ধারণার_অতীত [০৭]

0
985

ধারণার_অতীত [০৭]
লেখাঃ তাজরীন_খন্দকার

আম্মু আমার হাত ধরে বললো,
‘ বিয়ে তো শেষ, চল আমরাও বিদায় নিয়ে বাসায় যাই।

আমি মাথা নেড়ে আম্মুর সাথে শ্রেয়ার মা’র কাঁছে গেলাম। শ্রেয়ার মা মন খারাপ করে বসে আছে। আমাদেরকে দেখেই কাঁদো কাঁদো চেহেরায় বলে উঠলো,
‘ মেয়েটা ঘরটা ফাঁকা করে চলে গেলো।

আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আমারটাও জানি কোনদিন চলে যায়। এতো কষ্ট করে বড় করি পরেরবাড়ির জন্য। যাই হোক আমরা বাসায় চলে যাবো এখন। মেয়ে খুব ভালো থাকবে চিন্তা করবেন না।

আন্টি মাথা ঝাঁকালো।

আর আমি ব্যাগ হাতে নিয়ে বললাম,
‘ আচ্ছা আন্টি আমরা আজকে যাই, শ্রেয়া আসলে পরে একদিন আসবো।

আম্মুও সবার থেকে বিদায় নিলো। শ্রেয়ার মা ছলছল চোখে একে একে সব মেহমানদের বিদায় দিচ্ছে।

বাড়িতে আসার পরে দেখি আব্বু আজকে বাসায় তাড়াতাড়ি চলে আসছে। দেখেই আমরা মা মেয়ের হৃদকম্পন বেগতিক হলো। কারণ আমরা আব্বুকে কিচ্ছু জানিয়ে যাইনি। আর আজকে আব্বুর তাড়াতাড়ি চলে আসার কারণও আঁচ করতে পারলাম না। এদিকে আমাদেরকে দেখতে পেয়েই কর্কশ স্বরে আব্বু বলে উঠলো,
‘ ওহহ অবশেষে আসছো তোমরা? বসো এখানে,কথা আছে।

আম্মু ভয়ে ভয়ে সোফায় বসলো। আমি সোফার হাতলে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে বললেন,
‘ দাওয়াত কি তোমাদের দুজনকেই দিয়েছিলো?

আম্মু একটু ইতস্তত করে বললো,
‘ না আপনাকেও দিয়েছিলো।

বাবা জোর গলায় বলে উঠলেন,
‘ তাহলে আমাকে এই কথা জানিয়েছিলে? মা মেয়ে একা একা চলে গেলে, আমাকে মুখের কথাটাও জানালে না! অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে হয়নি? তারপর আবার কোথায় গেলে? যেখান্ব আমার মেয়েকে রিজেক্ট করে যাওয়া ছেলেটা বর ছিলো। আমার মেয়ে কোনদিকে শ্রেয়ার চেয়ে কম? বরং অনেক বেশি ভালো! তোমাদের লজ্জা করলোনা যেতে?

মা থতমত খেতে খেতে জবাব দিলো,
‘ সেসব কেন বলছেন? মেয়েটা যেমনি হোক ছেলেটা তাকে পছন্দ করতো। আর শ্রেয়ার বান্ধবীর বিয়েতে শ্রেয়া যাবেনা? আর ওর গার্ড হিসেবে আমার যাওয়াটাও তো জরুরী।

বাবা আরো রেগে বললো,
‘ তুমি গার্ড হিসেবে নও তুমি পুরো তদারকি করতে গেছো। এই বিয়ের সমন্ধ তোমার মাধ্যমেই হয়েছে। কেন এতকিছু লুকালে?

আমি পুরো থ মেরে রইলাম। আব্বু এতকিছু কি করে জানে? কে এসব বললো? আমি ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি। মা কোনোভাবে জবাব দিলো,
‘ ছেলেটা আমাকে সমন্ধের কথা বলতে বলছিলো। কারণ শ্রেয়ার পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক আছে আমি ছাড়া এমন কাউকে সে চিনেনা। আমি শুধুই এটাই করেছি।

আব্বু দাঁড়িয়ে গেলেন। আর টেবিলে গিয়ে জগ থেকে নিজের হাতে ঢেলে ঢকঢক করে একগ্লাস পানি এক নিঃশ্বাসে শেষ করলেন। আম্মু ভয় পাচ্ছে। কারণ আম্মু জানে আব্বু বেশি রেগে গেলে এভাবে পানি খায়।

পানি খেয়ে এসে আব্বু বললো,
‘ সত্যটা বলো মুনতাহার আম্মু। তোমার চোখ মিথ্যা বলছে। আর আমি জানি আমার স্ত্রী এতটাও আত্মসম্মানহীন হয়ে যায়নি যে আমাদেরকে রিজেক্ট করা ছেলের জন্য নিজে গিয়ে অন্য জায়গায় বিয়ের আয়োজন করবে, আবার সেজেগুজে সেখানে মেয়ে নিয়ে উপস্থিত থাকবে!

আমি ভয়ে এখান থেকে সরে পড়লাম। পর্দার আড়াল থেকে শোনার চেষ্টা করছি আম্মু এরপর কি বলে? আম্মু কপালে কিছুক্ষণ হাত রেখে সোজা হয়ে বসলো। আর সুন্দরমতো বুঝিয়ে বলতে লাগলো,
‘ শুনুন তাহলে। আপনি জেনেছিলেন না যে ওই ছেলেটার একটা সম্পর্ক আছে অনেক বছর ধরে? সে একটা মেয়েকে পছন্দ করে? সেটা আমাদের মেয়েই। আমাদের মেয়ে ছাড়া ছেলেটা আর কাউকেই পছন্দ করেনা। আর মুনতাহাও চায় যে রাফানের সাথেই তার বিয়ে হোক।

আব্বু সাথে সাথে চোখ বড় করে ফেললেন, হুংকার ছেড়ে বললেন,
‘ তুমি ওর মা? তুমি এসবকে প্রশ্রয় দিচ্ছো?ছি ছি! আমি কাকে নিয়ে সংসার করছি?

মা শান্ত গলায় বললো,
‘ আমিও সেদিনই জেনেছি। জানার পরে অনেককিছু বলতে গিয়েও বলিনি, যা হওয়ার তো হয়ে গেছে। এখনো কিছু বললে কি সময় ফিরে আসবে? আর মেয়ে বড় হয়েছে, ও যদি ওর পছন্দের মানুষ নিয়ে সুখে থাকে তাহলে আমরা কেন এই অবস্থায় বাঁধা হবো? আর ছেলের মাও যেখানে আমাদের মুনতাহার জন্য পাগল?

আব্বু গম্ভীর চেহেরায় ধপ করে বসে পড়লেন। দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
‘ অবাক লাগছে তোমাকে দেখে, কি করে পারলে আমার অগোচরে এতকিছু করতে? আর মেয়েকে তুমি! আমি ভাবতে পারছিনা।
যাও যাও যা ইচ্ছে করো গিয়ে, আমি এসবে নাই। তুমি ফোন করে ওদেরকে হ্যাঁ বলে দাও ব্যস! আমাকে টানবেনা। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না তুমি কি করে পারলে!

আম্মু আস্তে আস্তে উঠে আব্বুর পাশ ঘেঁষে বসলো। আমি সরে রুমে চলে গেলাম। আম্মু অবশ্যই আব্বুকে বুঝাবে। তবে এটা শুনে উনি কষ্ট পেয়েছেন সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। এটা পাবেন আগেই জানতাম, কিন্তু আমি যে একটা ভুল করে ফেলেছি বিয়ে ছাড়া সেটার আর কোনো প্রতিষেধক নেই।

যাই হোক এক হিসেবে ভালো হয়েছে বাবা জেনে গিয়েছে, এখন আর উনার সাথে আমাদের লুকোচুরি করতে হবে না। শুধু রাফানের মাকে কোনোভাবে বুঝাতে পারলেই হবে। সেটা বিয়ের আগে সম্ভব না আমি এবং রাফান দুজনেই জানি।

দুইদিন পর আমার আব্বুর রাগটা একদম ঠান্ডা হলো। আমাকে আর আম্মুকে একসাথে ডেকে বসিয়ে বললো,
‘ উপায় যেহেতু নেই-ই তাহলে আর কি করা? ওই আপাকে জানিয়ে দেই বিয়ের দিন তারিখ করে যেতে। কি বলো মুনতাহার আম্মু?

আম্মু খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
‘ অবশ্যই অবশ্যই এখনি কল করে বলে দেন।

আব্বু হাসিমুখটায় গম্ভীরতা এনে আম্মুকে চুপ থাকতে বললো। এরপর অপেক্ষা করছে ফোন রিসিভ হচ্ছে কিনা।
প্রথম কলটা রিসিভ হলোনা। পরেরবার দেওয়ার আগেই রাফানের মা ফোন ব্যাক করলো।
আব্বু লাউড স্পিকার দিলো।

রাফানের মা ওপাশ থেকে বললো,
‘ ইচ্ছে করেই রিসিভ করিনি ভাইজান। কারণ আমি ফোন দিতে যাচ্ছিলাম। যেহেতু আমি মেয়েকে চাচ্ছি সেহেতু আমারই এগিয়ে থাকা উচিত। তা আপনাকে আমি প্রমাণ দিতে চাই আমার ছেলের কোনো পছন্দ নাই, আর সে আপনার মেয়েকে নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করতে চাচ্ছে৷ আমি কালকেই বলতাম কিন্তু বিয়ের আয়োজন থেকে আজকেই বাসায় ফিরলাম। রাফান বলেছে তার নাকি মুনতাহাকে খুব ভালো লেগেছে। সে এই বিয়েতে রাজী।

আমার আব্বু গম্ভীরতার সাথে বললো,
‘ আচ্ছা আপা প্রমাণ লাগবেনা। আপনি ব্যবস্থা করুন। আপনাকে আমি ভরসা করি।

রাফানের মা বললো,
‘ মোটেও না। আমি প্রমাণ দিয়েই তবে বিয়ের তারিখ নিয়ে কথা বলবো। আপনি আমাদের বাড়িঘর দেখে যান, আর আমার ছেলের মুখে সরাসরি সম্মতি শুনে যান।

আব্বু আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আচ্ছা তাহলে এই কথা থাকলো। আমি আগামীকাল আমার স্ত্রীকে নিয়ে আসবো।

পরেরদিন আম্মু আব্বু একসাথে গিয়ে দেখলো। দুই পরিবার মিলে বিয়ের তারিখও পাকা করলো। মনে হচ্ছিলো এই জীবন আমার স্বার্থক। রাফানও খুব খুশি। আমাদের বিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে পরিবেশন হবে বলে সিদ্ধান্ত হলো।
অতিথি নিমন্ত্রণে দুই পরিবার মারাত্মক ব্যস্ত।
রাফানও ব্যস্ততায় আমার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে।

আমাদের সব আত্মীয় স্বজনরা বিয়ের ৩-৪ দিন আগ থেকেই আসতে লাগলো। ফুফি আর খালাদের আম্মু জোর করে নিয়ে আসছে।
আমাদের কাজিনরাও অনেকে চলে আসছে।

গায়ে হলুদের আগেরদিন রাফান ফোন করে বললো,
‘ মুনতাহা আমার আম্মু তো ক্ষেপে গেছে। আম্মু নাকি দক্ষিণ পাড়ায় গিয়েছিলো কাকে দাওয়াত দিতে, সেখান থেকে চলে গেলো আমার এক বন্ধুর বাড়িতে৷ কার্ড দেখে আমার বন্ধু নাকি বলছে, যাক আন্টি অবশেষে আপনি ছেলের পছন্দকে মানলেন। ওদের এত বছরের প্রেম স্বার্থক! আম্মু সেখানেও রাগ দেখিয়ে আসছে, আর এখানে এসেও রাগে ফোসফাস করছে। আম্মুকে এখন কি বলবো? এখনো ড্রয়িং রুমে মুখ গোমড়া করে বসে আছে!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here