ধারণার অতীত [০১]
লেখাঃ তাজরীন_খন্দকার
আমি যেই বাসায় টিউশনি করি ওই বাসার আন্টি আমাকে একটু বেশিই পছন্দ করে, এই পছন্দের ফলস্বরূপ উনি আজকে একটা বিরাট সমন্ধ নিয়ে আমার বাড়িতে আসবেন। উনার সাথে উনার বোন এবং বোনের ছেলে স্বয়ং উপস্থিত থাকবে। উনার বোনের ছেলের জন্য যোগ্য পাত্রী হিসেবে উনি আমাকে মনে মনে যে এতো পছন্দ করে রেখেছেন সেটা আমি জানতাম না! জানলে হয়তো টিউশনিটা অনেক আগেই ছেড়ে দিতাম। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আমার হাতের বাইরে চলে গেছে, কারণ উনার সিদ্ধান্তের সাথে আমার পরিবার জড়িয়ে গেছে। আজকে পাত্র আমাকে দেখে পছন্দ করলেই ব্যস! যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে হয়ে যাবে!
কারণ আমার আব্বু আম্মুর হাবভাব এটাই প্রমাণ করছে ছেলে সম্পর্কে শুনেই তাদের মন গলে একাকার! তার উপর বড়বাড়ির চাকরিজীবী ছেলে এটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। এমন পাত্র কে হাতছাড়া করে?
কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়, যা আমি এই মূহুর্তে আমার পরিবারকে বলতে পারছিনা।
অন্য সময় হলে পারতাম,কিন্তু এখন এমন পরিস্থিতিতে আমার মুখ খোলা খুনের অপরাধের চেয়েও বিরাট কিছু হতে পারে।
এদিকে আমার আম্মু সকাল থেকে তাদেরকে যথাযথ আপ্যায়ন করার জন্য যাবতীয় কাজ দৌঁড়ের উপর করে যাচ্ছে।
আর আমিও জীবনে এতটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়বো কল্পনা করিনি! টিউশনে গেলে ওই আন্টির সাথে ভালো আচরণ, অতি সম্মান দেখানোর কারণ যে আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে কে জানতো?
এমনিতে আমার জন্য বিয়ের সমন্ধ খুব কম আসে, কারণ কেউ আমাকে তেমন দেখেনা। আমার বাবা ইলিয়াস রহমানের যে উপযুক্ত একটা মেয়ে ঘরে আছে সেটাও অনেক মানুষের কাছে অজানা। বড় হওয়ার পরে সবসময় আমি বোরকা পরিধান করে চলাফেরা করি। তাই আমাকে দেখার সুযোগ সত্যিই কম, আর আমার পরিবার থেকে অতি দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাও আজকের আগে কমই ছিলো।
কিন্তু জানিনা ভালো সমন্ধ পেলে মেয়ের মা-বাবাদের মাথা এমন এলোমেলো হয়ে যায় কেন? এই যেমন আজকের অপ্রস্তুত ঘটনা এর অন্যতম উদাহরণ! আমার যেই আব্বু ছোট বেলা থেকে আমাকে পড়ালেখা নিয়ে এতো এতো স্বপ্ন দেখিয়ে আসছে,সেই বাবা আজকে বলে
‘ ৫ বছর পর তুমি যখন নিজের পায়ে দাঁড়াবে তখনও এমন যোগ্যতার পাত্রকেই বেছে নিতে হবে। তাহলে কি দরকার কামুকা ফরজ কাজে দেরি করার? বিয়ে করে ফেলো, স্বামী জব করে খাওয়াবে, তুমি শুধু পরিবার দেখাশোনা করবে৷
আমার আম্মুও সেইম কথা বলছে। এমনকি এই টিউশনিটাকে ওরা আমার ভাগ্যের সাথে তুলনা করছে। প্রথমদিকে আমি টিউশন নিবো শুনে রাগারাগি করছিলো, বলছিলো আমার কোনদিকে অভাব যে আমাকে কষ্ট করে টিউশন পড়াতে হবে?
কিন্তু আমি তখনও মূল কারণটা বলতে পারিনি। আর এখনো বলতে পারছিনা। আমার শুধু মনে হচ্ছে আমি শেষ! হয় আমার বাকশক্তিকে কবর দিতে হবে, নয় বেহায়া মেয়েদের মতো আব্বু আম্মুর মুখের উপর কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
সাড়ে বারোটা বেজে গেছে,
আম্মু বারবার ইশারা করছে তাড়াতাড়ি গোসল এসে চুল শুকাতে, ওদের আসার সময় হয়ে যাচ্ছে!
কিন্তু আমি ফোন হাতে উদাস চেহেরায় বসে আছি। একটু পর পর একটা নাম্বারে ফোন দিচ্ছি!
কিন্তু রিসিভ হচ্ছেনা। আমি জানি সেই নাম্বারের মালিক সকাল ৭ টায় ঘুমিয়েছে, বিকেল পর্যন্ত ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমিয়েই থাকবে। কিন্তু দুপুরে পাত্রপক্ষ এসে যদি কোনো একটা অঘটন ঘটিয়েই ফেলে তাহলে আমি কি করবো? কি করে আঁটকাবো সবকিছু? !
আর আমি জীবনে এমন মানুষ দেখিনি যারা কিনা সকালেই পাত্রী দেখতে আসার সংবাদ মেয়ের পরিবারে জানায়! এটা ভাবেনা যে মেয়ের পরিবার এতো দ্রুত সবকিছু সামাল দিবে কি করে?
কিন্তু শুনলাম গোপনে গোপনে নাকি আম্মুর সাথে ওই আন্টির আলাপ হয়েছিল, যা আম্মু আমাকে জানায়নি। আজকে আন্টির বোনপো অবসর আছে, কাল থেকেই নাকি আবার ব্যস্ত হয়ে যাবে। তাই আন্টি আম্মুকে বলেছিলো আমার পরিবার চাইলেই আজকে আসবে, নাহলে পরে আসবে। আম্মু সুন্দর করে বলে দিয়েছে আজকেই আসুন, সমস্যা নাই।
বুঝিনা আম্মুরা এমন কি করে হয়?
বোকার মতো সিদ্ধান্ত না এটা?
এরপর আম্মুর অবস্থা কি হলো? ওদেরকে বলার পরে পাগলের মতো ছুটছে, কাছাকাছি থাকা আমার ফুফিকে বাসায় ডেকেছে। পুরো বাড়িঘর পরিষ্কার সাথে রান্নাবান্না, সব মিলিয়ে বাজে অবস্থার শিকার উনাকেই হতে হচ্ছে।
ফুফি এটা সেটা রান্না করছে, আম্মু মাঝে মাঝে ফুফিকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে আর সবকিছু গুছাচ্ছে এর ফাঁকে আবার আমাকেও তৈরি হতে বলছে। আম্মুর যেই শাড়ীটা পরলে আমাকে সবচেয়ে বেশি মানায়, সেই শাড়ীটা খুলে সামনে রাখছে। সত্যি বলতে এই শাড়ীটা আমারও খুব পছন্দ। কিন্তু আজকে পরার কোনো ইচ্ছে নাই।
কিন্তু তবুও কিছু করার নেই, আপাতত বকা থেকে মুক্তি পেতে হলেও গোসল করতে হবে এবং সাজতে হবে।
গেলাম গোসল করতে, খুব দ্রুত গোসল শেষ করে এসেই দ্রুত ফোনে হাতে নিয়ে চেক করলাম কোনো কল আসলো কিনা? আজকে তো একটু তাড়াতাড়ি জাগতে পারে! পরে যখন শুনবে আমি পাত্রপক্ষের সামনে গিয়েছি তাহলে বিষয়টা কেমন হবে? জানি শুনলে রাগারাগিও করবে! কিন্তু আমি আর কি করে যোগাযোগ করবো? কোনো বন্ধুর নাম্বার পর্যন্ত আমি চাইনি, কিংবা নিজের কাছে রাখিনি যে এই বিপদে যা আমাকে একটু সহায়তা করতে পারে। আমি জানি ও একবার জানলে পুরো পরিস্থিতি বদলে যাবে, কিছু না কিছু করতে পারবে ওই জায়গায় বসেই। কিন্তু কিন্তু জানানোর অবস্থাটাই এখন আর নেই!
দেড়টা বেজে যাচ্ছে, আম্মুর রাগারাগি শুনতে পাচ্ছিলাম, ভয়ে ভয়ে ড্রেসিংয়ের সামনে বসলাম। শুধু চুলগুলো আঁচড়ে শাড়ী পরিধান করলাম। এর মধ্যে ফুফি এসে আমাকে দেখে বড় বড় চোখ করে বেড়িয়ে গেলো, কয়েক মিনিটের মধ্যে আম্মুসহ ফিরে আসলো। আম্মু আমাকে দেখেই বললো,
‘ তুই তো টিউশনে গেলেও এর চেয়ে পরিপাটি হয়ে যাস৷ এমন ফকিরের বেশ ধরলি কেন?
কিছু হয়েছে?
আম্মুর কথাতে কেমন যেন ভরসা পেলাম। আমি আস্তে আস্তে বললাম, ফুফিকে একটু বাইরে যেতে বলো।
আম্মু বলার আগেই ফুফি বেড়িয়ে গেলো।
আমি দৌঁড়ে গিয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। আম্মু ভেবাচেকা খেয়ে প্রশ্ন করতে লাগলো,
‘ কি হয়েছে মা? আমাকে বল?
আমি চোখ মুছতে মুছতে জবাব দিলাম,
, আম্মু যেই আন্টি প্রস্তাব নিয়ে আসছে, আমি উনার ছেলে রাফানের গার্লফ্রেন্ড। ওর ছোট বোনের জন্য শিক্ষক হিসেবে রাফান নিজেই আমাকে নিযুক্ত করেছে। আমরা দুজন দুজন ছাড়া থাকতে পারবোনা।
আম্মু আমার কথা শুনতেই বড় চোখ করে নিজের মুখ চেপে ধরলো। পা দুটো একহাত পেছনে নিয়ে বললো,
‘ তুই মানে তোর কারো সাথে সম্পর্ক আছে? আর আমি কতো গর্ব করি তোকে নিয়ে। আজকে কিনা তুই লাজ শরমের মাথা খেয়ে তোর মাকে বলছিস এই কথা? আবার তুই সেই ছেলের বাসায় টিউশন করতি, কি সাহস তোর?
আমি আস্তে আস্তে বললাম,
‘ তুমি থামবে আম্মু? এই যুগে কার সম্পর্ক নেই? এই তোমাদের মতো মা-বাবাদের ভয়েই সন্তানরা মানসম্মানের চিন্তা না করে পালিয়ে যায়৷ কিন্তু একটু যদি ভরসা দিতো ছেলেমেয়ে এমন করতো না। আর রাফান কোনদিকে অযোগ্য? রাফান ওই ছেলের থেকে ব্রিলিয়ান্ট, সুদর্শন, আর উচ্চবংশীয়। শুধু এক দুই বছর সময় দাও, দেখো তার অবস্থান কতো উপরে পৌঁছায়!
আম্মু কিছুটা নরম হয়ে বললো,
‘ সব বাদ আমাকে বল ওই বাড়িতে যাতায়াত করতি কেন ?
আমি কপাল চাপড়ে বললাম,
‘ এটাই আমার ভুল। সবকিছু রাফানের কুবুদ্ধি। যদিও পড়ালেখার জন্য সে শহরের বাইরে থাকে। কিন্তু সে আমাকে অবগত করেছে যে, টিউশনির মাধ্যমে ওর মায়ের কাছাকাছি হয়ে যেন উনার মন জয় করে নিতে পারি, তাহলে তার মা নিজেই আমাকে পুত্রবধূ করার জন্য প্রস্তাব পাঠাবে৷ ওর কথামতো আমিও রাজী হলাম, এমনকি আন্টি কোনো প্রকার সন্দেহ কিংবা খারাপ ধারণা করবে বলে রাফান বাসাতে আসলেও কখনো ওর দিকে আঁড়চোখেও তাকাইনা। চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো পড়িয়ে চলে আসি।
রাফান ঠিকি বলেছে, ওর মায়ের মন জয় করা সহজ, কিন্তু এতটাও সহজ না যে নিজের ছেলের জন্য আমাকে চেয়ে বসবেন! কি থেকে কি করে বসলো এখন? আমি ঠিকি মন জয় করতে পেরেছি, কিন্তু সেটার ভুল প্রয়োগ হচ্ছে।
মা কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই অনেক শব্দ শুনলাম, ফুফি দৌঁড়ে এসে বললো,
‘ ওরা চলে আসছে। মুনের রুমের দিকেই দুজন মহিলা আসতেছে।
আম্মু বিষন্ন চেহেরায় পিছিয়ে গেলো। দরজায় ওদের আওয়াজের সাথে সাথেই আমার আমার ফোনে রিং বেজে উঠলো। উঁকি দিয়ে দেখলাম রাফান ফোন দিচ্ছে। এতক্ষণে তার সময় হয়েছে! আমি দুদিকে তাকিয়ে পুরো হতবিহ্বল অবস্থায় পড়ে গেলাম।
চলবে……..