ধোঁয়াশা,১ম পর্ব

0
1974

ধোঁয়াশা,১ম পর্ব
সাহেরা_খান
লকড_রুম_মিস্ট্রি_থ্রিলার

রাত ৮ টা।
ভালোবাসার মানুষটিকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছে যুবকটি। মেয়েটিকে ধর্ষণের পরে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। শোকগ্রস্থ যুবক কোনোরকমভাবে লাশটির ব্যবস্থা নিজেই করল। সে এই জঘন্য ঘটনাটি কাউকে জানাল না অবধি!

*
সকালের নরম মিষ্টি রোদ এসে পড়ল পার্থর মুখে। সকাল হয়ে গেছে বুঝতে পেরে আনন্দে আড়মোড়া ভেঙে, ঘুম থেকে ওঠে সে। আজকে তার জীবনের বিশেষ একটি দিন। আজ ২১ আগস্ট। ২৭ বছরে পদার্পণ করেছে সে। কাল রাতটা সে অনেক সুন্দর কাটিয়েছে। বন্ধু আর বাবার সাথে বেশ উপভোগ করেছে। ঠোঁটের কোণে রহস্যময় এক হাসি নিয়ে ফ্রেশ হতে যায় সে।

ডাইনিং টেবিলে এসে বসে পার্থ। নিজের বাবাকে টেবিলে উপস্থিত না দেখে অবাক হয়ে বুয়াকে জিজ্ঞেস করল,

“ড্যাড কোথায়? সে তো আমার আগে এসে উপস্থিত হয়। ড্যাড কি বেরিয়েছে সকালে?”

পার্থর মতো বুয়াও চিন্তিত মুখে বলল,

“হেতেরে তো যাইবার দেহি নাই। তয় সে ঘুম থেইক্যা উডে নাই মনে অয়। গ্যালে এডি দেখতাম না?”

বুয়ার ভাষা অনুধাবন করতে ওর বেশ কষ্ট হয়। তবে সামান্য হলেও বুঝে নিয়েছে। ওর বাবা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। এটা বুঝতে পেরে সে নিজেই যায় ডাকতে। তার বাবার ভোরেই ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। সে যত রাতেই ঘুমোক না কেন! বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ল কি না তা ভেবে ঘরের দরজায় টোকা দিলো। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভাবল হয়তো বাবা ওয়াশরুমে আছেন। সে ফিরে এসে নাস্তা না করে বসে থাকল।

প্রায় আধা ঘণ্টা বসে থেকেও যখন বাবা আসলো না তখন বুয়াকে ডাকতে পাঠায়। প্রায় ১০ মিনিট পরে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসে সে। এসেই চিৎকার দিয়ে জানায় সাহেব ঘরের দরজা খুলছে না। পার্থ চিন্তায় পড়ে যায়। তাহলে কি বাবা ভীষণ অসুস্থ? না কি অন্য কিছু ঘটেছে!

কী করবে ভাবতে না পেরে অফিসের ম্যানেজারকে কল দেয় ও। বাবা ছাড়া ওর আর কেউ নেই। ছোটো বেলায় মাকে হারানোর পরে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে পর্যন্ত করেননি। বাবার পরে বিশ্বস্ত মানুষটি ম্যানেজার সাহেব। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে কু-চিন্তা মাথায় আসতেই।

ম্যানেজার আসার সাথেই ও কেঁদে ফেলে। দুশ্চিন্তায় মুখটা আমসি হয়ে গেছে। ম্যানেজার ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি সবটা নিজে দেখবেন বলে আশ্বাস দেন।

ম্যানেজার সাহেব নিজেও ডেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে থানায় ফোন করেন। দরজা ভেঙেই দেখতে হবে। কিন্তু নিজেরা না করে পুলিশ দিয়ে করাটাই ভালো হবে মনে করল। ভিতরে কী হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে না এখন। দেশের নামকরা বিজনেস ম্যান হিসেবে ঝুঁকি নেওয়াটা ঠিক মনে করল না সে।

থানা থেকে লোক আসতে বেশি দেরি হলো না। তারা এসেই জেনে নিলেন ব্যাপারখানা। দ্রুত মিস্ত্রি ডেকে দরজার লক ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিলেন। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে চেষ্টার পরে দরজা ভাঙতে সক্ষম হয় তারা।

পুলিশের দুজন কর্মকর্তা ভিতরে ঢুকেই চমকে ওঠেন। দ্রুত হ্যান্ড গ্লাভস পরে নিয়ে, বিছানায় পড়ে থাকা দেহটি পরীক্ষা করলেন।

দরজার সামনে উত্তেজিত জনতা অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে কী হয়েছে জানার জন্য উৎসুক হয়ে আছে বেশ। পুলিশ না বলা পর্যন্ত কেউ-ই যেতে পারছে না। পার্থ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে জোরেই জিজ্ঞেস করল,

“অফিসার, কী হয়েছে আমাকে বলুন প্লিজ। ড্যাড ঠিক আছে তো?”

অফিসার দরজা ফাঁকা করে পার্থকে ভিতরে আসতে বললেন। ও ভিতরে ঢুকেই চিৎকার দিয়ে বসে পড়ে। চোখ বন্ধ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। অফিসার ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন,

“নিজেকে শক্ত করুন প্লিজ। এভাবে ভেঙে পড়বেন না। আপনার বাবাকে যে বা যারা খুন করেছে তাদের খুঁজে বের করব আমরা।”

অফিসার, ম্যানেজার সাহেবকে ডেকে পার্থকে নিয়ে যেতে বললেন। ম্যানেজারও বিছানায় তাকিয়ে আঁতকে ওঠেন। বিছানায় পড়ে থাকা দেহটির উপর কেউ নিজের রাগ মিটিয়েছে। ছুরি দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। মনের ভিতর বোধহয় খুনির অসংখ্য ঘৃণা জমে ছিল। নাহলে এভাবে কেউ হত্যা করতে পারে না।

অফিসার দুজন প্রথমে নিজেরা তদন্ত করলেন। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল আগেই দেখেছেন। ঘরের সব জানালা অক্ষত অবস্থায় আছে সেটা দেখে নিরাশ হলেন। খুনি ভিতরে কীভাবে ঢুকল বা বের হলো তা খুঁজে যাচ্ছেন। সারাঘর খুঁজে একজন মানুষ আসা-যাওয়া করতে পারে এরকম কোনো ছিদ্র পেলেন না। বাড়িটি নতুন তৈরি করা হয়েছে। ভিতরে প্রবেশ করার সময়ই চোখে পড়েছে। প্রথমে ঘর পরীক্ষা করে কিছু না পেয়ে বাথরুমে গিয়ে চেক করতে ঢুকলেন। এস আই অর্ণব বাথরুমের দরজা ভিড়ানো পেয়ে ঢুকে পড়লেন। কিন্তু ভিতরে সবকিছুই স্বাভাবিক পেলেন। এমন কোনো চিহ্ন নেই যা দিয়ে খুনি ভিতরে ঢুকতে পারে বা বের হতে পারে। ওসি হাতেম আকবরের কাছে এসে সে বলল,

“স্যার কিছুই তো পেলাম না। সব পরিষ্কার। তাহলে খুনি বন্ধ ঘরে কীভাবে ঢুকে খুন করে বের হয়ে গেল!”

ওসি সাহেব বেশ ভাবনায় পড়ে গেলেন। তিনি কিছু একটা ভেবে বললেন,

“ট্রাপডোর আছে কি না দেখতে হবে। অন্যদের কাজে লাগিয়ে দেন। প্রতিটি কোণায় কোণায় খুঁজে দেখতে বলেন। খুনি হয়তো ভিতরেই আছে। বাইরের কেউ এসে খুন করে চলে যাবে তা অসম্ভব। আমি জিজ্ঞাসাবাদ করতে যাচ্ছি।”

এস আই অর্ণব দ্রুত ক্রাইম স্পট সিল করে দিলেন। কিছু পুলিশকে কাজে লাগিয়ে দিলেন ট্রাপডোর খুঁজে বের করতে। তারা প্রতিটি আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলল। খাট ভেঙে পরীক্ষা করলেন কোনো গোপন রুম আছে কি না। যেখানে খুনি লুকিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু হতাশ হয়ে গেল সবাই। নতুন দেয়াল হলেও তা খুব ভালো করে পরীক্ষা করলেন। কোনো ট্রাপডোর খুঁজে পেলেন না। দিনের বেশিরভাগ সময় ঘরে ক্লু খুঁজতেই লাগিয়ে দিলেন।

*
ওসি সাহেব এক এক করে বাড়িতে কাজ করে যারা সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। প্রথমে তিনি বুয়াকে ডাকলেন। পার্থ খুব ভেঙে পড়েছে। তাই তাকে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিলেন। বুয়া সামনে এলো। ওসি সাহেব দেখলেন সে অনবরত কাঁপছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে প্রশ্ন করলেন,

‘নাম কী আপনার?’

বুয়া উত্তর দেওয়ার চেষ্টা না করে কাঁদতে কাঁদতে ওসি সাহেব এর পা জড়িয়ে ধরে বললেন,

“আমি এডি কিচ্ছু জানি না সাহেব। আইনহে বিশ্বাস করুইন।”

ওসি সাহেব বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলেন না। তিনি শান্ত হয়ে বললেন,

“যা জিজ্ঞেস করছি সরাসরি উত্তর দেন। এরকম নাটক করলে সোজা থানায় নিয়ে যাব।”

বুয়া ভয় পেয়ে চুপ হয়ে যায়। তাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন,

‘নাম কী?’

ক্ষীণ সুরে বুয়া বলল,

‘আমেনা।’

‘কত বছর আছেন এখানে?’

‘১১ বচ্ছর।’

‘বাড়িতে কে কে আছে আপনার?’

বুয়ার মন খারাপ হয়ে গেল প্রশ্নটি শুনে। সে বিষণ্ণ গলায় বলল,

“বিধবা মানুষ হের লাইগ্যা সাহেব একবারেই নিয়া আইছিল। পুলাপানডিও নাই, মইরা গ্যাছে।”

“আপনি কি কিছু বলতে পারবেন? কাল রাত থেকে কি অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে? যা যা মনে আসবে সব বলবেন। কিছু যেন বাদ না পড়ে।”

“আমি কিচ্ছু জানি না সাহেব। কাল রাতথইন খালি বেবাক কাম হরছি। ছুডু সাহেবের জরমোদিন আছিল। হের লাইগ্যা রাইতের বেলা দুই সাহেব মিল্যা কেক কাইট্যা খাইছে। হেরপর এত্তডি কাম সাইরা হুইয়া পড়ছি। সহাল বেলা উইডাই ফের রান্দনের কাম হরছি। ছুডু সাহেব এর কতা হুইনা বড়ো সাহেব এর ঘরে ধাক্কাইছি। হ্যায় উডে নাই। হের লাইগ্যা আপনেগো ডাকছে।”

হড়বড় করে বুয়া কথাগুলো বলে গেল। ওসি সাহেব এর বেশ কষ্ট হলো বুঝতে। তবুও তিনি নিজের মতো সাজিয়ে নিলেন। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলেন,

“আপনি কিছুই শুনেননি? কোনো শব্দ বা কোনো অপরিচিত কেউ এসেছিল? কাল জন্মদিন ছিল তাহলে মেহমান আসেনি কোনো?”

বুয়া মাথা নাড়িয়ে না জবাব দিয়ে বলল,

“হুনি নাই কিচ্ছু। কাল কেউ আহে নাই। আমরাই আছিলাম বেবাকডি।”

তাকে চলে যেতে বলে তিনি দারোয়ান এর দিকে ফিরলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন,

“নাম কী, আর কত দিন হলো চাকরিতে আছেন? রাতে অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে দেখেছেন?”

দারোয়ান বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন,

“আমার নাম মকলেছ। ১৫ বচ্ছর কাজ করি সাহেব। এত বছরে এরকম কিছুই দেহি নাই। কাইল রাইতেও সব স্বাভাবিক আছিল সাহেব।”

তাদেরকে চলে যেতে বলে ওসি সাহেব ম্যানেজারকে ডাকলেন। তাকে নিয়ে আলাদা বসে কথা বলতে শুরু করেন। তিনি ম্যানেজারকে বেশ শান্ত থাকতে দেখছেন। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে মোটেও বিচলিত না। এত বড়ো ঘটনায় তিনি এভাবে নির্বিকার আছে ভেবে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

‘খুনের পিছনে আপনার হাত নেই তো?’

হুট করে এরকম প্রশ্ন শুনে এতক্ষণে ধরে রাখা ভাব পরিবর্তন হয়ে গেল তার। তিনি বেলুনের মতো চুপসে গিয়ে বললেন,

“আপনারা আইনের লোক তাই সন্দেহ করতেই পারেন। তবে আমি খুনের সাথে বিন্দুমাত্র জড়িত নই। হয়তো আমার প্রতিক্রিয়া না দেখে সন্দেহ করছেন। কিন্তু বিশ্বাস করেন, স্যার আমার অনেক কাছের লোক ছিলেন। তাঁর ডান হাত আমি। বিশ্বস্ততার সাথে সব সামলেছি। কিন্তু হঠাৎ করে এভাবে জঘন্য কিছু ঘটবে কল্পনা করিনি। আমি শুধু ভেবে বের করার চেষ্টা করছি কেন হলো এটা।”

ওসি সাহেব তাকে বললেন,

“আপনাকে ভেবে কষ্ট করতে হবে না। এজন্য আমারা আছি। আপনি শুধু বলেন তিনি কেন এরকম খুন হলেন। তার সাথে কার কী শত্রুতা আছে? ব্যবসায়ী মানুষ সে। শত্রু থাকা স্বাভাবিক। তাই কোনো কিছু না লুকিয়ে স্পষ্ট বলেন।”

ম্যানেজার সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। ২৭ বছর বয়সে তিনি এস পি কোম্পানিতে যোগদান করেন। এখন বয়স ৪৫ চলে। অনেক পরিশ্রম করে টিকে আছেন। বিশ্বাস অর্জন করে বড়ো পদে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি এখন পর্যন্ত। কিন্তু এত বছরে এরকম জঘন্য পরিস্থিতিতে পড়েননি একবারও। কোম্পানির কাজে মাঝে মধ্যে বিপাকে পড়েছেন। তবে বড়ো বিপদেও মাথা ঠান্ডা রাখার কারণে এখন সবই সহজে সামলাতে পারেন। কিন্তু এই খুন তাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। বসের করুণ মৃত্যুতে এখন সে বেশ ভাবনায় পড়ে গেছে। নিজেকে ঠান্ডা করে তিনি বললেন,

“বহু বছর ধরে কাজ করছি এই কোম্পানিতে। ১৮ বছরের অভিজ্ঞতায় কোনো শত্রু খুঁজে পাচ্ছি না বসের। যে এরকমভাবে খুন করবে। নিজের ঘরে খুন হয়েছেন তা-ও বন্ধ ছিল। সেখানে কে এরকম দুঃসাহস করতে পারে! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“এর মানে আপনি একবারেই অজ্ঞ এই ব্যাপারে? এমন কেউ নেই যাকে সন্দেহ করা যায়?”

প্রশ্ন শুনে কিছুটা দ্বিধায় পড়ে তিনি বললেন,

“এত বড়ো ব্যবসায়ী ছিলেন বস। প্রতিদ্বন্দ্বী তো অনেক আছে। কিন্তু তাকে পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার মতো কেউ আছে কি না ঠিক ধরতে পারছি না।”

“সাত্যকি বাবুর চরিত্র কেমন ছিল? স্ত্রীর মৃত্যুর পর তো তিনি দ্বিতীয় বিয়ে পর্যন্ত করেননি, কেন?”

চরিত্রের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ম্যানেজার সাহেব বললেন,

“তার চরিত্র বেশ ভালো ছিল। আমি কোনো দিন তার বাজে নেশা দেখিনি। ওই যে বলে না ‘ফুলের মতো পবিত্র’ সেরকম টাইপের দেখেছি। ছেলেকে ভালোবাসতেন খুব। তাই সৎ মা কেমন হবে সেই ভয়ে বিয়ে করেননি।”

ওসি সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন খুব। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

“পার্থর সাথে কথা বলা যাবে? তাকে ডেকে আনেন। আর একটা কথা তাঁর স্ত্রী কীভাবে মারা গিয়েছিলেন?”

চট করেই উত্তর দিলেন ম্যানেজার। তিনি বললেন,

“স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। এরকমই শুনেছি। আপনি বসেন, আমি পার্থকে ডেকে দিচ্ছি।”

বলেই তিনি উঠে গেলেন। ওসি সাহেব চুপচাপ ভেবে যাচ্ছেন। কেইসটা ভীষণ জটিল মনে হচ্ছে তার। বাইরের কাউকে সন্দেহ করতে পারছেন না আবার ভিতরেও কোনো ক্লু পাচ্ছেন না। ড্রয়িং রুমে বসেই এস আইকে কল দিলেন। এস আই পুরো ঘর তল্লাশি করে যাচ্ছে। কল পেয়ে সে দ্রুত ছুটে আসে। স্যারকে গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবতে দেখে জিজ্ঞেস করল,

‘স্যার, কিছু পেয়েছেন?’

প্রশ্ন শুনে চিন্তার সুতো ছিঁড়তেই অর্ণবকে তিনি বললেন,

“এখনো কিছুই পাইনি। তবে আশা ছাড়ছি না। আপনার কাজ কতদূর? কোনো ট্রাপডোর পেয়েছেন?”

হতাশ হয়ে অর্ণব বলল,

“কিছুই পাইনি। পুরো ঘরের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। তবুও কোনো চিহ্ন পাইনি।”

‘বাথরুম দেখেছেন?’

‘জি স্যার, এখন সেটাও দেখব।’

‘আচ্ছা আপনি যান, কাজ করেন।’

অর্ণব চলে যেতেই দেখলেন, পার্থকে ধরে নিয়ে এসেছেন ম্যানেজার সাহেব। ছেলেটা কেঁদে চোখ মুখ যাচ্ছেতাই অবস্থা করে ফেলেছে। ওসি সাহেব বেশ আন্তরিক হয়ে বললেন,

“একটু শক্ত হন মি. পার্থ। এখন আপনাকে বিরক্ত করা উচিত হচ্ছে না জানি। কিন্তু ডিউটি বুঝতেই পারছেন। আপনার বাবার খুনিকে ধরতে হলে কো-অপারেশন লাগবেই আমাদের। আপনার কি কোনো সমস্যা আছে?”

পার্থ হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল,

“অফিসার, আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার বাবার খুনিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য যা করতে হয় করুন। আপনাকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে পারব।”

“গুড। আপনি সত্যিই খুব স্ট্রং। আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?”

পার্থ কান্নাজড়িত গলায় বলল,

“জি না অফিসার। এরকম কোনো শত্রু আমার চোখে পড়েনি। যার নাম বিনা দ্বিধায় বলে দেবো।”

“কাল থেকে কী কী হয়েছিল বলতে পারবেন? আপনার না কি জন্মদিন আজ? জন্মদিনের শুভেচ্ছা। অনেক শুভকামনা আপনার জন্য।”

পার্থ শুভেচ্ছা পাওয়ায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ও একটু ভেবে বলল,

“কাল আমি প্রথমে বন্ধুদের সাথে সেলিব্রেট করেছিলাম। যদিও আজকে আমার জন্মদিন। আজকে কথা ছিল ড্যাডের সাথে সময় কাটানোর। রাত বারোটায় কেক কাটব, তারপর দিনের বেলা একসাথে আনন্দ করব।”

“এভাবে নয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বলেন।”

পার্থ বাধা পেয়ে আবার ভাবল। সে গুছিয়ে নিয়ে বলল,

“বন্ধুদের সাথে ৬ টায় দেখা করি আমি। সেখানে কেক কেটে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসি ১০টার দিকে। এসে দেখি ড্যাড তখনও ফেরেনি। তার জন্য বসে ছিলাম। প্রায় ১১টার দিকে আমার জন্য উপহার, কেক নিয়ে বাসায় ফেরেন। তখন আমি, খালা আর চাচাকে নিয়ে আয়োজন করি। ড্যাড ফ্রেশ হয়ে আমাদের সাথে যোগ দেন। ১২ টায় কেক কেটে আধা ঘণ্টা সময় কাটিয়ে রুমে আসতে বাধ্য হই। ড্যাড বললেন, ভীষণ ক্লান্ত তিনি তাই বিশ্রাম নেবেন। সকালে কথা হবে যেন তৈরি থাকি।”

ওসি সাহেব ওকে জিজ্ঞেস করলেন,

“আপনার রুম কোনটা? আপনি অস্বাভাবিক কিছুই শোনেননি?”

পার্থ হতাশ কণ্ঠে বলল,

“আমিও ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তবে জেগে থাকলেও কোনো লাভ হতো না। ড্যাডের রুম সাউন্ড প্রুফ। শুধু ড্যাডের না, আমারটাও। আমার রুম দোতলায় ডান পাশেরটা।”

‘আপনার বাবার পাশের রুমে কি কেউ থাকে?’

পার্থ ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘না, সব তো লক করা থাকে।’

“ঘরে কেউ প্রবেশ করতে পারবে চাইলেও? এরকম কোনো সিস্টেম এর কথা জানা আছে? এটা যে আত্মহত্যা না তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।”

পার্থ বিষণ্ণ মনে বলল,

“এরকম সিস্টেম তো জানা নেই আমার। আপনারা একটু চেষ্টা করে খুনিকে খুঁজে বের করুন প্লিজ। আমার আর কেউ নেই অফিসার। আমি জানি না কীভাবে বেঁচে থাকব!”

“হতাশ হবেন না প্লিজ। আমরা অবশ্যই চেষ্টা করব। মাত্র তো তদন্ত শুরু হলো। একটু সময় দিন। লাশ ময়নাতদন্ত করা হলে হয়তো কিছু জানতে পারব। রিপোর্টের অপেক্ষা শুধু। আমি গিয়ে দেখি ট্রাপডোর জাতীয় কিছু পেল কি না।”

অফিসার পার্থকে ঘরে যেতে বললেন। ম্যানেজার সাহেবকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

“আমাকে একটা সত্য কথা বলেন তো। পার্থের সাথে সাত্যকি বাবুর সম্পর্ক কেমন ছিল?”

তিনি প্রথম কথাটি বলে পরের প্রশ্নটি একটু সময় নিয়ে করলেন। ম্যানেজার সাহেব বিব্রতবোধ করছেন। তিনি ভিতরে ভিতরে বেশ বিরক্ত। পুলিশদের কেন মানুষ এত অপছন্দ করে তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন। বাবার খুন হয়েছে। বেচারার কী অবস্থা নিজে দেখছে। তবু ছেলেকেও সন্দেহ করছে। তিনি মনের বিরক্তি গোপন রেখে বললেন,

“বাবা-ছেলের মধ্যে আমার জানামতে কোনো শত্রুতা বা তিক্ততা ছিল না। অন্যরাও তাই বলবে। দুজনে ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল। একমাত্র সন্তান পার্থ। সম্পত্তির অভাব নেই। কোনো ঝামেলা তো থাকার কথা না। আর থাকলেও তা আমাদের নজরে পড়েনি। এজন্য আমি বলব তাদের অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল।”

ওসি সাহেব ম্যানেজারের সাথে কথা বলে বেশ মজা পাচ্ছেন। তিনি ভাবলেন পাক্কা শেয়ানা লোক সে। তিনি দ্রুত নিচ তলার বেডরুমে প্রবেশ করলেন। ঘরের বেহাল দশা দেখে আফসোস করলেন। কত যত্ন করে বাড়ি বানিয়েছিলেন। অথচ মৃত্যুর পর শখের বেড রুমের কী দশা করে ছেড়েছে। ভাগ্যিস তিনি নেই। থাকলে হয়তো হার্ট অ্যাটাক করতেন। এস আই অর্ণব দ্রুত এগিয়ে আসেন। তিনি আহত কণ্ঠে বললেন,

“স্যার ঘর আর বাথরুম দুটোই তো বেহাল দশা করে ফেললাম। কিন্তু কোনো কিছুই পেলাম না।”

ওসি সাহেব টিটকারির সুরে নিজেকেই বললেন,

‘তাহলে নিশ্চয়ই ভূত এসে খুন করে গেছে।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here