#ধোঁয়ার_নেশা,১৯,২০
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৯)
পালকের চকচক করে উঠা চোখের দিকে তাকিয়ে অন্ত্রীশার ভিজে উঠা চোখটা নিমিষেই শুকিয়ে গিয়েছে। থমথমে চাহনিতে চেয়ে রয়েছে অন্ত্রীশা। পালকের শুধু চোখ নয়,তার চোখের পাতার পলকে,ঠোঁটের হাসিতে,কথার ধ্বনিতে,নিশ্বাসের শব্দে মিশে রয়েছে খুশির আমেজ। যার বিপরীতে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অন্ত্রীশার মনের ভেতরের অন্ধকার কুটিরে জমে থাকা না বলা কথা আর তার শরীরের বাহ্যিকে অতি যত্ন আর আদরের মালিশে সাজসজ্জা!
“” অন্ত্রীশা আমার খুশিতে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা৷ এতো দ্রুত আর হঠাৎ করেই এভাবে আমার পত্রীকন্যা আমার সামনে চলে আসবে,আমি তো ভাবিইনি। আমার তো এখনো মনে হচ্ছে আমি স্বপ্নে আছি। তুমি কি আমাকে একটু চিমটি কাটবে,অনতি?””
পালকের মুখে অনতি ডাকটাও আজ অসাধারন খুশি বয়ে বেড়াচ্ছে। এটা তো তার ডাকনাম। আর এই ডাক নামে তাকে তার খুব কাছের মানুষরাই ডাকে। পালকও কি তার কাছের মানুষ? না তো সে তো খুব দূরের মানুষ নাহলে সে কী করে তার বিয়ে করা বউয়ের সামনে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে এতোটা খুশি প্রকাশ করতে পারে??
“” কী হলো,চিমটি কাটো না!””
অনতি নিজের ভাবনাগুলো পাশে রেখে ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি হেসে বললো,,
“” চিমটি কাটতে হবে না। আপনি বাস্তবেই বিরাজ করছেন। যে বাস্তবটা আপনার আর আমার সম্পর্কের ইতি টানতে বলছে।””
“” মানে?””
“” কিছু না। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি আপনার জন্য খাবার বাড়ছি।””
“” আমি তো খেয়ে এসেছি। পত্রীকন্যা আমায় নিজের হাতের রান্না খায়িয়েছে। আমি তো ওর বাসা থেকেই এসেছি। কী রান্না করেছিলো শুনবে??””
না আমি কিছু শুনবো না,কিছুনা। অন্য একটা মেয়ের রান্না খেয়ে এসে আমার সামনে গল্প করবেন? তার থেকে তো ভালো হতো যদি আপনি আমার ভেতরের সবকিছু খেয়ে নিয়ে গল্প করতেন তাও আমার এতো কষ্ট হতো না। আপনার এই বেখেয়ালিপনা আর অন্ধ ভালোবাসার শাস্তি আপনি পাবেন,আল্লাহ না করুক সেটা যেন আমার হাতে না হয়। তাহলে আপনার কপালে কী শনি আছে আমি নিজেও জানি না।
অন্ত্রীশা মনের কষ্ট মনেই গেঁথে রাখতে রাখতে নিজের শাড়ীর আঁচলে হাত দিয়েছে।
“” আরে তুমি আজ শাড়ী পরেছো যে,কোথাও গিয়েছিলে নাকি?””
“” হুম,ভেবেছিলাম আমিও আপনার পত্রীকন্যার মতো আমার প্রেমিককে তুলে নিয়ে আসবো,কিন্তু আহম্মকটা আবার অন্য কারো গলায় ঝুলছে!””
পালক বেশ গম্ভীর ও চিন্তিত কন্ঠে বললো,,
“” সে কী,তোমার প্রেমিক তো তাহলে সুবিধার ছেলে না। এমন ছেলের হাতে তুমি কী করে পড়লে? তোমার মতো এতো ভালো একটা মেয়ের কপালে এমন আহম্মক প্রেমিক??””
অন্ত্রীশা অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে পালকের দিকে তেড়ে এসেছে। ডানহাতের শাহাদাৎ আঙুলটা উঁচিয়ে নিয়ে বললো,,
“” খবরদার আমার প্রেমিককে নিয়ে আপনি কিছু বলবেন না। আমার প্রেমিক আহম্মক হোক আর ডাহম্মক হোক তাকে শুধু আমি বলবো।””
“” এতো ভালেবাসা?””
“” হুম!””
দুজন দু জায়গায় শুয়ে পায়চারির খেলায় মেতে আছে,একজন অপেক্ষাকে নিজের বশে করে তো আরেকজন অপেক্ষার ব্যর্থতায়। দুজনের মনেই এক অজানা অনুভূতিতে ছুঁয়ে আছে। একজন খুশিতে স্বপ্নের ঠিকানাগুলো সাজানো নিয়ে আরেকজন কষ্টে ভাঙা হৃদয়ের টুকরোগুলো কুড়িয়ে নেওয়ায়।
পালক হাজারো ভাবনা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুম আসেনি অন্ত্রীশার চোখে। তার ভয় হচ্ছে,অভিমান হচ্ছে,রাগ হচ্ছে,কষ্ট হচ্ছে,কান্না পাচ্ছে আবার ভালোবাসাও পাচ্ছে। বার বার ইচ্ছেগুলো তাকে তাড়া দিচ্ছে পালকের কাছে ছুটে গিয়ে বলতে,,আপনি আর কারো হতে পারেন না,আর কোনো ভুলে পা বাড়াতে পারেন না,আপনি শুধু আমার,আপনার স্বপ্নের রাজ্য সাজানোর প্রত্যেকটি ইটের টুকরে আর সিমেন্টের কণায় শুধু আমি মিশে থাকতে চাই! কিন্তু এক চাপা অভিমান অন্ত্রীশাকে ছুটে যেতে দিচ্ছে না৷ ভালোবাসাটা যখন সীমা লঙ্ঘন করে অতিরিক্তে পা দেয় তখন আর নিজে থেকে কিছু করতে ইচ্ছে করে না,একটুও জোর খাটাতে ইচ্ছে করে না। মন তো শুধু চায় প্রিয় মানুষটি নিজে থেকেই সব বুঝে নিক,নিজে থেকে এসে অভিমান ভাঙিয়ে দিক। অন্ত্রীশার ক্ষেত্রেও তা হচ্ছে। তার অভিমানরা খুব করে চায়ছে পালক নিজে থেকে সবটা বুঝোক। কিন্তু পালক কি আদৌ বুঝবে অন্ত্রীশার অভিমানকে???
অন্ত্রীশার ভেতরটা খুব চিৎকার করে কাঁদছে কিন্তু সেই চিৎকারটা সে আর তার আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো শুনার মতো ক্ষমতা আর কারো নেই। আসলেই ক্ষমতা নেই নাকি আগ্রহ নেই বুঝার???
সকালে মিসেস তানিয়া বেগমের চিৎকারে ঘুৃম ভেঙেছে অন্ত্রীশার। সারারাত কেঁদে কেটে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো তা তার অজানা। কান্নার প্রবলতাটা হয়তো বেশিই পড়েছিলো যার ফলাফল হিসেবে,মাথা ভারী হয়ে কিছুটা ব্যথা অনুভব হচ্ছে,চোখগুলো ফুলে আছে সাথে গালটাও ভারী হয়ে এসেছে। অন্ত্রীশা নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে পা বাড়িয়েছে মিসেস তানিয়া বেগমের রুমে!
“” তোর পছন্দটাই সব হয়ে গেলো,পালক? আমার পছন্দের কোনো মূল্য নেই? এভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাচ্ছিস?””
“” আম্মু,তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? আর পছন্দেরই কী আছে? আমি আর অন্ত্রীশা কেউ কারোর কাছে মানিয়ে নিতে পারিনি। একটা সম্পর্ক এভাবে জোর করে এগিয়ে নেওয়া অসম্ভব। যে মেয়েটাকে আমি কখনোই স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবো না তাকে কেন সম্পর্কের দোহায় দিয়ে বেধে রাখবো? তারও তো একটা শখ আহ্লাদের ব্যাপার আছে,তারও তো হাজারটা স্বপ্ন রয়েছে!””
মিসেস তানিয়া বেগম এতক্ষণ বসে থাকলেও এবার আর বসে থাকতে পারলেন না। বিছানা ছেড়ে পালকের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালেন। চোখে তার রাগ আর তাচ্ছিল্যতা। এমন একটা ভাব যে পালক এমন কথা বলছে উনি তা মেনে নিতে পারছেন না। হাতটাও শক্ত হয়ে এসেছে হয়তো পালকের গালে চড়ও পড়তে পারে।
“” থাপড়িয়ে তোর দ্বিতীয় বিয়ের স্বাদ আমি ছুটিয়ে দিবো। তোর বাপ থাকলে তুই এমন গলা উঁচিয়ে কথা বলতে পারতি? আজ বাপ নেই বলে নিজেকে খুব বড় ভেবে ফেলেছিস?? আমার সাথে তর্ক করছিস???””
শাশুড়ির মুখে পালকের দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনতেই অন্ত্রীশার মাথা পাক দিয়ে উঠেছে। হঠাৎ করেই শরীরের সব শক্তি কেউ কেড়ে নিয়েছে এমন মনে হলো। নিজের শরীরের ভরটাও যেন নিজে ধরে রাখতে পারছে না। নিজেকে দাঁড়িয়ে রাখার জন্য দরজাটা আকড়ে ধরে,চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেললো।
মা আর ভাইয়ের ঝগড়া দেখছে পাপড়ি। একবার মনে হচ্ছে মায়ের দলে যাবে তো আরেকবার মনে হচ্ছে ভাইয়ের দলে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আম্মুর দিক ভাবতে গেলেও আম্মুর কথাও ঠিক আছে,ঘরে বউ থাকতে আবার কিসের বিয়ে?? এটাতো ঘোর অন্যায়! আবার ভাইয়ের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে ভাইয়ের দিক থেকেও সে ঠিক আছে,কেননা সে তো জানে ভালেবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার মধ্যে কত সুখ! সুখটা নাহয় সে বুঝতে পারেনি কিন্তু ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে না পাওয়ায় কতটা কষ্ট এটা ঐদিন আতিশের ব্যবহারেই বুঝে গেছে। আর বোন হয়ে কী করে চায়বে তার ভাইটাও এমন কষ্টে ভুগোক??? তাই সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাটাকে গ্রহনযোগ্য মনে করেছে।
পালক এবার মিসেস তানিয়া বেগমের হাতদুটো নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরেছে। মেঝের দিকে তাকিয়ে অসহায়ভাবে বললো,,
“” আমি পত্রীকন্যাকে ছাড়া বাচবো না,আম্মু! ও বলেছে কাল ওকে বিয়ে না করলে ও আমার থেকে আবার হারিয়ে যাবে। এতো বছর ধরে ওকে খুঁজতে খুঁজতে আমি ক্লান্ত! এবার পেয়েও যদি আবার হারিয়ে ফেলি তাহলে আমি বেঁচে থেকেও যে মরে যাবো! ও যে আমার প্রাণ আর প্রাণ ছাড়া শরীরটাকে আমি কী করে বয়ে বেড়াবো?””
ছেলের অসহায়ত্ব আর কষ্টে সব মায়ের মনই গলে যায়। মিসেস তানিয়া বেগমেরও তাই হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেও যে পালককে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলতো পারতো এখন সে শক্ত কন্ঠে দুটো কথাও বলতে পারছে না। কন্ঠ নরম হয়ে এসেছে,,,
“” তাই বলে তুই অন্ত্রীশার কথা ভাববি না? তোর ভালোবাসাকে গ্রহণ করতে গিয়ে ওকে বর্জন করবি? এখানে ওর কী দোষ?””
পালক মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অন্ত্রীশা বলে উঠলো,,
“” উনার দ্বিতীয় বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই,আম্মা। উনার মতো আমিও পরিবারের চাপেই কাগজে সই করেছিলাম। সামান্য একটা কাগজের সই কখনোই একটা সম্পর্ক ধরে রাখতে পারে না। তার জন্য অসীম ভালোবাসার প্রয়োজন। আর সেটা আমাদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। তাছাড়াও উনার মতো আমার ও একজন আছে,যাকে আমিও অনেক বেশি ভালোবাসি!””
অন্ত্রীশার কথাতে পুরো রুমে নিরবতায় ছেয়ে আছে। সবার চোখজোড়া অন্ত্রীশার উপর। সবাই অপ্রস্তুত হয়ে আছে। কেউই যেন এমন একটা উক্তি আশা করেনি তাও অন্ত্রীশার কাছ থেকে। সবাইকে বিস্মিত করে অন্ত্রীশা পেছন ঘুরে হাঁটা শুরু করে দিয়েছে। তার যে আর কিছু বলার শক্তিতুটু নেই। ওখানে থাকা মানে আরো নানা প্রশ্নে সম্মুখীন হওয়া। এখন সে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চায় না, তার যে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। মনটা খুব করে জানতে চায়ছে,কেন এমনটা হচ্ছে????
অন্ত্রীশা রুমে পা ফেলতেই পেছন থেকে ধরফরিয়ে পালকও ভেতরে ঢুকেছে। উৎকন্ঠে বললো,,
“” সত্যি তোমার আপত্তি নেই অনতি?””
অন্ত্রীশার ক্লান্ত চোখ আবার গিয়ে ঠেকেছে পালকের চোখে। সেই আগের মতোই চকচক করছে,এবারেরটা কি একটু বেশিই চকচক করছে??
ঐ চোখের চকচকটা তাকে জ্বালিয়ে নাশ করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে শরীরের এক ইঞ্চি গ্যাপ রেখে একটা করে ফোস্কা পড়ছে। না এক ইঞ্চি নয় আধা ইঞ্চি! অন্ত্রিশা পালকের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না। বিছানা গুছাতে গুছাতে বললো,,
“” ওমা! আপত্তি কেন থাকবে?? আপত্তি থাকার মতো তেমন কিছু কি ঘটেছে আমাদের মাঝে?””
“” কিছু হয়নি ঠিক আছে,কিন্তু তারপরেও তুমি এতো সহজে মেনে নিবে ভাবতে পারিনি। মনে হচ্ছে অন্য কোনো কারণ!””
“” প্রেমিক কারণ!””
“” প্রেমিক কারন?””
“” হুম,কাল রাতে স্বপ্নে এসেছিলো। এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলো। আর আমিও মাফ করে দিলাম।””
পালক বিছানায় ধপাস করে বসে পড়েছে,অন্ত্রীশাকে সাহায্য করার বাহানায় ওর হাত থেকে কাঁথাটা নিয়ে নিজে ভাঁজ করতে করতে বললো,,
“” স্বপ্নে জড়িয়ে ধরতেই সব মাফ?””
“” হুম!””
“” এতো বড় অন্যায় এতো ছোট জিনিসে মাফ?””
“” কেন আপনি চান তাকে আরো কঠিনভাবে মাফ করতে?””
পালক কাঁথাটা বালিশের উপরে রেখে বললো,,
“” অবশ্যই,তোমার উনাকে কঠিন হতে কঠিনতর শাস্তি দেওয়া উচিত।””
“” সিউর?””
“” ১০০%””
“” ওকে। তাহলে সত্যি সত্যি যখন আমার কাছে মাফ চাইতে আসবে তখন কঠিন হতে কঠিনতর শাস্তি দিবো।””
অন্ত্রীশা ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকতে নিলেই পালক আবার বললো,,
“” স্বপ্নে এসেছিলো বলে সত্যি সত্যিই আসবে?””
অন্ত্রীশা পেছন ঘুরে চোখের পাতা ফেলে হ্যাঁ বোঝাতেই পালক বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে। চোখে বিস্ময় নিয়ে বললো,,
“” তোমার স্বপ্নের এতো পাওয়ার?””
“” না,আমার ভালোবাসার পাওয়ার!””
স্বপ্ন পুরনের ধারটায় চলে এসেও যখন তা অপুর্নই থেকে যায় তখন বুকের একদম ভেতরে না ভেতরেরও ভেতর থেকে ছোট্ট একটা ব্যর্থতার নিশ্বাস বেড়িয়ে আসে। পেছনে ফেলে আসা হাজারও কষ্টগুলো তখন এতোটাই চেপে ধরে যে তার ঐ ব্যর্থটার নিশ্বাসটা ফেলতেও শক্তিটুকু থাকে না। অন্ত্রীশারও আজ প্রত্যেকটা নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে নিশ্বাসগুলো বন্ধ করে একটা ছোট বাক্সে জমা করে রাখতে।
“” অন্ত্রীশা?””
অন্ত্রীশা বেলকনিতে দাঁড়িয়েই চাঁদের দিকে মুখ করে ছিলো। কিন্তু সে চাঁদ দেখছিলো না। তার চোখ বন্ধ করে চাঁদকে অনুভব করার চেষ্টা করছিলো। হঠাৎ পালকের ডাকে চোখ মেলেছে,,,
“” ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছো? এদিকে এসো,আমি পত্রীকন্যার জন্য কী কী কিনেছি দেখে যাও।””
পালকের হাতভর্তি শপিংব্যাগগুলোর উপর ও আজ অন্ত্রীশার রাগ হচ্ছে।
অন্ত্রীশার সামনে লাল বেনারশী মেলতেই অন্ত্রীশা বলে উঠলো,,
“” লাল বেনারশী যে?””
“” হুম,বিয়েতে তো লাল বেনারশীই পরে।””
“” তাই? তাহলে আমাকে মিষ্টি কালার বেনারশী কেন দিয়েছিলেন?””
“” ওটাতো অনিকশার ইচ্ছে ছিলো। ওকে দেখানোর জন্যই দিয়েছিলাম।””
অন্ত্রীশা শুকনো হাসি দিয়ে বললো,,
“” আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন,মিষ্টি কালার আপনার পত্রীকন্যারও পছন্দ!””
পালক হাত থেকে বেনারশী ফেলে অন্ত্রীশার দিকে তাকিয়ে বললো,,
“” তাইতো! এটাতো আমার মাথায়ই ছিলো না। এখন কী হবে? এতো রাতে তো মার্কেট খোলাও পাবো না। ধুর! কালকে আবার মার্কেটে যেতে হবে।!!””
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই পালক অন্ত্রীশার বিছানায় একটি কাগজ দেখতে পেলো। কাগজটি সেই মিষ্টি কালার বেনারশীতে রাখা যেটা অন্ত্রীশা বিয়ের দিন পরেছিলো। পালক সোফা থেকে উঠে চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়ছে,,,,
***মাঝরাতে আমার প্রেমিক স্বপ্নে এসেছিলো। সে বলেছে আমি যদি এখনি আমার প্রাক্তন স্বামীকে রেখে বাসায় না ফিরি তাহলে নাকি সে আমার কাছে সত্যি সত্যি ক্ষমা চাইতে আসবে না। এখন আপনিই বলুন সে যদি ক্ষমা চায়তে না আসে তাহলে আমি কঠিন হতে কঠিনতর শাস্তিটা কিভাবে দিবো? তাই চট করে সব গুছিয়ে চলে যাচ্ছি!
আপনার বিয়েতে তো আমি কিছু দিতে পারলাম না। তাই আপনার পত্রীকন্যার পছন্দের রঙের বেনারশীটা দিয়ে গেলাম। ভুলেও তাকে বলবেন না যে এটা পুর্বে ভুল জায়গায় ব্যহার হয়েছে তাহলে কিন্তু ও পরবে না।
যাইহোক,আপনার বিয়ের শুভকামনা রইলো।
ইতি
অন্ত্রীশা
হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত হওয়ায় ঘরোয়াভাবেই বিয়ের কার্যসম্পাদন হচ্ছে। সাক্ষী হিসেবে পালকের ফ্রেন্ড কাদির আর আতিশের আসার কথা ছিলো। কিন্তু আতিশ অফিসের দোহায় দিয়ে আসতে পারেনি তাই স্নিগ্ধা তার এক ভাইকে নিয়ে এসেছে। কাজী একটু পরই চলে আসবে।
মিসেস তানিয়া বেগম আর পাপড়িও তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন।যতই হোক এ বাড়ির ছেলের বিয়ে,হোক না তা দ্বিতীয় বিয়ে,কিন্তু বিয়েতো!
“” এইটা কোনো বেনারশী হলো পালক? এমন ভুটকানো কালারে আমাকে কেমন বিদঘুটে লাগছে। তোমার মাথায় এটা আসলো কিভাবে?? তুমি কখনো দেখেছো মিষ্টি কালারের বেনারশী পরে বিয়ে করতে??””
স্নিগ্ধা শাড়ীটা এমনভাবে ছুঁয়ে দেখছে যেন এতে মাছের আশটে লেগে আছে,ভালো করে হাত দিলেই হাতে লেগে গন্ধ বের হবে!
“” এতো রাগ করছো কেন,পত্রীকন্যা? এটাতো তোমার ফেবারিট কালার,তাই সারপ্রাইজ দিলাম!””
“” ফেবারিট? এইটা আমার ফেবারিট কালার? কে বলেছে তোমাকে?””
“” কেন,তুমিই তো চিঠিতে আমাকে জানিয়েছিলে,ভুলে গেলে?””
পালকের কথাই স্নিগ্ধা আমতা আমতা করে বললো,,
“” ওটাতো তখন ছিলো,এখন আমার এটা ভালো লাগে না।””
পালক স্নিগ্ধার হাত ধরতে গিয়েও থেমে গিয়ে আদুরী কন্ঠে বললো,,
“” রাগ করে না। আচ্ছা এর পর থেকে এমন ভুল আর কখনো হবে না৷ এবারের মতো ক্ষমা করে দাও?””
স্নিগ্ধা বিরক্তি নিয়ে বললো,,
“” কাজী কখন আসবে? উফ! কখন যে এই শাড়ীটা চেন্জ করবো, কেমন পচা মাছের গন্ধ আসছে শরীর থেকে!””
সবার অপেক্ষার প্রহর শেষ করে কাদির কাজী নিয়ে হাজির হয়েছে। কাজী তার মতো কাজ শেষ করে স্নিগ্ধার দিকে কলম এগিয়ে দিলেন সাইন করার জন্য। স্নিগ্ধা ঝটপট সাইন করে দিতেই পালকের দিকে পেপার আর কলম এগিয়ে ধরলেন কাজী।পালক রেজিস্ট্রি পেপারটা নিজের দিকে নিতেই চোখ পড়েছে স্নিগ্ধা সিথি নামটার উপর। মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে নিজেও সাইন করার জন্য কলমটা আঙুল দিয়ে চেপে ধরেছে।
চলবে
#ধোঁয়ার_নেশা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২০)
কলম চেপে ধরেছে তো ধরেছেই তা থেকে আর কালি বের করতে পারছে না। মনে হচ্ছে কলমটা আজ তার সাথে বিরহ করেছে সে তার ডাকে সারা দিয়ে কিছু লিখতে চাচ্ছে না,চাচ্ছে না কারো অধীনে গিয়ে নিজের ভেতরে জমে থাকা কালির বিসর্জন দিতে।
পালকের হাতেও কাঁপুনি উঠেছে,তবে তা বাহ্যিক নয়,আন্তিক। বার বার অন্ত্রীশার কথা মনে পড়ছে। এমনি এক কাগজ কলমের সাইনের জোরেই তো সে অন্ত্রীশাকে এ বাড়িতে এনেছিলো। ঠিক এমনি আরেকটি সাইনের জোরে সে আজ অন্য একজনকে এ বাড়িতে বাঁধতে বসেছে। পার্থক্য এতটুকুই সেদিন তার নামের পাশের জায়গায় ছিলো অন্ত্রীশা আর আজ রয়েছে স্নিগ্ধা।
পালক হঠাৎ করেই কলম ফেলে দিয়ে উঠে পড়ে,,,
“” আমি সাইন করতে পারবো না,আমি! আমি বিয়ে করতে পারবো না,আমি! আমি কবুলও বলতে পারবো না। উফ! আমি কিছু পারবো না,কিচ্ছু না!””
পালকের এমন আকস্মিক কান্ডে সকলেই হতভম্ব। সবার দৃষ্টি পালকের উপর।
স্নিগ্ধাও এতক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। পালকের কাছটাতে এসে অগ্নিদৃষ্টি ছুড়ে বলছে,
“” বিয়ে করবে না মানে? কী বলছো এসব? তোমার মাথা টাথা সব ঠিক আছে তো পালক??””
পালক চোখ বন্ধ করে বললো,,
“” আমার কিছু সময়ের প্রয়োজন স্নিগ্ধা,না অনেক সময়ের প্রয়োজন। আমি এখন কিছু করতে পারবো না। আমি! আমি মনে হয় লিখতে ভুলে গিয়েছি!””
স্নিগ্ধার রাগ ক্রমশই উর্ধ্বগতিতে উঠছে। এতোটা পথ এসে কী না বলে আর হাঁটতে পারবে না?? ইচ্ছে হচ্ছে পালককে ঠাটিয়ে দুটো চড় মেরে সাইন করাতে। কিন্তু পালকের মতিগতি ঠিক বুঝতে না পারায় রাগটাকে সংযত করে নিলো স্নিগ্ধা। ধীরগতিতে পালকের বুকে নিজের মাথাটা রেখে আদুরে আর কান্না মিশ্রিত সুরে বললো,,
“” এমন করছো কেন,পালক? তবে কি তোমার আমাকে পছন্দ হয়নি?? আমি কি দেখতে খুব খারাপ?? তোমার আমার চিঠিপ্রেমের কাছে আমার রুপটা মানাচ্ছে না?? তাহলে কি প্রেম মানেই রুপ-সৌন্দর্য! আমাকে কি তুমি ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছো?? আমাদের এতো বছরের চাওয়া-পাওয়াকে পায়ের তলায় পিষে দিতে চাচ্ছো? সব মিথ্যে করে দিতে চাচ্ছো পালক??””
পালক স্নিগ্ধাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,,
“” তুমি আমাকে ছোঁবে না,ছোবেঁ না তুমি আমাকে!””
“” কেন?””
পালক স্নিগ্ধাকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গিয়েছে। স্নিগ্ধার থেকে মনোযোগ সরিয়ে রেজিস্ট্রি পেপারটা দ্রুততার সাথে নিয়ে চেক করছে। স্নিগ্ধা সিথি নামটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,,
“” তুমি আমার পত্রীকন্যা নও।””
পালকের এমন কথায় হকচকিয়ে যায় স্নিগ্ধা। কিছুটা জড়োতা আর ভয়ার্ত নিয়েই পালকের কাছে এসে বললো,,,
“” আমিই তোমার পত্রীকন্যা,পালক। তুমি আমাকে চিনতে পারছো না??””
পালক আর স্নিগ্ধার মাঝে এবার কাদিরও এগিয়ে আসে৷ পালকের কাঁধে হাত রেখে বললো,,
“” পালক,তুই এসব কি বলছিস? তুই ই তো বললি ও তোর পত্রীকন্যা,তোর কথাতেই আমরা তোকে সঙ্গ দিচ্ছি। আন্টি আর পাপড়িরা যেমন তোর সুখে থাকা নিয়ে চুপ করে নিয়েছে আমিও তোর ভালোবাসার প্রাপ্তিতে চুপ করে ছিলাম। কিন্তু এখন আর চুপ থাকতে পারছি না। সবকিছু ঠিকঠাক,এখন বলছিস বিয়ে করবি না,ও তোর পত্রীকন্যা নয়। তুই আসলে কি চাস বলতো? সবকিছুতে ছেলেমানুষি?? এই পত্রীকন্যা তো তোকে অসুস্থ মানিয়ে দিচ্ছে!””
পালক অস্থিরতা নিয়ে রেজিস্ট্রি পেপারটা কাদিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,,,
“” এইটা আমার পত্রীকন্যার হাতের লেখা নয় রে,কাদির। এটা অন্যকারো লেখা। ও আমার পত্রীকন্যা হতে পারে না।””
স্নিগ্ধা পালককে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,,
“” তখন আমি ছোট ছিলাম,এখন বড় হয়েছি লেখা তো চেন্জ হবেই,তুমি একটা লেখা দেখে বুঝে গেলে আমি পত্রীকন্যা নই? একটা লেখার কাছে আমাকে নগন্য বানিয়ে দিচ্ছো,পালক??””
পালক স্নিগ্ধার থেকে মুখ ঘুরিয়ে আবার কাদিরের দিকে চেয়ে চিৎকার করে বললো,,
“” ও আমাকে বার বার পালক বলে ডাকছে কেন?? আমার পত্রীকন্যা তো আমাকে কখনোই পালক বলে ডাকেনি,সবসময় পত্র পুরুষ,কলংকিত পুরুষ,নাহয় শুদ্ধ পুরুষ বলে ডাকতো। ও আমার পত্রীকন্যা কিছুতেই হতে পারে না। কিছুতেই না!””
পালক চিৎকার করতে করতে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়েছে,গরম লাগছে খুব,বুকের ভেতরে আবার শুন্যতা অনুভব করছে,আরেকবার ঠকে গেছে সে। পত্রীকন্যার বেলায় কেন তাকে এতো ঠকতে হয়? কেন?? কেন??? কেন বারবার ওর কাছে যেতে চেয়ে অন্য কারো কাছে চলে যাচ্ছি?? তবে কি আমি কখনোই আমার পত্রীকন্যার কাছে পৌঁছবো না???
স্নিগ্ধা পালকের কপালের ঘাম মুছে দিতে দিতে বললো,,
“” তুমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছো,মাথায় বেশি চাপ পড়ে গিয়েছে তাই এমন আবোল-তাবোল বকছো,আচ্ছা আমরা নাহয় একটু পড়ে বিয়ে করবো কেমন??””
স্নিগ্ধা পালকের দিকে ঝুকে থাকায় গলার চেইনের মধ্যে গেথে থাকা লাভ শেপের মধ্যে ছোটছোট মুক্তো দানায় ঘেরা লকেটটা শুন্যে ভাসছে।
এটাতো সেই লকেট যেটা সে পত্রীকন্যাকে ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে দিয়েছিলো। ও যদি পত্রীকন্যা না হয় এই লকেটটাও ওর হওয়ার কথা না।
পালক ছোঁ মেরে লকেটটা টান দিতেই স্নিগ্ধার গলায় চেইনটা ছিড়ে পালকের হাতে চলে গিয়েছে।
ওটা খুলতেই একপাশে ভেতরে পালকের ছোট্ট ছবি দেখা যাচ্ছে,আর অপরপাশটা খালি। পালক চেয়ার ছেড়ে উঠে স্নিগ্ধার দিকে রুক্ষকন্ঠে বললো,,
“” এইটাতে আমার পত্রীকন্যার ছবি নেই কেন? কেন দাওনি ওকে? বলো কেন দাওনি??? তুমি আমার পত্রীকন্যার সাথে বেঈমানি করেছো আমার সাথেও বেঈবানি করেছো। ও তোমাকে কতটা বিশ্বাস করে আমার কাছে পাঠিয়েছিলো আর তুমি সেই বিশ্বাসকে এভাবে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে দিলে??? তোমাকে আমি….””
পালক যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে কাদির ওকে আটকিয়ে ফেলে। এতক্ষণে তারও মনে হচ্ছে পালক সত্যি বলছে। পালককে পিছনে রেখে সামনের দিকে এসে দাঁড়িয়েছে কাদির। যা করার এখন তাকেই করতে হবে,নাহলে ঘটনা অন্যদিকে চলে যাবে।
কাদির স্নিগ্ধার উদ্দেশ্যে কিছুটা কঠিন গলায় বললো,,
“” তুমি যদি পত্রীকন্যা না হও তাহলে পত্রীকন্যা কে??””
“”……””
“” আর তুমিইবা কেন হঠাৎ করে পত্রীকন্যা সেজে ওকে বিয়ে করতে চাইছো? ওর চিঠি,লকেট তোমার কাছে কী করে এলো??? এগুলো তো পত্রীকন্যার কাছে থাকার কথা। এতো বড় মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে তুমি কেন ওর কাছে এসেছো?? বলো কেন এসেছো?? আজ তুমি সত্যি কথা না বলে এখান থেকে এক পা ও নড়তে পারবে না।””
কাদিরের প্রত্যেকটা ধমকানিতে স্নিগ্ধা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভয়ের চুড়ান্ত পর্যায়ে এসে ঠেকেছে সে। চোখের চাহনি এক জায়গায় স্থির করতে পারছে না। কপালের ঘামগুলো গাল বেয়ে নিচে এসে পড়ছে। গলার স্বরটাও কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
স্নিগ্ধা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,,,
“” আমি পালককে ভালোবাসি!””
“” ভালোবাসো? তুমি ওকে আগে থেকেই ভালোবাসতে??””
কাদিরের প্রশ্নে স্নিগ্ধা মাথা নাড়িয়ে না বুঝাতেই কাদির আবার পাল্টা প্রশ্ন করে,,,,
“” তাহলে?””
“” পানি খাবো!””
পাপড়ি গ্লাসে করে পানি এগিয়ে ধরেছে স্নিগ্ধার দিকে। পাপড়ির হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোক পানি খেয়ে আবার বলতে শুরু করেছে স্নিগ্ধা,,,
“” উনি যখন আমার হাত দিয়ে চিঠি পাঠানো শুরু করেন তখন আমার খুব ইচ্ছে হতো এটার ভেতর উনি কী এমন লিখেছেন তা দেখার জন্য। প্রথম প্রথম ইচ্ছেটাকে প্রশ্রয় না দিলেও একদিন হুট করেই উনার চিঠিটা খুলে ফেলি। এতো সুন্দর,সহজ,সরল আর সাবলীল ভাষায় উনার ভালোবাসার কথা লিখেছিলো যে আমার তখনি মনটা আনন্দে ভরে গেলো। তারপর মাঝে মাঝেই উনার চিঠি খুলে পড়তে লাগলাম। মাঝে মাঝে উনার ছোটখাটো দুষ্টুমীর কথাগুলো আমাকে এতোটাই আকর্ষন করতে থাকে যে আমি উনার প্রতি মোহিত হতে লাগলাম। তার মধ্যে এটা,ওটা নানান নানান গিফট ও পাঠাতে লাগলেন,আমার তখন ওগুলোর প্রতি লোভ জন্মাতে থাকে,একসময় মনে হতে থাকে ইশ! কেন এগুলো আমার জন্য নয়,কেন উনি আমাকে চিঠি লিখেননি! আর তখনি উনি একটা চিঠিতে লিখেন উনি পত্রীকন্যার সাথে দেখা করতে চায়। ঐ সময় আমি উনার দিওয়ানা হয়ে গিয়েছি। আমি ঠিক করেছিলাম আমিই উনার পত্রীকন্যা হয়ে দেখা করবো তাই ঐ চিঠিটা আমার কাছেই রেখে দিয়েছিলাম,আর আমি যেহেতু পত্রীকন্যা নই তাই আমি চিঠিও লিখতে পারছিলাম না,মনে ভয় ছিলো যদি ধরা পড়ে যায়। ভয়টা খুব বেশিই আকড়ে ধরেছিলো যে,উনার সাথে দেখা করার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দিলাম। আমি ভেবেছিলাম যার চিঠি তাকেই দিয়ে দিবো। কিন্তু আমি চিঠি পৌঁছোনোর আগেই উনি অন্য কাউকে প্রপোস করে বসে। অন্য কাউকে পত্রীকন্যা ভেবে ভালেবাসতে শুরু করেন।””
স্নিগ্ধা পানির গ্লাস থেকে পানি খেয়ে আরেকটু গলা ভিজিয়ে বললো,,,
“” তারপর উনার সাথে আমার আর দেখা হয়নি,কোনো চিঠিও আদান-প্রদান হয়নি। আমি সব ভুলেই যাচ্ছিলাম,এর মধ্যেই একদিন উনাকে রেষ্টুরেন্টে দেখতে পাই,আমি ঠিক উনার পেছনের টেবিলটাই বসে ছিলাম। ওখান থেকেই জানতে পারি উনি এখনো উনার পত্রীকন্যার দেখা পাননি,আর সাথে সাথে আমার মনটা আবার লোভী হয়ে পড়ে। উনার প্রতি আবার ভালো লাগা কাজ করে,উনার ভালোবাসাকে নিতে ইচ্ছে করছিলো তাই আমি আমার একটা ফ্রেন্ডকে দিয়েই সব প্লেন করে উনাকে আমাদের বাসায় আনি,আর প্রমাণ করার চেষ্টা করি আমি উনার পত্রীকন্যা। উনিও আমার ফাঁদে পা ফেলে। আমি জানতাম অভিনয় করে আমি বেশিদিন উনাকে আটকে রাখতে পারবো না,তাই বিয়ের কথা বলি!””
স্নিগ্ধার কথা সকলেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলো। সবাইকে বাস্তবে আনতেই কাদির প্রশ্ন করে বসলো,,,
“” তুমিও যদি পত্রীকন্যা না হও তাহলে পত্রীকন্যা কে? কোথায় আছে সে??””
“” আমি জানি না।””
“” জানি না মানে? পত্রীকন্যার চিঠিতো তুমিই নিয়ে এসে পালককে দিতে।””
কাদির আর স্নিগ্ধার কথোপকথনের মাঝখানেই পালক উঠে দাঁড়িয়েছে। হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুমের দিকে ছুটছে। কাদির আর পাপড়িও পালকের পিছু নিয়েছে।
পালক অস্থিরতার সাথে নিজের বিছানা উল্টাপাল্টা করে কিছু খুঁজে যাচ্ছে। সবকিছু লন্ডভন্ড করে নিচে তাকাতেই একটা কাগজ কুড়িয়ে পেলো। ওটাতে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়েই নিজের সব জামাকাপড় বের করতে থাকে। শার্টের পকেটগুলো হাতড়াতে আরেকটা কাগজ খুজে পেয়েছে। কাগজ দুটোতে চুমু খেয়ে উজ্জলতরভাবে হেসে বললো,,
“” আমি পেয়েছি,আমার পত্রীকন্যাকে!””
কাদির ভ্রূ কুঁচকে বললো,,
“” মানে?””
পালক ঠোঁটের রেখা বড় করে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার থমকে যায়। ওয়াশরুমের দরজায় আটকে থাকা আরেকটা কাগজ নিয়ে নিলো।
“” পালক তুই আবার ভুল করছিস নাতো?””
পালক বের হতে হতে বললো,,
“” না,এবার আর কোনো ভুল করছি না। ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে যাচ্ছি,আমার পত্রীকন্যার রাগ ভাঙাতে যাচ্ছি!””
অফিস শেষে বের হতেই বাইরের ঝমঝমা বৃষ্টি দেখতে পাচ্ছে আতিশ। ইশ! এখনই বৃষ্টি আসতে হলো? এই চাকরির জ্বালায় তো আমি পাপড়িকে হারিয়ে ফেলছি। পালকের দ্বিতীয় বিয়েতেও যেতে পারলাম না,বিয়ে দেখি আর না দেখি পাপড়িকে তো দেখতে পেতাম। কতদিন হলো মেয়েটাকে দেখিনা,ওর অভিমানি,ওর ফুপিয়ে কান্নাগুলোকে এতো বেশি মিস করছি যে আর একমুহুর্তও ওকে ছাড়া থাকতে পারছি না। পালক তার ভালোবাসার মানুষটাকে পেলে আমি কেন পাবো না? আমারও চাই আমার ভালোবাসার ছোট্ট নারীটাকে,বাচ্চা নারীটাকে!
বৃষ্টির মধ্যেই আতিশ পাপড়িদের বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে।
দরজায় নক পড়তেই ভেতর থেকে পাপড়ি চিল্লিয়ে বললো,,
“” কে?””
পাপড়ির কন্ঠ শুনেই আতিশের মনটা জুড়িয়ে যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে হাসিও ফুটে উঠেছে,মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষটার সুন্দর কন্ঠই মন ভালো করার জন্য,সকল ক্লান্তি দুর করার জন্য যথেষ্ট!
“” আমি!””
“” আমি কে?””
“” আমি কে মানে? তুই কি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিস? আমার কন্ঠ চিনতে পারছিস না? এখন কি তোকে আমার পুরো বায়োডাটা দিতে হবে?””
“” অবশ্যই,বায়োডাটা না নিয়ে দরজা খুলবো কেন?””
“” পাপড়ি,তুই কিন্তু মাইর খাবি আমার হাতে,আমার সাথে ফাজলামী শুরু করেছিস? দিনে দিনে এতো বেদামড়ি হচ্ছিস কিভাবে?””
“” কী চাই আপনার?””
“” তুই দরজা খুলবি নাকি আমি ভেঙে ফেলবো?””
“” অবশ্যই খুলবো,কেন খুলবো না বলুন? আপনি বললেই তো হয় কাকে চায়? কেন এসেছেন?””
আতিশ নিজের রাগ কিছুতেই দমে রাখতে পারছে না। কিন্তু এখন সে চায় না রাগ করতে,সে তো এসেছে পাপড়ির রাগ ভাঙাতে!
আতিশ নরম সুরেই বললো,,
“” পালকের বিয়ে দেখতে এসেছি!””
“” বিয়ে তো হয়নি!””
“” হয়নি মানে?””
“” হয়নি মানে হয়নি!””
“”তুই দরজা খোল আমি পালকের কাছে যাবো।””
“” ভাইয়া বাসায় নেই!””
“” তুই এভাবে দরজা বন্ধ করে কথা বলছিস কেন? খুললে কী সমস্যা?””
“” অনেক সমস্যা,বাসায় কেউ নেই। খালি বাসায় ছেলে মানুষ ঢুকানো যাবে না।””
“” আমি ছেলে?””
“” তো কি মেয়ে?””
আতিশ রাগ সামলাতে গিয়ে এসব কী বলছে? গলা পরিষ্কারের বাহানায় গলা খাকিয়ে আবার বললো,,
“” খালি বাসায়ও তোকে আমি অসংখ্যবার পড়িয়ে গিয়েছি,পাপড়ি!””
“” তখন তো আপনি আমার টিউটর ছিলেন,এখন এক্স টিউটর হয়ে গেছেন,আর এক্স টিউটরের জন্য খালি বাসা বরাদ্দ নয়।””
“” এক্স টিউটর?””
“” হুম,বয়ফ্রেন্ড চেন্জ হলে যদি এক্স বয়ফ্রেন্ড হয় তাহলে টিউটর চেন্জ হলেও এক্স টিউটর হয়।””
“” তোকে এগুলো কে শিখিয়েছে?””
“” আমার নতুন টিউটর। আপনি যান তো আমি এখন বিজি!””
“” খালি বাসায় কী নিয়ে বিজি?””
“” আমার নতুন টিউটরকে নিয়ে বিজি। উনি আমায় আজকে নতুন জিনিস শিখাবেন!””
আতিশ রাগে দাঁত চিবিয়ে বললো,,
“” খালি বাসায় নতুন টিউটর কী করছে? দরজা খোল বলছি।”
“” না,এখন খোলা যাবে না,আমরা এখন সিকরেট কাজে ব্যস্ত””
“” সিকরেট?””
“” হুম,টপ সিকরেট! আপনি যানতো,আমাকে উনি ডাকছেন,আর বিরক্ত করবেন না।””
বৃষ্টির শব্দগুলো অন্ত্রীশাকে ডাকছে,তারা খুব করে চাইছে তাদেরকে নিয়ে অন্ত্রীশা খেলুক। কিন্তু অন্ত্রীশা আজ খেলবে না। সে তো বড্ড অভিমানে বালিশ ভেজানো কাজে ব্যস্ত। আজ তার কাছে আকাশ ভেঙে পড়া পানির ফোঁটা থেকেও চোখ ভেঙে আসা পানির ফোঁটা বেশি পছন্দ হচ্ছে। আজ সে কাঁদবে,মন ভরে কাঁদবে,কাঁদতে কাঁদতে চেখের পানি দিয়ে নিজেকে ভাসিয়ে ফেলবে,তবুও কাঁদবে,কষ্টকে যদি অনুভব করতে না পারে তাহলে কষ্ট পেয়ে কী লাভ? সে কষ্টের মধ্যেও আনন্দ খুঁজে নিবে।
অন্ত্রীশা উপুত হয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে,বালিশের উপর থুতনি দিয়ে সামনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। এ জানালাটা সে খুব একটা খুলে না,শুধু খুব খুশির সময় নাহয় খুব মন খারাপ হলেই খোলে। এটাও দক্ষিণ পাশে থাকায় বৃষ্টিতে ভিজে উঠা শীতল মৃদু বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে অন্ত্রীশাকে। বাতাসের সাথে সাথে বৃষ্টির গুড়িগুড়ি ফোঁটারাও অন্ত্রীশাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। বিছানার অনেকাংশই ভিজে উঠেছে। বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে নিজের চোখের পানিও ফেলছে।
“” পত্রীকন্যা!””
হঠাৎ কারো কন্ঠ পেয়ে অন্ত্রীশা ভয় পেয়ে পেছনে ঘুরতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো।
চলবে