ধারণার_অতীত [০২]
লেখাঃ তাজরীন_খন্দকার
রাফানের মা রুমে প্রবেশ করেই বলে উঠলো,
‘ কেমন আছো মুনতাহা?
আমি থতমত খেয়ে কিছু একটা জবাব দিতে যাবো তখনি দেখলাম উনি আড়চোখে রিং বাজতে থাকা ফোনটার দিকে তাকাচ্ছে, লক্ষ্য করলাম স্ক্রিনে ‘অক্সিজেন’ দিয়ে সেইভ করা রাফানের নাম্বারটা স্পষ্ট ভাসছে। এটা দেখে আমি ভয়ে বারবার ঢোক গিলতে লাগলাম। নাম্বারটাকে উনি একবার একটু খেয়াল করলেই আমি শেষ, অন্তত শিক্ষিত মা হয়ে ছেলের নাম্বার চিনতে ভুল করবেন না।
মোবাইলটাকে উনার চোখের আড়াল করতে আমি ভয়ে ভয়ে একটু করে পেছাতে লাগলাম। আর সুযোগ খুঁজতে লাগলাম কি করে মোবাইলটাকে উপুড় করে দেওয়া যায় কিংবা সাইলেন্ট করা যায়। যখনি মোবাইল পর্যন্ত পৌঁছালাম তখনি রাফানের আন্টি মানে পাত্রের মা এগিয়ে এসে আমার মাথায় রাখলো, তারপর গালে একটু আঙুল ছুঁয়ে বললো,
‘ সত্যি তুমি দেখতে ভারী মিষ্টি ।
পাশ থেকে আমার আম্মু বলে উঠলো,
‘ আর বলবেন না, আমার মেয়ে যে পরিমাণ কেয়ারলেস । দেখেন ওকে কতক্ষণ থেকে রেডি হতে বলছি, কিন্তু ও এখন মাত্র গোসল করে আসছে।
আমার ফুফি আম্মুর সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
‘ একদম ঠিক, আমার ভাই ভাবির আদরে আদরে ও যা আহ্লাদীপনা করে! কি করে জানি সংসার সামলায় কে জানে? কিন্তু এমনিতে কিন্তু আমার ভাতিজী সুন্দরই মাশাল্লাহ। শুধু বিয়ের পরে দায়িত্ব শেখানোর ব্যাপারে শাশুড়ীর কষ্ট করা লাগবে।
সাথে সাথে পাত্রের মা’র জবাব,
‘ এসব ব্যপার না।
আমি জোরপূর্বক হাসতে হাসতে ওদের অমনোযোগে বা’হাতে ফোনটাকে কোনো রকম ছুঁলাম,তারপর না তাকিয়েই পাওয়ার বাটনে চাপ দিয়ে কেউ দেখার আগে অফ করে দিলাম।
রাফানের মা সাথে সাথেই আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকালো, ফোনটা আবার জায়গায় রেখে দেওয়ার সময় উনি খেয়াল করেছেন। আর তাই আমি ফোনটা রেখে দিতেই বলে উঠলেন,
‘ আরে মা রিসিভ করো সমস্যা নাই, আমরা তো তোমার নিজেদেরই লোক। জরুরী কলও হতে পারে!
আমি অভিনয় করা হাসিটা তখনও ঠোঁটে ধরে রাখলাম। রাফানের আন্টি খুব খেয়াল করে আমাকে দেখছে। অবশ্য দেখার জন্যই তো এসেছে,কিন্তু আমার ভালো লাগছেনা। হাত পা কাঁপছে, শুধু অস্থির অস্থির লাগছে ওরা কখন বের হবে আর আমি রাফানকে সবকিছু জানাবো!
কিন্তু উনাদের চেহেরায় আমাকে ছাড়া বের হওয়ার কোনো ভঙ্গিমাই নেই। উল্টো পাত্রের মা মানে রাফানের আন্টি বলছে,
‘ চলো আমি তোমাকে সাজিয়ে দিচ্ছি। তোমাকে তো আমার আগে থেকেই পছন্দ, শুধু আমার ছেলের জন্যই এখানে আসা। ও পছন্দ করলেই হয়ে গেলো, এখন যতো যাই হোক তোমাকে আমার বাড়ির বউ করবোই করবো। কারণ আমার আদরের ছোট বোন তোমাকে পছন্দ করেছে। কথা ছিলো ওর প্রথম মেয়ে হলে আমার ঘরেই যাবে, কিন্তু ওর মেয়ে তো মাত্র জন্মালো, ক্লাস থ্রিতে পড়ে, নাইন টেনে পড়লেও নাহয় কোনো রকম নিয়ে যেতাম!কিন্তু ততদিনে আমার ছেলের বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাবে৷ এরপর বলে দিলাম ওর মেয়ে উপযুক্ত হয়নি তো কি হয়েছে, আমার ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজে দিবে৷ তাই হলো! তোমাকে পেলো মনমতো আর আমাকে দেখালো আর আমি আমার ভাবনা এখানেই স্থির করলাম।
উনার কথা শুনে আমি রাফানের মা’র দিকে প্রশ্নসূচক চোখে তাকালাম, উনি কি যেন ভেবে গলা খাঁকরে বললেন,
‘ আরে তুমি আমাদের বাসায় যাওনা? তো আমি একদিন আপাকে বলছিলাম তোমাকে দেখে যেতে৷ আমার রুম থেকে লুকিয়ে একটু দেখছিলো, তখন তোমার সামনা সামনি যায়নি তুমি কিনা কি ভাবো সেটা চিন্তা করে। সেই দেখাতে আর আমার মুখে প্রশংসা শুনেই তোমাকে ঢের পছন্দ করে বসেছে বুঝছো?
উনার কথা শুনে আম্মু ফুফিসহ হেসে উঠলো।
আমাকেও দাঁত বের করে উনাদের হাসির সাথে ভদ্রতা দেখাতে হাসতে হলো।
এরপরই আন্টি মানে রাফানের মা আমাকে ইশারা করে বললো,
‘ আপাকে অন্যদের মতো ভেবোনা, উনি খুব স্মার্ট, আর একদম ফ্রেন্ডলি। বসো তোমাকে তার ছেলের পছন্দসই সাজিয়ে দিক!
এটা শুনতেই আমার মেজাজ বিগড়ে গেলো, যা প্রকাশ করতে পারলাম না। আমি জানিনা কোন পাত্রের মা পাত্রীকে এসে নিজে সাজিয়ে দেয়! কিন্তু খেয়াল করি আম্মুও আমাকে উনাদের কাজে রেসপন্স করার নির্দেশ দিচ্ছে। আমি উপায়ন্তর না দেখে বসতে যাবো তখনি রাফানের আন্টি বলে উঠলো,
‘ কিছু মনে করোনা, আসলে আমার ছেলে রাহিলের শাড়ী পছন্দ না। তুমি বরং নরমালি কোনো একটা জামা পরে নাও, যা ইচ্ছা। কালো রঙের হলে বেশি ভালো হয়। ওর আসলে কালো পছন্দ।
আমার আম্মু উৎসুক দৃষ্টিতে আলমারির দিকে দেখিয়ে বললো,
‘ মুন ওই যে তোর আব্বু নিহার বিয়েতে কিনে দিয়েছিলো না? ওইটা পরে ফেল, তোকে ওটাতে ভালো লাগে।
ওদের সাথে সাথে এবার আমি আম্মুর অতিরিক্ত আগ্রহের উপরেও বিরক্ত হতে লাগলাম। তবুও কিছু করার ছিলোনা, তাই ধিরে ধিরে গিয়ে ওই জামাটা বের করে ওয়াশরুমে গেলাম। ওয়াশরুমে গিয়েই আমার খেয়াল হলো আসার সময় কৌশলে কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে আমার ফোনটা নিয়ে আসলে ভালো হতো। ফিসফিস করে হলেও তো রাফানের সাথে কথা বলতে পারতাম । সেসময় আবার মাথায় আসলো আমি ওকে কোনো টেক্সট করিনি কেন? শিট! আমি অন্তত সবকিছু খোলে বলে রাখতে পারতাম, এমন বোকামি আমার দ্বারা কি করে হলো? কিন্তু এর জন্য সব দোষ ওর, রাফানের টেক্সট করা পছন্দ না, এতে নাকি অনেক সময় অপচয় হয়, তাই সে বলে দিয়েছে, যেই কথা ম্যসেজে আধ ঘন্টা লাগিয়ে বলবো সেটা যেন ফোন করে পাঁচ মিনিটে বলে ফেলি। কিন্তু বিপদের সময় তো দরকার। আজকে এটা ভুলে যাওয়া উচিত হয়নি। এইতো চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে!
ভাবছিলাম আবার দরজা খোলে গিয়ে মোবাইলটা নিয়ে আসবো, আর এসময় রাফানকে কল দিলেই পাওয়া যাবে, কারণ ওর ঘুম ভেঙে গেছে মানে ফোন জেনারেল মুডে। কিন্তু এখন বের হয়ে সামনে থেকে ফোন আনলেই বা ওরা কি ভাব্বে? রাফানের মায়ের সামনে খারাপ হওয়াটাও আমার জীবন মরণের রিস্ক, উল্টা পাল্টা ধারণা হলে বোনপো তো যেমন তেমন ছেলের জন্য তো একেবারেই মানবেনা।
নিরূপায় আমি উপায় না দেখে শাড়ী বদলে জামা পরলাম। পরার পরেও বের হচ্ছিলাম না। আমার বের হতে কেন জানি ইচ্ছে করছিলোনা। দরজার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। এর মধ্যে আম্মু কয়েকবার ডেকে বলেছে,
‘ কিরে আর কতক্ষণ লাগবে? শেষ হয়েছে?
আমি কোনো শব্দ করিনি । কিন্তু দরজায় দাঁড়ানোর মিনিট তিনেক পরে শুনতে পেলাম রাফানের মা বলছে,
‘ আরে আরে আপা আমার রাফান ফোন দিচ্ছে। ওকে তো জানাতেই ভুলে গেছি আমি পাত্রী দেখতে বাসার বাইরে আসছি।
টের পেলাম কথা বলার জন্য উনি রুম থেকে কিছুটা দূরে চলে যাচ্ছেন, কারণ উনার গলার আওয়াজ ছোট হয়ে আসছে। আমি আর একটুও দেরি না করে দরজা খোলে বের হয়ে গেলাম।
বেড়িয়ে দেখি আন্টি বারান্দার দিকে অগ্রসর হচ্ছে৷ আর আমার আম্মু উনার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আম্মুও তো ইতোমধ্যে জানে এই রাফানের সাথেই আমার সম্পর্ক, তাই সবকিছুই আম্মুর কাছে অদ্ভুত ঠেকছে।
আমিও পাত্রের মাকে একদম খেয়াল না করে দ্রুত বারান্দার দরজার কাছাকাছি চলে গেলাম। শুনলাম আন্টি বলছে,
‘ আমরা এখনো খাইনি, পাত্রীকে তৈরি করতেছি, আচ্ছা তুই তাহলে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে। পরে তোকে এই সমন্ধ নিয়ে আপডেট দিবো।
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। উনি এটা কেন বলেনি যে ওর বোন রিক্তার ম্যামকেই পাত্রী হিসেবে দেখতে এসেছে? তাহলেও তো রাফান বিষয়টা জানতে পারতো।
উনি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আমি এখান থেকে সরে গেলাম। পাত্রের মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ কোনো সমস্যা? ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এবার তো একদম ঠিক আছো, আর কিছুর দরকার নাই। তবে চাইলে একটু কাজল আর লিপস্টিক দিতে পারো। এরপর আমাদের সাথেই চলো একবারে রাদিফ দেখে নেবে। দরকার হলে তোমরা নিজেদের মধ্যে একটু কথা বলে নেবে। আমার বিশ্বাস তোমাকে অপছন্দ করার ছেলে রাদিফ নয়।
আমি কাজল হাতে নিয়ে অসহায় চোখ করে সবার দিলে তাকিয়ে আছি। আমার চোখে পানি টলমল করছিলো, তবুও কোনো রকম আটকিয়ে বললাম,
‘ আমি কাজল দিতে পারিনা, চোখে পানি চলে আসে৷
বলতে বলতেই গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো,কাজল দিলে আমার আসলে কিছুই হয়না। কিন্তু এমনিতেই এই মূহুর্তে আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো তাই এভাবেই একটু কান্নার সুযোগ খুঁজে নিলাম।
আম্মু এবার আর হাসছেনা। একটু বিষন্ন চেহেরায় আমার দিকে এগিয়ে বললো,
‘ কিচ্ছু লাগবেনা, এমনি চল। সাদাসিধা অবস্থায় দেখাটাকেই ভালো বলে মনে করি।
রাফানের মা এটাতে সম্মতি দিলেও আমার ফুফু আর পাত্রের মা এটাতে একটু বিচলিত।
তবুও কিছু বললোনা। রাফানের মাকে লক্ষ্য করে বললো,
‘ চল আমরা যাই, আর আপনারা আপনাদের মেয়েকে নিয়ে আসুন।
বলেই বেড়িয়ে গেলো। আমি আবার আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম।
আম্মু মাথায় হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,
‘ কিচ্ছু হবে না। এই অবস্থায় পাত্র তোকে মোটেও পছন্দ করবেনা। চল, দেখলেই বিয়ে হয়ে যায়না। এমনিতেই ওরা সবাই সন্দেহজনক চোখে দেখছে, আর পাগলামি করিস না।
আমি আম্মুর কথা শুনে ভরসা পেলাম। ধিরে ধিরে বেড়িয়ে হলাম। ফুফু দৌঁড়ে গিয়ে আগে থেকে তৈরি করে রাখা শরবত সাথে হালকা নাস্তা সামগ্রী এনে আমার দিয়ে বললো,
‘ আয়! তাড়াতাড়ি আয়।
আমি মাথা নিচু করে গিয়ে বসলাম। রাফানের মা উঠে এসে আমার মাথা তোলার চেষ্টা করলো আর বললো,
‘ রাদিফ মাশাল্লাহ বলো।
কিন্তু একি! আমাকে দেখার সাথে সাথে আমার সামনে বসে থাকা পাত্র উঠে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি এতে অবাক হয়ে কিছু ভাবার আগেই সে জোর গলায় বলে উঠলো,
‘ ছি আন্টি! এসব কি?আমি আমার ছোট ভাইয়ের প্রেমিকাকে কি করে বিয়ে করবো?
এই কথা শুনে উপস্থিত সবাই পুরো স্তব্ধ হয়ে গেলো। আর সাথে সাথে রাফানের মা ছিঁটকে নিজের হাত আমার থেকে সরিয়ে নিলো।
চলবে…..