নক্ষত্র_নারী #দ্বিতীয়_এবং_শেষ_পর্ব

0
653

#নক্ষত্র_নারী
#দ্বিতীয়_এবং_শেষ_পর্ব


পায়েলদের বাড়িতে যখন পৌঁছালাম তখন মাঝ রাত। দরোজায় কলিং বেল টিপে ভাবছিলাম, দরোজা নিশ্চয়ই পায়েলের বাবা খুলবেন। পায়েল বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে চার মাস হলো। সে নিশ্চয়ই পরিবারের সবাইকে বলেছে, কেনো সে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। সব কিছু জানার পর পায়েলের পরিবারের কেউ আমার সাথে ভালো ব্যবহার করবে বলে মনে হয় না। শ্বশুরের অকথ্য ভাষার আক্রমণের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হতে লাগলাম। যে কুৎসিত কাজ করেছি তাতে এমন কঠিন ব্যবহার পাওয়াই উচিত।

আমার ভাবনা অনুযায়ী দরোজা খুললেন পায়েলের বাবা। দেখে বোঝা গেলো ঘুম থেকে উঠে এসেছেন। মাঝ রাতে ভেজা কাপড়ে আমাকে দেখে তিনি চরম আশ্চর্য হয়ে গেলেন। আমি তার চেহারায় রাগ খুঁজতে লাগলাম। নিশ্চিত ছিলাম, তার মুখের ঐ প্রাথমিক আশ্চর্য ভাব কেটে যাওয়ার পরই তিনি অসম্ভব রেগে যাবেন। এবং নির্মম দুর্ব্যবহার করে আমার মুখের ওপর দরোজা বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু সেরকম কিছু দেখলাম না।

তিনি কণ্ঠে অবিশ্বাস নিয়ে বললেন,”কী আশ্চর্য, তুমি এতো রাতে, তাও ভেজা শরীরে! আর তুমি এমন হাঁপাচ্ছো কেনো? বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দৌড়েছো বুঝি? সব খবর ভালো আছে? ভেতরে এসো, ভেতরে এসো।”
আমি ওনার প্রশ্নগুলোর উত্তরে কিছু না বলে শুধু হাসার চেষ্টা করলাম। এবং ওনাকে সালাম দিয়ে দ্বিধা জড়ানো পায়ে ভেতরে ঢুকলাম।
এরপর তিনি বললেন,”আমি তোমার জন্য শুকনো কাপড় নিয়ে আসছি। ভেজা কাপড় বদলে ফেলো। নইলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”
বলেই তিনি কাপড় আনতে ভেতরে গেলেন। তিনি আমার ওপর রেগে না গিয়ে শুকনো কাপড় আনতে কেনো ভেতরে গেলেন বোধগম্য হলো না। কিন্তু একটু পরই সব বুঝতে পারলাম।

হাতে শুকনো কাপড় নিয়ে ফিরে এসে তিনি বললেন,”তোমার বই লেখাটা শেষ হয়ে গেছে? এখনো তো দু মাস বাকি।”
আশ্চর্য হয়ে বললাম,”জী বুঝি নি। আপনি কোন বইয়ের কথা বলছেন?”
“পায়েল বলেছিলো, তুমি বড়ো একটা লেখায় হাত দিয়েছো। বইটার জন্য অনেক খাটাখাটি করতে হবে তোমাকে। এবং নিরিবিলি পরিবেশ দরকার। তাই ছ মাসের জন্য তুমি সিলেটের এক নির্জন জায়গায় গেছো। বইটা শেষ করে বাড়ি ফিরবে। তাই বলছিলাম, ছ মাস শেষ হতে তো আরো দু মাস বাকি। দু মাস আগেই বইটা শেষ করে ফেলেছো দেখছি।”
তারপর বললেন,”তুমি কি সিলেট থেকে সরাসরি এখানে এসেছো? তোমাকে দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। নতুবা এতো রাতে…?”
বুঝলাম পায়েল বাড়িতে আমার আর সিনথিয়ার ব্যাপারে কিছুই বলে নি। বরঞ্চ মিথ্যে বলেছে। আর সেজন্যই আমার শ্বশুর এতো ভালো ব্যবহার করছেন। পায়েলের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেলো।
আমতা আমতা করে বললাম,”জী সরাসরি এখানে এসেছি। অনেকদিন পায়েলকে দেখি না। বিন্দুকে দেখি না। তাই চলে এলাম। আর হঠাৎ করে ঝড় বৃষ্টি আরম্ভ হওয়াতে ভিজে গেলাম।”
এরপর নিচু গলায় বললাম,”পায়েল বোধহয় ঘুমাচ্ছে, তাই না?”
“হ্যাঁ ঘুমাচ্ছিলো। কিন্তু এখন জানতে পেরেছে তুমি যে এসেছো। একটু পরই সে আসবে।”

পায়েল আসছে, শোনার সাথে সাথেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো। আমার এই মাঝ রাতে হুট করে চলে আসাটাকে সে কীভাবে নেবে বুঝতে পারছিলাম না।
আমি শুকনো কাপড় হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম।
তিনি বললেন,”আমি রুম থেকে চলে যাচ্ছি। তুমি কাপড় বদলে নাও।”
কিন্তু কাপড় বদলের কোনো আগ্রহ বোধ করলাম না। শঙ্কিত বুকে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম পায়েলের জন্য। পায়েল আর বিন্দুকে নিয়ে বাড়িতে না যাওয়া পর্যন্ত আমার জীবন স্বাভাবিক হবে না। আমার পক্ষে একটি বাক্যও লেখা সম্ভব হবে না। আর লিখতে না পারলে নির্ঘাৎ মারা যাবো।

সময় কতোক্ষণ কেটেছে জানি না, আচমকা কারো পায়ের শব্দ শুনলাম। চেয়ে দেখি পায়েল রুমে এসেছে।
আমি একবার ওর চোখের দিকে তাকাচ্ছি, পরক্ষণে চোখ সরিয়ে নিচ্ছি। ওর দিকে স্থির তাকাতে সাহস পাচ্ছিলাম না।
কিছু সময় চুপচাপ কাটার পর অপরাধী গলায় বললাম,”পায়েল আমি দুঃখিত। তোমার সাথে যে ভয়াবহ অন্যায় করেছি, তা ক্ষমার অযোগ্য। তবু বলছি, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। আমি সিনথিয়াকে চিরকালের মতো ছেড়ে এসেছি।”
এরপর উৎকণ্ঠিত স্বরে বললাম,”পায়েল তোমাকে ছাড়া আমি লিখতে পারছি না।”
পায়েল আমার কথার জবাব না দিয়ে বললো,”শুধু আমার কাছে ক্ষমা চাইলে তো হবে না। তোমাকে আরো একজনের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।”
“কার কাছে?”
“সিনথিয়ার কাছে।”
কিছু না বলে চেয়ে রইলাম।
পায়েল তারপর বললো,”সিনথিয়া অল্প বয়সী একটা মেয়ে। জনপ্রিয় পুরুষের প্রতি ওর আকর্ষণ থাকাটাই স্বাভাবিক। তুমি ঐ আকর্ষণটাকে বাজে ভাবে ব্যবহার করেছো। ওর না হয় বয়স কম, তাই না বুঝে, শুধুমাত্র মোহের টানে সে তোমার দিকে ঝুঁকেছিলো। কিন্তু তুমি তো অপরিণত নও। বিয়ে করেছো, সন্তানের বাবা হয়েছো। তোমার তো উচিত ছিলো না সিনথিয়ার আহ্বানে সাড়া দেয়া। তোমার উচিত ছিলো সিনথিয়াকে এই সম্পর্কে জড়াতে না দেয়া। এখন তুমি লিখতে পারছো না, তাই সিনথিয়াকে ছেড়ে আমার কাছে ছুটে এসেছো। ছুটে আসার সময় একবারো ভাবো নি, তোমার এই খামখেয়ালী আচরণ ঐ অল্প বয়সী মেয়েটার ওপর কতোখানি প্রভাব ফেলবে? সে কি সারাজীবনেও পারবে এই ধাক্কা সামলে উঠতে?”

স্তব্ধ হয়ে তার কথা শুনে যেতে লাগলাম।
পায়েল থামলে বললাম,”আমি কালই সিনথিয়ার কাছে ক্ষমা চাইবো। এবং আমার এই অন্যায় ওর জীবনে যেনো খুব একটা প্রভাব না পড়ে, তার জন্য সব রকম সহযোগিতা ওকে করবো। পায়েল তুমি যা বলবে তাই করবো। তুমি শুধু ফিরে চলো। তোমাকে ছাড়া একটা শব্দও লিখতে পারছি না।”
“যদি লিখতে পারতে, তাহলে কি আমার কাছে আসতে?”
জানি এ প্রশ্নের সদুত্তর আমার কাছে নেই। কিন্তু এটা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি, শুধু লেখার জন্য নয়, জীবনের সব কিছুতেই পায়েলকে আমার চাই।
কিছুটা জড়ানো স্বরে বললাম,”পায়েল আমি অতো কিছু বুঝি না। তুমি প্লিজ বিন্দুকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে চলো। তোমাকে আমার লাগবেই।”
পায়েল দৃঢ় কণ্ঠে বললো,”তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারলে না।”
ওর কণ্ঠে এমন কিছু ছিলো যে, আমি আতঙ্ক নিয়ে ওর দিকে তাকালাম।
এবং আকুল হয়ে বললাম,”প্লিজ…।”
ও আমার কথার ধারেকাছেও না গিয়ে শীতল গলায় বললো,”কাপড় বদলে শুয়ে পড়ো। সকালে চলে যাওয়ার সময় আমাকে ডেকো না। তোমার সাথে আর হয়তো দেখা হবে না।”
পায়েল যাওয়ার আগে শেষ কথা যা বললো তা ছিলো খুবই অপ্রত্যাশিত।
সে বললো,”সিনথিয়াকে বিয়ে করে নিও। আমার দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই আর। মেয়েটা অন্তত কষ্ট পাওয়া থেকে বাঁচবে।”

পায়েল চলে গেলে, বেশ খানিকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর রাতের বৃষ্টির মধ্যে আবারো যখন পথে নামলাম, তখন নিজেকে মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে পরাজিত এবং শূন্য মানুষ।


ঘোর লাগা বুকে বাড়ি ফিরলাম। বাড়িতে এসে ফোন করলাম সিনথিয়াকে। বললাম, কাল যেনো মুন রেস্টুরেন্টে সে অবশ্যই আমার সাথে দেখা করে। জরুরী কথা আছে তার সাথে। সে আসবে বলে কথা দিলো।

বাকি রাত একটুও ঘুম হলো না। ঘুমানোর কথা মনেও পড়লো না। প্রাণহীন দেহে বারান্দায় বসে চেয়ে রইলাম রাতের বিরামহীন বৃষ্টির দিকে।

পরদিন সিনথিয়া আসার আগে রেস্টুরেন্টে চলে যাই। মিনিট বিশেক পর সিনথিয়া এলো। চমৎকার সেজে এসেছে। শাড়ি পরেছে, কপালে টিপ, চোখে কাজল, আর চুলে দিয়েছে ফুল।
সিনথিয়া হাসি মুখে আমার টেবিলের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু কাছে এসে আমার চেহারার দিকে তাকাতেই তার হাসি অদৃশ্য হয়ে গেলো। এবং চিন্তিত স্বরে বললো,”তুমি ঠিক আছো? তোমাকে দেখতে কেমন যেনো অন্য রকম লাগছে।”
গতকাল রাতের মর্মান্তিক ধকল আমার চেহারায় পড়বে এটাই স্বাভাবিক।
কোনো রকমে হেসে বললাম,”আমি ঠিক আছি।”

কিছু সময় টুকিটাকি কথা বলার পর, এবং ওয়েটার খাবার দিয়ে যাওয়ার পর আমি ধীরে ধীরে বললাম,”সিনথিয়া তোমাকে আজ বিশেষ কিছু কথা বলার জন্য ডেকেছি।”
সে মিষ্টি হেসে বললো,”জানি। ঐ বিশেষ কথাটা শুনবো বলেই তো শাড়ি পরে এলাম। আজকের দিনটি হবে আমাদের জন্য চিরস্মরণীয় একটি দিন।”
আমি আচ্ছন্নের মতো বললাম,”সিনথিয়া তুমি আমাকে ক্ষমা করো।”
তারপর এলোমেলো ভাবে বললাম,”তোমার সামনে পুরো জীবন পড়ে আছে। ছাত্রী হিসেবে তুমি মেধাবী। তোমার এখন অন্য কিছু না ভেবে পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া উচিত।”
সিনথিয়া সন্দেহ মাখা গলায় বললো,”তোমার কথা বুঝতে পারলাম না। তুমি ক্ষমার কথা কেনো বলছো? আর অন্য কিছু না ভেবে বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছো?”
মাথা নিচু করে বললাম,”তোমার সাথে সম্পর্কে জড়ানো আমার ঠিক হয় নি। হাজার হোক আমি বিবাহিত এবং এক সন্তানের পিতা। আমার পক্ষে এই সম্পর্ক স্থায়ী করা সম্ভব নয়।”
সিনথিয়ার মুখ শক্ত হয়ে গেলো।
বললো,”সম্পর্ক করার এতোদিন পর তোমার মনে পড়লো তুমি যে বিবাহিত, তুমি যে পিতা? মনে পড়লো এই সম্পর্ক স্থায়ী করা সম্ভব নয়?”
আমি চুপ হয়ে রইলাম।
“তুমি জানো আজ আমি কেনো শাড়ি পরে এসেছি?”
নীরব থাকলাম আমি।
“আমি ভেবেছিলাম তুমি আজ আমাদের বিয়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা বলবে। গতকাল ফোনে তুমি যখন বলেছিলে আমার সাথে জরুরী কথা আছে, তখন থেকে খুশিতে আমি আকাশে উড়ছিলাম। আর সেখানে তুমি এখন শোনাচ্ছো, তোমার হঠাৎ উপলব্ধি হওয়া নীতি কথা?”
আমি নত মাথায় বসে রইলাম।
“তোমার মন চাইবে সম্পর্ক করবে, মন চাইবে সম্পর্ক ছেড়ে দেবে, মানুষের জীবনকে কি তোমার কাছে ছেলেখেলা মনে হয়?”
মাথা নিচু করে রইলাম।
“তোমার দিকে তাকাতেই আমার এখন বমি আসছে।”
আমি ক্ষীণ স্বরে অগোছালো ভাবে বললাম,”তোমার যদি কখনো কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হয় আমাকে বোলো। আমি পূর্ণ সহযোগিতা করবো।”
“চুপ থাকো। তোমার মতো থার্ড ক্লাস মানুষের সহযোগিতা নেয়ার প্রশ্নই আসে না। এটাই আমাদের শেষ দেখা। আমি ভাবতেই পারছি না যে, তোমার মতো একটা জঘন্য মানুষকে ভালোবেসেছিলাম।”
এই বলে সিনথিয়া চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। এবং তীব্র ক্রোধের সঙ্গে বললো,”তোমার গালে যদি কষে একটা থাপ্পড় মারতে পারতাম তবে আমার খুব ভালো লাগতো।”
তারপরই সে বেরিয়ে গেলো। ভেবেছিলাম সিনথিয়া কান্নাকাটি করবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেললো না। হয়তো সে কাঁদতো, কিন্তু পরে হয়তো তার মনে হলো, আমার মতো নোংরা মানুষের জন্য চোখের পানি ফেলা অর্থহীন।
সিনথিয়াকে অনায়াসে বিয়ে করে নিতে পারতাম। কোথাও কোনো বাধা ছিলো না। কিন্তু লিখতে না পেরে এবং পায়েলকে হারিয়ে এতোটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, এ জীবনে অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করা তো দূরে থাক, তাদের নিয়ে ভাবতে পর্যন্ত পারবো না।
আমি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত মানুষের মতো একা বসে রইলাম।


সিনথিয়াকে হারানোর বেদনা আমি অনুভব করি নি। ওর জন্য খারাপ লাগতো। ওর সাথে অন্যায় করেছি এই অপরাধ বোধে জর্জরিত হতাম। হারানোর বেদনা অনুভব করতাম পায়েলের জন্য, বিন্দুর জন্য। প্রতিটি মুহূর্তে তাদের অনুভব করতাম।

পায়েলকে হারিয়ে আমার জীবন সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে গেলো। ঠিক মতো খাওয়া নেই, ঘুম নেই। আর লেখার আগ্রহ পুরোপুরি চলে গেলো। কখনো জোর করে লিখতে বসলেও একটা বাক্যও লিখতে পারতাম না। নিশ্চিত বুঝে গেলাম, আমার দ্বারা আর লেখালেখি হবে না। সম্পাদকরা কয়েকবার লেখা চেয়ে না পেয়ে তারাও বুঝে গেলেন, আমাকে দিয়ে আর হবে না। ধীরে ধীরে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। দিনের পর দিন বাসায় পড়ে থাকি। হয় মড়ার মতো বিছানায় পড়ে থাকি, নতুবা মূর্তির মতো বারান্দায় বসে থাকি।

খাওয়া ঘুম ঠিক ভাবে না হওয়াতে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এবং ডাক্তার দেখাতাম না বলে অসুস্থতার মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগলো। এক সময় এমন অবস্থা হলো যে, আমি জীবিত না মৃত বুঝতে পারতাম না। সব কিছু ঘোলাটে লাগতো। দিন রাতের হিসেব ছিলো না আমার। বুঝতে পারতাম না কখন দিন হয়, কখন রাত হয়।
ড্রাইভার আমার বাড়িতেই থাকে। আমার নির্মম অবস্থা দেখে সে দু একবার আমাকে ডাক্তার দেখানোর কথা বললে তাকে কড়া ভাষায় নিষেধ করে দিলাম, সে যেনো আমার বিষয়ে মাথা না ঘামায়। সে বিষন্ন এবং অসহায় চোখে আমার ধ্বংস দেখতে লাগলো।

জানি না এভাবে কতোদিন কেটেছে। একদিন হঠাৎ লেখার জন্য প্রবল টান বোধ করলাম। কীভাবে এ টান এলো জানি না। লেখার টান এতো প্রবল ছিলো যে, আমি প্রচণ্ড অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছানা থেকে নামলাম। এবং মাতালের মতো নিজেকে টেনে টেনে কম্পিউটারের সামনে নিয়ে গেলাম। চেয়ারে বসে কম্পিউটার অন করলাম। বহুদিন বন্ধ হয়ে থাকা কম্পিউটারের স্ক্রিন আলোকিত হয়ে উঠলো। তারপর দুর্বল আঙুলে কী বোর্ড টিপতে লাগলাম। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, আমি লিখতে পারছি! একের পর এক বাক্য লিখে যেতে লাগলাম। কী করে এই অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে বুঝতে পারছিলাম না। লিখতে পারছি এই আনন্দে এবং বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। মনে হলো, আমি সুস্থ হয়ে উঠছি। বেঁচে উঠছি। আমি লিখছি আর কাঁদছি। কাঁদছি আর লিখছি।

কতক্ষণ এভাবে লিখেছি বলতে পারবো না। অকস্মাৎ কানে ভেসে এলো অতি পরিচিত এক কণ্ঠস্বর।
“এই যে লেখক সাহেব, আপনার এই উপন্যাসের প্রথম কপিটা অটোগ্রাফসহ আমার চাই। এই নিন অগ্রীম টাকা।”
মানুষটির দিকে না তাকিয়েই তার টাকাসহ বাড়িয়ে দেয়া হাতটি দেখে এবং কণ্ঠস্বর শুনে বুঝে গেলাম মানুষটি কে? আরো বুঝতে পারলাম, কেনো এতোদিন পর পুনরায় লিখতে পারলাম।
আমার রুগ্ন শরীরের বুক চিরে কান্না আসতে লাগলো।
তারপর শুনলাম ছোট্ট একটি মেয়ের মিষ্টি কণ্ঠ,”বাবা তুমি কাঁদছো কেনো?”
আমি কোনো কথাই বলতে পারছিলাম না। শুধু কেঁদেই যাচ্ছিলাম।
এরপর নারী কণ্ঠটি ব্যাকুল হয়ে বললো,”কী অবস্থা করেছো তুমি নিজের! ড্রাইভার আমাকে না জানালে তো তোমার এই সর্বনাশের কথা জানতেই পারতাম না। এখনই হাসপাতাল যাবে চলো।”
এক সময় ড্রাইভার আমাকে ডাক্তার দেখানোর কথা বললে ওর ওপর আমি ক্ষিপ্ত হয়েছিলাম, কিন্তু এবার তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে গেলো।
আমি ছোট্ট মেয়েটাকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে ভেজা চোখের ঝাপসা দৃষ্টিতে নারীটির দিকে তাকিয়ে অবশেষে বলতে পারলাম,”ব্যস্ত হয়ো না। এবার আমি সেরে উঠবো। আর কোনো কিছুর সাধ্য নেই আমাকে অসুস্থ করে।”

নারীটি কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললো,”তোমার এই উপন্যাসের নাম কী দেবে?”
নারীটির ডান হাত আমার ক্ষীণ মুঠোয় নিয়ে বললাম,”নক্ষত্র নারী।”
পায়েল হাসলো।
এবং বললো,”গল্পের শুরুটা দেখাও। অনেকদিন তোমার নতুন লেখা পড়ি নি।”
আমি শুরুটা এনে দিলাম।
পায়েল শব্দ করে পড়তে লাগলো,”পায়েলকে যখন বিয়ে করি তখন সবে লেখালেখি শুরু করেছি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে, অন লাইনে গল্প প্রকাশ হতে লাগলো। তখনো কোনো নাম ডাক ছিলো না আমার। পেশাগত দিক থেকে একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম আর অবসরে লিখতাম। লেখাটা ছিলো স্রেফ শখ। ভালো লাগতো তাই লিখতাম….
বিয়ের পরই পায়েল প্রথম আমার লেখা পড়লো। কোনো একটা পত্রিকা থেকে পড়েছিলো।
সে রাতে পায়েল আমাকে জিজ্ঞেস করলো,’তুমি লিখছো কতোদিন থেকে?’…..”
এটুকু পড়ে সে থামলো। এবং আমার দিকে তাকালো। অর্থাৎ সে বুঝতে পারলো আমি কোন নক্ষত্র নারীর গল্প লিখছি।
খানিক পর পায়েল আবার পড়তে শুরু করলো।

ওর অলৌকিক উচ্চারণে আমার সাধারণ শব্দগুলো হয়ে উঠতে লাগলো আশ্চর্য জীবন্ত। আমি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম নক্ষত্র নারীর দিকে।

“নক্ষত্র নারী”
– রুদ্র আজাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here