ধূম্রজাল,০৭,০৮

0
287

‘ধূম্রজাল,০৭,০৮
তাবিনা মাহনূর
সপ্তম পর্ব
___________

আজ সাদির সাথে গুলবাহারের তৃতীয় দিনের সাক্ষাৎ। অথবা হতে পারে এটাই শেষ সাক্ষাৎ। কারণ দ্বিতীয় দিন বাহারের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য না পাওয়ায় শাওন এবং শুভ্রত স্যার বাহারকে নিয়ে আশাহত হয়েছেন। তারা বাহারকে সন্দেহ করা শুরু করেছেন। তারা ভাবছেন, হয়তো বাহার নিজেই কথাগুলো গোপন করছে যেহেতু তারা পূর্বে একে অপরের পরিচিত ছিল।

বাহার অনেকবার বুঝিয়ে বলেছে তাদের পরিচয় ছিল মাত্র কিছু মুহূর্তের জন্য। এরপর তাদের আর কখনো যোগাযোগ হয়নি। তবু শাওন স্যার বাহারকে এই শেষবার চেষ্টা করতে বলেছেন। বাহার নিজেকে প্রস্তুত রেখেছে। নিজের মনকে বুঝিয়েছে, কোনোভাবেই সাদির জগতে বিচরণ করা চলবে না। নাহলে সাদি হবে তার মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রক, সে হবে শুধুই পুতুল।

গুলবাহার সেই কামরায় বসে অপেক্ষা করছে। তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সাদি এলো ধীর পায়ে। এবারও সাদির দৃষ্টি নিচের দিকে। বাহার তাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। সে মুচকি হেসে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম।’

সাদি উত্তর দিলো, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম।’

বাহার সরাসরি প্রসঙ্গে না গিয়ে নিজের সাজানো পরিকল্পনা অনুযায়ী চললো। সে প্রশ্ন করলো, ‘আপনাকে ভালো সেলে রাখা হয়েছে?’

– হুম।
– ঠিকমতো খাবার দেয়া হচ্ছে?
– হুম।
– আলহামদুলিল্লাহ। এবার ঠিক বলেছি তো?

সাদি চুপ করে আছে। বাহার মুচকি হেসে বললো, ‘এবার অবশ্যই ঠিক বলেছি। যেহেতু আপনার কারাগার আগের তুলনায় উন্নত, তাই আলহামদুলিল্লাহ বলাটা ভুল হয়নি। আচ্ছা যাক সেসব কথা। আপনার সাথে একটু গল্প করি। জানি আপনি উত্তর দিবেন না। আমি একাই বলতে থাকি। কোনো ভুল পেলে আপনিই ধরিয়ে দিবেন।’

সাদি এর পৃষ্ঠে কিছুই বললো না। বাহার হাতে থাকা কিছু কাগজ আর মোবাইলে রাখা তথ্যগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে সাদির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এটা একটা গল্পের মতো। সুদর্শন এক যুবকের গল্প, যেখানে রয়েছে ভালোবাসা, যত্ন, হতাশা আর প্রত্যাবর্তন। ছেলেটা হলো প্রিয়ংশু ব্যানার্জি।’

সাদি হালকা হেসে উঠলো, কেউ সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে না তাকালে সেই হাসি দেখতে পাবে না। কিন্তু বাহার দেখেছে। কারণ সাদির গালের খাঁজ একটুখানি গভীর হয়েছিল সেসময়। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবার বাহার ভেঙে পড়েনি। সেও হেসে বলে উঠলো, ‘প্রিয়ংশু ব্যানার্জি বেশ নামকরা কোম্পানির মালিকের প্রিয় ছেলে। তিনি তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু তাদের মধ্যে হঠাৎ ঝামেলা শুরু হলো। তার স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য, ঝগড়া বাড়তে বাড়তে সমাপ্তিতে পৌঁছে হয়ে গেল বিচ্ছেদ। এরপর তিনি পরিবারের সাথে থাকা বন্ধ করে দিলেন। বেসরকারি এক সংস্থা ও ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানির দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা প্রিয়ংশু দেশ বিদেশ ঘুরতে শুরু করলেন কাজের প্রয়োজনে। দুবাই গিয়ে তিনি পেয়ে গেলেন অমূল্য রতন। সেখানকার এক বন্ধুর সাহায্যে তিনি জানতে পারলেন ইসলামকে, চিনতে পারলেন আসল সত্তা সম্পর্কে। গ্রহণ করলেন ইসলাম। প্রিয়ংশু বদলে নাম দিলেন সাদি হাসরাত।’

সাদির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে এমনভাবে বসে আছে যেন বাহারের উপস্থিতি তাকে বেশ বিরক্ত করছে। যেন সে এই ব্যাপারে উদাসীন। বাহার তা উপেক্ষা করে বলেই গেল।

– এরপর সাদিকে কোন কারণে কোম্পানির চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

এসময় সাদি বলে উঠলো, ‘দাড়ি রাখার কারণে। টাখনুর উপর প্যান্ট পরার কারণে।’

বাহার ভেতরে ভেতরে অনেক খুশি। সাদি ধীরে ধীরে সব ধোঁয়াশা পরিষ্কার করবে বলে সে বিশ্বাস করে। এর জন্য একটু পরিশ্রম তাকে করতেই হবে। সে আবার বললো, ‘এরপর সাদি দেশে ফিরে রিসার্চ সেন্টারে যুক্ত হলেন।’

– ভুল বলেছেন, আমি আগে থেকেই যুক্ত ছিলাম সেখানে।

বাহার ইচ্ছে করেই ভুল বলেছিল যেন সাদি সাড়া দেয়। সে মুখ শান্ত রেখে বললো, ‘হুম, আগে থেকেই ছিলেন সাদি। তবে কাজের চাপে রিসার্চ সেন্টারে বেশিক্ষণ সময় দিতে পারতেন না। কাজ যেহেতু হারিয়ে ফেললেন, তাই তোহা সেন্টারে তিনি নিয়মিত হয়ে গেলেন। কারণ তোহা স্যার তাকে খুব ভালোবাসতেন। তার বেতনের পরিমাণ বাড়তে থাকলো আর ধীরে ধীরে তিনি এতোটাই বিশ্বস্ত হয়ে গেলেন যে তোহা স্যারের গোপন ঘরের খবরও জেনে গেলেন।’

সাদি বিরস ভঙ্গিতে মুখ দিয়ে শ্বাস ফেলে বললো, ‘আমার ঘটনা আমাকে শোনানোর কারণ?’

বাহার মুচকি হাসলো। এ সবকিছু সে অরিত্রীর কাছ থেকে জেনেছে। অরিত্রীকে সে আরো প্রশ্ন করেছিল কিন্তু সেগুলো অরিত্রী এড়িয়ে গিয়েছে। যেমন, সাবিত্রীর সাথে প্রিয়ংশুর বিচ্ছেদের কারণ, দুবাই গিয়ে কার সাথে দেখা হয়েছিল, পরিবার থেকে আলাদা কেন থেকেছে ইত্যাদি নানান কারণ অরিত্রী জানে না বলে এড়িয়ে গিয়েছে। তবে যতটুকু জানা গিয়েছে তাতেই চলবে।

– সাদির সাথে তোহা স্যারের সম্পর্ক ছিল বাবা ছেলের মতো। তাহমিদ ইকবাল বলেছেন, সাদি তোহা স্যারের বাসায়ও গিয়েছে। তারা দুজন খুব চিন্তিত ভঙ্গিতে গল্প করতেন যেন ভবিষ্যতের কোনো ব্যাপারে তারা চিন্তায় ব্যস্ত। তারপর তোহা স্যারকে প্রায়ই বিমর্ষ দেখা যেতো। শেষ যেদিন স্যার নিখোঁজ হলেন, সেদিন সকালে সাদি স্যারের সাথে লম্বা আলোচনায় বসেছিলেন।

সাদি বলে উঠলো, ‘যেই পেপারগুলো আপনারা খুঁজে পাচ্ছেন না, সেগুলোর ব্যাপারে কথা হয়েছিল সেদিন।’

ধরা দিচ্ছে সাদি। বাহার নিজের উত্তেজনা চেপে বললো, ‘তারপর সাদি দুপুর বেলা নিজের বাড়ি গেলেন। বিকেলে আবার এলেন রিসার্চ সেন্টারে। গোপন কক্ষে গেলেন তোহা স্যারের সাথে। তারপর বেরিয়ে এলেন একা। বাইরে থেকে দরজা আটকে দিলেন যেন ভেতরে কেউই নেই!’

– আমি সেসময় বাসায় ছিলাম। আমি দুপুরে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেন্টারে আর যাইনি।
– তাহলে চেকইন কে করেছে? সিসিটিভি ফুটেজে আপনার চেহারা ও পিস্তলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিললো কিভাবে?
– সবই ঠিক আছে, কিন্তু মানুষটা আমি না।

বাহার চোখ ঘুরিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করে কেমন হেসে উঠলো, ‘সাদি, আপনি কি বলছেন জানেন?’

সাদিও হেসে উঠে শ্বাস টেনে বললো, ‘জানি জানি! ইটস্ লাইক আ মেজ।’ (এটা একটা গোলকধাঁধার মতো)

– অ্যান্ড ইউ ওয়ান্ট টু সলভ ইট বাই মি? (আর আপনি এটা আমার দ্বারা সমাধান করতে চাইছেন?)

এর প্রেক্ষিতে সাদি কিছুই বললো না। বাঁকা হাসিটা তার মুখে এখনো বিদ্যমান। বাহারের রাগ উঠে যাচ্ছে। কিন্তু সে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজের ক্রোধ সংবরণের চেষ্টা করে কিছু বলতে যাবে, তার পূর্বেই সাদি বলে উঠলো, ‘আমি সাধারণ একজন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার। আমার কাছে পিস্তল কিভাবে থাকবে?’

বাহার থমকে গিয়েছে। তার ঠোঁট দুটো ফাঁকা হয়ে আছে কিছু বলার জন্য, কিন্তু সে যেন মূর্তিতে পরিণত হয়েছে। সাদি আরো বললো, ‘আর পিস্তল দিয়ে গুলি করে মেরে সেখানেই কেন সেটা রেখে আসবো আমি? এছাড়াও আমার রুম সার্চ করে দেখতে পারেন। কোনো প্রকার পিস্তল বা এ জাতীয় বস্তুর লাইসেন্স নেই আমার।’

বাহার ভ্রু কুঁচকে বসে আছে। তার কানে থাকা ব্লুটুথ হেডফোনে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর শুনে সে চুপ করে বসে থাকলো। তার হাত কাঁপছে। চোখের পাতা ঘন ঘন পলক ফেলছে। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘সাদি, হয়তো আপনার সাথে আজ আমার শেষ দেখা। কারণ আপনি যা বলেছেন তা ইতিমধ্যে ওসি গালিব, সিআইডি সাগর স্যার জেনে গিয়েছেন।’

সাদি চোখ বন্ধ করে বললো, ‘জানতাম, আজ আপনি নিশ্চয়ই রেকর্ডার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন? কারণ এতদিন আপনার কানে ব্লুটুথ হেডফোন দেখিনি। আজ দেখেছি। এবং আমি বোকা নই যে না জেনে বুঝে বকবক করবো আপনার সাথে। আলহামদুলিল্লাহ, নারীর সাথে কথোপকথনের যন্ত্রনা আর পোহাতে হবে না আমায়।’

হতবাক বাহার বিস্ময় নিয়ে বললো, ‘আপনি! আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না।’

সাদির নির্বিকার চাহনি। বাহার এক পলক তাকে দেখে বেরিয়ে আসার মুহূর্তে রেকর্ডার বন্ধ করে দিলো। তারপর সাদির দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠলো, ‘আপনার কাছে অন্য মহিলা পাঠাবো। যেন সবকিছু দ্রুত স্বীকার করেন। আপনি একটু বোকামিই করে ফেললেন।’

_________

ফোনটা অনবরত বেজেই যাচ্ছে। সালমা বাহারের ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে আছেন। এই রাতে বাহার গোসল করতে বাথরুমে ঢুকেছে। সালমা তার বের হওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু ফোনের শব্দটা বেশ কড়া হওয়ায় তিনি বিরক্ত হলেন। কে ফোন করেছে, দেখবেন না ভেবেও উপর থেকে উঁকি দিয়ে দেখলেন অচেনা নম্বর। তিনি ফোন সাইলেন্ট করতে জানেন না। তবে তার বিরক্ত মনোভাব কমিয়ে দিতে বেরিয়ে এলো বাহার।

তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বাহার সালমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ফুপি, একটু দেখবে কে ফোন করেছে?’

সালমা ফোন হাতে নিয়ে বললেন, ‘অচেনা নম্বর। এই নিয়ে তিনবার করলো। দেখছেই তো ফোন ধরছিস না। এতোবার করার কি আছে?’

অন্য সময় হলে বাহার ফুপির রাগের পৃষ্ঠে হেসে ফেলতো। কিন্তু আজ তার মন কোনোভাবেই ভালো নেই। সে চিরুনি হাতে নিয়ে বললো, ‘পরে ধরবো। তুমি কিছু বলবে?’

– তুই রাতের খাবার খাসনি। এখন খেতে যাবি চল। আর রাতের বেলা গোসল করলি কেন?
– খুব গরম লাগছে ফুপি। সন্ধ্যায় বাইরে থেকে এসে ক্লান্ত শরীরটা চলছিল না। তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এখন গোসল না করলে আমার ঘামের গন্ধে বমি করে ফেলতাম।

সালমা মুখ কুঁচকে বললেন, ‘এই অনিয়ম করে আর কতদিন চলবি? রাতের বেলা গোসল, কাজ। সন্ধ্যায় ঘুমানো। বিকালে কাজ, সকালে কাজ। কি যে করিস তুই!’

বাহার মৃদু হাসলো। পরক্ষণেই অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইল আয়নার সামনে। তার কাঁধে হাত রেখে সালমা বললেন, ‘এখন খেতে যাবি চল।’

বাহার আহ্লাদ নিয়ে বললো, ‘এখন না ফুপি। ক্ষুধা পেলে আমি গিয়ে খেয়ে নিব। কিন্তু এখন একদম শক্তি নেই।’

– আমি খাইয়ে দিব?

এবার না করবে কে? ফুপির হাতে খেতেই এতো অভিনয় চলছিল বাহারের। দেরি না করে মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলে দিলো সে। সালমা মুচকি হেসে খাবার আনতে চলে গেলেন। বাহার বারান্দায় তোয়ালে রেখে এসে ফোন হাতে নিলো। অচেনা নম্বরে ফোন করলো সে। শুরুতেই ভেসে এলো পুরুষের কন্ঠ।

– হ্যালো!

বাহার ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?’

– ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আমি সিয়াম। চিনেছেন আমাকে?

বাহার চিনতে পারেনি। এসময় আবিরের ফোন করার কথা ছিল। আবিরকে সে জানাতে বলেছিল সাদির জন্য কোন সিআইডি আর পুলিশ নিয়োজিত করা হয়েছে। কিন্তু আবির ফোন করেনি। তারমানে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বড় স্যাররা। কিন্তু সিয়াম কে? বাহার বলে উঠলো, ‘কে সিয়াম?’

সিয়াম যেন হতাশ হলো, ‘আহা! চিনতে পারেননি? আমার মা, মিসেস হাফসা আপনাদের বাসায় গিয়েছিলেন।’

এবার চিনেছে বাহার, ‘ওহ! জি চিনেছি। কিন্তু আপনি আমার নম্বর কোথা থেকে পেলেন?’

বাহার কখনোই এতোটা সরাসরি কথাবার্তা বলে না কারো সাথে। আজ সিয়ামের অপ্রত্যাশিত ফোন তাকে আরো বেশি বিরক্ত করছে। সিয়াম অবশ্য ঠিক তার উল্টো। তার কণ্ঠের উচ্ছ্বাস বাহার টের পেয়েছে।

– আপনার মা আমার মাকে নম্বর দিয়েছিলেন। তিনিই এসে আমাকে দিয়ে বললেন আপনাকে যেন ফোন করি। আপনি মনে হয় খুব ব্যস্ত?
– জি একটু ব্যস্ত ছিলাম।

সালমা খাবার নিয়ে বাহারের সামনে বসলেন। সিয়াম আরো কিছু বলছিল, কিন্তু বাহার তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘কিছু মনে করবেন না, আমি এখনো ডিনার করিনি। আমি এখন খেতে বসেছি। একটু পড়ে ফোন করি?’

সিয়াম আন্তরিকভাবে বিদায় নিয়ে নিলো। বাহার ফোন কেটে রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘অদ্ভুত তো! আমাকে না বলেই ফোন নম্বর দিয়েছে মা!’

– কে?
– যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে।

সালমা কিছুই বললেন না এ ব্যাপারে। তিনি এসব বিষয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিবেন বলে ভেবে রেখেছেন। তবে গতকাল বাহারের চাকরি হালাল হওয়ার প্রশ্ন ওঠায় তিনি বিশ্বাস করেন বাহার একদিন ইসলামের আলো খুঁজে পাবে। তাই একটুখানি বললেন, ‘ছেলে মানুষের সাথে কথা না বলাই ভালো। এখনো বিয়ে হয়নি তোদের।’

বাহার খাচ্ছে আর রাগ দেখাচ্ছে, ‘সেটাই তো! বিয়ে হয়নি, অথচ উনার খেজুরে আলাপের ইচ্ছে জেগেছে। অসভ্য!’

বাহারের রাগের কারণ বুঝতে পারছেন না সালমা। এরকম অনেক ছেলের সাথে বাহার প্রয়োজনে কথা বলে। আজ নাহয় অপ্রয়োজনেই বলতে হয়েছে। তাতে বাহার এতো বেশি রেগে যাচ্ছে কেন বুঝলেন না সালমা।

সালমা খাইয়ে দিয়ে চলে গেলেন। বাহারকে নির্দেশ দিলেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেতে। বাহারও বেশ ক্লান্ত হওয়ায় আজ কোনো কাজ হাতে রাখলো না। লাইট বন্ধ করে বারান্দার আলো জ্বালিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলো সে। সাদির কথাগুলো ভেসে আসছে কানে। সত্যিই, পিস্তল কোথায় পাবে সে? এরই মাঝে ফোনের আওয়াজ এলো।

বাহার কাঙ্খিত কলের আশায় ফোন হাতে নিয়ে হতাশ হলো। আবির নয়, সিয়াম আবার ফোন করেছে। সে ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। আপাতত কারো কথাই তার ভালো লাগছে না।

________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

‘ধূম্রজাল’
অষ্টম পর্ব

তাবিনা মাহনূর

_________

তিন দিন হয়ে গেল, আবিরের মাধ্যমে বাহার সাদি সম্পর্কিত কোনো তথ্যই পেলো না। আবির এড়িয়ে চলছে এই বলে, ‘আমি কিছুই জানি না বাহার। এই কেসে আমার কোনো হস্তক্ষেপ নেই। তাই আমাকে তারা গোপনীয়তা রক্ষার্থে কিছুই জানাননি।’

আবিরের কথা বিশ্বাস করতে পারছে না বাহার। কারণ সাগর স্যারের পরই সিআইডি সেক্টরে আবিরের অবস্থান দৃঢ়। এই মামলায় তাকে না জড়ালেও সে চাইলেই খোঁজ-খবর রাখতে পারে। কিন্তু বাহারের সামনে সে কিছুই না জানার ভান করে। বাহার একজন মনোবিজ্ঞানী। সে আবিরের চোখ দেখেই বুঝে যায় কোনটা মিথ্যে, কোনটা সত্য।

তবে বাহার এ ব্যাপারে কিছু বলে না আবিরকে। সে অপেক্ষায় আছে কখন শাওন স্যার অথবা শুভ্রত স্যার তাকে ডেকে পাঠাবে। আপাতত বাহার কোনো মামলার সাথে সংযুক্ত নেই। পুরোনো আসামি ও কিছু মানসিক রোগীর সাথে তার দেখা সাক্ষাৎ চলে। মানসিক রোগীগুলোও কোনো না কোনো অপরাধের সাথে জড়িত। এর মাঝে বেশিরভাগই খু-নের সাথে জড়িত ছিল। মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় তাদের শাস্তি কম কিন্তু বিশেষ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে রাখা হয়েছে তাদের। এসব কাজের মাঝে তিন দিন যাবৎ বাহার নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। কিন্তু মন পড়ে আছে সাদি মামলায়।

সাদির সাথে শেষ দেখার পর আজ চতুর্থ দিন অফিসে গেল বাহার। গিয়েই জানতে পারলো, নতুন এক কিশোর অপরাধীর সাথে তাকে সাক্ষাৎ করতে হবে। কোনো মামলায় মন বসে না তার। আজ মনের বিরুদ্ধে মামলা সামলাতে হবে। বাহার নিজেকে প্রস্তুত করে গেল অপরাধীর কারাগারে।

_________

– তুমি কেমন বাবা? নিজের ছেলেকে কেউ এভাবে ফাঁসিয়ে দেয়? ছি!

রাধিকা ব্যানার্জির কথায় রণজিৎ ব্যানার্জির কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না তিনি। ডাইনিং টেবিলের নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে আয়েশ করে চা পান করছেন তিনি। চোখের চশমাটা ঠিকঠাক করে ল্যাপটপের ইমেইল দেখছেন মনোযোগ দিয়ে। স্ত্রী রাধিকা কি বলছে তাতে মন দিয়ে সময় নষ্ট তিনি করবেন না।

কাল সাদির আঘাতপ্রাপ্ত মুখে আর্মি স্কোয়াড থেকে স্পেশাল সেলে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের ভিড় জমেছিল। সেসময় তোলা একটি ছবি আজ খবরের কাগজে ছেপেছে। রণজিৎ খবরের কাগজ নেয়ার পক্ষে ছিলেন না। আজকের যুগে কে পড়বে কাগজে লেখা খবর যেখানে ভার্চুয়ালি এর চেয়েও আপডেটেড খবর পাওয়া যায়? কিন্তু স্ত্রী রাধিকার ইচ্ছেকে তিনি প্রাধান্য দেন বেশি। রাধিকা খবরের কাগজ ছাড়েন না। তিনি মনে করেন এটিই এখন পর্যন্ত পুরোনো যুগের ভাব বজায় রাখতে পেরেছে। আর কয় বছর পর এই খবরের কাগজও থাকবে না। ততদিন পর্যন্ত তিনি পুরোনো যুগটা ধরে রাখতে চান।

তাই সকাল বেলা আজকের কাগজে সাদির মুখ দেখে মায়ের মন কেঁদে উঠেছে। তিনি চা মুখে দিতে পারেননি। রণজিৎ ব্যানার্জিকে দেখে তার ঘৃণা ক্রমেই বাড়ছে। থুতু ছিটিয়ে স্বামীর মুখটা কলঙ্কিত করতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু এতো দ্রুত সবকিছু শেষ করবেন না তিনি। এমনভাবে স্বামীর বুকে আঘাত হানবেন যা কেউ কল্পনা করতে পারবে না।

রণজিৎ চা পান শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। স্ত্রীকে এক পলক দেখে ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন। তবে থেমে গেলেন রাধিকার কথায়।

– মনে পড়ে না একটুও? আমাদের সন্তান সে। ছোট ছোট পায়ে হেঁটে তোমার কোলে যাওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতো। তুমি অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও প্রিয়কে কোলে নিয়ে আদর করতে। ছেলেটা বড় হয়েও তোমার ভক্ত ছিল। কোনো কাজ তোমার সিদ্ধান্ত ছাড়া করতো না সে।

তেজ দেখিয়ে উত্তর দিলেন রণজিৎ, ‘হ্যাঁ, কোনো সিদ্ধান্ত সে একা নেয়নি। কিন্তু মুসলিম হওয়ার সিদ্ধান্ত সে একাই নিয়েছে। শুধু তাই নয়! আমাদেরকেও ঠেলেছে যেন ইসলাম গ্রহণ করি। এসবের পরও তুমি ওকে আমার ছেলে বলো কিভাবে?’

– যত যাই হোক, তোমার অংশ সে!
– আমি ওকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেছি অনেক আগেই। তারপরও তোমার নাটক শেষ হয় না।
– ত্যাজ্য বললেই সন্তান ও পিতৃত্ব মিথ্যে হয়ে যায় না।
– বাংলা সিনেমার ডায়ালগ দেয়া বন্ধ করো। আমাকে রাগিয়ে দিও না, নাহলে ছেলেকে যতটুকু ভালো দেখেছো তার অবনতি ঘটাতে আমার এক আঙুলের ইশারাই যথেষ্ট।

রণজিৎ চলে গেলেন। পেছনে থেকে রাধিকা চিৎকার করছেন, ‘নিষ্ঠুর! নিকৃষ্ট বাবা তুমি! কবে যে তোমার সংসার ছাড়তে পারবো!’

_________

দরজা খুলে একজন পুলিশ কনস্টেবল ভাতের থালা মেঝের উপর রেখে ঠেলে দিলো সাদির কাছে। কর্কশ সুরে বলে উঠলো, ‘খেয়ে নে। দ্রুত খাবি।’ পুলিশ বাইরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।

হাঁটু জোড়া হাত দিয়ে জড়িয়ে ‘দ’ ভঙ্গিতে শুয়ে আছে সাদি। গালের চামড়া ছিলে গিয়েছে, ঠোঁট ফেটে রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে। পিঠের মাংস ছিলে শার্টের কিছু অংশ ছিঁড়ে গিয়েছে। সারা শরীরে ব্যথা তার, অস্থিসন্ধিগুলো ফুলে আছে। চোখের পাতা নাড়াতে পারছে না, হাত উঠিয়ে খাবে কি করে? তবু বেঁচে থাকতে হলে তাকে খেতে হবে। না খেয়ে পেট পরে আছে যেন মাটির সাথে মিশে যাবে।

সাদি দেয়াল ধরে হেলান দিয়ে বসলো। মৃদু আর্তনাদ করে ভাতের থালা এগিয়ে নিলো নিজের কোলের উপর। ধীরে ধীরে অর্ধেক ভাত খেতেই দরজায় কড়া নারলো কনস্টেবল।

– খাওয়া শেষ হয়নি?

সাদি আস্তে করে বলে উঠলো, ‘না।’

কনস্টেবল লোকটা আর কিছু বললো না। হয়তো শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছে সে। সাদি সবটুকু ভাত খেতে পারছে না, কিন্তু একটা দানাও নষ্ট হতে দেবে না সে। অবশ্য ভাত নষ্ট করলে পুলিশ মেরে মেরে খাওয়াবে আর বলবে, ‘তোর বাপের টাকায় চাল কিনছি?’

ভাত খাওয়ার পর বমি অনুভব করলো সাদি। কোনোরকম মুখ চেপে বমি আটকে সে বলে উঠলো, ‘হয়েছে।’

কনস্টেবল লোকটা ভেতরে ঢুকে থালা নিলো। সাদির মাথায় অনেক রকম চিন্তা ঘুরছে। সে হঠাৎ লোকটাকে ডেকে বললো, ‘ভাই, এখন কি যুহরের সময়?’

– হুম।
– আপনার কাছে ফোন হবে?

নাহ! সাদি ভুল জায়গায় টোকা দিয়েছে। কনস্টেবল ভাতের থালা তার মুখে ছুঁড়ে বললো, ‘টাকা নাই আবার ফোন চাস? মাংনা দিব তোরে?’

সাদি বুঝতে পারলো না লোকটা কিভাবে জেনেছে তার পকেটে টাকা নেই। অবশ্য সে এখন বিশাল এক মামলার আসামি। তার ব্যাপারে সবাই সচেতন থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। পুলিশ কনস্টেবল থালা নিয়ে চলে যাওয়ার পর সে তায়াম্মুম করে যুহরের সালাত আদায় করলো। সিজদাহ দিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মনের আরাম মিলেছে তার। মন ভরে আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা করলো সে। যদি জেলে থেকেই তার আখিরাতে কষ্টের কমতি মিলে যায়, তাহলে এটাই ভালো। আর যদি মুক্তিতে কল্যাণ থাকে, তাহলে সেটাই হোক। আল্লাহ যা ভালো মনে করেন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের আবির্ভাব। রোদের আলো ফিকে হয়ে আসছে। জেলের বাইরে সারি সারি কিছু গাছ আছে। সেখানে ঘর বাধা চড়ুই পাখির বাসা থেকে কিচিরমিচির ডাক ভেসে আসছে। সাদি জেলে বসে কল্পনায় পাখিদের আলাপে যোগ দিলো। পাখিরা ডেকে ডেকে বলছে, ‘আর একটু কষ্ট করো, দুনিয়া মুমিনদের জন্য কারাগার। কাফিরদের জন্য স্বর্গ স্বরূপ।’ উত্তরে সাদি মনে মনে বললো, ‘কষ্ট বলে এ জীবনে আর কিছুই নেই যেদিন জানতে পেরেছি আখিরাতের ভয়াবহতার কাছে দুনিয়ার কষ্ট তুচ্ছ। শুধু চাই, আমার মা যেন ফিরে আসেন। মায়ের হিদায়াহ চাই আমি। আর কিচ্ছু নয়!’

ক্যাচ ক্যাচ শব্দে দরজা খোলার আওয়াজে সাদি চোখ বন্ধ করে ফেললো। নতুন যন্ত্রনা শুরু হতে চলেছে।

ওসি গালিব আর সিআইডি সাগর ভেতরে ঢুকলেন। সঙ্গে এনেছেন নতুন সিআইডি যিনি একজন নারী। সাদি আবছা আলোয় দেখতে পেলো, মহিলার পরনে কোট আর প্যান্ট। উপরে তাকিয়ে নেমট্যাগ দেখতে গিয়েও চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। দাঁড়ানোর অশালীন ভঙ্গি আর আঁটসাঁট পোশাকে সিআইডি ফারহানা আলমগীরকে দেখে মনেই হচ্ছে না তিনি চল্লিশোর্ধ্ব একজন বিবাহিতা। এই মহিলাকে আনার কারণ কিছুটা বুঝতে পেরেছে সাদি। তবে সে শেষ চেষ্টা করবে কিছু স্বীকার না করার।

– চোখ তুলে তাকাও সাদি। তোমার জন্য নতুন মেহমান এনেছি।

ওসি গালিবের কথায় সাদি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো। চিবুক উঁচু করে ওসির দিকে তাকিয়ে সে বললো, ‘জাঝাকাল্লাহ খইরন স্যার। ছেমড়ির চেয়ে বুড়ি মহিলা অধিক ভালো।’

সাথে সাথে সাদির কাছে গিয়ে ওসি গালিব লাথি মারলেন। সাগর সাদির চুল ধরে টেনে চেয়ারের কাছে নিয়ে গেলেন। ফারহানার মুখ থমথমে হয়ে গিয়েছে। আজ পর্যন্ত তাকে কেউ মহিলা সম্বোধন করতে সাহস পায়নি। কারণ তার শরীরের অবয়ব যেমন নিখুঁত, তেমনই তার কণ্ঠের ধার। যে কেউ তাকে ত্রিশ বছরের যুবতী ভেবে বসতে পারে। অথচ এই ছেলে, যে কিনা তার চেয়ে খুব বেশি হলে সাত আট বছরের ছোট হবে, সেই ছেলের কাছে তার মূল্য এতো সামান্য!

সাগর সাপের মতো হিসহিস করে শ্বাস ছাড়ছেন আর বলছেন, ‘অনেক বাড় বেড়েছে তোর। জানিস তুই কার ব্যাপারে কি বলছিস? সিআইডি ফারহানা আলমগীর তিনি। তোকে একশবার বেচলেও ফারহানা ম্যামের মর্যাদা পাবি না তুই।’

সাদি বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। সাগর তা শুনতে একটু কাছে গিয়ে বললেন, ‘কি বলছিস জোরে বল?’

সাদির আজ কি হয়েছে কেউ জানে না। সে কেমন দুষ্টুমির ছলে বলে উঠলো, ‘তাহলে একশো একবার বেচলে মর্যাদা পাওয়া যাবে। ধন্যবাদ স্যার হিসেবটা বলার জন্য!’

সাগর আবার মারতে উদ্ধত হলে ওসি গালিব থামালেন। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘ফাজলামি করতে আসিনি সেটা তুই ভালো করেই জানিস। শোন সাদি, তোকে এখন মোটামুটি একটা খারাপ কারাগারে রেখেছি আমরা। আর্মি স্কোয়াড থেকে ফিরিয়ে এনেছি। ভালো কারাগারে থাকতে পারতি যদি তুই সব স্বীকার করে নিতি। জামিন দেয়া সম্ভব নয়, তাই ভালো কারাগারের কথা বললাম। তুই আজকে কোনো ঝামেলা ছাড়াই সব স্বীকার করে নে। তাহলে খুব আরাম থাকতে পারবি। একদম ঘরে থাকার মতো। বিনা পয়সায় খাবি, থাকবি।’

পুরো কথার মাত্র একটা শব্দ সাদির মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করে দিলো। ‘জামিন!’ এই শব্দটা তার মনে অনেকক্ষন বিচরণ করলো। মস্তিষ্কে কিছু নিউরন জাগ্রত হয়েছে। চোখ বন্ধ করলো সাদি। ভেসে আসছে নতুন বুদ্ধি। ওসি গালিব আর সাগর এখনো কথা বলেই যাচ্ছেন। ফারহানা চুপ করে আছেন তবে তার দৃষ্টি সাদির উপরে। ছেলেটা সেই যে চোখ বন্ধ করেছে, খোলার নাম নেই। কি ভাবছে ছেলেটা?

_________

রাত বাড়ছে। গুলবাহারের চোখে ঘুম নেই। এটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয় তার জন্য। কিন্তু এখন ইনসোমনিয়া রোগে ধরেছে তাকে। ফজর পর্যন্ত সে জেগে থাকে। ফজরের সালাত আদায় করে ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর সকাল সাতটায় উঠে শুরু হয় তার যান্ত্রিক জীবন। আজকাল সালাত পড়তে শুরু করেছে সে। এর পেছনে ফুপির ভূমিকা অনেক। বাহার বাড়িতে থাকলে ফুপি সালমা সালাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। আর সে বাইরে থাকলে ফুপি ফোন করেন। মিষ্টি হেসে বলেন, ‘আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়ার সময় হয়েছে মা। কাজ পরে, আগে সালাত। ঘুমের চেয়ে সালাত উত্তম, কাজের চেয়ে সালাত উত্তম।’

আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় করা সম্ভব হয় না বাহারের। কিন্তু সে পারতপক্ষে সালাত কাযা করে না। সালাতে সে মনের শান্তি খুঁজে পেয়েছে। প্রথম যেদিন ইশার সালাত আদায় করলো অনেকদিন পর, সেদিন সিজদাহ দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিল সে। এতো শান্তি! এতো নির্মল মন! যেন অসীমের স্পর্শে তার শরীরের অপবিত্রতা ঝেড়ে শুদ্ধতা রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গিয়েছে এক মুহূর্তের জন্য দাসত্ব স্বীকার করে নিয়ে। তারপর থেকে সেই দাসত্ব ছাড়েনি। সে আল্লাহর দাস।

পুরুষের সাথে কথা বলতেও দ্বিধা হয় তার। কিন্তু কাজের প্রয়োজনে বলতে হয়, আবার মাঝে মাঝে কথা বলতে গিয়ে ভুলেই যায় এটা পাপ হচ্ছে। অর্থাৎ সেসময় তার ধারণায় থাকে না সে কার সাথে কথা বলছে। স্বাভাবিক কথোপকথনের মতোই মনে হয়। যখন কথা বলা শেষ হয়, তখন তার মনে পড়ে এটা ঠিক হচ্ছে না। আফসোস হয় তার, যদি জন্ম থেকেই একটা দ্বীনি পরিবেশ সে পেতো। যদি সে ফুপির মতো মা পেয়ে যেতো!

ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে মাথা ব্যথা উঠে যাচ্ছে। তারপরও সে ধরছে না কারণ ফোনটা সিয়াম করেছে। এই ছেলের সাথে আগামী সপ্তাহে তার বাগদান। অথচ ছেলেটা কথা না বলে থাকতেই পারে না। একদিন কথা না বললে পরেরদিন বলতেই হবে। বাহার ভেবে নিয়েছে এটা তার শাস্তি। এতোদিন ছেলে বন্ধুর সাথে গল্প করতে তার দ্বিধা হয়নি। এখন সেই শাস্তিটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে।

ফোন কেটে গেল। বাহার এবার সেটা হাতে নিয়েই চমকে উঠলো। সিয়াম নয়, আবির ফোন করেছে। সে দ্রুত উঠে বসে কল ব্যাক করলো। আবির ফোন ধরেছে।

– হ্যালো বাহার? কল ধরছিলে না কেন?

কি উত্তর দিবে বাহার? মিথ্যে বলা ছেড়ে দেয়ার চেষ্টায় আছে সে। সে শুনেছে, এক লোক সব রকম পাপকাজ করে এবং সে একটি পাপ ছাড়তে চেয়েছিল। কারণ তার দ্বারা সব পাপ ছেড়ে দেয়া সম্ভব ছিল না। তখন তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, ‘মিথ্যা বলা ছেড়ে দাও।’ লোকটা মিথ্যা বলা ছেড়ে দিলো। এরপর একে একে সব পাপ ছাড়তে পারলো সে। তাই বাহার এখন মিথ্যা বলা ছেড়ে দেয়ার চেষ্টায় আছে।

– আমি অন্য কেউ ভেবেছিলাম। আচ্ছা শোনো, তুমি কি সাদির ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছো?

আবির যারপরনাই বিরক্ত। যতবার তাদের কথা হবে, ততবারই বাহারের প্রধান প্রসঙ্গ থাকবে সাদি হাসরাত। আবির তার বিরক্ত প্রকাশ না করে বললো, ‘খুব বেশি কিছু জানতে পারিনি। শুধু জেনেছি সিআইডি ফারহানা ম্যামকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি নিশ্চয়ই সফল হবেন।’

বাহারের কন্ঠ যেন থমকে গিয়েছে, ‘কি? মহিলা সিআইডি?’

_________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here