ধৈর্য,১৪,১৫

0
496

ধৈর্য,১৪,১৫
Tahmi_Chowdhury
১৪
:
-হুম প্রিয়ন্তির বাবা!
ঠিকই বলেছেন ছেলেটা ভীষণ ভালো……ওর বিষয় আমি খুঁজ খবর নিয়েছিলাম!
এই বলে হালকা হাসলেন অনিতা……
বিজয়বাবু চশমাটা মুছে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,,
-তা আমার দ্বীপকে দেখেই বুঝেছিলাম।
ছেলেটা লন্ডন থেকে এসেছে তারপর ও ওর মাঝে কোন অহংকার বা উগ্র কোন ভাব দেখতে পাই নি!
সচরাচর বড়লোকরা অহংকারী হয়!
কিন্তু দ্বীপের ফ্যামিলিটা একদম আলাদা!
মেয়েটা আমার দ্বীপের কাছে ভালোই থাকবে!
স্বামীর পাশে বসতে বসতে অনিতা বললেন,,,
-সেদিন যদি দ্বীপের মায়ের সাথে এক্সিডেন্টিলি দেখা হতো না তাহলে হয়তো দ্বীপের মতো এমন ছেলেকেও আমরা পেতাম না!
দ্বীপের মা আমার আপন বোন না হলেও আপনের থেকে কম কিছু নয়……
-হু ঠিকই বলেছো,,,কে এমন আছে বলো!
সেদিন হয়তো রক্তের অভাবে তুমি মারাই যেতা…
কিন্তু হঠাৎ করেই দ্বীপের মা আর রক্ত দেওয়া সবকিছু অলৌকিক লাগছিলো!
আর এখন প্রিয়ন্তিকে নিজের ছেলের জন্য……
সত্যি উনারা বড্ড বড় মনের মানুষ!
আগের দিনের স্মৃতি বিজড়িত কথা মনে করতে করতে অতীতে হারিয়ে গেলেন অনিতা………
★★
-আমি এই বিয়ে করতে পারবো না……
সদ্য টুকটুকে লাল কাপড় গায়ে জড়িয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে প্রিয়ন্তির কথা শুনে উপস্থিত সকলে হুরমুড়িয়ে দৃষ্টি ছুড়ে দিলেন প্রিয়ন্তির দিকে!
অনিতা মেয়ের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তখনো তাকিয়ে আছেন……
তিনি যেন জানতেন এমন কোন কিছুই ঘটবে।
এক হাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে বিছানার একপাশে জড়ো হয়ে বসা প্রিয়ন্তির গলা কাঁপছে।
কাঁপাকাঁপা ঠোঁটে দাঁত দিয়ে কামড়ে আবার বললো প্রিয়ন্তি……
-আমি এই বিয়ে করতে পারবো না!
দ্বীপ আমার জন্য হারাম!
ওর সাথে আমার বিয়ে সম্ভব নয়!
প্রিয়ন্তির দৃঢ় আর ঝটপট কথাগুলো উপস্থিত প্রিয়ন্তির মা,,বাবা,,ভাই,,
আর প্রিয়ন্তির হবু শাশুড়ির হজম হতে কষ্ট হচ্ছিলো বটে!
প্রিয়ন্তি দম নেয়,,,আবার মুখ খুলতে চায়……
কিন্তু পারে নি,,তার আগে হুড়মুড়িয়ে বিছানারা এক কোণোয় সজোরে মাথা লেগে যায় কারো আঘাতে!
মুখের উপর থেকে ঘোমটা সরে গিয়ে প্রিয়ন্তির উজ্জ্বল বর্ণের গড়ন দৃশ্যমান হলে সে দেখতে পায় বাবা বিজয়বাবু রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে প্রিয়ন্তির দিকে ঝুকে আছেন……
গলা কাঁপিয়ে বলে প্রিয়ন্তি……
-বাবা আমি মুসলিম!
আর একজন মুসলিমের সাথে অমুসলিমের বিয়ে অসম্ভব!
এ হতেই পারে না,,,এ হারাম!
এ জঘন্য অপরাধ! একজন অমুসলিমকে বিয়ে করে অবৈধ সম্পর্ক আমি গড়তে চাই না বাবা।
বাবা আমি………
পরপর দুটো চড়ের শব্দ শুনা গেলো,,,প্রিয়ন্তি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে!
মাথাটা কাজ করা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে তার!
নিথর চোখদুটি শুধু অবিশ্বাস্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে সামনের ব্যক্তিটির দিকে প্রিয়ন্তি!
মহেশ আবার মারতে উদ্ধত হলে অনিতা ছেলের হাত ধরেন করজোড় ভঙ্গিতে!
ছোট্ট ভাই মহেশের দিকে তখন নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে প্রিয়ন্তি!
যে ছোট্ট ভাইটার হাত ধরে হাটতে শিখিয়েছে,,,
সেই ছোট্ট ভাই সেই হাত দিয়ে প্রিয়ন্তির গায়ে হাত তুললো আজ?
বাবা-মাকে রাতেই নিজের ইসলাম গ্রহণ করার বিষয়ে জানিয়ে দিয়েছিলো প্রিয়ন্তি!
বিজয়বাবু এটার শুনার পর পশুর মতো প্রিয়ন্তিকে মারেন আর একটাই শব্দই বলেন ইসলাম ত্যাগ করতে প্রিয়ন্তিকে……
প্রিয়ন্তি এতো মারের পর ও দমে যায় নি!
নিজের জানটা বেধে নিয়েছে সে!
কিছুতেই ইসলাম ত্যাগ করবে না সে……
ঘরে তখনো পিনপতন নীরবতা!
কালকে সব খুলে বলার পর ও জোড় করেই প্রিয়ন্তিকে বিয়ের আসরে বসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বিজয়বাবু!
অনিতা মেয়ের দিকে তাকিতে তখনো আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছেন!
মায়ের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ প্রিয়ন্তির কানে যেতেই বুক ফাটা আর্তনাদ ভেসে আসে ভেতর থেকে!
মাকে সে অনেক আগেই বলে দিয়েছিলো,,,
কিন্তু তিনি তো মা,,মেয়েকে কিছুক্ষণ ধমকিয়ে নিজেই দমে গিয়েছিলেন!
পরে আর ঘাঁটান নি প্রিয়ন্তিকে!
হয়তো মেয়ের জেদকে মেনে নিয়েছিলেন তিনি……
মেয়ের সাথে মাঝে মাঝে ইসলামের অনেক বিষয় জানতে চাইলে প্রিয়ন্তি গড়গড় করে সব বলে……
অনিতা মেয়ের মুখে ইসলামের বুলি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেন……
এতোক্ষণে বাড়িতে উপস্থিত সকলের কাছে সংবাদ পৌঁছে গেছে প্রিয়ন্তির ইসলাম গ্রহণের কথা!
বিজয়বাবু মেয়ের আচমকা এমন ব্যবহারের হকচকিয়ে যান!
কারণ তিনি মনে মনে ভেবেছিলেন প্রিয়ন্তি হয়তো মানুষদের সামনে কোন কথা বলতে পারবে না……
কিন্তু প্রিয়ন্তি তো অনেক আগে থেকেই আল্লাহকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে নিয়েছে……
তাহলে আল্লাহর পথে অটল থাকতে এসব তো কিছুই না প্রিয়ন্তির……
প্রিয়ন্তির ইসলাম গ্রহণের খবর শুনে কয়েকজন ইসলাম বিদ্বেষী উপস্থিত মহিলা প্রিয়ন্তিকে মারতে উদ্ধত হলেও অনিতা থামিয়ে দেন……
“ইন্নাল্লাহা মায়াস সবিরিন(নিশ্চয় আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন)
ক্লান্ত প্রিয়ন্তি আয়াতটা বিড়বিড় করতে করতে জ্ঞান হারায়……
মেয়ের শিয়রে দৌড়ে গিয়ে বসেন অনিতা………

চারদিকে চোখ বুলিয়ে হুরমুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসতেই কিছু একটার সাথে পায়ে টান খায় প্রিয়ন্তি……
আধোআধো মনে করার চেষ্টা করে প্রিয়ন্তি……
সে চুপি চুপি ঘরের মেইন ডোর খুলেছিলো,,,
হ্যাঁ সে পালাতে চেয়েছিলো,,তারপর আবার জ্ঞান হারায়………
পায়ের দিকে তাকায় প্রিয়ন্তি নিজেকে ঝিঞ্জির এর সাথে আটকে থাকতে দেখে ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠে…

বিয়েটা সেদিন ভেঙ্গে গিয়েছিলো,,,
দ্বীপ সেদিন প্রিয়ন্তির ইসলাম গ্রহণের খবর শোনে ছুটে এসেছিলো প্রিয়ন্তির কাছে!
জ্ঞান হারা প্রিয়ন্তিকে দেখেছিলো সেদিন দ্বীপ।
নিষ্পাপ লাগছিলো নিস্তেজ প্রিয়ন্তিকে,,,,বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছিলো দ্বীপের!
একমুহূর্তের জন্য প্রিয়ন্তিকে ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছে জেগেছিলো তার!
সেদিন মনটা চেয়েছিলো প্রিয়ন্তির সাথে সেও মুসলিম হয়ে যেতে!
কিন্তু পিছুটান,,ফ্যামিলির করুণ চাহনি বারবার চেহারায় ভেসে আসছিলো……
চোখ নামিয়ে প্রিয়ন্তির থেকে শেষ বিদায় নিয়েছিলো দ্বীপ।
প্রিয়ন্তিকে নিজের করে পাবার ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দিয়ে বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়ে একেবারে এয়ারপোর্টে চলে এসেছিলো দ্বীপ……
বিয়েটা শেষ পর্যন্ত আর হয়নি……
.
গলাটা শুকিয়ে কাট হয়ে যাচ্ছে……রুমের চারিদিকে পানির ছিটেফোঁটা ও দেখতে পাচ্ছে না প্রিয়ন্তি!
নিজেকে বড্ড অভুক্ত লাগছে,,,এখন খাবারের বড্ড প্রয়োজন!
জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে পেটে হাত বুলালো প্রিয়ন্তি……
দরজায় ছ্যাত করে আওয়াজ হলে সেদিকে ফিরে তাকালো প্রিয়ন্তি!
আওলা চুল,,টকটকে লাল চোখের মহেশকে দেখে রীতিমতো ভয় পেয়ে যায় প্রিয়ন্তি!
ছোট্ট ভাইটিকে প্রিয়ন্তি এখন বড্ড ভয় পায়!
ছোট্ট ভাইটার হাত বড্ড শক্ত হয়ে গিয়েছে,,,মারটা বড্ড জোরেশোরেই লেগে যায়……
মহেশ এসে প্রিয়ন্তির পায়ের কাছে বসলো,,,
পা টা গুটিয়ে নিতে চাইলে মহেশের হাতে পা বাধা পড়লো প্রিয়ন্তির!
চোখে টলমল পানি নিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে বললো মহেশ……
-আপু তুমি কেন এমন করলে……
আর আমি তোমাকে আপু আমি তোমাকে এই হাত দিয়ে……
কথা শেষ করতে পারে না মহেশ……
কান্নাগুলো গলায় দলা পাকাতে শুরু করে!
ভাইয়ে মাথায় আলতো করে দুর্বল হাতটি রাখে প্রিয়ন্তি!
বোনের হাত জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দেয় মহেশ……
কান্নারত মহেশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে প্রিয়ন্তি!
ছোট্ট ভাইটিকে ফিরে পেয়েছে প্রিয়ন্তু……

-তোকে নিজের সন্তান বলতেও ঘেন্না হয়!
দুদিন ধরে না খেয়ে পড়ে আছিস,,মরিস না……
নিজের জন্মদাতা পিতার মুখ থেকে এমন বুলি শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় প্রিয়ন্তি!
কথা বলার ভাষা হারিয়ে বাবার দিকে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে শুধু!
অনেক সময় ধরে মেয়েকে মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে বসে মেয়েকে এই কথাটি বললেন বিজয়বাবু!
কথা বলতে পারছে না প্রিয়ন্তি,,,
অস্পষ্ট সুরে তবুও কথার বুলি উঠায় সে……
-বাবা!
যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদের ডাকে,ওরা তো কোন কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না;
বরং ওরা নিজেরাই অন্যের দ্বারা সৃস্টি হয়।(আন নাহল-২০)
:আমি কি আল্লাহকে ছেড়ে অন্য কোন রব অন্বেষণ করব? অতচ তিনিই সব কিছুর রব।
যে যা করে তা তারই উপর বর্তায় এবং কেউ অন্যের বোঝা বহন করবে না। অবশেষে তোমাদের প্রত্যাবর্তন তোমাদের রবের কাছে, তারপর তিনি তোমাদের জানিয়ে দিবেন হে বিষয়ে তোমরা মতভেদ করতে।
(সূরা:আন’আম-১৬৫)
কোরআনের আয়াতগুলো শেষ করে ক্লান্ত দৃষ্টি দেয় বাবার দিকে প্রিয়ন্তি!
বিজয়বাবু মেয়ের শুকনো মুখ দেখে ভেতরটা গলে না!
তিনি আবার ও ক্ষোভ নিয়ে প্রিয়ন্তির গায়ে হাত তুলতে যান …
কিন্তু মাঝপথে বাবাকে থামিয়ে দেয় মহেশ!.
বাবার হাত থেকে বাশের কেল্লাটা নিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় ভরে নেয়!
ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসে প্রিয়ন্তি!
বিজয়বাবু ছেলের দিকে ক্ষুদ্ধ হয়ে চেয়ে থাকেন……
মহেশ বাবাকে ঠেলে বাহিরে পাঠিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়!
প্রিয়ন্তি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,,,
-আমি মাগরিবের নামাজটা পড়বো মহেশ!
আমার পায়ের বাঁধনটা খুলে দে……
বোনের এমন কথায় ক্ষোভ ঝড়ে পড়ে মহেশের!
নিজেকে সামলে হাতের বাশের টুকরারে শক্ত করে চেপে ধরে……
-তোকে এই পথের দিক কে দেখিয়েছে আপু!
তুই কেন এই পথে……
প্রিয়ন্তি মুখ উজ্জ্বল করে বলে,,,
ﻭَﻭَﺟَﺪَﻙَ ﺿَﺎﻟًّﺎ ﻓَﻬَﺪَﻯٰ
তিনি আপনাকে পেয়েছেন পথহারা, অতঃপর পথপ্রদর্শন করেছেন।
(সূরা আদ-দুহা আয়াত:৭)
বোনের এমন কথা মহেশের পাগলামো বার্তা মনে হয়!
নিজের রাগটাকে হয়তো দমিয়ে রাখতে না পেরে আবারো অবাধ্য হাত উঠে যাবে বোনের উপর,,
তাইতো একঝিড়ি রাগ নিয়ে নীরবে রুম ত্যাগ করলো মহেশ………
প্রিয়ন্তি সিজদায় পড়ে রইলো,,,
রাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলো প্রিয়ন্তি……
সে দেখলো,,
কেউ একজন তার মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন!
মানুষটার মুখ চাঁদের থেকেও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিলো……
ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রিয়ন্তির সমস্ত শরীরে এক আনন্দের অনুভূতি ছেয়ে গেলো প্রিয়ন্তির!
কে ছিলো এই মানুষটা?
ঘড়ির দিকে তাকায় প্রিয়ন্তি,
ঘড়িতে রাত ৩ টা বেজে ১৫ মিনিট……
★★
-মা ও মা,,,আজ তিনদিন হলো তোমাকে দেখিনা,,
মা তোমার মেয়েটা অভুক্ত হয়ে আছে আজ তিনদিন……
মা……
আর্তনাদ করে উঠে প্রিয়ন্তি!
.
অনিতা হাতে কিছু রুটি আর সবজি নিয়ে মেয়ের ঘরে চুপিচুপি আসেন!
মাকে দেখে প্রিয়ন্তি শুকনো মুখে হাসে!
অনিতা চুপচাপ মেয়েকে ধরে শোয়া থেকে উঠে বসান!
মেয়ের নিথর দেহটা দেখেই বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠে অনিতার……
মায়ের হাতে রুটি আর সবজি খেয়ে পানি খেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় প্রিয়ন্তি!
অনিতা নীরব হয়ে কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করে বুকে জড়িয়ে নেন!
মায়ের বুকে মাথা দিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দেয় প্রিয়ন্তি……
-মা আমার বাঁধনটা খুলে দিয়ে নিজের উপর বিপদ টেনে এনো না মা………
অনিতা মেয়ের বারণ শুনেন না!
চুপচাপ ঝিঞ্জিরটা খুলে দিয়ে মেয়ের মাথায় আদরের চুমো খেয়ে বলেন,,
-চলে যা মা!
জানিনা তুই কোথায় যাবি,,কিন্তু চলে যা………
এই নে এখানে টাকাগুলো,,যেখানে যাবি দূরে যাস!
-মা……
মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে বলেন অনিতা!
-এখানে থাকলে ওরা তোকে মেরে ফেলবে রে মা!
আর আমি জানি তুই মরতে প্রস্তুত হবি কিন্তু ইসলাম ত্যাগ করবি না,,
মা রে এই মা টাকে আর কষ্ট দিস না,,,চলে যা মা………
.
.
১৫
:
অনিতা মেয়েকে প্রায় ঠেলে বাইরে বের করে দিয়ে ধপাস করে দরজা আটকে দিলেন……
আর্তনাদ করছে প্রিয়ন্তি……
-মা ও মা,,, আমি তোমাকে ছাড়া কেমনে থাকবো গো মা……মা এমন করো না,,
মা ও মা……
মেয়ের আর্তনাদ কলিজায় গিয়ে লাগছে অনিতার!
শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কান্না করে যাচ্ছেন অনিতা!
প্রায় অনেকক্ষণ দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলো প্রিয়ন্তি!
তারপর চোখমুখ শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো……!
আস্তে আস্তে বাড়ির বড়ো উঠোনটা পেড়িয়ে গেইটের বাহিরে চলে এলো প্রিয়ন্তি!
মায়ের মুখখানি আরো একবার দেখার জন্য পেছনে তাকালো প্রিয়ন্তি!
অনিতা জানালার পর্দার আড়াল থেকে মেয়েকে পরখ করছিলেন,,প্রিয়ন্তি পেছনে তাকাতেই জানালার পর্দাটা ছেড়ে দিলেন!
তিনি চান না অনিতা আর মায়া বাড়াক,,কোন পিছুটান আর দিতে চান না মেয়েকে……
চোখের সামনে মেয়েকে মরতে দেখতে পারবেন না তাইতো এই সিদ্ধান্তটটা নিয়েছেন অনিতা!
চোখের জলধারা চিবুক বেয়ে পড়তে লাগলো প্রিয়ন্তির!
কোথায় যাবে কি করবে কিচ্ছুটি ভেবে পাচ্ছে না সে……
মাথার উপর সূয্যিমামার কড়া রোদে মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো প্রিয়ন্তি!
একে তো দুর্বল তার উপর প্রখর রোদ!
আস্তে আস্তে হাটতে লাগলো প্রিয়ন্তি!
কোথায় যাবে এখনো ঠিক করতে পারছে না প্রিয়ন্তি”
-বাবা আপুকে হয়তো বিয়ে দিয়ে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে,,,এই পাগলামো জেদটাও ছুটে যাবে!
আর আমাদের দুর্জয় তো সব শুনেই আগ্রহ দেখালো……
হাটতে হাটতে কথাগুলো শুনে থমকে দাঁড়ালো প্রিয়ন্তি……
পাশ ঘেষে বাবা ভাইকে যেতে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছে সে!
যাক তাকে তো ওরা চিনতেই পারে নি,,,
স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারলো না প্রিয়ন্তি!
ওখানে মা,,,মাকে যদি ওরা প্রশ্ন করে!
আমায় যদি খোঁজে, মা কি উত্তর দিবে?
আমি কি ফিরে যাব!
মাকে যদি ওরা……
ভাবতে পারছে না প্রিয়ন্তি,,
পেছন ফিরে আবারো জোরেশোরে হাটা ধরলো।
কিছুতেই মাকে বিপদে ফেলতে পারবে না প্রিয়ন্তি!
.
-মা আমি তোমাকে কতোবার করে বলছি আমি এখন বিয়েটা করছি না,,,প্লিজ মা আমাকে একটু সময় দাও!
মেহরাবের এমন কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না রেহনুমা বেগম!
তিনি ছেলেকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত!
এভাবে কতোদিন বয়স তো আর কম হচ্ছে না ছেলের।
যতো চিন্তা আমারই!
-তুই এবারো আমার কথা রাখবি না তাই তো……
কটমট করে বললেন রেহনুমা!
মেহরাব মায়ের দিকে মায়াভরা দৃষ্টি দিলো,,
মায়ের হাত মুহূর্তেই মুঠোভরে বললো মেহরাব,,
-মা আমায় কয়েটা দিন সময় দাও প্লিজ।
এবার ইন শা আল্লাহ নিরাশ করবো না তোমায়।
সবকিছুর একটা প্রস্তুতি দরকার মা!
হঠাৎ করেই তো কোনকিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।
আর যেখানে বিয়েটা পুরো একটা জীবনের প্রশ্ন।।
এখানে তাড়াহুড়ো করে তো সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না মা।
নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে দাও মা!
মাদ্রাসার কাজগুলো ও একটু গুছিয়ে নেই।
বিয়ে করলেই তো দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না মা!
বিয়ে মানে দায়িত্ব বেড়ে যাওয়া।
যে আসবে তার ভরণপোষণের সঠিক দায়িত্ব যদি আমি পালন করতে না পারি তাহলে আমাকে তো আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে মা।
রেহনুমা মুচকি হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলালেন।
মাকে মানাতে পেড়েছে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো মেহরাব!
এবার একটা সিদ্ধান্তে সত্যিই পৌঁছাবে সে!
অতীত হাতরানো তো অনেক হলো…
হঠাৎ করেই সেদিনের সারাহর কথাগুলো মনে পড়লো মেহরাবের।
মায়ের দিকে ফের তাকালো মেহরাব,,
রেহনুমা তখনো চিন্তিত হয়ে কি যেন ভেবে চলছেন,,,
মায়ের দিকে তাকিয়ে কপালে হালকা ভাজ সাথে ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো মেহরাব…

অজানা পথে হেটে চলছে প্রিয়ন্তি!
বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেও শেষ পর্যন্ত আবারও ফিরতে হলো প্রিয়ন্তিকে!
মা তাকে আসার সময় বলেছিলেন যদি সে আবার ফিরে আসে তাহলে মাকে চিরতরে হারাবে……
কথাটি মনে পড়তেই আর এগুতে পারলো না প্রিয়ন্তি,,
পা টাও থমকে গেলো মুহূর্তেই……
একরাশ কষ্ট বুকে নিয়ে আবারো অজানা গন্তব্যপথ ধরলো সে!
প্রায় বিকেল হতে চললো,
কিন্তু এখনো কোন সিদ্ধান্তইই নিতে পারছে না প্রিয়ন্তি!
মোবাইলটা বের করে সারাহর নাম্বারে কল করলো প্রিয়ন্তি,,,কিন্তু বারবার দেখাচ্ছে নাম্বার বন্ধ……
কি করবে ভেবে পাচ্ছে না প্রিয়ন্তি!
আকাশের দিকে তাকিয়ে নিকাবের আড়ালে একফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলো প্রিয়ন্তি!
-এই মেয়ে এতোরাতে এখানে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছো কেন?
বাড়িঘর নেই……
চোখেমুখে পানির ছিটে পড়তেই ধড়ফড় করে স্টেশনের বেঞ্চ থেকে উঠে বসলো প্রিয়ন্তি!
কখন যে ট্রেনের অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারলো না প্রিয়ন্তি!
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ভয়ে চুপসে গেলো প্রিয়ন্তি!
প্রায় রাত হয়ে এসেছে……
সামনে থাকা ব্যক্তিটার রক্তচক্ষু দেখে আরো কুঁকড়ে গেলো প্রিয়ন্তি!
-আরে মেয়ে কথা বলছো না কেন?
প্রিয়ন্তি এবার মুখ তুলে তাকালো লোকটার দিকে,,
চশমা পড়া টগবগে যুবক,
ইয়া লম্বা,,,ছেলেটাকে দেখে রীতিমতো কাঁপছে প্রিয়ন্তি!
অজানা ভয়টা প্রখর ভাবে ঘিরে রেখেছে তাকে!
গলা দিয়ে আওয়াজটাও যেন বের করতে কষ্ট হচ্ছে!
এখন কি দৌড় দিবি প্রিয়ন্তি?
নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো প্রিয়ন্তি,,
-দৌড় দে না প্রিয়ন্তি,,রাত বেড়েছে ছেলেটা যদি তোকে……পালা প্রিয়ন্তি পালা!
কাদের ব্যাগটা দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরে যেই পেছনে ফিরে দৌড় লাগাবে ওমনি এক মাঝবয়সী মহিলা এসে সামনে দাঁড়ালেন প্রিয়ন্তির!
চোখের চশমটা ভালো করে নেড়েচেড়ে মহিলাটা প্রিয়ন্তির দিকে অবাক হয়ে তাকালেন,,
প্রিয়ন্তি এদিক ওদিক মাথা কাত করতে লাগলো,
কি করবে মাথায় কুলাচ্ছে না প্রিয়ন্তির!
মহিলাটি প্রিয়ন্তির পাশে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন,,
-তা মেয়ে তুমি এতো রাতে দৌড় দিতে যাচ্ছিলে কেন?
প্রিয়ন্তি ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে পেছনে ফিরে মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,,
-ইয়ে মানে আন্টি আমাকে বাঁচান,, উ…উনি…
হাত দিয়ে পেছনে ইশারা করলো প্রিয়ন্তি!
সত্যি প্রচণ্ড রকমের ভয় পেয়েছে প্রিয়ন্তি!
রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সামনি থাকা মহিলাটির মুচকি হাসি চোখ এড়ালো না প্রিয়ন্তির!
প্রিয়ন্তি ভাবছে,,
-আচ্ছা মহিলাটি হাসছে কেন?
আচ্ছা এরা পাচারকারী নয় তো? ওরা যদি আমায় ধরে নিয়ে যায়।
ইয়া আল্লাহ!
দৌড়ের প্রস্তুতি নিলো প্রিয়ন্তি…
তখনি মহিলাটি কোমলকন্ঠে বলে উঠলো,,
-আরে মেয়ে,,ও আমার ছেলে ভয় নেই।
তুমি এতো রাতে স্টেশনে পরে পরে ঘুমাচ্ছ দেখেই ও হয়তো তোমাকে জিজ্ঞেস করেছে,,,
আচ্ছা ট্রেন তো অনেক আগেই চলে গেছে,,কোথায় যাবে মা!
এতোক্ষণে মন থেকে ভয়টা উবে গেলো প্রিয়ন্তির!
অযথাই ভয়টা পাচ্ছিলো,,আর অদ্ভুত সব চিন্তা করে অস্থির হচ্ছিলো……
নিজের মনকে নিজেই ধমকে দিলো প্রিয়ন্তি।
মহিলাটি তখনো চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে আছেন……
প্রিয়ন্তি মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো,,
-কোথায় যাব এখনো ঠিক জানিনা আন্টি!
প্রিয়ন্তির উদাসীন উত্তর দেখে মহিলাটি চমকে উঠে প্রিয়ন্তির হাতে চেপে পাশের বেঞ্চিতে বসলেন,,,
যুবক ছেলেট তখনো বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে আছে!
-মা তুমি কি বাসা থেকে পালিয়ে টালিয়ে এসেছো না কি?
বুঝি রে মা বুঝি! এখনকার যা পরিস্থিতি এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক,,বরং না হলেই অস্বাভাবিক।
কিন্তু মা! এসব তো ঠিক না,,
মা-বাবাকে এভাবে ফেলে আসা তোমার একদম ঠিক হয় নাই মা!
উনারা তোমায় কত্ত কষ্ট করে বড় করেছেন, কতো স্বপ্ন উনারা তোমায় নিয়ে বুনে রেখেছেন,,এইভাবে উনাদের সম্মান মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারো না,,
দুদিনের আসা ছেলেটির জন্য নিজের জন্মদাতা পিতা-মাতাদের ছেড়ে চলে যেও না।
মা-বাবাকে সন্তান কষ্ট দিলে আল্লাহ সহ্য করেন না।
তুমি ফিরে যাও মা……
মহিলাটির দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে প্রিয়ন্তি বললো,,,
-আপনি যেটা ভাবছেন,,সেইরকম কিছুই না আন্টি!
মহিলাটি প্রিয়ন্তির কথার আগামাথা কিছু বুঝতে পারলেন না, ফ্যালফ্যাল নয়নে চশমার ভেতর থেকে তাকিয়ে রইলেন শুধু!
প্রিয়ন্তি পেছনে তাকিয়ে দেখলো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটি দূরে চায়ের দোকানের বেঞ্চটাতে বসে আছে!
প্রিয়ন্তি মাথা নিচু করে বললো,,
-আমি হিন্দু পরিবারের মেয়ে আন্টি,,,কিন্তু প্রায় কয়েক মাস আগে আমি ইসলাম গ্রহণ করি,,
এতে বাবা ভাই আমার উপর ক্ষেপে যান,,
আর সেই সুবাদেই আজ মা আমায় প্রায় ঠেলেই ঘর থেকে বের করে দিলেন।
কারণ চোখের সামনে কোন মা ই সন্তানের মরণ সহ্য করতে পারবে না……
প্রিয়ন্তির গলার স্বর ভারী হয়ে এলো……
মহিলাটি কি ভেবে প্রিয়ন্তির হাত জড়িয়ে ধরে বললেন,,
-যাবে মা আমার সাথে?
প্রিয়ন্তি অবাক হয়ে তাকালো মহিলাটির দিকে!
মহিলাটির চোখমুখ অজানা খুশিতে চিকচিক করছে,,
উজ্জ্বল হাসিখুশি মুখের পেছনে কি কারণ বুঝতে পারলো না প্রিয়ন্তি……
মাথা নেড়ে বললো প্রিয়ন্তি,,
-আন্টি এমন হয়না।
আমি….
প্রিয়ন্তিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন মহিলাটি,,
-মা রে না করিস না,,
আমার সাথে চল!
আমি এইভাবে একা তোকে বিপদে ফেলে চলে যেতে পারি না,,তার উপর তুই বলছিস তোর যাওয়ার কোন জায়গা নেই!
আমি একটা মেয়ে হয়ে চোখের সামনে অন্য মেয়ের বিপদ দেখে চলে যেতে পারি না!
আর কেন জানিনা তোর এই পোশাক তোর প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দিলো,,তুই তো আকার সাথে যাবি মা!
প্রিয়ন্তি কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছেলেটি এসে সামনে দাঁড়ালো,,
মহিলাটি ছেলেটির উদ্দেশ্যে বললেন,,
– হ্যাঁ রে আয়াত,,ট্রেন তো আর নাই এমন সময় আসলাম ট্রেনটা ধরতেও পারলাম না এখন গ্রামে যাব কেমনে?
আয়াত বিরক্তি নিয়ে বললো,,,
-মা লাস্ট ট্রেন একটা আছে,,রাত ১০.০০ টার দিকে আসবে……
এই বলে হনহন করে আবারো সেই আগের স্থানে গিয়ে বসে পড়লো ছেলেটি!
-কিছু মনে করিস না মা!
ছেলেটা এমনই কিন্তু মনের দিক দিয়ে খুবই কোমল।
প্রিয়ন্তি ভ্রু কুচকে মনে মনে বললো,,
-কোমল না ছাই,,,আমার কি?
অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ট্রেন আসলো…
ভদ্র মহিলা প্রিয়ন্তির হাত ধরে ট্রেনের দিকে হাটতে লাগলেন,,
পেছন থেকে আয়াত অবাক হয়ে ভ্রু কুচকালো……
ঢাকা থেকে সিলেটের পথে পাড়ি জমালো ট্রেনটি……
অতীতের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো!
মেহরাবের সেই পবিত্র মুখটা বারবার কেন জানি কল্পনাতে ভেসে উঠছে,,,
মনে মনে আল্লাহর কাছে শয়তান থেকে সাহায্য চেয়ে
জানালা দিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে রইলো প্রিয়ন্তি……

#চলবে ইন শা আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here