#ধোঁয়ার_নেশা,১৭,১৮
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৭)
অনিকশা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অরিদকে দেখছে অপলকে। কে এটা? এটাই কি তার সেই ভোলাভালা স্বামী? যে কী না রাগ দেখাতেও জানতো না?
অনিকশা অরিদের এমন রূপে এতোটাই বিস্মিত যে কেউ চড় মারলে তাকে কাঁদতে হবে এটাও ভুলে গিয়েছে। শুধু মনে মনে এটাই ভাবছে,এটা তার অরিদ হতে পারে না। নিশ্চয় অরিদের রূপে অন্য কেউ,ভুত নয় তো???
অরিদ হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই লাগেজে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। আলমারী খুলে নিয়ে সেখান থেকে যা পারলো ব্যাগে রেখে ভরে ফেলছে। চেইন লাগাতে না পারায় ঠাস করে একটা লাথি মারলো লাগেজে।
লাগেজ বিছানা থেকে নিচে পড়ার শব্দে অনিকশার হুশ এসে গেছে। তার চোখ দিয়ে টপটপ করা পানি নিয়ে অরিদের কাছে যাচ্ছে!
আকাশটা মেঘে ছেয়ে আছে। বৃষ্টি নামার কোনো নামগন্ধ নেই,বাইরের বাতাসে শীতলতার ছোঁয়া আছে,যা একটু পরপর অন্ত্রীশাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। বৃষ্টির পরে তার এই আবহাওয়াটাও ভিষণ পছন্দের।
“” তুমি এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে আছো যে? তোমাকে না বললাম আমরা বেরোবো?””
অন্ত্রীশা,পালকের দিকে না তাকিয়েই বললো,
“” ইচ্ছে করছে না। আপনার বেলকনিটা খুব সুন্দর। দক্ষিন দিকের হাওয়ায় বাতাসেরা সারাক্ষণই লুকোচুড়ি খেলে।””
পালক নিজের শার্টের বোতামটা লাগাতে লাগাতে অন্ত্রীশার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে,
“” ইচ্ছে না করলেও যেতে হবে। সবসময় নিজের ইচ্ছে কে গুরুত্ব দিতে নেই।””
অন্ত্রীশা পেছনে ঘুরতেই পালকের মুখোমুখি হয়ে গেছে,দুরত্বটাও খুব বেশি যে তা নয়,আবার খুব কাছেও না। মেঘ কালারের শার্টটাতে পালককে মেঘের রাজপুত্রের মতো লাগছে। মাত্রই কি গোসল করে এসেছে? মুখটা এতো পবিত্র লাগছে যে। যেন সে এক গোসলেই তার ভেতরের সবটা অপবিত্র ধুয়ে এসেছে। বাতাসের ঝাপটাই সুঘ্রাণ ভেসে আসছে অন্ত্রীশার নাকে। পারফিউম মেখেছে কি? কিন্তু উনি তো পারফিউম পছন্দ করেন না,তবে কি এটা তার পুরুষত্বের অধিকারে থাকা বিশেষ আহ্বানের সুবাস??
হঠাৎই বাতাসের দমকা ছোঁয়াই অন্ত্রীশার পেছনে ছেড়ে দেওয়া চুলগুলো সামনে চলে এসেছে। অন্ত্রীশার মুখ পুরো ঢেকে গিয়েছে,অনেকটা ছোটবেলায় মজা করে চুল দিয়ে ভুত সাজার মতো দেখাচ্ছে অন্ত্রীশাকে।
পালকের ইচ্ছে হচ্ছে অন্ত্রীশার মুখটাকে চুলের আড়াল থেকে বের করে নিয়ে আসতে। অমন মিষ্টি মুখের অধিকারী নারীর মুখ চুল দিয়ে কেন ঢেকে থাকবে? এই চুলগুলোও এতো কেন বেহায়া হয়? যখন তখন নানানভাবে ছুঁয়ে দেয়। পালকের ডান হাতটা অজান্তেই অন্ত্রীশার মুখের কাছে চলে যাচ্ছে। কিন্তু হাতটাকে সামলিয়ে নিয়েই পালক শব্দ করে হেসে উঠলো,,,
অন্ত্রীশা দুহাত দিয়ে নিজের চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে বললো,
“” আপনাকে বেশ উৎফুল্ল লাগছে। কারণটা কি?””
পালক ঠোঁটে হাসি রেখেই বা হাতের দুটো আংগুল দেখিয়ে বললো,
“”দুটো কারণ!””
“” দুটো?””
পালক ডান হাত দিয়ে বা হাতের একটা আংগুল ভাঁজ করে নিয়ে বললো,
“” হুম।নাম্বার ওয়ান,অনিকশা আমার পত্রীকন্যা নয় তাই। নাম্বার টু,যেহেতু অনিকশা পত্রীকন্যা নই সেহেতু পত্রীকন্যা এখনও আমার।””
“” কিভাবে বুঝলেন পত্রীকন্যা এখনও আপনার? আপনাদের মধ্যে কিন্তু বিশাল গ্যাপ রয়েছে। এমনও তো হতে পারে,এতোদিনে ও বিয়ে করে,দুকন্যার বাপ সরি,মা হয়ে গিয়েছে।
অন্ত্রীশার কথায় পালক মুচকি হেসে নিয়ে ওর হাত চেপে ধরেছে। অন্ত্রীশাকে রুমের ভেতরে নিতে নিতে বললো,
“” এটা কখনোই সম্ভব না অন্ত্রীশা। আমার পত্রীকন্যা আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করতেই পারে না। আর দুকন্যা কিভাবে আসবে?””
“” এতো আস্থা?””
পালক খাটের উপরে রাখা একটা শপিং ব্যাগ থেকে একটা শাড়ী বের করে অন্ত্রীশা হাতে দিয়ে বললো,
“” আমার প্রাণ ও। প্রাণের বিশ্বাস না রাখলে কিভাবে হবে বলো? এখন এতো কথা বাদ দিয়ে যাও এটা পড়ে আসো। উই আর লেইট!””
অন্ত্রীশা হাতের সাদার মধ্যে লাল পাড়ের সিল্কের শাড়ী দেখতে পাচ্ছে। এ রকম শাড়ীগুলো হিন্দুরা বেশি পড়ে থাকে। অবশ্য তারও মাঝে মাঝে পড়তে অনেক শখ হতো। কিন্তু সত্যি সত্যি পড়বে এটা কখনো ভাবেনি।
“” আমি বাইরে ওয়েট করছি,ইউ হেভ অনলি ৩০ মিনিটস।””
পালক চলে যেতে নিলেই অন্ত্রীশা পেছন থেকে বললো,
“” অন্যের জন্য কেনা শাড়ীটা আমাকে পরতে দিচ্ছেন? কাগজ কলমের বউ হিসেবে এটলিস্ট একটা শাড়ীতো গিফট পেতেই পারি!””
অন্ত্রীশার এমন কথায় পালক দরজার কাছটাতে এসে থমকে গিয়েছে৷ পেছনে চট করে ঘুরতেই অন্ত্রীশাকে ওয়াশরুমে ঢুকে যেতে দেখতে পেলো। ও কিভাবে জানলো এটা ওর জন্য কেনা হয়নি? আমি তো ওকে এই ব্যাপারে কিছু বলিনি। হ্যাঁ মানছি এটা আমি আমার পত্রীকন্যার জন্য কিনেছিলাম। মেয়েটার হাজারও শখের মধ্যে এটিও একটি। তার খুব শখ ছিলো পহেলা বৈশাখে এমন একটা সাদার মধ্যে লাল পাড়ের শাড়ী পড়ে খোপা করবে৷ খোপাতে ফুলও দিবে বলেছিলো,কিন্তু কী ফুল দিবে সেটা জানায়নি।
অনিকশার সাথে দেখা করার পর মনটা হালকা করতেই আতিশের বাসায় যাওয়া পালকের। ওখানে গিয়েই জানতে পারে আতিশের চাকরি হয়েছে। আর ও অফিসেই আছে। চাকরি পাওয়ার সাথে সাথে আন্টিকেও নিয়ে এসেছে। আন্টির সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্পে গল্পে সময় কাটিয়ে উঠতেই আতিশের আগমন ঘটে। অনিকশার সাথে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা আতিশকে জানাতে জানাতে রাত হয়ে এসেছিলো। এতো রাতে শপিংমলে গিয়ে শাড়ী কেনা অসম্ভব তাও আবার একটা অজানা মেয়ের জন্য। যার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত তেমন কিছু সে জানে না। তার কোন কালার ভালো লাগে,কোন ডিজাইন ভালো লাগে,কী ধরনের শাড়ী পছন্দ করে,আদৌ শাড়ী পছন্দ করে নাকি তাও জানে না। তাই এতো রিস্ক না নিয়েই পালক বাসায় চলে এসেছিলো। নিজে ড্রেস চেন্জ করে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াড্রবটা মেলতেই এই শাড়ীটা চোখে পড়েছিলো। যার জন্য অনিকশানামক এক বিরহ থেকে বের হতে পেরেছে সে, তাকে এই শাড়ীটা পরতে দিলে কি তার পত্রীকন্যা রাগ করবে? কখনোই না আমার পত্রীকন্যা এতো ছোট মনমানসিকতার হতেই পারে না৷ সেরকম চিন্তাভাবনা করেই পালক অন্ত্রীশাকে এই শাড়ীটা দিয়েছিলো। তাই বলে এভাবে অপমান করে দিবে? তাকে শাড়ী কিনে দেওয়ার জন্য স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক তুলে আনার কি খুব প্রয়োজন ছিলো??
পালক কিছুটা মন খারাপ করেই বাইরে অন্ত্রীশার জন্য অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু ত্রিশ মিনিটের জায়গায় এক ঘন্টা হতে চলাতেও যখন অন্ত্রীশার কোনো সাড়া পাচ্ছে না তখন কিছুটা বিরক্তের ছাপ পড়েছে পালকের মুখে। টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে নিজের রুমের দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে উত্তর এসেছে,,
“” পরপুরুষের মতো অভিনয় না করলেও হবে। ভেতরে আসুন।””
অন্ত্রীশার এমন তিক্ত কথায় পালক কিছুটা থতমত খেয়েই ভেতরে ঢুকে হাঁ হয়ে দাড়িয়ে রইলো।
অন্ত্রীশা ব্লাউজ বিহিন শাড়ীটাকে প্যাঁচিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। চুলগুলো এলোমেলোভাবে প্যাঁচিয়ে খোপা করে রাখায় কাঁধ আর গলার দিকটা বেশি নগ্ন লাগছে। আচ্ছা শুধু জামাকাপড়বিহীন হলেই মানুষকে নগ্ন বলা হয় নাকি বিশেষ বিশেষ জায়গায় কাপড় না থাকলেও নগ্ন বলা যায়??
অন্ত্রীশার এমন রূপ দেখে মনে হচ্ছে তার সামনে বসে রয়েছে সাদা আগুনের দেবী। যার দিকে তাকালেই সে ভস্ব হয়ে যাবে। সাদা আর লাল ভস্ব!
পালক অন্ত্রীশার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে চাইলেও পারছে না। মনে হচ্ছে সাদা আগুনের দেবী তার আগুনী যাদুতে তার চোর দুটোকে স্থির করে ফেলেছে। সে চাইলেও চোখের পাতা ফেলতে পারবে না। চাইলেও চোখ সরিয়ে নিতে পারবে না।
“” আপনি কি অমন হা করে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য এসেছেন?””
“” হুম!””
“” কী?””
“” না মানে,আপনি এখনও রেডি হোননি কেন?””
অন্ত্রীশা যেন পালকের এই প্রশ্নের জন্যই এতক্ষণ গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা করছিলো। পালক যত দ্রুত সে তার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে তার থেকেও দ্বিগুন গতিতে তার দিকে তেড়ে এসে বললো,,,
“” আপনি যা দিয়েছেন তা দিয়ে তো রেডি হয়েছি,চলেন যাওয়া যাক।””
পালক চোখ দুটো চোখ বড় বড় করে বললো,
“” এভাবে?””
“” হুম, চলুন।””
“” আপনি কি সবাইকে ভস্ব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?””
অন্ত্রীশা ভ্রু কুঁচকে বললো,
“” মানে?””
“” আপনি আর কিছু পরবেন না?””
“” আপনি কি আর কিছু দিয়েছেন?””
“” আমি দেইনি বলে পরবেন না?””
অন্ত্রীশা উল্টোদিকে ঘুরে হাতদুটো একটা আরেকটার উপর রেখে পেট ও বুকের মাঝখানে ভাঁজ করে নিয়ে বললো,
“” না।””
পালক অন্ত্রীশার পিঠের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“” একটা মেয়ের কতগুলো জায়গা নগ্ন হতে পারে?””
“” গুনে দেখতে চান?””
অন্ত্রীশার আকস্মিক কথায় পালকের গলা শুকিয়ে এসেছে। চোখের কাজটা ঠিকমতো করতে গিয়ে কি মুখের কাজটা ভুল করে ফেলেছি? নাহলে মনে মনে কথা ও কি করে শুনলো???
“” অন্ত্রীশা,আসলে হয়েছে কি আমিতো এতোকিছু ভেবে শাড়ী কিনিনি তাই আর…..”””
“” ব্লাউজ কেনা হয়নি তাইতো? কেন আপনার কি মনে হয়নি উইথআউট ব্লাউজ শাড়ী কিভাবে পরবে?””
“” কী করে কিনবো,আমি তো পত্রীকন্যার….””
“” পত্রীকন্যার কী?””
পালকের আরো বেশি গলা শুকিয়ে এসেছে,তার পানি খাওয়া বড্ড প্রয়োজন। এভাবে আর কিছুক্ষন অন্ত্রীশার সামনে থাকলে সে সত্যি সত্যিই ভস্ব হয়ে যাবে।
“” কিছু না। আচ্ছা আপনি অন্যকিছু পরে নিন। আপনার শাড়ী পরা লাগবে না।””
পালকের এ কথায় অন্ত্রীশা তেলেবেগুনে জ্বলে যাচ্ছে। পালকের একদম কাছটাতে এসে বললো,
“” কেন পরবো না? অবশ্যই পরবো,এই শাড়ীটাই পরবো,এইভাবেই পরবো,আর আপনার সাথে বাইরেও যাবো।””
পালক চোখ বুঝে কিছুটা পেছনের দিকে ঝুকে আল্লাহ আল্লাহ ঝপতেছে৷ সে কী করে এভাবে তাকে বাইরে যেতে দিবে? সামান্য রেগে যাওয়ার ফলেই যে শাড়ীটা খুলে যাওয়ার উপক্রম সে শাড়ী পরে বাইরে যাওয়া অসম্ভব!
“” কী পাগলামী করছো অরিদ? কী হয়েছে বলবে তো?””
অরিদ ছলছল নয়নে অনিকশার দিকে তাকিয়ে বললো,
“” তুমি চেয়েছিলে না আমি তোমাকে মুক্তি করে দেই? তাই করছি। তোমাকে আজ মুক্তো করে দিবো আমি,তুমি একদম মুক্তো!””
অনিকশা অরিদকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“” এমন করে বলছো কেন? আমার খুব ভয় হচ্ছে। তোমাকে দেখে আমার খুব ভয় লাগছে,অরিদ! আর কিসের মুক্তির কথা বলছো? আমি কোনো মুক্তি চাইনা,আমিতো আমার অরিদের খাচায় বন্দী হতে চাই।””
অরিদ একটানে অনিকশাকে সরিয়ে নিয়ে বললো,
“”তুমি কি চাও না চাও সব আমি জানি,তোমার থেকে ভালো করে জানি। আমাকে কাছে টেনে না নেওয়াতেও এতোটা কষ্ট ছিলো না যতটা লুকিয়ে তুমি অন্যকারো বুকে পড়েছিলে।””
“” অন্যকারো বুকে?””
অরিদ অনিকশার দিকে এগিয়ে ধমকাতে ধমকাতে বললো,
“”তুমি মানা করতে পারবে,পালক তোমাকে জড়িয়ে নেয়নি?””
“” পালক!””
“” হ্যাঁ! হ্যাঁ!! হ্যাঁ!!! পালক। তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ড,সরি এক্স কেন হবে? প্রেজেন্ট এন্ড ফিউচার!””
অরিদ কথা শেষ করতেই অনিকশা ওর গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
“” তোমার কাছে আমি এটা কখনো আশা করিনি অরিদ,কখনো না। এত বছর তোমাকে আমি আমার হৃদয়ের সর্বোচ্চ জায়গায় যে সম্মান দিয়ে বসিয়েছিলাম আজ তুমি একটা আঘাতে শেষ করে দিলে। তোমাকে অনেক কিছু বলার ছিলো,কিন্তু এখন মনে হয় না আর কিছু বলা প্রয়োজন!””
অনিকশা চোখের পানি মুছতে মুছতে দরজা মেলে বেরিয়ে গেলো। কষ্ট হচ্ছে তার। খুব কষ্ট! যে ছেলেটা এক ফোঁটা ভালোবাসা না পেয়ে,এতো অবহেলার মধ্যেও এত ভালোবাসা দিতে পেরেছে,সে কিনা ছোট্ট একটা ভুল বুঝাবুঝি নিয়ে এমনটা করতে পারলো? একবার কি তার আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ হয়নি???
অনিকশা চলে যেতেই অরিদ হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে। ঘরের সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে সে।
“” দুলাভাই,ঘরের এ অবস্থা কেন? আপনাকে এমন পাগল পাগল লাগছে কেন? আপু কোথায়? আমরাতো আপনাদের সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেরাই সারপ্রাইজ হয়ে যাচ্ছি। কি ঘটেছে এখানে? কিছু বলছেন না কেন??””
অন্ত্রীশা নিজের হাতের কেকটা খাটের উপর রেখে দিয়েছে। আজ অনিকশা আর অরিদের পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী। পালক তাকে এখানেই নিয়ে আসার জন্য তাড়া দিচ্ছিলো। শুধু বিবাহ বার্ষিকির উইশ করার জন্যও পালক আসেনি। তার আরেকটা উদ্দেশ্য আছে। যে সম্পর্কটা তার আর অনিকশার একটা ভুল বুঝাবুঝির জন্য নড়বড়ে হয়ে আছে তা ঠিক করা। এই এক বছরে সে অনিকশাকে যতটুকু বুঝেছে তাতে এটা স্পষ্ট এতোদিনেও সে অরিদের কাছে কিছুই বলেনি। আর এই না বলার ব্যর্থতার জন্যই হয়তো তারা এতোটা কাছাকাছি থেকেও অনেকটা দূরে। এই দূরত্বটাকে সরিয়ে দিয়ে ওদের দুজনকে মিশিয়ে দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য পালকের। সেটা কোনো বিশেষ দিনে হলে মন্দ হয় না তাই পালক আজকেই এসেছে,অরিদের সাথে কথা বলবে বলে।
অন্ত্রীশা অরিদের দিকে এগুতেই ও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেছে। চোখের তীক্ষ্ণদৃষ্টি পালকের দিকে।
অন্ত্রীশা অরিদের দিকে হাত বাড়াতেই ওকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দিয়ে পালকের দিকে ঝাপিয়ে পড়ে। অরিদের এমন হঠাৎ আক্রমনে তাল সামলাতে না পেরে মেঝেতেই উল্টিয়ে পড়ে গিয়েছে পালক। সাথে অরিদও।
অন্ত্রীশা ভয়ে দৌড়ে এসে অরিদের হাত থেকে পালককে ছুটানোর চেষ্টা করছে,,
“” কি করছেন,দুলাভাই? পালককে কেন মারছেন? আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? ছাড়ুন! ব্যথা পাবেন তো!””
পালক নিজেকে সামলে নিয়ে অন্ত্রীশাকে উদ্দেশ্য করে বললো,,
“” অন্ত্রীশা তুমি ব্যথা পাবে সরে যাও। অরিদ ভাইয়ার এখন মাথা ঠিক নেই।””
অন্ত্রীশা পালকের কথা অগ্রাহ্য করেই অরিদের হাত ধরে টানতে থাকে। অরিদের দুটো হাতই পালকের গলা টিপে ধরে আছে।
পালক আবার চিৎকার করে বললো,
“” উনার পাগলামীর কারণ হয়তো আমি বুঝতে পারছি,অন্ত্রীশা! উনাকে আমি সামলিয়ে নিচ্ছি। তুমি অনিকশাকে খুঁজো। দেরি হলে অনেক বড় কিছু ঘটে যেতে পারে। আমার কথাটা শুনো,প্লিজ অন্ত্রীশা!””
অন্ত্রীশা অরিদের কাছ থেকে সরে দরজার কাছে এগিয়ে আবার ওদের দুজনের দিকে তাকাতেই পালক চোখের ইশারায় বললো,
“” যাও!””
অন্ত্রীশা সেখানে আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায়নি। পুরো ফ্লাটে অনিকশাকে খোঁজা শুরু করে দিয়েছে। কোথাও না পেয়ে ছাদের দিকে পা বাড়িয়েছে।
অরিদ রাগে নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলেছে,চোখ,মুখ,নাক,গাল সব লালরং ধারন করে ফোলে উঠেছে। পালক অনেক কষ্টে নিজের গলা থেকে অরিদের একট হাত সরালেও সে থমকে যায়নি। ডান হাতটা মুঠো করে পালকের মুখের দিকে আনতেই পালক নিজের হাত দিয়ে আটকে বললো,
“” সেদিন যে কারণে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন আজ সেই একি কারণে আমার গলা টিপে ধরেছেন,তাই না বড় ভাই???””
চলবে
#ধোঁয়ার_নেশা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৯)
পালকের চকচক করে উঠা চোখের দিকে তাকিয়ে অন্ত্রীশার ভিজে উঠা চোখটা নিমিষেই শুকিয়ে গিয়েছে। থমথমে চাহনিতে চেয়ে রয়েছে অন্ত্রীশা। পালকের শুধু চোখ নয়,তার চোখের পাতার পলকে,ঠোঁটের হাসিতে,কথার ধ্বনিতে,নিশ্বাসের শব্দে মিশে রয়েছে খুশির আমেজ। যার বিপরীতে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অন্ত্রীশার মনের ভেতরের অন্ধকার কুটিরে জমে থাকা না বলা কথা আর তার শরীরের বাহ্যিকে অতি যত্ন আর আদরের মালিশে সাজসজ্জা!
“” অন্ত্রীশা আমার খুশিতে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা৷ এতো দ্রুত আর হঠাৎ করেই এভাবে আমার পত্রীকন্যা আমার সামনে চলে আসবে,আমি তো ভাবিইনি। আমার তো এখনো মনে হচ্ছে আমি স্বপ্নে আছি। তুমি কি আমাকে একটু চিমটি কাটবে,অনতি?””
পালকের মুখে অনতি ডাকটাও আজ অসাধারন খুশি বয়ে বেড়াচ্ছে। এটা তো তার ডাকনাম। আর এই ডাক নামে তাকে তার খুব কাছের মানুষরাই ডাকে। পালকও কি তার কাছের মানুষ? না তো সে তো খুব দূরের মানুষ নাহলে সে কী করে তার বিয়ে করা বউয়ের সামনে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে এতোটা খুশি প্রকাশ করতে পারে??
“” কী হলো,চিমটি কাটো না!””
অনতি নিজের ভাবনাগুলো পাশে রেখে ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি হেসে বললো,,
“” চিমটি কাটতে হবে না। আপনি বাস্তবেই বিরাজ করছেন। যে বাস্তবটা আপনার আর আমার সম্পর্কের ইতি টানতে বলছে।””
“” মানে?””
“” কিছু না। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি আপনার জন্য খাবার বাড়ছি।””
“” আমি তো খেয়ে এসেছি। পত্রীকন্যা আমায় নিজের হাতের রান্না খায়িয়েছে। আমি তো ওর বাসা থেকেই এসেছি। কী রান্না করেছিলো শুনবে??””
না আমি কিছু শুনবো না,কিছুনা। অন্য একটা মেয়ের রান্না খেয়ে এসে আমার সামনে গল্প করবেন? তার থেকে তো ভালো হতো যদি আপনি আমার ভেতরের সবকিছু খেয়ে নিয়ে গল্প করতেন তাও আমার এতো কষ্ট হতো না। আপনার এই বেখেয়ালিপনা আর অন্ধ ভালোবাসার শাস্তি আপনি পাবেন,আল্লাহ না করুক সেটা যেন আমার হাতে না হয়। তাহলে আপনার কপালে কী শনি আছে আমি নিজেও জানি না।
অন্ত্রীশা মনের কষ্ট মনেই গেঁথে রাখতে রাখতে নিজের শাড়ীর আঁচলে হাত দিয়েছে।
“” আরে তুমি আজ শাড়ী পরেছো যে,কোথাও গিয়েছিলে নাকি?””
“” হুম,ভেবেছিলাম আমিও আপনার পত্রীকন্যার মতো আমার প্রেমিককে তুলে নিয়ে আসবো,কিন্তু আহম্মকটা আবার অন্য কারো গলায় ঝুলছে!””
পালক বেশ গম্ভীর ও চিন্তিত কন্ঠে বললো,,
“” সে কী,তোমার প্রেমিক তো তাহলে সুবিধার ছেলে না। এমন ছেলের হাতে তুমি কী করে পড়লে? তোমার মতো এতো ভালো একটা মেয়ের কপালে এমন আহম্মক প্রেমিক??””
অন্ত্রীশা অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে পালকের দিকে তেড়ে এসেছে। ডানহাতের শাহাদাৎ আঙুলটা উঁচিয়ে নিয়ে বললো,,
“” খবরদার আমার প্রেমিককে নিয়ে আপনি কিছু বলবেন না। আমার প্রেমিক আহম্মক হোক আর ডাহম্মক হোক তাকে শুধু আমি বলবো।””
“” এতো ভালেবাসা?””
“” হুম!””
দুজন দু জায়গায় শুয়ে পায়চারির খেলায় মেতে আছে,একজন অপেক্ষাকে নিজের বশে করে তো আরেকজন অপেক্ষার ব্যর্থতায়। দুজনের মনেই এক অজানা অনুভূতিতে ছুঁয়ে আছে। একজন খুশিতে স্বপ্নের ঠিকানাগুলো সাজানো নিয়ে আরেকজন কষ্টে ভাঙা হৃদয়ের টুকরোগুলো কুড়িয়ে নেওয়ায়।
পালক হাজারো ভাবনা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুম আসেনি অন্ত্রীশার চোখে। তার ভয় হচ্ছে,অভিমান হচ্ছে,রাগ হচ্ছে,কষ্ট হচ্ছে,কান্না পাচ্ছে আবার ভালোবাসাও পাচ্ছে। বার বার ইচ্ছেগুলো তাকে তাড়া দিচ্ছে পালকের কাছে ছুটে গিয়ে বলতে,,আপনি আর কারো হতে পারেন না,আর কোনো ভুলে পা বাড়াতে পারেন না,আপনি শুধু আমার,আপনার স্বপ্নের রাজ্য সাজানোর প্রত্যেকটি ইটের টুকরে আর সিমেন্টের কণায় শুধু আমি মিশে থাকতে চাই! কিন্তু এক চাপা অভিমান অন্ত্রীশাকে ছুটে যেতে দিচ্ছে না৷ ভালোবাসাটা যখন সীমা লঙ্ঘন করে অতিরিক্তে পা দেয় তখন আর নিজে থেকে কিছু করতে ইচ্ছে করে না,একটুও জোর খাটাতে ইচ্ছে করে না। মন তো শুধু চায় প্রিয় মানুষটি নিজে থেকেই সব বুঝে নিক,নিজে থেকে এসে অভিমান ভাঙিয়ে দিক। অন্ত্রীশার ক্ষেত্রেও তা হচ্ছে। তার অভিমানরা খুব করে চায়ছে পালক নিজে থেকে সবটা বুঝোক। কিন্তু পালক কি আদৌ বুঝবে অন্ত্রীশার অভিমানকে???
অন্ত্রীশার ভেতরটা খুব চিৎকার করে কাঁদছে কিন্তু সেই চিৎকারটা সে আর তার আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো শুনার মতো ক্ষমতা আর কারো নেই। আসলেই ক্ষমতা নেই নাকি আগ্রহ নেই বুঝার???
সকালে মিসেস তানিয়া বেগমের চিৎকারে ঘুৃম ভেঙেছে অন্ত্রীশার। সারারাত কেঁদে কেটে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো তা তার অজানা। কান্নার প্রবলতাটা হয়তো বেশিই পড়েছিলো যার ফলাফল হিসেবে,মাথা ভারী হয়ে কিছুটা ব্যথা অনুভব হচ্ছে,চোখগুলো ফুলে আছে সাথে গালটাও ভারী হয়ে এসেছে। অন্ত্রীশা নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে পা বাড়িয়েছে মিসেস তানিয়া বেগমের রুমে!
“” তোর পছন্দটাই সব হয়ে গেলো,পালক? আমার পছন্দের কোনো মূল্য নেই? এভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাচ্ছিস?””
“” আম্মু,তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? আর পছন্দেরই কী আছে? আমি আর অন্ত্রীশা কেউ কারোর কাছে মানিয়ে নিতে পারিনি। একটা সম্পর্ক এভাবে জোর করে এগিয়ে নেওয়া অসম্ভব। যে মেয়েটাকে আমি কখনোই স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবো না তাকে কেন সম্পর্কের দোহায় দিয়ে বেধে রাখবো? তারও তো একটা শখ আহ্লাদের ব্যাপার আছে,তারও তো হাজারটা স্বপ্ন রয়েছে!””
মিসেস তানিয়া বেগম এতক্ষণ বসে থাকলেও এবার আর বসে থাকতে পারলেন না। বিছানা ছেড়ে পালকের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালেন। চোখে তার রাগ আর তাচ্ছিল্যতা। এমন একটা ভাব যে পালক এমন কথা বলছে উনি তা মেনে নিতে পারছেন না। হাতটাও শক্ত হয়ে এসেছে হয়তো পালকের গালে চড়ও পড়তে পারে।
“” থাপড়িয়ে তোর দ্বিতীয় বিয়ের স্বাদ আমি ছুটিয়ে দিবো। তোর বাপ থাকলে তুই এমন গলা উঁচিয়ে কথা বলতে পারতি? আজ বাপ নেই বলে নিজেকে খুব বড় ভেবে ফেলেছিস?? আমার সাথে তর্ক করছিস???””
শাশুড়ির মুখে পালকের দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনতেই অন্ত্রীশার মাথা পাক দিয়ে উঠেছে। হঠাৎ করেই শরীরের সব শক্তি কেউ কেড়ে নিয়েছে এমন মনে হলো। নিজের শরীরের ভরটাও যেন নিজে ধরে রাখতে পারছে না। নিজেকে দাঁড়িয়ে রাখার জন্য দরজাটা আকড়ে ধরে,চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেললো।
মা আর ভাইয়ের ঝগড়া দেখছে পাপড়ি। একবার মনে হচ্ছে মায়ের দলে যাবে তো আরেকবার মনে হচ্ছে ভাইয়ের দলে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আম্মুর দিক ভাবতে গেলেও আম্মুর কথাও ঠিক আছে,ঘরে বউ থাকতে আবার কিসের বিয়ে?? এটাতো ঘোর অন্যায়! আবার ভাইয়ের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে ভাইয়ের দিক থেকেও সে ঠিক আছে,কেননা সে তো জানে ভালেবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার মধ্যে কত সুখ! সুখটা নাহয় সে বুঝতে পারেনি কিন্তু ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে না পাওয়ায় কতটা কষ্ট এটা ঐদিন আতিশের ব্যবহারেই বুঝে গেছে। আর বোন হয়ে কী করে চায়বে তার ভাইটাও এমন কষ্টে ভুগোক??? তাই সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাটাকে গ্রহনযোগ্য মনে করেছে।
পালক এবার মিসেস তানিয়া বেগমের হাতদুটো নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরেছে। মেঝের দিকে তাকিয়ে অসহায়ভাবে বললো,,
“” আমি পত্রীকন্যাকে ছাড়া বাচবো না,আম্মু! ও বলেছে কাল ওকে বিয়ে না করলে ও আমার থেকে আবার হারিয়ে যাবে। এতো বছর ধরে ওকে খুঁজতে খুঁজতে আমি ক্লান্ত! এবার পেয়েও যদি আবার হারিয়ে ফেলি তাহলে আমি বেঁচে থেকেও যে মরে যাবো! ও যে আমার প্রাণ আর প্রাণ ছাড়া শরীরটাকে আমি কী করে বয়ে বেড়াবো?””
ছেলের অসহায়ত্ব আর কষ্টে সব মায়ের মনই গলে যায়। মিসেস তানিয়া বেগমেরও তাই হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেও যে পালককে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলতো পারতো এখন সে শক্ত কন্ঠে দুটো কথাও বলতে পারছে না। কন্ঠ নরম হয়ে এসেছে,,,
“” তাই বলে তুই অন্ত্রীশার কথা ভাববি না? তোর ভালোবাসাকে গ্রহণ করতে গিয়ে ওকে বর্জন করবি? এখানে ওর কী দোষ?””
পালক মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অন্ত্রীশা বলে উঠলো,,
“” উনার দ্বিতীয় বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই,আম্মা। উনার মতো আমিও পরিবারের চাপেই কাগজে সই করেছিলাম। সামান্য একটা কাগজের সই কখনোই একটা সম্পর্ক ধরে রাখতে পারে না। তার জন্য অসীম ভালোবাসার প্রয়োজন। আর সেটা আমাদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। তাছাড়াও উনার মতো আমার ও একজন আছে,যাকে আমিও অনেক বেশি ভালোবাসি!””
অন্ত্রীশার কথাতে পুরো রুমে নিরবতায় ছেয়ে আছে। সবার চোখজোড়া অন্ত্রীশার উপর। সবাই অপ্রস্তুত হয়ে আছে। কেউই যেন এমন একটা উক্তি আশা করেনি তাও অন্ত্রীশার কাছ থেকে। সবাইকে বিস্মিত করে অন্ত্রীশা পেছন ঘুরে হাঁটা শুরু করে দিয়েছে। তার যে আর কিছু বলার শক্তিতুটু নেই। ওখানে থাকা মানে আরো নানা প্রশ্নে সম্মুখীন হওয়া। এখন সে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চায় না, তার যে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। মনটা খুব করে জানতে চায়ছে,কেন এমনটা হচ্ছে????
অন্ত্রীশা রুমে পা ফেলতেই পেছন থেকে ধরফরিয়ে পালকও ভেতরে ঢুকেছে। উৎকন্ঠে বললো,,
“” সত্যি তোমার আপত্তি নেই অনতি?””
অন্ত্রীশার ক্লান্ত চোখ আবার গিয়ে ঠেকেছে পালকের চোখে। সেই আগের মতোই চকচক করছে,এবারেরটা কি একটু বেশিই চকচক করছে??
ঐ চোখের চকচকটা তাকে জ্বালিয়ে নাশ করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে শরীরের এক ইঞ্চি গ্যাপ রেখে একটা করে ফোস্কা পড়ছে। না এক ইঞ্চি নয় আধা ইঞ্চি! অন্ত্রিশা পালকের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না। বিছানা গুছাতে গুছাতে বললো,,
“” ওমা! আপত্তি কেন থাকবে?? আপত্তি থাকার মতো তেমন কিছু কি ঘটেছে আমাদের মাঝে?””
“” কিছু হয়নি ঠিক আছে,কিন্তু তারপরেও তুমি এতো সহজে মেনে নিবে ভাবতে পারিনি। মনে হচ্ছে অন্য কোনো কারণ!””
“” প্রেমিক কারণ!””
“” প্রেমিক কারন?””
“” হুম,কাল রাতে স্বপ্নে এসেছিলো। এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলো। আর আমিও মাফ করে দিলাম।””
পালক বিছানায় ধপাস করে বসে পড়েছে,অন্ত্রীশাকে সাহায্য করার বাহানায় ওর হাত থেকে কাঁথাটা নিয়ে নিজে ভাঁজ করতে করতে বললো,,
“” স্বপ্নে জড়িয়ে ধরতেই সব মাফ?””
“” হুম!””
“” এতো বড় অন্যায় এতো ছোট জিনিসে মাফ?””
“” কেন আপনি চান তাকে আরো কঠিনভাবে মাফ করতে?””
পালক কাঁথাটা বালিশের উপরে রেখে বললো,,
“” অবশ্যই,তোমার উনাকে কঠিন হতে কঠিনতর শাস্তি দেওয়া উচিত।””
“” সিউর?””
“” ১০০%””
“” ওকে। তাহলে সত্যি সত্যি যখন আমার কাছে মাফ চাইতে আসবে তখন কঠিন হতে কঠিনতর শাস্তি দিবো।””
অন্ত্রীশা ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকতে নিলেই পালক আবার বললো,,
“” স্বপ্নে এসেছিলো বলে সত্যি সত্যিই আসবে?””
অন্ত্রীশা পেছন ঘুরে চোখের পাতা ফেলে হ্যাঁ বোঝাতেই পালক বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে। চোখে বিস্ময় নিয়ে বললো,,
“” তোমার স্বপ্নের এতো পাওয়ার?””
“” না,আমার ভালোবাসার পাওয়ার!””
স্বপ্ন পুরনের ধারটায় চলে এসেও যখন তা অপুর্নই থেকে যায় তখন বুকের একদম ভেতরে না ভেতরেরও ভেতর থেকে ছোট্ট একটা ব্যর্থতার নিশ্বাস বেড়িয়ে আসে। পেছনে ফেলে আসা হাজারও কষ্টগুলো তখন এতোটাই চেপে ধরে যে তার ঐ ব্যর্থটার নিশ্বাসটা ফেলতেও শক্তিটুকু থাকে না। অন্ত্রীশারও আজ প্রত্যেকটা নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে নিশ্বাসগুলো বন্ধ করে একটা ছোট বাক্সে জমা করে রাখতে।
“” অন্ত্রীশা?””
অন্ত্রীশা বেলকনিতে দাঁড়িয়েই চাঁদের দিকে মুখ করে ছিলো। কিন্তু সে চাঁদ দেখছিলো না। তার চোখ বন্ধ করে চাঁদকে অনুভব করার চেষ্টা করছিলো। হঠাৎ পালকের ডাকে চোখ মেলেছে,,,
“” ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছো? এদিকে এসো,আমি পত্রীকন্যার জন্য কী কী কিনেছি দেখে যাও।””
পালকের হাতভর্তি শপিংব্যাগগুলোর উপর ও আজ অন্ত্রীশার রাগ হচ্ছে।
অন্ত্রীশার সামনে লাল বেনারশী মেলতেই অন্ত্রীশা বলে উঠলো,,
“” লাল বেনারশী যে?””
“” হুম,বিয়েতে তো লাল বেনারশীই পরে।””
“” তাই? তাহলে আমাকে মিষ্টি কালার বেনারশী কেন দিয়েছিলেন?””
“” ওটাতো অনিকশার ইচ্ছে ছিলো। ওকে দেখানোর জন্যই দিয়েছিলাম।””
অন্ত্রীশা শুকনো হাসি দিয়ে বললো,,
“” আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন,মিষ্টি কালার আপনার পত্রীকন্যারও পছন্দ!””
পালক হাত থেকে বেনারশী ফেলে অন্ত্রীশার দিকে তাকিয়ে বললো,,
“” তাইতো! এটাতো আমার মাথায়ই ছিলো না। এখন কী হবে? এতো রাতে তো মার্কেট খোলাও পাবো না। ধুর! কালকে আবার মার্কেটে যেতে হবে।!!””
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই পালক অন্ত্রীশার বিছানায় একটি কাগজ দেখতে পেলো। কাগজটি সেই মিষ্টি কালার বেনারশীতে রাখা যেটা অন্ত্রীশা বিয়ের দিন পরেছিলো। পালক সোফা থেকে উঠে চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়ছে,,,,
***মাঝরাতে আমার প্রেমিক স্বপ্নে এসেছিলো। সে বলেছে আমি যদি এখনি আমার প্রাক্তন স্বামীকে রেখে বাসায় না ফিরি তাহলে নাকি সে আমার কাছে সত্যি সত্যি ক্ষমা চাইতে আসবে না। এখন আপনিই বলুন সে যদি ক্ষমা চায়তে না আসে তাহলে আমি কঠিন হতে কঠিনতর শাস্তিটা কিভাবে দিবো? তাই চট করে সব গুছিয়ে চলে যাচ্ছি!
আপনার বিয়েতে তো আমি কিছু দিতে পারলাম না। তাই আপনার পত্রীকন্যার পছন্দের রঙের বেনারশীটা দিয়ে গেলাম। ভুলেও তাকে বলবেন না যে এটা পুর্বে ভুল জায়গায় ব্যহার হয়েছে তাহলে কিন্তু ও পরবে না।
যাইহোক,আপনার বিয়ের শুভকামনা রইলো।
ইতি
অন্ত্রীশা
হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত হওয়ায় ঘরোয়াভাবেই বিয়ের কার্যসম্পাদন হচ্ছে। সাক্ষী হিসেবে পালকের ফ্রেন্ড কাদির আর আতিশের আসার কথা ছিলো। কিন্তু আতিশ অফিসের দোহায় দিয়ে আসতে পারেনি তাই স্নিগ্ধা তার এক ভাইকে নিয়ে এসেছে। কাজী একটু পরই চলে আসবে।
মিসেস তানিয়া বেগম আর পাপড়িও তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন।যতই হোক এ বাড়ির ছেলের বিয়ে,হোক না তা দ্বিতীয় বিয়ে,কিন্তু বিয়েতো!
“” এইটা কোনো বেনারশী হলো পালক? এমন ভুটকানো কালারে আমাকে কেমন বিদঘুটে লাগছে। তোমার মাথায় এটা আসলো কিভাবে?? তুমি কখনো দেখেছো মিষ্টি কালারের বেনারশী পরে বিয়ে করতে??””
স্নিগ্ধা শাড়ীটা এমনভাবে ছুঁয়ে দেখছে যেন এতে মাছের আশটে লেগে আছে,ভালো করে হাত দিলেই হাতে লেগে গন্ধ বের হবে!
“” এতো রাগ করছো কেন,পত্রীকন্যা? এটাতো তোমার ফেবারিট কালার,তাই সারপ্রাইজ দিলাম!””
“” ফেবারিট? এইটা আমার ফেবারিট কালার? কে বলেছে তোমাকে?””
“” কেন,তুমিই তো চিঠিতে আমাকে জানিয়েছিলে,ভুলে গেলে?””
পালকের কথাই স্নিগ্ধা আমতা আমতা করে বললো,,
“” ওটাতো তখন ছিলো,এখন আমার এটা ভালো লাগে না।””
পালক স্নিগ্ধার হাত ধরতে গিয়েও থেমে গিয়ে আদুরী কন্ঠে বললো,,
“” রাগ করে না। আচ্ছা এর পর থেকে এমন ভুল আর কখনো হবে না৷ এবারের মতো ক্ষমা করে দাও?””
স্নিগ্ধা বিরক্তি নিয়ে বললো,,
“” কাজী কখন আসবে? উফ! কখন যে এই শাড়ীটা চেন্জ করবো, কেমন পচা মাছের গন্ধ আসছে শরীর থেকে!””
সবার অপেক্ষার প্রহর শেষ করে কাদির কাজী নিয়ে হাজির হয়েছে। কাজী তার মতো কাজ শেষ করে স্নিগ্ধার দিকে কলম এগিয়ে দিলেন সাইন করার জন্য। স্নিগ্ধা ঝটপট সাইন করে দিতেই পালকের দিকে পেপার আর কলম এগিয়ে ধরলেন কাজী।পালক রেজিস্ট্রি পেপারটা নিজের দিকে নিতেই চোখ পড়েছে স্নিগ্ধা সিথি নামটার উপর। মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে নিজেও সাইন করার জন্য কলমটা আঙুল দিয়ে চেপে ধরেছে।
চলবে