নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_১১
লেখায়_জারিন
৪৯.
‘ওও…হো! মিসেস. নক্ষত্র তবে নিজ নামে বাড়ি পেয়ে মি. নক্ষত্রের প্রেমে পড়ে গেল শেষমেশ?? ‘ রসিকতার করে বললো রাফিদ।
‘নাহ। উনার স্ত্রী হিসেবে যেখানে অঢেল সম্পত্তির অর্ধেক মালিকানা আমার ছিল আজীবনের জন্য, সেখানে ওই সামান্য একটা বাড়ি এমন আর কি ছিল!’ – রাফিদের রসিকতার বিপরীতে পাল্টা জবাব দিয়ে বললো ইরিন।
‘এই আপনি তো এখনো উনার স্ত্রী। সব সম্পত্তির অর্ধেক মালকিন। তাহলে তো আপনাকে কিডন্যাপ করলে এক ধাক্কায় বড়লোক হয়ে যাওয়া যাবে। ঠিক ওই বাংলা সিনেমার ভিলেনের মত। একটা দলিল করে আপনাকে দিয়ে সই করিয়ে নিলেই সব সম্পত্তি আমার। ‘ কথাটা বলেই হো হো করে হেসে উঠলো রাফিদ।
না চাইতেও নিঃশব্দে হেসে ফেললো ইরিনও। হাসি মুখেই বললো, ‘আমাকে কিডন্যাপ করলে ওসবের কানা কড়িও জুটবে না কারও। যেখানে মানুষটার উপরেই মালিকানা খুইয়েছি সেখানে সম্পত্তিতে কি করে ভাগ রাখি বলুন। উনার যা কিছু ছিল সব কিছুর দাবি ছেড়ে দিয়েই ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছি আমি। ‘
‘ধ্যাতত্তেরিকা!! এইডা কিছু হইলো?? ‘ বেশ আহত স্বরে বললো রাফিদ।
‘মি. রাফিদ, আবার!!’ -শাসনের স্বরে বললো ইরিন।
‘এই কিসের আবার! কই আমি একলাফে কোটিপতি হওয়ার প্ল্যান করছিলাম, আর আপনি কিনা…!’ – স্বপ্নভঙ্গের মত ব্যাথিত ভংগিতে বললো রাফিদ। রাফিদের কথায় ইরিন এবারেও না হেসে পারলো না। তাকে হাসতে দেখে এক পর্যায়ে হেসে ফেললো রাফিদও। প্রসঙ্গ বদলে জিজ্ঞেস করলো, ‘এবার বলুন এত অনিচ্ছা, অসন্তুষ্টি নিয়েও মি. নক্ষত্রের প্রেমে পড়লে কিভাবে আপনি?’
রাফিদের এ প্রশ্নে মিষ্টি করে হাসলো ইরিন।।কিঞ্চিৎ লাজুক আভা উঁকি দিল তার সমগ্র চোখ মুখে। মুখের হাসিখানা বজায় রেখেই সে বললো, ‘ আমি উনার প্রেমে পড়িনি কখনো। ভালোবাসাটাও হয়েছিল অনেক পরে। কিন্তু তার আগেই মায়া নামক সূক্ষ ঘাতক ব্যাধিটাই আজীবনের নামে আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জিম্মি করে ফেলেছিল। নিজের অজান্তেই আমি মনে প্রাণে ডুবে গেছিলাম নক্ষত্র বন্দনায়। ‘
‘নক্ষত্র বন্দনায়! ওয়াও!’ -মনে মনে আউড়ালো রাফিদ। তারপর ইরিনকে বললো, ‘ গল্পটা প্লিজ…’
মুখের হাসিটা আরও প্রসস্থ হলো এবার ইরিনের। ইরিন বলতে শুরু করলো।
‘আমি যখন মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি নক্ষত্র আর এ সম্পর্কটা ছেড়ে যাওয়ার, জীবন আমাকে এমন এক সত্যের মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো যার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। মূলত এ সত্যের রেশ ধরেই বদলে যেতে শুরু করে ইরিন নামক সত্ত্বাটা। ‘
রাফিদের কপাল কুচকে এলো। এ ব্যাপারে তো ডায়রিতে কিছু লেখা ছিল না। এ কোন নতুন অধ্যায় যা রয়ে গেছে দৃষ্টির অলক্ষ্যে থাকা কোনো একটা পাতার ভাঁজে?!
৫০.
ইরিনকে বাড়ির দলিল দেওয়ার পরের দিনের ঘটনা। সেদিন ছিল শুক্রবার। দুপুরে জুম্মার নামাযে গিয়েছিল নক্ষত্র। ইরিন মাত্রই নামায শেষ করে জায়নামাজ ভাঁজ করছে, এমন সময় নীচে হলরুমে নক্ষত্রের বাবা নাফিজ শেখের চেঁচামেচির আওয়াজ কানে এলো ইরিনের। কি হয়েছে বোঝার জন্য রুম থেকে বের হতেই আওয়াজ আরও বেশি স্পষ্ট হলো।
শুধু নাফিজ শেখ নয়, নক্ষত্রও আছে সেখানে। মিসেস. শায়লাও এসে দাঁড়িয়েছেন নীচে। হলরুমের এককোণায় দাঁড়িয়ে আছেন চুপচাপ। অদ্রিজা, কনক আর রিতু গেছে মিসেস. শায়লার ছোট বোনের বাড়ি। আজ তার মেয়ের জন্মদিন। অদ্রিজা, কনক,রিতু সারাদিন থাকবে। শায়লা ও নাফিজ শেখ সন্ধ্যায় যাওয়ার কথা। যদিও বিয়ের পর থেকে ইরিন দেখেছে শায়লার বাপের বাড়ির কারও পক্ষ থেকে কোন অনুষ্ঠানে দাওয়াত থাকলে নক্ষত্র যায় না। তাই ইরিনেরও যাওয়া হয় না। ইরিনের কেবলই মনে হয় ওরা কেউ নক্ষত্রকে পছন্দ করেনা। তবে এ ব্যাপারে কখনো কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি ইরিনের।
সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই নীচে তাকালো ইরিন। মূল ঘটনা কি তা বুঝতে না পারলেও খন্ড খন্ড কিছু বাকদন্ডিতা শুনতে পেলো সে।
‘তুমি কিন্তু ভুলে যাচ্ছো আদৃত, আমার পরে এইসব তোমার হবে। তোমাকেই মালিক হিসেবে এসবের দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। তাহলে এই অনর্থক জেদ কেন করছো তুমি?’ তেজি স্বরে বললেন নাফিজ শেখ।
‘আমি আগেও বলেছি।আজ আবারও বলছি। আপনার কোন সম্পত্তি আমার চাই না। এতদিন যখন এসবের দরকার পড়েনি, ইন শাহ আল্লাহ বাকি জীবনও আমি এসব ছাড়াই পার করতে পারবো। একমাত্র আম্মুর কারণেই আমি এ বাড়িতে আছি আজ এতগুলো বছর। উনার জন্যই আপনার কোম্পানিতে কাজ করছি। নয় তো আমার যা কোয়ালিফিকেশন্স, দেশের বাইরে মোটা অংকের চাকরি পাওয়া আমার জন্য কোন কঠিন কিছু নয়। ‘
‘নিজের জ্ঞান গরিমার অহংকার দেখাচ্ছো তুমি? কাকে দেখাচ্ছো এই অহংকার? ভুলে যেও না তোমার রক্তে আমার রক্তও মিশে আছে। আমারই অংশ তুমি। তোমার এই বোধ বুদ্ধি আমার অংশ হিসেবেই পাওয়া।’
‘আমি আপনার অংশ এটা আমৃত্যু ভুলে যাওয়ার কোন উপায় নেই আমার। আপনার জন্যই তো আমার মায়ের এই পরিণতি।ভুলে যাওয়া অসম্ভব।’ – প্রচন্ড ক্রোধমিশ্রিত গলায় বললো নক্ষত্র।
নক্ষত্রের এমন কথার পরে কিছুটা দমে গেলেন নাফিজ শেখ। ক্লান্ত যোদ্ধার মত আপোষের স্বরে বললেন, ‘প্লিজ আদৃত। পুরোনো কথা ধরে আর কতকাল বসে থাকবে। পেপারগুলোয় সাইন করে দাও। আমি একা আর পারছি না কোম্পানির দায়িত্ব নিতে। এবার আমি চাই একজন সাধারণ কর্মী থেকে এবার তোমার যোগ্য আসনে বসো তুমি। আমার জায়গাটা নাও। আজ নয় তো কাল এটাই তো তোমার ভবিষ্যৎ! ‘
‘স্যরি..মি. শেখ, আমি আমার নিজের জায়গাতেই ঠিক আছি। নিজের যতটুকু যা আছে তাতেই আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি আমি। আপনার এ বিশাল সম্পত্তির জন্য আপনার তিন কন্যাই যথেষ্ট। ‘
‘তুমি এই বংশের একমাত্র বংশধর,আদৃত। এই জন্যই তোমাকে…
নাফিজ শেখের কথাটা শেষ করতে দিল না নক্ষত্র। মাঝখান থেকে সে নিজেই বললো, ‘এই জন্যই আমাকে এতিমখানা থেকে তুলে…না, স্যরি..কিনে এনেছিলেন। নয় তো নিজের আরশকে সবার সামনে স্বীকৃতি দিয়ে আপন করে নিতে অন্য কারও ধার ধারতেন না আপনি।’ বেশ চেঁচিয়েই কথাগুলো বললো নক্ষত্র।
‘মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ, আদৃত। ‘খানিক ধমকের স্বরেই বললেন নাফিজ শেখ। নক্ষত্রের এমন আচরণ তার মোটেও সহ্য হচ্ছে না।
‘এই দেখুন মি. শেখ…আপনি আজও সত্যি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। সত্যির মুখোমুখি হতে কষ্ট হয় আপনার তাই না? আমারও হয়। কিন্তু, কি বলুন তো! আমার মা বা আম্মু কখনোই আমাকে এই শিক্ষা পেতে দেয়নি যে আমি সত্যি জেনে বুঝেও মুখ ফিরিয়ে নিবো। আর ঠিক এই কারণেই আমার বাবার জায়গায়,আমার পরিচয়ের কোথাও না কোথাও আপনার নামটাকেও আমার জায়গা দিতে হয়। অস্বীকার করতে পারিনা। তাই আপনার প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই আপনার কোম্পানিতে কাজ করছি আমি। নয় তো এটুকুও করতাম না আমি। ‘- নক্ষত্রের প্রতিটা কথায় চাপা রাগ, অভিমান এবং কষ্টের ছাপ। উপরের সিড়িতে দাঁড়িয়ে তা স্পষ্ট বুঝতে পারলো ইরিন। কিন্তু কেন এতসব…সেটা বুঝে উঠতে পারলো না সে।
‘তার মানে তুমি কোম্পানির ওনারশিপ এক্সেপ্ট করবে না?’
‘না।’ -স্পষ্ট স্বরে জানিয়ে দিল নক্ষত্র।
‘ তোমার মায়ের মতই একরোখা হয়েছো দেখছি। সৌভাগ্যকে পায়ে ঠেলছো। তখন তোমার মা’ও একই কাজ করেছিল বলেই শেষে জ্বলেপুড়ে মরতে হয়েছে।’ -একপ্রকার চাপা ক্ষোভ আর অভিমানের বশে তাচ্ছিল্য করে বললেন নাফিজ শেখ। আর তার এই চাপা ক্ষোভ অভিমান মায়ের প্রতি অপমান হিসেবে নিল নক্ষত্র। রাগে ফেটে পড়ে চেঁচিয়ে উঠলো সে।
‘হ্যাঁ, হয়েছি আমি আমার মায়ের মত। আমার মা যেমনই ছিল খুব ভালো ছিল। অন্তত আপনার টাকার কাছে বশ না হয়ে নিজের জোরে বেঁচে ছিল। আমাকে জন্ম দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল ১১ টা বছর। আপনার কানা কড়ির প্রয়োজনও পড়েনি তখন তার। আর না আমার পড়েছে কোনদিন।
আপনি ভুলেও ভাববেন না আমি আপনার দয়ায় এ বাড়িতে ছিলাম বা আছি। আমি আজ যা কিছু সবটাও শুধু আমার মা,আম্মু আর নিজের জোরে। আমার জন্মদাতা হওয়া ছাড়া আর কোন ক্রেডিট আপনার নেই।’
-রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো নক্ষত্র। রাগ সামলানোর চেষ্টা করে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। তারপর একটু থেমে আবার বললো, ‘আর হ্যাঁ, আমার মাকে নিয়ে আর কখনো এমন কিছু বলার দুঃসাহস আপনি করবেন না প্লিজ।’
‘তুমি ভুলে যেও না আদৃত, তোমার মা সবার আগে আমার স্ত্রী ছিল।তাকে নিয়ে কি বলবো, কি করবো সেটা তোমার দেখার বিষয় নয়।’ কঠোর গলায় বললেন নাফিজ শেখ।
‘স্ত্রী?! লাইক সিরিয়াসলি মি. শেখ? ‘ তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে বললো নক্ষত্র। নাফিজ শেখের কিছু বলার অপেক্ষা না করেই আবার বললো, ‘স্ত্রী শুধু কাগজে কলমে সই করে বা মুখে কবুল বললেই হয় না। স্ত্রীকে প্রাপ্য মর্যাদা, অধিকার আর সম্মান দিয়ে তবেই স্ত্রী বলে দাবি করতে হয়। যেটার কোনটাই আপনি করতে পারেননি। তাই আমার মাকে স্ত্রী বলে অধিকার দেখাতে আসবেন না।’ -প্রচন্ড ক্ষোভ মিশ্রিত স্বরে বললো নক্ষত্র।
‘তুমি আমাদের সম্মিলিত ভালোবাসার ফল, আদৃত। এই সম্মানটুকু আশা করি তুমি তোমার মায়ের থেকে কেড়ে নেবে না।’
নিস্তেজ গলায় বললেন নাফিজ শেখ। তার এককালের অপরাগতা, নিরবতা আজ তারই শত্রু হয়ে তার সবথেকে প্রিয় আর ভালোবাসার ফল তার ছেলেকেই তার থেকে দূরে করে দিয়েছে। সে চাইলেও নক্ষত্রকে নিজের কাছে পায়নি কখনো। নক্ষত্ররই বা দোষ কোথায়।এর সবই তার নিজের কর্মফল।
কিন্তু, এই কথার পর নক্ষত্রও চুপ হয়ে গেল। তিক্ত হলেও সত্যি…তার জন্ম কোন দূর্ঘটনা নয়। দুটো মানুষের সম্মতি ও ভালোবাসায় তার জন্ম। কিন্তু, তারপরের ঘটনাগুলো…..সেগুলোকে নিছক দূর্ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। প্রয়োজনের সময় পিছিয়ে যাওয়ার মত প্রতারণা কোন দূর্ঘটনা হতে পারে না। এটা সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা।আর এর ফল যদি প্রাণহানি হয় তবে তার জন্য কি আদৌও ক্ষমা করা যায়? নাকি ক্ষমা করা উচিৎ?
নক্ষত্রকে চুপ থাকতে দেখে কিছুটা শান্ত হলেন নাফিজ শেখ। হতাশায়, বিষন্নতায় জর্জরিত হয়েও আরও একবার নক্ষত্রকে রাজি করানোর চেষ্টা করলেন তিনি। হাল ছেড়ে দিয়ে আপোষের স্বরে বললেন,
‘আমি মরে গেলে আমার সব কিছু এমনিতেই তোমার হবে নক্ষত্র। তুমি সেটা গ্রহণ না করলে তোমার আম্মু বা তোমার বোনেরা কেউই তা ঠিকভাবে সামলাতে পারবে না। তুমি আমাকে ভালোবাসো না জানি, কিন্তু তাদের তো বাসো। তাদের জন্য হলেও সময় থাকতে সব বুঝে নাও। বিজনেসটাকে এগিয়ে না নিয়ে গেলেও ধরে তো রাখতেই পারবে তুমি। নইলে আমার অবর্তমানে সব লোপাট করার মানুষের অভাব হবে না।এটা আমিও জানি আর তুমিও জানো। তাই বলছিলাম যে সাইনটা করে দাও। অফিসিয়ালি সব তোমায় বুঝিয়ে দেই আমি।তারপর তুমি সেটা ধরে রাখো বা তোমার বোনেদের দিয়ে দাও,সিদ্ধান্ত তোমার। ‘
কথা শেষ করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই পথে শায়লাকে দেখতে পেলেন তিনি। ।চোখাচোখি হতেই বুঝলেন এতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে সব দেখেছেন তিনি। নিরবে কেঁদে যাচ্ছিলেন। এখনো সিক্ত আখিপল্লব তার জানান দিচ্ছে।
এ কান্নার কারণটাও নাফিজ শেখ জানেন..বুঝেন। কিন্তু, কিছু অতীত…কিছু সত্য চাইলেও পাল্টানো যায় না। তিনিও অপরাগ। আর দাঁড়ালেন না তিনি।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শায়লাকে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
৫১.
এতক্ষণ যাবৎ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নিরবে সব দেখে যাচ্ছিল ইরিন। মনে হাজারো প্রশ্ন ভীড় জমিয়েছে ইতোমধ্যে। নক্ষত্রের যে রাগী রূপ সে আজ দেখেছে বিগত ছয় মাসে তার থেকে একদম অপরিচিত ছিল ইরিন। নক্ষত্র এমনিতেই স্বল্পভাষী..শান্ত স্বভাবের। কিন্তু আজকের এই নক্ষত্রটা অন্য কেউই ছিল যাকে ইরিন ভুলেও কল্পনা করেনি কখনো। নক্ষত্রের দিক থেকে সম্পর্ক সহজ হলেও ইরিনের রয়েছে নক্ষত্রের প্রতি অনেকখানি আড়ষ্টতা। তাই নক্ষত্রকে সাহস করে কিছু জিজ্ঞেস করার চিন্তাটা মাথায় আসতেই বাতিলের খাতায় ফেললো ইরিন।
কিন্তু তার তো অনেক প্রশ্ন করার আছে। জানার আছে অনেক কিছু। বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই ইরিন লক্ষ্য করেছে, বাবা ছেলের সম্পর্কটা কেমন অদ্ভুত এদের। বাড়িতে থাকাকালীন এরা কেউ একে অন্যের সাথে কথা বলে না খুব একটা। যদি কখনো কিছু বলতে শুনেছে সেটাও অফিসের কাজ রিলেটেড। নাফিজ শেখ যা জিজ্ঞেস করে, নক্ষত্র রোবটের মত ফর্মালি উত্তর দেয়। যেন মালিক আর কর্মীর কথোপকথন চলছে। তবে এই নিয়ে কখনো কাউকে প্রশ্ন করা হয়নি ইরিনের।
কারণটা হলো নক্ষত্রের সাথে জড়িত কোন বিষয়েই ইরিন আগ্রহ দেখায় না। তাকে নিয়ে কোন কৌতুহলও তৈরী হয় না ইরিনের মনে। কিন্তু, ইরিন জানে তার বাবার শূন্য জায়গাটা স্নেহ দিয়ে অনেকাংশেই পূর্ণ করে দিয়েছেন নাফিজ শেখ। এই মানুষটাকে নিজের বাবার মতই শ্রদ্ধা, সম্মান করে ইরিন। তারই সাথে নক্ষত্রের আজকের কথোপকথন অনেকগুলো ধারণার উপর প্রশ্ন তুলেছে।
সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই ইরিন দেখেছে নক্ষত্র রাগ করে তখনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। এবার নিচের দিকে তাকাতেই শায়লার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলে তার। অপ্রস্তুত ভংগিতে চোখ মুছতে দেখলো তাকে। তারপর, অপ্রস্তত হয়েই মুচকি হেসে চলে গেলেন তিনি ওখান থেকে। ইরিনও কথা বাড়ালো না। কিছুটা সময় দেওয়া দরকার তাকে। পরে সুযোগ বুঝে সব জেনে নেওয়া যাবে।তাই নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো ইরিন।
৫২.
দুপুর বেলা কারও কিছুই খাওয়া হলো না। ইরিন একবার এসে ডেকে গিয়েছিল। শায়লা বা নাফিজ শেখ কেউ খাবেন না বললায় ইরিনেরও কিছু মুখে তুলতে ইচ্ছে করেনি।ঘরে এসে দুপুরে ঘটা ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙে সন্ধ্যা নাগাদ। ঘুম ভাংতেই ইরিন টের পেল পেটের ভেরত গুড়গুড় করে খিদে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। নক্ষত্রের কথা খেয়াল হতেই ঘরের চারপাশে নজর বুলিয়ে খুঁজলো তাকে। না পেয়ে বুঝলো সে ঘরে নেই। তবে কি সে বাড়ি ফিরেনি এখনো? এটা মনে হতেই তাড়াহুড়ো করে বিছনা থেকে নামলো ইরিন। ফ্রেশ হয়ে নীচে যেতে হবে। নক্ষত্রের খোঁজ নিতে হবে। এদিকে পেটের ক্ষুধাটাও এবার তীব্রভাবে খোঁচাখুঁচি শুরু করেছে। একে থামানো দরকার।
নীচে নেমে প্রথমে কিচেনে গেল ইরিন। সেখানে গিয়ে দেখলো শায়লা কিছু একটা রান্না করছেন। গন্ধে ভাজাভুজির আভাস পেল ইরিন। পাশেই চুলায় চায়ের পানি বসানো হয়েছে। ইরিন কাছে গিয়ে দেখলো ফ্রোজেন করে রাখা চিকেন রোল ভাজছেন। তা দেখে ইরিন গিয়ে বললো, ‘আমাকে দিন মা। আমি ভেজে দিচ্ছি। ‘ বাঁধ সাধলেন শায়লা। বললেন,
‘তোমার এটা করা লাগবেনা, মা। তুমি বরং চায়ে পাতাটা দাও। আজকে বউ শাশুড়ি চা খেতে খেতে গল্প করবো। ‘
‘আপনারা ছোট খালার বাসায় যাবেন না? আজ তো এশার জন্মদিনের দাওয়াত আপনাদের। ‘
‘না। ওদের ফোন করে মানা করে দিয়েছি। তোমার শশুড় যেতে চাইছেন না। আমি একলা মানুষ গিয়ে আর কি করবো। বাচ্চাদের পার্টি। বাড়ির মেয়েরা তো গেছেই। ওরা আনন্দ করুক না। আজ বরং আমি আর তুমি মিলে একটু গল্প গুজব করি।’ – আলতো হেসে বললেন শায়লা।
ইরিন আর কথা বাড়ালো না। উপরের সেল্ফ থেকে চা পাতার বোয়ম বের করে তা থেকে কয়েক চামচ পাতা ফুটন্ত পানিতে ছেড়ে দিল। মনে মনে ভেবে নিল, এই সুযোগে দুপুরের ঘটনাটাও যদি জিজ্ঞেস করে নেওয়া যায়!
৫৩.
‘তোমাদের বিয়ের তো ছয় মাস হলো, ইরিন। কেমন চলছে সব?’ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন শায়লা।
ইরিন চিকেন রোল খাচ্ছিল। শায়লার কথা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে ছোটখাটো বিষম খেলো। শায়লা দ্রুত পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। মুখের খাবারটুকু শেষ করে ইরিন পানি খেল বেশ অনেকটা। তারপর কিছুটা অপ্রস্তুত ভংগিতে হেসে জবাব দিল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। সব ঠিক আছে, মা। ‘
‘নক্ষত্রকে তুমি কতটুকু জানো?’ বেশ সাবলিলভাবেই প্রশ্ন করলেন শায়লা।
‘মা..আপনি তো দেখেছেনই বিয়ের পর থেকেই উনি কতটা ব্যস্ত ছিলেন। তাই সেভাবে খুব একটা সময় সুযোগ হয়নি উনাকে জানার। ‘ প্রবোধ দেওয়ার স্বরে বললো ইরিন।
‘বিয়ের আগে তোমাকে কিছু কথা জানানোর ছিল। নক্ষত্রের তরফ থেকে। কিন্তু আমি জানাইনি তোমাকে।’ চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে বললেন শায়লা।
‘মানে? ‘ অবাক হয়ে জানতে চাইলো ইরিন।
‘কথাগুলো নক্ষত্র সম্পর্কে। ওর জীবন সম্পর্কে। নক্ষত্র জানে আমি তোমাকে সব বলেছি। কিন্তু, তুমিও জানতে না তোমার এসব জানার ছিল, বিয়ের আগেই। ‘
শায়লার কথায় ইরিন বেশ সতর্ক ভংগিতে নড়েচড়ে বসলো। জিজ্ঞাসু মনের প্রলয়কে যথাসম্ভব দমিয়ে দৃঢ় কন্ঠেই জিজ্ঞেস করলো,
‘তাহলে আমাকে জানানো হয়নি কেন?’
‘তুমি জানো কিনা জানি না, তোমার ভাবী ঘটককে দিয়ে সম্বন্ধটা নাকচ করেছিল। কারণ হিসেবে বলেছিল তুমি নাকি এই বিয়ের জন্য মানা করে দিয়েছো শুধুমাত্র নক্ষত্র দেখতে কালো বলে। উপরন্ত, তোমার বদলে নাবিলার সম্বন্ধ পাঠিয়েছিল। ব্যাপারটা নক্ষত্রও জানে। তাই ও নিজেও বিয়েটার জন্য মানা করে দিয়েছিল। কিন্তু, আমি জানতাম এত বছর পর বিয়ের জন্য রাজি হওয়া আমার ছেলেটা তোমাকে পছন্দ করেছিল বলেই বিয়েতে হ্যাঁ বলেছিল।
আর এবার যদি বিয়েটা না হয়, তাহলে ও হয় তো আর কখনো বিয়ের ব্যাপারে কোন কথাই বলতে দিবে না আমাকে। তাই আমিও আর রিক্স নিতে চাইনি। ওই ঘটনাটা না ঘটলে আমি আগেই তোমায় সব বলে দিতাম। তখন অল্প হলেও সম্ভাবনা থাকতো, তুমি নক্ষত্রকে বিয়ে করবে বলে। কারণ আমার ছেলের সেই যোগ্যতা আছে। কিন্তু, নক্ষত্র সম্পর্কে জানার পর যদি তুমি আবারও মানা করে দাও…তাই আর বলিনি সেসব কথা। ‘
‘তারমানে আপনারা আমার সাথে প্রতারণা করেছেন। সত্যি লুকিয়ে বিয়েটা করিয়েছেন। এটা কি করে করতে পারলেন মা আপনি? মেয়ে তো আপনারও আছে। তার সাথে এমন হলে কেমন হতো এটা একবারও ভাবেননি আপনি?’
-আহত স্বরে তবে অনেকটা চেঁচিয়েই বললো ইরিন।শায়লা কোন ভাবান্তর দেখালেন না। তিনি জানেন ইরিনের এমন প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। তাই নিজের ভাবমূর্তি বজায় রেখে শান্ত স্বরে বললেন, ‘ নক্ষত্রের যা যোগ্যতা তাতে যে কোন মেয়ে ওকে নির্দ্বিধায় বিয়ে করে নিত। বড় ঘরের যে কোন সুন্দরী মেয়ে। কিন্তু, তাদের ছেড়ে আমি এবং বিশেষ করে নক্ষত্র তোমাকে পছন্দ করেছি। এত এত মেয়ে রেখে, তুমি মানা করে দেওয়ার পরেও আমি তোমার সাথেই নক্ষত্রের বিয়ে দিয়েছি,কেন জানো?’
‘কেন?’ কৌতুহলী স্বরে প্রশ্ন করলো ইরিন।
‘কারণ আমার মনে হয়েছিল তুমি নক্ষত্রকে বুঝবে। নক্ষত্রের যে শূন্যতা তার একাংশ তোমারও আছে। দুঃখ দুঃখকে খুব ছোঁয়। এটা তার সহজাত স্বভাব। তোমাদের ক্ষেত্রেও আমি এক রকম দুটো দুঃখকে একটা সুখের ছত্রছায়ার বাঁধতে চেয়েছিলাম। দু মুঠো শূন্যতাকে এক করে একটা ভরাট সম্পর্ক তৈরী করতে চেয়েছিলাম। তাই এত সব কিছুর পরেও আমার কথায় নক্ষত্র বিয়েটা করেছে।
নক্ষত্র সত্যিকার অর্থেই নক্ষত্র, ইরিন। রেণু আপা যথার্থই রেখেছিলেন ওর নামটা। তবে নক্ষত্র যেমন অন্ধকার ছাড়া দেখা যায় না। অন্ধকার ছাড়া যেমন নক্ষত্রের মর্ম আমরা বুঝি না, ঠিক তেমনি নক্ষত্রের জীবনটাও অন্ধকার ঘিরে ছিল অনেকখানি। আজও সেই অন্ধকার সে নিজের মাঝে পুষে রেখেছে। তবে, আমি মনে করি ওই অন্ধকারটুকু নক্ষত্রের জীবনে এসেছিল বলেই, সে আজকের এই নক্ষত্র। ‘
‘মা আপনি কি বলছেন বা বলতে চাইছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা। খুলে বলুন প্লিজ। ‘ বিভ্রান্ত স্বরে বললো ইরিন।
‘আজকের ঘটনা তো দেখেছই। বুঝেছো হয় তো জন্মসূত্রে আমি নক্ষত্রের মা নই। নক্ষত্রকে আমি জন্ম দেইনি। নক্ষত্রের মা তোমার শশুড় মানে নাফিজের প্রথম স্ত্রী রেণুর গর্ভজাত সন্তান। ‘
শায়লার কথা শুনে খুব একটা অবাক হলো না ইরিন। প্রথম প্রথম নক্ষত্রের কথায় মা এবং আম্মুর মাঝে তফাৎটা না বুঝলেও আজ দুপুরের ঘটনার পর অনেকটাই আন্দাজ করে নিয়েছিল সে ব্যাপারটা। এখন শায়লার কথা শুনে ইরিন পরিষ্কারভাবে বুঝে গেছে তার ধারণাই ঠিক। নক্ষত্রের মা অন্য কেউ। কিন্তু নক্ষত্রের অতীত কি? কেন নিজের বাবার সাথেই তার এমন সম্পর্ক? মনে প্রশ্ন উঠতেই শায়লাকে জিজ্ঞেস করলো সে।
‘তাহলে উনি বাবার সাথে এমন আচরণ করেন কেন, মা?’ আর উনার মায়ের কি হয়েছিল? তাছাড়া, উনি কেন বললেন তখন যে উনাকে এতিমখানা থেকে কিনে আনা হয়েছে? ‘ অতি কৌতুহলে হড়বড়িয়ে একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করলো ইরিন।তবে শায়লা জবাব দিলেন শান্তভাবেই।
‘রেনু আপা মারা গেছেন নক্ষত্রের যখন ১১ বছর বয়স। এরপর ওর জায়গা হয় এতিমখানায়। ১ বছর সেখানেই ছিল ও। তারপর, টাকার বিনিময়ে ওকে ওখান থেকে নিয়ে আসা হয়। তাই জন্যই এমন বলেছে ও। ‘
‘মানে? ‘
‘বলছি। আজ তোমাকে সব বলবো বলেই এত আয়োজন। ‘
ইরিন আবারও নড়েচড়ে বসলো। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল একটা বড় ধরণের সত্যের সম্মুখিন হওয়ার। শায়লাও নিজেকে কিঞ্চিৎ প্রস্তুত করে নিলেন নক্ষত্রের অন্ধকার অতীতের পর্দা উন্মোচন করবেন বলে।
‘
৫৪.
‘ নক্ষত্রের মা, মানে রেণু আপা ছিল গ্রামের চেয়ারম্যানের মেয়ে। একবার গ্রামে একটা প্রোজেক্টের সাইট ভিজিট করতে গিয়ে রেনু আপাদের বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা হয় নাফিজের।এরপর কাজের সূত্রে বেশ কয়েবার যাওয়া হয় ওর ওখানে। রেণু আপাদের বাড়িতেই থাকা হতো প্রতিবার। সেখানেই রেণু আপার সাথে তার পরিচয়। শুনেছি রেণু আপা তখন মাধ্যমিক পাস করে রেজাল্টের অপেক্ষায়।
একটা গ্রাম্য স্বচ্ছল জীবনের জন্য যতটুকু দরকার রেণু আপার কাছে সব ছিল। অর্থ সম্পদ, বংশ মর্যাদা, সম্মান, শিক্ষা সব। শুধু তার একটাই খামতি ছিল। সে রূপবতী ছিল না। গায়ের রঙ ছিল কালো।যার কারণে তার মায়া মায়া মুখখানিও সবাই অগ্রাহ্য করে যেত। কিন্তু নাফিজের চোখে, ওর মনে ওই মায়া মায়া মুখখানিই গেঁথে যায় নিবিড়ভাবে।
যেখানে গ্রামের বাকি সবার চোখে তার বাহ্যিক রুপটাই প্রধান ছিল, সেখানেই তার গুণ আর মায়াভরা মুখখানি কালো রঙের রূপটাকে কিভাবে যেন নাফিজের দৃষ্টিতে ছাপিয়ে গেল।
ঘন ঘন দেখা হওয়া, কথা হওয়া, আবার মাঝে বেশ কিছুদিন একই বাড়িতে থাকার ফলে তাদের মধ্যে ভালো লাগার সৃষ্টি হয়। প্রেম হয়। এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে রেণু আপাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় নাফিজ। রেণু আপার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখেন। তিনি নাফিজকে পছন্দ করতেন। শহরের বড় পরিবারের ছেলে ছিল নাফিজ। শিক্ষিত। এত বড় আর্কিটেক্ট। তাকে অপছন্দ করে তার কালো মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কোথায় তার! তিনি নাফিজকে স্বপরিবারে প্রস্তাব নিয়ে আসতে বললেন।
নাফিজ জানালো তার বাবা বেঁচে নেই। মায়ের পক্ষে এত দূরে গ্রামে আসা সম্ভব না। তাই রেণুকে একেবারে বিয়ে করে সাথে নিয়ে ফিরতে চায়। একমাত্র ছেলে সে তার মায়ের। মা কখনোই অমত করবেন না বলেও আশ্বাস্ত করলো নাফিজ তাকে। গ্রামের মুরুব্বিরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার।
‘তারপর?’
‘বিয়ে হলো। বিয়ের তিনদিন পর নাফিজ রেণু আপাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসে । কিন্তু, তাকে সরাসরি এই বাড়িতে তুলেনি। বনানীতে নাফিজের একটা ফ্ল্যাট আছে। রেনু আপাকে সেখানেই রেখে আসে সে। এই বলে যে, বাড়িতে জানিয়ে একেবারে অনুষ্ঠান করে বউ ঘরে তুলবে সে। রেনু আপা নাফিজকে এতটাই বিশ্বাস করতো যে নির্দ্বিধায় তার কথা মেনে নিয়েছিল। – এটুকু বলে থামলেন শায়লা। টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা হাতে তুলে নিলেন।
‘বাবা বাড়িতে জানাননি বিয়ের কথা?’ প্রবল উত্তেজনা নিয়ে প্রশ্ন করলো ইরিন।
‘জানিয়েছিল। মা প্রথমে নারাজ হয়েছিলেন ছেলের এমন কাজে। তিনি পুরোনো ধ্যানধারার মানুষ ছিলেন। বাপের বাড়িও ছিল শহরের অভিজাত একটি পরিবার। একমাত্র ছেলে এভাবে না জানিয়ে, হুট করে কাকে না কাকে বিয়ে করে এনেছে। অথচ, তার কত শখ ছিল দেখেশুনে পছন্দ করে একমাত্র ছেলের বউ ঘরে আনার! স্বাভাবিকও সেটা। সব মিলিয়ে ছেলের এমন কাজে তিনি মনে মনে খুব কষ্ট পেলেন। কিন্তু, একমাত্র ছেলের পছন্দও মেনে নিলেন। রেণু আপাকে বাড়িতে আনার আয়োজন করা হলো। ‘
‘উনি এসেছিলেন?’ কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলো ইরিন।
‘হ্যাঁ। নাফিজ কথা রেখেছিল। একদম জাঁকজমকভাবে আয়োজন করে রেণু আপাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু এ বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতর বাড়ি পর্যন্ত তার আর আসা হয়নি।
বউ বরণ করতে গিয়ে শাশুড়ি মা দেখলেন তার রাজপুত্রের মত ছেলের পাশে কালো একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। যে কিনা তার ছেলের স্ত্রী। এই বংশের বউ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাব্য জন্মদাত্রী। শেখ বংশের একমাত্র বউ দেখতে এমন কালো চামড়ার হবে এটা সে কিছুতেই মানতে পারলেন না। তিনি গ্রহণ করলেন না আপাকে। ভরা বাড়িতে সবার সামনেই ফিরিয়ে দিলেন তাকে। নাফিজ কোনভাবেই মাকে রাজি করাতে পারলো না। আবার মাকে অগ্রাহ্য করে আপাকে বাড়িতেও রাখতে পারলো না। শেষমেশ তাকে রেখে এলো ধানমন্ডির ওই ফ্ল্যাটেই।
‘তাদের কি ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল?’
‘না। মা জেদি হলে ছেলেও ছিল সমান জেদি। তিনি আপাকে ছাড়লেন না। বিধবা মা আর বাবার এতদিনের কষ্টে গড়া ব্যবসা একলা ছেড়ে সে গেল না। মায়ের সাথে এ বাড়িতেই থাকলো। কিন্তু, স্ত্রী হিসেবে আপার সাথেই সংসার করে গেল ও বাড়িতে। শশুড়বাড়িতে ঠাই হয়নি এই নিয়ে কষ্ট পেলেও স্বামী নামক মানুষটার ভালোবাসা, সম্পর্কের প্রতি তার নিষ্ঠাকে ভরসা করে আপাও কেবল স্বামী সংসার করতে থাকলো। ‘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো শায়লা।
‘তাহলে আপনার সাথে বাবার বিয়ে হলো কি করে?’
‘এক পক্ষে জোর খাটিয়ে আর অন্যপক্ষে সত্যি লুকিয়ে।’ আলতো হেসে বললেন শায়লা। ইরিন খেয়াল করলো তার মুখে কষ্টের মৃদু আভা ফুঁটে উঠেছে। এর মানে প্রতারণার শিকার শায়লা নিজেও। কিন্তু, কিভাবে?
চলবে…