ধূম্রজাল,১৮,১৯

0
230

‘ধূম্রজাল,১৮,১৯
তাবিনা মাহনূর
অষ্টাদশ পর্ব
__________

বেশ রাত হয়েছে। একটু পরেই ফজরের আযান শোনা যাবে। এমন সময় ফোনের বিকট আওয়াজে পুরো ঘরে শব্দের আলোড়ন তৈরি হলো। প্রতিধ্বনি হওয়া শব্দগুলো বাহারের কানে যেন আঘাত করছে। ঘুম ভাঙা চোখে আবছা তাকিয়ে সে নিজেকে বিছানায় দেখলো। পাশে সিয়াম ঘুমন্ত অবস্থায় বালিশ জড়িয়ে নিজের কান ঢেকে রেখেছে। বাহারের জ্ঞান ফিরে এলো। উঠে বসে সে শাড়ি ঠিক আছে কিনা তা দেখে দ্রুত নেমে মোবাইলের কাছে গেল। আল্লাহর সাহায্য ছিল বলেই সিয়াম নিজের অধিকার ফলাতে আসেনি। নাহলে নৌ বাহিনীতে কর্মরত একজন পুরুষের দৈহিক শক্তির কাছে তাকে হেরে যেতেই হতো।

বেজে বেজে কল কেটে গিয়েছে। বাহার কল লিস্টে গিয়ে দেখলো, ফোন নম্বরটা অচেনা। বাহার ফোন সাইলেন্ট করে বিছানার কাছে এসে বালিশ নীচে ফেলতেই আবার ফোনের আলো জ্বলে উঠলো। এতো রাতে নিশ্চয়ই জরুরি কল করবে কেউ। আবার উটকো ঝামেলাও আসে মাঝে মাঝে। এক রাতে এমন এক অচেনা নম্বর থেকে কল এসেছিল। সে প্রয়োজনীয় ভেবে কল ধরেই বিপদে পড়ে গিয়েছিল। অপর পাশে থাকা মানুষ রূপী পিশাচ খুব নোংরা কথা বলেছিল তাকে। অশ্লীল সেইসব ভাষা শুনে সেই দিনের পর থেকে সে রাতের বেলা অচেনা নম্বর থেকে আসা কল ধরে না।

আজ অবশ্য দু’বার ফোন এসেছে। বাহারের কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় এখন ঘুম আসার সম্ভাবনাও কম। তাই দ্বিতীয়বার কল আসায় সে ধরে ফেললো, কিন্তু কোনো কথা বললো না। আগে দেখতে হবে এটা ছেলে নাকি মেয়ে।

ওপাশ থেকে ভেসে এলো অল্প পরিচিত কন্ঠ, ‘হ্যালো!’

বাহার চিনতে পারেনি। তবে কণ্ঠের অধিকারিণী একজন মহিলা। বয়সের ভারে গম্ভীর কণ্ঠ কিন্তু মেয়েলি ভাবটা এখনো আছে। বাহার বলে উঠলো, ‘কে?’

– আদাব আপনাকে। আমি প্রিয়ংশুর মা।

চমকে উঠলো বাহার। এই রাতে ফোন করার অর্থ কি? কোনো বিপদ আসেনি তো? বাহার বারান্দায় গিয়ে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম, জি বলুন?’

– আপনি প্রিয়ংশুর সাইকোলজিস্ট? আমার ছেলেটার সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারবেন? আমি আপনার চেম্বারে যাবো, আমার ছেলেকেও আসতে বলবেন। তাহলেই হয়ে যাবে।

বাহারের অনুতপ্ত মন, মৃদু স্বরে সে বলল, ‘আসলে আমি একজন ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্ট ছিলাম। চাকরি ছেড়ে দেয়ায় উনার সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।’

আর্তনাদ করে উঠলেন রাধিকা, ‘হায় হায়! আমি খুব কষ্টে আমার দারোয়ানের ফোন থেকে কল করেছি আপনাকে। অনেক আশা নিয়ে। আপনি একটু ব্যবস্থা করে দিন না? আমি ছেলেটাকে কতদিন দেখিনা।’

মায়ের কণ্ঠের আকুলতা বাহারের মনে বিষাদ নামালো। সে মলিন কণ্ঠে বললো, ‘দুঃখিত আন্টি, আমি…’

– যেকোনো উপায়ে? দয়া করো মা। আমি আমার ছেলেকে না দেখে থাকতে পারছি না আর।

বাহার বলে উঠলো, ‘এক মিনিট, আমি ব্যবস্থা করতে পারি কিনা দেখি।’

– একটা সেকেন্ডও সময় দিতে পারবো না মা। আমার স্বামী জেগে গেলে সব শেষ।
– ঠিকাছে আন্টি, আপনি কাল গুলশান আড়ং এ আসতে পারবেন?
– হ্যাঁ পারবো, কিন্তু বিকেল বেলা।
– ঠিকাছে সমস্যা নেই। পৌঁছে কোন নম্বরে ফোন করবো আপনাকে?
– আমিই ফোন দেব। আমাকে ফোন করো না। করলে রণজিৎ টের পেয়ে যাবে।

এ কথা বলেই তিনি ফোন কেটে দিলেন। বাহার ফোন নম্বরটা সেভ করে রাখলো। কালকে দেখা করবে সে এ কথা তো জানিয়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু সাদিকে কীভাবে আনবে?

চিন্তিত বাহার বারান্দা জুড়ে পায়চারি শুরু করলো। একজন মানুষকে কথা দেয়া হয়েছে, সেটা ভঙ্গ করলে গুনাহ তো হবেই আবার মানুষটার নিরাশ মুখ দেখতে বাহারের ভালো লাগবে না। যেকোনো উপায়ে সাদির সাথে যোগাযোগ করতে হবে। বিশাল এই দ্বিতল ভবনের এক প্রান্তে সিয়ামের ঘরের বারান্দায় রাজকীয় ছোঁয়ার প্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন মূল্যবান তৈজসপত্র দ্বারা। এরই একটি হলো দামি ডিভান যেটা বারান্দার মাঝ বরাবর রাখা। এক কোণে আরামকেদারাও আছে। বাহারের ধারণা, সিয়াম দোলনা পছন্দ করে না। তাই এতো সুন্দর বারান্দায় একটা ছোট খাটো দোলনাও নেই।

ডিভানে শুয়ে বাহারের চোখে ঘুম চলে এলো। তবে হঠাৎ এক বুদ্ধি মস্তিষ্কে বিচরণ করায় নিমিষেই ঘুম ছুটে গেল। উঠে বসে সে ফেক আইডি দিয়ে ফেসবুকে ঢুকলো। সাদি হাসরাতের আইডি খুঁজতেই পেয়ে গেল সে। বাহার কিছুটা বিস্মিত, সাদি কেন তাকে আনব্লক করেছে? দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে সে বুঝতে পারলো সাদি তাকে ব্লক করেনি। আইডি ডিএক্টিভেট করার কারণে সে সাদিকে অনলাইন দুনিয়ায় খুঁজে পায়নি। এখন একটিভ থাকায় বাহার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো। দ্রুত লিখে রাখলো, ‘আসসালামু আলাইকুম সাদি, আপনি কি জেগে আছেন? অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। দয়া করে এড়িয়ে যাবেন না।’

__________

তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে সাদি জিকিরে ব্যস্ত। চোখ দুটো বন্ধ করে অনবরত ইস্তেগফারে মগ্ন থাকা সাদি দিন দুনিয়া ভুলে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে নিজের প্রাণ-মনন নিবেদিত রেখেছে। এ সময় এক নারী, যে তার আপন কেউ নয়, সেই নারীর বার্তা তার কাছে পৌঁছায়নি। ফজরের আযান না দেয়া পর্যন্ত তাকে কেউ খুঁজে পাবে না।

আজান শোনা গেল। সাদি চোখ খুলে আজানের জবাব দিতে শুরু করলো। মাঝে মাঝেই তার ভয় হয়, যদি আল্লাহ ক্ষমা না করেন? কত পাপ করেছে সে! সবচেয়ে বড় পাপ, শিরক। আবার সে কৃতজ্ঞতায় সিক্ত করে দু নয়ন। আল্লাহ কতই না মহান! তাকে পথভ্রষ্ট অবস্থায় পেয়ে পথ দেখিয়েছেন।

ফজরের সালাত আদায় শেষে কিছুক্ষণ বারান্দায় হেঁটে ভোরের শীতল হাওয়ায় মন ভেজালো সাদি। ডিসেম্বরের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর, শিশির ঝরা মুগ্ধতা। সাদি দু চোখ বন্ধ করলো। তার কবি মন জেগে উঠছে।

‘শুভ্রতা,
আর্দ্র প্রণয়ে মেতে ওঠা উত্তাপ কি তোমার রূপকে কলঙ্কিত করে?
স্নেহ মাখা কণ্ঠে পাখির ঘুম ভাঙা আহ্বান,
প্রবোধ জাগায়, কাঞ্চন রঙা শুভ ভোরে।
স্বপ্ন যে সত্য বার্তা নিয়ে আসে না, সিক্ত নয়নে দেখি তোমার নির্বান।
শুভ্রতা, তুমি কি ছলনাময়ী?

শুভ্রতা,
চাদর গায়ে জড়িয়ে মনের নগ্নতা ঢাকার ব্যর্থ প্রয়াস,
নির্বাক শূন্য দৃষ্টির মায়ায় অবগাহন।
সব মিছে খেলা, পুষ্পহীন জীবনে কল্পিত সুবাস।
চাঁদ ডোবা সুবহে সাদিকে শিশির রোদন।
শুভ্রতা, তুমি কি ছলনাময়ী?

শুভ্রতা,
কৃষ্ণচূড়ার পথ মাড়িয়ে বিবাগী…’

থেমে গেল সাদি। একটা নাম মনে আসছে। ‘কৃষ্ণচূড়া’ নামটা তার উচ্চারণ করতে কষ্ট হচ্ছে। রাধা-কৃষ্ণ জুড়ির প্রেম কাহিনী তার এক সময়ের কণ্ঠস্থ বিষয় ছিল। সাবিত্রীকে সে বলতো, ‘আমরা হবো সেরা প্রেমিক। আমি কৃষ্ণ, তুমি রাধা।’ সাবিত্রী মুচকি হেসে বলতো, ‘অথচ আমি সত্যবানের স্ত্রী। সাবিত্রী!’ এতে সাদি কথা ঘুরিয়ে নিজেকে সত্যবান দাবি করতো। এসব মনে আসায় এখন তার মুখ কুঁচকে আসছে। ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়তে পড়তে সে ঘরে চলে গেল। সকালের শুরুটা তার ভালো মনে হলো না। সাবিত্রীকে মনে পড়লেই তার গালি চলে আসে, কিন্তু গালি দেয়া নাজায়েজ হওয়ায় বারবার সে বলে, ‘বেয়াদব সাবিত্রী, বেয়াদব…’

কিন্তু তার জন্য ভালো অপেক্ষা করছিল। ফোন হাতে নেয়ার সাথে সাথে গুলবাহারের ম্যাসেজ পেয়ে সে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করলো। ‘অসহ্য’ বলে উঠে সে ম্যাসেজের উত্তর জানালো, ‘আপনি দয়া করে ম্যাসেজ করবেন না। এখানেও ব্লক দেব আপনাকে।’

কিন্তু ম্যাসেজটা সে মুছে কিছুক্ষণ চিন্তায় মগ্ন থাকলো। তারপর সে ম্যাসেজ না পাঠিয়ে সোজা চলে গেল ব্লক অপশনে। একবারে ব্লক করে দিলেই ঝামেলা চুকে যাবে। কিন্তু হঠাৎ উপরে আরেকটি বার্তার খবর আসায় তার হৃদপিন্ড থমকে গেল।

সাদি ম্যাসেজ সিন করে রেখে দেয়ায় গুলবাহার দ্রুত লিখে পাঠিয়েছে, ‘আপনার মায়ের সাথে আমি যোগাযোগ করেছি। তিনি আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন।’

সাদি হাত চালিয়ে লিখলো, ‘কীভাবে? কোথায়? আপনার সাথে কীভাবে কথা হলো?’

সাদির উত্তর দেখেই বাহার তার মনের অবস্থা বুঝতে পারলো, ‘এতকিছু লিখতে পারবো না। শুধু দেখা করতে চাইলে বিকেলে গুলশান আড়ং এ চলে আসবেন।’

– এভাবে বললেই হলো? আপনার ষড়যন্ত্র কিনা…
– দেখুন, আপনি আসলে আপনারই ভালো। আমি আন্টিকে কথা দিয়েছি, তাই আপনাকে একটু জোর করেছি।
– আমি আসবো কিনা বলতে পারছি না।
– আমি আর আন্টি যাবো ইন শা আল্লাহ। আপনি এলে আমাকে ম্যাসেজ করবেন।

সাদি আর কিছু লিখতে পারলো না, এর পৃষ্ঠে কিছু বলার নেই। কথা যত সংক্ষিপ্ত হবে ততই ভালো। তবে বাহারকে নিয়ে অন্য ঝামেলায় পরে গেল সে। এখন পর্যন্ত নারীদের সাথে বেশ দূরত্ব মেনে চলেছে সে। এই একজন নারী তাকে বারবার টলিয়ে দেয়। সে একজন পুরুষ মানুষ, শয়তানের ওয়াসওয়াসা তাকে সর্বদা ঘায়েল করতে চেষ্টারত। সে নিজের ইচ্ছে ও শক্তি দমন করে আল্লাহর হিফাজতে চলছে, কতদিন এভাবে চলে যাবে জানা নেই। সে যা পরিকল্পনা করেছে তাতে কাউকে বিয়ে করলে ঝামেলা আরো বাড়বে।

সাদির ঘুম এলো না। ভোর থেকে সকাল, পুরোটা সময় তার অস্থিরতায় কাটলো।

_________

বাহার বাকিটা সময় ঘুমিয়ে নিলো। সিয়ামের আগে তাকে জাগতে হবে। এখন না ঘুমালে পরে ঘুম ধরবে, এ বাড়ি থেকে বের হতেও সমস্যা হবে। কিন্তু বাহারের পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছুই হলো না। ঘুম ভাঙলো তার সিয়ামের ডাকে, ‘বাহারজান, তুমি এখানে কেন? ঘরে গিয়ে ঘুমাও।’

বাহার ভুলেই গিয়েছিল সিয়ামের সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে যাওয়ার অভ্যাস আছে। সকাল আটটায় উঠে সে ব্যায়াম করে। সিয়ামের শরীর থেকে ঘামের গন্ধ আসছে। বাহার উঠে বসে বললো, ‘আর ঘুমাবো না।’

– কিন্তু তুমি এখানে কেন ছিলে? আমার উপর এখনো রাগ করে আছো?
– আরে না, ফজরের সময় সালাত পড়ে এখানে এসেছিলাম। ভালো লাগছিল তাই এখানে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছি। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।

বাহার ঝটপট মুখ ধুয়ে মাথায় ওড়না জড়িয়ে নীচে চলে গেল। কত পুরুষের আনাগোনা চলছে এখানে! বাহারের নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। এখানে যদি ফুপির মতো কেউ থাকতো তাহলে ভালো লাগতো তার। একজন মহিলাকে দেখেছিল চকচকে কারুকাজ করা আবায়া আর নিকাব পরতে। কিন্তু সেই মহিলার মেয়েটা হাতা কাটা ব্লাউজ দিয়ে পাতলা শাড়ি পরে ছিল। ওটা দেখেই বাহার বুঝে নিয়েছে দ্বীন বলতে তারা কি বুঝেন। যুবক সময়ে প্রদর্শন করে চলো, বুড়ো বয়সে পর্দা করো – এই পন্থায় বিশ্বাসী কিছু মানুষকে দেখলেই বোঝা যায়। তবে সুধারণা রাখা উচিত বলে বাহার সেই মহিলাকে বলেছিল, ‘মা শা আল্লাহ, আপনাকে অনেক ভালো লাগছে দেখে।’

উনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘ভালো লাগছে? আমি আজ লাল আবায়া পরতে চেয়েছিলাম। তোমার আংকেল বললো গোল্ডেন কালারে আমাকে মানায় বেশি। আবার আমার মেয়েটাও গোল্ডেন শাড়ি পরেছে, দেখেছো আমার মেয়েকে? দাঁড়াও ডেকে আনি।’

এরপর তিনি মেয়েটাকে ডেকে এনে বললেন, ‘এইযে আমার মেয়ে। ও এবার মিস বিডিতে দশের মধ্যে আছে। দুআ করো ওর জন্য।’

বাহার বিব্রত ভঙ্গিতে হেসে, ‘ও আচ্ছা’ বলে কেটে পড়েছিল। মিস বিডি! আবার দুআ!

এখনো আশেপাশে অভিজাত চলনভঙ্গি দেখে বাহার কুণ্ঠিত বোধ করছে। গায়ের ওড়না আরো ভালো করে জড়িয়ে সে রান্নাঘরে যেতে চাইলে বাধা পেলো। নতুন বউ হওয়ার এই এক জ্বালা। সকালে উঠে ক্ষুধা নিবারণ করবে সেই সুযোগ নেই। এক ঝাঁক মহিলা এসে ঘিরে ধরবে, বউয়ের লজ্জিত মুখখানি দেখবে। তারপর কত কি উপমা জড়িয়ে কথা বলবে যা শুনে বউয়ের কান লাল হয়ে উঠবে সুখী লজ্জায়। বাহারও এই দলের একজন ছিল। নতুন ভাবি পেলে সে কোনো মন্তব্য যা করলেও এই দলের মহিলাদের সাথে দাঁড়িয়ে ভাবীর লজ্জিত মুখ দেখতো। তখন ভালোই লাগতো। কিন্তু আজ নিজে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকায় বেশ অনুভব করতে পারছে যে এটা কতখানি বিব্রতকর!

‘কই মা? দেখি দেখি তোমার সুন্দর মুখটা। চোরের মতো চলে যাচ্ছ আমাদের না দেখার ভান করে, নিশ্চয়ই কিছু লুকানোর চেষ্টা করছো!’ এই বলে সিয়ামের ছোট খালা এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন বাহারকে। বাহার মুচকি হেসে মনে মনে বললো, ‘আগে নাস্তা খেতে দিন। তারপর আমি এ বাড়ি ছেড়ে একবার বের হবো, আর আসবো না।’ কিন্তু তাকে মুখে বলতে হলো, ‘আমার ক্ষুধা লেগেছে তো, তাই সরাসরি রান্নাঘরে যাচ্ছিলাম।’

কম বয়সী এক মেয়ে বলে উঠলো, ‘ওমা! ভাবি কি খাদক গোছের নাকি? ভাবি মাইন্ড করবেন না। আমি একটু এমন করেই কথা বলি।’

সবাই প্রশ্রয়ের সুরে মেয়েটার বাহুতে হালকা আঘাত করলো এ ধরণের কথা বলায়। বাহার বুঝেছে এটা একটা ঢং। তারা মেয়েটার এসব কথায় মজা পান, কিন্তু মানুষের সামনে বোঝান এগুলো ঠিক নয়। এ ধরণের অদ্ভুত অভিনয় বাহারের রাগ আরো বাড়িয়ে দিলো। হাফসা এসে বাহারকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমরাই এখনো খাইনি। এখন সাড়ে আটটা বাজে। বিয়ে বাড়ি বলে একটু দেরি হলো। চলো ডাইনিং টেবিলে বসি।’

বাহারের খাওয়ার ঘরে যাওয়া হলো না। সবাই মিলে তাকে ঘিরে ধরেছে। এসব বাহারের অত্যন্ত বিরক্ত লাগছে কিন্তু কিছুই করার নেই। একবার মনে হলো মুখ না ধুয়ে এখানে আসা উচিত ছিল। তাহলে আর কেউ কথা বলার সাহস করতো না। এখন এসব সহ্য করতে হবে। খেয়েই সে সিয়ামকে বলে বেরিয়ে যাবে। তারপর বাসায় গিয়ে কাউকে কিছু না বলে শুধুমাত্র ফুপির সহায়তায় অন্য পরিকল্পনা করবে। কারণ সে একদম নিশ্চিত, বসার লোকজন সিয়ামের অবিশ্বাসী মনোভাবের পৃষ্ঠে তালাক দেয়াটা একেবারেই মেনে নিবে না।

বাহার নাস্তা খেলো অপরিচিত কতগুলো লোকের সাথে। সবচেয়ে কষ্টের বিষয়, শাড়ির সাথে ওড়না মাথায় দেয়ায় হাফসা তা কেড়ে নিয়ে বলেছেন, ‘ওড়নার প্রয়োজন নেই। আমরা আদিম যুগের শশুর শাশুড়ি নই যে তুমি মাথায় ঘোমটা না দিলে তোমাকে বকা দেয়া হবে।’ হাফসার কথার ধরণ ছিল মিষ্টি, কিন্তু তা বিষের মতো লেগেছে বাহারের। শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে দ্রুত নাস্তা খাওয়া সেরে সে ঘরে গেল। সিয়াম তখন গোসল করে বেরিয়েছে। ব্যায়াম করার পর সে গোসল করে, তা নাহলে ঘামে মাখা তৈলাক্ত শরীরে তার অস্বস্তি শুরু হয়।

সিয়ামকে দেখে বাহার বললো, ‘সিয়াম, আমি এখন একটু বের হবো।’

অবাক হলো সিয়াম, ‘কোথায় যাবে?’

– বাসায়।
– কেন?
– রাগ করো না, আমি আমার বাবাকে দেখেই চলে আসবো।

মিথ্যে বলার জন্য মনে মনে তওবা করলো বাহার। এখানে তার কিছুই করার নেই। সত্য বললে সিয়াম আটকে রাখবে, জোর করবে। তখন তাকে যিনার সংসার করতে হবে যা সে জীবন থাকতে কোনোদিন মানতে পারবে না। সিয়াম তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বললো, ‘আমি গাড়ি বের করছি তুমি নীচে এসো।’

বাহার দ্বিমত করলো না, ‘ঠিকাছে।’

সিয়াম নাস্তা খেয়ে গাড়ি বের করলো। বাহার ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে আছে। মেহেদী রাঙা হাত দুটো দেখে সে আনমনে হেসে উঠলো। এই মেহেদী কত রঙিন, যতটা তার জীবনে মলিনতা রয়েছে। সিয়ামকে গম্ভীর দেখা যাচ্ছে। বাহারের বাড়ি পৌছেই সিয়াম বললো, ‘আমি যাবো না। তোমার কথা শেষ হলে ফোন করবে, আমি চলে আসবো।’

বাহার কিছু না বলে গাড়ি থেকে নামলো। সে নিজেও চায়নি সিয়াম এখানে আসুক। সিয়াম আবার ডেকে বললো, ‘শোনো বাহার, একটা কথা বলে রাখি। তোমার মন খারাপ বলে আমি সবার কড়া দৃষ্টি উপেক্ষা করে তোমাকে নিয়ে এখানে এসেছি। আমার এই স্যাক্রিফাইসের দাম তুমি রেখো। নাহলে পরবর্তীতে তোমার জন্য কিছু করতে আমাকে ভাবতে হবে।’

বাহার মনে মনে বেশ কিছু বললো যে শুনলে সিয়াম হয়তো তাকে থাপ্পড় মেরে বসতো। বাহার উপর নিচ মাথা দুলিয়ে বললো, ‘অবশ্যই সিয়াম। যথাযথ দাম দেয়া হবে।’

– কোথায়? এখনো দাওনি কিন্তু?

সিয়াম কি বলেছে তা বুঝতে বাকি নেই। বাহার এতোটাও বোকা নয়, সে মুচকি হেসে বললো, ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেয়ার ইচ্ছে নেই। তোমার বাড়ি গিয়ে দেখা যাবে।’

– আমার বাড়ি, তোমারও বাড়ি।

বাহার মুচকি হাসি দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। ফুপির সাথে পরামর্শ করা খুব জরুরি।

__________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)
‘ধূম্রজাল’
ঊনবিংশ পর্ব

তাবিনা মাহনূর

__________

– আস্তাগফিরুল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! কি কথা বলছিস মা? আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছে…

সালমা ফুপিকে বাহার সিয়ামের মনোভাব বলতেই তিনি চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাহার তাকে জড়িয়ে ধরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো, ‘ঘাবড়ে যেও না ফুপি। আমাদের বিয়ে সহীহ হয়নি, বলতে গেলে বিয়েই হয়নি। তাই তালাকের ঝামেলা নেই। আমি আজ আমার বান্ধবী রিজিয়াকে ফোন করবো। সিয়ামের সাথে সম্পর্ক রাখবো না।’

– এতো সহজে মেনে নিবে সিয়াম?
– মেনে নিতে বাধ্য সে। যদি আমার পরিবার সাহায্য করে তাহলে এটা সহজ হয়ে যাবে। আর যদি তারাও আমার বিরুদ্ধে থাকে তাহলে আমি অনেক দূরে চলে যাবো। যেখানে আমাকে কেউ খুঁজে পাবে না। ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী আমি কোনো ভুল করছি না। সুতরাং আমার কোনো ভয় নেই ফুপি। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো। এখন আমাকে একটা সমাধান দাও। এ বাসায় থাকলে সিয়াম আমাকে নিতে আসবে। আমি আজ কোথায় গিয়ে থাকবো?

সালমা দিশেহারা বোধ করছেন। জটিল এই পরিস্থিতিতে তিনি কোনো কূল খুঁজে পাচ্ছেন না। এদিক ওদিক তাকিয়ে তিনি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বললেন, ‘আমি কিছুই জানি না। আমার ভালো লাগছে না। আমার মেয়েটার সাথে এ কি হলো আল্লাহ!’

ফুপিকে জড়িয়ে ধরলো বাহার, ‘এমন করে বলো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনি আমার জন্য কল্যাণ রেখেছেন বলেই এটা হয়েছে। আমি ঐ বাড়িতে পর্দা করতে পারতাম না ফুপি। যতটা সহজ ভেবেছিলাম, আদৌ তা সহজ নয়। চাইলেই মডারেট পরিবারকে বদলে দেয় যায় না। পর্দার পরিবেশ পাওয়া যায় না।’

আল্লাহ যা রেখেছেন, তা নিশ্চয়ই কল্যাণের। এ কথা ভেবেই সালমা শান্ত হলেন। তিনি সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘এক কাজ কর তুই। আমার খালাতো বোনের বাসায় গিয়ে থাক।’

– তোমার খালাতো বোন মানে বাবারও বোন। তাহলে বাবা তো জেনেই যাবে আমি কোথায় যাচ্ছি।
– ঠিকাছে, তাহলে আমার ছোট বেলার বান্ধবীর কাছে যা? সে আবার নরসিংদী থাকে। ওর বাড়িও খুব পাকা নয়। তুই থাকতে পারবি?
– অবশ্যই পারবো। আমার এখন একটা থাকার জায়গা হলেই হবে।
– যখন নরসিংদী সদরে থাকতাম তখন রাবেয়া আর আমি একসাথে স্কুলে যাতায়াত করতাম। রাবেয়ার পাঁচ সন্তান, অর্থের অভাবে কেউই খুব শিক্ষিত হতে পারেনি। কিন্তু সচ্ছল পরিবার। তুই গেলে তোকে খুব আদর করবে দেখিস। আর পর্দার ব্যবস্থা আছে ভালো। আল্লাহ আমাকে ওর উসিলায় হিদায়াহ দিয়েছিলেন। এতো অল্প টাকার মধ্যেও রাবেয়া আর ওর স্বামী হজ করে এসেছে।

বাহারের বুক থেকে অনেকখানি ভার নেমে এলো। আজই সে গুলশান আড়ং এ কাজটা সেরে এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে চলে যাবে। ‘এগারো সিন্ধুর গোধূলি’ ট্রেন ছয়টা চল্লিশে ছাড়বে কমলাপুর থেকে। নরসিংদী পৌঁছাতে দেরি হবে না। রাবেয়া আন্টির নাম্বার নিয়ে সে অনলাইনে টিকিট বুকিং দিয়ে রাখলো। এরই মাঝে হানজালা আর নাজ এলো সালাদ আর লেমন মিন্ট জুস হাতে।

– এসেই ফুপির কোলে চড়ে আছিস, মায়ের কথা মনে পড়েনি ওখানে?

মায়ের কাছে এক লাফে পৌঁছে বাহার জড়িয়ে ধরলো হানজালাকে। নাজও পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘অনেক মিস করেছি তোমাকে। তুমি আজকে থেকে যাও এখানে।’

বাহার আর হানজালা হেসে ফেললেন। সাখাওয়াত গিয়েছেন বাজারে। দুপুরের খাবার এখানেই খাবে বাহার, সিয়ামকে ফোন করে বিকেল চারটায় আসতে বলেছে সে। কারণ তার আগেই সে এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। যদি মা বাবার অভিব্যক্তি অনুকূলে হয় তবে সে ফিরে আসবে। আর যদি প্রতিকূল হয় তাহলে ডিভোর্স পেপার হাতে না আসা পর্যন্ত সে কাউকে নিজের খোঁজ দিবে না। সিয়াম যেমন বেপরোয়া ছেলে তাতে বাহারের পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া উপায় নেই।

চার জন মিলে বেশ আড্ডা জমিয়ে তুলেছে। কথার এক ফাঁকে নীরবতা দেখা দিলে বাহার প্রসঙ্গ টেনে আনলো, ‘মা জানো? সিয়াম নাস্তি-ক।’

চমকে উঠলেন হানজালা, ‘কি বলছিস এসব!’

– হুম, কালকে রাতে ও আমাকে বলেছে ও ধর্ম বিশ্বাস করে না। কোনো ধর্মই না।

হানজালা চিন্তিত মুখে বললেন, ‘ওর মা বাবা হজ করে এসেছেন, আবার ওদের উমরা হজের ছবি দেখেছি আমি।’

– মা, ওরা এগুলো কালচার মনে করে। সিয়াম উমরা করেছে যেমন, তেমনই ভুটান বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়েছে। পাকিস্তানের এক মাজারে একটা পুকুরে সবাই কয়েন ফেলে, সেও ফেলে এসেছে ভাগ্য পরিবর্তন হওয়ার নাম করে। যদিও এসবে সে বিশ্বাস করে না কিন্তু এগুলো তার কাছে নতুন কিছুর অভিজ্ঞতা বলে মনে হয়।
– তোকে নামাজ পড়তে দেয়?
– হ্যাঁ, এটা সে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা মনে করে।

হানজালা চিন্তা থেকে বেরিয়ে এলেন, ‘তাহলে সমস্যা কি? তুই নামাজি বানিয়ে নিস, তাহলেই হবে।’

সালমা আর বাহার দুজনেই হতবাক। হানজালা কি জানেন না এই বিয়ে যে হয়নি? বাহার বললো, ‘মা, আমাদের বিয়েটা কিন্তু শুদ্ধ হয়নি। ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী বিয়েটা হয়নি।’

হানজালা ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘যাহ! কবুল বলে বিয়ে হয়েছে তোদের। বিয়ে শুদ্ধ হবে না কেন?’

– মা, তুমি যদি সিয়ামের হাতে সিঁদুরের কৌটা দিয়ে বলো আমার সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে বিয়ে করতে, তাহলে সে সেটাই করবে। কারণ তার ধারণা এই কবুলের নিয়ম বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী পালন করে তাই সেও করছে। এতে তার কোনো সমস্যা নেই, কারণ এটা ট্রেডিশন!
– আস্তাগফিরুল্লাহ! সিঁদুর দিতে যাবে কেন?
– কারণ এটাও একটা ট্রেডিশন তার কাছে। বিদেশ গেলে সে হয়তো বলতো, ‘আই ডু, আই ডু!’ খ্রিস্টান রীতি অনুযায়ী। বৌদ্ধদের রীতি আমার জানা নেই, নাহলে সে সেটাও করতে পারতো। মোট কথা, তার মাঝে ধর্মীয় বিশ্বাসটাই নেই। তাহলে কীভাবে বিয়ে শুদ্ধ হয়?

হানজালা বললেন, ‘তাহলে কি আবার বিয়ে করবি তোরা? ওকে মুসলিম বানিয়ে আবার কবুল পড়ে বিয়ে করে নে।’

বাহার হতাশ হয়ে যাচ্ছে। ধৈর্য ধরে সে বললো, ‘মা, এতো সহজে সিয়ামকে বিশ্বাস করানো যাবে বলো? আমি গিয়ে যদি বলি তুমি ইসলামী বিশ্বাসে বিশ্বাস স্থাপন করো, তাহলে দুটোর মধ্যে যেকোনো একটা প্রতিক্রিয়া পেতে পারি। প্রথমত, সে হয়তো নিজেই আমাকে তালাক দিয়ে দিবে। কারণ তার স্বাধীনতায় আমি হস্তক্ষেপ করছি। দ্বিতীয়ত, সে তালাক দিতে না চাইলে মুসলিম হওয়ার অভিনয় করবে, অর্থাৎ মুনাফিক হবে। কারণ সে আমাকে ভালোবাসে বলেই জানি।’

হানজালা সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই কি বলতে চাইছিস?’

– আমি ভাবছি সিয়ামকে তালাক দিয়ে দিব।

হানজালা আঁতকে উঠলেন, ‘ইন্না লিল্লাহ! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? বিয়ের একদিন মাত্র হলো, আর তুই ডিভোর্সের কথা চিন্তা করছিস?’

এই আলাপে একমাত্র নাজই অবুঝের মতো বসে আছে। সালমা চুপ করে থাকলেও তিনি এর মাঝে ঢুকবেন না। কিন্তু তিনি যেই ভয়ে কথা বলতে চাইছিলেন না, সেই কাজটাই হলো। হানজালা বাহারকে কিছু বলতে না দিয়ে সালমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনিই কি ডিভোর্সের কথা বলেছেন বাহারকে?’

সালমা বিস্মিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। বাহার দ্রুত বলে উঠলো, ‘মা, এভাবে বলছো কেন ফুপিকে? ফুপি আমাকে কিছুই বলেনি। আমি নিজে থেকেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি।’

– কিন্তু তোর ধর্মীয় জ্ঞান কবে থেকে এলো? যেখানে আমিই জানতাম না তোদের বিয়ে শুদ্ধ হয়নি সেখানে তুই কীভাবে জানলি যদি তোর ফুপি না জানায়?
– এটা কমনসেন্স মা। একটা বৌদ্ধ ছেলেকে বিয়ে করে আনলে তোমরাই বলতে, দূর হ তুই এখান থেকে। আর নাস্তি-ক ছেলের সাথে কীভাবে জায়েজ হয় বলো?

হানজালা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি কিছুই জানি না। তুই সিয়ামকে বদলানোর চেষ্টা করবি। ও তোকে অনেক ভালোবাসে, তোর জন্য ছেলেটা পরিবর্তন হতেও রাজি আছে।’

মৃদু আর্তনাদ করে বলে উঠলো বাহার, ‘কিন্তু মা, যতদিন না ও পরিবর্তন হবে ততদিন ও আমার জন্য হারাম হয়েই থাকবে। তখন আমি কীভাবে ওর থেকে দূরে থাকবো?’

হানজালা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। যেতে যেতে তিনি বললেন, ‘আমি আর একটা কথাও শুনবো না। সিয়াম এলে বলবো তোকে নিয়ে যেতে। বৌভাতেও এই বাসায় আসার দরকার নেই।’

হানজালা চলে গেলেন। বাহারের চোখ ভরে উঠছে। কাঁদলে তার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাবে বলে সে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছলো। নাজ তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তোমার যা ইচ্ছে করে তাই করো আপু। জোর করে সংসার হয় না।’

বাহার মুচকি হেসে নাজের গালে হাত রেখে বললো, ‘ভালো কথা বলেছিস। এখন একটু যা তো বোন, আমি ফুপির সাথে কথা বলবো। আমিই আসবো তোর ঘরে।’

__________

দুপুরের খাওয়া শেষে বিশ্রাম নিলো বাহার। আজ বেশ পরিশ্রম করতে হবে তাকে। গাড়িও থাকবে না, এখান থেকে তাকে আড়ং যেতে হবে। বি-প্যালেস গুলশানে হওয়ায় গুলশান আড়ং যেতে রাধিকার কোনো অজুহাত দিতে হবে না। তবে সাদির জন্য কষ্ট হয়ে যাবে। সে থাকে আজিমপুর এলাকায়।

দুপুর সাড়ে তিনটা বাজছে। বাহার একটা ব্যাগে প্রয়োজনীয় জামা কাপড়, জমানো টাকা আর কিছু গয়না নিয়ে নিলো। যেন বিপদে পড়লে গয়না বেচে খেতে পারে। আর কাঁধের ব্যাগে একটা বোরখা ঢুকিয়ে নিলো। এখান থেকে বের হয়েই সে বোরখা নিকাব পরবে। ফুপির বোরখাটা লম্বায় একটু ছোট হচ্ছে, কিন্তু আপাতত এটাই তার সম্বল। বাইরে গিয়ে কেনার মতো পরিস্থিতি নেই। রাবেয়া আন্টির বাসায় পৌঁছে অনলাইনে বোরখা কিনে নিলেই হবে। অথবা সদরে গিয়ে মার্কেট থেকে বোরখা কেনা যাবে। এখন এটাই তার জন্য অন্ধের যষ্ঠি।

হানজালা আর সাখাওয়াত দরজা ভিড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলাপে মগ্ন আছেন। বাহার জানে এই আলোচনা কি নিয়ে চলছে। তার ডিভোর্সের সিদ্ধান্তের কথা হয়তো ইতিমধ্যে বাবার কানেও পৌঁছে গিয়েছে। বাবার অভিব্যক্তি জানা হলো না বাহারের। সময় নেই। জলদি বেরিয়ে পরতে হবে। তা নাহলে সিয়াম এসে গেলে সব শেষ!

ফুপির অশ্রু মাখা গালে হাত বুলিয়ে সে বিদায় নিলো। সালমা বাহারের কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ‘সাবধানে যা মা। কোনো সমস্যা হলে ফোন দিবি। কখনো একা ট্রেন ভ্রমণ করিসনি। আজ যাচ্ছিস, খুব ভয় হচ্ছে আমার।’

বাহার আশ্বাস দিয়ে বলেছে, ‘ভয় পেও না। আল্লাহ আছেন, তিঁনিই আমাকে হিফাজত করবেন। তুমি দুআ করতে থাকো। আর আমি বিশ্বাস করি, ভরসা করি তোমাকে যে আমার ঠিকানা তুমি কাউকে বলবে না ফুপি।’

বাহার বেরিয়ে একটা রিকশা নিয়ে নিলো। এখান থেকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত গিয়ে আবার বাসে উঠবে সে। বাসে উঠে বমি এলেও তার কিছু করার নেই। এভাবেই আজকের দিনটা তাকে পার করতে হবে।

কষ্ট শেষে আড়ং পৌঁছে গেল বাহার। তার বোরখার কারণে তাকে অনেকেই কেমন বাঁকা চোখে দেখছে। বাহারের কেন যেন ভালো লাগছে। মন বলছে, এটাই তো চেয়েছিলাম!
আড়ং এ প্রবেশ করে বাহার জামা কাপড় দেখার ভান করে হাঁটতে থাকলো। রাধিকা ব্যানার্জিকে সে চেনে না। টিভি দেখা হয় না, নিউজপেপার পড়া হলেও কখনো তার ছবি দেখেনি বাহার। তাই রাধিকাকে না পেয়ে সাদিকে খুঁজতে শুরু করলো সে। রাধিকা নিশ্চয়ই এখনো আসেননি। নাহলে তিনিই ফোন করতেন।

জিনিসপত্র দেখতে দেখতে হঠাৎ বাহারের মনে হলো, যেই বাড়িতে সে যাচ্ছে সেখানে কোনো উপহার নেয়া উচিত। রাবেয়া আন্টির ছোট মেয়েটার একটা ছেলে হয়েছে এক সপ্তাহ হলো। সেই ছেলেটার জন্য তিনটা নিমা জাতীয় আরামের পোশাক কিনলো বাহার। রাবেয়া আন্টির জন্য থ্রি পিসের কাপড় আর দুই ভাবীর জন্য দুটো আয়না। আরো কিছু কেনার ইচ্ছে থাকলেও টাকার স্বল্পতা চলে আসবে বলে কেনা হলো না।

পছন্দের জিনিসগুলো নিয়ে সে কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়ালো। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বেশ লম্বা, মাথায় বেসবল ক্যাপ। মুখে কালো মাস্ক আর পরনে জিন্সের জ্যাকেট। আড়ং এর ভেতরে খুব শীত নেই, তবু লোকটা নিজেকে এমনভাবে আবৃত করে রেখেছে যেন সে মানালিতে আছে। বাহার এই লোকটার জন্য সামনের কিছু দেখতে পাচ্ছে না। বিপত্তি বাঁধালেন পেছনের মহিলা। তিনি এসেই এমনভাবে ধাক্কা দিলেন যে বাহার হুড়মুড় করে লোকটার উপর পড়ে গেল। জ্যাকেট খামচে না ধরলে মান সম্মান চলে যেত।

মূলত মহিলার দোষ নেই। তার পিছে থাকা লোক, এরও পিছে আরেকজন লোক অনেকক্ষণ ধরে সামনে আগানোর কল্পিত চেষ্টায় বারবার ঠেলছেন। ভুঁড়িতে-পিঠে ঘর্ষণে এমন ধাক্কাধাক্কির উৎপাত। লাইনে দাঁড়ালে এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতেই হয়। কিন্তু সকালে থেকেই বাহারের মেজাজ গরম থাকায় এবার সে রেগে গেল। কর্কশ স্বরে ক্যাশ কাউন্টারে থাকা লোকটাকে সে বললো, ‘মেয়েদের আলাদা লাইন কেন নেই? এভাবে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা যায়?’

এতেই কিছু ছেলে যেন প্রশ্রয় পেয়ে বসলো, ‘কি হয়েছে আপু? কেউ অ্যাবিউজ করেনি তো? বলেন আপু, ভয় পাবেন না। প্রতিবাদ করবেন।’ আরেকজনের কথা, ‘মেয়েদের আলাদা লাইন রাখতে হবে কেন। এত সমান অধিকারের যুগ। ছেলেরা বিরক্ত করলে মেইন পয়েন্টে কষিয়ে লাথি দিবেন।’
বাহারের মুখ লাল হয়ে এসেছে। আরো বিপদ হলো যখন একটা ছেলে এগিয়ে এসে বললো, ‘আপনার পেছনে তো মহিলা দাঁড়িয়ে। সামনে পুরুষ। ইনি কিছু করলে বলুন আপু। আমরা হ্যান্ডেল করবো ব্যাপারটা।’

বাহার বলে উঠলো, ‘আরে না না, উনি কিছুই করেননি।’

ছেলেটা নাছোড়বান্দা, ‘না আপু, আপনি বলেন। ভয় পাবেন না।’

সামনে দাঁড়ানো লোকটা পেছন ফিরলো। বাহার ভ্রু কুঁচকে ছেলেটাকে বললো, ‘দরকার নেই। উনি কিছুই করেননি।’ এই বলে সামনে ফিরতেই থমকে গেল সে। সাদি হাসরাত ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন মনে মনে অনেক অভিশাপ দিচ্ছে লোকটা। বাহার বলে উঠলো, ‘উনি আমার চেনা মানুষ। আপনাদের কিছু করতে হবে না।’

সাদি এক পলক তাকিয়ে আবার সামনে ফিরে গেল। তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে এই চিপা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে। সামনেও দাঁড়ানো এক নারী। নারী না পুরুষ বোঝার উপায় নেই। কারণ সাদিকে দেখার পর থেকে মেয়েটা বারবার কিছু ছ্যাঁচড়া পুরুষদের মতো পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। মেয়েটার চুলগুলো বাবরি কাট দেয়া। সাদি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। বেরিয়ে চলে যেতে নিলে বাহার বললো, ‘শুনুন, আমার হাতে দিন জিনিসগুলো। আমি ক্যাশের ঝামেলা মিটিয়ে দিচ্ছি।’

সাদি বুঝতে পারছে না মেয়েটা কে। তাকে বিস্মিত করে বাহার বললো, ‘ভয় পাবেন না। আমি গুলবাহার।’

সাদি তবু তাকে কিছুই না দিয়ে চলে গেল। বাহার অবশ্য হতাশ হলো না। সাদিকে সে চেনে। সাদি অল্প কথায় মানুষ, মেয়ে দেখলে এলার্জি রোগীর মতো লুকিয়ে পরে। বাহার তাই তার আচরণে মন খারাপ করে না। বরং তার এখন আফসোস হচ্ছে, সিয়াম যদি এমন হতো!

ক্যাশের ঝামেলা মিটিয়ে বাহার দেখলো সাদি লাইনের পেছন দিকে দাঁড়িয়ে। এবার তার সামনে পেছনে পুরুষ দাঁড়ানো। বাহার অবাক হলো না। সাদি তো এমনই। তবে বাহারের চিন্তা অন্যখানে। রাধিকা আন্টি এখনো ফোন করেননি। রণজিৎ এর কাছে ধরা পড়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সাদি ভাববে তাকে বাহার প্যাঁচে ফেলেছে, আবেগের স্থানে আঘাত করে তাকে এখানে ডেকেছে কোনো উদ্দেশ্যে। বাহারের চিন্তা কমিয়ে ফোন বেজে উঠলো। আবারো অচেনা নম্বর। বাহার ফোন ধরলে ওপাশ থেকে রাধিকা বললেন, ‘হ্যালো!’

– জি আন্টি, আমি বাহার।
– আমি আড়ং পৌঁছে গিয়েছি। এটা আমার ড্রাইভারের নাম্বার। তুমি কিন্তু ফোন করো না একবারও।
– জি আন্টি। তবে আপনি কেমন জামা পরে আছেন সেটা বললে ভালো হতো। আপনাকে কখনো দেখিনি তো তাই দেখলে চিনতে পারবো না।
– আমি ধূসর রঙের শাড়ি পরে আছি। আর একটা লাল রঙের সাল জড়িয়ে আছি যেটায় নকশি কাঁথার মতো নকশা আছে। ওটা দেখলেই বোঝা যাবে। আর আমি মাঝারি আকারের মানুষ।
– ঠিকাছে আন্টি, আমি কালো বোরখা পরেছি। বোরখাটা একটু ছোট।

কথা শেষ করে বাহার দরজার কাছে গেল। আড়ং এর দুই দিকে দুটো দরজা। একটি পার্কিং লট থেকে সোজা আড়ং এ ঢোকার জন্য, অন্যটি রাস্তা থেকে আড়ং প্রাঙ্গনে ঢুকে যারা, তাদের জন্য। বাহার ধারণা করলো রাধিকা নিশ্চয়ই পার্কিং লট থেকে আসবেন। তার ধারণা সঠিক হলো না। এই দরজাটা আজ বন্ধ। এর বাইরে কিছু কাজ চলছে। পুরোনো ওয়ালম্যাট বদলে নতুন লাগানো হচ্ছে। রাধিকা তাই ঘুরে এসে প্রথম দরজা দিয়ে ঢুকলেন।

বাহার যখন দেখলো দ্বিতীয় দরজাটা বন্ধ, সে প্রথম দরজার দিকে নজর রেখে সেদিকে হাঁটতে শুরু করলো। দুটো দরজা বিপরীত প্রান্তে হওয়ায় বেশ লম্বা দূরত্ব।

বাহার হাঁটছে। রাধিকা ঢুকলেন আড়ং এ। সানগ্লাস খুলে তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করলেন। বাহার দেখেই চিনে ফেলেছে। অভিজাত সাজে রাধিকা তাগা ব্র্যান্ডের জামা কাপড়ের দিকে যাচ্ছেন, বাহার গতি বাড়ালো। হঠাৎ দৌড়ে এসে কেউ রাধিকাকে জড়িয়ে ধরলো। রাধিকা পরেই যাচ্ছিলেন। তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন, তার নাক ফুলে উঠছে। এক্ষুনি অশ্রু ঝড়বে। বাহার দেখলো সেই দৃশ্য। মা সন্তান একে অপরকে জড়িয়ে যেন দীর্ঘদিন পর শ্বাস নিতে পেরেছে। বাহার স্বস্তির শ্বাস ফেললো। এবার তার ফিরে যাওয়ার পালা।

_________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here