ধৈর্য,১৬,১৭

0
503

ধৈর্য,১৬,১৭
#Tahmi_Chowdhury
১৬
:
সিলেট স্টেশনে এসে ট্রেনটি থেমে গেলে প্রিয়ন্তিরা নেমে সি এন জি স্ট্যাম্প এর দিকে এগোতে থাকে…।
আয়াত তখনো স্থিত দৃষ্টিতে প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে আছে,,,
প্রিয়ন্তিকে দেখে অনেকটা অবাক হচ্ছে আয়াত……
-মেয়েটা হুট করে কোথা থেকে এলো,,তার উপর মা ই বা মেয়েটাকে এভাবে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন।
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এগুতে থাকে আয়াত!
-মা একটু শুনবে এদিকে…
ছেলের কণ্ঠ শুনে জহুরা হোসেন পেছনে তাকান…
প্রিয়ন্তি তখন আশপাশ দেখতে ব্যস্ত,,,
শহরটা একদম অপরিচিত,,
আর অপরিচিতিদের সাথেই এই অজানা শহরে……
কিছুটা ভয় ও পাচ্ছে প্রিয়ন্তি!
কিন্তু কিচ্ছু করার নেই,,পরিস্থিতিটাই এমনি……
আল্লাহ উপর তাওয়াককুল করে সামনে এগুয় প্রিয়ন্তি!
তখনি ভদ্র মহিলার কন্ঠে থেমে যায় সে……
কিছুটা দূরে ছেলে মা কি নিয়ে যেন কথা বলে যাচ্ছেন!
প্রিয়ন্তি চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকায়,,,,
-মা মেয়েটা কি আমাদের সাথেই যাচ্ছে?
আয়াতের কথায় জহুরা এক গাল মুচকি হেসে বলেন,,
-হ্যাঁ আব্বা,,আজ থাইক্কা মেয়ে আমাদের সাথেই থাকবো!
-মা কোথাকার কি……
আয়াতকে থামিয়ে দিয়ে জহুরা হোসেন প্রিয়ন্তির বলা কথা একে একে আয়াতকে খুলে বলতে লাগলেন…
প্রিয়ন্তি স্থির হয়ে তখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে,,,
তখনো মা ছেলে কথা বলে যাচ্ছেন!
আয়াত অবাক চোখে প্রিয়ন্তির দিকে তাকায়,,
মেয়েটা হিন্দু হয়ে ইসলামকে জেনে গ্রহণ করেছে,,আর আমরা মুসলিম হয়েও ইসলামকে জানলাম না?
হঠাৎ করেই কথাগুলো মাথায় ঝট পাকাতে লাগলো আয়াতের……
.
-এখানে থামান!
সি এন জি থেকে তিনজন নেমে দু তালা বিশিষ্ট বাড়িটার দিকে এগুতে লাগলো!
অদ্ভুতভাবে ভয় ও জড়োতা প্রিয়ন্তিকে ঘিরে ধরেছে।
আয়াত প্রিয়ন্তির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে হাটছে,,
গেইটের সামনে আসতেই বাড়িটার দিকে তাকালো প্রিয়ন্তি,,,
বিলাশবহুল বাড়িটা নজর কাড়ে প্রিয়ন্তির!
-আসো মা……
ভদ্র মহিলার হাতটা চেপে রাখে ভয়ে,,,
প্রিয়ন্তির হাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেন জহুরা,,
-মা ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই,,এটা আমার নিজের বাড়ি।
এখন থেকে তোমারও বাড়ি এটা।
নিজেরই মনে করো সব!
ভদ্র মহিলার কথায় মাথা কাত করে প্রিয়ন্তি!
বাড়ির ভেতর ঢুকতেই দুজন যুবতী মেয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে জহুরার গায়ের উপর!
মেয়েগুলোদের দেখে প্রিয়ন্তির চোখে ধাঁদা লেগে যায়……
পরীর মতো সুন্দর দুজন,,,দুজনেরই চোখে ফ্রেমের চশমা,,,
আচ্ছা এ ঘরে কি সবারই চোখে সমস্যা?
মনে মনে ভাবে প্রিয়ন্তি!
জহুরা মেয়েদের জড়িয়ে ধরেন দুই বাহুতে,,
-আয় তোদের পরিচয় করিয়ে দেই,,
এগিয়ে গিয়ে প্রিয়ন্তির পাশে দুই মেয়েকে নিয়ে দাঁড়ান জহুরা!
অবাক বিস্ময়ে মেয়েগুলো প্রিয়ন্তির মাথা থেকে পা থেকে পর্যবেক্ষন করতে লাগলো……
-ও হচ্ছে তোদের আরেক বোন প্রিয়ন্তি!
মা ওরা হচ্ছে আমার দুই মেয়ে নিলাশা,,মিতিশা!
প্রিয়ন্তি নিকাবের আড়াল থেকে হালকা হাসলো নিলাশা আর মিতিশার দিকে তাকিয়ে!
দুই বোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে প্রিয়ন্তির দিকে আবারও তাকালো……
ওদের এমন বিস্ময়কর চাহনি প্রিয়ন্তিকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিলো……

-বাহ পিও আপুনি,,তুমি তো হুরপরী গো,,,
প্রিয়ন্তি হালকা হেসে মিতিশার দিকে তাকিয়ে বললো,,
-আমি আপনাদের থেকে অনেক ছোট আপু,,
আমাকে আপু বলবেন না প্লিজ!
মিতিশা প্রিয়ন্তির গালটা হালকা টেনে দিয়ে বললো,,
-হু,,দেখতেও একদম বাচ্চাদের মতো লাগে,,,
তা ইন্টারের ফাইনালটা দিবা না বুঝি……
মিতিশার কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রিয়ন্তি!
নিলাশা প্রিয়ন্তির নাক টেনে দিয়ে বললো,,
-পিও,,,একদম মন খারাপ করবা না।
আর তুমি ইন্টারের পরীক্ষাটা দিবা!
ভালো করে পড়ো কেমন?
বড় বোন নিলাশার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকালো মিতিশা……
মিতিশা এবার অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী,,
আর নিলাশার মাস্টার্স কম্পলিট!
মিতিশার চাহনি দেখে মুচকি হেসে বললো নিলাশা,,,
-হ্যাঁ অবাক হওয়ার কিছু বলিনি মিতি,,
আমাদের পিও পরীক্ষা দিবে আর সেটা ঢাকাতে গিয়েই,,,আর এখানে জাস্ট কোচিং করবে। পরীক্ষার সময় ঢাকাতে চলে যাবে আমাদের খালামণির বাসায়!
পিও দুবোনের দিকে অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো……
-মাত্র দুদিন হলো এ বাড়িতে পা রেখেছি।
আর কি অদ্ভুত ভাবেই না ওরা আমায় আপন করে নিলো…মানুষকে মুহূর্তেই আপন করে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এ ঘরের প্রতিটা সদস্যদের……
-কি ভাবছো এত্ত পিও!
মিতিশার আর নিলাশার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো প্রিয়ন্তি!
.
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে আয়াত!
অদ্ভুত এক আকর্ষণ প্রিয়ন্তির প্রতি আসছে আয়াতের!
আজ ছাদে এক ঝলক প্রিয়ন্তির ঘোমটায় আঁকা মুখটাকে দেখেছিলো……
আয়াতের উপস্থিতি টের পেতেই ওড়নাটা মুখের উপর টেনে নিয়েছিলো প্রিয়ন্তি!
ওই এক ঝলকই দেখা আয়াতের জন্য ছিলো যতেষ্ট……
আয়াত বিছানায় বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে গেলো!
ঘুম তো কিছুতেই আসছে না!
বারান্দায় গেলো আয়াত,,,রেলিং ধরে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ওই দূর আকাশে……
বাহিরের ঝিরিঝিরি বাতাশ আয়াতের মনটাকে এক নতুন অনুভূতির পরিচয় করিয়ে দিয়ে যায়……

খুব সকালেই সারাহ বিষণ্ণ মনে এলো বাবার বাড়ি!
মেহরাব সারাহর বিষণ্ণ মুখটা দেখে চিন্তিত কন্ঠে বললো,,
-কি হয়েছে সারাহ! তোর ফোন অফ কেন?
আর এরকম দেখাচ্ছে কেন তোকে?
সারাহ চুপচাপ সোফায় বসে পড়লো,,,
সারাহর দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো মেহরাব,,
আহনাফ এর মাঝে ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকলো……
সালাম জানিয়ে মুসাফার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো মেহরাবের দিকে……
মুচকি হেসে আহনাফের দুহাতে হাত মিলিয়ে দিলো মেহরাব……
সারাহ তখনো চুপটি করে সোফায় বসে আছে!
-ভাইয়া সারাহকে একটু জিজ্ঞেস করেন না,
কি হয়েছে সকাল থেকেই এইভাবে চুপচাপ বসে আছে……কিছু জিজ্ঞেস করলে বলছে ও না……
চিন্তিত ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে থামলো আহনাফ!
মেহরাজ তখন আহনাফের সাথে এসে গলা মিলায়,,,,
বসতে বসতে আয়শাকে ডাক দেয় মেহরাজ……
আয়শা মোবাইলটা কানে নিয়ে কথা বলতে বলতে আসে মেহরাজের সামনে……
আয়শা উপস্থিত সারাহ আর আহনাফকে দেখে একবার মুচকি হাসে……
আহনাফ আয়শাকে দেখে চোখ নামিয়ে নেয়!
এই মহিলাটিকে একদম সহ্য হয় না আহনাফের।
মহিলাটির উগ্র চলাফেরাই আহনাফের এই অসহ্যের কারণ!
ঘরের মেয়েরা হবে অত্যন্ত নাজুক,,,কিন্তু এই মহিলা……
মনে মনে ভাবতে থাকে আহনাফ,,,
-আয়শা ওদের জন্য একটু নাস্তার ব্যবস্থা করো তো!
মেহরাজ আয়শার দিকে তাকিয়ে কথাটি বললেও,,আয়শা মেহরাজের কথাটি একদম শুনেনি এমনভাবে সামনে থেকে সরে গেলো!
মেহরাব বেশ বুঝতে পারলো আয়শা কখনোই রান্নাঘরে যাবে না!
আয়শাকে শুধু নিজের প্রয়োজনেই রান্নাঘরে দেখা যায়!
মায়ই ঘরের সব সামলান!
ভাইয়াটাও যে কি মায়ের বয়স হয়েছে,,এখন তো একটু ভাবিকে বুঝাবে যে সংসারটা ধরতে…কিন্তু না……
চায়ের কাপে চিনি মিশাতে মিশাতে বিরক্তি নিতে ভ্রু কুচকালো মেহরাব!
রান্নাঘরে এসে ঠিকই ভাবিকে দেখতে পায় নি মেহরাব!
তাই নিজেই চা টা করে নিলো।
মা ও অসুস্থ তাই তো,, নাহলে মা ই করে দিতেন।
ট্রেতে চা নিয়ে ড্রয়ই রুমে গিয়ে বসলো মেহরাব……
-এসবের দরকার ছিলো না ভাইয়া!
সারাহ চোখ দুটো ছোট্ট ছোট্ট করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো …
মেহরাজ আয়শার এমন আচরণে বেশ বিরক্ত হলো!
ঘরে মেহমান এসেছে,,চা টা একটু করে দিলে কি ক্ষতি হয়ে যেত!
ইদানীং আয়শার কিছু আচরণে বেশ বিরক্ত মেহরাজ!
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মেহরাবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো মেহরাজ,,
-চা টা তো ভালোই করে নিতে পারিস!
এবার বিয়েটা করে নে!
ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো মেহরাব!
হ্যাঁ বিয়ে তো করতে হবে,, কিন্তু……
সারাহর দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো মেহরাব!

নাক টেনে টেনে ফুঁপিয়ে কান্না করছে সারাহ!
মেহরাব কপালে ভাজ তুলে চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে……
-ভাইয়া কোথায় যেতে পারে ও।
ওর নাম্বারটাও বন্ধ,,,দুদিন ধরে ট্রাই করছি।
মেয়েটা একা একা কোথায় যাবে,,,কোন আত্মীয়ের বাড়ি যাবে না কারণ কোন আত্মীয়ই প্রিয়ন্তির ইসলাম গ্রহণ করা মেনে নিয়ে জায়গা দিবে না।
আর যতটুকু জানি প্রিয়ন্তিও এমন রিস্ক নিবে না।
ভাইয়া কাল আমি ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম,,
আন্টিও কিছু বলতে পারলেন না।
আন্টিকে দেখে আমার বুক ফেটে কান্না আসছিলো ভাইয়া।
মানুষরূপী ওই পশুরা আন্টিকে একেবারে বিছানার সাথী করে দিয়েছে……
আর কিছু বলতে পারলো না সারাহ,
দু হাতে মুখ ঢেকে কান্না করতে লাগলো…
বুকের চিনচিন ব্যথাটা হঠাৎ করেই যেন বাড়তে লাগলো মেহরাবের……
.

১৭
:
প্রায় তিনমাস হলো প্রিয়ন্তি এ বাড়িতে আছে!
বাড়ির টুকটাক কাজগুলো প্রিয়ন্তিই করে দেয়,, জহুরা হোসেন আপত্তি জানালেও প্রিয়ন্তি বলে সে পায়ের উপর পা তুলে এভাবে খেতে পারবে না!
কিছু একটা করতে চায় সে!
তাই জহুরা হোসেন আর প্রিয়ন্তিকে ঘাটালেন না।
কাজে খুবই পারদর্শী প্রিয়ন্তি!
ঘরের সবাই এখন প্রিয়ন্তির হাতের রান্না খাওয়ার জন্য পাগল!
তাই নিজ হাতে প্রতিদিন রান্নার কাজটা খুব আনন্দেই করে নেয় প্রিয়ন্তি!
জহুরা হোসেন নিজের মেয়ের চোখেই প্রিয়ন্তিকে দেখেন,,,হালকা শাসন,, আদর সব মিলিয়ে প্রিয়ন্তি খুব ভালো আছে!
কিন্তু কোথাও একটা শূণ্যতা ঠিকই কাজ করে……
বুকের চিনচিন ব্যথাটা হঠাৎ করেই দেখা দেয় প্রিয়ন্তির!
নিঃশ্বাসটা খুব দীর্ঘ হয়েই বেড়িয়ে আসে ভেতর থেকে!
.
জহুরা হোসেন চায়ের কাপটা প্রিয়ন্তির হাতে দিয়ে বললেন,,
-চা টা আয়াতের রুমে দিয়ে আয় মা!
প্রিয়ন্তি ইতস্ততবোধ করলো এতে!
জহুরা হোসেন সেদিকে তেমন পাত্তা দিলেন না!
এ বাড়িতে আসার পর থেকে প্রিয়ন্তিকে খুব করে পর্দার জন্য সমস্যায় পড়তে হয়েছে! পর্দার ব্যাপারে খুব বেশি কেউই সিরিয়াস নয় এরা!
প্রিয়ন্তি কৌশলে অনেকবার বুঝিয়েছে মিতিশা আর নিলাশাকে কিন্তু এ ব্যাপারে উদাসীনতা ছাড়া আর তাদের মাঝে কিছুই দেখতে পায় নি সে!
জহুরা হোসেন এত্ত সাহায্য করে যাচ্ছেন প্রিয়ন্তিকে,,
মুখের উপর তো আর না বলতে পারে না……তাই হাতে চায়ের কাপটা নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে খুব বিনয়ীকন্ঠে বললো প্রিয়ন্তি,,
-উনি তো আমার জন্য গায়রে মাহরাম আন্টি!
আমি কি উনাকে চা দিতে পারি,,,এতে তো ফেতনার ও আশংকা আছে আন্টি!
জহুরা কিছুটা অবাক হলেন বটে,,,তবে তিনি কিছু বললেন না উত্তরে!
জহুরা হোসেনের কোন উত্তর না পেয়ে নিঃশব্দে চাপা নিঃশ্বাসটা নিয়ে বেড়িয়ে গেলো!
অনেকবারই এ বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে জহুরা হোসেনের সাথে,,,কিন্তু উনার এক কথা……
-মাথায় ওড়না দিয়ে যেতে পারো মা,,কিচ্ছু হবে না!
হুহ উনি জানেন কিচ্ছু হবে না।
আল্লাহর হুকুম মানার জন্য আমি আমার মা-আমার বাড়ি ছাড়লাম আর এখানে এসে আমি তা লঙ্গন করবো?
কখনোই তা হবে না ইন শা আল্লাহ!
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আয়াতের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো প্রিয়ন্তি!
দরজাটা ভেজে দেওয়া,,
গায়ের হিজাব দ্বারা চেহারা ও গায়ের উপর পর্দা টেনে দিয়ে অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকলো প্রিয়ন্তি!
চোখের চশমাটা নাকের ডগায় এসে হাসফাস করছে,,আর আয়াত চশমাটা বারবার চোখের উপর তুলছে……
মাথা নিচু করে উরুর উপরে ল্যাপটপ রেখে এক ধ্যানে কি যেন করে যাচ্ছে আয়াত!
প্রিয়ন্তি টেবিলের উপর আস্তে করে চায়ের কাপ রেখে দিয়ে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে ডাক দিলো আয়াত……
-শুনো পিও!
থেমে গেলো প্রিয়ন্তি,,,
এই মানুষটা গত তিনমাস ধরে হুটহাট এইভাবে প্রিয়ন্তিকে ডাক দেয়,,তবে তা কখনো বিনা প্রয়োজনে নয়!
আয়াত যখন থেকে জেনেছে প্রিয়ন্তি আয়াতের সামনে আসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না তখন থেকেই প্রিয়ন্তির সামনে ও আয়াত তেমন পরে না,,,বা প্রিয়ন্তির দিকে আর আগের মতো তাকায় না!
কেন আয়াতের ও অজানা।
হয়তো প্রিয়ন্তিকে অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না বলেই!
হাতের ল্যাপটপটা বিছানার এক কোণে রেখে চায়ে এক চুমুক দিয়ে বললো আয়াত,,
-চা টা বেশ ভালোই হয়েছে মাশা’আল্লাহ!
ও হ্যাঁ যার জন্য ডেকেছিলাম।
পিও তোমার তো কোচিং এ ভর্তি হওয়ার কথা ছিলো,,
আম্মু বলেছিলেন তোমাকে নিয়ে কোচিং সেন্টারে যেতে,,কিন্তু হাসপাতালের রোগীদের মাঝে পরে সব ভুলে গিয়েছিলাম।
তুমি আজ তৈরি থেকো,,একটু পরই বের হবো!
আজ আর হাসপাতালে যাচ্ছি না!
প্রিয়ন্তি আমতাআমতা করে বললো,,,
-মিতিশা আপু ও আমাদের সাথে গেলে হবে না!
আয়াত চট করে মাথা তুলে তাকালো,,,
প্রিয়ন্তি চোখ নামিয়ে ফেললো!
আয়াত ও মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,,
-হ্যাঁ তুমি যদি চাও যাবে।
ওকেও রেডি হতে বলো!
প্রিয়ন্তি নিরবে চলে আসলো,,,
আয়াত দীর্ঘশ্বাস নিয়ে প্রিয়ন্তির যাওয়ার পানে তাকিয়ে ভাবলো,,
-মেয়েটা এখনো আমায় বিশ্বাসই করতে পারলো না!
প্রিয়ন্তি সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ভাবছে,,
-কথাটা বিঃশ্বাসের নয়!
মানুষটা হয়তো বিঃশ্বাসের,,
কিন্তু আপনি আমার জন্য গায়রে মাহরাম! আর গায়রে মাহরামদের সাথে একা যাওয়া আসা ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ আছে।
আমি আল্লাহর বিধান অমান্য করতে চাই না!
মিতিশা ফোন আলাপে ব্যস্ত,,
কথা বলতে বলতে হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে……
দরজায় ঠোকা দিলো প্রিয়ন্তি!
মিতিশা আস্তে করে কলটা কেটে দিয়ে প্রিয়ন্তির দিকে মুচকি হেসে বললো,,
-পিও মণি যে আসো আসো!
প্রিয়ন্তি মিতিশার পাশে গিয়ে বসতে বসতে বললো,,
-কি গো আপুনি,,,এত্ত হাসি……
মিতিশা হাসতে হাসতে বললো,,,
-আর বলো না পিও!
রাদিফটা না যা ফাজিল হইছে আজকাল!
মিতিশার হাতে হালকা চাপ দিয়ে বললো প্রিয়ন্তি,,
-আপুমণি যিনাকারীর শাস্তি ভয়ংকর গো!
আমি চাই না আমার কলিজার আপুটার……
প্রিয়ন্তির চোখটা ছলছল করে উঠলো!
এ বিষয় নিয়ে মিতিশাকে অনেকবারই বুঝিয়েছে প্রিয়ন্তি!
কিন্তু প্রতিবারই মিতিশা গাফেল!
-আ……আমাদের তো ব…বিয়ে হবে পিও
কিছুটা থেমে থেমে উত্তর দিলো মিতিশা!
-তুমি কি গ্যারান্টি দিচ্ছো আপুমণি!
আল্লাহর হুকুম ছাড়া কিছুই হয় না আপুমণি,,আর যদি বিয়েটা না হয় আল্লাহর হুকুম না হয়……আপুমণি এর থেকে ভাইয়াকে বলো এখুনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আক্দটা করে নিতে।
তবেই আর ভয় নেই!
মিতিশা ভেবে উত্তর দিলো,,
-কিন্তু ও তো এখনো স্টাবলিশ নয়, ফ্যামিলি তো মানবে না আর ওর পক্ষে এখনি বা বিয়ে করা সম্ভব হবে কি করে?
প্রিয়ন্তি করুণ গলায় বলে উঠলো,,,
-তাহলে যোগাযোগটা ছাড়িয়ে নাও আপু!
জানো বিয়ের আগে প্রেম ভালোবাসা সম্পূর্ণ হারাম!
-পিও আমি চেষ্টা করি কিন্তু পারি না……
-আপু মন থেকে একবার জোর দিয়ে চেষ্টা করো!
পাঁচ ওয়াক্ত নামায সকল খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে,, তুমি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ো আপু,,,
-পড়ি তো পিও,,নামায তো নিয়মিতই পড়া হয় দেখিস না।
-আপু নামাজটা হয়তো নামাজের মতো হচ্ছে না।
নইলে নামায মানুষকে হারামের সাথে জড়াতে দেয় না। এটা আল্লাহর দেওয়া প্রদত্ত রহমত।
যারা খুশুখুজুর সাথে নামায আদায় করে নিতে পেরেছে তাদের জীবন আখিরাত সত্যি আলোকময়।
-তাহলে আমার নামায হচ্ছে না……
-তা ঠিক বলতে পারছি না আপু। রিলেশনটা বাদ দাও আপু,, তুমি হয়তো সবসময় রাদিফ ভাইয়ের চিন্তাটা নিয়েই ঘুরো,,,নামাজেও হয়তো ভাইয়ার চিন্তা আসে!
তাই হয়তো নামাজে খুশুখুজু আদায় হয় না……
মিতিশা মুখ কালো করে বললো,,
-এটা ঠিক বলেছিস রে পিও,,নামাজে দাঁড়ালেইই কোথা থেকে অদ্ভুত চিন্তা আসে,,,আর কয়েটা রুকু দিলাম কয়টা সিজদা দিলাম ঠিক মনেই করতে পারি না।
-আপু শয়তানের ওয়াসওয়াসা এটা,, শয়তানই নামাজে এমন ব্যাঘাত ঘটায়!
কিন্তু আমাদের নামাজে যত্নশীল হতে হবে সচেতন হতে হবে……
-কি করবো রে পিও,,,তুই সেদিন আমায় কথাগুলো বলার পর আমি পুরো একদিন ওর সাথে যোগাযোগ করি না,,,কিন্তু কিন্তু পিও তুই তো আমার অবস্থা দেখেছিস ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হলো!
প্রিয়ন্তি কিছুটা ভেবে বললো,,
-রাগ করো না মিতিপু,,,এটা শুধুই তোমার দুর্বলতা।
আর শয়তানের ওয়াসওয়াসা,,,।
তুমি যদি মনকে শক্ত করতে কিছুটা হলেও পারতে,,,কষ্ট তো হবেই আপু আর এই কষ্ট সৃষ্টি করে শয়তান।
আর শয়তানই মনে অনেক চিন্তা অনেক ইমোশন ঢুকিয়ে দেয়,,,সেই সময় আমাদের একদম সিজদায় লুটিয়ে পড়ার কথা,,,নিজের ইমোশন নিজের কষ্ট আল্লাহর কাছে তুলে ধরা!
দেখতে আপু আল্লাহর সাহায্য ইন শা আল্লাহ আসতো……!
মিতিশা চুপ মেরে রইলো,,
আয়াতের কন্ঠ শুনে হকচকিয়ে গেলো প্রিয়ন্তি,,
আয়াত ও প্রিয়ন্তিকে মিতিশার সাথে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো……
সে ভেবেছিলো পিও হয়তো নিজের রুমে রেডি হচ্ছে,
কিন্তু না……
মিতিশা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,,
-ভাইয়া কিছু বলবি?
উলটো দিকে ফিরে বললো আয়াত,,,
-হু হ্যাঁ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে এসো তোমরা,,আমি গাড়িতে ওয়েট করছি!
আয়াত চলে গেলে প্রিয়ন্তি নিজের মাথায় ঠোকা দিয়ে বলে,,
-এই যা কথায় কথায় ভুলেই গিয়েছিলাম!
আজ কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দিতে চাইছিলেন, তুমিও যাবে আমার সাথে আপু।
মিতিশা জানে প্রিয়ন্তি কখনোই আয়াতের সাথে একা যাবে না,,তাই সেও এক কথায় রাজি হয়ে যায় প্রিয়ন্তির সাথে যাওয়ার জন্য……

পরশু নিলাশার বিয়ে,,,
বাড়িতে মেহমানরা গিজগিজ করছে!
প্রিয়ন্তি প্রায় হাপিয়ে উঠেছে,,,
এখানে সব মেহমানরাই অতিরিক্ত আধুনিক,,
সবার এক চালচলনের মাঝে প্রিয়ন্তির আলাদা চলনটা সবারই দৃষ্টি ঘোচর হলো!
কেউ কেউ তো মুখ বাঁকাল,আবার কেউ কেউ টিপ্পনী মেরে অনেক কথাই শুনালো প্রিয়ন্তিকে!
সবকিছুর মাঝে প্রিয়ন্তি যেন হাপিয়ে উঠেছে!
এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে প্রিয়ন্তি কখনোই ভাবে নি!
পর্দা করা যতটা সহজ রক্ষা করা ঠিক ততোটাই কঠিন।
সারাদিন গায়ে জিলবাবটা পরে ঘুরতে হচ্ছে,,
না ঘুরলেও হচ্ছে না,,,জহুরা সব দায়িত্ব যেন প্রিয়ন্তির উপরই ছেড়ে দিয়েছেন।
খাবারের অমিল,, ডেকোরেশন সব প্রিয়ন্তিকেই গুনতে হচ্ছে!
আয়াত আজ সারাদিন প্রিয়ন্তির কার্যক্রম পরখ করছিলো……
সন্ধ্যে হতেই প্রচুর মাথা ব্যথা ধরেছিলো প্রিয়ন্তির।
তা চা খেতে রান্নাঘরে এসেছে,,যদি মাথাব্যথা কিছুটা হালকা হয় এই আশায়!
সারাদিন তো আর কম খাটুনি যায় নি মেয়েটার মাথার উপর দিয়ে!
চায়ের কাপে চিনি মেশাতে ব্যস্ত প্রিয়ন্তি,,,তখনি আয়াত রান্নাঘরে ঢুকে বলে,,,
-পিও দু কাপ চা করে দিও তো!
কপালে বিরক্তির ভাজ তুলে কর্কশ গলায় বললো প্রিয়ন্তি,
-রহিমা খালা তো আছে উনাকে বলেন না……
প্রিয়ন্তি কর্কশ স্বর শুনে হাসিটা চেপে রেখে বললো আয়াত,,
-স্পেশাল গেস্ট আসছে পিও। চা টাও তো স্পেশাল হওয়া চাই……
আয়াত এই বলে চলে গেলো,,
প্রিয়ন্তি হাতের চামচটা ছুড়ে মারতেই রান্নাঘর ঝনঝন শব্দে মুখরিত হলো……
:
পরিচিত কন্ঠটা শুনে ঝট করে পেছনে ফিরে তাকালো প্রিয়ন্তি,,,
সোফায় বসে আয়াত ও মেহরাব গল্প করছিলো।
কি মনে করে মেহরাব ঘার কাত করতেই হিজাবে আবৃত কাউকে দেখে বসা থেকে ঝট করেই উঠে দাঁড়ালো……
মেহরাবের দৃষ্টি অশান্ত,,,
খুব দ্রুত ভাবছে মেহরাব!
প্রিয়ন্তি আর সেখানে দাঁড়াতে পারলো না।
ছুটে চলে এলো রুমে,,দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়লো!
বাধ ভাঙ্গা কান্নাটা আজ কাঁদছে প্রিয়ন্তি!
মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজ দ্রুত চলছে,,
মাথা তুলে ফোনটা হাতে নিতেই মায়ের নাম দেখে চোখ মুছে কলটা কানে ধরলো প্রিয়ন্তি……
-আসসালামু আলাইকুম মা!
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম।
ভালো আছিস মা,,,ওখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো……
প্রিয়ন্তির গলার স্বরটা ভারী হয়ে এলো,,,
-ভালো আছি মা,,আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি খুব ভালো আছি মা……
কথাটা বলেই ফোনটা কুট করে কেটে দিলো প্রিয়ন্তি,,
চোখ বেয়ে উপচে উপচে পানি পড়ছে প্রিয়ন্তির।
কান্নাটা কিসের,,?
কেন এমন কষ্টের অনুভূতি,,?
বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা হাহাকারটা আজ হঠাৎ করেই কেন ই বা বেড়ে গেলো সব যেন অজানা আজ প্রিয়ন্তির……।

#চলবে ইন শা আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here