ধূম্রজাল,পর্ব-০২,০৩

0
484

‘ধূম্রজাল,পর্ব-০২,০৩
তাবিনা মাহনূর
দ্বিতীয় পর্ব
________

রাত নেমেছে। বাহার তার প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো ল্যাপটপে টুকে রেখে সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। অনেকক্ষণ একভাবে বসে থেকে কাজ করায় ঘাড়ে ব্যথা করছে। আজকে যেই মেয়েটার সাথে সে দেখা করেছে সেই মেয়েটা নেশাদ্রব্য সেবনের কারণে বাসার কাজের মেয়েটাকে খু-ন করেছে। কিশোরী মুনিয়াকে কিশোর সংশোধনাগারে রাখা হবে। তার আগে মুনিয়ার মানসিক অবস্থা যাচাই করে তাকে কেমন সেবা দিলে সে কতটুকু উন্নতি করবে, এসব বিষয় পরিকল্পনা করে রাখা হলো।

কিশোরী মুনিয়ার বয়স কম নয়। দেখে মনে হলো আঠারো পার হয়েছে, কিন্তু সার্টিফিকেট অনুযায়ী বয়স এখন সতেরো। বাহার তাকে দেখেই বুঝেছে মুনিয়া মোটেও কিশোরী নয়। মিথ্যে বয়স আর আঠারো বছরের অদ্ভুত নিয়মের কারণে মুনিয়া খু-নের মতো বড় পাপ করেও কেমন ছোটখাটো শাস্তি পাচ্ছে! বাহার যখন মুনিয়ার মানসিক অবস্থা যাচাই করছিল, তখনো সে বুঝেছে মুনিয়া ছোট নয়।

এভাবেই অপরাধ জগৎটা তার নিজস্ব মতে চলছে। চাইলেই তারা শাস্তির বিধান বদলে, মানুষকে পুতুলের মতো চালিয়ে নিজেদের নোংরা উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে। বাহারের মাঝে মাঝে সব ছেড়ে একাকী ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। চারিপাশের নোংরা বলয়ের মাঝে থাকতে থাকতে তার মনের রং ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে, বিবশ তার অনুভূতি।

মা হানজালা সেই রং ফিরিয়ে আনতে প্রায়ই বিয়ের কথা বলেন। কিন্তু বাহারের মনে কারো প্রতি আকর্ষণ কাজ করে না। আবির ছেলেটা ভালো হলেও তাকে দেখে কেন যেন মনের মাঝে কোনো ঘন্টা বাজে না। তাই আজও বাহার একা, ধূসর রঙা মন নিয়ে মরীচিকার পেছনে ব্যস্ত।

ফোনের আওয়াজ শুনে বাহার ফোন হাতে নিলো। আবির কল করেছে। ছোট এক শ্বাস ফেলে সে কল ধরে বললো, ‘আবির? এত রাতে?’

– কোথায় রাত? কেবল একটা বাজে।
– রাত একটা তোমার কাছে রাত নয়?
– উহু, আচ্ছা এসব ছাড়ো। তুমি কালকে অফিসে আসবে?
– না। আজ মুনিয়ার কেসটা শেষ হলো। এখন নতুন কোনো কেস হাতে নেই। তাই আগামী তিনদিনের জন্য অফিস ছুটি নিয়েছি।

আবিরের মন খারাপ হয়ে এলো। তবে সে সেটা প্রকাশ না করে বললো, ‘কাল এমনিই একটু বের হবে? ধরো বিকেল বেলা একসাথে দুজন কোথাও বেরিয়ে এলাম…’

– না আবির। আমি অন্তত একটা দিন আরাম করতে চাই। কাল পুরো দিন বাসায় থেকে বিশ্রাম নিব। বাইরে যদি যাই তাহলে পরশু দিন যাবো।
– ওকে ফাইন। আমি অপেক্ষায় থাকবো।
– তোমার কাজ নেই কাল?
– আমার তো প্রায় সবসময়ই কাজ। এদিকে আবার নতুন মামলা। ডক্টর শামসুজ্জামান তোহার মামলা বেশ জটিল। ওহ বাহার! জিজ্ঞেস করতে ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা, তুমি কি সাদিকে চেনো? তখন প্রশ্ন করা সত্ত্বেও তুমি কোনো উত্তর না দিয়েই চলে গিয়েছিলে।

মনে পড়লো বাহারের, সাত বছর আগে তার বান্ধবী অরিত্রী চক্রবর্তীর বিয়ের অনুষ্ঠানে সে দেখেছিল প্রিয়ংশুকে। প্রিয়ংশু ব্যানার্জির আরো একটা পরিচয় আছে। প্রিয়ংশুর সেদিনের আলাপে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছিল বাহারের মুখে। অরিত্রীর বিয়েতে সে পরেছিল কালো রঙের জামদানি শাড়ি এবং মুক্তার গয়না। তার খোঁপায় ছিল বেলির সুবাস। সবাই চোখ জুড়িয়ে তার দিকে তাকালেও সে খেয়াল করেছিল প্রিয়ংশু একবারও তাকে দেখে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করেনি।

এরপর তার কেন যেন নিজেকে বেদামি মনে হয়েছিল। হিন্দু থেকে মুসলিম, সকল পুরুষের চোখে সে ছিল অনিন্দ্য সুন্দরী। অথচ প্রিয়ংশু যেন তাকে দেখেও না দেখার ভান করছে। বাহার সেদিন বুঝতে পারেনি প্রিয়ংশুর সেই অনাগ্রহী মনোভাব কেন সে মেনে নিতে পারছিল না। তবে সে স্বেচ্ছায় যায়নি। তার হাত ধরে তারই এক বান্ধবী প্রিয়ংশুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। যখন সে মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, ‘আমি গুলবাহার সাখাওয়াত।’

তখন প্রিয়ংশু তার টোল দৃষ্টিগোচর করে হালকা হেসে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, ‘আমি প্রিয়ংশু ব্যানার্জি।’

আর বাহার থমকে গিয়েছিল সেসময়। এ যে হিন্দু ছেলে! সে কেন যে হিন্দু বাড়িতে এসে ছেলেটাকে মুসলিম ভেবে বসে ছিল! বাহার তার মনের অবস্থা বুঝতে না দিয়ে নিজের পরিচয় জানিয়েছিল। এভাবেই সে জানতে পারে প্রিয়ংশু ব্যানার্জি সম্পর্কে অরিত্রীর মামাতো ভাই এবং সেই সাথে নামকরা কোম্পানি বি-অ্যারোমার প্রতিষ্ঠাতার নাতি।

প্রিয়ংশু বাহারের মতো রূপবতীকে দেখে টলেনি এর কারণ তার প্রিয়তমা স্ত্রী। স্ত্রী সাবিত্রীকে দেখামাত্রই সে হাত বাড়িয়ে কেমন আদুরে ভঙ্গিতে জড়িয়ে নিয়েছিল নিজের বাহুদ্বয়ের মাঝে। বাহার অবাক হয়ে দেখেছিল, প্রিয়ংশু কত প্রাণবন্ত হাসি হাসছে স্ত্রীকে কাছে পেয়ে!

ভাবনার সুতো কাটলো আবিরের কন্ঠ শুনে, ‘হ্যালো, হ্যালো! তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে বাহার?’

বাহারের সম্বিৎ ফিরলো। সে বলে উঠলো, ‘হুম, দেখেছিলাম একটা অনুষ্ঠানে। অরিত্রীর কথা মনে আছে?’

– কোন অরিত্রী? চক্রবর্তী নাকি চৌধুরী?
– চক্রবর্তী। ওর বিয়েতে তুমি যাওনি মনে হয়।
– না, অরিত্রী চক্রবর্তির সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল না। দূর থেকে দেখা হলে হাই-হ্যালো ছাড়া আর কোনো কথা হতো না।
– আমি ঐ লোকটাকে অরিত্রীর বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম। উনার বয়স আছে, দেখে বোঝা যায় না।
– মানে?
– মানে কম করেও তেত্রিশ চৌত্রিশ বছর হবে উনার। আমার বয়সই তো ঊনত্রিশ হলো।
– তোমার সাথে উনাকে মেলাচ্ছ কেন তুমি?
– আরে, সাত বছর আগে দেখেছিলাম উনাকে। ওইসময় বিবাহিত ছিল লোকটা। এখনো তেমনই আছে দেখতে। তাই মিলিয়ে দেখলাম ছেলেরা সহজে বুড়ো হয় না।

হেসে উঠলো আবির, ‘আর মেয়েরা?’

বাহার বললো, ‘মেয়েদের বয়স আর বুড়ো হওয়ার অনুপাত আপেক্ষিক। এটা নির্ভর করে ছেলেদের উপর। তারা যেভাবে মেয়েদের বয়স কল্পনা করবে, সেটাই সেই মেয়ের বয়স অনুযায়ী বুড়ো হওয়ার অনুপাত।’

– বাহ! ফিলোসফি নিয়ে পড়া শুরু করেছো নাকি?
– মজা করছি না আবির। তোমার বয়সও আমার মতো। অথচ তুমি এখনো যুবকের মতো দেখতে। আমাকে দেখলেই বোঝা যায় ত্রিশের কাছাকাছি চলে এসেছি।
– তাতে কি? মেয়েরা পঞ্চাশ হলেও ছলনাময়ী থেকে যায়।

বাহারের কথা বলতে ভালো লাগছে না। এখন তার ঘুমের প্রয়োজন। সে কথা শেষ করতে বলে উঠলো, ‘আবির, এখন রাখি। ঘুম ধরেছে।’

আবির দ্রুত বলে উঠলো, ‘এই এই! আমাকে উত্তর দাও যে সাদির সাথে তোমার কিভাবে পরিচয়? ওকে দেখে কি মনে হয় ও অপরাধী হতে পারে?’

‘আমার পরিচয় সাদি না, প্রিয়ংশুর সাথে ছিল’, এই বলে বাহার কল কেটে দিলো। নাহলে আবির যেকোনো অজুহাতে কথা চালিয়ে রাত তিনটা বাজিয়ে ফেলবে।

__________

আজ অফিসে কাজ নেই। বাসায় থেকে বিশ্রাম নিতে চাইলেও বাহারের মন যেন ক্লান্ত হতে চায় না। তাই আজও বাহার নেমে পড়লো তথ্য সন্ধানে। আজকের বিষয় প্রিয়ংশু ব্যানার্জি যার এখনকার পরিচয় সাদি হাসরাত।

বন্ধু নিলয়, তারপর প্রান্ত এবং সবশেষে রাশার কাছ থেকে অরিত্রীর ফোন নম্বর জোগাড় করলো বাহার। অরিত্রীর মামাতো ভাই প্রিয়ংশু। তাই সাদি হাসরাতের পরিচয় জানতে অরিত্রীর সাহায্য নিতে হবে তাকে। অরিত্রী ফোন ধরলে সে আন্তরিক ভঙ্গিতে বললো, ‘কি খবর অরি? আমাকে চিনেছিস?’

– আরে বাহার! চিনবো না কেন? তোর কন্ঠ সবচেয়ে অনন্য। একবার শুনলে যে কেউ মনে রাখতে পারবে।

অরিত্রী এমনই হাসিখুশি স্বভাবের মেয়ে। কিন্তু এতোটা খুশি আচরণ বাহার আশা করেনি। নিজের আত্মীয় খু-নের দায়ে জেল খাটতে চলেছে, অথচ অরিত্রীর যেন কোনো চিন্তাই নেই! বাহার শুরুতেই সেই প্রসঙ্গে গেল না। প্রথমে কিছু সাধারণ কথাবার্তা সেরে সে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা দোস্ত, তোর একটা মামাতো ভাই ছিল না?’

– কোন ভাই?
– প্রিয়ংশু ব্যানার্জি?

চুপ করে আছে অরিত্রী। বাহার উত্তরের অপেক্ষায়। কিছুটা ধীর স্বরে অরিত্রী বলে উঠলো, ‘প্রিয়ংশু বলে আমাদের পরিবারে কেউ নেই। তুই এই নামের কারো কথা জিজ্ঞেস করবি না।’

– ওমা! আমার সাথে উনার পরিচয় হয়েছিল তোর বিয়ের দিন। উনি তো…
– ছিল একজন। এখন কেউ নেই। কিন্তু তুই হঠাৎ তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিস কেন?
– তুই টিভি দেখিসনি? দোস্ত, আমাকে ভুল বুঝিস না। আগেই বলে রাখি, আমি পাশের বাসার আন্টিদের মতো নই যে তোদের বংশের বদনাম করতে প্রিয়ংশুর কথা তুলে আনছি। তুই হয়তো জানিস না, আমি অপরাধ মনোবিজ্ঞানের কর্মী। এ কারণেই…
– আমি তোকে ভুল বুঝছি না বাহার। তবে আমাকে এই ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন না করলেই খুশি হবো।
– শুধু এটুকু বল যে উনি কি মুসলিম হয়েছেন?
– হুম।
– তাহলে আমি ভুল দেখেনি। আচ্ছা, উনি হঠাৎ মুসলিম কেন হলেন?
– আমি জানি না। তার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

বাহার বুঝতে পারলো অরিত্রী বিরক্ত বোধ করছে। সে মিষ্টি হেসে বললো, ‘আচ্ছা সমস্যা নেই। অনেক ধন্যবাদ তোকে। উনার সম্পর্কে জানা খুব প্রয়োজন ছিল এই কেসের জন্য।’

ফোন রাখার পর বাহারের মনের অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল। সাদি হাসরাতের জীবনী না জানা পর্যন্ত সে স্বস্তি ফিরে পাচ্ছে না। বিকেলে আবিরের সাথে বের হলে হয়তো একটু মনের প্রশান্তি মিলবে। এই ভেবে আবিরকে ফোন করে দেখা করার কথা বলে রাখলো।

বিকেল বেলা আবিরের সাথে ধানমন্ডি লেক, চন্দ্রিমা উদ্যান, এসব জায়গায় ঘুরে একটা পিজ্জার দোকানে গিয়ে দুজনে বসলো। আবিরকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে সে বড় এক প্ৰশ্বাস নিয়ে বললো, ‘রোদ নেই কিন্তু গরম লাগছে।’

– হুম, তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি খুব ক্লান্ত। আগে ঠান্ডা ধরণের কোনো খাবার খাও। আইসক্রিম অর্ডার করবো?
– আমি করছি, তুমি বসো।
– আমি করছি তো, তুমি আরাম করে বসো।

যেসব দোকানে সেল্ফ সার্ভিস সিস্টেম, সেসব জায়গায় আবিরের যেতে ইচ্ছে করে না। এই যেমন এখন বাহারকে উঠে গিয়ে আইসক্রিমের অর্ডার করতে হলো। ছেলে মানুষ হিসেবে নিজেকে অযোগ্য মনে হচ্ছে। কিন্তু তার শরীর আজ সত্যিই খারাপ। নতুন এক আসামিকে মারতে মারতে দুটো দাঁত ফেলে দিয়েছে তবু সেই আসামি ডাকাতির ঘটনা স্বীকার করছে না। আপাতত সাদিকে নিয়ে বড় বড় সিআইডি-রা কাজ করছেন। তাই এই ব্যাপারে তার হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়নি। ছোট মামলাগুলোই সামলে রাখছে সে। আজকে সে এমনভাবে মেরেছে যে নিজের হাতে পায়ে ব্যথা করছে।

তবে একটা বিষয় ভেবে আবির আনমনে হেসে উঠলো। তা হলো নারী-বাদ। এখানে কোনো কোমলমতি মেয়ে থাকলে সে শত বারণ উড়িয়ে নিজেই যেতো অর্ডার করতে। কিন্তু বাহার একজন প্রতিষ্ঠিত এবং স্বাধীন নারী। সে যেই বিশ্বাসে বিশ্বাসী, আবির তাতে নাক গলানোর অধিকার রাখে না। বাহারকে মানা করলে সে সেটা পুরুষদের কর্তৃত্ব ফলানোর অপচেষ্টার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে থাক নাহয়! বরং তারই ভালো হলো। কষ্ট করে উঠে যেতে হলো না। সে মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না নারীরা কেন যেচে এসবের ভার নিতে চায়? পুরোপুরি ভার নিতে হয় না বলে তারা এখনো বোঝে না কত কষ্ট আর যন্ত্রণার পর দিনটা শেষ হয় রাত্রির স্পর্শে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা নারীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান গড়েছেন, তিনি নির্দেশ দিয়েছেন এমন কিছু নিয়মের যা নারীদের জন্যই মঙ্গল। অথচ আজকের নারীরা সেইসব নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের গড়া অদ্ভুত নিয়মে চলছে। ঠিক নিয়ম নয়, বিশৃঙ্খল জীবন। সাজানো গোছানো একটা অধ্যায়কে তারা উল্টে-পাল্টে নিজেদের অবস্থান করেছে ভঙ্গুর। একটা সময় আসবে, যখন বেশিরভাগ পুরুষ পূর্বের নারীদের মতো ঘরে থাকবে অথবা কাজের ভার বহন করতে অস্বীকৃতি জানাবে। সেসময় নারীরা কেমন পুরুষত্ব দেখিয়ে সমাজ চালাবে, তা যেন অকল্পনীয়! কারণ এখন পর্যন্ত দু পক্ষ থেকে সমান চলে আসছে। একটা সময় ছিল শুধু পুরুষের, এরপর আসবে শুধু নারীদের। তখন বোঝা যাবে নারীরা সত্যিই পারে, নাকি শুধুই মিথ্যে বুলি ওড়ায়।

ভাবনার নৌকা পাড়ে এনে আবির দেখলো বাহারকে। আজ বাহার একটা ফতুয়া আর পায়জামা পরেছে। গলায় ওড়না ঝোলানো। মেয়েটার পেশা অনুযায়ী মেয়েটাকে ছেলেদের মতো কোট-প্যান্ট পরতে হতো। কিন্তু সে অপশনাল পোশাক শাড়িটাকেই মূল পোশাক হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাহলে বাহারের মনে হয়তো কিছুটা শালীনতা আছে। আজকাল আবার দ্বীনি নারী-বাদীও বের হয়েছে অবশ্য। তবে বাহার অতটাও ধার্মিক নয়। আবির মনের মাঝে চেপে রাখা প্রশ্নটা আজ করেই ফেললো, ‘বাহার, তুমি শাড়ি কেন পরো? তোমার পেশা অনুযায়ী শার্ট প্যান্ট পরাটাই শোভা পেতো না?’

বাহার হাত দুটো টেবিলের উপর রেখে বললো, ‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’

– না মানে, তোমাকে আমি আধুনিক মুক্তমনা মেয়েদের মতোই চলতে দেখেছি। কিন্তু পোশাকে কেন যেন তোমার মাঝে বাঙালি নারীদের ছাপ দেখতে পাই। সবসময় একটা শালীনতা, আই মিন, বাঙালিয়ানা ভাব বজায় থাকে।

বাহার উত্তরটা গুছিয়ে দিলো, ‘প্রথমত, আমি এমন এক ঘরের মেয়ে যেখানে পাশ্চাত্য পোশাকের মূল্য কম, বাঙালিয়ানা বেশি। এবং দ্বিতীয়ত, আমার নিজস্ব একটা স্বাধীনতা আছে। আমার মন সবসময় বাঙালি পোশাক, সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট বোধ করে। তাই শার্ট প্যান্ট কিংবা কোট টাই পরার ইচ্ছে কোনোকালেই ছিল না।’

আবিরের মনে হলো বাহার রেগে যাচ্ছে। হয়তো এমন প্রসঙ্গ তার পছন্দ হয়নি। সে কথা ঘুরিয়ে বললো, ‘বুঝেছি, তুমি তোমার বৈশিষ্ট্যে অনন্য!’

মুচকি হাসলো বাহার। ইতিমধ্যে পিজ্জা চলে এসেছে। আইসক্রিম খাওয়া শেষে পিজ্জার দিকে হাত বাড়ালো আবির। খাওয়ার মাঝে আবির খেয়াল করলো, বাহারের মনোযোগ খাবারের দিকে নেই। সে আনমনে অন্য জগতে বিচরণ করছে। আবির বললো, ‘তোমাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে, কিছু হয়েছে বাহার?’

কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাহার বলে উঠলো, ‘আবির, তুমি কি প্রিয়, মানে সাদি হাসরাতের মামলাটা হ্যান্ডেল করছো?’

আবির বুঝতে পারছে না সাদিকে নিয়ে বাহারের এতোটা কৌতূহলের কারণ কি। সে ভ্রু জোড়া দুবার উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘তার আগে তুমি বলো, সাদিকে নিয়ে তোমার এতো আগ্রহ কেন? একটা গুরুতর আসামিকে নিয়ে মাথা ঘামানোর কারণ বুঝতে পারছি না বাহার।’

– আবির, তুমি কি ভাবছো জানি না। কিন্তু আমাকে ভাবতেই হচ্ছে, মোট কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। সাদির আসল পরিচয় তুমি জানো?
– কোন পরিচয়? প্রিয়ংশু?
– হুম।
– প্রিয়ংশুর আগে পরে কোনো পদবি নেই? দেবনাথ কিংবা…
– ব্যানার্জি। প্রিয়ংশু ব্যানার্জি।
– এটা তো ব্রাক্ষ্মণ বংশের পদবি। খুবই উচ্চমানের। তাহলে সাদি কি কোনো জ-ঙ্গি দলের চাপে পড়ে…
– আমি এটাই বুঝতে পারছি না সে কিভাবে বদলে গেল? আরো বড় কথা, সে যেন তেন পরিবারের কেউ নয়। তার একটা বিশেষ পরিচয় আছে।
– কি? কে সে?

বাহার বলার পূর্বেই কেউ ‘বাহার’ বলে উচ্চস্বরে ডেকে দৌড়ে কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। হতভম্ভ বাহার দেখলো, তার বান্ধবী রাশা এবং পেছন পেছন নিলয় ও প্রান্ত এসেছে। অনেকদিন পর বন্ধুমহলের কয়েকজনকে পেয়ে সে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লো। গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো চাপা পড়ে গেল আনন্দ উল্লাসের ভারে।

_________

– স্যার, আসামি সাদি রমনা থানার অধীনে রয়েছে। তাই ওসি রূপম সমস্ত দায়িত্ব আপনার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন তিনি আপনাকে অনেক ভরসা করেন।

ওসি গালিব পরিশ্রান্ত মুখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। এইতো কিছুদিন আগে এক মন্ত্রীর ছেলে নিজের স্ত্রীকে মেরে ফেলায় বিষয়টা ধামাচাপা দেয়ার কাজে তাকে বেশ খাটতে হয়েছে। এখন আবার বিশাল মামলা। ডক্টর তোহার মৃত্যু কোনো সাধারণ বিষয় নয়। তিনি ছিলেন দেশের গর্ব, রত্ন। তার অমূল্য অবদান তাকে যেমন বেঁচে থাকতে সম্মানিত করেছে, তেমন মৃত্যুর পরও তার জন্য সকলের শ্রদ্ধা ও সচেতনতা শীর্ষে। তাই তার মৃত্যুর পেছনের রহস্য উদঘাটনে জোর তদন্ত চলছে। তাছাড়া তার অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যপূর্ণ প্রমাণপত্র হারিয়ে গিয়েছে যেটা খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত জরুরি।

ওসি গালিব এএসপি নাকিবকে চলে যেতে বললেন। এই মুহূর্তে নিজের দায়িত্বের কথা ভাবলেই জ্বর চলে আসছে। এসব ভরসা বাক্য শোনার পর মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তার উপর পেয়েছেন একটা আসামি। মুখ থুবড়ে ভেঙে ফেললেও কথা বের হয় না।

এমন সময় আরেকটা খবর তার ক্লান্ত মনকে নিমিষেই আনন্দে ভরিয়ে তুললো। নাকিব এসে ফরেনসিক রিপোর্টের প্রমাণপত্র তার সামনে রেখে বললো, ‘স্যার, সিসিটিভি ক্যামেরায় সাদির চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।’

___________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

‘ধূম্রজাল’
তৃতীয় পর্ব

তাবিনা মাহনূর

____________

রক্তাক্ত মেঝে। ছোপ ছোপ লাল রঙে ধুলোময় মেঝে দেখে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছেন গালিব। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্রোধ তাকে গ্রাস করছে। সাদিকে মারতে মারতে নিস্তেজ করে ফেলেছেন। পাশে দাঁড়ানো দুজন এএসপি নাকিব আর তুহিন। সিআইডি সাগর বেশি মেরেছেন। গালিব প্রথমে এলোপাতাড়ি ঘুষি দিয়ে সাদির কথা বলার শক্তি কেড়ে নিয়েছেন। এরপর সাগর দিলেন একের পর এক লাথি। এখন সাদি মেঝের উপর অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে আছে।

গালিব মারার সময় সাদির দাঁতের সাথে হাতে ঘর্ষণ খাওয়ায় কব্জির উপরের অংশে ছিলে গিয়েছে। এন্টিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে তিনি নিজ কেবিনে ফিরে গেলেন। পেছন পেছন সাগর গেলেন। দুজনে এসি ঘরে কিছুক্ষণ ঠান্ডা হয়ে বিশ্রামের ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে থাকলেন। কারো মুখেই কথা নেই। তবে প্রথম নীরবতা ভাঙলেন সাগর।

– সাংঘাতিক চিজ! কিছুই স্বীকার করছে না।

গালিব সাগরের দিকে তাকালেন। ঘাম শুকিয়ে যাওয়া তেলতেলে মুখে রুমাল চালিয়ে তিনি বললেন, ‘বুঝতে পারছি না। বারবার এক কথা বলছে, সিসিটিভি ফুটেজ ভুল, সে নাকি কিছু চুরি করেনি। সব তথ্য প্রমাণ ওর বিরুদ্ধে থাকার পরও কিছুতেই স্বীকার করছে না। এখন আমিই দ্বিধায় পরে গিয়েছি।’

সাগর ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘আরো একবার ভিডিওটা দেখবেন নাকি?’

– কোন ভিডিও?
– সিসিটিভি ফুটেজের কথা বলছি।
– আরেকবার দেখে কি হবে? ওখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সাদির হাত ধরে গোপন কক্ষে প্রবেশ করলেন তোহা। এরপর সাদি একাই বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে দরজা লক করে হেঁটে হেঁটে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
– এর মাঝে কি অন্যকিছু হতে পারে না? ধরুন ফুটেজে কিছু কাঁটটছাঁট করেছে হয়তো…
– না সাগর। এটা নিরবিচ্ছিন্ন ভিডিও। ভিডিওতে গরমিল থাকলে আমরা সহজেই টের পেতাম। সমস্যাটা অন্য জায়গায়।
– কোথায়?

গালিব পিঠ টানটান করে বসলেন, ‘সাদি হাসরাতের আগের পরিচয় সে প্রিয়ংশু ব্যানার্জি। বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ার সময় থেকেই ডক্টর তোহা তাকে স্নেহ করতেন। যেহেতু তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তারপর প্রিয়ংশু একটি বেসরকারি সংস্থার দায়িত্বে চাকরি নিলো, আর ওভার টাইম হিসেবে তোহা রিসার্চ সেন্টারে যোগদান করলো। সময়ের স্রোতে প্রিয়ংশু হয়ে গেল সাদি এবং তোহা সেন্টারের বিশ্বস্ত কর্মচারী, এতোটাই বিশ্বস্ত যে ডক্টর তোহা নিজের গোপন কক্ষের কথা মাত্র তিনজনকে বলেছিলেন। সেই তিন জনের একজন সাদি হাসরাত।’

– বাকি দুজন?
– উনার অ্যাসিস্টেন্ট তাহমিদ ইকবাল এবং উনার স্ত্রী, যিনি কিনা নিজেও একজন গবেষক, স্টেরি রোজারিও।
– রোজারিও? খ্রিস্টান?
– না-স্তিক বলা যেতে পারে। উনাদের তো কোনো ধর্ম নেই। গবেষকদের কাজ শুধু বিভিন্ন ধরণের আবিষ্কার নিয়ে। তাই গবেষণা করতে করতে কার সাথে প্রেম হয়ে গেল, এগুলোর ব্যাপারে তাদের কোনো চিন্তা ভাবনা থাকে না। এমনও হয়, গবেষণার স্বার্থে বিয়ে করেন অনেকেই।
– কিন্তু আপনার খটকা লাগছে কোথায়?
– সাদি যদি তোহার প্রিয়জন হয়ে থাকে এবং সাদি সম্পর্কে কেউই কোনো বিরূপ মন্তব্য না করে থাকে তাহলে সাদি কেন ডক্টরকে মারবে? বরং ডক্টর বেঁচে থাকলে একদিন সে অনেক উঁচু পর্যায়ে যেতে পারতো। যেহেতু কিছুদিন ধরেই টিভি চ্যানেল, খবরের কাগজে ডক্টরের পাশে সাদিকে প্রায় সবসময় দেখা যেত।
– কাগজগুলো নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যার কারণে সাদি ডক্টরকে মেরে….

গালিব হঠাৎ সাগরকে থামিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না যা দেখানো হচ্ছে তা পুরোটাই ইন্দ্রজাল?’

– এটা কিভাবে সম্ভব? এ ব্যাপারে সবার সাথে আলোচনা করে তবেই সিদ্ধান্ত নেয়া ভালো হবে মনে করি।
– তাহলে তাই হোক। আজ বিকেলে এই মামলার সাথে জড়িত সকল গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একত্রিত হতে বলি।

________

তিন দিনের ছুটি শেষে বাহার এখন কাজে নেমে পড়েছে। এই তিনদিন বন্ধুদের সাথে সময় কেটে গেছে। আজ তাই কাজের বেশ চাপ। নতুন একটা মামলা এসেছে। এটাও মা-দক সম্পর্কিত। এবং এবারও একজন কিশোরের সাথে তাকে কথা বলতে হবে। তবে এবারের বিষয়টা একটু জটিল। কারণ কিশোর ছেলেটা শুধু নে-শা-দ্রব্য গ্রহণ করেই ক্ষান্ত দেয়নি, সে এগুলো পাচারের সাথেও জড়িত। কিন্তু ছেলেটাকে উত্তম মধ্যম দেয়ার পরও কোনো কথা বলছে না। তাই বাহারের সাহায্য নিতেই হলো।

বাহার একটা ব্যাপারে বেশ দক্ষ। কেউ মিথ্যে বললে সে চট করে ধরে ফেলতে পারে। তার সাথে কেউ সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। সে শুধু ধরেই না, কৌশলে অপরাধীর মুখ থেকে সত্য বের করে আনে। এবং আজও সে ছেলেটার মিথ্যে ধরে ফেললো। সেই সাথে সত্য বের করে আনলো তার নিজস্ব নিয়মে।

তাই অপরাধ মনোবিজ্ঞানের প্রধান সাইকিয়াট্রিস্ট শুভ্রত বেশ প্রশংসা করলেন বাহারের। এই বিভাগে বাহারের তুলনা হয় না। অন্য অনেক মনোবিজ্ঞানী আছেন, তারাও তাদের কাজে পারদর্শী। কিন্তু বাহার যেন অনন্য! এসব প্রশংসায় বাহার বিনিময়ে মুচকি হেসেছে। কিন্তু তার মন পড়ে আছে অন্য মামলা নেবার জন্য। যেই মামলায় তার মতো আগ্রহী আর কেউ নেই!

আরো এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, সাদি হাসরাতের মুখ থেকে কোনো সাক্ষ্য পাওয়া যায়নি। সে বারবার এক কথা বলছে, ‘আমি খু-ন করিনি। আমি নির্দোষ। আমি জানি না পেপারগুলো কোথায়।’ তার সামনে সব তথ্য পেশ করা সত্ত্বেও সে ওগুলো ভুল বলে আখ্যায়িত করছে। অনেকেই হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলেছেন, ‘স্বীকার করুক আর না করুক, ও যে দোষী তা সবাই জানে। ওকে এখন আদালতে নেয়া প্রয়োজন। যা সিদ্ধান্ত কোর্ট থেকে দেয়া হবে।’

এভাবে বললেই তো হয়ে যায় না, অপরাধীর মুখ থেকে স্বীকার্য বাণী না শোনা পর্যন্ত তার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসা জটিল পর্যায়। তাই সাদিকে এখন বিশেষ সেলে রাখার আলোচনা চলছে। আরো তিন দিনের রিমান্ডে থাকার পরও যদি সাদি কিছুই স্বীকার না করে তাহলে তাকে ভয়াবহ শাস্তির মাঝে রাখা হবে।

অন্যদিকে স্টেরি রোজারিও স্বামীর মৃত্যুর কারণ না জানা পর্যন্ত পুলিশদের ছাড়ছেন না। প্রতিদিনই সাদির ব্যাপারে খোঁজ করেন তিনি, কিছুটা বিমর্ষ ভঙ্গিতে বলেন তিনি সাদিকে কত বিশ্বাস করতেন। তাহমিদ ইকবালও কিছুদিন হতাশায় ভুগেছিলেন সাদির মতো ছেলের এমন কুকীর্তি দেখে। মোট কথা, পুরো তোহা রিসার্চ সেন্টারের কর্মী থেকে শুরু করে গবেষক সকলেই হতবাক। তাই পুলিশদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে সাদির মুখ থেকে কথা বের করতে। তাদের ধারণা, সকলেই সাদিকে ভালো ছেলে বলে দাবি করায় সাদির বল চলে এসেছে যার কারণে সে কিছুতেই স্বীকার করছে না।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তিন দিনের রিমান্ডে সাদি একবারও বলেনি সে খু-ন করেছে। এবারও সে শুধুই বলছে সে নির্দোষ। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে নিয়ে যাওয়া হলো আর্মি স্কোয়াডে। সেখানে থাকা বিশেষ কারাগারে তাকে রাখা হবে যতদিন না সে স্বীকার করছে। এই কারাগারের বৈশিষ্ট্য, ছোট্ট একটা ঘর যেখানে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। এবং সেই ঘরের দরজা বন্ধ করলেই পুরো ঘর অন্ধকারে ডুবে যায়। রাত-দিন বোঝার উপায় থাকে না। প্রথম দিন কোনো খাবার বা পানি দেয়া হবে না। দ্বিতীয় দিন শুধু পানি দেয়া হবে। এরপর সাদির শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে খাবার দেয়া হবে, সেটা তিন দিন পরে হতে পারে অথবা দশ দিন পর।

কথা অনুযায়ী কাজ চললো। সাদিকে রাখা হলো একশো চার নং সেলে। তার নাম দেয়া হলো আসামি ওয়ান-জিরো-ফোর-এস। গভীর আঁধারে ডুবে সাদি শেষবার দেখতে পেলো গালিবের মুখ। এবং শুনতে পেলো, ‘এখানেই থাক। বসে বসে তসবি জপে প্রার্থনা কর।’

সাদির দিন নেই রাত নেই। দেহঘড়ি অনুযায়ী সে কল্পনা করে নেয় দিন রাত। তারপর ওয়াক্ত কল্পনা করে তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করে। মাঝে মাঝে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বের হলে সেই ফাঁকে ওযু সেরে নেয়। আলো দেখে বুঝে নেয় বেলা গড়ালো নাকি। তবে কষ্ট হচ্ছে পানি ও খাবার ছাড়া থাকতে। দ্বিতীয় দিনও তাকে পানি দেয়া হয়নি। ফলে পেটের মাঝে গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে হড়হড় করে বমি করেছে সে। তৃতীয় দিন থেকে পানি দিলেও খাবার দেয়া হচ্ছে না। পেটের উপর হাত চেপে সে কোনোরকম পেট ভারী করে রাখছে। খুব কষ্ট হলেও চিৎকার চেঁচামেচি করা সাদির স্বভাবে নেই। তার পুরোনো রূপেও সে ছিল ভদ্র স্বভাবের শক্ত সামর্থবান যুবক। এখনও তেমনই আছে। তাই কেউ এসে মারধর করলেও সে কিছুই বলে না। চুপচাপ কাঙ্ক্ষিত সময়ের অপেক্ষায় থাকে।

আজ থেকে সাদিকে খাবার দেয়া হচ্ছে। গতকাল সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। পরবর্তীতে তাকে আসামিদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে নিয়ে স্যালাইন দেয়া হয়েছে। আজ তার জ্ঞান ফিরেছে, সবচেয়ে সুখের বিষয় সে একটুখানি আলোর দেখা পেয়েছে। আলো ছাড়া অন্ধকারে বাস করতে কত যে কষ্ট তা সাদি খুব ভালো করেই উপলব্ধি করতে পেরেছে।

প্রায় দু সপ্তাহ ধরে সাদি আর্মি স্কোয়াডে আছে। শেষ সপ্তাহে তাকে আবারো একশো চার নং সেলে রাখা হয়েছে। কিন্তু আজকের অভিজ্ঞতা সাদির জন্য ভিন্ন রকম। আজ একজন সাইকিয়াট্রিস্ট আসবেন সাদিকে প্রশ্ন করতে। এমনই শুনেছে সে, যখন গালিব কথা বলছিলেন মেজর বিক্রমের সাথে।

________

– আপনি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলুন হাসরাত।

সাদি একবারও মুখ তুলে তাকায়নি। বাহারের খুব বিরক্ত বোধ হচ্ছে। এখানে তো সাদির স্ত্রী নেই যে বাহারকে দেখলে তার জাত চলে যাবে। বাহার নিজের ভাবনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে বললো, ‘সাদি হাসরাত, আপনি সরাসরি তাকিয়ে কথা না বললে আমি আমার কাজ ঠিকমতো করতে পারবো না। এবং ধরেই নিব আপনিই অপরাধী, তাই চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন।’

কিন্তু সাদির উত্তর শুনে সে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলো।

– কোনো পুরুষ সাইকিয়াট্রিস্ট নেই?

মেজাজ চড়ে যাচ্ছে বাহারের, তবু সে মৃদু স্বরে বললো, ‘কেন? নারীদের অক্ষম মনে হয়?’

এবারও সাদি নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো, ‘কোন ব্যাপারে অক্ষম বলতে চাইছেন?’

– কাজের ব্যাপারে। আমি একজন মনোবিজ্ঞানী, আমার কাজে কি আপনার সন্দেহ হচ্ছে? মনে হচ্ছে নারীরা দক্ষতার সাথে প্রশ্ন করতে পারে না?
– এটা ভাবলে আপনাকেই থাকতে বলতাম। কারণ আপনি প্রশ্ন করতে না পারলে আমারই লাভ।

বাহার থমকে গেল। কথা ভুল নয়, সে যদি দক্ষ না হয়ে থাকে তাহলে সাদির ক্ষতি নেই। কিন্তু সাদি পুরুষ কেন খুঁজছে? উত্তর সাদিই বলে দিলো।

– নারীদের সাথে কথা বলা ছেড়ে দেয়ার পর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে অস্বস্তি হয় আমার।

বিরক্ত হলো বাহার। তবে মেজাজ হারালে সাদির মুখ থেকে কথা বের করতে অসুবিধা হবে তার। তাই সে মুচকি হেসে বললো, ‘এমন করছেন কেন বলুন তো? আগে বুঝি নারী দেখেননি?’

– আগে নারী দেখেছি বলেই এখন আর দেখতে চাই না। আর কত পাপ বাড়াবো? এখন তাওবা করতে চাই।

বিস্মিত বাহার দেখছে, কতটা পরিবর্তন হতে পারে একটা মানুষের। কিন্তু বাহারের মেজাজ এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে এসব কথা শুনে। কত কষ্টে সে এই জায়গায় এসেছে তা কি আর সাদি বুঝবে? সাদিকে দেখার জন্য সিনিয়র সাইকিয়াট্রিস্ট শাওন স্যারের আসার কথা ছিল। যেকোনো উপায়ে সে সেটা আটকে দিয়েছে। শাওন স্যার কিছুতেই তাকে আসতে দিতে চাননি। সে নিজের সফলতার প্রমাণ হিসেবে কিছু সার্টিফিকেট আর নিজের দক্ষতার পরিচয় জানিয়ে খুব কষ্টে এখানে আসতে পেরেছে। সবচেয়ে বড় যেই তথ্য তাকে সাহায্য করেছে তা হলো, সাদির সাথে তার পূর্ব পরিচয়। সে চাইলেই অরিত্রীর সাহায্য নিয়ে সাদির ব্যাপারে আরো তথ্য জানতে পারবে। তাই তাকে বিশেষ চোখে দেখা হচ্ছে। তবে শর্ত দেয়া হয়েছে, সে যদি তিন দিনের কথোপকথনেও সাদির মুখ থেকে কোনো তথ্য বের করতে না পারে তাহলে তাকে এই কাজে আর কোনো সুযোগ দেয়া হবে না।

বাহার নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললো, ‘দেখুন সাদি, পুরুষ সাইকিয়াট্রিস্ট নিশ্চয়ই আছে। তবু আমাকে পাঠানোর কারণটা আপনার বোঝা উচিত। আমি এ পর্যন্ত যতগুলো কেস হ্যান্ডেল করেছি প্রায় প্রতিটি সফল হয়েছে। তাই আমাকে প্রাধান্য না দেয়ার কোনো কারণ নেই।’

সাদি চুপ করে আছে। বাহার এবার নিজের কৌশল অবলম্বন করলো। নরম কণ্ঠে বললো, ‘দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপনি অনেক অসুস্থ। কিন্তু কি করবেন বলুন? পাপ করেছেন, শাস্তি ভোগ করতেই হবে।’

– আমি খু-ন করিনি। পেপার্স চুরি করিনি।
– সাদি, আপনাকে সবাই অনেক ভালোবাসে। এটা আমি শুনেছি যে তোহা স্যারও আপনাকে ভালোবাসতেন। তাই আমাদেরও সন্দেহ আছে আপনিই আসল খু-নি কিনা। কিন্তু দেখুন, আপনার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ আছে। আমরা কোনটা বিশ্বাস করবো বলুন? আপনি পারবেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে?

সাদি এবারও চুপ করে আছে। বাহার বলে উঠলো, ‘সাদি, আপনি যদি সব স্বীকার করে নেন তাহলে শাস্তি কমে আসতে পারে।’

– মিথ্যে বলছেন কেন? যাই হোক, শাস্তি আমার ফাঁসি। কারণ স্যারের মতো বড় মাপের মানুষের খু-নিকে কেউ ছেড়ে দিতে চাইবে না।

বাহার ঘাবড়ে গেল না। যদিও কথা সত্যি। কারণ সাদির পক্ষে এমন কেউ নেই যে তার শাস্তি কমানোর আবেদন করবে। বাহার একই সুরে বললো, ‘তবু আদালতের সিদ্ধান্ত কোনটা হবে বলা যায় না। আপনি স্বীকার করবেন কিনা সেটা আগে বলুন।’

সাদি হঠাৎ সরাসরি তাকিয়ে বললো, ‘কি স্বীকার করবো? যেখানে আমি খু-ন করিনি, চুরি করিনি, সেখানে আমার কি বলার আছে?’

স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো বাহার। সাদি অবশ্য কথাগুলো বলেই মুখ নামিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বাহারের দৃষ্টি থমকে গিয়েছে। যেন সে এখনো দেখতে পাচ্ছে নির্মল দুটো চোখ যেখানে বলা হচ্ছে সত্য কাকে বলে। সেই দৃষ্টি বাহারকে কিছু মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত করে দিলো। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ দুটো বন্ধ করে বললো, ‘এতক্ষণ তাহলে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন কিভাবে চোখ দিয়ে মিথ্যে ঢাকা যায়।’

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো সাদি। বাহার সেটা দেখে বললো, ‘এইবার চোখ তুলে তাকালেন এমনভাবে যেন সত্য কথা বলছেন। আমি একটু হলেই সব বিশ্বাস করে ফেলতাম।’

– আপনার বিশ্বাস অবিশ্বাস দিয়ে আমার কিছু আসে যায় না।
– কিন্তু আমার আসে যায়। কারণ এটা আমার চাকরি। আমাকে অন্য পথ অবলম্বন করতে হবে।

বাহার চেয়ার নিয়ে সাদির সামনে অল্প দূরত্বে বসলো। সাদির পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। বাহার মাথা নিচু করে সাদির চোখ দেখার চেষ্টা করছে। সাদি মুখ ঘুরিয়ে নিলে বাহার বলে উঠলো, ‘আপনার পছন্দ হবে না, কিন্তু আমি আপনার মুখে হাত দিয়ে চোখ দুটো সরাসরি নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করতে পারি।’

এ কথাই যথেষ্ট ছিল সাদির জন্য। সে এবার বাহারের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কথা বলছি। আপনি একটু পিছিয়ে যান।’

বাহার চেয়ার নিয়ে পিছিয়ে গেল। সাদির নজর এদিক ওদিক ঘুরছে। বাহার প্রশ্ন করলো, ‘রবিবার আপনি তোহা সেন্টারে গিয়েছিলেন?’

– হুম।
– যাওয়ার আগে কারো সাথে কথা হয়েছিল?
– আমার মা।

ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো বাহার, ‘আচ্ছা, আপনি যে আপনার মায়ের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন এ কথা পুলিশের কাছে বলেননি কেন?’

সাদি শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো, ‘আমার বিরুদ্ধে রণজিৎ ব্যানার্জি চুরির অভিযোগ তুলেছেন। তাই আমার মা রাধিকা ব্যানার্জির সাথে আমার যোগাযোগ থাকার বিষয়টা পুলিশ নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না? আপনাকে বললাম কারণ আমি পারতপক্ষে মিথ্যে বলি না যেহেতু আপনি সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যেটা পুলিশ করেনি। আর আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আপনিও পুলিশকে এই বিষয়টা বলবেন না।’

হতবাক বাহার। সে একজন মনোবিজ্ঞানী, অথচ তাকেই যেন মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে সাদি। এটা কিভাবে সম্ভব? কোন অবিনশ্বর সত্তা সাদিকে সাহায্য করছেন?

তিঁনি যে রক্ষাকর্তা, তিঁনিই আস সামাদ!

___________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here