ধূম্রজাল’ একাদশ পর্ব

0
229

‘ধূম্রজাল’
একাদশ পর্ব
তাবিনা মাহনূর

___________

হানজালার প্রশ্নের পৃষ্ঠে গুলবাহার বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বললো, ‘কে বলেছে?’

– নাজ বললো। তোর কাছে নাকি পাঁচশ টাকা চেয়েছে, পায়নি। তুই বলেছিস চাকরিই থাকবে না আর টাকা কোথা থেকে দিব?
– বাহ! আমার কথাগুলো কপি করে তোমার কাছে পেস্ট করেছে সে।
– এতকিছু বুঝি না। তুই চাকরি ছাড়ার কথা বললি কেন? কি হয়েছে? অফিসে ঝামেলা চলছে?

বাহার নিরাশ ভঙ্গিতে বললো, ‘শেষ তিনটা কেসে আমি ব্যর্থ হয়েছি। তাই স্যাররা আমার কাজে অসন্তুষ্ট। তাছাড়া এই বিভাগ থেকে নানান অনৈতিক প্রস্তাব আসছে প্রতিনিয়ত। তাই এই কাজটা একদিন ছেড়ে দিতেই হতো।’

হানজালা রেগে গিয়েছেন। কণ্ঠে তার রাগের মৃদু আঁচ প্রকাশ করে বললেন, ‘আর তারপর বেকার হয়ে বসে থাকবি? এতোই যখন নীতি নৈতিকতা মেনে চলিস তাহলে এই বিভাগে চাকরি নিয়েছিলি কেন? জানিস না এসব জায়গায় সৎ থাকা যায় না?’

– আমি জানতাম মা। কিন্তু কল্পনাও করতে পারিনি যে এতোটা নোংরা জায়গা। এখানে কোনো সৎ মানুষ কাজ করতে পারবে না মা। যে সৎ, তাকে বেরিয়ে আসতেই হবে। আর যে বের হতে পারবে না তার দুটো পরিণতি। হয় সে অসৎ হয়ে যাবে, আর নয়তো তাকে ফাঁসিয়ে দেয়া হবে। আর ফেঁসে গেলেও দুটো পরিণতি। জেলে যাও, আর নাহলে মরে যাও।
– ঠিকাছে, চাকরি ছেড়ে কি করবি ভেবেছিস?
– আপাতত বিয়েটা হওয়ার পর সিয়ামের সাথে মিলে সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছি। মনোবিজ্ঞানের শাখার অভাব নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যাবো। আর নয়তো বিদেশে যাবো উচ্চ ডিগ্রি নেয়ার জন্য।

হানজালা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বিরক্ত মুখে বললেন, ‘কি ভীমরতি জেগেছে তোর জানি না। অসহ্য লাগে নতুন নতুন ঢং দেখলে। সিয়াম যখন জানবে তোর চাকরি নেই, তখন সে কি ভাববে বল তো? আজকালকার মেয়ে হয়েও নিজের একটা স্থান তৈরি করতে পারলি না! কি জন্ম দিলাম আমি! ওদিকে ছোটটা প্ৰি টেস্টে ফেল করেছে…’

এসব বকতে বকতে চলে গেলেন হানজালা। বাহার বুঝতে পারলো তার মায়ের রাগটা কোথায়। বিয়ের ফুল ফুটেছে তার, ফুল যদি ঝরে যায় এসব খবর শুনলে? তাহলে সিয়ামকে বাহার নিজেই বিয়ে করবে না। কারণ এমন পুরুষ তার দরকার নেই যে স্ত্রীর চাকরির উপর নির্ভর করে সংসার নির্ধারণ করে।

হানজালা চলে যাওয়ার পর বাহারের আবারো মনে পড়ে গেল, সাদি তাকে ফেসবুকে ব্লক করে দিয়েছে। বাহারের অনেককিছু জানা বাকি। কাল অফিসে গিয়ে পদত্যাগ পত্র দিবে সে। অনৈতিক সব প্রস্তাবের কথা মনে পড়লেই তার গা গুলিয়ে বমি চলে আসছে। শাওন স্যার তাকে সাদির সাথে অশ্লীল আচরণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মানসিকভাবে সাদিকে নারী দ্বারা নড়বড়ে করে দিতে চেয়েছিল। কারণ পুরুষ মানুষ এই একটা বিষয়ে হার মানবেই। চল্লিশোর্ধ্ব ফারহানাকে দিয়ে তেত্রিশ বছরের সাদির মন গলানো যায়নি। বরং সাদি ফারহানার কাছ থেকে বাঁচতে একবার ফারহানার হাত খামচে বলেছিল, ‘এখানে কেন আপনি? আপনার তো বে* পল্লীতে থাকার কথা।’ এই কথার কারণে সাদিকে সেদিন পঞ্চাশ বেত্রাঘাত করা হয়। সাদি যখন একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে গিয়েছিল তখন তাকে কয়েদিদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

এসব বাহার জানে না। কিন্তু সে যখন সাদির সাথে অশ্লীল আচরণ করতে রাজি হয়নি তখন শাওন স্যার অদ্ভুত কথা বলেছিলেন, ‘তোমাকে আমার এজন্যই ভালো লাগে বাহার। জানো? আজ পর্যন্ত তোমার মত একটা মেয়েকেও দেখিনি। ফারহানা ম্যামকেই দেখো, মধ্য বয়স্ক নারী হয়েও পরকী-য়ায় জড়িয়েছেন ওসি রূপমের সাথে। আর তোমার মত কম বয়সী মেয়েদের নিয়ে কিছু বলতেও রুচিতে আসে না। আমার ডিভোর্সের পর থেকে আমি তোমার মতো সতী নারী অনেক খুঁজেছি, কিন্তু কাউকেই বিশ্বাস হয় না। জীবনসঙ্গী বিশ্বস্ত না হলে হয় বলো?’

বাহার চোখ বড় বড় করে কথাগুলো শুনে মেকি হেসে বলেছিল, ‘জি স্যার, সংসারে বিশ্বাস না থাকলে সেটা টিকিয়ে রাখা অনেকটা তাসের ঘরের মতো। আলহামদুলিল্লাহ, আমিও সামনে বিয়ের পিঁড়িতে বসবো। আমার জন্য দুআ করবেন।’

শাওন ভ্রু কুঁচকে বলেছিলেন, ‘মানে?’

বাহার তখন বাগদানের আংটি দেখিয়ে বলেছিল, ‘আমার আংটি বদল হয়েছে স্যার। তিন মাস পর বিয়ে। আপনাদের সবাইকে দাওয়াত দিব ইন শা আল্লাহ।’

এরপরই শাওনের আসল রূপ বেরিয়ে আসে। তিনি একের পর এক অভিযোগ তুলেন বাহারের বিরুদ্ধে। এক পর্যায়ে শুভ্রত স্যারকে ডেকে এনে বাহারের শেষ কয়দিনের কাজের বিরূপ সারাংশ তুলে ধরেন তিনি। শুভ্রত স্যার কপাল কুঁচকে বাহারকে অনেকরকম সতর্কতা দিয়েছেন।

বাহার ঠিক করেছে কাল পদত্যাগ পত্র দিয়ে একবারে চাকরি ছেড়ে দিবে। অফিসিয়ালি চাকরি ছাড়ার সকল কার্যক্রম এগিয়ে রাখবে। সিয়ামকে বলতে হবে এসব। যতই হোক, সিয়াম তার সঙ্গী হতে চলেছে। তাকে জানানো জরুরি। পরবর্তীতে যেন সে খোঁচা দিয়ে কথা না বলে। এসব চিন্তা শেষে সে তার ফেক আইডিতে ঢুকলো। সেটা থেকে সাদিকে ম্যাসেজ দিয়ে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালো। যেকোনো ভাবেই সাদির সাথে তার কথা বলতেই হবে।

_________

‘আজ আমার জন্য বিশেষ দিন। আজকের দিনটা হয়তো এই বাড়িতে শেষ দিন, অথবা আমার জীবনের নতুন মোড় শুরু হওয়ার সাক্ষী। আমি আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছি আয়না। কাল যদি সফল না হই, তাহলে আমার পরিণতি খুব একটা ভালো হবে না। তাতে আফসোস নেই। কিন্তু একটাই ভয় জেগেছে মনে। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করেছেন তো? নাকি ক্ষমা লাভ না করেই…’

ডায়েরি লেখার অভ্যাস সাদির ছোট থেকেই। আর সে যখন একটু বাংলা ও কাব্য বুঝতে শুরু করলো, তখন থেকেই সে ডায়েরীকে একটা জীবন্ত অস্তিত্ব কল্পনা করে নিয়ে ‘আয়না’ সম্বোধন করে। আজ অনেকদিন পর সে ডায়েরীতে লিখতে পারছে, আয়নার কাছে তার মনের অনেক কথা বলার আছে। পাঁচ পৃষ্ঠা লেখার পর সে দুই হাত উঁচু করে আড়মোড়া ভেঙে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রান্নাঘরে গিয়ে রেডি নুডুলসে গরম পানি ঢেলে আবার ফিরে এলো। শরীরের ব্যথার কারণে কোনো কিছু রাঁধতে ভালো লাগছে না তার। মাকে খুব মনে পড়ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে মায়ের সাথে কথা বলা অনেক ঝুঁকির ব্যাপার। সে ভেবেছিল তার ফোন জব্দ করে পুলিশের কাছে রাখা হবে। কিন্তু সেটা না করে তাকে ফোন দেয়া হয়েছে। তারপর সে বুঝতে পারে এর কারণ। সে কোথায় ফোন করছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কার সাথে কেমন চ্যাট করছে, তাকে কে মেইল পাঠাচ্ছে, সব রকম তথ্য পুলিশ অনায়াসে পেয়ে যাচ্ছে।

এই কারণেই সাদি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে সোশ্যাল মিডিয়ায় যত আইডি আছে, সব ডিএক্টিভেট অর্থাৎ নিস্ক্রিয় করে ফেলবে। আপাতত এসব থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়। প্রথমেই তার ফেসবুকের কথা মনে পড়লো। এটা সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তাই এটাকে শুরুতে নিস্ক্রিয় করতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সে ফেসবুকে ঢুকে দেখলো তার ম্যাসেজ রিকুয়েস্ট এ বেশ কিছু ম্যাসেজ জমা পড়ে আছে। আর নোটিফিকেশনে সে দেখলো একটা আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো হয়েছে। আইডির নাম ‘রঙিন কানন’।

এই আইডি থেকে ম্যাসেজ পাঠানো হয়েছে, ‘দয়া করে ব্লক মারবেন না। একটাই প্রশ্ন আছে। আপনার সাথে আমার যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিন আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে পরিচয় করানোর পর আমি চলে এসেছিলাম। তারপর কি আমাদের আর দেখা হয়েছিল?’

ব্লক পাওয়ার ভয়ে সরাসরি প্রশ্ন লিখে পাঠিয়েছে গুলবাহার। সাদির মেজাজ আবার গরম হয়ে এলো। সে কোনো উত্তর না দিয়ে ডায়েরীতে লিখলো, ‘গুলবাহার অর্থ ফুল বাগান। সাখাওয়াত অর্থ নমনীয়তা। অথচ একটা মেয়ের মাঝে না আছে নম্র ভদ্রতা, না আছে পুষ্পের মতো লাজুকতা। এতো ছ্যাঁচড়া মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখিনি। ইচ্ছে করছে চড় মেরে গাল ফাটিয়ে দিই। আয়না, আমার ইদানিং খুব রাগ বেড়েছে জানো?’

এটুকু লিখে সাদি ক্ষান্ত দিলো। সত্যিই তার রাগ বেড়েছে। আগের মতো নরম সাদি সে আর নেই। চোখ দুটো বুড়ো আঙুল দিয়ে ডলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। উঠে দাঁড়িয়ে সে ঘর থেকে বের হলো। গরম নুডুলস এনে ফোন হাতে নিয়ে সাদি লিখলো, ‘সেই প্রথম, সেই শেষ দেখা। এরপর আর দেখা হয়নি আমাদের।’

সাথে সাথে বার্তা পাঠালো বাহার, ‘তাহলে আমাকে যিনি গর্জিয়াস বলেছিলেন তিনি আপনার ভাই?’

‘আপনাকে কে কি বলেছে জানি না। তবে আমি আমার স্ত্রী থাকাকালীন অবস্থায় অন্য কোনো নারীকে গর্জিয়াস বলার মতো পুরুষ নই।’ এতকিছু লিখেও সাদি তা মুছে ফেলে লিখে পাঠালো, ‘হতে পারে।’ কারণ তার কাছে আগের কথাগুলো কৈফিয়তের মতো মনে হয়েছে। একটা পরনারীর কাছে এতো কৈফিয়ত দেয়ার কোনো কারণ নেই।

বাহার আবার লিখলো, ‘আচ্ছা, কি আছে ওই পেপারে বলুন না?’

সাদি তা দেখেও কিছু লিখেনি। সে দ্রুত ফেসবুক ডিএক্টিভেট করে টুইটারে গেল। সেটাও ডিএক্টিভেট করে দিলো। একে একে সব নিস্ক্রিয় করে স্বস্তির শ্বাস ফেললো সে। এগুলো থেকে দূরে থাকাই ভালো।

কিন্তু বাহার ভেবে নিলো, তাকে আবারো ব্লক করেছে সাদি। তবে সে অবাক হয়নি। সাদির মতো পুরুষের এমন কাজই শোভা পায়। সাদিকে তার আর প্রয়োজন নেই। বাহার নিজেকে প্রশ্ন করলো, ‘সিয়াম কি এমন পুরুষ?’ তারপর আবার প্রশ্ন করলো, ‘আমি কেমন? আমার হায়া কতখানি?’ আবার মনে পড়লো তার, ‘রিপন ভাইয়া কেমন? সে কেন আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে ছিল, পাশে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও?’ এসব প্রশ্নের উত্তর আছে, কিন্তু বাহারের কাছে উত্তরগুলো অস্পষ্ট। সে নীচে গেল। সালমার ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে সে বললো, ‘ফুপি, আসবো?’

সালমা ভেতর থেকে বললেন, ‘আয় মা।’

বাহার ভেতরে ঢুকে সালমার কাছে গিয়ে বসলো। সালমা বললেন, ‘কোলের উপর মাথা দে, চুলে হাত বুলিয়ে দিই?’

বাহার তাই করলো। তবে তার মন অস্থির হয়ে আছে। সে সরাসরি প্রশ্ন করলো, ‘ফুপি, তোমার কাছে আমি একটা বিষয় জানতে এসেছি।’

– কি বিষয়?
– মেয়েরা পর্দা না করলে হয় না? পুরুষরা কেন তাদের চোখ, হাতের হিফাজত করে না?
– এই প্রশ্ন তোর মনে কে জাগিয়েছে?
– কেউ না। আমিই জানতে চাইছি।

সালমা বললেন, ‘পুরুষদের অবশ্যই দৃষ্টির হিফাজত করতে হবে, সকল অঙ্গের হিফাজত করতে হবে। কিন্তু এর সাথে নারীর পর্দা মিশিয়ে ফেললে হবে না মা। পুরুষ নিজেদের হিফাজত করলো, নারীরা করলো না এমন হলে সমাধান সম্ভব নয়। দুই পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।’

– কেন? পুরুষ ঠিক থাকলে নারীদের পর্দার কি প্রয়োজন?

সালমা মুচকি হেসে বললেন, ‘তোকে প্র্যাকটিক্যালি না বোঝালে তুই বুঝবি না। তাই তোকে একটা কাজ দিই, তুই সফল হলে বলবি।’

– কি কাজ?
– কাল সকাল সাতটা থেকে আগামীকাল সকাল সাতটা, এই চব্বিশ ঘন্টা তুই নিজের দৃষ্টি, মন সবকিছুর হিফাজত করবি।
– এটা কোনো ব্যাপার!
– আগে পারিস কিনা দেখ।
– আচ্ছা পরীক্ষা দিব। কিন্তু আমার উত্তর দাও।

সালমা বুঝিয়ে বললেন, ‘পুরুষ প্রজাতিকে আল্লাহ এমনভাবে তৈরি করেছেন যে তারা আকৃষ্ট অনুভব করবে, আর নারীরা আকর্ষণীয় হবে। অর্থাৎ দুই প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে দু রকম ভাবে। তাই নারীদের আকর্ষণ ঢেকে রাখা আবশ্যক, পুরুষের আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতা দমিয়ে রাখা আবশ্যক। একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী দুজন নর-নারী যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বীকৃতি পেয়ে যায় তখন তাদের আকর্ষণে কোনো বাধা থাকে না। তবে নারীদের মাঝেও আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতা থাকে, কিন্তু এর পরিমাণ পুরুষদের তুলনায় কম। আবার পুরুষের মাঝেও আছে আকর্ষণ, যা নারীদের তুলনায় কম। যদি তারা তাদের এই বিশেষ টান দমন না করে উশৃঙ্খল চলাচল করে তাহলে সমাজে অনাচার ও অশ্লীলতা ক্রমেই বাড়বে, এবং বাড়ছে।’

বাহারের মনের শান্তি এখনো আসেনি। সালমা আবার বললেন, ‘পুরুষ মানুষের মাঝে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা এমন এক বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন যে তাদের সেটা দমন করা অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই তারা যদি এই বিষয়টাকে দমিয়ে রাখতে পারে, তাহলে তাদের জন্য মহা পুরস্কার রয়েছে। তুই বুঝবি না রে মা, তাদের এই বৈশিষ্ট্য, এই আকর্ষণের প্রবণতা দমিয়ে রাখতে কত কষ্ট হয়। আল্লাহ তা জানেন বলেই তিঁনি চার বিয়ের বিধান দিয়েছেন। তিঁনি আরো বলেছেন, জান্নাতে হুর থাকবে। এসব বিনা কারণে কখনোই তিঁনি বলেননি, তিঁনি যে আল খবির! তাই তো তিঁনি এসকল বিধান দিয়েছেন যেন পুরুষ তাতে সন্তুষ্ট থাকে, অন্যায় কাজ না করে।’

– তারপরও তো পুরুষ মানুষ খারাপ কাজ করে। ধর্ষণ করে, নর্তকীর কাছে যায়…
– এটার দুটো কারণ। প্রথমত, এসব পুরুষ নফসকে আরাম দিতে চায়। আখিরাতের অপেক্ষায় থাকতে পারে না। দ্বিতীয়ত আমাদের সমাজ। সামাজিক নিয়মগুলোর কারণে পুরুষ তার শরিয়াহ ভিত্তিক নিয়ম থেকে সরে যাচ্ছে। তাই তারা যথাযথ নিয়মে নিজেদের হিফাজত করতে পারছে না। সহশিক্ষায় নারীরা বেপর্দা চলে, সহ চাকরিতে নারীর পাশাপাশি কাজ করে পুরুষ, সিনেমা জগতের প্রসার, নাটকে অশ্লীলতা, শাস্তি যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়া, এইসব কারণে পুরুষ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। আগের যুগে এরকম অপরাধ ঘটেনি তা নয়। কিন্তু আগে এর পরিমাণ ছিল খুবই কম। যারা এসব কাজ করতো, তারা নফসের আরামের জন্য করতো। আর এখন এসব বেড়ে গিয়েছে কারণ এখন সমাজই তাদেরকে এসব কাজে উদ্বুদ্ধ করছে।

বাহার উঠে বসে বললো, ‘তাহলে পুরুষ নিজেকে হিফাজত করতে পারে না তাদের ওই প্রবণতা অনেক বেশি বলে?’

– হুম। কিন্তু এর মানে এই নয় যে তারা জবাবদিহিতা থেকে বেঁচে যাবে। আল্লাহ ছেড়ে দিবেন না। যদি তারা তাওবা না করে।
– আর নারীরা? তারা পর্দা করলে লাভ কি?
– বিশ্বাস করবি কিনা জানি না, নারীরা পর্দা করলে সবচেয়ে বেশি তাদেরই লাভ।
– কীভাবে?
– এখনকার নারীরা ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে অনেক কথা বলে। তুই একটু বিবেচনা করে দেখ। পুরুষ তার দৃষ্টির হিফাজত করছে না এটা মেনে নিলাম। কিন্তু নারী কি করছে? পুরুষের চোখের আর মনের খাবার হচ্ছে না তারা? ইভটিজিং এ কি কি অশ্লীল শব্দ ব্যবহার হয় তা ভেবে দেখ নারী কি সেগুলো প্রকাশ্যে রাখে না? কাদের জন্য রাখে? বিদেশিদের দেখিস, ওরা উন্মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়ায় কারণ পুরুষদের চোখে ওরা সুন্দরী হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। সেই নারীকেই একটা বস্তির ছেলে আবেদনময়ী বলে সম্বোধন করলে সেটা কি হবে? ইভটিজিং! কেন? কারণ ছেলেটাকে মেয়েটার পছন্দ হয়নি।

বাহার ভেবে দেখলো, এটা একদম ঠিক কথা বলেছে তার ফুপি। বিদেশিদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড চিন্তাভাবনার কথা বলে শেষ করা যাবে না।

সালমা আবার বললেন, ‘প্রথমেই বলে রাখি, মুসলিমদের যা হুকুম দেয়া হয়েছে তা মানতেই হবে। কারণ আমরা যেখানে সুবিধাটা খুঁজে পাব না আল্লাহ সেখানেই অসীম উপকার লুকিয়ে রেখেছেন, এমনও হতে পারে। তাই তো সূরা বাক্বরয় বলা আছে, আমরা শুনলাম এবং মানলাম। এরপর আসি উপকারিতায়। মুসলিম নারীরা বোরখা পরেও ইভটিজিং এর শিকার হয় এটাও সত্যি। কিন্তু শতকরা হিসাব করলে এর পরিমাণ কম। যদি তারপরও কেউ মানতে না চায় তাহলে বলবো, যেই নারী নিজেকে হিফাজত করে চলছে সে নিজে কি মানসিক প্রশান্তি পাচ্ছে না? একটা বেপর্দা মেয়ে আর পর্দাশিন মেয়ে পাশাপাশি হাঁটলে অবশ্যই বেপর্দা মেয়েটাকে দেখে টিজ করবে বখাটের দল।’

– তারপরও কিন্তু পুরোপুরি সমাধান হয় না।
– ঐযে বললাম, কিছু পুরুষ আছে শয়তানের ধোঁকায় পুরোপুরি অন্ধ। আর এছাড়াও আমি আগেই বলেছি মুমিনকে যা আদেশ করা হয়, সে তা এমনিই মানবে। কারণ এটা যেন তেন কারো আদেশ নয়। এটা রবের পক্ষ থেকে নির্দেশ। তিঁনি নিশ্চয়ই সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী, তিঁনিই সবচেয়ে বেশি প্রজ্ঞাময়। তাঁর বুদ্ধির তুলনা হয় না।

এবার বাহারের মন শান্ত হলো। সে একদিন ফুপির বোরখা পরে বেরিয়েছিল। সেদিন খুব গরম লেগেছে, বিরক্তও লেগেছে। কিন্তু রাস্তায় চলতে এতটুকু অনিরাপদ মনে হয়নি। যদিও রাতের বেলা বোরখা পরিহিত নারীও অনিরাপদ। কিন্তু বাহারের সেদিন নিজেকে ঝুঁকিমুক্ত মনে হয়েছিল। এই কথাটা সে কাউকে বলেনি, বলতে পারেনি। কেমন যেন লজ্জা ঘিরে ধরেছিল তাকে।

বাহার উঠে দাঁড়িয়ে ফুপির দুই গাল ধরে বললো, ‘তুমি খুব ভালো। থ্যাংক ইউ ফুপি!’

– উহু, জাঝাকিল্লাহ খইরন বল। এর অর্থ, আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।
– জাঝাকিল্লাহ খইরন ফুপি! কিন্তু আমাকে যেই পরীক্ষাটা দিলে, সেটা কাল না হয়ে পরশু করি?
– কেন?
– কাল আমাকে অফিসে যেতে হবে।
– তো? এটাই তো চাইছি। অফিসে ছেলেদের সাথে কথা বলবি। কিন্তু চোখ ও মনের হিফাজত করে। যেভাবে তোরা চাস পুরুষ মানুষ হিফাজত করুক নিজেদেরকে।

ফুপির বুদ্ধিতে বাহার হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো!

___________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here