়াও! নির্লজ্জ বেহায়া দেখেছি, তোমাদের মতো দেখিনি।
(চলবে)
#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট৮
#পিকলি_পিকু
হানিমুনে নেপাল গিয়েছে ধরিত্রী আর রাফসান। প্রথম দিন ওরা আশেপাশে হালকা পাতলা ঘুরে বেড়ালেও রাতে রাফসান ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ধরিত্রী তাড়াতাড়ি উঠে তৈরী হয়ে পড়ে। ওর মন্দিরগুলো দেখার খুব ইচ্ছা। কিন্তু রাফসান তো ঘুম। ওকে জাগাতে জাগাতে ক্লান্ত হয়ে ধরিত্রী বের হয়ে গেল। একা একাই ঘুরবে ও। হানিমুন বলে কী হাসবেন্ড নিয়েই ঘুরতে হবে? এটাও তো একটা ট্রিপ।
একটু পর রাফসানের ফোন বেঁজে উঠলো। রাফসানের এবার ঘুম ভাঙলো। ফোন টা হাতে নিয়ে দেখল মা হোয়াট্সঅ্যাপে কল করেছে।
– তোরা এখন কোথায়?
– মাত্র উঠলাম।
– ধরিত্রী কে দে তো।
– আমার সাথে বলতে দোষের কী?
রাফসান ধরিত্রীকে খুঁজে খুঁজে দেখছে। ও কোথাও নেই।
– একটু পরে করি।
– ও কোথায়?
– নেই তো।
রাফসান নীচে গিয়ে শুনলো বউ ওর একা ঘুরতে বেরিয়েছে। এটা কোনো কথা! হানিমুনে এসে বউ হারিয়ে গেল। রাফসান এখন ধরিত্রীকে কোথায় খুঁজবে? ওর হোয়াট্সঅ্যাপে কল করেও লাভ নেই। নেট কানেকশন যে নেই। একা একাই ঘুরতে বের হলো। সেখানে গিয়ে যদি দেখা যায় আরকি। ঘুরতে ঘুরতে দুপুরের দিকে পেয়ে গেল ওকে।
– আরে! তুমি এখানে?
– আমি আসবো না? আমাকে রেখে এসেছ কেন?
রাফসান অনেক রেগে আছে। তাই ধরিত্রী নিজের দাঁতের পাটি দেখানো বন্ধ করলো।
– ঘুম ভাঙে না কেন তোমার? জাগাচ্ছিলাম। ওঠোনি।
– অ্যালার্মের শব্দ ছাড়া আমি ঘুম থেকে উঠতে পারি না।
– কী অদ্ভুত!
– হানিমুনে কেউ একা ঘুরে নাকি?
– হানিমুনে কেউ ঘুমায়? হোয়াটেভার, ফর মি ইটস আ ট্রিপ। সময় নষ্ট করার ইচ্ছা ছিল না। এখনো নেই।
ধরিত্রী সামনে আগাতে থাকে। রাফসান ওর পেছনে পেছনে হাঁটছে। ধরিত্রী এমন কেন?
– দেখি, এখানে দাঁড়াও তো।
– কেন?
– ছবি তুলবো।
– কেন?
– তোমার তো ফেসবুক নেই। এখান থেকে গিয়ে একটা আইডি খুলে দেব। এরপর একটা ছবি তুলবো। প্রোফাইল পিক দেব। স্ট্যাটাস চেঞ্জ করবো। ম্যারিড টু রাফসান আহমেদ।
রাফসান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ধরিত্রী কত কিছু চিন্তা করে। ওর মনে আছে ও যে বলেছিল ফেসবুক নেই।
– দাঁড়াও না। তোমার মা বলেছে তোমার ছবি নাকি ভালো আসে না। রোবটের মতো লাগে?
– কী!
– বান্ধবীর ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছি। আবদার অনুযায়ী তার ছেলের কয়েকটা ছবি না তুলে দিয়ে যাব না।
ধরিত্রী হাসতে থাকে। মা এত কথা বলে কেন ওকে। ধরিত্রী রাফসানের অনেকগুলো ছবি তুলে দিল। ধরিত্রী ছবি অনেক সুন্দর তোলে। রাফসানের ছবির অ্যাঙ্গেল ভালো না। কিন্তু ওর হাত অনেক শক্ত। তাই ছবি এতটাও খারাপ আসছে না। ধরিত্রী ওকে ছবি তোলানো শেখাচ্ছে প্ল্যান অনুযায়ী ওরা দেশে ফিরেই ফেসবুক আইডি খুলল। আগেরটা ডিএক্টিভেটই থাক। মীরা বাসায় বসে ওদের হানিমুনের নানা ছবি আর ম্যারিড স্ট্যাটাস দেখছে। অঙ্কন খেয়াল করলো।
– কী হয়েছে?
– ম্যারিড স্ট্যাটাস দিয়েছে। অ্যাজ ইফ কেউ জানতো না ওরা বিবাহিত। হাহাহ!
– আমরাও তো দিয়েছিলাম।
– নতুন নতুন বিয়ে করলে সবাই এত ঢং কেন করে?
– পুরনো হলে সব গায়েব হয়ে যায় তাই।
এই বলে অঙ্কন মীরার কাছে আসার চেষ্টা করছিল। বুঝতে পেরে মীরা আবার ওকে এড়িয়ে চলল।
– সমস্যা কী?
– অনেক বড় সমস্যা। কোড রেড।
– এখনই হতে হলো।
– তো কখন হবে?
– মীরা, হোয়াই উই আর নট ট্রাইং ফর,
– নো অঙ্কন। আমার একটু সময় দরকার।
– আর কত।
– জানি না। আমাকে বিরক্ত করো না। আমি এখনো তৈরী না এসবের জন্য।
মীরা অঙ্কন থেকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লো। অঙ্কন সোজা হয়ে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। অশান্তি লাগছে ওর। মীরা কেন বদলে গেল? আগে ওর জন্য কত পাগল ছিল। চোখে হারাতো ওকে। বাড়ি ফিরতে দেরী হলে অফিসে চলে আসতো। এখন সব প্রেম কোথায় গেল?
ধরিত্রীর শ্বশুর বাড়িতে ওর খুব যত্ন চলছে। অবশেষে আহসান ধরিত্রীকে ভাবি বলার পূর্ণ অধিকার পেয়েছে। রাশাও ধরিত্রীর আদেশ পালনে এক পায়ে দাঁড়ানো। কিছুদিন পরেই সবাই ধরিত্রী ফ্যান ক্লাব খুলবে। এখানে ধরিত্রী একদম মিশে গেছে। এ বাড়িতে সবাই দুপুরের খাবার আর রাতের খাবার একসাথে খায় না তা ধরিত্রী বুঝে গেছে। ব্যস্ত সবাই। বিশেষ করে রাফসান আর চাচ্চু রাতে দেরিতে আসে। তাই নাস্তার টেবিলেই সবাই একত্রিত হয়। কিন্তু ধরিত্রীর একটা বদভ্যাস আছে। আর তা হলো সকালে ভোরে নাস্তা না করা। দশটার আগে ও কিছু খেতে পারে না। এনারা সবাই সাতটা বাজেই নাস্তা করেন।
– তুই কিছু খাচ্ছিস না কেন ধরিত্রী?
– মা, আসলে পরে খেয়ে নেব।
– প্রথম দিন থেকে খেয়াল করছি তুই খেতে চাইছিস না। পছন্দ হচ্ছে না? পছন্দ কী? রুমির মা বানিয়ে দেবে।
– না না ভালোই। খাচ্ছি।
ধরিত্রী জোর করে পাউরুটি খাওয়ার চেষ্টা করে। ও যে জোর করে খাচ্ছে সেটা রুবাইয়া বুঝতে পারছে। হঠাৎ ধরিত্রীর বমির বেগ হলো। ও বমি আসার শব্দ করে নিজের ঘরের দিকে দৌঁড় দেয়। সবাই অবাক হয়ে সেদিকে তাকালো। বিয়ের মাত্র দুই সপ্তাহ। আর ধরিত্রী বমি করছে! মাশরুফা রাফসানের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো। রাফসান তো নিষ্পাপ শিশুর মতো বসে আছে। রুবাইয়া উঠে ধরিত্রীর পেছনে গেল।
– মা তোর কী হয়েছে?
– কিছু না।
– খালি পেটে বমি করেছিস?
– বমি না। এমনি।
ধরিত্রীর কণ্ঠ টা খুব ক্লান্ত। রুবাইয়া ধরিত্রীকে এনে বসালো।
– এখন বল। সমস্যা কী?
– আসলে।
রাফসান ঢুকে পড়লো। ওরা দুজনেই রাফসানের দিকে তাকিয়ে আছে। ধরিত্রী রাফসানকে দেখে কিছু বলছে না।
– বল।
– কিছু না।
– রাফসানের সামনে বলবি না?
– আসলে,
রাফসান ওকে প্রাইভেসি দিতে বেরিয়ে আসলো। রুবাইয়া এবার ধরিত্রীর দিকে তাকালো।
– কী করে যে বলব।
– আমার কাছে লজ্জা পাচ্ছিস!
– আসলে, আমি এত সকালে নাস্তা খেতে পারি না। দশটার পর খাই। একটু জোর করলেই বেরিয়ে আসে।
– এই কথা। এর জন্য লজ্জা পাওয়ার কী আছে?
– তোমরা সবাই কত ডিসিপ্লিনড।
– আরে ওসব নিয়ে চিন্তা করিস না। জোর করার দরকার নেই। টিফিন নিয়ে যাবি। আর অভ্যাস টা ভালো না। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। অল্প অল্প করে কিছু খেয়ে নিস।
রুবাইয়া চলে আসছিল। ধরিত্রী রুবাইয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– থ্যাংকস মা।
– একটা থাপ্পড় দেব। আমাকে থ্যাংকস বলছিস!
রাফসান বাইরে থেকে সবটা দেখেছে। মা ধরিত্রীকে খুব পছন্দ করে। রাফসান এই কথা বললে অনেক বকতো। কিন্তু ধরিত্রী তো, তাই সাত খু*ন মাফ।
ধরিত্রীর অফিস শেষে ও বাড়ি ফিরে সবার জন্য হালকা নাস্তা বানানোর চেষ্টা করে। যদিও এ বাসার সবাই এই সন্ধ্যার নাস্তা এড়িয়ে চলে কিন্তু নতুন বউয়ের বায়না। রাশা আর আহসানের জন্য ভালোই হয়েছে। আহসান তো ফ্যান ধরিত্রী ভাবির।
– শুনো ভাবি, কাল চিকেন পাকোড়া।
– ওটা তো পারি না।
– ইউটিউব দেখে নিও। আই উইল হেল্প।
– ওকে মুশকিল আহসান বাবা।
মাশরুফা রুবাইয়ার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে বলল,
– ভাবি, তুমি ওকে কিছু বলবে না?
– কী?
– উই এভয়েড ডীপ ফ্রাইড।
– মাঝে মধ্যে খাওয়া যায়।
– আহসান তো ওভার ওয়েট।
– সেটা ও বাইরের খাবার বেশি খায়। সেটা কন্ট্রোল করা উচিত। আর ধরিত্রী যা বানাচ্ছে তা নিজে বানাচ্ছে। কিছুদিন পর এমনিতেই আর ইচ্ছে করবে না।
– সত্যি?
– এখন দেবর ননদদের সাথে একটু বন্ধুত্ব করতে দে তো। তোর বরকেও ওর পছন্দের বিরিয়ানি করে খাইয়ে বশ করেছি। দেবরদের এভাবেই হাত করতে হয়।
ধরিত্রীর দেবর ননদ তো ওর হাতে। শ্বশুর ও ওকে অপছন্দ করে না। চাচা শ্বশুরের সাথে খুব একটা কথা হয়নি। নাস্তার টেবিলে একটু আধটু। তবে রাফসান…
ধরিত্রী ওর অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন তো প্রায় এমন হয়। রাতের বেলা বাড়ি ফিরে ও নিজের খাবার খেয়ে এসে দেখলো বউ ঘুমিয়ে পড়েছে। বিয়ের পর ছুটি নেওয়ার জন্য ওর অনেক চাপ পড়ে গেছে এখন। বিয়ের প্রায় একমাস চলছে। এখনো একটা মুভি দেখতে যেতে পারেনি।
– বিয়ে করে ভুলে গেছিস?
– না রে। হাসপাতালেই থাকি।
– বিয়ের আগের লাইফ আর পরের লাইফের পার্থক্য কেমন?
– এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমি ধরিত্রীকে বিয়ে করেছি। বাসায় গিয়ে যখন দেখি ও আমার খাটে ঘুমাচ্ছে তখনো আমার বিশ্বাস হয় না।
– কদিন পর বাচ্চার বাপ হয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে বলবি আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এটা আমার আর ধরিত্রীর বাচ্চা।
– হতেই পারে। আমার না সবই স্বপ্ন মনে হয়।
– ভালোই আছিস দেখছি। ম্যারিড লাইফ ভালো যাক।
– থ্যাংকস দোস্ত।
মীরার ফোন রেখে রাফসান আবার কাজে মন দেয়। আজকেও ওর দেরি। আজকেও ধরিত্রী ঘুমাচ্ছে। রাফসান ধরিত্রীর কাছে গিয়ে দেখলো। কাউকে ঘুমের ভেতর ও এত সুন্দর কী করে লাগে? ওর হাতে কী যেন একটা। রাফসান সেটা হাতে নিয়ে দেখল ডায়েরি। বাতি জ্বালানোই। অর্থাৎ ও ডায়েরি লিখছিল। কারো ডায়েরি পড়া ভালো না, কিন্তু ওর তর সইছে না। ডায়েরি খুলে দেখলো। আজকে লিখেছে বিয়ের একসমাস পূর্তির জার্নাল। ওভার অল ম্যারিড লাইফ। সবাইকে নম্বর দিয়েছে। কে কেমন ব্যবহার করে ওর সাথে সেই হিসেবে। মাকে নাম্বার দিয়ে ছোট করবেনা। সবাই ভালোই পেয়েছে। ৭ এর নীচে কেউ পায়নি। রাফসান কেও নাম্বার দিয়েছে। ৩/১০! কী! এত বাজে তো জীবনে কোনো পরীক্ষাতে করেনি। আবার মন্তব্য ও করেছে।
“স্বামী হিসেবে সে কোনো পর্যায়েই পরে না। মাত্র এক মাসে তাকে সেই মাপ দন্ডে মাপবো না। সাধারণ পরিবারের সদস্য হিসেবে খুব একটা কথাবার্তা ও হয়নি। বাকি সবার মতো সকাল বেলা দেখা যায়। তাকে সৌজন্য করেই ৩ দেওয়া। সম্ভব হলে নম্বরই দিতাম না।” রাফসান সেই ডায়েরি টা হাতে বসে রইলো।
” ধরিত্রী সত্যি আমাকে ভালোই বাসে না। বাসবে ও না। আমি ব্যর্থ! বাকি সবাই কমপক্ষে সাত আট পেয়েছে। এমনকি রুমির মা ও নয় পেয়েছে। আমি মাত্র তিন!”
(চলবে)