নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_১০
লেখায়_জারিন
৪২. (অবশিষ্টাংশ)
‘ওই যে মরতে বসার আগে জানা ছিল না যে জীবন কতটা মূল্যবান!’
‘ওটা তো আরও পরের গল্প, তাই না? ‘
‘হ্যাঁ। ‘
‘তাহলে ওটা থাক এখন। যেটা শুনছি ওটাই বলুন আজ। ‘
‘হুম…বলছি।’ বিষন্ন সুরে বললো ইরিন। তারপর, আবারও খুঁড়তে শুরু করলো অতীত নামক একখণ্ড কবর।
৪৩.
নক্ষত্র ও ইরিনের বিয়ের তখন ৪ মাস পেরিয়েছে। নক্ষত্র আগের মতই ব্যস্ত ছিল সে সময়। তবে ইরিনকে কাছে টেনে প্রায়ই ক্লান্ত অথচ আদর মাখা গলায় বলতো, ‘ইরিন..প্লিজ কিছু মনে করো না। একটু ধৈর্য্য ধরো। এই কাজটা গুছিয়ে উঠতে পারলেই আর তেমন ব্যস্ততা থাকবে না। তখন তোমায় ঠিক সময় দিবো,যেভাবে যা চাইবে তাই করবো। ‘ কিন্তু এতে ইরিনের কখনোই কিছু যায় আসতো না। নক্ষত্রের অনুনয়ের প্রেক্ষিতে সম্মতিসূচক আলতো হেসে কাটিয়ে দিতো ব্যাপারটা। তবে ইরিন ধৈর্য্য ধরতো।প্রতিটা দিন রাত একজন অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষের সাথে সংসার করার ধৈর্য্য।
এরইমাঝে একদিন শায়লা বললেন, তিনদিন পর ওয়াসিফ আর অদ্রির এংগেইজমেন্ট করে ফেলবেন। ওয়াসিফ দু সপ্তাহ পরেই লন্ডনে ব্যাক করবে। তারপর, অদ্রির এইচ.এস.সি পরীক্ষার পর ওদের বিয়ে দিয়ে দিবেন। বাকি পড়াশোনা সে ওয়াসিফের সাথে লন্ডনে থেকে করবে।ইরিন বাইরে বাইরে খুশি প্রকাশ করলেও ভেতর ভেতর ওয়াসিফের বিয়ে হয়ে যাবে ভেবেই প্রচন্ড অস্থির হয়ে ওঠেছিল সেদিন।
যথারীতি এংগেইজমেন্টের আয়োজন শুরু হলো। ওয়াসিফ আর ওর মা এলো নক্ষত্রদের বাড়িতে। অদ্রিকে নিয়ে শপিং এ যাবে বলে। অদ্রি রেডি হতে গেল আর ওয়াসিফের মা নুপুর মিসেস. শায়লার সাথে ভেতর ঘরে চলে গেলেন। তখনই ওয়াসিফ ইরিনকে বললো,
‘এককাপ স্ট্রং ব্যাক কফি করে দাও তো ইরিন। মাথা ব্যাথা করছে খুব। আর আমি ছাদে যাচ্ছি। কফিটা নিয়ে ওখানেই এসো।কথা আছে তোমার সাথে। ‘ এই বলে ওয়াসিফ সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে গেল। ইরিন কিছুটা অবাকই হয়েছিল সেদিন ওয়াসিফের এমন কথার ধরণে। তাছাড়া বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল ওয়াসিফকে। ইরিন ভেতর ভেতর অস্থির হয়ে উঠলো, ওয়াসিফ কি বলতে চায় তা শোনার জন্য। তাই দ্রুত কফি করে নিয়ে ছাদে গেল সে।
৪৪.
‘আপনার কফি। ‘ ওয়াসিফের পেছনে দাঁড়িয়ে বললো ইরিন।
ইরিনের উপস্থিতি টের পেয়ে পেছন ঘুরে হাত বাড়িয়ে কফির মগটা তুলে নিল ওয়াসিফ। আস্তে ধীরে তাতে চুমুক দিল। ইরিন হাতের ট্রে নামিয়ে কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। ওয়াসিফ কিছু বলছে না দেখে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। পেছন ঘুরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ওয়াসিফ পেছন থেকে ডাকলো।
‘ইরিন…ওয়েট। চলে যাচ্ছো কেন? বলেছিলাম না তোমার সাথে জরুরি কথা আছে। ‘
‘জ্বী,ভাইয়া বলুন। ‘ দাঁড়িয়ে গিয়ে সামনে ফিরে বললো ইরিন।
‘তুমি কি সত্যিই সব জেনে বুঝে নক্ষত্রকে বিয়ে করেছো?’
ওয়াসিফের কথা শুনে বেশ অবাক হলো ইরিন।হঠাৎ এমন প্রশ্ন করার কোন কারণ খুঁজে পেল না সে। তারপরেও উত্তর দিল, ‘জ্বী।’
ইরিনের জবাবে বেশ অবাক হলো ওয়াসিফ।মনে মনে আরেকদফা হিসাব কষে নিল। তবে কি তার ধারণা ভুল? উহু…সেটা তো হওয়ার নয়। তবুও আরও একবার ইরিনকে বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করলো।
‘কিন্তু, তাও তুমি ওর সাথে সুখী নও।’ কফিতে চুমুক দিয়ে বললো ওয়াসিফ।
ইরিন বেশ অপ্রস্তুত গেল ওয়াসিফের এই কথায়। ও তো স্বাভাবিকভাবেই সংসার করছে। বাড়ির কেউ কখনো এই নিয়ে প্রশ্ন করেনি। এমনকি নক্ষত্রকেও বুঝতে দেয়নি যে ও এই বিয়েটা মানলেও নক্ষত্রকে এখনো মানতে পারেনি। তাহলে ওয়াসিফ কি করে বুঝলো। ইরিন ভীষণ শক্ত মনের মেয়ে। সহজে ভেতরের ভাব বাইরে প্রকাশ না করার গুণটা ওর বেশ ভালোই আছে। তাই কপট হেসে বললো,
‘আপনার এমন কেন মনে হচ্ছে ভাইয়া যে আমি উনার সাথে সুখী নই? উনি একজন দায়িত্ববান মানুষ। শত ব্যস্ততাতেও আমার কোন কিছুর খেয়াল রাখতে উনার ভুল হয় না। এমন মানুষের সাথে সুখী না হয়ে পারা যায় নাকি!’
-বেশ গুছিয়ে তবে দ্রুত গতিতে বললো ইরিন। তার বলার ধরণ দেখে বাঁকা হাসলো ওয়াসিফ। ইরিনের মুখে লেপ্টে থাকা নকল হাসিকে নিমিষেই মুছে দিয়ে বললো,
‘তুমি যদি সুখীই হতে তাহলে আমাকে এভাবে প্রবোধ দেওয়ার জন্য এতগুলো কথা তুমি বলতে না, ইরিন।’
ইরিন এবার হাতে নাতে ধরা পড়ার মত ঘাবড়ে গেল। ওয়াসিফের দিকে তাকিয়ে দেখলো দুর্বোধ্য হাসছে সে। ইরিন দমলো না। ওয়াসিকে ভুল প্রমাণ করার জন্য অবলিলায় আরেকদফা অপচেষ্টা চালালো।
‘আমি প্রবোধ গুনছি না ভাইয়া। উনি সত্যিই আমার অনেক খেয়াল রাখেন। শুধু আমার না। আমার ছোট বোন রিতু,আর এই পরিবারের সবার খেয়াল রাখেন উনি। ‘
‘নক্ষত্রকে তুমি ভালোবাসো?’ বেশ সাবলিল ভংগিতে জিজ্ঞেস করলো ওয়াসিফ।
ইরিন এবারে আর উত্তর দিতে পারলো না। নিজের সাথে লড়াই করেও এমন মিথ্যা মুখ দিয়ে বের করতে পারলো না।
তাকে চুপ থাকতে দেখে ওয়াসিফ বললো, ‘আমি তোমাকে পছন্দ করি ইরিন। পরিচয়ের শুরুর দিন থেকেই তুমি আমার মন মস্তিষ্কে জেঁকে বসেছো। অদ্রির সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে সেই ছোট থেকেই। তাই এই জীবনে কখনো অন্য কোন নারীর সাথে সম্পর্কে জড়ায়নি। কিন্তু, তোমার দেখা পাওয়ার পর আমি কিছুতেই নিজেকে ফেরাতে পারিনি তোমার থেকে। ভেবেছিলাম লন্ডনে ফিরে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু, অদ্রির সাথে এংগেইজমেন্টের ব্যাপারটা ফাইনাল হওয়ার পর আমি রিয়ালাইজ করেছি আমার দ্বারা এটা সম্ভব না। ‘ এটুকু বলে থামলো ওয়াসিফ।
ইরিন হতভম্ব স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘ কি সম্ভব না?’
‘অদ্রিকে বিয়ে করা। ওকে ভালোবেসে স্ত্রীর অধিকার দেওয়া। শুধু অদ্রি কেন…অন্য কাউকেই তোমার জায়গা দেওয়া সম্ভব না।’
‘ আপনি কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলছেন? অদ্রি বা পরিবারের কেউ জানলে কতটা কষ্ট পাবে ভাবতে পারছেন আপনি? তাছাড়া আমি আপনার ভাইয়ের স্ত্রী। ‘ নিজেকে অপ্রস্তুত মনোভাব থেকে যথাসম্ভব সামলে রেখে বললো ইরিন।
‘সুখবিহীন একটা দাম্পত্য কত দিন বয়ে বেড়াবে ইরিন? কতদিন নক্ষত্রকে ঠকিয়ে সুখী হওয়ার ভান করবে? আর আমি? আমি যদি অদ্রিকে বিয়েও করি ওকেও তো ঠকানো হবে। আর আমি চাইনা অদ্রিজা এভাবে ঠকে যাক। কষ্ট পাক। তাছাড়া, আমি জানি তুমি নক্ষত্রকে নয় আমাকে পছন্দ করো। আমি সেটা বুঝতে পেরেছি বলেই আজ এসব বলার সাহস করতে পেরেছি তোমাকে। ‘
এটুকু বলেই সে এগিয়ে এলো ইরিনের দিকে। ইরিনের হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বললো,
‘প্লিজ ইরিন। আমাকে ফিরিয়ে দিও না। আমি আর তুমি না হয় সব ছেড়ে লন্ডন চলে যাবো। রিতুকেও নিয়ে যাবো সাথে। কথা দিলাম। নক্ষত্রকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো। একদম সবার থেকে দূরে গিয়ে সুখে সংসার করবো আমরা। প্লিজ ইরিন…ট্রাই টু আন্ডারস্যান্ড, তোমার মত মেয়েকে নক্ষত্রের মত একটা ছেলে কখনোই ডিজার্ভ করে না। ‘
ইরিন অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে কেবল শুনছে ওয়াসিফের বলা প্রতিটা কথা। ওয়াসিফকে ও পছন্দ করে। অন্যায় হলেও এটাই সত্যি যে ও ওয়াসিফকে অন্য চোখে দেখে। কিন্তু, ওয়াসিফও যে ওকে পছন্দ করে সেটা ও কখনোই ভাবেনি।
‘কি হলো ইরিন। প্লিজ সুইটহার্ট, ডোন্ট রিফিউজ মি। আমি কথা দিচ্ছি তোমায়, তুমি যেভাবে চাইবে সেভাবেই রাখবো তোমায়। বিনিময়ে শুধু তোমাকে আমার জীবনে চাই ইরিন।আমার করে চাই। জরুরী নয় তুমি আমার হও। কিন্তু, এটাই সত্যি, আমি তোমার ছাড়া অন্য কারও হতে চাই না। অন্যকেউ আমার লাইফে এলে কখনোই সুখী হবে না। আর না তুমি কখনো সুখী হবে নক্ষত্রের সাথে এই মিথ্যে ভালো থাকার অভিনয় করে। দ্যাটস হুয়াই আ’ম রিকুয়েস্টিং ইউ…প্লিজ বি মাইন। আমি অদ্রিকে নয় তোমাকে চাই ইরিন। তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আর আমি জানি তুমিও আমাকে চাও। শুধুমাত্র নক্ষত্রের সাথে একটা সো কল্ড সম্পর্কে জড়িয়ে আছো বলে নিজের ফিলিংস তুমি চেপে যাচ্ছো। অথচ তুমি চাইলেই তাদের ডানা মেলে উড়তে দিতে পারো। আর সেই ডানাগুলো আমি হতে চাই ইরিন। এরপরেও তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিবে ইরিন?’
ইরিনের মাথা কাজ করছে না। কাঙ্খিত মানুষ…একটা সম্ভাব্য সুখী জীবন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অথচ সে বাঁধা পড়ে আছে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষ আর তার সাথে জড়ানো একটা অসুখী অনিশ্চিত দাম্পত্যে। কিন্তু, এখন তো জীবন তাকে আরেকটা সুযোগ দিচ্ছে। সে চাইলেই সেই সুযোগ লুফে নিতে পারে। একটা সুন্দর সুখী জীবন সাজাতে পারে। হয় তো অনেকগুলো সম্পর্ক এতে আহত হবে, কিংবা শেষ হয়ে যাবে চিরতরে। কিন্তু বিনিময়ে সে তার পছন্দের মানুষটাকে পাবে। বাকি জীবনটা গুমড়ে গুমড়ে বাঁচতে হবে না তাকে। অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে অস্বস্তিতে গাঁট হতে হবে না বারেবার। এতে অবশ্য তাকে স্বার্থপর হতে হবে। হলে হবে! কি এমন হবে এটুকু স্বার্থপর হলে? কিন্তু পরমূহুর্তেই মন বাঁধ সাধলো, স্বার্থপর হতে গেলে তোমাকে অনেক নীচে নামতে হবে ইরিন। এতটা নীচে নামার শিক্ষা তোমাকে কখনো দেওয়া হয়নি। তুমি এই অন্যায় করতে পারো না।
‘আই লাভ ইউ, ইরিন। এন্ড আই মিন ইট। তুমি যদি আমাকে ফিরিয়েও দাও মনে রেখো তুমি তোমার সাথে সাথে আমার ভালো থাকাটার সুযোগটাও শেষ করে দিবে। আর রইলো, অদ্রির কথা…তুমি আমার না হলেও অদ্রিকে আমি বিয়ে করবো না। যদি চাপে পড়ে এংগেইজমেন্টটা করতেও হয়, তবে সেটা ওই পর্যন্তই থাকবে। আমি লন্ডনে গেলে আর ফিরবো না কোনদিন। ভেঙে দিবো এংগেইজমেন্ট। বাকিটা তোমার ডিসিশন। ‘
-ওয়াসিফের কথায় ভাবনাচুত্য হলো ইরিন। কিছুসময় অপলক তাকিয়ে রইলো ওয়াসিফের দিকে। তার চোখে মুখে আবেগের ঘনঘটা। এই বুঝি ইরিনকে না পেলে সে মরেই যাবে। এই দেখে ইরিনের চোখে মুখে খুশি ঝিলিক দিল মূহুর্তের জন্য। তারপর, আলগোছে ওয়াসিফের হাতের বন্ধন থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে কয়েকদম পিছিয়ে গেল ইরিন। কোন রকম বাক্যবিনিময় ছাড়াই নেমে গেল ছাদ থেকে। ওয়াসিফ বিভ্রান্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো ওখানেই।
৪৫.
যথারীতি তিনদিন পর ওয়াসিফ আর অদ্রিজার এংগেইজমেন্টটা হয়ে যায়। তবে, বিগত ৩ দিনে ওয়াসিফ কম চেষ্টা করেনি ইরিনের মতামত জানার। কিন্তু, ইরিন ওকে কোন জবাব দেয়নি। ফোনকল রিসিভ করেনি। ম্যাসেজের রিপ্লাই দেয়নি। এংগেইজমেন্টের পুরো অনুষ্ঠানেও ওয়াসিফের সাথে কোন কথা বলেনি। তবে পুরো অনুষ্ঠানে ওয়াসিফকে হাসিখুশিই দেখা গেল।
সেদিন রাতেই পরিবারের সবাই যখন মেহমানদের বিদায় দিতে ব্যস্ত ইরিন তখন রিতুর ঘরে ওকে ঘুম পাড়াচ্ছিল। রিতু ঘুমিয়ে গেলে ওকে রেখে ঘর থেকে বেরোনোর সময় ওয়াসিফ এসে ওকে ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়। ইরিন কিছু বলার আগেই দরজা আটকে দিয়ে বলে, ‘জাস্ট টু মিনিটস ইরিন। আই নিড টু টক টু ইউ, প্লিজ!’
‘ইরিন কথা বাড়ালো না এই নিয়ে। ঘরে রিতু ঘুমাচ্ছে দেখে বেলকোনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। ওয়াসিফও গেলো পেছন পেছন। ওয়াসিফের উপস্থিত টের পেয়েই ইরিন বললো, ‘ বলুন কি বলবেন। ‘
‘তুমি ঠিক কি চাইছো বলো তো ইরিন? কেন এমন করছো তুমি?’
‘আপনার সাথে অদ্রির এংগেইজমেন্ট হয়ে গেছে। সম্পর্কে আজ থেকে আমি আরও পাকাপোক্তভাবে আপনার ভাবী হই। এবার তো অন্তত ভাবী বলে ডাকুন।’
‘রসিকতা ছাড়ো ইরিন।এখন রসিকতা করার মতো মেন্টাল সিচুয়েশনে নেই আমি। ‘
‘আমি মোটেও রসিকতা করছিনা। যা সত্যি সেটাই বলছি।’
‘আমি পরশু চলে যাবো। আর ফিরবো না। ‘ ইরিনের কথাটা এড়িয়ে ব্যথিত কন্ঠে বললো ওয়াসিফ।
‘ সম্পর্ক ভাঙা এত সহজ নয়, ওয়াসিফ। আমরা চাইলেই সেটা করতে পারি না।’
‘যে সম্পর্কটা শুধুমাত্র নামমাত্র, সেটাকে বয়ে বেড়ানো অর্থহীন ইরিন। ‘
‘বিয়ের সম্পর্ক মানে বোঝেন? আজ ৪ মাসের বেশি আমি একই ঘরে এক বিছানায় তার সাথে রাত কাটিয়েছি। এমন মেয়েকে আপনি নিজের জন্য চাইছেন। অবিশ্বাস্য! ‘
‘যাকে তুমি ভালোবাসো তাকে সব রূপে সব অবস্থাতেই ভালোবাসা যায়। তুমি কেবল শরীরের কথা বলছো, মনকে কেন আঁড়াল করছো?’
ওয়াসিফের কথায় তার মুখের দিকে চাইলো ইরিন। আলতো হাসছে ওয়াসিফ। নাহ, তাকে দেখে কোনভাবেই মনে হচ্ছে না, সে মিথ্যা বলছে কোনো। বা কোনপ্রকার ছল করছে। আর কেনই বা করবে। কি লাভ তাতে তার?
ইরিনের দৃষ্টি বুঝতে অসুবিধা হলো না ওয়াসিফের। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভরপুর সে দৃষ্টি। দু’কদম এগিয়ে এলো ওয়াসিফ। দু হাতের আঁজলা তুলে নিল ইরিনের মুখখানি। ইরিনের কোন ভাবান্তার হলো না। কাংখিত মানুষটির এমন স্পর্শেও কোন শিহরণ ছুঁয়ে গেল না তাকে। কিন্তু, মনে উঁকি দিল অন্য একটা স্পর্শের রেশ।
ইরিনের চোখের দিকে তাকিয়ে ওয়াসিফ বললো, ‘একটা সুযোগ দাও ইরিন। কথা দিচ্ছি ঠকবে না এক বিন্দুও। ‘
‘আপনি সব ব্যবস্থা করুন।আমি রাজি। ‘ – ওয়াসিফের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো ইরিন।
ইরিনের জবাব পেয়ে এক মূহুর্তেও দেরি করলো না ওয়াসিফ। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইরিনকে। খুশিতে আটখানা হয়ে বললো, ‘ফ্লাইটটা তাহলে আর কিছুদিন ডিলে করে দেই, কি বলো? ‘
ইরিন ওয়াসিফকে আঁকড়ে ধরলোনা।বরং আলগোছে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল তার বাহুবন্ধন থেকে। ওয়াসিফ এমনটা আশা না করলেও কিছু বললো না। বললো ইরিন।
‘ফ্লাইট ডিলে করার দরকার নেই। যতদ্রুত সম্ভব আমাকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমাদের বিয়েটা আগে হোক। তারপর যেভাবে ইচ্ছা ছুঁয়ে দিবেন আমায়। আমি নির্দ্বিধায় সঁপে দিবো নিজেকে। আপনি যান এখন। বাইরে কেউ আপনার খোঁজ করছে হয় তো।’
কথা শেষ করে ইরিন বেরিয়ে গেল বেলকোনি থেকে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ওয়াসিফ বলে গেল,’ রাতে কল দিবো। রিসিভ করো প্লিজ।’
৪৬.
শান্ত বিকেলের কোলাহল অনেকটা নেই বললেই চলে। প্রকৃতির কোল জুড়ে নেমে এসেছে সাঁঝের আলো। ধীরেধীরে তা গভীর থেকে গভীর ধারায় রূপ নিয়ে ধারণ করছে নিকষ কালো অন্ধকারে। নদীর পাড়ের নির্জনতা মিলেমিশে যাচ্ছে সেই অন্ধকারের শরীরজুড়ে। পাশাপাশি বসে থাকা দুজন মানব মানবীও চুপ। দীর্ঘ পথ যাত্রার শেষে যেন একটুখানি বিশ্রাম এই নিশ্চুপ প্রহর।
পা ভাজ করে হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে বসেছে ইরিন। কিন্তু, রাফিদের এমনভাবে হা হয়ে তাকিয়ে আছে ইরিনের দিকে যেন তার চোখগুলো বুঝি এবার কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে একেবারে। ইরিন সম্মুখে তাকিয়ে নদী ঘাটে ফিরতি মাঝিদের নৌকা বাঁধা দেখছে একমনে।
মশাদের উৎপাত শুরু হয়েছে একটু আধটু। তৎখনাৎ পায়ে একটা মশার কামড়ে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটলো ইরিনের। দুই একটা পন পন করে নিজেদের উপস্থিত জানান দিচ্ছে কানের আশে পাশে। মশা তাড়াতে তাড়াতেই বিরক্তির স্বরে ইরিন বললো, ‘ এই উঠুন তো এখন এখান থেকে। বড্ড মশা। কামড়ে তো শেষ করে দিচ্ছে। পরে ডেংগু হয়ে গেলে সর্বনাশ । সামনেই আমার ফাইনাল প্রেজেন্টেশন। অসুস্থ হলে হবে না। উঠুন তাড়াতাড়ি। ‘
কথা শেষ করে রাফিদের দিকে তাকাতেই থতমত খেয়ে গেল ইরিন। তাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘হোয়াট?’
‘আপনি সিরিয়াসলি এটা করেছেন ইরিন? আই মিন হাউ কুড ইউ ডু দ্যাট?’ – ইরিনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে পাল্টা প্রশ্ন করলো রাফিদ।
‘মানে কি! কি করেছি আমি?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো ইরিন।
এবারে রাফিদ ইরিনের দিকে ঘুরে বসলো। পা দুটো ভাজ করে বসে সিরিয়াস গলায় বললো, ‘মানে আপনি ওকে জড়িয়ে ধরতে দিলেন? না মানে আপনার একটুও খারাপ বা অস্বস্তি লাগলো না? মি. নক্ষত্রের কথাও মনে হলো না একবারও? আবার কি সুন্দর বলে দিলেন, আপনি রাজি! মানেএএএএ ইয়াররর…..এইডা কিছু হইলো??’
রাফিদের বাকি কথাগুলো যেমন তেমন…শেষবাক্যের ভাষায় আরেকদফা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ইরিন। কঠোর গলায় বললো, ‘এসব কি ধরণের ভাষা মি. রাফিদ!’
রাফিদ সে কথার পাত্তা দিল না। উল্টা প্রশ্ন করলো আবারও।
‘এই আপনি কি সত্যি সত্যি ওয়াসিফের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন? আই মিন, পরকীয়া করতেন?’
‘কেন ডায়রি পড়েছেন অথচ এর উত্তর জানতে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন?’
‘আরে নিকুচি করি আপনার ডায়রির। ওতে অত শত কিছু লিখা আছে নাকি। শুধু লিখেছেন আপনি মি. নক্ষত্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কিছু অবৈধ্য ইচ্ছেদের প্রশ্রয় দিয়েছেন অন্য কাউকে ভরসা করে। বিনিময়ে সৃষ্টিকর্তাও নিদারুণ এক প্রতিফল দিয়েছেন আপনাকে। বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিফলে ঠকে গেছেন আপনিও। ওয়াসিফ আপনাকে ঠকিয়েছে।’
‘বাহ! ভালোই তো মনে রেখেছেন দেখছি। মুখস্থ করেছেন নাকি?’ – খোঁচা মেরে বললো ইরিন।
‘আরেহ নাহ। প্রোফেশনাল ন্যাচার বলতে পারেন। যাই পড়ি, যাই দেখি…শুনি তাতেই মনোযোগ দিতে হয়।আস্তে ধীরে এটা আমার নিজস্ব স্বভাবেও ঢুকে পড়েছে। তাই আর কি..’ – মিষ্টি হেসে খানিক লাজুক স্বরে বললো রাফিদ।
‘বুঝেছি। ‘ ছোট্ট করে বললো ইরিন।
‘হুম। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। ‘
‘ না। ওয়াসিফের সাথে আমি কোন সম্পর্কে জড়ায়নি।’
‘তাহলে? আপনি যে বললেন, ওয়াসিফ আপনাকে ঠকিয়েছে? কি করেছিলো ও আপনার সাথে?’
‘বলবো। তবে এখানে নয়। মশা কামড়াচ্ছে। ক্যাফেতে গিয়ে বসি? বাকি গল্পটা না হয় কফি খেতে খেতেই বলি! ‘
ইরিনের কথায় দিরুক্তি করলো না রাফিদ। চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো। আশে পাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজলো সে। তারপর, ইরিনকে বললো, একটু দাঁড়ান প্লিজ। আমি আসছি এখনই।’
তারপর..সাথে করে আনা পেস্ট্রি বক্স, চিপসের প্যাকেট, জুস আর বাকি খাবারের প্যাকেটগুলো নিয়ে কোথাও একটা রওনা দিল। ইরিনের বুঝতে বাকি রইলো না, আজও সে পথশিশু নয় তো অসহায় কাউকে এগুলো বিলি করতে গেছে। প্রতিবারই এমন করে। প্রায় সময় নিজে যা খায় সেটাই আরেকটা প্যাক করে নেয়। তারপর, রাস্তায় বসে অসহায় কোন ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়। ইরিনের বেশ ভালো লাগে রাফিদের এই ব্যাপারটা। একটু বেশি বকবক করে কিন্তু মানুষটা খুব একটা মন্দ না। – এসব ভেবেই আলতো হাসি ফুঁটে উঠলো ইরিনের ঠোঁটের কোণে।
৪৭.
‘মায়া বোঝেন ? ‘ জানলার কাঁচ ভেদ করে দূর আকাশের আধখানা চাঁদ দেখতে দেখতে বললো ইরিন।
‘বুঝি তো!’ কিছুটা খাপছাড়া গলায় জবাব দিল রাফিদ।
‘এই মায়া জিনিসটা একটা ঘাতক ব্যাধির মত। বলতে পারেন, এটা অনেকটা ক্যান্সারের জীবাণুর মত। আপনার অজান্তেই একটু একটু করে আপনার ভিতর জন্ম নিবে। একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে একসময় পুরো কব্জা করে নিবে আপনাকে। আর যতক্ষণে আপনি টের পাবেন আপনি তার দখলে জিম্মি হয়েছেন ততোক্ষণে হয় সেটা আপনাকে পুরোপুরি শেষ করে দিবে। নয় তো আমৃত্যু তা বয়ে বেড়াতে হবে নিজের মাঝে। তবে এদের মধ্যে তফাৎটা শুধু এটাই যে, ক্যান্সার শরীরে বাসা বাঁধে আর মায়া অন্তরাত্মায়। ‘
‘আজকাল ক্যান্সারের অনেক উন্নত ট্রিটমেন্ট আছে মিসেস.ইরিন। সময়মত সঠিক ট্রিটমেন্ট দিলে ক্যান্সারে ভালো হওয়ার চান্স শতভাগ। মৃত্যুর পরিমাণও অনেকখানি কমে গেছে এর ফলে। ‘ চিকেন প্যাটিসে কামড় বসিয়ে বললো রাফিদ।
‘ইরিন চাঁদ দেখা বাদ দিয়ে রাফিদের দিকে তাকালো এবার। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়েছে সে রাফিদের এমন রসিকতায়। তাই খানিক গম্ভীর স্বরে বললো, ‘মোহ কাটানোর উপায় থাকলেও মায়া কাটানো অসম্ভব। একবার কোন কিছুর মায়ায় জড়িয়ে গেলে মরণ ছাড়া তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব না। ‘
‘তো আপনি কোন স্টেজে আছেন মিসেস. নক্ষত্র?’ -এই প্রথম ইরিনকে মিসেস. ইরিন না বললে মিসেস. নক্ষত্র বলে সম্বোধন করলো রাফিদ।
রাফিদের এমন কথা ও সম্বোধনে এবার মুচকি হাসলো ইরিন। বিরক্তিভাবটা কেটে গেল তার। ঠোঁটের কোণে হাসি জড়িয়েই বললো, ‘যে মায়ায় জড়িয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন…
আমি তোমারও বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস।
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী
দীর্ঘ বরষ মাস!’
মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনলো রাফিদ… ইরিনের উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ। এত গভীরতা, এত বিষাদমাখা প্রতিটা শব্দ। এ কেবল গভীর মায়ায় পড়লেই বুঝি সম্ভব। মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো সে, মায়া সত্যি মারাত্মকরকমের ঘাতক এক অনুভূতি। মায়া কাটিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে বুঝি মরণ শতগুণে সহজ।
নিজের ভাবনায় এবার নিজেই অবাক হলো রাফিদ। ইরিনের মত সেও কেন মরণকে সহজ মনে করছে! তবে কি তাকেও ইরিনের সঙ্গ দোষে ধরলো নাকি শেষমেশ?!
৪৮.
ওয়াসিফের চ্যাপ্টারটা আজ বরং এখানেই ক্লোজ করি। ভিন্ন কিছু শোনাই। – ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিয়ে আবারও বাইরে দৃষ্টি মেলে দিয়ে বললো ইরিন।
‘আপনি কিন্তু আমাকে এলোমেলো পথ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন মিসেস. নক্ষত্র। পরে কোন পথ ধরে কতটা এসেছিলাম গুলিয়ে ফেলবো তো। সোজা রাস্তায় হাঁটুন। ‘
‘বেশ। এবার তবে আপনাকে নামসূত্রে মিসেস. ইরিন থেকে মনেপ্রাণে মিসেস.নক্ষত্র হয়ে ওঠার গল্পটা বলি।’ মুচকি হেসে বললো ইরিন। তার কথার সুরে খানিক লাজুকতার রেশ পেল রাফিদ। এই নিয়েও ইরিনকে খোঁচা মারতে ছাড়লো না সে। টিটকারির স্বরে বললো, ‘বাহ!আজ তবে কিছু ব্যক্তিগত মূহুর্তের কথা সামনে আসতে চলেছে। তোর তো আজ কপাল খুলে গেছে রে রাফিদ। ‘
ইরিন রাফিদের টিটকারি গায়ে মাখলো না। নিজের মত বলতে শুরু করলো।
‘ওয়াসিফের সাথে আমার সম্পর্কের কোন নাম ছিল না। কোন নির্দিষ্ট ধারাও ছিল না। এংগেইজমেন্টের দু সপ্তাহ পরে যাওয়ার কথা থাকলেও সে তার কথা অনুযায়ী দু দিন পরেই চলে যায়। প্রায়ই সে আমাকে ফোন করতো। প্রেম আলাপ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যা ছিল সব তার পক্ষ থেকেই। আমি শুধু হু, হা…কিংবা ফর্মালি যতটা যা বলে তার কথায় সঙ্গ দেওয়া যায় ততোটাই বলতাম। আমার সচেতন মন যতই ওয়াসিফকে পাওয়ার বাসনা রাখুক না কেন কোথাও না কোথাও আমি জানতাম ওয়াসিফকে আমি ভালোবাসি না। তাই তার প্রতি ভেতর থেকে তেমন কোন অনুভূতি কাজ করতো না। আমি ভাবতাম হয় তো সময়ের সাথে আমি আমার এই ভালো লাগাকে ভালোবেসে ফেলবো। কিন্তু, মন খুব একটা জোর দেখাতো না আমার এই ভাবনার প্রতি।
এভাবেই আরও দু মাস কেটে যায়। নক্ষত্রের অগোচরেই ওয়াসিফের সাথে আমার যোগাযোগ চলতে থাকে। কিন্তু, তাকে যতবারই জিজ্ঞেস করতাম কবে সব ব্যবস্থা হবে, সে শুধু বলতো সময় লাগবে। আমি অপেক্ষার প্রথর গুনতাম। একটা অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক থেকে মুক্তির। একটা সুন্দর কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের।
দেখতে দেখতে আমাদের বিয়েরও ৬ মাস পূর্ণ হয়। সেদিন নক্ষত্র সন্ধ্যা নাগাদই বাড়ি ফিরে আসেন। ঘরে এসে সে কি হাকডাক জনাবের! আমি কিচেনে তার জন্য চা করছিলাম। বাড়ি ফিরে শাওয়ার নিয়ে কড়া এক কাপ চা খাওয়ার অভ্যাস তার। কিন্তু, জনাবের হাকডাকে সেদিন চা ছাড়াই ঘরে যেতে হলো আমার।
আমি ঘরে যেতেই আচমকা খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন উনি আমায়। প্রচন্ড খুশি দেখাচ্ছিল উনাকে। ওদিকে উনার বাহুবন্ধনে আটকে অস্বস্তিতে পিষছিলাম আমি। কিছু সময় পরে উনি আমাকে ছেড়ে আলতো করে চুমু খেলেন আমার কপালে। আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘হ্যাপি সিক্সথ মান্থস এনিভার্সারি মাই ডিয়ার ওয়াইফ। ‘ আমি অবাক হয়েছিলাম কারণ আমার তো মনে ছিলই না আবার এত স্পেশাল কিছুও ছিল না এটা আমার জন্য। তারপর, উনি টেবিলের উপর রাখা একটা ফাইল আর একটা বিশাল আকৃতির বক্স আমায় দেখিয়ে বললেন, ‘এটা তোমার জন্য ইরিন। আমার এত দিনের অপ্রতুল ব্যস্ততার অবসান আমি তোমায় দিলাম। দেখতো ভাল্লাগে কিনা। ‘
আমি কিছুই বুঝলাম না উনার কথা। এগিয়ে গিয়ে ফাইলটা হাতে নিলাম।
‘ আপনার বাড়ির দলিল, তাই না?’ উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললো রাফিদ।
‘হ্যাঁ। সিলেট ট্যুরে যাওয়ার পর সেখানে একটা জমি উনার খুব পছন্দ হয়। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বেশ বড়সড় একটা জমি। ওটার বেশ কাছাকাছি একটা ঝরণাও আছে। ভেতর বাড়ির বেলকোনিতে বসলেই ঝরণার কলকলিয়ে বয়ে যাওয়ার শব্দ ভেসে আসে কানে। সেই জায়গাটায় উনি বাড়ি করার সিদ্ধান্ত নেন। আর জমিসহ বাড়িটা উনি আমার নামে করে দেন। আর ওই বক্সে ছিল বাড়ির মডেল। যেটা উনি নিজ হাতে ডিজাইন করেছেন।’
‘হ্যাঁ, হাজবেবড যখন এত নামিদামি..গুণী আর্কিটেক্ট তখন তো বউয়ের জন্য করা বাড়ির ডিজাইন করার ক্ষমতা সে ছাড়া অন্য কারো আছে নাকি!’
‘আবারও খোঁচা মেরে কথা বলছেন, মি. রাফিদ?’
‘এই একদম না। আমি তো যা সত্যি তাই বললাম।’ নিজের সাইফে বললো রাফিদ।
‘ নিজের কাজের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে এই বাড়ির জমি কেনা ও ডিজাইন করতে গিয়েই রাত দিন খাটতে হয়েছে উনাকে। উনি চেয়েছিলেন যেন আমাদের বিয়ের ছ’মাসের পূর্তির দিনই এটা আমি হাতে পাই।’
‘কেমন ফিল হয়েছিল তখন আপনার?’
‘এটা বলে বোঝানোর মত শব্দ আমার জানা নেই। আমি কত সময় স্টান্ড হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি নিজেই বলতে পারবো না । যখন উনি দেখলেন আমার চোখের পানিতে ফাইল ভিজে যাচ্ছে, খুব যত্ন করে আগলে নিয়েছিলেন আমায় নিজের মাঝে। অনুভূতি শূন্য লাগছিল নিজেকে। উনার বাহুবন্ধনে গিয়ে মনে হয়েছিল আমি যেন অকূল পাথারে পড়ে ঠাই খুঁজে পেয়েছি। উনি বললেন, ‘ডিজাইনটা আমি নিজে করেছি ইরিন। তোমাকে ভেবে তোমার মন মত করার চেষ্টা করেছি। পছন্দ না হলে বলো বদলে দিব। ‘
একবার ভাবুন আপনি, যে মেয়েটা ছোট থেকে মধ্যবিত্তের টানাপোড়নের সংসারে বড় হয়েছে….অভাব দেখেছে, তাকে নিয়ে কেউ এতটা ভাবছে, এতটা যত্ন নিয়ে তার মনমতো কিছু তৈরী করার চেষ্টা করেছে, সেই মেয়েটার জন্য এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে? আমার জন্য ব্যাপারটা বাড়ি পাওয়া ছিল না …ছিল নিজের জন্য কারও অনেকখানি ডেডিকেশন, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। সেবারই প্রথম আমার মনে প্রশ্ন জাগে,’ আচ্ছা, উনি কি তবে আমায় ভালোবাসেন?’
চলবে…