ধূম্রজাল’ একবিংশ পর্ব

0
162

‘ধূম্রজাল’
একবিংশ পর্ব
তাবিনা মাহনূর

__________

কাননভিলার মতো বি প্যালেসে এখন হাহাকারের ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। রণজিৎ ব্যানার্জির চারিপাশে অন্ধকার হয়ে আসছে। মাত্র অল্প কিছু তথ্যের ভিত্তিতে পুরো দেশে তিনি এখন অসৎ লোকদের একজন। সরকারের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন এখন তার প্রতিটা ধাপের পেছনে কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছে। সাংবাদিকদের ভিড় তো লেগেই আছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, তার ব্যবসায় এখন লাল বাতি। মুহূর্তেই ধস নামতে শুরু করেছে। বি অ্যারোমা কোম্পানির মতো বিশাল এই ব্যবসা কেমন এক নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল, তা দেখেও রণজিৎ উপলব্ধি করলেন না সৃষ্টিজগতের একমাত্র অধিপতি চাইলে কী না পারেন!

রাধিকা বাড়ি পৌঁছেই নিজের ঘরে গেলেন। রণজিৎ আরামকেদারায় বসে চোখ বন্ধ করে আছেন। রাধিকার আগমনী সুর শুনে তিনি বললেন, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’

রাধিকার যান্ত্রিক জবাব, ‘আড়ং।’

– কেন?
– একটা ভ্যানিটি ব্যাগ, শাড়ি আর জুয়েলারি বক্সের দরকার ছিল।

উঠে দাঁড়ালেন রণজিৎ। ফুঁসে উঠলেন তিনি, ‘আড়ং থেকে দামি দামি জিনিস কিনে এনেছো। আর তোমার পেয়ারের ছেলে যে আমার সর্বনাশ করে বসে আছে, সেই খবর রেখেছো?’

এতো বছর ধরে একজন সফল ব্যবসায়ীর সাথে সংসার করছেন রাধিকা, তিনি টুকটাক খবর রাখেন না তা নয়। তিনিও জানেন সামনের দিনগুলো ভালো হবে না। তবু তিনি বললেন, ‘এতো রাগ করছো কেন? কি হয়েছে?’

রণজিৎ যেন কেঁদেই ফেলবেন, ‘দেউলিয়া হয়ে যাবো আমি। বিজনেস গ্রাফে রেড লাইন দিন দিন শুধু বাড়ছেই, বাড়ছেই। একদিন দেখবে এই বি প্যালেস বিক্রি করে দিতে হবে, তখন এইযে ষাট হাজার টাকার শাড়ি পরে বেরিয়েছিলে, এটাও সম্ভব হবে না। আড়ং থেকে কেনাকাটা করাও সম্ভব হবে না। নিউ মার্কেট থেকেই পারবে না কিনতে, তখন ফুটপাতের সস্তা কাপড় কিনে নিজে সেলাই করে সেটা পরতে হবে।’

রাধিকা অলংকার খুলতে খুলতে বললেন, ‘আমার সমস্যা নেই। আমি খুব বড় ঘরের মেয়ে ছিলাম না। মোটামুটি একটা সচ্ছল পরিবারের মেয়ে ছিলাম। ভালোবেসে বড়লোকের বউ বানিয়েছো ঠিকই, কিন্তু তাতে আমার পুরনো সত্তা পঁচে মরেনি। হয়তো কিছুদিন কষ্ট হবে, কিন্তু মানিয়ে নিতে পারবো।’

রণজিৎ বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘তুমি কি বলছো তুমি তা জানো? এটা কোনো সহজ কথা নয় রাধা।’

– আচ্ছা, তোমার তো শুধু বি অ্যারোমা নয়। আরো অনেক ব্যবসা আছে।
– কয়টা? আর তিনটা যা আছে, ওগুলোতেও ধস নামতে শুরু করেছে। ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার বিষয়টা ধরা পড়ে গিয়েছে। দুদক জরিমানা করলে এক ব্যবসা ওখানেই শেষ হয়ে যাবে। আর জুতার ব্যবসার কথা বলছো? চামড়ার ডিলাররা আমাকে চামড়া দেবে না বলেছে।
– কেন!
– কেন জানো না? তারা জানে, আমার কোম্পানির জুতা আর কেউ কিনবে না। তারা চামড়া দিলে বরং ধরা খেয়ে যাবে। দুদক তখন তাদের পিছে পড়লে তাদেরও কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাবে। তাই আমার থেকে যত দূরে থাকা সম্ভব ততই ভালো।

রাধিকা আর কিছু বললেন না। রণজিৎ নিজেই নিজেকে বলছেন, ‘আমার কিছু ভালো লাগছে না। এদিকে হিমাংশুকে লন্ডন থেকে আনার ব্যবস্থা শুরু হয়ে গিয়েছে। দেশের লোকজন তোহার মৃত্যুর ন্যায় বিচার চায়। স্টেরিও গা বাঁচাতে স্কটল্যান্ডে চলে গেল, আর এলো না। বাংলাদেশের লোকজন তাকে ধরলো না, বিদেশি কিনা! বিদেশি মাল ধরলে যদি বাংলাদেশের বদনাম শুরু হয়ে যায়। এখন দেখি স্টেরিই অভিনয় শুরু করে দিয়েছে। তার স্বামীকে মারার পেছনে আমার আর হিমের হাত শুধু। সে নাকি জানেই না কিছু! নোংরা মহিলা!’

রাধিকা বাথরুমে ঢুকে গেলেন। এসব শুনতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। রণজিৎ পাগল হয়ে যাচ্ছেন। মেয়ে সুনীতি আমেরিকায় গিয়ে বাবার এমন অবস্থার কথা শুনে সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। যেন তার যে রণজিৎ নামক বাবা আর রাধিকা নামক মা আছে, এটা সে ভুলে গিয়েছে। রাধিকা বোঝেন সব। ছেলেমেয়েরা আজকাল খুব স্বার্থপর। সুনীতি এর ব্যতিক্রম নয়। নিজেকে সে বাঙালি দাবি করতেই লজ্জা পায়। সে নাকি ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তার দাদা ভারতের কলকাতার চব্বিশ পরগনায় জন্মেছে, এটাই সে বোঝায়। বাংলাদেশি নয় সে, ভারতীয়। এবং এখন মার্কিন। আর হিমাংশু মাসে একবার ফোন করে। রাধিকার খুব মনে পড়লে তিনিই ফোন করেন। অল্প কথা বলে রেখে দেয় হিম। প্রিয়ংশু অর্থাৎ সাদি ছিল পরিবারপ্রেমী। এ কারণেই ছেলেটা সাবিত্রীর অন্যায় মেনে নিতে পারেনি, খুব আঘাত পেয়েছিল।

রাধিকা বেরিয়ে আসার পর রণজিৎকে দেখলেন অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে দু হাত মাথার পেছনে দিয়ে শুয়ে আছেন। তিনি স্বামীর পাশে বসে বললেন, ‘প্রিয় মিষ্টান্ন ভান্ডার, ওটার কি খবর?’

নিরাশার মাঝে এক টুকরো আশা খুঁজে পাওয়ার মতো চমকে উঠে বসলেন রণজিৎ, ‘ওটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম!’

– ভুলবেই তো, প্রিয়র নামে যে। কুমিল্লায় তিনটা বড় দোকান আছে আমাদের। কেউ তো জানে না ওটা আমাদের দোকান।
– হ্যাঁ, ওটা আমি স্বপন ঘোষের নামে চালাই, বলতে পারো ব্যাক আপ বিজনেস।
– এখন এটা নিজের নামে না করাই ভালো। স্বপন দাদার মতো ভরসাযোগ্য মানুষ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
– কিন্তু স্বপন আমার ব্যবসার ভার আগেই আমাকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল। ওর নাকি দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
– এখন বুঝে নাও। আর নামটা একই রাখো। উনি মারা না যাওয়া পর্যন্ত সবাই জানবে এটা উনার দোকান। এরপর যদি উনার সময় ফুরিয়ে আসে, আমরা অন্য ব্যবস্থা নিব তখন। আপাতত এই ব্যবসাটার হাল ধরো।

রণজিৎ ফোন হাতে বারান্দায় চলে গেলেন। এখনই সময় মিষ্টান্ন ভান্ডারের দোকানটা নতুন করে জেগে তোলার। কুমিল্লার রসমালাই যেমন বিখ্যাত, তাতে এই দোকান দিয়ে মধ্যবিত্তের মতো চলাচল করা যাবে। দেউলিয়া হয়ে পথে বসে থাকতে হবে না।

রাধিকা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কল্পনায় আগের স্মৃতি ভাসছে। কত সুন্দর দিন ছিল! অন্যায় কর্ম কখনোই শান্তি এনে দেয় না। একদিন ধরা পড়তেই হয়।

স্টেরি রোজারিও অণুজীব আর কাগজের কথা ভুলে এখন নিজের মান বাঁচাতে ব্যস্ত। অণুজীব আগেই মারা গিয়েছে। উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে অণুজীবের প্রাণনাশ হয়েছে, নতুন করে খুঁজতে হলে প্রত্যন্ত সেই অঞ্চলে যেতে হবে যা আপাতত সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক মহলে স্টেরি এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে এবার রণজিৎকে জড়াননি। রণজিৎ ইতিমধ্যে এমনভাবে ফেঁসে গেছেন যে তাকে জড়ালে স্টেরির নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে। রণজিৎ এর সবকিছু এখন শেষ। ছেলে হিমাংশুকেও সরকারি সহায়তায় দেশে এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

সাদি হাসরাতকে ছেড়ে দেননি স্টেরি। তিনি এখন চুপ করে আছেন। বর্তমানে কিছু করলেই বিপদে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। কেননা, তিনি যদি জনগণের নজরে একবার পরে যান তাহলে আন্তর্জাতিক মহলের লোকজন তাকে নিজেদের সংঘ থেকে বহিষ্কার করে দেবে এবং তিনি খুব ভালো করেই জানেন এই সংঘ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরিণতি কি। বেশিরভাগই মৃত্যুতে গিয়ে শেষ হয়। কঠিন মৃত্যু। তাই সাদি আর অণুজীব নিয়ে এখন আলোচনা না করাই শ্রেয় বলে মনে করছেন তিনি।

অর্থনৈতিক বাজারে বি অ্যারোমার অবস্থান ক্রমেই নিম্নতর হচ্ছে। রণজিৎ এর সকল পণ্য বয়কট করছে জনগণ। সাদি হাসরাতের পক্ষে একদল সংগঠন উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের একটাই কথা, সাদিকে ফাঁসানো হলে তারা আন্দোলনে নেমে পড়বে। তাই সাদি আল্লাহর রহমতে ভালো দিন কাটাচ্ছে। আর কিছু মাস পরেই সে এ দেশ ছেড়ে চলে যাবে, খুব শীঘ্রই।

__________

গুলবাহার ডিভোর্সের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সালমা ফুপির সাথে কথা হয়েছে তার। ফুপি সুনামগঞ্জ চলে গিয়েছে শুনে সে ফোন কানে রেখেই কেঁদে ফেলেছিল। কত আনন্দে কাটতো তাদের দিন, আর আজ কেমন অগোছালো সবকিছু। গুলনাজের জীবনেও বিশৃঙ্খলা নেমে এসেছে। তার দিন কাটে হারামে ডুবে। বাবার অতিরিক্ত আদর, মায়ের ভুল জায়গায় শাসন আর এখন অবহেলা, সব মিলিয়ে নাজ বেপরোয়া নারীদের মতো চলাচল করছে। এই বিষয়টা গুলবাহারকে আরো কষ্ট দিচ্ছে।

চৌদ্দ দিন রাবেয়ার বাড়িতে থাকার পর গুলবাহার কাল মেয়েদের হোস্টেলে উঠবে। এরই মাঝে তার বাবার সাথে কথা হয়েছে। বাবা সাখাওয়াত জানেন মেয়ে ভালো জায়গায় আছে। কিন্তু বাহারের অনুরোধে তিনি হানজালাকে কিছু জানাননি। বাহারের ইচ্ছে, মাকে কিছুদিন এভাবেই থাকতে দেয়া হোক। তিনি যেই অন্যায় বাহারের উপর চাপিয়ে দিচ্ছিলেন, তা বিবেচনা করলে এ শাস্তি খুবই কম হয়ে যায়। বাহার এই কয়দিন রাবেয়ার বাড়িতে থেকেছে, কখনো নিজেকে পর মনে হয়নি। কিন্তু সে হোস্টেলের খোঁজ করছিল বহুদিন ধরে। এভাবে একটা বাড়িতে মাস পার করে দেয়া তার কাছে অস্বস্তিকর বটে। বাড়ির লোকজনের ব্যবহার দেখে বোঝা যায় না তারা আসলে বাহারের একভাবে থেকে যাওয়াটা কেমন চোখে দেখছেন। তারা সবাই খুব মিষ্টভাষী।

ইশার সালাত আদায় করে বাহার বসে আছে বারান্দায়। এ জায়গাটা তার খুব পছন্দের। লোকজন যাওয়া আসা না করলে সামনের মাঠটা খুব সুন্দর দেখা যায়। বিশেষ করে চাঁদের আলো যখন পুরো মাঠ জুড়ে শোভা ছড়িয়ে দেয়, তখন সেই দৃশ্য দেখে বাহারের মন ভালো হয়ে আসে। আজ যদিও তার মন খারাপ। এখানে এভাবে বসে থাকা হবে না আর।

ভাবনার মাঝে রাবেয়া এলেন। পাশে বসে বাহারের হাত ধরে তিনি বললেন, ‘তোমারে একটা কথা বলি।’

– জি বলুন আন্টি।

রাবেয়া বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আসলে, এতদিন বলতে চাইছিলাম। কিন্তু তুমি যদি কিছু মনে করো তাই কই, বলি নাই। এখন যেহেতু চইলাই যাইতেছো, এর জন্য ভাবলাম কথাডা বইলাই ফালাই।’

– আপনি নির্ভয়ে বলুন আন্টি, আমি কিছু মনে করব না। আপনার আমার বিপদে যেমন সাহায্য করেছেন, আমি কোনো কিছু দিয়ে এই ঋণ শোধ করতে পারবো না। আল্লাহর কাছে শুধু দুআই করে যাবো।

মিষ্টি হাসলেন রাবেয়া, ‘দুআডাই আসল। যা বলতেছিলাম, তুমি যে মাহরাম ছাড়া এতো দূরে আছো, এইডা কিন্তু ঠিক না। এতদিন কই নাই কারণ তুমি যদি আবার ভাবো তোমার থাকার বিষয়ডা আমগো পছন্দ হইতেছে না। এই জন্যে অহন কইলাম। কাইল তো চইলাই যাইতেছো। যাওয়ার আগে ভাইবা যাও বিষয়ডা।’

বাহার কিছু বললো না, মূলত সে এর পৃষ্ঠে কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পেল না। কথাটা ভুল নয়। এতদিন ধরে মাহরাম ছাড়া বাড়ি থেকে দূরে থাকা উচিত নয়। কিন্তু সে যে নিরুপায়। এর সমাধান কি হতে পারে? তার মনের প্রশ্নের উত্তর রাবেয়া নিজেই দিয়ে দিলেন।

– আমি বলি কি, তুমি আরেকবার বিয়া করো।

বাহার মলিন কণ্ঠে বললো, ‘ইদ্দত?’

– বিয়াই তো হয় নাই। ইদ্দত কিয়ের?
– তারপরও, আমরা ফিকহবিদ না আন্টি। সতর্কতাবশত আইনিভাবে ডিভোর্স কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইছি। এরপর ভেবে দেখবো ইন শা আল্লাহ।
– আমি তোমার জন্য ঠিক করবো বিয়া?

মুচকি হাসলো বাহার, ‘করুন। কিন্তু, আমার পরিস্থিতি মেনে নেয়ার মতো কেউ আছে?’

উৎসাহ পেলেন রাবেয়া, ‘থাকবো না কেন? আমার মেজো পোলার বন্ধু, উসামা হইলো খুবই ভদ্র পোলা। হ্যারও বিয়া হইছিল একবার। কিন্তু বউ মইরা গেছে বাচ্চা হওনের সময়। বাচ্চাডাও মইরা গেল তিন দিনের মাথায়। বিয়া করতে চায় না। আমরা এমন মাইয়া খুঁজতেছি যারে একবার দেইখাই ভালা লাইগা যাইবো। তুমি অনেক সুন্দরী মা। তোমারে দেখলে আর মানা করতে পারবো না পোলা।’

বাহার সব শুনলো। তার ইচ্ছে আছে দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসার। কিন্তু ভয় হয় তার। এক ধরণের আতঙ্ক কাজ করে তার বুকের মধ্যে। প্রথমবার তো বিয়েই ছিল না সেটা। দ্বিতীয়বারও যদি ভুল কাউকে ভালোবাসে সে? বাহারের চুপ থাকাকে মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ ভেবে রাবেয়া হেসে উঠলেন, ‘পোলা রে দেখলে তোমারও ভালা লাগবো। আমি জানি। তাইলে কথা কইয়া দেখি মা?’

বাহার সম্বিৎ ফিরে পেল, ‘এখন না আন্টি। আমি হোস্টেলে বেশিদিন থাকবো না। বড়জোর এক সপ্তাহ থেকে বাসায় চলে যাবো। আমার বাবা রাজি হয়েছেন তালাকের ব্যাপারে। তিনি আমাকে সাহায্য করবেন। আর এমনিতেও ঢাকায় যেতে হবে আমাকে। রিজিয়ার সাথে যোগাযোগ হয়েছে তালাকের বিষয়ে, ও বলেছে ঢাকায় কিছু কাজ আছে। অনেক ধন্যবাদ, জাঝাকিল্লাহ খইরন আন্টি। আপনাদের উপকার আমি কোনদিন ভুলবো না।’

রাবেয়া আশাহত হলেন না। তিনি বাহারকে ভাবার সময় দিলেন। আরো কিছুক্ষণ গল্প করার পর তিনি চলে গেলেন। বাহার প্রতিদিনের মতো এবারও একাকী বসে আছে। ফোন এখন আর বন্ধ রাখে না সে। বাবা মাঝে মাঝে ফোন করেন, মা এখনো অসুস্থ রোগীর মতো চলাফেরা করেন, নাজের সময় কাটে গান শুনে আর প্রেম করে। বাহারকে ছাড়া কাননভিলা এখন নিয়মের বাইরে। বাহারের চিন্তায় সিয়াম আসে না, সাদি আসে না। সে এখন পুরুষ নিয়ে ভাবতে পারে না, চায় না। কণ্ঠের পর্দার বিষয়েও তার খেয়াল রয়েছে। এই বাড়ির মানুষগুলোর সান্নিধ্যে থেকে অনেককিছু শিখেছে সে। ডিভোর্সের ঝামেলা মিটলে বাহারের ফরজ ইলম অর্জনের ইচ্ছে আছে। এর জন্য কাল সে অনলাইনে একটা মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে যেটার ক্লাস শুরু হবে দু মাস পর।

হঠাৎ ফোনের শব্দে বাহার কেঁপে উঠলো। স্নিগ্ধ নীরব পরিবেশে ফোনের আওয়াজ বিকট শোনায়। বাহার নাম্বার দেখে অবাক হলো। রাধিকা নিজের ফোন থেকে কল করেছেন। বাহার দ্রুত তা ধরে বললো, ‘হ্যালো!’

রাধিকা কপট রাগ দেখালেন, ‘বাহার? তুমি কেমন মেয়ে? তোমার জন্য আমার ছেলের সাথে দেখা করতে পারলাম আর তুমিই দেখা করলে না?’

মুচকি হেসে বাহার উত্তর দিলো, ‘আমার একটু তাড়া ছিল আন্টি। আপনারা সময় কাটাতে পেরেছেন একসাথে?’

– হ্যাঁ, অনেক গল্প করেছি, আমি তোমার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ থাকবো মা।
– আজ কোনো সমস্যা হবে না তো আন্টি? নিজের নম্বর দিয়ে ফোন করেছেন দেখছি।
– আমার স্বামী এখন ব্যবসা বাঁচাতে ব্যস্ত। আমি কার সাথে যোগাযোগ রাখছি সেদিকে তার খেয়ালই নেই।

রাধিকার সাথে আরো অনেক কথা হলো বাহারের। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, রাধিকা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানতে চেয়েছেন। বাহারের ধারণা তিনি সাদির পরিবর্তনের কারণ বের করতে চাইছেন। ছেলেটা এতো কষ্ট সহ্য করেও কীভাবে ইসলাম আঁকড়ে ধরে আছে, তা তিনি বুঝতেই পারছেন না। একবার যদি সাদি ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে, তাহলেই সে আনন্দময় জীবন উপভোগ করতে পারবে। এ কথা রাধিকা ভালো করেই জানেন। কিন্তু ছেলেটা সবকিছু ত্যাগ করতে রাজি থাকলেও ইসলাম ত্যাগ করবে না। কি এমন আছে ইসলামে?

বাহার এখন খুবই আনন্দিত। রাধিকার সাথে কথা বলার পর তার মনে হয়েছে, রাধিকা ইসলামের প্রতি আকর্ষণ বোধ করছেন। বাহারকে তিনি নিয়মিত কল করবেন বলে জানিয়েছেন। বাহার নিজের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। উম্মাতের সংখ্যা যত বাড়বে, ততই শত্রুদের ঘায়েল করা যাবে। যদিও মুসলমানরাই জয়ী হয়ে এসেছে, ভবিষ্যতেও তারাই জয়ী হবে আল্লাহর ইচ্ছেয়।

____________

তোহা স্যারের মামলাটা ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছে। দেশের জনগণ ভুলে যাচ্ছে শামসুজ্জামান তোহা নামের একজন বরেণ্য ব্যক্তি অন্যায়ের শিকার হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেছেন এবং সেই অন্যায়ের বিচার এখনো পাওয়া যায়নি। হিমাংশু ব্যানার্জিকে সরকারি সহায়তায় দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, কিন্তু তা যেন শুধুই মুখের কথা। একজন ব্যক্তিকে বিদেশ থেকে আটক করতে মাসের পর মাস লেগে যাওয়ার কথা নয়। অবশ্য লন্ডনে হিমাংশুর অবস্থান দৃঢ় হওয়ায় তাকে নিরাপত্তা দানে বেশ কিছু সংগঠনের হাত রয়েছে, যার পৃষ্ঠে সরকারও নিরুপায় হয়ে বসে আছেন। এই সংগঠনগুলো চোখের আড়ালে থেকে যায়, মানুষের জ্ঞানের সীমার বাইরে তাদের কার্যক্রম চলতেই থাকে। যা আত্মপ্রকাশ পাবে হয়তো আরো কয়েক বছর পর, মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মুহূর্তে।

তাই চার মাস পেরিয়ে গেল, তোহা স্যারের মৃত্যুর বিচার হলো না। রণজিৎকে একবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল জনগণকে দমিয়ে রাখতে। কিন্তু অদ্ভুত কিছু যুক্তি দেখিয়ে তাকে জামিন দেয়া হয়। তিনি এখন জামিনে দিব্যি স্বাধীন মানুষের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যদিও আগের সেই প্রতাপ প্রতিপত্তির ছিটেফোঁটা নেই। তাকে দেখলে মানুষ এড়িয়ে চলে, চোখের দৃষ্টি দিয়ে ধিক্কার জানায়। ছেলে মেয়ে ছাড়া তিনিও সারাক্ষণ বিমর্ষ থাকেন। সুনীতিকে একবার ফোন করেছিলেন দেশে আসার জন্য। সুনীতির স্পষ্ট বক্তব্য, সে বিয়ে করেছে একজন সেক্যুলারকে। তার নতুন সংসার ও এর সাথে মিশে থাকা লোকজনের কাছে সে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য পেতে চায় না। তাই তার ইচ্ছে, বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ কম রাখবে সে। জমিজমা ও প্রোপার্টি বুঝে নিতে প্রয়োজনে দেশে আসবে সে। কিন্তু সবকিছু শুধু প্রয়োজনের খাতিরে, কোনো সহানুভূতির স্থান এখানে নেই।

আর হিমাংশুর সাথে রণজিৎ এর কথোপকথন না বললেই ভালো। অকথ্য সেইসব কটুবাক্য আর অসম্মানের কথাগুলো রণজিৎকে দুদিন অসুস্থ করে রেখেছিল। তিনি মাইনোর স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। যার জন্য করলেন চুরি, সেই বলে চোর! রাধিকা সব ব্যাপারেই নিষ্প্রাণ থাকেন। সুনীতির সাথে অল্প কথা বলে যখন বুঝেছিলেন মেয়েটা বেশ পর হয়ে গিয়েছে, তখন স্বামীর হাতে ফোন দিয়ে দিয়েছেন। হিমাংশুর সাথে কথা বলেননি তিনি। হিম নিজেই চেয়েছিল, তবু বলেননি। তার একমাত্র আগ্রহ প্রিয় ছেলেকে নিয়ে। নামটা ভালোই দিয়েছিলেন তিনি, এই ভেবে নিজেই হাসেন রাধিকা। প্রিয়ংশু প্রিয় হয়েই থাকলো। বাবা রণজিৎ তাকে যতই ফাঁসিয়ে দিক না কেন, তিনিও এখন উপলব্ধি করেন প্রিয় কেমন সন্তান। যে জেলখানা থেকে ছাড় পাওয়ার পরও নিজের বাবার নাম একটা মামলা দূরের কথা, ছোটখাটো প্রতিশোধও নেয়নি।

সময় নামক চঞ্চল বাহনে চড়ে জীবনের গতি বহমান। সাদি কাতার যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, সেখানেই একবারে থেকে যাবে সে। কাতারের এক ঔষধ কোম্পানির অধীনস্থ কর্মী হিসেবে চাকরিটা তার হয়েই গিয়েছে। বেশ ঝামেলার কাজ ছিল। বিদেশি মানুষগুলো তার ইতিহাস ঘেঁটে জেল খানার আসামি জানতে পেরে তাকে চাকরি দিতে চায়নি। সে নিজের পক্ষে যুক্তি তৈরি করে মেইল পাঠালে কোম্পানির অধীনে থাকা একজন উচ্চপদস্থ কর্মী তাদের কোম্পানিতে কর্মরত বাঙালি ভদ্রলোককে দিয়ে সাদির ব্যাপারে খোঁজ নেন। সত্যতা যাচাই করেই তারা সাদিকে কাজের সুযোগ দিয়েছেন, এবং আরো অনেক সুবিধা দেয়ার আশ্বাস জানিয়েছেন। এর কারণ হলো, সাদি রিভার্টেড মুসলিম এবং নিপীড়িত একজন। কোম্পানির মালিক অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ মুসলিম হওয়ায় সাদির মতো ধৈর্যশীল পুরুষকে সানন্দে কাজের সুযোগ দিয়েছেন।

আর ক’দিন পরই সাদি চলে যাবে কাতারে। পাসপোর্ট আর ভিসা নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল, সেগুলো পরিচিত বন্ধু ও পুলিশের সহায়তায় মেটানো গিয়েছে। সাদি আল্লাহর কাছে বারবার শুকরিয়া আদায় করে। কত সহজে সবকিছু ঘটে যাচ্ছে! সুবহানাল্লাহ!

__________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here