ধারণার_অতীত [০৮]

0
857

ধারণার_অতীত [০৮]
লেখাঃ তাজরীন_খন্দকার

আন্টির অবস্থা শুনে আমার মাথা পুরো ঘুরে গেলো। আর আমি বুঝতে পারছি না রাফানের বন্ধুগুলো এতো আজব কি করে হলো? আন্টিকে সরাসরি এটা জিজ্ঞাসা করার কি দরকার ছিলো? ওরা ভালো করেই জানতো যে আন্টি এসব ব্যপার নিয়ে বেশ মারাত্মক।

এদিকে রাফান আমাকে ফোনে বলছে,
‘ আচ্ছা আমি রাদি ভাইকে ফোন করে দেখি উনি কোনো বুদ্ধি দিতে পারে কিনা? আমার মাথা একদম আউলে গেছে। বুঝতে পারছি না মাকে কীভাবে বুঝাবো!?

আমি হ্যাঁ সম্মতি দিয়ে ফোন কেটে দিলাম। রাফান এরপর রাদিফ ভাইয়াকে কি বলছে জানিনা। তবে আমি রাফানকে এসএমএসে জিজ্ঞেস করছিলাম আন্টির রাগ কমেছে কিনা?
রাফান জবাব দিয়েছে,
‘ হ্যাঁ রাদি ভাইয়া আম্মুর এই রাগের কথা শুনে কালকে আসার কথা থাকলেও আজকে আমাদের বাসায় এসে পড়েছে। সাথে খালামনি আর শ্রেয়াকেও আজকেই নিয়ে আসছে। আর এসে নিমিষেই সবকিছু সমাধান করে দিলো। হাহাহা জানো মুন, রাদি ভাইয়ের বুদ্ধির তিল পরিমাণ যদি আমার থাকতো আমি কবেই তোমাকে পেয়ে যেতাম! এতো ঝড়ঝাপটা পোহাতে হতোনা।

আমি এসএমএসটা পড়ে হাসলাম। আসলেই রাফান বড্ড বোকা, আর সে এমন বোকা বোকা বলেই আমি তাকে একটু বেশি ভালোবাসি! একদিকে সে তার মাকে খুশি রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে, আর অন্যদিকে শুধু আমাকেই পেতে চায়। আমি ছাড়া সে যে ভালো থাকতে পারবেনা তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি।

আমাদের বাড়িতে প্রচুর গোছগাছ চলছে, কালকের অনুষ্ঠানের জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। আয়োজন আমাদের বাসায় না হলেও কেনাকাটা আজকেই হয়ে যাচ্ছে, যে যার জিনিসপত্র একত্র করছে।

আমি বেশ খুশি ছিলাম, যাই হোক অবশেষে তো আমরা এক হতে যাচ্ছি। আমার আব্বু আম্মুও অনেক খুশি৷ আব্বু প্রথম রাগারাগি করলেও মন থেকেই মেনে নিয়েছেন ব্যপারটা৷

গায়ে হলুদের দিন।
দুই পরিবারের সকল মেহমান এক স্থানে মিলিত হচ্ছে। আমার বাবা-মা আর আত্মীয় স্বজন সবাই আনন্দে মুখর হয়ে আছে। আর পাত্রকেও সবার বেশ পছন্দ হয়েছে। আমার কাজিনরা রাফানকে দেখার পর থেকে তো বারবার বলছে,
‘ আপু ইচ্ছে করছে তোমার বরকে চুরি করে নিয়ে পালিয়ে যাই।

আমি সবার কথা শুনে শুধু হাসছি। কারণ আমি জানি আমি জিতে গেছি। রাফান পাত্র হিসেবে সবদিকেই সেরা, শুধু একটু ভীতু।

এদিকে রাফানের পরিবার আমাদের পরে আসছে। রাফান, রাদিফ ভাই আর শ্রেয়া একসাথে এক গাড়ীতে মালামালসহ আসছে, আর আন্টিরা পরের গাড়ীতে।
শ্রেয়া গাড়ী থেকে নেমেই দৌঁড়ে এসে আমার কাছে এসে আমার হাত চেপে ধরে বললো,
‘ এসব কি মুনতাহা? তুই আমাকে এতদিন এসব কেন জানাস নি?

আমি আশেপাশের মানুষজনের দিকে তাকিয়ে থতমত খেলাম। তারপর ফিসফিস করে বললাম,
‘ বলার কোনো সুযোগ পাইনি শ্রেয়া। তোর বিয়েটাও অনেক গোপনীয়তা বজায় রেখে হয়েছে। আমি জানি রাদিফ ভাই সবকিছু তোকে বুঝিয়ে বলেছে, কিংবা বলবে।

শ্রেয়া চোখ পিটপিট করে বললো,
‘ কখন বলছে জানিস তুই? কালকে বলেছে। তাও আমি না জেনে ঝামেলা পাকানোর পর।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘ তুই কি ঝামেলা পাকাতে যাচ্ছিলি?

শ্রেয়া আস্তে আস্তে বললো,
‘ আরে তোর শাশুড়ী যে কোথায় তোদের সম্পর্কের কথা জেনে রেগে ছিলোনা? সেটা সমাধান করতে তো রাফান ভাইয়া আমাদেরকে ডাকছে। কিন্তু আমার উনি তো আমাকে এসব জানিয়ে আনেনি। গিয়ে আন্টিকে বুঝাচ্ছে যে রাফান ভাইয়ার সাথে তোর পূর্ব পরিচিতি ছিলোনা, ওরা যা জানে তা সম্পূর্ণই ভুল। আন্টিকে স্বাভাবিক করতে উনি এটাও বললো যে রাফান ভাইয়ের অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো, যার নাম মুনতাহা নয় মুনমুন। কারণ ওই ছেলেটা তোকে মুন নামেই উল্লেখ করেছিলো নাকি! এরপর খালামনি বিশ্বাস করলো যে সেটাই হবে। এদিকে আমি বলে বসছিলাম যে রাফান ভাইয়ার কোনো এক্স ছিলো বলে তো জানতাম না। উনি তো একজনকেই ভালোবাসতেন।
সেই কথা শুনে আন্টি রেগে আমাকে প্রশ্ন করলো, সেটা তোমাদের মুন নয়তো? আমি পুরো বোকাবনে গেলাম। তারপর বিষয়টার গভীরতা আঁচ করে চুপ করে থাকলাম। আর সেই পরিস্থিতি রাদিফ অনেক কষ্টে সামাল দিয়েছে। সেখান থেকে আমাকে রুমে এনে তারপর দুই ঘন্টা লাগিয়ে আন্টি আর তোদের ব্যপারে সম্পূর্ণ ঘটনা বুঝিয়েছে। শুনে তো আমার মাথা পুরো হ্যাং হয়ে গিয়েছিলো। কি জটিল শাশুড়ীরে তোর।

আমি অভিমানি স্বরে বললাম,
‘ জটিল তোর শাশুড়ীও, কিন্তু এসব ছাড়াও আমি বুঝতে পারিনা উনার সমস্যাটা কোথায়? ছেলের অন্য জায়গায় সম্পর্ক থাকলেও মেনে নিবে কিন্তু আমার সাথে কেন নয়? উনি কেন এমন করছে?

শ্রেয়া হাসতে হাসতে বললো,
‘ কারণ উনি তোকে প্রচন্ডরকম বিশ্বাস আর আকাঙ্খা নিয়ে পুত্রবধূ করছে। ছেলের খারাপ কিছু মানলেও তোকে যে পরিমাণ বিশ্বাস করে সেটার বিপরীত কিছু উনি মানতে নারাজ। যদি এমন কিছু উনার সামনে আসে তাহলে নাকি উনার নিজেকে খুব ছোট মনে হবে। কালকের কথায় আমি তাই বুঝতে পারলাম। সত্যি তুই পরেও ফেঁসে যেতে পারিস, সাবধান। আর উনি খুব বেশি কষ্ট পাবে তোর এবং আমাদের এমন লুকোচুরি খেলার ব্যপারে জানলে!

আমি জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে জবাব দিলাম,
‘ একদিন না একদিন তো সত্য সামনে আসতেই পারে, কতদিন গোপন রাখতে পারবো বল? জানিনা ওইদিনটা আমার জীবনের শেষদিন হয় কিনা!

শ্রেয়া হাসতে লাগলো।

সবাই উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে আয়োজন জমকালো হতে থাকলো। চারপাশে হইচই, নাচগান আর সাজগোজ। শ্রেয়া পার্লার থেকে সেজে আসছে। আর আমাকে ভেতরে সাজানো হচ্ছে।
রাফান এর মধ্যে আমার সাথে দেখা করেনি। আমার শাশুড়ী একবার এসেছিলো। বেশিক্ষণ থাকেনি কারণ উনি মেহমানদের সাথে আলাপ আলোচনায় বেশ ব্যস্ত।

আমাকে সাজানো শেষ হওয়ার মূহুর্তেই হইহট্টগোল আরো বেড়ে গেলো। কারণ ইতোমধ্যে সবাই আমারই অপেক্ষা করছিলো।
সবাই আলাপ আলোচনা ছেড়ে এবার আমার দিকে মনোযোগী। আমার শাশুড়ী প্রথম আমার কাছে আসলেন, মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। সবার সাথে ছবি তুললেন, নিজেও আমার সাথে সেল্ফি তুললেন। আমার মাকে ইশারা করে ডাকলেন আমার কাছে আসতে। আমার মা আমার পাশে আসলো, মুচকি হেসে বললো,
‘ এই মা টাকে একটু বেশিই ভালোবাসিস,দেখছিস তো তোকে কতো শখ করে নিজের কাছে নিয়ে যাচ্ছে?

আমি হেসে মাথা নাড়লাম। ঠিক সেসময় হন্তদন্ত হয়ে আমাদের সামনে একটা মেয়ে দৌঁড়ে এসে দাঁড়ালো, সে হাঁপাচ্ছে।
পেছনে বিষন্ন চেহেরায় রাফান দাঁড়িয়ে আছে। নিজের বাড়ানো হাতটা মূহুর্তে গুঁটিয়ে নিয়েছে সে। দুজন একসাথেই এসেছে। মেয়েটা দ্রুত গলায় রাফানের মাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো,

‘ আন্টি আন্টি প্লিজ আপনি এই বিয়ে থামান। এই বিয়ে আপনি দিতে পারেন না! আপনি আপনার ছেলের বিরুদ্ধে বিয়ে দিচ্ছেন, সে আমাকে ভালোবাসে। আমি মুনমুন, আপনার ছেলে রাফানের প্রেমিকা। অনেকদিন ধরব আমাদের সম্পর্ক। আমি জানতামই না যে রাফানকে আপনি এভাবে বিয়ে করিয়ে ফেলবেন। যখনি শুনলাম আমি একটুও দেরি করিনি, কি করে করবো বলুন? আমরা দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসি যে। আমি জানি আপনাকে রাফান এসব জানাতে পারবেনা, তার এতো সাহস নেই। তাই আমি জানাতে এসেছি। প্লিজ আপনি আপনার পছন্দে ওকে অশান্তিতে ফেলে দিবেন না। ওর পছন্দকে একটু গুরুত্ব দিন।

আমি কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে যেই কিছু বলতে যাবো যে আন্টির পছন্দে বিয়ে হচ্ছে কে বললো? তখনি আমার মনে পড়লো এই কথা বলা যাবেনা। কিন্তু আমার মাথায় গোলমাল পেকে গেলো, শ্রেয়ার মুখে মুনমুন নামের কথা মনে হতেই আমার সারা শরীর শিউরে ওঠলো। শ্রেয়া বলছিলো রাদিফ ভাইয়া আন্টিকে মুন বলতে মুনমুন নামক কাউকে বুঝিয়েছে যেটা কিনা মিথ্যা। কিন্তু এতো দেখি সত্যি আর সে নিজে উপস্থিত। মেয়েটা এসব কি বলছে? তাদের সম্পর্ক ছিল মানে? আমি ধারণাই করতে পারছিনা যে এই মেয়ের রহস্য কি? এভাবেই কেন আসলো? আর পেছনে রাফানই বা কেন এমন বিমর্ষ চেহেরায় দাঁড়িয়ে আছে?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here