নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_১৬
লেখায়_জারিন
৮৫.
সময়টা মধ্যরাত্রি। ছাদের মেঝেতে সটান হয়ে শুয়ে আছে ইরিন। শাড়ির আঁচলটা কাঁধ ডিঙিয়ে ইরিনের মতই নিস্তেজ।হয়ে পড়ে আছে মেঝের উপরে। কোমড় সমান খোলা ঘন চুলগুলো বা’পাশের কাঁধ বেঁয়ে নেমে এসে মেঝে ছুঁয়েছে। ডান হাতটা মাথার নীচে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে সে। কি ভীষণ রকম বিষন্ন চাহনী তার!
ক্ষণে ক্ষণে ঝিরিঝিরি হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে। আজ জোছনা নেই। কিন্তু, বিশাল আকাশ জুড়ে ধুম্রজালের মত ছেয়ে আছে লক্ষ কোটি নক্ষত্র। মিটিমিটি করে জ্বলছে ধবধবে শুভ্র আলোয়। ভীষণ আদুরে লাগছে তাদের দূর থেকে।
ইরিন আপন মনেই আঙুল উঁচিয়ে একটা একটা করে গুণার বিফল চেষ্টা করছে। কয়েকটা গুণতে না গুণতেই আবার হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ এই বিফল চেষ্টার পর একসময় বিরক্ত হয়ে আঙুল নামিয়ে নিল ইরিন। ঠিক তখনই ইরিনের চোখে পড়লো টুক করে খসে পড়া এক টুকরো নক্ষত্র। মিনিট খানিক ওই খসে পড়া নক্ষত্রের হারিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ইরিন। আপনা আপনি চোখ ভিজে এলো তার। চোখের পাতা কার্নিশ ছুঁতেই টুপটাপ করে ঝরে পড়লো পুঞ্জিভূত মেঘের পরে উচ্ছলিত সিক্ত ধারা। বাঁ’হাতটা তুলে আলগোছে পেটের উপর রাখলো সে। সাথে সাথেই দু চোখের কোল বেয়ে নেমে এলো শান্ত বারি ধারার মতই অবিরত অশ্রুকণা। বন্ধ চোখেই ভেসে উঠলো কিছু খন্ড খন্ড অতীত।
৮৬.
নক্ষত্রের বুকে লেপ্টে শুয়ে আছে ইরিন। আজকাল ইরিনকে জাপটে ধরে ঘুমানোর অভ্যাসটা ছাড়তে হয়েছে নক্ষত্রকে। কিন্তু, ইরিনের থেকে দূরে সে কিছুতেই ঘুমাবেনা। তাই যথা সম্ভব ইরিনকে নিজের কাছাকাছি রেখে ঘুমায়।
নক্ষত্র বিড়বিড় করে সূরা পড়ছে আর একটু পর পর ইরিনের শরীরে ফুঁ দিচ্ছে। ইরিন গর্ভধারণ করেছে এ খবর জানার পর থেকেই এটা নক্ষত্রের নিয়মত কার্যকলাপে পরিণত হয়েছে।
এভাবে তিন চারবার ফুঁ দেওয়ার ইরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নক্ষত্র বললো, ‘ঘুমাও এবার। ‘
‘আপনি রোজ রোজ এসব করেন কেন বলুন তো?আমাকে কি জ্বিন ভূতে তুলে নিয়ে যাবে নাকি!’ কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললো ইরিন।
‘নিতেই পারে! আর তোমাকে নিলে তো টেক ওয়ান গেট ওয়ান হিসেবে ওদের এখন ডাবল লাভ। ‘ দুষ্টু হেসে বললো নক্ষত্র।’
‘ফাজলামো করছেন?’
‘হু। ‘ নির্বিকারভাবে জবাব দেয় নক্ষত্র।ইরিন ঈষৎ রাগে ঠোঁট ফোলায়। নক্ষত্র ইরিনের অভিমানী চোখে রাখে।
‘আমি এগুলো করি যাতে আমার পরী আর রাজকন্যা…দুজনেই সব রকম কুফরি কালাম আর বদনজর থেকে সুরক্ষিত থাকে সারারাত। ‘ মিষ্টি হেসে বলে নক্ষত্র। ইরিন মুগ্ধ হয়ে দেখে সেই হাসি মুখটা। ঈষৎ রাগ অভিমান মিইয়ে যায় তাতে। তারপর, কি যেন একটা ভেবে নক্ষত্রের মুখপানে চেয়ে বলে, ‘আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি আপনাকে? রাগ করবেন না প্লিজ!’
‘প্রশ্নটা কি রাগ করার মত,পরী? ‘ হেসে পাল্টা প্রশ্ন করে নক্ষত্র।
‘জানি না। তবে আমার মনে হলো আপনি রাগ করতে পারেন তাই আর কি..’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার শুনি কি প্রশ্ন আপনার?’
নক্ষত্রের বুকে শুয়ে থেকেই এবার একটু নড়েচড়ে উঠলো, ইরিন। একপলক নক্ষত্রকে দেখে আরেকটু মিশে গেল নক্ষত্রের সাথে। কিছুটা চোরা গলায় প্রশ্ন করলো তাকে।
‘আচ্ছা….আমি যদি কখনো আপনাকে ছেড়ে যাই, কেমন হবে সেটা?’
‘ছেড়ে যাবে মানে? কোথায় যাবে?’ বিভ্রান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে নক্ষত্র।
একটা ফাঁকা ঢোক গিলে ইরিন। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলে, ‘এই যে ধরুন আমি বাবুকে জন্ম দিবো তখন যদি আমার কিছু হয়ে যায়? না…মানে…হয় না এমন যে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মা মারা যায়। আবার অনেক সময় বাচ্চা আর মা দুজনেই মরে যায়। এমন হলে কি করবেন আপনি?’
কথাটা বলে নক্ষত্র বুকে শুয়েই কিঞ্চিৎ মাথা তুলে চায় ইরিন। আড়চোখে নক্ষত্রকে দেখার চেষ্টা করে। নক্ষত্র ভাবলেশ হয়ে শুয়ে থাকে আগের মতই। আঙুল চালায় ইরিনের চুলের ভাঁজে ভাঁজে। নক্ষত্রকে এমন চুপ থাকতে দেখে ইরিন আবার প্রশ্ন করে, ‘বলুন না…কি করবেন আপনি? আমি না থাকলে আরেকটা বিয়ে করবেন তখন?’
‘তুমি মা হিসেবে ভীষণ খারাপ হবে ইরিন। কিন্তু, আমি নাফিজ শেখ হবো না কখনো। বাকিটা আমার আল্লাহর হাতে। উনি যা চাইবেন সেটাই হবে। তাতে যদি আমার সকল দো’য়া নাকচ হয় তবে তাই! ঘুমিয়ে পড়ো। ‘
কথা শেষ করে ইরিনকে বুকে নিয়েই চোখ বন্ধ করে নক্ষত্র। ইরিন চুপটি করে পড়ে থাকে নক্ষত্রের শান্ত শীতল প্রশস্থ বুকে। কিন্তু তার বুকে দামাডোল বাজে। নক্ষত্র ফের নারাজ হয়েছে। কষ্ট পেয়েছে তার কথায়। সে যে রেগে গেছে তা ইরিন নিজের নাম শুনেই বুঝে গেছে। একান্ত সময়গুলোতে নক্ষত্র কখনোই ওকে পরী বিনা অন্য কোন নামে ডাকে না। কেবল অন্যদের সামনে কিংবা তার উপর রাগ বা বিরক্ত হলেই কেবল নাম ধরে সম্বোধন করে।
কিন্তু, নক্ষত্রের নারাজির থেকেও বেশি কষ্ট লাগছে তার নক্ষত্রের বলা কথাটায়। সে কেন খারাপ মা হবে? এমন কথা কেউ কোন মাকে বলে? এটুকু মনে হতেই অভিমান জমলো ইরিনের মনে। পলক ঝাপটাতেই তা হাজির হলো ইরিনের ছলছলে চোখে। এবং মূহুর্তেই তা উপচে পড়ে ভিজিয়ে দিল নক্ষত্রের পড়নের পাতলা টি-শার্টটার বুকের অংশটুকু।
নক্ষত্র এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। বরং ইরিনের মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললো, ‘যে মা জন্মের আগেই সন্তানের মৃত্যুর কথা ভাবে সে কখনোই ভালো মা হয় না, ইরিন। তুমি ছেড়ে গেলে মেনে নিবো। কারণ জোর করে শরীর ধরে রাখা যায়, মন নয়। আর মন ছাড়া মানুষ একটা মাংস পিন্ড কেবল। যেটা আমার কাছে অযাচিত বস্তু ছাড়া অন্য কিছুই না। তবে হ্যাঁ, যদি হারিয়ে যাও….মন থেকে মরে যাবে একটা নক্ষত্র। ‘
ইরিন কিছু বলে না। নক্ষত্রের কথাগুলো তার অভিমান আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতেই নক্ষত্রের বুকের অংশের টি-শার্ট খাঁমচে ধরলো ইরিন। সেটা আঁকড়ে ধরেই মাথা উঁচু করে নক্ষত্রের মুখোমুখি হলো সে। রাগে অভিমানে নক্ষত্রের ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে একসময় জোরেসোরে কামড় বসিয়ে দিল ইরিন।
নক্ষত্র ব্যাথা পেলেও টু শব্দটি করলো না। নক্ষত্রের এমন ভাবলেশ প্রতিক্রিয়া দেখে এবার সত্যি সত্যি সশব্দে কেঁদে উঠলো ইরিন। রাগে দুঃখে নক্ষত্রের থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য বালিশে মাথা রেখলো।
নাঁকি সুরে কেঁদে বললো, ‘আমার ভালো মা হতে হবে না। আপনি একাই ভালো বাবা হোন।আমি তো থাকবো না, দেখি তখন কি করে সামলান সব। খারাপ লোক একটা। খালি আজেবাজে কথা বলে। যখন ছেড়ে যাবো তখন বুঝবে মজা। ‘
‘প্রেগন্যান্সিতে মুড সুয়িং হয় জানি। কিন্তু, তাতে যে বউ এমন রোমান্টিক মুডে সুইং করে সেটা জানা ছিল না। আর আগে তো আমি একটু কাছে টানলেই লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে, নওরিন এসে কি তোমার সব লাজ লজ্জা খেয়ে নিল নাকি পরী? ‘
কথাগুলো বলতে বলতেই ইরিনকে টেনে নিজের বুকে এনে ফেললো নক্ষত্র। তারপর, নিজের বুড়ো আঙুল দিয়ে আলতো করে মুছে দিল ইরিনের ঠোঁটে লেগে থাকা রক্ত বিন্দুটুকু।
ইরিনের রাগ বাড়লো আরও। ফুঁসে উঠে আবারও বললো, খাবেই তো। আমার রক্ত মাংস সব খেয়ে শেষ করে তারপর এই দুনিয়ায় অবতির্ন হবেন আপনার রাজকন্যা।তখন থাকবেন বাপ বেটিতে সুখে। আমি তো ভালা না। তুমি ভালা লইয়াই থাইকো। ‘
নক্ষত্র এবারে থতমত খেয়ে গেল ইরিনের আচরণ আর কথাবার্তায় । ইরিন তখনো কেঁদেই চলেছে। নক্ষত্র আর কথা বাড়ালো না। ইদানীং ইরিনের ঘন ঘন মুড সুইয়িং হয়। অল্পতেই রাগে অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলে ইরিন।
গর্ভধারণ করেছে এটা জানার আগে মাঝেমধ্যে নক্ষত্র একটু আধটু বিরক্ত হয়ে যেত, ইরিনের হঠাৎ হঠাৎ অকারণে এমন অদ্ভুত আচরণে। তারপর যখন জানলো ইরিন একা নেই, তাতে নতুন প্রাণের আগমন ঘটেছে….তখন থেকেই নক্ষত্র বেশ সচেতন হয়ে গেছে এসব ব্যাপারে। ডাক্তার তো বলেইছে যে এসময় হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে মুড সুইং হওয়াটা স্বাভাবিক। তাছাড়া, কিভাবে কি করতে হবে…ইরিনের যত্ন নিতে হবে এসবও বলে দিয়েছে ডাক্তার।।
তারপরেও সময় পেলেই নক্ষত্র ল্যাপটপ নিয়ে বসে যায়। গুগলে সার্চ করে। গর্ভাবস্থায় কিভাবে কি হয়, কিভাবে সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করতে হয় এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করে।এছাড়াও শায়লা তো আছেনই সবসময়।
এদিকে সবে পাঁচ মাস চলছে মাত্র। তাতেই যা অবস্থা..বাকি ৪/৫ মাস যে কি হবে সেটা ভেবেই হাঁপিয়ে উঠে নক্ষত্র। কিন্তু, সে হাল ছাড়ে না। ধৈর্য্য ধরে ইরিনের টুকটাক বাজে ব্যবহার, আবদার, পাগলামো সহ্য করে নেয়।
যথা সম্ভব ইরিনকে সামলানোর চেষ্টা করে সে। যতযাই হোক মেয়েটা তার অংশকে নিজের মাঝে ধরণ করেছে। দিনের পর দিন তাকে বহন করে চলেছে সব শারিরীর মানসিক সমস্যা, কষ্ট সহ্য করে। বিনিময়ে এতটুকু আদর যত্ন, সহযোগিতা তো সে ডিজার্ভ করেই! আর নক্ষত্র সর্বোচ্চ চেষ্টা করে তাকে এই সবকিছু দেওয়ার।
৮৬.
ইরিনের কান্না এবার আর সহ্য হলো না নক্ষত্রের। আস্তে করে ইরিনের মাথাটা আরেকটু টেনে এনে নিজের বুকে চেপে ধরলো।ইরিন বাঁধা দিয়েও সফল হলো না। ইরিনের কপালে সযত্নে চুমু দিয়ে বললো, ‘আর কাঁদে না, পরী। চুপ করো এখন। ঘুমাও’।
‘হ্যাঁ, ঘুমাবোই তো। আমি ঘুমালেই তো আপনার শান্তি। একেবারে ঘুমিয়ে যাবো এবার, তখন শান্তিতে থাকবেন ভালো করে। ‘
‘এখন কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে ইরিন। চুপ করে ঘুমাও। ‘ কড়া গলায় হুশিয়ারি দিয়ে বললো নক্ষত্র। কিন্তু ইরিন দমলো না। ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো।
নক্ষত্র এবার হার মেনে নিল। ইরিনকে বুকের উপর থেকে সরিয়ে তাকে কাছে টেনে নিল গভীরভাবে। ইরিনের গলায় মুখ ডুবিয়ে বললো, ‘ এই পরীটা ছাড়া নক্ষত্রের কাছে ঘেঁষার সাধ্য অন্য কারও নেই। আর আগেও বলেছি ছেড়ে গেলে যাবে…..তবে আমি তোমায় সহজে ছাড়বো না। আমার কায়া….তার ছায়া থেকে যত দূরেই পালাও না কেন মায়া তোমাকে আমাকে ছাড়তে দিবে না কখনো। আর জানো তো…ভালোবাসা ভুলে যাওয়া যায়….মোহ কাটিয়ে উঠা যায়….কিন্তু মায়ার মৃত্যু নেই।’
‘এই কি করছেন…দূরে সরুন। ‘ নক্ষত্রকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বললো ইরিন। নক্ষত্রের আদর ভালোবাসা উপেক্ষা করা কঠিন তার জন্য, কিন্তু এখন তার অভিমান সেসবের কাছে বশ হতে নারাজ। তাই, দূরে সরে আসার চেষ্টা তার। তবে, তাতে লাভের লাভ তো কিছু হলোই না বরং নক্ষত্র তার উপর আরও বেশি চড়াও হলো। ইরিনের পায়ের উপর পা তুলে দিল। গলায় নাক ঘঁষে বললো, ‘ভালবাসি তো পরী।’
‘আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আর কোন মায়াও নেই আমার আপনার প্রতি। ‘ কপট রাগ দেখিয়ে বললো ইরিন।
‘তুমি নিজেও জানো না পরী…তুমি আমাকে কতখানি ভালোবাসো। ‘
‘জানি…জানি….আমি আপনাকে একটুও ভালোবাসি না।’ জেদি গলায় বললো ইরিন।
নক্ষত্র ইরিনের কথায় পাত্তা দিল না। ওর মনে এখন ইরিনের নেশা চড়েছে। তাকে গভীরভাবে কাছে পাওয়ার তীব্র বাসনা দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে মনের আনাচে কানাচে। কিন্তু অনাগত প্রাণটার কথা ভেবে সংযত করে নিল সে নিজেকে।
কেবল ইরিনের ঠোঁটে প্রগাঢ়ভাবে লেপ্টে দিল এক ছটাক ভালোবাসা। অতঃপর প্রেয়সীর চোখে চোখ রেখে নেশা জড়ানো কন্ঠে আউড়ালো…
‘ঠোঁটের শব্দ যতই করুক ভালো না বাসার দাবি,
স্পর্শ জানে, অনুভূতি সাক্ষী….তা মিথ্যে কতখানি!’
৮৭.
গভীর রাত। ইরিনকে বুকে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে নক্ষত্র। কিন্তু ইরিনের চোখে ঘুম নেই। কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া মূহুর্তগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে মন মস্তিষ্কে। আর মাত্র দুদিন পরেই সে নক্ষত্রকে ছেড়ে….তার চেনা পরিচিত সব কিছু ছেড়ে পাড়ি জমাবে পৃথিবীর অন্য একপ্রান্তে।
ওয়াসিফের সাথে নতুন করে সংসার সাজাবে সে। যেখানে থাকবে তার মনের স্বস্তি, ভালো লাগার মানুষটা। যে তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। ভালোবাসে?! মন প্রশ্ন করে। ভালো তো নক্ষত্রও বাসে। তাহলে সে কেন নয়? আচ্ছা, ইরিন কি তবে ওয়াসিফকে ভালোবাসে বলেই…মন কঠোরভাবে লাগাম কষে। এই চিন্তা ভুল। এই ধারণা মিথ্যা। ইরিন কেবলই বিভ্রান্ত হয়। অমোঘ দোলাচলে দোলে।
নক্ষত্র বলে ইরিন নাকি তাকে ভালোবাসে। তাহলে ইরিন কেন বোঝে না এই অনুভূতি? নাকি নক্ষত্র কেবলই ওর মোহ। মোহের কাছে নিজেকে এতটা গভীরভাবে উজাড় করে দিয়েছে বলেই কি নক্ষত্র সেটাকে ভালোবাসা বলে ভাবছে? নাকি সে সত্যিই ভালোবাসে নক্ষত্রকে? যার জন্য এতটা অবলীলায় নিজেকে সঁপে দেয় নক্ষত্রের কাছে। উপেক্ষা করতে পারেনা তার প্রতি নক্ষত্রের স্পর্শ, অনুভূতি, অধিকার!
তাহলে ওয়াসিফ কি? ওর পরিচয় কি অনুভূতির শহরে? কেন যাচ্ছে ইরিন ওর সাথে? কেন বিচ্ছিন্ন করছে এই অনাগতকে তার প্রকৃত পিতৃপরিচয়…স্নেহ থেকে?
ইরিনের মনে ঝড় বয়ে যায়। অস্থির হয়ে হাঁশফাস করতে থাকে সে। খাঁমচে ধরে নক্ষত্রের টি-শার্ট। মূহুর্তেই তার মনে হয়, আজ বাদে কাল স্বেচ্ছায় যে জায়গাটা ছেড়েছুড়ে চলে যাবে…সেই জায়গাটাই কেন আঁকড়ে ধরছে সে? এতটা বেহায়া কবে হলো সে?
এই কথা মনে হতেই ঝট করে উঠে বসে ইরিন। ঘুম ভেঙে যায় নক্ষত্রের। অস্থির গলায় প্রশ্ন করে, ‘কি হয়েছে পরী? কোন সমস্যা?’
ইরিন জবাব দেয় না। এক পলক নক্ষত্রকে দেখে বালিশ টেনে নেয়। আলগোছে শুয়ে পড়ে তাতে। যে বুক শূন্য করে কাল চলে যাবে তাতে আর জুড়ে না থাকাই ভালো।
নক্ষত্রও কিছু বলে না। ইরিনের পাশে শুয়ে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়। বালিশ ভিজিয়ে চোখ বন্ধ করে ইরিন। রাত তলিয়ে যায়। ইরিনের মনের বিভ্রান্তির অন্ধকার কাটে না।
৮৮.
‘আমি অনেক ভেবেছি এই ব্যাপারে। মন সায় দিচ্ছে না কিছুতেই। ‘ বেশ কাঁচুমাচু করে বললো ইরিন।
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি ইরিন। ‘কঠিন গলায় বললো ওয়াসিফ।
‘উনিও আমাকে ভালোবাসেন। উনার সন্তান আমার গর্ভে বড় হচ্ছে রোজ দিন। এত বড় প্রতারণার উনি কিছুতেই প্রাপ্য নন। আমি বাচ্চাটা উনাকে দিয়ে যেতে চাই। আপনার তো আমাকে দরকার, বাচ্চাটা থাকুক না ওর বাবার কাছে। ‘
‘আমার বাচ্চাটাও চাই ইরিন। তুমি ওকে ছাড়া কষ্টে থাকবে বা তোমার কোন পিছুটান থাকবে এখানে এমন কিছুই আমি চাই না। তাছাড়া আমি তো ওর বাবা হতেই চাইছি। তুমি আপত্তি করছো কেন?’
‘পিছুটান তো কত কিছুরই থেকে যাবে। নতুন জায়গায়, নতুন জীবনে ঠিক মানিয়ে নিব হয় তো সব। ‘ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো ইরিন।
‘পরশু ভোরবেলা ফ্লাইট, সুইটহার্ট। এখন এমন কেন করছো তুমি বলো তো?’
‘আপনি একাই ফিরে যান এবার। আমি না হয় বৈধভাবে আপনার স্ত্রী হয়েই যাবো কয়েকমাস পরে। এসব মিথ্যা পরিচয়ের তখন আর দরকার হবে না। ‘
‘ওকে…ফাইন। বাট আই নিড লিগ্যাল এশিওরেন্স দ্যাট ইউ উইল বি মাইন। ‘
‘মানে?’
‘তুমি আমার সামনে ডিভোর্স পেপারে সাইন করবে। আমাকে এশিওর করবে যে বেবি জন্মানোর পরে নক্ষত্রের সাথে তোমার লিগ্যালি কোন সম্পর্ক থাকবে না। ‘
‘কিন্তু আমার এই অবস্থায় ডিভোর্স সম্ভব না ওয়াসিফ। ‘
‘সেটা আমি দেখে নিবো। তুমি পেপারস সাইন করবে কিনা বলো।’
কিছুটা সময় নিয়ে ভাবে ইরিন। নক্ষত্রের থেকে আলাদা হয়ে যেতে হবে এটা ভাবতেই কোথায় যেন খাঁমচে ধরে। চিনচিনে ব্যাথা হয় একটা। তবুও বলে, ‘আচ্ছা…আপনি কাগজপত্র রেডি করুন। আমি সাইন করে দিচ্ছি। তারপর তো আমাকে রেখে যেতে কোন সমস্যা হবে না আপনার?’ ক্লান্ত স্বরে বললো ইরিন। আজ সকাল থেকেই শরীরটা খারাপ লাগছিল ওর। এদিকে ওয়াসিফকে বুঝিয়ে না বললেই নয়। তাই বাধ্য হয়েই হোটেলে এসেছে ওয়াসিফের সাথে দেখা করতে।’
‘নো। দ্যাট উইল ইনাফ ফর মি। ‘ বাঁকা হেসে বললো ওয়াসিফ। তারপর ইরিনকে বললো, ‘তুমি একটু ওয়েট করো। আমি পেপারস রেডি করাচ্ছি। ‘
‘এত তাড়াতাড়ি? ‘
‘টাকা থাকলে সব সম্ভব ডার্লিং। আমি আমার লইয়ারকে বলছি, সে সব রেডি করে দিবে।’
‘আচ্ছা। ‘ এই বলে ইরিন অপেক্ষা করে।
ঘন্টা তিনেকের মাঝেই ওয়াসিফ ডিভোর্স পেপার রেডি করিয়ে ফেলে। ইরিন বিনাবাক্য বেয়ে রোবটের মত সই করে দেয়। একবার তাকিয়ে দেখে না পর্যন্ত।
সই করা হয়ে গেলে ইরিন চলে আসতে চায়।।বাঁধা দেয় ওয়াসিফ। অনুরোধের সুরে বলে, ‘আজকে আমার সাথে লাঞ্চ করে যাও প্লিজ। ‘
ইরিন ওয়াসিফের অনুরোধ ফেলতে পারে না। এমনিতেও নক্ষত্র শহরে নেই। গাজীপুরে গেছে একটা সাইট ভিজিট করতে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হবে। কিন্তু, ইরিন মুখে রাজি হলেও মনটা ওর খচখচ করছে ভীষণ। কিন্তু, ওয়াসিফের এই সামান্য চাওয়াটুকু অগ্রাহ্য করতে চাইলো না সে।
ওয়াসিফ ঘরেই খাবার অর্ডার করলো। কিন্তু, ইরিন বেশি কিছু খেতে পারলো না। বমি করে ফেলে দিল সব। ফ্রেশ হয়ে এসে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসতেই শরীর ছেড়ে দিল তার। নিতিয়ে পড়া লতার মত ঘুমিয়ে গেল সে ওখানেই।
৮৯. .
‘একুশ ঘন্টা হয়ে গেছে, অফিসার। আমার ওয়াইফ মিসিং! অথচ আপনারা কিছুই করছেন না? এটা কেমন সিস্টেম আপনাদের?’ থানার ইন চার্জ অফিসারের উপর চেঁচিয়ে বললো নক্ষত্র।
গতকাল থেকে ইরিনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোনটাও বন্ধ। গতকাল অদ্রিজার সাথে শপিং করতে গিয়েছিল। সেখানেই অদ্রিজার এক বান্ধুবীর সাথে তাদের দেখা হয়। ইরিন অদ্রিজাকে তার সাথে সময় কাটাতে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা বলে। সাথে ড্রাইভার থাকায় অদ্রিজাও আপত্তি করেনি। কারণ, এ সময় ইরিনের যথাসম্ভব বিশ্রামে থাকা প্রয়োজন। ইরিন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলেও না ড্রাইভারকে কল করেছে আর না বাসায় গিয়েছে।
তবে, শেষবার দুপুরবেলা কথা হয়েছিল নক্ষত্রের সাথে। ইরিন বলেছিল অদ্রিজার সাথে বাইরে লাঞ্চ করবে। বাড়ি গিয়ে মেডিসিন খেয়ে নিবে। নক্ষত্রর ব্যাপারটা ভালো না লাগলেও ইরিনের ভালো লাগার কথা ভেবে আর আপত্তি করেনি। তাছাড়া, অদ্রিজাও সাথে ছিল। কিন্তু, বিকেল গড়িয়েও যখন সন্ধ্যায় অদ্রিজা বাড়ি ফিরলেও ইরিন বাড়ি ফিরলো না, শায়লা নক্ষত্রকে জানালো ব্যাপারটা।
নক্ষত্র তখন গাড়িতে। ঢাকা ফিরছিল। ইরিনের বাড়ি না ফিরে আসা আর ফোনেও না পাওয়ায় চিন্তার পারদ হুড়হুড় করে বাড়তে থাকে তার। ইরিনের বাবার বাড়ি থেকে সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করে। কিন্তু, কোথাও ইরিনকে পাওয়া যায় না। শেষে থানায় আসে রিপোর্ট লিখাতে। কিন্তু তারা রিপোর্ট নেয় না। উপরন্ত নক্ষত্রের এমন চেঁচামেচির বিপরীতে অফিসার বলে,
‘চব্বিশ ঘন্টা না গেলে কোন মিসিং রিপোর্ট নেওয়া হয় না। এটাই সিস্টেম আমাদের। সব জায়গায়ই একই নিয়ম। তাছাড়া, আপনি কেন এত অস্থির হচ্ছেন? হতেও তো পারে উনি স্বেচ্ছায় কোথাও চলে গেছেন বা এমন কোথাও আটকে গেছেন যেখানে ফোনের নেটওয়ার্ক নেই?’
‘আমার কাল দুপুরেই কথা হয়েছিল ওর সাথে। ওর বাড়ি ফিরে আসার কথা ছিল। ‘উত্তেজিত হয়ে বললো নক্ষত্র।
‘ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু আসেননি। ফোনটাও বন্ধ করে রাখা। কাউকে কিছু বলেও যাননি।একজন এডাল্ট মানুষের এমন আচরণকে আপনি কি বলবেন, হ্যাঁ?
আর আজকাল এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। বউ পরকীয়া করে অন্য আরেকজনের সাথে পালিয়ে যাচ্ছে। আর বেচারা জামাই বউ খুঁজে অস্থির! হেহ! এইসব আজকাল কমন ব্যাপার। ‘ উপহাস করে হেসে বললো অফিসার।
ইরিনকে নিয়ে এমন কথা সহ্য হলো না নক্ষত্রের। রাগে টেবিলে সজোরে একটা থাবা দিয়ে চেঁচিয়ে বললো, ‘সি ইজ ফাইভ মান্থস প্রেগন্যান্ট। আমাদের বাচ্চা ওর গর্ভে। আর ও মিসিং গতকাল থেকে। আপনি বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা?’
‘বাচ্চাটা যে আপনারই তার কি গ্যারান্টি? তাছাড়া, উনি নিজে থেকেই যে কোথাও চলে যাননি সেটাই বা কে বলবে? আর যদি আপনি আইনের সাহায্য চান এ ব্যাপারে তাহলে আপনাকে চব্বিশ ঘন্টা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমরাও তো ভাই সিস্টেমের হাতে বন্দি। মেনে চলতে হয়। সেভাবেই কাজ করতে হয়। আপনি বরং শান্ত হোন। অপেক্ষা করুন আরও কিছুক্ষণ। তারপরও যদি খোঁজ না পাওয়া যায় আমরাও দেখবো কি করা যায়। ‘ নক্ষত্রকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো অফিসারটি।
নক্ষত্র চুপচাপ শুনলো সবটা। এত অল্পতে উত্তেজিত হওয়া তার স্বভাব নয়। কিন্তু ইরিনের এই অবস্থায় খোঁজ না পাওয়াটা চিন্তায়…ভয়ে অস্থির করে তুলেছে তাকে। তারপর আবার পুলিশ অফিসারের এমন অহেতুক আজেবাজে কথা। রাগ লাগছে তার ভীষন। সব কিছু মিলে এখন পুরো দিশেহারা লাগছে ওর। হতাশ হয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এলো নক্ষত্র।
আবারও ফোন বের করে পুনরায় সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে খোঁজ নিতে শুরু করলো। কিন্তু, হতাশা ছাড়া কোন আশার আলোর দেখা মিললো না এবারেও। শেষমেশ থানার সামনে বসেই অপেক্ষা করতে লাগলো। চব্বিশ ঘন্টা পার হতে আরও দুই ঘন্টা বাকি। এর মধ্যে খোঁজ পাওয়া না গেলে রিপোর্ট লিখিয়ে তদন্ত শুরু করিয়ে তবেই এখান থেকে নড়বে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।
চলবে…