‘ধূম্রজাল,০৯,১০
তাবিনা মাহনূর
নবম পর্ব
সাদির জামিন ঘোষণা করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ থাকলেও তার পক্ষের উকিলের সাহায্যে তার জামিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিশেষ কারণে। সাংবাদিকদের কৌতুহল কমে যাওয়ার বদলে বেড়েই চলছে। কেন সাদিকে জামিন দেয়া হলো? তাও ঘটনার দুই মাসের মাঝেই! কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই সাদিকে জামিন দেয়া হয়েছে।
এই ঘটনায় সবচেয়ে অবাক হয়েছে গুলবাহার। গত এক মাস ধরে সে সাদির বিষয়ে কোনো খবর পায়নি। তবে সাদিকে নিয়ে আদালতে দৌড়াদৌড়ি চলছিল, এ খবর সে জানতে পেরেছিল। এবং সে কিছুটা আভাস পেয়েছিল সাদির জামিনের ব্যাপারে। তবে সে বিশ্বাস করেনি। কারণ সাদি এখনো কিছু স্বীকার করেনি। তাহলে সে কি এমন বলেছে যার জন্য তাকে ছেড়ে দেয়া হলো?
এর পেছনের অসহনীয় কষ্টের বর্ণনা বাহার জানে না। ফারহানার নোংরা অঙ্গভঙ্গি, সাগরের লাথি আর গালিবের হাতে উত্তম মধ্যম খেয়ে সাদির শরীরের কোনো অংশে আঘাতের চিহ্নের অবশিষ্ট বাকি নেই। ফারহানা আসতেন, এসেই সাদির মুখ চেপে ধরতেন। নোংরা ভাষায় কথা বলতেন। সাদির হাত দুটো ধরে তিনি নিজের হাতের মুঠোয় আটকে রাখতেন। তারপর সাগর একের পর এক ঘুষির বর্ষণ ঘটিয়ে সাদিকে বলতেন, ‘বল পেপার্স কোথায়? বল! তুই খু-ন করেছিস। তুই খু-ন না করলেও করেছিস!’
অর্থাৎ সাদি যে খু-ন করেনি তা সবাই জানেন। সাদির মুখ থেকে তারা গুরুত্বপূর্ণ সেই পেপারের খোঁজ চাইছে। সাদি কাটা ঠোঁটে বারবার বলেছে, ‘আমি পেপার্স চুরি করিনি। আমি চুরি করিনি।’ কিন্তু তারা সেই ঠোঁটে ঝাল শুকনো মরিচ ডলেছে, পিঠে বিছুটি পাতা ঘষে দিয়েছে। ঘা শুকিয়ে যাওয়ার সময় দেয়নি। সেই ঘা এর উপর আবার আঘাত করেছে। দ্রুত সাদিকে হাসপাতালে না নিলে গুরুতর রোগ হওয়ার ঝুঁকি আছে। কারণ কারাগারের দেয়ালগুলো স্যাঁতস্যাঁতে। মেঝে নোংরা, ঘরের চাল থেকে রঙের আস্তরন খসে পড়ে। এমন পরিবেশে সাদির স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছে।
তাই জামিন পাওয়ার পরপরই সাদি গিয়েছে নিজের বাড়িতে। টানা দুই ঘন্টা বাথরুমে ঝর্ণার নীচে দাঁড়িয়ে সে নিজের সবটুকু অংশ পরিষ্কার করেছে। শরীর চলতে চায় না, হাঁটু ভেঙে আসে। কিন্তু তার মনের জোর প্রবল, তাওয়াক্কুল সাগর সম। গোসল শেষে সে আছরের সালাত আদায় করেছে। লম্বা সিজদাহ দিয়ে আল্লাহর গুনগান গেয়েছে। নফল সালাত আদায় করে সে দুআ করেছে, যেন তার পরিকল্পনা সঠিক পথে চলে। সে যেন সফলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাফিরদের মুখোশ খুলে দিতে পারে।
সালাত শেষে সাদি তার প্রিয় স্থানে গেল। বারান্দার উঁচু অংশে একটা দোলনা আছে। দোলনাটা বারান্দার বাম পাশে, আর ডান পাশে চিকন তোশক বিছিয়ে তাতে দুটো বালিশ রাখা। তোশক জড়িয়ে রাখা চাদরটা কুসুম রঙা, বালিশ দুটো হালকা গোলাপি ও আকাশি রঙের। হালকা রঙে ঘর সাজাতে সে ভালোবাসতো, ভালোবাসতো সাবিত্রীও। বারান্দার নিচু অংশে আছে ইনডোর গাছ আর একটা জলপ্রপাতের আদলে তৈরি ঘর সাজানোর শো-পিস। এটা তার খুব বেশি পছন্দ নয়, কৃত্রিম জলপ্রপাতে সে প্রশান্তি খুঁজে পায় না। তবে এটা সে ব্যানার্জি প্যালেসে নিজের ঘরে রেখেছিল মায়ের দেয়া উপহার হিসেবে। তাই যেদিন একবারে বাড়ি ছেড়েছে, সেদিন ভ্যানে চড়ে সঙ্গে করে এটাও নিয়ে এসেছে।
পুরো বারান্দাটা সে ব্যানার্জি প্যালেসে তার নিজের ঘরের বারান্দার রূপে সাজানোর চেষ্টা করেছে। তফাৎ এতটুকুই, তার এই বারান্দা আকারে অনেকটা ছোট। ঘর সাজানোর কাজ সচরাচর মেয়েদের মাঝে লক্ষ্য করা যায়। এদিক দিয়ে সাদি কিছুটা বিপরীত স্বভাবের। তার ফ্যাশন ডিজাইনার স্ত্রী সাবিত্রী প্যালেসের একটা ঘর নিজের করে নিয়েছিল শুধুমাত্র বাড়িতে বসে ডিজাইনিং এর কাজগুলো করার জন্য। সেই ঘরের মেঝে জুড়ে বিরাজ করতো টুকরো কাপড়ের রাজত্ব। যেসব নকশা পছন্দ হয় না, সেসব নকশার কাগজ সাবিত্রী দুমড়ে মুচড়ে ফেলে রাখতো সারা ঘরে। সাদি যখন সেই ঘরে স্ত্রীর সঙ্গ পেতে প্রবেশ করতো, তখন তার কাছে ঘরের মেঝেতে হেঁটে হেঁটে সাবিত্রী পর্যন্ত পৌঁছানো অনেকটা রণাঙ্গন জয়ের সমান মনে হতো। সে একটু একটু করে এগিয়ে যেতো আর বলতো, ‘সুশ্রী দেখো, আমি আসছি কিভাবে! যেন ঘন জঙ্গলে রাজকন্যা উদ্ধারে এসেছি।’
রূপসী স্ত্রীকে ভালোবেসে সুশ্রী ডাকতো সাদি। সাবিত্রী তা শুনে কলকলিয়ে হেসে উঠতো। তার হাসির রিমঝিম ধ্বনি প্যালেসের এ কোণ ও কোণ ছড়িয়ে যেতো, যেমনটা সাদির বুকের সায়রে ঢেউ তুলতো। অথচ এই স্ত্রীকে ছেড়ে আজ পাঁচ বছর ধরে সে নিঃসঙ্গতাকে আপন করে নিয়েছে।
বারান্দার কোণে থাকা তোশকের উপরে বসলো সাদি। একটা বালিশ পিঠের পেছনে দিয়ে আরেকটা কোলের উপর রেখে চোখ বন্ধ করলো সে। মনে পড়লো তার কারাগারের ক্ষণিক মুহূর্তের কথা…
– জামিন? তুই কি বোকা পেয়েছিস আমাদের?
ওসি গালিবের এই কথার পৃষ্ঠে রক্ত মাখা ঠোঁটে উত্তর দিলো সাদি, ‘বোকা নয়, আপনাদের চালাক মনে করি বলেই জামিনের কথা বলছি। জামিনের ব্যবস্থা করলে আমি বলবো পেপার্স আর আপনাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তু কোথায় আছে।’
এই প্রস্তাবের পর সাদির উপর নেমে আসে অসহনীয় যন্ত্রণার পাথুরে বর্ষণ আর নিকৃষ্ট আচরণের খেলা। এমন কোনো আঘাত তারা বাকি রাখেনি, যখন তারা জানতে পেরেছে সাদি সত্যিই পেপার্স সরিয়েছে। এবং সে জানে কোথায় আছে তা। শারীরিক অত্যাচার, মানসিক অত্যাচার, নারী কনস্টেবল দ্বারা অশ্লীল আচরণে জোর করা, সব রকম নোংরামির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েও সাদি সব স্বীকার করে নেয়নি। যখন তার অবস্থা নাজুক, তাকে হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন পড়লো, তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলো সাদিকে জামিন দেয়া হবে এই শর্তে, মাত্র পনেরো দিনের মাঝে তাকে গুরুত্বপূর্ণ সেই কাগজ খুঁজে দিতে হবে ও কাগজে লেখা তথ্যের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। সেই অনুযায়ী কাজ করলে সাদিকে খু-নের মামলা থেকেও বাঁচিয়ে নেয়া হবে। এ ব্যাপারে ওসি গালিব, সিআইডি সাগর, এএসপি নাকিব, সিআইডি ফারহানা, মেজর বিক্রম এবং বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে ওসি রূপমের একটি আলোচনা কমিটি গঠন করা হয়। তারা সকলে মিলে এসব সিদ্ধান্তে পৌঁছান।
সাদিকে তারা প্রথম তিন দিন সব রকম কাজ থেকে ছুটি দিয়েছেন। সাদি এতে বেশ অবাক হলেও বুঝতে পেরেছে এখানে কোনো ‘কিন্তু’ আছে। কিন্তুটা হলো তাকে পর্যবেক্ষণ করা, নজরে রাখা। সাদির পরিকল্পনা কোনো ফাঁদ কিনা তা দেখা। সাদি অবশ্য নিশ্চিন্ত মনে নিজেকে সময় দিচ্ছে। তিন দিন পরই তাকে কাজে নেমে পড়তে হবে। আপাতত বারান্দায় গোধূলি বিলাস শেষ করে মাগরিবের সালাত আদায় করবে সে। তারপর হাসপাতালে গিয়ে কিছু সন্দেহমূলক রোগের টেস্ট করাবে। শরীরটা বেশ খারাপ।
_______
বাহারের বাগদান শেষ হওয়ার পর সিয়াম চলে গিয়েছে চট্টগ্রাম পোর্টে। ব্যস্ততার কারণে ছেলেটা সপ্তাহে একদিন ফোন করে। এতেও বিরক্ত হয় বাহার। ফোনে কথা না বললে সিয়ামের শান্তি হয় না। বেশিরভাগ কথা তার আভিজাত্য নিয়ে। কয়টা দেশে ঘুরেছে, মধুচন্দ্রিমায় কোথায় যাওয়ার ইচ্ছে আছে, ছোট থেকে সে কত বুদ্ধিমান, এসব নিয়েই তার বাহারের সাথে আলাপন। বাহার মাঝে মাঝে উদাস মনে সেসব শোনে আর বারবার হাই তোলে। অবশ্য একদিক থেকে সে বেঁচে গিয়েছে। তাকে কথা বলতে হয় না, সিয়ামের মতো বাঁচাল ছেলে একা কথা বলতেই ভালোবাসে।
আজ বেশ উত্তেজনায় বাহারের হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। সাদির সাথে দেখা করা জরুরী। সে জানতে চায় সাদি কি বলেছে, কি করেছে। সাদি কি হার মেনে নিয়েছে? সেও কি দুনিয়ার সুখে হারিয়ে যেতে চাইছে? সে কি খারাপ লোকদের মতো হয়ে গেল?
এতগুলো প্রশ্নের কোনো উত্তর পায়নি বাহার। প্রথম কারণ, ইদানিং কাজের ব্যাপারে তার উদাসীনতা বড় স্যারদের চোখে পড়েছে তাই তাকে যেকোনো মামলা থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা হচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ, তার বাগদানের পর থেকে আবির তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। শেষ একটা কথাই আবির বলেছে, ‘আমাকে এভাবে না ঠকালেও পারতে।’
বাহার বুঝতে পারেনি আবির প্রতারণার কথা কেন বলছে। সে কখনোই আবিরকে প্রশ্রয় দেয়নি, কখনো এমন কিছু বলেনি যে সেও আবিরের প্রতি আকৃষ্ট।আবির নিজে থেকেই বাহারকে সঙ্গী ভেবে বসে থাকলে এখানে কারো কিছুই করার নেই। আবির সহকর্মী হিসেবে অনেক সহযোগিতাপূর্ণ মানুষ। কিন্তু জীবনসঙ্গী হিসেবে আবিরের মতো মেয়েলি পুরুষ বাহারের পছন্দ নয়।
বিয়ের প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু হয়েছে। আজ হাফসা বেগমের সাথে বাহারকে ডায়মন্ডের আংটি কিনতে শপিং মলে যেতে হবে। আর গহনার কাজটাও এই হাতে সেরে ফেলতে চান হাফসা। হানজালা খুবই খুশি বড় মেয়ের জন্য এমন অমায়িক শাশুড়ি পেয়ে। তিনি এবার অনেকটা চিন্তা মুক্ত হয়েছেন। তিনিও যাবেন মেয়ের বিয়ের বাজারে অংশ নিতে। হাফসা হানজালাকেও এক জোড়া স্বর্ণের দুল উপহার দিয়েছেন। তার টাকার গরম দেখাতে নাকি মনের বড়ত্ব প্রমাণে, এ বিষয়টা এখানে পরিষ্কার হয়নি। যাই হোক, বাহারের শাশুড়ি হিসেবে মানুষটা বেশ আন্তরিক।
শপিং মলে ঘুরতে ঘুরতে অপ্রসন্য মনে বাহার দোকানের বাইরে খোলা জায়গায় হাঁটাহাঁটি করছে। ভেতরে তার আংটির মাপ পছন্দ করা হয়ে গিয়েছে। তাই সে হাফসাকে বলে বাইরে হাঁটছে। মূলত তার বিক্ষিপ্ত মন তাকে কোনো কাজে মনোযোগী হতে দিচ্ছে না। তাই মনকে বোঝাতে সে পায়চারি করছে ফাঁকা জায়গাটায়।
হাফসা, হানজালা আর সিয়ামের ভাবি সুতপা দোকানের ভেতরে অন্যান্য গহনা দেখছে। সেসময় দোকানের দরজা ঠেলে সিয়ামকে ভেতরে ঢুকতে দেখলো বাহার। থমকে গিয়ে সে ডেকে উঠলো, ‘সিয়াম!’
সিয়াম দোকানে ঢুকে হাঁটছে। তবে বাহারের ডাক শোনার কিছুক্ষণ পর সে পিছে তাকালো। যেন সে বিদেশে থাকে, নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে শুনতে দেরি করে ফেলেছে। এমন ভঙ্গিতে সিয়াম বাইরে বেরিয়ে এসে হেসে ফেললো। বাহার বিস্মিত কণ্ঠে বললো, ‘তুমি এখানে! কবে এসেছো?’
সিয়াম শরীর কাঁপিয়ে হাসছে। সে হঠাৎ ডেকে উঠলো, ‘মা! দেখো ভাবি আমাকে সিয়াম ভেবেছে।’
বাহার কিছুই বুঝতে পারছে না। হাফসা বেরিয়ে এসে মৃদু হেসে বললেন, ‘সিয়াম আর সিজান দুজন আমার যমজ ছেলে। সিয়ামের প্রায় এক দেড় মিনিট পর সিজানের জন্ম হয়েছিল। তাই সিয়ামকে মেজো বলি, ওকে ছোট বলি।’
বাহারের বিস্ময় এখনো কাটেনি। এতোটা মিল কিভাবে থাকতে পারে দুজন মানুষের চেহায়ার! সিজানই উত্তরটা দিয়ে দিলো, ‘আমরা আইডেনটিক্যাল টুইন ভাবি। আমাদের আলাদা করতে আপনার বেশ বেগ পেতে হবে।’
বাহার ঈষদ হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘সরি, আমি সত্যিই চিনতে পারিনি সিজান ভাই।’
– একদম ভাই বলবেন না। এক দুই মিনিটের হলেও ছোট আমি। আমি নিজেকে ছোট ভাবতে বেশ ভালোবাসি। তাই আমার নাম ধরে ডাকবেন ভাবি।
সিজান দেখি সিয়ামের চেয়েও এক ডিগ্রি বেশি কথা বলে! সিয়াম শুরুতে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করতো। আর সিজান শুরু থেকেই চঞ্চলতা প্রমাণে অস্থির। সে এসেছে আংটির টাকা নিয়ে। ব্যাংক থেকে আসতে একটু দেরি হওয়ায় সে একসাথে আসতে পারেনি। মনে পড়লো বাহারের, সিয়ামকে সে ছোট ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। সিয়াম তখন দুষ্টু হেসে বলেছিল, ‘তোমার জন্য সারপ্রাইজ রাখলাম আমার ছোট ভাইকে।’
সত্যিই সারপ্রাইজ হিসেবে হাজির হয়েছে সিজান। আর কাটিয়ে দিয়েছে কিছু ধোঁয়াশা।
শপিং মলে বাহারের পুরো সময়টা কাটলো নিরামিষ ও চিন্তাকে বন্ধু বানিয়ে। প্রয়োজনীয় কলটা সে করতে পারছে না বাইরের মানুষগুলোকে অসম্মান করা হবে বলে। অথবা তারা ভাবতে পারে বাহার কাজের চাপ দেখাচ্ছে, ভাব দেখাচ্ছে। তাই বাহার বাসায় যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো।
বাসায় গিয়ে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সে অরিত্রীকে ফোন করলো। বাইরের কাপড় ছাড়েনি সে, কুলকুল করে ঘামতে থাকা শরীরকে শীতলতা প্রদানে ফ্যানটাও ছাড়েনি সে। অরিত্রী ফোন ধরছে না। সে আবার করলো। এবার ফোন ধরেছে অরিত্রী। কিন্তু তাকে ভালো-মন্দ কিছুই বলতে না দিয়ে বাহার বলে উঠলো, ‘প্রিয়ংশু ব্যানার্জির কি কোনো যমজ ভাই আছে?’
অরিত্রী চমকে উঠলেও বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ, কিন্তু কেন?’
উত্তেজনায় বাহারের কন্ঠ কেঁপে উঠছে, ‘তারা কি আইডেনটিক্যাল টুইন?’
– হ্যাঁ, দুজনের চেহারায় এতো মিল যে এখনো বুঝতে পারি না আমরা। শুধু প্রিয় দাদা মুসলিম হয়ে যাওয়ায় আমরা এখন হিম দাদাকে চিনতে পারি।
– কি নাম বললি? হিম?
– হিমাংশু ব্যানার্জি। আমরা হিমদা বলি।
হেসে উঠলো বাহার, তবে নিঃশব্দে। অরিত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চোখ বন্ধ করে হাসলো সে। দ্রুত ফেসবুক জগতে ঢুকে সে খুঁজতে শুরু করলো হিমাংশুর আইডি। প্রথমেই চলে এলো বি-অ্যারোমা কোম্পানির উত্তরসূরি হিমাংশু ব্যানার্জির আইডি যেখানে নামের পাশে নীল টিক চিহ্ন দ্বারা বোঝা যাচ্ছে সে বিশেষ ব্যক্তি। এবাউট অপশনে লেখা, ‘লিভস ইন লন্ডন। স্টাডিস বার অ্যাট ল ইন ব্রিটিশ কাউন্সিল।’
একজন সুপরিচিত কোম্পানির উত্তরাধিকারি, উচ্চ ডিগ্রি সম্পন্ন ব্যারিস্টারের কাছে লাইসেন্স যুক্ত পিস্তল থাকা নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক নয়?
_________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)
‘ধূম্রজাল’
দশম পর্ব
তাবিনা মাহনূর
_________
– এক্সকিউজ মি! আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
সাদির দুদিনের ছুটি শেষে আজ তৃতীয় দিন সে গিয়েছিল রিসার্চ সেন্টারে। সেখানে গিয়ে নিজের কক্ষে কিছু টেস্টিং কীট তৈরি রেখে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে সে। তবে সে সরাসরি বাসায় যাবে না। এখন যে বাসায় আছে, সেই বাসা ছেড়ে নতুন ছোট বাসা নিবে সাদি। কারণ সে রিসার্চ সেন্টারের চাকরিও হারাতে বসেছে। আর কয়দিন পর আর্থিক সংকট দেখা দিলে বড় বাসায় থাকা সম্ভব হবে না।
সেই প্রয়োজনে হেঁটে হেঁটে অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে কোনো বাসায় টু-লেট আছে কিনা তা দেখছে সাদি। কিন্তু পথিমধ্যে বোরখা পরিহিত এক নারী তাকে ডেকে উঠলো। সাদি ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে নাকে হাত দিয়ে অচেনা নারীকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্ধত হলো। ফুটপাত থেকে নেমে সে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলে অচেনা নারীটি দ্রুত নেমে তার পিছু নিলো। পেছন থেকে তার শার্ট খামচে ধরে নারীটি বললো, ‘আমি ছেলেধরা নই যে নাকে হাত চেপে রাখবেন। আমি গুলবাহার।’
সাদি এক ঝটকায় শার্ট ছাড়িয়ে সরে দাঁড়ালো। কপালে রেখা টেনে সে বললো, ‘সরে দাঁড়ান। কাছে আসবেন না একদম!’
বাহার তার নিকাব উঁচিয়ে চেহারা দেখিয়ে বললো, ‘আপনি আমাকে অবিশ্বাস করবেন না দয়া করে। আমি আপনার বিষয়ে জানতে পেরেছি বলেই এসেছি। কেউ যেন চিনতে না পারে তাই ফুপির বোরখা পরে এসেছি।’
সাদি কোনো গুরুত্ব দিলো না। তার বিষয়টা সম্পর্কে সিআইডি বিভাগের প্রত্যেকেই অবগত। সবাই জেনেশুনেও না জানার ভান করছে। তাই তারা বাহারকে নতুন টোপ হিসেবে ব্যবহার করে সাদিকে জালে জড়িয়ে নিতে চাইছে কিনা, তা সাদি নিশ্চিত নয়। সে পকেটে দু হাত গুঁজে বললো, ‘যা বলতে চান এখানে দ্রুত বলে ফেলুন।’
বাহার বললো, ‘আপনার আইডেনটিক্যাল টুইন ব্রাদার হিমাংশু ব্যানার্জি খু-ন করেছে, তাই তো?’
সাদি ঠোঁটে উপহাসের হাসি এঁকে বলে উঠলো, ‘নতুন কিছু বলুন। এ কথা সবাই জানে।’
অবাক হলো বাহার, ‘মানে! আমি তো জানতাম না। আমি নিজেই এটা সমাধান করে বের করেছি।’
‘খুব ভালো করেছেন’, এই বলে সাদি আবার চলে যেতে চাইলে বাহার বলে উঠলো, ‘আপনার ভাইয়ের পিস্তল আছে, তার চেহারা আর আপনার চেহারায় কোনো অমিল নেই তাই সে চেকইন করতে পেরেছে। আর আইডেনটিক্যাল টুইনদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট একই রকম হয়ে থাকে যেটা সাধারণ যমজদের থাকে না।’
সাদি হেঁটে চলে যাচ্ছে। এসব পুরোনো কথা শুনে কানের কাজ আর বাড়াতে চায় না সে। কিন্তু বাহার পিছু ছাড়েনি। সে পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘কিন্তু গোপন কক্ষের খবর আপনার ভাই কিভাবে জানতে পারলো?’
থেমে গেল সাদি। পেছনে না ফিরেই সে বলে উঠলো, ‘অর্ধেক তথ্য বের করেছেন, বাকিটাও নিজেই বের করুন।’
সাদি কোনোকিছু সরাসরি বলে না। এই ব্যাপারে বাহার বরাবরই বিরক্ত। এবারও সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে শূন্যে হাত ঝাঁকিয়ে নিজের রাগ প্রকাশ করে বললো, ‘ওহ! এরকম ঘাড়ত্যাড়া মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি।’
সাদির তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে এখন এই ফাঁকা গলি থেকে বেরিয়ে রিকশা খুঁজবে। তাড়াতাড়ি এই মহিলার থেকে নিস্তার না পাওয়া পর্যন্ত তার শান্তি হবে না। কিন্তু বাহার তাকে ছাড়ছে না। পেছন পেছন আসছে আর কথা বলেই যাচ্ছে। এক পর্যায়ে সাদি বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, ‘স্টেরি রোজারিও হিমকে গোপন কক্ষের খবর দিয়েছে। রণজিৎ, হিম, স্টেরি, এরা তিনজনই ওই পেপার্স নিয়ে তোহা স্যারের বিরুদ্ধে ছিল। তাই স্যারকে মেরে ফেলতে তারা দেরি করেনি। আর আমিও ছিলাম স্যারের পক্ষে। তাই আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে সব রকম ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু বিপত্তি বেঁধেছে পেপার্স নিয়ে। যেটা কোথায় আছে তারা কেউ জানে না।’
বলেই সাদি দ্রুত হেঁটে গলি পার হয়ে হাঁক ছাড়লো, ‘মামা! আজিমপুর যাবেন?’
সাদি গড়গড়িয়ে অনেক তথ্য বলে দিয়েছে। তারপরও বাহারের মনে তৈরি হওয়া সব প্রশ্নের উত্তর মিলেনি। ইতিমধ্যে সাদি একটা রিক্সা খুঁজে পেয়েছে। তাতে চড়ে সে মামাকে যেতে বললে বাহার দ্রুত পথ রোধ করে বললো, ‘আপনি যে বলেছিলেন পেপার্স আপনি চুরি করেননি?’
হেসে উঠলো সাদি, ‘তোহা স্যার নিজে আমাকে আমানত হিসেবে সেগুলো রাখতে বলেছিলেন। আমি কেন চুরি করবো?’
বিস্মিত কণ্ঠে আরো একটি প্রশ্ন করলো বাহার, ‘আসলে কী আছে ওই পেপারে?’
রিকশা চলতে শুরু করেছে। সাদি দৃঢ় মুখে সম্মুখে তাকিয়ে। বাহারকে হতবাক করে দিয়ে সে কিছু না বলেই চলে গেল।
__________
বেশ কয়েকমাস পূর্বে…
– সাদি, তুমি আমাকে এই শেষ বয়সে এসে কী বোঝাতে চাইছো বলো তো? আমার ছেষট্টি বছরের জীবনে আমি কখনোই ধর্মের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করিনি। তুমি রাগ করো না, আমি ধর্ম বিষয়টাকে স্রেফ মানুষের দুর্বলতা মনে করি।
কফির মগটা টেবিলে রেখে ঠোঁট ভিজিয়ে সাদি প্রশ্ন করলো, ‘দুর্বলতা? কেমন?’
তোহার উত্তর, ‘প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষ যেকোনো সমস্যার সমাধান খুঁজতে আগে নিজের বুদ্ধি খাটিয়েছে। তারপর যখন তারা সমাধান করতে ব্যর্থ হতো তখন আকাশের দিকে হাত তুলে প্রার্থনা করতো, যেন কোনো অলৌকিক সত্তা তাদের সমস্যার সমাধান করে। এভাবেই ধর্মের উৎপত্তি। মানুষ নিজের দুর্বলতাকে পুঁজি করে ধর্ম নামক একটি অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে। এখনকার সমাজ অনেক উন্নত। যেকোনো সমস্যার সমাধান বিজ্ঞানের দ্বারাই সম্ভব। আমরা জানি, অলৌকিক সত্তা বলে কিছু নেই। ওগুলো মানুষের দুর্বল সত্তার অস্তিত্বহীন প্রকাশ। তাই আমরা কেন ধর্ম বিশ্বাস করবো বলো তো?’
সাদি মুচকি হাসতে গিয়ে কিছুটা শব্দ করে ফেললো। তোহা কৈফিয়তের সুরে বললেন, ‘না দেখো, আমি এটাকে যার যার ব্যক্তি স্বাধীনতা মনে করি। তাই তোমার যদি ধর্ম পালন করতে ইচ্ছে হয় তাতে আমি বাধা দিব না অবশ্যই। এমনকি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালীন সময়ে তোমাকে হিন্দু দেখেছি। এখন দেখছি তুমি মুসলিম। এতেও আমার কোনো অসুবিধা নেই। কারণ এটা তোমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কিন্তু সাদি, আমাকে একটা কথা বলো। এইযে তুমি বললে জিন ক্লোনিং ক্ষেত্র বিশেষে হারাম, আর এই কারণে এটার সাথে তুমি সম্পৃক্ত থাকতে চাও না, এই সিদ্ধান্ত নেয়া কি উচিত হয়েছে? জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং না থাকলে আমরা উন্নত প্রজাতির জীব পেতাম কি করে? তুমি আসলেই বোকা সাদি। এতো এতো উন্নয়ন এভাবে অস্বীকার করতে পারো না।’
– অস্বীকার করছি না স্যার। অবশ্যই বিজ্ঞান আমাদেরকে উন্নতির পথ দেখিয়েছে। বৈদ্যুতিক আলো, যাতায়াতের সুবিধা সহ জীবনযাত্রায় অনেক ভূমিকা আছে এই বিজ্ঞানের। কিন্তু বিজ্ঞানের সৃষ্টি করেছে মানুষ, আর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন স্রষ্টা, আল খলিক। তাঁকে আমরা কয়জন স্বীকার করি? তিঁনি যদি আমাদের জ্ঞানী রূপে, আশরাফুল মাখলুকাত রূপে না পাঠাতেন তাহলে এসব উন্নয়ন কোথা থেকে আসতো?
তোহা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমি সত্যিই চিনতে পারি না তোমাকে। আমার সেই ছাত্র, যে টপ রেজাল্ট করতো। শুধু তাই না, যে দেশ বিদেশ থেকে বিতর্কের উপর ট্রফি নিয়ে এসেছে, দাবা খেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, সেই ছাত্র এমন অদ্ভুত চিন্তাধারার কিভাবে হতে পারে!’
সাদি মৃদু হেসে বললো, ‘সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তিঁনি আমাকে দয়া করেছেন তাই আমি আলোর পথ দেখেছি।’
– প্রি… সাদি শোনো। জিন ক্লোনিং এর ব্যাপারে তোমার ধর্ম কোনো পূর্বাভাস দেয়নি? যেকোনো তথ্যই নাকি ক্বুরআনে লেখা আছে।
সাদি উত্তরটা গুছিয়ে বললো, ‘প্রথমত একটা বিষয় এই যে, সবকিছুর খোঁজ ক্বুরআনে করে একে প্রশ্নবিদ্ধ করা একদম অনুচিত। কারণ সূরা বাক্বরার দ্বিতীয় আয়াতেই আল্লাহ সকল সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে দিয়েছেন, এই কিতাবকে সন্দেহমুক্ত ঘোষণা করে। তাই বিজ্ঞান অতীতে কি আবিষ্কার করেছে, ভবিষ্যতে কি আবিষ্কার করবে তা ক্বুরআনে খোঁজ না করাটাই শ্রেয়। কারণ এভাবে ক্বুরআনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।’
এর পৃষ্ঠে তোহা কিছু বললেন না। তিনি সহনশীল প্রকৃতির মানুষ। তাই তিনি চুপচাপ সাদির কথা শুনলেন।
– আর দ্বিতীয়ত, কা-ফিরদের প্রশ্নের অত্যাচারে কিছু মুসলিম বাধ্য হন ক্বুরআনের সায়েন্টিফিক দিকগুলো তুলে ধরতে। এতে অবশ্য ঈমান কমে না, বরং আরো বৃদ্ধি পায় যে আল্লাহ কতই না প্রজ্ঞাবান! তাই আমাদের মুসলিম সমাজের কিছু ভাইয়েরা না-স্তি-কদের প্রশ্নের জবাব দিতে ক্বুরআনের কি ওয়ার্ড গুলো থেকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। যেমন, মিরাজে ভ্রমণের ব্যাখাকে বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমান করা যায়। এটা সরাসরি ক্বুরআনে লেখা নেই। এটা তাফসীরবিদগণ ভালো প্রমাণ করতে পারেন, কারণ তারা ক্বুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু চর্চা করেন। এবার আসি আপনার প্রশ্নে।
সাদি পানির গ্লাস হাতে নিয়ে এক ঢোক পানি খেয়ে আবার বলতে শুরু করলো, ‘জিন ক্লোনিং মূলত একটা জীবের কোষ থেকে পূর্ণাঙ্গ জীব তৈরি। এটা আপনি জানেন। যেমন, সর্ব প্রথম ভেড়ার একটি কোষ নিয়ে একদম ঐরকমই আরেকটি ভেড়া তৈরি করা হয়েছিল যার নাম দেয়া হয়েছিল ডলি। ডলি মানুষের তৈরি ভেড়া, এটা বললে অবশ্য ভুল হবে। কারণ মানুষ ডলিকে তৈরি করলেও আল্লাহ যদি না চাইতেন তাহলে এটা সম্ভব হতো না।
হেসে উঠলেন তোহা, ‘আচ্ছা? ইন্টারেস্টিং! জিন ক্লোনিং হারাম অথচ আল্লাহ চাইছেন এটা হোক। এটা কেমন কথা সাদি?’
সাদিও হেসে উঠলো, ‘যেমনটা মানুষ চুরি করার ক্ষেত্রে করে। চুরি করা হারাম, কিন্তু তাকে আল্লাহ একটা হাত দিয়েছেন। তাকে হাতের ব্যবহার করার তৌফিক দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহ তা দিয়েছেন ভালো কাজে ব্যবহারের জন্য। অথচ মানুষটা চুরি করে হাতকে খারাপ কাজে ব্যবহার করলো। এর দায় কখনোই স্রষ্টার নয়। এই ব্যাখ্যা অন্য কোনোদিন স্যার, আজ জিন ক্লোনিং নিয়ে বলি। আমি একদিন হুট করে এই ব্যাপারে একটা তথ্য পেয়ে যাই। সেটাই বলবো আপনাকে।’
– প্লিজ! আমি অপেক্ষায় আছি।
– আপনি জানেন, নবী আদম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন?
– হুম জানি।
– তারপর তিনি যখন নিঃসঙ্গতা অনুভব করলেন, তখন তার বুকের পাঁজরের হাড় থেকে হাওয়া আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়।
‘পয়েন্ট!’, বলে মৃদু চিৎকার করে উঠলেন তোহা। সাদি তা দেখে হেসে ফেললো। এরপর তাকে কিছুই বলতে হলো না। তোহা নিজেই বলে গেলেন, ‘পাঁজরের হাড়ের কোষ থেকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি। জিন ক্লোনিং!’
সাদি বললো, ‘জি, ডিএনএ মিলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লার পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। তিনি হাওয়া আলাইহিস সালামকে একদম ভিন্ন এক মানবী রূপ দান করলেন। অর্থাৎ, জিন ক্লোনিং এর ব্যাপারটা কোনো নতুন ব্যাপার নয়। এটা মানব সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই হয়ে আসছে।’
তোহা ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘তাহলে তো আরও একজন আদম আলাইহিস সালাম তৈরি হওয়ার কথা ছিল?’
– সেটাই তো বললাম স্যার। আল্লাহ ক্লোন তৈরি না করে মানবী তৈরি করেছেন। আল্লাহর পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। তিঁনি পাঁজরের হাড় কেন ব্যবহার করলেন, এটাও তিঁনিই ভালো জানেন। কিন্তু আমি শুধু এটা বোঝাতে চাইছি যে পন্থাটা মোটেও মানবসৃষ্ট নয়। বরং মানুষের তো লজ্জা পাওয়া উচিত। তারা এক মানব থেকে অন্য মানব সৃষ্টি করে স্রষ্টার সাথে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। অথচ তারা ভিন্ন মানব তৈরি করতে পারেনি, এতে তাদের বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। সবকিছুই তারা স্রষ্টার সাথে তুলনা করে মেনে চলে। অথচ স্রষ্টা তুলনাহীন, তিঁনি আস সামাদ।
– আর ঐযে ক্ষেত্র বিশেষে বললে?
– জিন ক্লোনিং এর মাধ্যমে যদি চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে অণুজীবের উপর এই পরীক্ষা চালানো হয় তবে কিছু কিছু আলেমের মতে তা হালাল। কারণ আল্লাহ তা’লা ক্বুরআনে মূলত সেই সৃষ্টির ব্যাপারে প্রশ্ন করেছেন যেটা কোনো কিছু থেকেই উৎপত্তি হয়নি।
– আমি বুঝছি না।
সাদি বললো, ‘অর্থাৎ আমরা কখনোই অস্তিত্বহীন কোনো কিছুকে অস্তিত্ব দিতে পারব না। এটা একমাত্র আল্লাহই পারেন, কারণ তিনি স্রষ্টা। আর এ কারণে আলেমদের মতে, ক্লোনিং একটি অস্তিত্ব থেকে আরেকটি অস্তিত্ব তৈরি করার পদ্ধতি বলে এটা কিছু ক্ষেত্রে হালাল। তবে বেশিরভাগ আলেম ক্লোনিং কে সার্বিকভাবে হারাম ঘোষণা করেছেন।’
চুপ করে আছেন তোহা। তিনি চিন্তায় মগ্ন। তারপর তিনি হঠাৎ বললেন, ‘শেষ কথা এই যে, তুমি আমাকে আমার রিসার্চ পেপারগুলো পাবলিশ করতে মানা করছো?’
– জি স্যার। শুধু মানা নয়, এগুলো যেন কারো কাছে না যায়।
– কিন্তু সাদি, আমি যে তোমার বাবা, মানে রণজিৎ ব্যানার্জির সাথে চুক্তি করে ফেলেছি।
– ভেঙে ফেলুন সেই চুক্তি। যেই ক্লোনিং এর কারণে মানবজাতির অকল্যাণ হবে, সেই কাজ করবেন না স্যার।
তোহা তার আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসে বললেন, ‘আমি যে হালাল হারাম মানি না।’
– স্যার, আপনি কি বিশ্বাস করেন যে আপনি একদিন মারা যাবেন?
এই একটি কথাই তোহার সিদ্ধান্ত মুহূর্তেই ঘুরিয়ে দিলো। তিনি বললেন, ‘আমি আজ রণজিৎ ব্যানার্জির সাথে কথা বলবো। আর আমার স্ত্রীর সাথেও। ধন্যবাদ সাদি, তুমি খুব সুন্দর পরামর্শ দিয়েছো।’
__________
সাদির টেস্ট রিপোর্ট এসেছে। আল্লাহর রহমতে তার গুরুতর কোনো রোগ ধরা পড়েনি, শুধুমাত্র ছত্রাক জনিত একটি চর্ম রোগ ধরা পড়েছে। এটার জন্য আজ সে ডাক্তারের কাছে যাবে। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ঔষধ সেবন করলে এবং মলম জাতীয় ঔষধ নির্দিষ্ট স্থানে লাগিয়ে এই রোগ সারিয়ে তোলা যাবে। এছাড়া তার সাধারণ কিছু সমস্যা যেমন ঠান্ডা লেগে যাওয়া, শরীর ব্যথার কারণে হালকা জ্বর এগুলো আছে যা ঔষধের উসিলায় সেরে যাবে ইন শা আল্লাহ।
মাগরিবের সালাত আদায় করে সাদি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। একটু আগে এএসপি নাকিব ফোন করে সতর্ক করে দিয়েছে যেন সাদি কোনোরকম চালাকি না করে। আগামীকাল সে রিসার্চ সেন্টারে যাবে যেখানে এখন এমডি ও সিইও হিসেবে আছেন স্টেরি রোজারিও। এবং সাদি যেখানেই কাগজগুলো রাখুক, তা সঙ্গে করে সেন্টারে যেতে হবে। স্টেরি নিজ চোখে কাগজগুলো দেখবেন, ফটোকপি করবেন এবং সাদির মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করবেন। তবে বাংলাদেশে কাগজের লেখা অনুযায়ী কাজ করা সম্ভব নয়। তাই সাদিকে প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করতে হবে দেশে বসে। এবং পরবর্তীতে তাকে নিয়ে স্কটল্যান্ডে যাওয়া হবে, যেখানে তোহা দীর্ঘ আঠারো বছর রিসার্চ করেছিলেন এবং স্থানীয় স্টেরির সাথে পরিণয়ে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
বের হওয়ার পূর্বে মোবাইলের ওয়াইফাই বন্ধ করতে গিয়ে নোটিফিকেশনের আওয়াজ শুনে সে ভ্রু কুঁচকে দেখলো, গুলবাহার সাখাওয়াত নামের একটা আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এসেছে। সাদি বেশ বিরক্ত হলো। এক নম্বর কারণ, মেয়েটা পিছু ছাড়ছে না। জোঁকের মতো লেগেই আছে। দুই নম্বর কারণ, মেয়েটা গোয়েন্দা বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত হওয়া সত্ত্বেও সাদির ব্যাপারে নাক গলানোর কারণে চাকরি হারাতে পারে। সেই সাথে সে ফেঁসেও যেতে পারে। সাদি সব দিক বিবেচনা করে বাহারকে ব্লক মেরে দিলো। নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ছেড়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো সে। যত দ্রুত সম্ভব সে কাজ সেরে বাসায় ফিরবে। কালকের কথোপকথনের প্রস্তুতি নিতে হবে তাকে।
অন্যদিকে, বাহার সাদির আইডি হারিয়ে ফেলায় হতবাক হয়ে বসে আছে। বারবার সার্চ করেও খুঁজে পেলো না সে। হঠাৎ তার মনে হলো, সাদি তাকে ব্লক করেছে। সে তার ফেক আইডি দিয়ে সার্চ করে সাদির আইডি খুঁজে পেলো। মুহূর্তেই মন খারাপ হয়ে এলো তার। সাদি কেন এই কাজ করলো সে বুঝতে পারলো না। সে একটা ম্যাসেজ দিয়েছিল সাদিকে, ‘প্রয়োজন আছে।’ সেটা কি সাদি দেখেনি?
এমন সময় হানজালা এলেন ঘরে। এসেই তিনি বললেন, ‘এই, তুই নাকি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছিস?’
__________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)