ধূম্রজাল’ বিংশ পর্ব

0
184

‘ধূম্রজাল’
বিংশ পর্ব

________

‘এগারো সিন্ধুর গোধূলি’ নামক ট্রেনে সাধারণ সিটে বসে আছে বাহার। রাধিকার সাথে একবারও দেখা করেনি সে। যত দ্রুত সম্ভব স্টেশনে চলে এসেছে সে। ওই এলাকায় সিয়ামের পরিচিত কেউ থাকলে সমস্যা হয়ে যেতো। যদিও বোরখায় কেউ তাকে চিনতে পারতো না, কিন্তু সাবধানতা অবলম্বন করা উত্তম।

ফোন বন্ধ করে রেখেছে বাহার। আড়ং এ পৌঁছেই ফোন এসেছিল সিয়ামের নম্বর থেকে। তখনই বন্ধ করে দিয়েছে সে। বাড়ি থেকে আসার আগে সে তার নিজের ঘরে একটা চিরকুট রেখে দিয়েছে। যেখানে লেখা আছে সে কেন বেরিয়ে এলো…

‘আসসালামু আলাইকুম। প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমার পক্ষে একজন নাস্তি-কের সাথে সংসার করা সম্ভব নয়। আমি কোনোভাবেই চাই না আমার সন্তান পথভ্রষ্ট হোক বা মুমিনদের কাছে জারজ নামে পরিচিত হোক। সমাজের কাছে সে জারজ হবে না বলেই মুমিন বলেছি। আর আমি একজন মুমিনাহ হিসেবে কোনোভাবেই স্বামীর অবিশ্বাসী মনোভাব মেনে নিতে পারবো না। সিয়ামের কাছে ডিভোর্স লেটার চলে যাবে। সে যদি ডিভোর্স দিতে না চায় তাহলে আমি আত্মহত্যার পথ খুঁজে নেব, তবু তার সাথে সংসার করবো না। মাথায় রেখো কথাটা। আর ফুপিকে দোষারোপ করবে না কেউ। ফুপি আমাকে কিছুই বলেননি। আমি নিজেই এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। ভালো থেকো তোমরা। ডিভোর্সের কাজটা শেষ হলে খোঁজ নিব ইন শা আল্লাহ। আর মনে রেখো, আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করিনি কিন্তু। কিছুদিন শুধু নিরাপদে থাকতে চাইছি বলে যোগাযোগ রাখছি না। আল্লাহ তোমাদের হিদায়াহ দিন, আমাকেও দিন। আসসালামু আলাইকুম।’

এই চিঠি দেখে বাড়িতে কি প্রতিক্রিয়া আসবে বাহারের জানা নেই। তবে সে বাড়ি ফিরে যাবে না, এটাই তার শেষ কথা। ওখানে ফিরে গেলেই জোর করে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে। চাইলেও দায়িত্ব এড়িয়ে চলা যাবে না। তখন সিয়াম মুনাফিক হয়ে যাবে। বাহার এসব নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে হতাশ থাকবে সবসময়। তবে আত্মহত্যার কথাটা শুধুমাত্র হুমকি স্বরূপ। এক মহাপাপ থামাতে গিয়ে অন্য মহাপাপ করার মতো বোকা সে নয়।

ট্রেনে চড়ে খারাপ লাগছে না বাহারের। কত মানুষ এখানে, অনেক রকম চিত্র। আল্লাহর রহমতে তার পাশে একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা বসেছে, কোনো পুরুষ বসেনি। মহিলাটা ভদ্র স্বভাবের। গায়ের কাপড় দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি অসচ্ছল কিন্তু খুব পরিষ্কার। কোলের ছেলেটাকে আগলে রেখে চুপচাপ বসে আছেন তিনি। বাহার স্বস্তি পেলো। ট্রেনের উটকো ঝামেলাগুলো থেকে আল্লাহ তাকে রক্ষা করেছেন।

ঢাকা থেকে নরসিংদী খুব বেশি দূরত্ব নেই। তাই জানালা দিয়ে পথঘাট দেখতে দেখতেই নরসিংদী স্টেশনে পৌঁছে গেল বাহার। সেখানে পৌঁছানোর আগে সে ফোন অন করেছে। সাথে সাথেই কতগুলো আওয়াজ ভেসে এলো যা দ্বারা বোঝা যাচ্ছে অনেকবার ফোন করা হয়েছে তাকে। ম্যাসেজও এসেছে অনেক। সব সিয়ামের। সিয়াম ভালো হয়ে যাবে, সে মুসলিম হবে, এমন আরো কত কথা! বাহার দ্রুত রাবেয়ার নাম্বারে ফোন করলো। রাবেয়া ধরলেন, ‘কে?’

– আসসালামু আলাইকুম আন্টি, আমি বাহার।
– ওহ বাহার মা? তুমি পৌঁছে গেছো?
– জি, আর একটু পথ আছে।
– আচ্ছা আচ্ছা, আমার বড় ছেলে আর বড় বৌমা তোমাকে আনতে গেছে। তুমি আমার বৌমার নম্বর নিয়ে রাখো। জিরো ওয়ান…

বাহার রাবেয়ার বড় বৌমার নম্বর সেভ করে রাখলো। বড় ভাবীর নাম সুবহা। স্টেশনে পৌঁছে সে সুবহা ভাবীকে ফোন করলো। তিনি কল ধরেই আন্তরিক কণ্ঠে নিজেদের অবস্থান জানালেন। বাহার হাঁটতে হাঁটতে একজন বোরখা পরিহিত নারীকে ফোনে কথা বলতে দেখে বলে উঠলো, ‘ভাবী, একটু পিছে তাকাবেন?’

সেই নারী পিছে তাকালে বাহার বুঝতে পারলো ইনিই সুবহা ভাবি। সে ফোন রেখে এগিয়ে গেল। সুবহার কাছাকাছি যেতেই সে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম ভাবি, আমি গুলবাহার।’

সুবহা সালামের উত্তর দিয়ে বললো, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আমি আসলে দূর থেকে বুঝতে পারিনি। আপনার আসার পথে কোনো সমস্যা হয়নি তো?’

সুবহা বেশ আন্তরিক স্বভাবের মেয়ে। বয়সে বাহারের তিন চার বছরের বড় হবে হয়তো। সুবহার পাশে দাঁড়ানো একজন সুন্নি পোশাকের লোক বাহারের সাথে কোনো কথা না বলেই সুবহাকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা হাঁটতে থাকো। আমি অটো খুঁজি।’

বাহার বুঝতে পারলো ইনিই বড় ভাইয়া হামিদ। রাবেয়া আন্টির বাসায় প্রায় সবাই দ্বীন মেনে চলার চেষ্টা করে, সুবহা আর হামিদকে দেখে বাহার অনেকটা বুঝে গেল। রাবেয়া আন্টি একজন মহিয়সী মা।

সুবহার সাথে সাধারণ গল্পে মেতে বাহারকে নিয়ে তারা পৌঁছে গেল রাবেয়ার বাড়ি। সদর থেকে কিছুটা দূরে গ্রামের কাছাকাছি জায়গায় সুন্দর এই নিবাসের আশেপাশে আছে অনেক গাছ আর পেছন দিকে বড় মাঠ। আরো কিছু বাড়ি আছে এদিকে। বোঝা যাচ্ছে, আর একটু পথ গেলেই গ্রাম শুরু হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশে বাহারের মন ভালো হয়ে এলো। তবে রাত হয়ে যাওয়ায় গ্রামের সৌন্দর্য ভালো করে দেখতে পেল না সে। কিছুদিন থেকে ভোর বেলা হাঁটতে বের হওয়ার ইচ্ছে পুষে রাখলো বাহার।

বাড়িটা কাঁচা নয়, বেশ দারুন এবং পাকা। সালমা ফুপি আগের পরিস্থিতি ভেবেই হয়তো আধা পাকা বাড়ি বলেছিলেন। এখন বাড়িটা এক তলা, বিশাল বড়। বড় ভাইয়ের ইলেকট্রনিক জিনিসের ব্যবসা আছে, মেজো ভাইটা মোটামুটি শিক্ষিত হওয়ায় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক পদে আছে। আর ছোট ভাই মাস্টার্স পাশ। তিনি বউ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে থাকেন। সেখানেই একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন তিনি। তিন ভাইয়ের হালাল আয়ে বড় পরিবার চলছে স্বাচ্ছন্দ্যে।

রাবেয়ার স্বামী আমজাদ বেশিরভাগ সময় বিছানায় শুয়ে কাটান। বয়সের ভার তাকে কাবু করে ফেলেছে, বেশিক্ষণ হাঁটতে পারেন না তিনি। খাওয়া আর গোসলের সময়টা ছাড়া বাকি সময় বিছানায় কাটিয়ে দেন। বড় ভাইয়ের এক ছেলে এবার দ্বিতীয় শ্রেণীতে আর ছোট ছেলেটা এবার স্কুলে ভর্তি হবে। আর মেজো ভাইয়ের একটাই মেয়ে, তিন বছর বয়স। এই কয়জন মানুষ নিয়ে রাবেয়া আন্টির সংসার। মেয়ে দুটোর বিয়ে হয়েছে দূরেই, আনাগোনা কম চলে। তাই বড় মেয়ে শান্তার ঘরে থাকতে দেয়া হলো বাহারকে।

রাত হয়ে যাওয়ায় বাহারকে দ্রুত খেতে দেয়া হলো। এ বাড়ির লোকজন সাড়ে দশটা বাজলেই ঘুমের আয়োজন শুরু করে। তাই নয়টার মধ্যে খাওয়ার পর্ব শেষ করেন তারা। বাহারও খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ বারান্দায় সময় কাটালো। বারান্দার সামনে সবজির বাগান। তার সামনে রাস্তা দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সাইকেলের যাতায়াত দেখা যাচ্ছে, হয়তো দোকান বন্ধ করে বাজার থেকে লোকজন ছুটছে ঘরের দিকে। বারান্দার লাইট বন্ধ করে বাহার মেঝের উপর বসে আছে। গ্রামের দৃশ্য কাছ থেকে অনুভব করার প্রশান্তিই অন্যরকম।

– এমা, মাটির উপর বসছো কেন? দাঁড়াও পাটি আনতাছি।

রাবেয়া আন্টি কিছুটা গ্রামীন আর শহুরে ভাষার মিশেলে কথা বলছেন। যেমন, তিনি ‘এখানে’ কথাটা ‘অ্যানো’ উচ্চারণ করেন। আবার কাউকে সম্বোধন করলে বলেন, ‘হ‍্যায় এই কাম করতাছে।’ কিন্তু বাহারের সাথে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করছেন তিনি। নাহলে বাহারের কথা বুঝতে কষ্ট হবে। বাহারের ভালোই লাগছে শুনতে। মন খারাপের এই সময়টায় এই মানুষগুলো যেমন উপকার করছে তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আপন মানুষগুলোও করে না।

রাবেয়া মাদুর এনে মেঝের উপর বিছিয়ে বললেন, ‘এখানে বসো।’ বাহার মুচকি হাসলো। রাবেয়া যতটা পারা যায় শুদ্ধ বলার চেষ্টা করছেন, ‘তোমার ফুপি, আমার বান্ধবী লাগে। ফোন দিছিলো আজকে। কাহিনী কি ক… বলো তো।’

বাহার অবাক হয়ে বললো, ‘ফুপি বলেনি আপনাদের?’

– হ্যাঁ বলছে তো। ভালো কইরা বলতে পারে নাই। তোমার আম্মা আব্বার ভয় করতেছিল। বলতেছিল তুমি বিপদে পড়ছো। তোমার স্বামী নাকি আল্লাহ বিশ্বাস করে না।

বাহারের মন আবারো ভার হয়ে এলো। রাবেয়া তার গালে হাত রেখে বললেন, ‘ঠিক কইরে কও তো মা। কি হইছে আসলে?’

বাহার সংক্ষেপে পুরো ঘটনা তুলে ধরলো। রাবেয়া খুবই চিন্তিত এবং বিস্মিত। হানজালার প্রতিক্রিয়া তাকে বিস্মিত করেছে, কীভাবে তিনি মেয়েকে একজন অবিশ্বাসীর সাথে সংসার করতে বলেন? রাবেয়া বাহারের দিকে তাকালেন। তার মাঝে মাতৃত্ব জেগে উঠছে, মায়া ভরা কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘কি বিপদ আইলো তোমার! অহন কি হইবো? তোমারে নাহয় আমরা থাকতে দিলাম, তুমি যতদিন চাও ততদিন থাকতে পারবা মা। আমগো কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু ওই পোলাডা তালাক দিব তো?’

বাহার রাবেয়ার হাতে হাত রেখে বললো, ‘বিপদ বলে মনে করছি না আন্টি। এই বিপদে না পড়লে আমি আল্লাহর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেতাম না। সিয়ামের পরিবারে আমার পর্দা করা খুব কঠিন হয়ে যেতো। আজ ফুপির বোরখা পরে এসেছি। আলহামদুলিল্লাহ, এতো শান্তি পেয়েছি! আর সিয়াম তালাক দিতে বাধ্য হবে। কারণ ওর বাড়ি থেকে আমি পালিয়ে এসেছি এক প্রকার। এই কারণে ওর পরিবারের লোকজন আমাকে দ্বিতীয়বার মেনে না নেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সমাজে ওদের মুখ দেখানোর জায়গা থাকলো না। এসব ভাবলে নাহার আন্টি আমাকে আর গ্রহণ করবেন না, তিনিই সিয়ামকে চাপ প্রয়োগ করবেন। ইন শা আল্লাহ।’

রাবেয়া আশ্বস্ত হলেন, ‘ইন শা আল্লাহ। তাই যেন হয়। তুমি অনেক কষ্ট করছো আজ। ঘুমায় যাও তাড়াতাড়ি।’

রাবেয়া চলে গেলেন। রাত এখন প্রায় এগারোটা। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সুবহা ভাবি এসে একবার কথা বলে গিয়েছেন। মেজো ভাবি খুশি এসে দেখা করে গিয়েছেন। তিনিও বেশ মিশুক মনের মানুষ, যাওয়ার আগে বলেছেন, ‘কাল ভালো করে কথা বলবো। আজ আপনি বিশ্রাম নিন।’ এ বাড়ির সবাইকে ভালো লাগছে বাহারের। পুরুষ সদস্যরা একবারও তার খোঁজ নেয়নি, মহিলারা আপনজনের মতো। তবু বাহারকে বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। তার কাছে যথেষ্ট টাকা আছে। ওটা দিয়ে নতুন ভাবনা ভাবতে হবে, এভাবে অন্যের বাসায় বিনা পয়সায় থাকা আত্মসম্মানে আঘাত করে। হোক সে মেহমান।

কেমন পরিবর্তন এলো বাহারের জীবনে! ছোট থেকে যেই বাহার গান শিখে বড় হয়েছে সে আজ কণ্ঠের পর্দার ব্যাপারেও সচেতন হতে চাইছে। যেই বাহারের জীবনে কখনো কোনো বিষয়ে অভাব দেখা দেয়নি, সেই বাহার আজ একটা আবাসের অভাবে আশ্রয় খুঁজে চলছে। এসবই তার দ্বীন ইসলাম পালনের উদ্দেশ্যে। বাহার জানে, নিশ্চয়ই এতে কল্যাণ রয়েছে।

মধ্য রাতের সময়টা অশ্রু ঝরানো বার্তার সাথে চললো। মুসাল্লার উপর শুয়ে বাহার কেঁপে কেঁপে উঠছে। কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এসেছে তার, নয়ন জোড়ার ভাষা দ্বারাই সে ধরিত্রীর একমাত্র অধিপতির কাছে আবেদন পেশ করছে। এ সময় একান্তই তার, এ সময় অনুভবের।

________

রাধিকার সাথে সাদি অনেকটা সময় কাটালো আড়ং এর নিজস্ব রেস্তোরাঁয়। সে তার মায়ের জন্য ভ্যানিটি ব্যাগ, একটা মসলিন কাপড়ের শাড়ি আর একটা জুয়েলারি বক্স কিনেছে। রাধিকাকে কোনো কেনাকাটা করতে হয়নি। তিনিও ছেলের জন্য পাঞ্জাবি আর মানিব্যাগ কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাদি অনেক বাধা দিয়েছে এসব কিনতে। তিনি তবু একটা পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছেন। সাদি আর মানা করতে পারেনি।

দুজনে কফি অর্ডার করে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় গল্পে মেতে উঠলো। রাধিকা বারবার ছেলেকে দেখছেন। দাড়ি ভর্তি চিবুক আর মুচকি হাসিটা কেমন অচেনা। প্রিয়ংশু আর সাদির মাঝে বিশাল তফাৎ। সেটা বেশভূষা ও আচরণ, উভয় দিক থেকেই। প্রাণ চঞ্চল ছেলেটা এখন উচ্চস্বরে হাসে না, মুচকি হেসে কথা বলে। গুরুগম্ভীর স্বভাবের সাদি আর শিশুসুলভ প্রিয়ংশুর সকল কিছু মাঝে বিস্তর পরিবর্তন দেখে রাধিকা চোখের পলক ফেলতে পারছেন না।

সাদি মাকে একমনে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসে বললো, ‘কি দেখছো মা? আমি তোমার ছোট্ট প্রিয়ই আছি। এতো চিন্তা করতে হবে না। সবাইকে ভুলে গেলেও তোমাকে ভুলবো না।’

রাধিকা অন্যায় আবদার করলেন, ‘তাহলে মায়ের কথায় তুই আবার হিন্দু হয়ে যাবি প্রিয়?’

হাসি থেমে গেল সাদির। মুখ গম্ভীর করে সে কফির কাপে এক চুমুক দিলো। রাধিকা অনুনয় করে বললেন, ‘প্রিয় বাবু আমার, তুই হিন্দু হয়ে গেলে সব সমস্যা মিটে যাবে। আমাদের আগের সংসার ফিরে আসবে। আমাদের জীবন আগের মতো রঙিন হয়ে যাবে।’

সাদি বলে উঠলো, ‘আমি সর্ব প্রথম আল্লাহকে ভালোবাসি। তাঁর দ্বীন থেকে বের হওয়ার মতো দুর্ভাগ্য যেন আমার কোনোদিন না আসে। মা, আমি যদি বলি আমি তোমার প্রিয় ছেলে। তুমি হিন্দু থেকে মুসলিম হয়ে যাও, আমার সাথে থাকো। তাহলে তুমি হবে মা?’

রাধিকা বিরক্ত হলেন, ‘কি যে বলিস! আমার সংসার আছে, আমার একটা সমাজ আছে।’

সাদি মুচকি হেসে বললো, ‘তারমানে তোমার ধর্ম খুব বেশি ঝামেলা করবে না, সমাজ যতটা করবে।’

রাধিকা থমকে গেলেন। ইতিমধ্যে কাজু বাদামের সালাদ এসে পড়েছে। তিনি এক চামচ মুখে নিয়ে খেয়ে বললেন, ‘এসব কথা বাদ দে এখন। যার জন্য তোর সাথে দেখা করতে পারলাম সেই মেয়েটাকেই তো দেখলাম না। ফোন দিয়েছি একবার, ফোন বন্ধ বললো।’

সাদি এবার মূল প্রশ্নে আসলো, ‘আচ্ছা, ওই মেয়েটার সাথে তোমার পরিচয় হলো কিভাবে?’

– জানি না সে কীভাবে আমার নাম্বার পেয়েছে। একদিন ফোন করে বললো সে নাকি তোর সাইকোলজিস্ট।

সাদি চোখ বড় বড় করে বললো, ‘কত বড় মিথ্যে কথা!’

রাধিকা দ্রুত শুধরে নিলেন, ‘মিথ্যে নয়, মেয়েটা ঠিকই বলেছে হয়তো। আমিই ভুল করছি। ঐযে, ক্রিমিনাল সাইকোলজি না কি যেন বলে? মেয়েটা নাকি চাকরিও ছেড়ে দিয়েছে। আমাকে বললো তোর সাথে দেখা করাতে পারবে না। এরপর আমি জোরাজুরি করতেই বললো আড়ং এ চলে আসতে।’

সাদি বললো, ‘কোনো রেস্টুরেন্টের নাম বলেনি, এটাই ভালো করেছে। নাহলে আমার সমস্যা হয়ে যেতো।’

– মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছে তোর?
– হুম।
– কোথায় রে? আমি একটু দেখবো। যার জন্য এখানে তোকে দেখতে পেলাম সেই নেই। আবার ফোনও বন্ধ।
– বাদ দাও মা। হয়তো চাইছেন না দেখা হোক।
– তা কেন হবে?
– আহা বাদ দাও না মা। পরে দেখা করে নিলেই হবে।

রাধিকা আর কথা বাড়ালেন না। মাগরিবের আযান দিয়ে দেয়ায় সাদি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘মা, তুমি যদি পারো তাহলে পনেরো মিনিট অপেক্ষা করবে? আমি সালাত পড়ে আসি। পাশেই মসজিদ আছে।’

রাধিকার মুখ ভার হয়ে এলো, ‘নারে, এখন আর সময় নেই। আমাকে যেতে হবে। তোর বাবা মনে হয় বাসায় চলে এসেছে এতক্ষণে।’

সাদি মলিন হেসে বললো, ‘তাহলে আর কি! আবার দেখা হবে ইন শা আল্লাহ।’ সে জড়িয়ে ধরলো তার মাকে। রাধিকা আবারো অশ্রু ঝড়ালেন। সাদি তার মায়ের দু চোখ মুছে দিয়ে বললো, ‘মা, তুমি যদি মুসলিম হতে তাহলে এই পৃথিবীতে আমার চাওয়ার আর কিছু থাকতো না। শুধু আল্লাহর ভালোবাসা চাই আমি, আর তোমার হিদায়াহ।’

রাধিকা বললেন, ‘জানি না কোনটা সত্য। তবে আমিও চাই সত্য চিনতে। আমার ছেলেটা এতো কষ্টের পরও যেই ধর্ম ছাড়েনি, সেই ধর্ম সম্পর্কে আমিও জানতে চাই।’

সাদি খুশি হয়ে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আমি অনেক দুআ করবো মা। আজ আসি? সাবধানে থেকো।’

____________

হানজালার মাথায় পানি ঢালছে গৃহকর্মী রেবা। তিনি বিড়বিড় করে কথা বলেই যাচ্ছেন। নাজ নিজের ঘরে বসে আছে। এমন পরিবেশ কোনোদিন তৈরি হয়নি এ বাসায়। এই প্রথম এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে নাজের ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে বাহারের মতো দূরে চলে যেতে। কিন্তু এতে আরো বিপদ বাড়বে। সাখাওয়াত নিজের ক্ষমতা বলে চব্বিশ ঘন্টা না যেতেই থানায় জিডি করেছেন। সিয়ামের বাবা ফোন করে বাহারকে গ্রহণ করবেন না বলে জানিয়েছেন। এরপর থেকে হানজালার প্রেসার বেড়ে অসুস্থতার শুরু। ওষুধ খেয়েও অস্থিরতা কমছে না। ডাক্তার এসে দেখে গিয়েছে। তবু তিনি মাথায় পানি ঢালছেন।

সালমাকে জেরা করা হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত লজ্জিত বোধ করায় সুনামগঞ্জে তার স্বামীর পৈতৃক ভিটায় ফিরে যাওয়ার কথা তুলেছেন। ওখানে কেউ থাকে না, বাড়িটা এক দম্পতির কাছে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন তিনি। বয়স বেড়েছে, তাকে দেখাশোনার অভাব হওয়ায় সাখাওয়াত নিজের কাছে রেখেছেন। কিন্তু তিনি আর থাকতে চাইছেন না। দরকার হলে একাকী মরবেন, তবু এতো অপমানের মাঝে থাকবেন না বলে জানিয়েছেন।

একদিকে মেয়ে পলাতক, আর অন্যদিকে বোনের জেদ সাখাওয়াতের শরীরকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে। তিনি অল্প হলেও দ্বীনের জ্ঞান জানেন। মেয়ের আপত্তি সম্পর্কে তিনি অবগত। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেয়ে আসলে সিয়ামের সাথে ডিভোর্সের ব্যাপারে সম্মতি জানাবেন। আগে মেয়েটাকে খুঁজতে হবে। মান সম্মানের চেয়ে মেয়ের নিরাপত্তা তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

হানজালা বকেই যাচ্ছেন, ‘আমার মেয়েটা এমন ছিল না। চাকরি ছেড়ে দিলো, আনস্মার্ট হয়ে গেল। হিজাব পরে বিয়ে করতে চাইলো! এখন আবার কি সব বলছে ও আল্লাহ! কার কথায় ওর এই দিন আসলো আল্লাহ!’

সালমা এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শুনেই এ বাড়ি ছাড়তে চেয়েছেন। একবার বলতে চেয়েছিলেন, ‘কার কাছে বিচার দিচ্ছ হানজালা? যার নিয়মের বিরোধিতা করছো তুমি?’ কিন্তু তিনি এমনিতেই সকলের দৃষ্টিতে অপরাধী। এ বাড়ি ছাড়ার আগে তিনি আর কোনো ঝামেলা বাড়াতে চান না।

পুরো এক দিন পার হয়ে গেল, বাহারের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। সালমা আজ চলে যাবেন। সাখাওয়াতকে আগেই বলে রেখেছেন। তার ননদ ঢাকায় এসেছিল, সেই ননদের সাথেই তিনি সুনামগঞ্জ চলে যাবেন। নিজের স্বামীর ভিটায় থাকবেন।

সকাল সকাল তৈরি হয়ে বের হলেন সালমা। সাখাওয়াতের কাছে গিয়ে বিদায় নেয়ার সময় হানজালা ফুঁসে উঠলেন, ‘কি ব্যাপার? অকাজ করে এখন বিদায় নিতে আসছেন কেন? আপনি আমার মেয়ের সন্ধান দিয়ে তবেই যাবেন।’

সাখাওয়াত থামালেন, ‘থামো তো! আপা চলে যাচ্ছেন, এই সময় এগুলো বলতেই হবে তোমার?’

– বলবো না কেন? এই মহিলার জন্য আমার মেয়েটা কেমন বদলে গেল! কত ভালো মেয়ে আমার, পালিয়ে যাওয়ার সাহস কীভাবে পেলো সে?
– থামো বাহারের মা। আর কথা বাড়িও না।

সালমা কেঁদে ফেললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমরা। আমি সত্যিই পারছি না এখানে থাকতে। অনেকদিন জ্বালিয়েছে। দুআ করি বাহার ফিরে আসুক। ভালো থেকো।’

সালমা চলে গেলেন। বাড়িটা নিথর মরুভূমিতে পরিণত হলো।

________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here