ধূম্রজাল,১৬,১৭

0
355

‘ধূম্রজাল,১৬,১৭
তাবিনা মাহনূর
ষোড়শ পর্ব

প্রতীক্ষা শব্দটা একেক জনের কাছে একেক অর্থ বয়ে আনে। কেউ অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় বসে থাকে, কেউ অশান্ত মনে বারবার বলে ওঠে, ‘কখন সময় হবে!’ কেউ আবার ঠোঁটে মুচকি হাসি রেখে প্রতীক্ষার প্রহর গুনে, কেউ আতংকে মুহূর্তগুলো অনুভব করতে পারে না প্রতীক্ষার অবসান ঘটার আশংকায়।

বাহারের প্রতীক্ষায় কোনো অনুভূতি ছিল না। প্রায় এক মাস যাবৎ সিয়ামের সাথে কথা হয়নি, এ ব্যাপারে খুব কষ্টে রাজি করানো গিয়েছিল সিয়ামকে। আজ বিয়ের দিন। গতকাল গায়ে হলুদ হয়েছে। যদিও এসব লৌকিকতা তার পছন্দ হয়নি, বেশ কয়েকবার মানা করা সত্ত্বেও হানজালা শুনলেন না। বড় একটা রিসোর্ট ভাড়া করে সেখানে আধুনিক চাকচিক্যময় পরিবেশ গড়ে তিনি গায়ে হলুদের বিশাল আয়োজন করেছিলেন। বাহারের ফুপি সালমা বাসায় থেকেছেন, এতে তার আরো মন খারাপ হয়েছে। ফুপির ভাষ্যমতে, বিয়েতে যত কম খরচ হয় ততই বরকত বাড়ে। অথচ বাহারের পরিবার আর আশেপাশের সামাজিক জীবগুলো যেন উল্টো কথায় বিশ্বাসী। যত বেশি খরচ হবে, বিয়ের স্মৃতি ততই মধুর হবে।

আজকের অনুষ্ঠানও বেশ বড় এক কনভেনশন হলে হবে। এই বিয়ে নিয়ে বাহার বরাবরই উদাসীন। কোনো এক কারণে বিয়েতে মন টানে না তার। ফুপির পরামর্শে ইস্তিখারা করেছিল, কোনো ফলাফল বোঝেনি সে। স্বপ্নও দেখেনি। ফুপিকে শুধু বলেছে তার মন ভালো নেই। ফুপি মুফতি কিংবা আলিম নন, তিনি কোনো সিদ্ধান্ত দিতে ভয় পেলেন। বিজ্ঞ মানুষের কাছে যেতে বললেন। কিন্তু বাহার কাউকে পায়নি, সময়ও মেলেনি তার।

সিয়ামের প্রতীক্ষার ফল ঠিক এর উল্টো। গত কাল বাহারকে বাসন্তী রঙা শাড়ি আর হলুদ চন্দ্রমল্লিকায় মেতে ওঠা লম্বা বিনুনিতে দেখে সিয়ামের চোখ থেকে যেন ধোঁয়া উড়ছিল। দুষ্টুমি করে বাহারের গালে একটু হলুদ লাগিয়ে দিয়েছিল সে, বাহার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু কিছুই বলেনি। সারাক্ষণ সে কেমন অপ্রসন্য মনে বসে ছিল। সিয়ামের চোখ এড়িয়ে যায়নি। তবে সে আজ নিশ্চয়ই প্রিয়তমার মন ভালো করবে, এই বিশ্বাস রেখে আজ সে মহা খুশি।

বাহার হিজাব পরা ধরেছে। অনুষ্ঠানেও হিজাব পরতে চেয়েছিল কিন্তু হানজালা আর বাকি আত্মীয় স্বজনদের কথার অত্যাচারে সে নিজের ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারেনি। ফুপি সালমা কথা বলা থামিয়ে দিয়েছিলেন বহু আগেই। কিন্তু কাল ভাতিজির ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে তিনিও আওয়াজ তুলেছিলেন। প্রতিবারের মতো এবারও তাকে অপমানই পেতে হয়েছে। বিশেষ করে হানজালার বোনেরা খুব কটূক্তি করছিলেন, ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলছিলেন। বাহার নিজের ফুপির অপমান সহ্য করতে না পেরে রাগ প্রশমনের চেষ্টা করে ফুপিকে ঘরে যেতে বলেছিল। সে জানে, কোনোভাবেই সে হিজাব পরতে পারবে না। শুধুই অপদস্থ হবে তার ফুপি।

বাহার সিয়ামকে বলার সুযোগ পায়নি সে পর্দা করতে চায়। ভেবেছে বিয়ের পর বলবে, যদি করতে না দেয় তাহলেও সে পর্দা শুরু করবে। সিয়াম বাড়াবাড়ি করলে সে মায়ের কাছে চলে আসবে। মেয়ের কষ্ট নিশ্চয়ই মা হিসেবে তখন হানজালা মেনে নিবেন না। বাহার আরো একটা পরিকল্পনা করে রেখেছে। জাপানে সে যাবে না।নিজস্ব একটা চেম্বার খুলে সেখানেই মানসিক চিকিৎসা দিবে সে। আর ফেসবুকে আগেই একটা পেজ খুলে রেখেছে সে। সেখানে মাঝে মাঝে কিছু মনোবিজ্ঞান বিষয়ক তথ্য শেয়ার করে সে। ওটা ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করছে, এসব কাজেই তার ব্যস্ততা চলে আসবে।

অন্য একজন মানবও প্রতীক্ষায় ছিল এতদিন। আজ সাদির মামলা প্রত্যাহারের দিন। সাংবাদিকরা ইতিমধ্যে ভিড় জমিয়েছে। আদালতে সাদিকে আনা হয়েছে। রণজিৎ আর ডক্টর স্টেরি মামলা তুলে নিচ্ছেন। এই সংবাদে পুরো মিডিয়া দুনিয়া এখন এই রহস্যের সমাধানের খোঁজ করছে। সাদি আজ তার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে চলেছে। তবে সে যেমন আশায় বসে আছে, তেমনই আশংকা গ্রাস করছে তাকে। আল্লাহর নাম নিয়ে সে আদালতে প্রবেশ করলো।

__________

গন্ধরাজ ফুলের তৈরি সারি সারি মালা দিয়ে গুলবাহারের বসার স্থানের সামনে দরজা সদৃশ তৈরি করা হয়েছে। বাহারের পাশে বসতে হলে ফুলগুলো দু হাত দিয়ে পর্দার মতো সরিয়ে তারপর বসতে হচ্ছে। এরকম অনন্য সাজে সাজানো আসনে বাহারের মন খারাপ। সবাই তার মুখ দেখেই বুঝতে পারছে সে ভালো নেই। সবার ধারণা, বিয়ের দিন মেয়েদের যেই চিন্তাটা হয় সেটাই হচ্ছে বাহারের। বাবা মাকে ছেড়ে সে কীভাবে থাকবে? সংসার নামের ভার সে কীভাবে বহন করবে? এসব ভেবেই বাহারের হয়তো মলিন মুখ। তারা আসছেন, আদর করে ডাকছেন। তারা বুঝলেন না বাহারের আসল আপত্তি কোথায়।

সালমা এবার এসেছেন, বিয়েতে না এসে পারেননি। আড়ম্বর আয়োজন দেখে তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন, পানাহ কামনা করলেন যেন এমন চকচকে সৌন্দর্যে তিনি অভিভূত না হন। ঈমান হারিয়ে না ফেলেন। প্রিয় ভাতিজির মুখ দেখে তিনিও মন খারাপ করে বাহারের পাশে বসলেন। মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘ওদিকে গেট ধরার টাকা নিয়ে ঝগড়ার অভিনয় চলছে। নাজকে দেখলাম হাত নাড়িয়ে ঝগড়া করছে, মেয়েটাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে মা শা আল্লাহ।’

বাহার বললো, ‘বরযাত্রী চলে এসেছে?’

– হ্যাঁ মা। সিয়ামকে বসানো হবে ওর আসনে। এরপর কাজী ডাকা হবে। আগে বিয়ে পড়িয়ে তারপর খাওয়া দাওয়ার পর্ব সারবে।
– ওহ।
– মনে অশান্তি চলছে না রে মা?
– খুব। মনে হচ্ছে কিছুই ঠিক নেই।
– এই দিনে সব মেয়েরই এমন মনে হয়। তবে তোকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে অনেকেই অবাক হয়েছে। এ যুগের মেয়েরা নাকি শুধু হাসে। বিয়ের দিন হাসতেই থাকে, এমনকি বিদায়ের সময়েও। কি দিন এলো হায় আল্লাহ!

হেসে ফেলল বাহার, ‘আমিও হেসে ফেললাম ফুপি তোমার কথা শুনে।’ সালমাও হাসলেন। বাহারের চিবুক ধরে তিনি বললেন, ‘হাসি আজীবন অটুট থাকুক। দুআ করি তোর জীবনে হিদায়াহর বর্ষণ ঘটুক।’

– আমিন।

বর পক্ষকে ঢুকতে দেয়া হয়েছে। গেট ধরার টাকা ত্রিশ হাজার পেয়েছে অবিবাহিত ছেলে মেয়েগুলো। তাতেও খুশি নয় তারা। তাদের দাবি এক লাখ, পরে সেটা কমিয়ে পঞ্চাশে নামানো হয়েছিল। কিন্তু সিয়াম ত্রিশ হাজার ছাড়া দিতেই চাইলো না। বউ নাকি ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করবে যদি ঢুকতে না দেয়া হয়। এসব খুনসুটি
শেষে সিয়ামকে বসতে দেয়া হলো তার আসনে। ঠিক তার বিপরীতে সে দেখতে পেলো অপরূপা বাহারকে। লাল রঙের পাকি-স্তানি গাউন আর অফ হোয়াইট নেটের ওড়নায় ঘোমটা দিয়েছে তার প্রিয়তমা। সিয়াম অপেক্ষায় থাকলো কখন কাজী আসবে।

অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। কাজী এলেন সিয়ামের কাছে। বিয়ে পড়ানোর সময় সিয়ামের তাড়াহুড়ো দেখে তার আশেপাশে থাকা সবাই হেসে ফেলল। বন্ধুরা অশ্লীল উক্তিও বলে ফেললো, তাতে হাসির দফা আরো বাড়লো। সিয়ামের বিয়ে পড়ানো শেষে কাজী ছুটলেন বাহারের কাছে।

বাহারের সামনে বসে আছেন কাজী। পাশে তার বাবা সাখাওয়াত, আর দুই পাশে বসেছেন তার এক মামা ও চাচা। মামা সাক্ষী এবং উকিল বাবা হবেন চাচা। সব কিছু ঠিক করে কাজী কত রকম দুআ পড়লেন, সবাই চুপচাপ শুনছেন। মহিলাদের কান্নার বেগ বাড়ছে, বিশেষ করে হানজালার কান্নার কারণে মহিলারা তাকে থামানোর চেষ্টা করছে নিজেরাও কাঁদছে। সালমা একটু দূরে দাঁড়িয়ে অশ্রু ঝরাচ্ছেন নিঃশব্দে।

কাজী এবার উপরে তাকালেন। আন্তরিক কণ্ঠে বললেন, ‘পিতা সাখাওয়াত ইসলাম ও মাতা হানজালা শিকদারের বড় কন্যা গুলবাহার সাখাওয়াত, পিতা সরফরাজ জিদান ও মাতা হাফসা জামিলের মেজো পুত্র সিয়াম সরফরাজের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইবে। গুলবাহার মা, বলুন আলহামদুলিল্লাহ কবুল?’

বাহারের শরীর কাঁপছে, তার চোখে কোনো অশ্রু নেই। শুষ্ক জ্বলজ্বলে চোখ দুটো তাকিয়ে আছে রেজিস্ট্রি পেপারে। ঠোঁট কাঁপছে তার। বুকে তীব্র যন্ত্রণা, এই ব্যথা শারীরিক নাকি মননগত সে জানে না। চোখ দুটো বন্ধ করলো সে। আশেপাশে মৃদু কণ্ঠে কেউ কেউ বলছে, ‘কবুল বল মা, বল!’

কাজী আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘মা, বলুন আলহামদুলিল্লাহ কবুল?’

__________

মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। আদালতে সাদিকে নির্দোষ সাব্যস্ত করা হয়েছে সিসিটিভি ফুটেজ ভুল প্রমাণ করে। ওখানে সাদির ছবি বসিয়ে দেয়া হয়েছে এমন একটা অভিযোগ দায়ের করে মামলার নিষ্পত্তি ঘোষণা করা হয়েছে। মূলত নতুন করে আবার ভিডিও বানিয়ে সাদির গলায় একটা কাটা দাগ বসিয়ে বোঝানো হয়েছে ভিডিওতে সাদি নেই। সাদির ছবিটা কেউ বসিয়ে দিয়েছে।

সাদি নিজ চোখে দেখলো এখানে কত রকম দুর্নীতি হতে পারে। সে চেয়েছে মামলা তুলে নেয়া হোক, কিন্তু তাই বলে মিথ্যে প্রমাণ! ব্যারিস্টার জানেন, উকিল জানেন, পুরো আদালত জানে ওই সব মিথ্যে, ভণ্ডামি। অথচ কত সুন্দর অভিনয় করে সবাই সবকিছু না জানার ভান করছে, ফলাফল জানা সত্ত্বেও ফলাফল দিচ্ছে নির্বিকার চিত্তে। সাদি হতবাক, মুখোশ পরিহিত মানুষ নামের পুতুল দেখে। পুতুলের শরীরগুলো কার নিয়ন্ত্রণে চলছে? নফস নাকি শয়তান?

সাদি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঘিরে গাঢ় নীল পোশাকের গার্ডরা হাঁটতে শুরু করলো। একজন আস্তে করে বললো, ‘অণুজীব আর পেপার কোথায়?’

সাদি বুঝে গিয়েছে সব। এরা তার সাথে রিসার্চ সেন্টার পর্যন্ত যাবে। তার আগে ছাড়বে না এক মুহূর্ত। সাদি বললো, ‘তোহা রিসার্চ সেন্টার। ওখানে স্যারের কামরায় যাবো।’

কয়েকজন বডি গার্ড সমেত সেন্টারে পৌঁছে গেল সাদি। সেখানে গিয়ে তোহা স্যারের কক্ষে যাওয়ার পূর্বে নিজের ঘরে গেল সে। গার্ডগুলো তার সাথেই আছে। একটি ইলেকট্রনিক অণুবীক্ষনযন্ত্রের উপর চোখ রেখে সাদি মুচকি হেসে উঠলো। গার্ডগুলো নিশ্চয়ই মূর্খ। তা নাহলে সাদির এমন কাজে বাধা দিতো তারা। কিন্তু তারা ভ্রু কুঁচকে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের এমন অঙ্গভঙ্গি সাদির ঠোঁটের কোণ বাকিয়ে তুলছে বারবার। সে চেষ্টা করছে না হাসতে। ফোন বের সাদি দশ সেকেন্ড অতিবাহিত করার পরপরই একজন গার্ড সেটা ছিনিয়ে নিয়ে বললো, ‘স্যার না আসা পর্যন্ত কোনো প্রকার ডিভাইস ব্যবহার নিষেধ।’

সাদির কাজ অবশ্য শেষ হয়ে গিয়েছে ওই দশ সেকেন্ডের মাঝেই। কারণ সে পূর্বেই কাজ এগিয়ে রেখেছিল, মোবাইলের স্ক্রিনে শুধু একটা প্রেস করলেই সম্পূর্ণ কাজ হয়ে যাবে যা ইতিমধ্যে সাদি করে ফেলেছে। গার্ডের কথা শুনে সাদি ঠোঁট বাকিয়ে কেমন দুষ্টু হেসে বললো, ‘কি আর করার! টিভি দেখতে পারবো?’

বডিগার্ডগুলো চুপ করে আছে। সাদি হাঁটতে হাঁটতে দরজার কাছে গেল গার্ড ডিঙিয়ে। সে তাহমিদের কেবিনে গিয়েও আবার উল্টো ঘুরে গেল তোহা স্যারের কেবিনে। গার্ডগুলো কেমন তার পিছে পিছে তাহমিদ স্যারের কেবিনে গিয়েও বোকা হয়ে ফিরে এলো! দেখেই সাদির হাসি আসছে। নিজের গাম্ভীর্য ধরে রেখে সে ভাবলো, অণুজীবগুলো ব্যাসিলাস টাইপের ছিল। এরা লম্বা হয়ে থাকে। অনেকটা ক্যাপসুলের মতো। দলবদ্ধ হয়ে ঘুরতে থাকা অণুজীবগুলো দল ছেড়ে কেমন নিথর পড়ে আছে!

তোহা স্যারের ঘরে গিয়ে টিভি চালু করলো সাদি। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর উচ্চ আওয়াজে পদধ্বনি তুলে স্টেরি আর রণজিৎ এসে হাজির হলেন। সাথে আছে এএসপি নাকিব, সিআইডি সাগর আর দুজন অপরিচিত লোক। তবে লোকদের দেখে মনে হলো তারা স্টেরির কাছের কেউ হবেন। রণজিৎ কোনো কথাই বললেন না। স্টেরি বললেন, ‘প্রথমে অণুজীব হস্তান্তর করো।’

সাদি হেসে একটা বাক্সের দিকে আঙ্গুল তাক করে বললো, ‘ঐযে হলুদাভ রঙের কাচের বাক্স। ওটাই আপনাদের কাঙ্ক্ষিত অণুজীব।’

একজন গার্ড ওটা ধরতে গেলে স্টেরি বললেন, ‘খালি হাতে ধরা যাবে না।’

গার্ড সাদির কাছে গ্লাভস চেয়ে নিলো। বাক্সটা হাতে রেখে দাঁড়িয়ে রইলো সে। স্টেরি বললেন, ‘এটা আমার কক্ষে নিয়ে আমি পরীক্ষা করবো। তবে এখন কাগজগুলো দাও।’

সাদি একটা ফাইল এগিয়ে দিলো। ফাইলটা হাতে নিয়ে স্টেরি দ্রুত তা খুলে দেখলেন। ভ্রু কুঁচকে তিনি বললেন, ‘হোয়্যাট দ্যা হেল স্যাডি? ইটস ব্ল্যাংক! (এটা ফাঁকা)’

সাদি একটু শব্দ করে হেসে বললো, ‘বাট ইটস দ্যা পেপার ইউ ওয়ান্টেড। (কিন্তু এটাই সেই পত্র যা তুমি চেয়েছিলে।)’

– আর ইউ কিডিং উইদ মি? (তুমি কি আমার সাথে মজা করছো?)

স্টেরির রাগের মাত্রা বাড়ছে দেখে সাদি মুচকি হেসে বললো, ‘ডক্টর স্টেরি, কাগজ আর অণুজীব আমার কাছে কেন থাকবে বলুন? এগুলো সব আপনার কাছে। আপনি স্যারের স্ত্রী, অথচ স্যার আমাকে কেন সব দিয়ে যাবেন?’

সাদির ছক্কা উল্টে যাওয়ায় স্টেরি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। নাকিব দৌড়ে এসে সাদির কলার ধরে বললো, ‘যা দিতে বলছে তা দিয়ে দে। নাহলে আবার গারদে পুড়বো।’

স্টেরি কোনো কথা বললেন না। রণজিৎ আক্রোশের সাথে বললেন, ‘প্রিয়ংশু, যাই করো না কেন কোনোভাবেই তুমি ছাড় পাবে না।’

সাদি কলার ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, ‘আমার কাছে কিছুই নেই। সব স্টেরির কাছে। সেই জানে তার হাজবেন্ড কি রেখে গিয়েছে। আমি কিছুই জানি না।’

সাগর চিৎকার করে বললেন, ‘অ্যারেস্ট হিম!’

সাদিকে গুম করা হবে। সাদির হাতে হাতকড়া পরিয়ে নাকিব সাপের মত ফুঁসে উঠে বললো, ‘এইবার দেখিস আগের চেয়ে কেমন ডলা দিই।’

সাদি নির্বিকার। একমনে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ সাগরের ফোন আসলো। তিনি কানে ফোন রেখে সাদির দিকে হতবাক চিত্তে তাকিয়ে আছেন। কানে ফোন নিয়েই তিনি বললেন, ‘সাদি!’

___________

– বলুন আম্মা কবুল?

গুলবাহার হঠাৎ পিঠ টানটান করে বসলো। মুখ তুলে তাকালো সে সম্মুখে। চোখ দুটো বন্ধ করে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল, কবুল, কবুল!’

সাদি হাসরাত মুচকি হেসে বলছে, ‘ইয়েস সিআইডি সাগর। দ্যা গেম ইজ ওভার। আমি সব ফাঁস করে দিয়েছি।’

টিভিতে ভেসে আসছে সদ্য পাওয়া খবর,

‘তোহা হত্যা মামলার নতুন মোড়। অভিযুক্ত আসামি সাদি হাসরাতের জামিনের পর আজ মামলা প্রত্যাহার। পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাদি হাসরাত আইডি থেকে তোহা মামলা সম্পর্কিত তথ্য ফাঁস হয়েছে যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিমধ্যে ঝড় তুলে দিয়েছে। তথ্য সূত্রে জানা গিয়েছে, সাদি হাসরাতের আইডেনটিক্যাল টুইন অর্থাৎ যমজ ভাই হিমাংশু ব্যানার্জি এ হত্যার সাথে জড়িত…’

____________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

‘ধূম্রজাল’
সপ্তদশ পর্ব

তাবিনা মাহনূর

__________

আসসালামু আলাইকুম,

ইতিমধ্যে আপনার জানেন আমি কে। আমি সাদি হাসরাত, যাকে তোহা স্যারের খু-নি হিসেবে সন্দেহ করা হয়েছিল কয়েকটা তথ্যের ভিত্তিতে। শুরুতে আমি একটা গল্প বলবো। তারপর সেই তথ্যগুলোর বিশ্লেষণ, এরপর জানাবো কে আসল অপরাধী।

দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিদের অন্যতম একজন রণজিৎ ব্যানার্জি, যিনি বিখ্যাত কোম্পানি বি-অ্যারোমার মালিক এবং তার আরো ছোট ছোট কয়েকটা বিজনেস আছে যা মোটামুটি ধনী পর্যায়ের মাঝেই পড়ে। তার যমজ পুত্র, হিমাংশু ও প্রিয়ংশু। আর তার একমাত্র কন্যা সুনীতি ব্যানার্জি। প্রিয়ংশু ব্যানার্জি হলাম আমি যে পরবর্তীতে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে নাম বদলে রেখেছে সাদি হাসরাত। সাদি, অর্থাৎ আমি খুব সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত ছিলাম। তোহা স্যার আমাকে অনেক বিশ্বাস করতেন কারণ আমি ছিলাম সবার দৃষ্টিতে ভদ্র ও আমানত রক্ষাকারী। অবশ্যই সকল প্রশংসা আল্লাহর।

স্যারের হত্যায় আমাকে অপরাধী ভাবার পেছনে যেই যুক্তিগুলো রয়েছে…

১. সেন্টারে ঢোকার সময় চেকইন করতে গিয়ে আমার চেহারা দেখানো হয়েছে।
২. পিস্তল দিয়ে স্যারকে মেরে ফেলা হয়েছে। যেখানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর সাথে আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলে যায়।
৩. স্যারের গোপন কক্ষের খবর আমি জানতাম।
৪. স্যারের ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সিসিটিভি ক্যামেরায় আমাকে বের হতে দেখা গিয়েছে।

এবার যুক্তিখন্ডন করছি…

১. আমার যমজ ভাই হিমাংশু আমার মতোই দেখতে। সে সেন্টারে বিকেল বেলায় গিয়েছিল। তাই চেকইন করার সময় সে গেলেও আমাকে ভেবে নেয়া হয়েছে।

২. আমি সাধারণ একজন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার। আমার সাথে প্রশাসনিক কাজকর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই আমার কোনো পিস্তল নেই। হিমাংশু আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছে। এবং তার পিস্তলের লাইসেন্স আছে। সে যেই পিস্তল ব্যবহার করেছে তার নম্বর মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, ওটা বিদেশ থেকে ইমপোর্ট করা বা সে নিজেই বিদেশে গিয়ে ওটা ব্যবহারের স্বীকৃতি পেয়েছে। সে এখন লন্ডনে থাকে।

৩. স্যারের গোপন কক্ষের খবর ডক্টর স্টেরি, তাহমিদ স্যার এবং আমি জানতাম। হিমাংশুকে গোপন কক্ষ সম্পর্কে আমি বাদে বাকি দুজন জানাতে পারে।

৪. সিসিটিভি ক্যামেরায় যাকে দেখা যাচ্ছে সে হিমাংশু।

এখন আসি, হিমাংশু কেন স্যারকে মেরে ফেলবে? এটা জানতে হলে আমাদের পেছনের ইতিহাস জানতে হবে।

তোহা স্যার বান্দরবানের রুমা অঞ্চলে এক প্রত্যন্ত গ্রামে নতুন অণুজীবের সন্ধান পান। সেটা সম্পর্কে তিনি কাউকে জানাননি কারণ ওই অণুজীব দ্বারা একজন মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল স্কিন ক্যান্সারে এবং তার মেলানিন হরমোন হ্রাস পাচ্ছিলো। স্যার তাই এ কথা কোথাও ফাঁস না করে অণুজীব সম্পর্কে গবেষণা করেন এবং মেলান স্প্রে নামক এক ধরণের সুগন্ধি যুক্ত স্প্রে তৈরির কৌশল বের করেন যা মানুষের শরীরের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করবে। এতে স্কিন ক্যানসারের ঝুঁকি কমে আসলেও শূন্য হয়ে যায়নি। কেউ কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারতো। তাই স্যার এ সম্পর্কে আরো গবেষণা করতে চেয়েছিলেন। বিপত্তি বাঁধালেন স্টেরি।

স্টেরি ম্যাম স্যারের অনুমতি না নিয়েই রণজিৎ ব্যানার্জির সাথে চুক্তি করে ফেলেন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে তিনি এই স্প্রে বাজারজাত করবেন। এছাড়াও তাদের ভেতরে চলছিল নোংরা এক খেলা যা আমি প্রকাশ করছি না। তোহা স্যার চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি আমার কাছে পরামর্শ চাইলেন, আমি এ কাজ করতে অনুৎসাহিত করলাম।

স্যার আমার কথা শুনলেন। তিনি অণুজীব ও কাগজ লুকিয়ে ডক্টর স্টেরিকে জানালেন তিনি এ কাজ করবেন না। স্টেরির মাঝে মনুষ্যত্ব বোধ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। স্টেরি রণজিৎ এর সাথে স্যারকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করলেন এবং আমাকে ফাঁসিয়ে দিতে চাইলেন যেন আমি আর কোনো বাধা হিসেবে না থাকি। হিমাংশু শুধু তার বাবার কথা মতো কাজ করেছে। তাকেও অর্থ স্বচ্ছলতার লোভ দেখানো হয়েছে। আফসোস! এতো বিত্তশালী হয়েও সকলের আরো চাই, আরো চাই!

প্রশ্ন হলো, ফাঁসিয়ে দেয়ার পরও কেন আমার মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে? কারণ হলো, মেলান স্প্রে তৈরি করতে যা যা প্রয়োজন তা একমাত্র আমিই জানি। এ দেশে এই স্প্রে তৈরি সম্ভব নয়। কারণ এখানে পর্যাপ্ত যন্ত্র নেই, সুবিধা নেই। আমাকে স্কটল্যান্ডে যেতে হবে। মামলায় জড়ানো পুরুষ হিসেবে আমি বিদেশ যেতে পারতাম না। তাই আমি একটু বুদ্ধি খাটিয়েছি। তাদেরকে বলেছি আমার মামলা প্রত্যাহার করতে, এরপর আমি স্প্রে তৈরি করবো।

এবার আসি হিমাংশুই অপরাধী তার প্রমাণ নিয়ে। নিচের ছবিতে কয়েকটা তথ্য দিয়েছি। সেগুলো পড়ে দেখুন। তোহা স্যারের নিখোঁজ হওয়ার দুই দিন আগে হিম দেশে আসে। এরপর স্যারের নিখোঁজ হওয়ার দিন রাত সাতটার ফ্লাইটে সে লন্ডন চলে যায়। আমি এয়ারপোর্টে এবং বিমান সংশ্লিষ্ট লোকদের সাথে যোগাযোগ করেছি। তারা আমাকে হিমের তথ্য দিয়েছে। অবশ্য এখানেও কিছু রাজনীতি আছে। যেমন, হিম বলেছে সে তিন বছর ধরে দেশে আসে না। তাই এয়ারপোর্ট সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পদের মানুষ আমাকে বারবার বলছিল হিম আসেনি। ভিসা অফিসেও একই কথা বলেছে। সব বুঝে গিয়েছিলাম আমি। তাই তথ্য বের করতে নিজের পরিচিত মানুষের সহায়তা নিয়েছি। তার কথা বলবো না, তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য। আরো একটা বিষয় আগেই বলেছি, হিমের পিস্তল সে ইচ্ছে করে কক্ষে রেখে গিয়েছিল যেন ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেয়ে মনে হয় আমি অপরাধী। কিন্তু বোকামি করেছে সে এখানেই। আমার মতো সাধারণ লোকের কেন পিস্তল থাকবে?

যাই হোক, সব প্রমাণ আমি নিচের ছবিতে যুক্ত করে দিয়েছি। অপেক্ষায় থাকুন, দেখা যাক কি হয়। এখন বাকিটা পুলিশের হাতে। তোহা স্যারের মতো দেশের একজন নক্ষত্র যার হাতে ঝরে পড়ে গেল, তাকে ধরতে আশা করি পুলিশ বাহিনী এবং সরকার কোনো উদাসীনতা দেখাবে না।

_________

বিয়ের পর নিজের নতুন ঘরে প্রথম মুহূর্তে বাহার ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া পোস্ট পড়ছে। তার মাঝে বিয়ে নিয়ে যতটা আগ্রহ, তার চেয়েও বেশি আকর্ষণ কাজ করছে সাদির বিচক্ষণ মানসিকতার প্রতি। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে গুলশানে শ্বশুরবাড়িতে আনা হয়েছে। দুদিন পর বৌভাত হবে। এসব নিয়েই বাড়ির মানুষগুলো খুব ব্যস্ত।

বাড়ি পৌঁছানোর পর সিয়ামের কোলে চড়ে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দরজা পর্যন্ত গিয়েছিল বাহার। এটা সিয়ামেরই দুষ্টু কাজ। সবাই হেসে উঠেছিল উচ্চস্বরে। বাহার অবশ্য লজ্জা পেয়েছিল। সে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, ‘সিয়াম, আমাকে নামিয়ে দাও।’ সিয়ামের উত্তর ছিল, ‘এখন তুমি আমার। আমার ইচ্ছেকেও প্রাধান্য দিতে শেখো বাহারজান।’

হেসে উঠেছিল বাহার। সিয়াম খুব দুষ্টু স্বভাবের ছেলে। আড্ডা জমিয়ে তুলতে পারে, মন খারাপ থাকলে চট করে খুশি করে দিতে পারে। বাহার অবশ্য বিয়ের আগে গম্ভীর মুচকি হাসির ব্যক্তিত্ব আছে এমন পুরুষ চাইতো। কিন্তু আল্লাহ যা রেখেছেন, তাই মেনে নিয়েছে সে। সিয়ামকে মানতে তার কোনো সমস্যা হয়নি। কারণ সিয়াম এখন পর্যন্ত তাকে কোনো ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করেনি। মানসিক অশান্তিতে রাখেনি। বাকিটা সংসার করতে গেলে বোঝা যাবে।

সিয়ামকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সাদা আর লালের মিশ্রণে কিছু অজানা ফুল ও রজনীগন্ধায় সাজানো ঘরে ঢুকতে সিয়ামের মনসায়রে ঢেউ খেলে যাচ্ছে, অথচ বাঁধ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে তার ভাই বোনেরা। ভেতরে মুচকি হাসছে বাহার। বিয়ের কাপড় ছেড়ে লাল রঙের জামদানি শাড়ি নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল সে। গোসল সেরে বের হয়ে সিয়ামকে না পেয়ে বুঝতে পারলো, এখনো তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। বেশিক্ষণ হয়ে যাওয়ায় বাহার দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিয়ে বললো, ‘সিয়াম কোথায়?’

এক ননদ হাসতে হাসতে বললেন, ‘সিয়াম ছাদে নাচ দেখাতে গিয়েছে। নাচ না দেখালে তোমার কাছে আসতে দেয়া হবে না।’

বাহার কিছুটা বিব্রত বোধ করে মেকি হাসি হেসে ভেতরে চলে গেল। ছেলে মানুষ নাচবে, এ কথা ভাবলেই কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি ঘিরে ধরে বাহারকে। নাচ করা ছেলেদের ব্যক্তিত্বহীন মনে হয় তার। কিন্তু সে এটা প্রকাশ করতে পারতো না। কিছু মানুষ তেড়ে আসতো এই বলে, ‘নৃত্যশিল্পীদের সম্মান করতে শেখো!’

বাহারকে আর বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। সিয়াম এসেই দরজা আটকে এক লাফে বিছানায় উঠে বাহারের কোলে মাথা রাখলো। বাহার মুচকি হাসতেই সে বললো, ‘এভাবে হেসো না, বুকে লাগে।’

আরো হেসে উঠলো বাহার। যদিও এসব ভালোবাসাময় বাক্যগুলো শুনতে বাহারের কোনোদিন ভালো লাগেনি। এর আগেও কত শত প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে সে। সবই ছিল প্রেমিক ধরণের। সবার কথাতেই তার জন্য স্তুতি বাক্য ঝরে পড়তো। বাহার এসব পছন্দ করে না। তার বরাবরই গম্ভীর স্বভাবের ছেলে পছন্দ ছিল। এজন্য এসএসসি কোচিং করার সময় এক স্যারের প্রতি তথাকথিত ক্রাশ খেয়েছিল সে। স্যার সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকতেন। মাঝে মাঝে মুচকি হাসতেন। তবে বাহারকে একবার খুব বকা দিয়েছিলেন একটা পরীক্ষা না দেয়ায়, সেদিন থেকে বাহারের মোহ কেটে গিয়েছিল।

আজ নিজের স্বামীকে মেনে নিতে কোনো কষ্টই হচ্ছে না। বরং এটাই ভালো লাগছে। কারণ সে বারবার নিজেকে বোঝাচ্ছে, তার স্বামীর সাথে হালাল বন্ধন জুড়ে গিয়েছে। বাহারকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিয়াম বলে উঠলো, ‘কি ভাবছো বাহারজান?’

বাহার ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘বাহারজান কি হুম? আমি গুলবাহার।’

সিয়াম বাহার চুল নিয়ে খেলা করছে, ‘আজ থেকে আমার বাহারজান তুমি। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করেই তোমায় আমার সিলমোহর মেরে দিয়েছি।’

বাহার হেসে বললো, ‘জি না। কবুল বলে আমরা বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি।’

সিয়াম দায়সারা কণ্ঠে বললো, ‘একই ব্যাপার। কবুল না বললেই কি! ভালোবাসা মানে না কোনো বাঁধা।’

বাহার কোল থেকে সিয়ামের মাথা নামিয়ে বললো, ‘এই উঠো দেখি। কবুল কোনো ব্যাপার না?’

সিয়াম উঠে বসে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘তুমি বিয়ের আগে কি যেন বলেছিলে? হিজাব পরতে চাও নাকি…’

বাহার মনে মনে ভাবছে, সে পরিপূর্ণ পর্দা করতে চায়। কিন্তু শুরুটা হিজাব দিয়েই হোক। যেহেতু সিয়ামকে মানিয়ে নেয়ার সময় দিতে হবে। সে বললো, ‘হ্যাঁ। আমার পর্দা করার ইচ্ছা আছে।’

– দেখো, তুমি যা ইচ্ছে মেনে চলো। আমার সমস্যা নেই। আমি মনে করি এটা যার যার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা।
– স্বাধীনতা? তুমি ধর্ম মানো না সিয়াম?
– একটা কথা এখনই পরিষ্কার বলে দিই। আমি কোনো ধর্মই বিশ্বাস করি না।

আকাশ ভেঙে পড়লো বাহারের উপর। সিয়ামের ধ্যান ধারণা অবিশ্বাসীদের মতো। তারমানে তাদের বিয়েটা শুদ্ধ হয়নি, বলতে গেলে বিয়েই হয়নি তাদের।

বাহারের চোখ দেখে সিয়াম বলে উঠলো, ‘আরে ঘাবড়ে যেও না। তোমাকে আমি কখনোই কোনো বিষয়ে চাপ দিব না। তোমার ইচ্ছেকে সম্মান জানাই আমি। আমার বাবা মা হজ করে এসেছেন, আবার আমার বড় ভাবি কিন্তু হিন্দু ছিলেন। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত। পরে অবশ্য ভাইয়ার প্রেমে পড়ে ধর্মান্তরিত হয়েছেন, কিন্তু মনের দিক থেকে হিন্দুই আছেন। আমাদের পরিবারে কেউ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। সবাই নিজেদের নিয়মে চলতে পারে।’

বাহার নিজেকে শান্ত করলো, চেষ্টা করলো তার ভেতরের ঝড় যেন সিয়াম টের না পায়। কারণ সিয়াম তাহলে তার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য জোর করতে পারে। আর সেটা হবে ভয়াবহ যিনা। সে বললো, ‘সিয়াম, এখন এসব কথা থাক। আমার শরীর খারাপ লাগছে। আমি এশার সালাত পড়বো।’

বাহার নেমে গেল। বাথরুমে গিয়ে দরজা আটকে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কেমন ভয়াবহ রাত তাকে দেখতে হলো! এতদিন যাবৎ কথা হয়ে আসছে দুজনের, অথচ সিয়াম একবারও বুঝতে দেয়নি সে ধর্মে বিশ্বাস করে না। বাহার অবশ্য ধর্মীয় কোনো আলোচনা করতো না। সিয়ামই মাঝে মাঝে গল্পের ছলে বলতো, ‘জানো এবার ঈদে কি হয়েছে? গত ঈদে আমরা থাইল্যান্ড ছিলাম…’ ঈদের গল্প করায় বাহার বুঝতেই পারেনি সিয়াম নাস্তি-ক।

ওযু সেরে বের হয়ে সিয়ামকে মুসাল্লা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে দেখলো বাহার। তার প্রশ্নবিদ্ধ মুখখানি দেখে সিয়াম বললো, ‘আমি নামাজ পড়ি না। তাই জায়নামাজ রাখি না। তুমি পড়বে বলে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে এলাম।’

বাহার সেটা নিয়ে সালাত আদায় করলো। অনেকক্ষণ মোনাজাতে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলো সে। কাল এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। সিয়াম ফিরিয়ে নিতে চাইলে বিভিন্ন হুমকি দিবে সে। আইনি সাহায্য নিয়ে ডিভোর্সের কাজটা দ্রুত সারতে হবে তাকে।

বাহারের সালাত আদায় শেষে সে সিয়ামকে প্রশ্ন করলো, ‘তোমরা ঈদ কেন পালন করো সিয়াম?’

সিয়াম হাসিমুখে উত্তর জানালো, ‘এটা তো একটা ট্রেডিশন। ঈদ, পূজো, ক্রিসমাস সবই পালন করি আমি। আমার উৎসব অনুষ্ঠান খুব ভালো লাগে।’

বাহারের পানসে মুখ দেখে সিয়াম বুঝে গিয়েছে বাহার খুবই চিন্তিত এবং বিস্মিত তার কথায়। সে বললো, ‘তুমি বেশি চিন্তা করো না বাহার। আমি তোমার কাজে কখনোই বাধা হয়ে থাকবো না। শুধু তুমি থাকলেই চলবে।’

বাহার কিছু না বলে বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়লো। সিয়াম বলে উঠলো, ‘এমন করছো কেন বাহার? আমার কথা শোনো…’

সিয়াম তার কাঁধে হাত রেখেছে। বাহারের মনে হলো কোনো গরম লোহা তার চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে। এতোটা ঘৃণা নিয়ে সে নিজের ক্রোধ যথাসম্ভব দমন করে বললো, ‘আমার খুবই ঘুম ধরেছে সিয়াম। আজকে কথা বলার শক্তিই নেই। দশ কেজি ওজনের জামা পরে হেঁটেছি। ভারী গয়নাও ছিল। বুঝতেই পারছো।’

এই বলে বাহার আবার ঘুরে গেল। সিয়াম লাইট বন্ধ করে হঠাৎ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আর আমার অপেক্ষার কি হবে?’

চমকে উঠে বসলো বাহার, ‘অপেক্ষার অবসান ঘটালে সেটা ম্যারিটাল রেপ হবে। তোমাদের ভাষায়।’

বাহার বালিশ নিয়ে নীচে নেমে পড়লো। সিয়ামের মুখ শক্ত হয়ে এসেছে। তাদের বানানো নিয়ম দিয়েই বাহার তাকে ঘায়েল করেছে। কিন্তু সে যথেষ্ট চালাক ছেলে। সে স্ত্রীর মন গলাতে বলে উঠলো, ‘আচ্ছা ঠিকাছে, রাগ করো না। উপরে উঠে ঘুমাও বাহারজান।’

বাহার চুপ করে শুয়ে আছে। সিয়ামও তার পাশে শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। বাহার চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করলো। আপাতত এভাবেই থাকুক, নাহলে হীতে বিপরীত হতে পারে। সকাল হলেই সে কোনো এক অজুহাতে এ বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আর কোনোদিন আসবে না।

মাঝরাতে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল বাহারের…

__________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here