নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_২২

0
662

নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_২২
লেখায়_জারিন

১২২.

ইরিনের বাড়ি যাচ্ছে নক্ষত্র। কিন্তু, ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে কোন জায়গায় পৌঁছানো তো আর সহজ বিষয় নয়। দুপুরের মিটিং শেষে ভেবেছিল আজ ইরিনের বাড়িতেই লাঞ্চ করবে নক্ষত্র। কিন্তু, রাফিদের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল যাত্রায় পা রেখেছে টের পায়নি কেউ। অফিসেই ৪ টার বেশি বেজে গিয়েছিল। রাফিদ যাওয়ারও আধা ঘন্টা পরে নক্ষত্র বেরিয়েছে মিরপুর ২ এ ইরিনের বাসার উদ্দেশ্যে। কিছু পথ আসার পরেই জ্যামে আটকে গেছে।যাওয়ারই কথা! বিকেলের সময়টায় বেশিরভাগ অফিস ছুটি হয়। মানুষ ঘুরতে বের হয়। তাছাড়া ঢাকা শহরে জ্যাম ভীড়ের জন্য আলাদা কোন উপলক্ষ লাগেনা কখনো।

ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিল নক্ষত্র জ্যাম ছাড়ার।হঠাৎ ঝলমলে রোদের খুশি খুশি ভাবটায় জল ঢালার মত করেই আকস্মিক ঝুমঝুমি নেমে এলো অবিশ্রান্ত বেগের বারিধারা। চারদিক ঘন কুয়াশার মত আচ্ছন্ন করে বাড়তে থাকলো মেঘাচ্ছন আকাশের রূপ বদল।

নক্ষত্র গাড়ির জানলার কাঁচ ভেদ করে প্রথমে রাস্তায় তারপর আকাশপানে চাইলো। হঠাৎ বৃষ্টিতে চলন্ত পথের মানুষগুলো ছুটাছুটি করছে ছাউনির খোঁজে। কেউ কেউ আশ পাশের দোকানের ছাউনিতেই ঠেসাঠেসি করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কেউ বা ছাতা মেলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।কেউ আবার বৃষ্টির ছাটকে উপেক্ষা করে থেমে যাওয়া কোলাহল মাড়িয়ে দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে নিজ গন্তব্যে। জ্যামে আটকে থাকা রিক্সাওয়ালা ভিজছে। যাত্রীরা কেউ কেউ পলিথিন শিট দিয়ে নিজেদের ভিজে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। আর নক্ষত্রের মত যারা গাড়িতে বসে আছে তারা কেউ কেউ উপভোগ করছে হয় তো প্রকৃতির এই অবেলার বৃষ্টিস্নান। কারও বা বিরক্তি বাড়ছে অপেক্ষায়।

নক্ষত্র পথঘাট থেকে চোখ সরিয়ে আকাশ পানে চাইলো। ঘন বারিধারায় আকাশের স্তর বোঝা কষ্টকর। হঠাৎ জানলায় টোকা পড়তেই নক্ষত্র দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে জানলায় তাকালো। ১০/১১ বছরের একটা কৃষ্ণকায় রোগাপাতলা গড়নের মেয়ে। অগোছালো ছোট বড় চুলগুলো ঘাড়বেয়ে কাঁধ ছুঁয়ে আছে খানিক। ছোট ছোট মলিন চোখজোড়ায় অভাবের ছাপ স্পষ্ট।

মেয়েটির হাতে ছোট একটা বালতিতে তাজা টকটকে বড় বড় লাল গোলাপ। কিছু কদম ফুল আর রজনীগন্ধার স্টিক। অন্যহাতে ঝুলছে বেলি, বকুল আর কাঠগোলাপের মালা। একটা নীল রঙের কমদামি পাতলা ছাতা ঘাড় কাত করে ধরে রেখেছে মাথার উপর। শুকনো মুখেও মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে নক্ষত্রের দিকে। চোখের তারায় এক চিলতে আশা। যদি দু একটা ফুল বিক্রি হয়!

নক্ষত্র জানলার কাঁচ না নামিয়ে সরাসরি গাড়ির দরজা খুলে দিল। গাড়ি ফুটপাতের পাশে দাঁড়ানো ছিল বিধায় খুব একটা অসুবিধা হয়নি দরজা খুলতে। মেয়েটি প্রথমে ভয়ে দু কদম পিছিয়ে যায়। গাড়ির দরজা খুলতেই আবার এগিয়ে আসে কিছুটা। নক্ষত্রের স্নেহভরা চাহনী আর হাসিমুখটা তার ভয় কাটিয়ে দেয়।পুনরায় হাসি মুখে নক্ষত্রের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। হাতের ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘ফুল নিবেন স্যার? এক্কেরে তাজা ফুল। হেব্বি সুবাস। ম্যাডামে খুশি হইয়া যাইবো। ‘

মেয়েটির কথার ধরণে হেসে ফেললো নক্ষত্র। মেয়েটির বাড়ানো হাতটা ধরে খানিকটা কাছে টেনে আনলো নিজের। মেয়েটি অবাক হলো। চোখে জড় হলো কিঞ্চিৎ ভয়। নক্ষত্র তার ভয়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হাত বাড়িয়ে ছাতার হ্যান্ডেল্টা ধরলো। মেয়েটির ঘাড়ের ভাজ থেকে ছাড়িয়ে সোজা করে ধরলো তার মাথার ওপর।

মেয়েটির বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে নক্ষত্র বললো, ‘বৃষ্টিতে ভিজে ফুল বিক্রি করতে কে বলেছে আপনাকে? অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়লে তখন কে বিক্রি করবে এগুলো?’

মেয়েটি যারপরনাই অবাক হওয়া গলায় বললো, ‘আমাগোর আবার রোদ বৃষ্টি দেহনের কাম আছেনি! পেটের জ্বালা আগে…পরে বাকিসব। ‘

ছোট্ট মেয়েটির মুখে এমন বড় বড় কথা শুনে অবাক হলো না নক্ষত্র। এরা তো এমনই! বয়স হওয়ার আগেই জীবনযুদ্ধে নেমে যায়। শৈশব কৈশোর ভুলে আয় রোজগারের নিয়ম নীতি শিখে। এদের মুখে এসব বুলি অস্বাভাবিক নয়।

‘নাম কি তোমার?’

‘নুরানি ‘ মেয়েটি স্বতঃস্ফূর্ত স্বরে জবাব দেয়।

‘বাহ…সুন্দর নাম। তা…কত টাকার ফুল আছে এখানে?’ নক্ষত্র জিজ্ঞেস করে।

মেয়েটি দুই হাত একবার দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনে সবগুলান নিবেন?’

‘হ্যাঁ, নিবো। বলো এবার…দাম কত?’

মেয়েটি আরেকবার সবটা দেখে হিসেব করে বলে,’ ৫০০
টাকা,স্যার।’

‘আচ্ছা, মালা গুলো দাও আগে।’ এই বলে নক্ষত্র মালাগুলো এক এক করে মেয়েটির হাত থেকে খুলে নেয়। অন্যহাতে মেয়েটি বাকিফুলগুলো এগিয়ে দেয়। গাড়িতে রাখার পর নক্ষত্র ওয়ালেট বের করে দুটো পাঁচশ টাকার নোট বের করে দিলে মেয়েটি কেবল একটি নেয়। নক্ষত্রকে বলে, ‘মা’য় কইছে যা দাম হয় খালি ওইডাই নিতে। বেশি নেওন গুনা(গুনাহ)। ‘

নক্ষত্র মিষ্টি করে হাসলো মেয়েটির এ কথায়। মনে পড়ে গেল তার নিজের মায়ের কথা। রেণুও তাকে শিখিয়েছিলেন, ‘যার যতটা মূল্য বা যতটা প্রাপ্য কেবল সেটুকুই নেওয়া উচিৎ। অতিরিক্ত নিলে লোভ বাড়ে। আর লোভ কেবল গুনাহ বাড়ায়।’

‘তোমার মাকে বলবে আমি তোমার ছোট্ট বালতিটাসহ ফুল নিয়েছি। তাই এত দাম হয়েছে। নতুন বালতি কিনে দিতে বলবে। ঠিক আছে?’

নক্ষত্রের কথায় মেয়েটি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল। নক্ষত্র সেটা বুঝতে পেরে বললো, ‘বৃষ্টি বাড়ছে। টাকাটা নিয়ে বাড়ি যাও। জ্যাম ছেড়ে দিবে এখনই। আমাকে যেতে হবে। আমার মেয়েটার অসুখ। ওর কাছে যাচ্ছি। তুমিও বাড়ি যাও, কেমন?’

মেয়েটি আর সংকোচ করলো না। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল। নক্ষত্র মেয়েটির বাড়িয়ে দেওয়া হাতটায় এক এক করে বকুল,বেলি আর কাঠগোলাপের তিনটা মালা পেঁচিয়ে দিল। বালতি থেকে একটা বড় লাল গোলাপ নিয়ে গুঁজে দিল মেয়েটির কৃষ্ণকায় কানের পিঠে ও অগোছালো চুলের মাঝামাঝি। একপলক তাকে দেখে মুচকি হেসে বললো, ‘সুন্দর লাগছে তোমাকে। একদম প্রকৃতিকন্যা। বাড়ি যাও এবার।’

মেয়েটি মায়া মায়া চোখে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে ভীষন মিষ্টি করে বললো, ‘থ্যাংকু স্যার।’

নক্ষত্র মেয়েটির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল।সিগন্যাল দিতেই জ্যাম ছাড়তে শুরু করে দেয়। নক্ষত্র গাড়ির দরজা লাগিয়ে নেয়। গাড়ি চলতে থাকে। পেছনে ফেলে যায় একটা ক্ষণিকের খুশিভরা ছোট্ট জীবন।

১২৩.

গাড়ি এসে ইরিনের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। নক্ষত্র বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে।ফুলগুলো নিবে নাকি গাড়িতেই রেখে যাবে এই নিয়ে। ইরিন কি ভাববে এগুলো দেখলে? ডিভোর্সের দঁড়িতে ঝুলে থাকা বউয়ের বাড়িতে বালতি ভর্তি ফুল নিয়ে এসেছে সে? পুতুল দেখলেই বা কি ভাববে? কোন কিছুর অভাব না রাখলেও যে বাবাকে সে নিজ হাতে কোনদিন একটা সুতো পর্যন্ত এনে দিতে দেখেনি তার মাকে সে এতগুলো ফুল নিয়ে এসেছে তার মায়ের জন্য…এমন ভাববে?

যাহ…এতকিছু ভেবে কি হবে! যার যা ভাবার ভাবুক। পুতুল তো অসুস্থ। অসুস্থ মানুষকে দেখতে গেলে তো ফুল নেওয়াই যায়। এটা ভাবতে ভাবতেই মন বলে, তাই বলে বাচ্চা মানুষের জন্য ফুল? তাও আবার লাল গোলাপ, কদম ফুল?! বেশ বিপাকে পড়েছে নক্ষত্র। কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতেই একসময় দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে গেল সে।

পর পর তিনবার বেল বাজানোর পরে দরজা খুলে দিল ইরিন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নক্ষত্রকে দেখে ভিমড়ি খেয়ে গেল রীতিমত। চোখ যেন তার কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। নক্ষত্র বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে ইরিনের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে। তারপরেও পুরোদমে এটিটিউড নিয়ে গলা ঝেড়ে বললো, ‘দরজার সামনে বেরিকেট হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন? সরে দাঁড়াও, ভেতরে যেতে দাও।’

নক্ষত্রের গলার আওয়াজে হুঁশ হলো ইরিনের। আরও একবার আগাগোড়া দেখে নিল সে নক্ষত্রকে। এক হাতে একটা ছোট বালতি ভরা হরেকরকম ফুল আর ফেলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর অন্যহাতে একটা টেডি বিয়ার আর দুটো চকলেট বক্স। ওসব যে রিতু আর পুতুলের জন্য সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না ইরিনের। কিন্তু, ফুল কার জন্য?

‘তুমি কি আমাকে ভিতরে যেতে দিবা না, পুতুলের আম্মু? দেখি সাইড দাও। ‘ এই কথা বলে ভিতরে ঢোকার জন্য অগ্রসর হলো নক্ষত্র। ইরিন দ্রুত দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। নক্ষত্র ভিতরে ঢুকে একবার পাশ ফিরে ইরিনকে দেখলো। তারপর হাতে থাকা বালতিটাকে। কালবিলম্ব না করে সেটা ইরিনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে গেল। ইরিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো বালতিটার দিকে।

এত এত ফুল আবার ফুলের মালাও! এগুলো সব কি জন্য এনেছে নক্ষত্র? তার জন্য? উহু…অসম্ভব।আজ তো কোন বিশেষ দিনও নয়। তাহলে এত ফুল কেন? তাও আবার তার পছন্দের বকুল আর কাঠগোলাপের ফুলের মালা। নক্ষত্র কি সত্যিই তার জন্য এনেছে এগুলো? কিন্তু, এতকাল পরে হঠাৎ এসব কেন?

এতসব ভাবতে ভাবতেই দরজায় আবার বেল পড়লো। ইরিন ভাবনাচুত্য হয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো ড্রাইভার এসেছে। হাতে ফলের ঝুড়ি, মিষ্টির বক্স আর দুটো ফাস্ট ফুডের প্যাকেট। ড্রাইভার সেগুলো ডাইনিং টেবিলের উপর রেখে বেরিয়ে যেতেই আক্কেল গুডুম দশা হলো ইরিনের। একগাদা ফলমূল এনেছে নক্ষত্র।আবার এতসব মিষ্টি। ইরিন এবার চেঁচালো।

‘এইই….এসব কি? পুরো বাজার তুলে আনে কেউ এভাবে? এতসব খাবে কে? এই পুতুলের বাবাই…

‘আহ…এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন? ‘পুতুলকে কোলে নিয়ে ডাইনিং এ এসে বললো নক্ষত্র।

‘এসব কি করেছেন আপনি? এতসব জিনিস আনার কি মানে?’

‘এতসব কোথায় কি এনেছি? কিছু ফ্রুটস আর বুড়ির পছন্দের মিষ্টি আর সাথে বার্গার। ফ্রুটসগুলা ভাগ করে কিছু মায়ের ওখানে পাঠিয়ে দিও। আর কিছু রতনের মাকে দিয়ে দিও। তাহলেই তো হলো। আর বাকি গুলা তুমি, বুড়ি আর পুতুল মিলে খাবে। ব্যস…এম্নিতেই ফুরিয়ে যাবে সব! তাই না পুতুল মা? ‘ মেয়েকে আদর করে বললো নক্ষত্র।’

‘পুতুলের ফ্রুটস ভাল্লাগেনা তো!’ বাবার কাঁধে মুখ গুঁজে বিরক্ত স্বরে বললো পুতুল। জ্বরে মুখ তেঁতো হওয়ায় কিছুই রুচে না তার মুখে।

‘কিন্তু, ফ্রুটস তো হেলদি খাবার আম্মু। খেতে হয়। ‘ নক্ষত্র মেয়েকে বুঝিয়ে বললো। তবে তাতে বিশেষ কাজ হলো না। পুতুল নেতানো শরীর নিয়ে লেপ্টে রইলো বাবার কোলে।

নক্ষত্র আর কথা বাড়ালো না। পুতুলকে নিয়ে ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। পেছন থেকে ইরিন বললো, ‘দুপুরে খাননি কেন? যান ফ্রেশ হয়ে আসুন। খাবার দিচ্ছি আমি।’

নক্ষত্র অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না। ইরিন তার মুখ দেখলেই কিভাবে যেন বুঝে যায় সে খেয়েছে কিনা। সে কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত কিনা। এতগুলো বছর একসাথে থাকার ফলেই কি এমনটা হয়েছে? নাকি ইরিন আন্দাজে বলে এসব? এতটাও খেয়াল সত্যিই কি কখনো করেছিল ইরিন তাকে? নক্ষত্র কথা বাড়ায় না। চুপচাপ পুতুলকে নিয়ে ঘরে চলে যায়।

ইরিন ফলের ঝুড়িটা সরিয়ে মিষ্টির প্যাকেটগুলো তুলে রাখছিল ফ্রিজে। প্যাকেটগুলো রাখতে গিয়ে অবাক হলো সে। দুটো প্যাকেটে রিতুর প্রিয় মিষ্টি মতিচুর লাড্ডু আর মালাইকারী। আর অন্য আরেকটায় ইরিনের পছন্দের রসমালাই। নক্ষত্র যতই বলুক ইরিনকে নিয়ে সে আর মাথা ঘামায় না।কিন্তু, ইরিনের সব পছন্দ, অপছন্দ প্রয়োজনের খেয়াল রাখতেও ভুলে না সে। তবে, ইরিনের মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে,’ এসব কি নক্ষত্র তার জন্য করে নাকি কেবল ইরিন পুতুলের মা এই জন্য?’

১২৪.

ঘরে পুতুল কার্টুন দেখছে শুয়ে শুয়ে। রিতু এখনো ফিরেনি টিউশন ক্লাস থেকে। নক্ষতে অবশ্য ড্রাইভার পাঠিয়েছে ওকে আনতে। ইরিন নক্ষত্রের দেওয়া গাড়ি ব্যবহার না করলেও রিতুর ব্যাপারে কোন আপত্তি মানে না নক্ষত্র। রিতুর লাইফের সব ডিসিশন যেন কেবল সেই নিতে পারে এমনভাবে সব করে।আম্বিয়াও এই নিয়ে কিছুই বলেন না।

রিতুও হয়েছে একদম দুলাভাইয়ের ন্যাওটা। নক্ষত্র ভাইয়া বলতে অস্থির। নিজের ভাইদের সাথেও তার এত ভাব নেই যতটা না নক্ষত্রের সাথে তার ভাব। নক্ষত্র যা বলবে সেও তাতেই রাজি। তাই তো নক্ষত্রের এক কথায় তার আদরের খেলার সাথী..পুতুলকে ছেড়ে ইরিনের সাথে থাকতে রাজি হয়েছে। আর নক্ষত্রও বা কম কি! অদ্রিজা বা কনকের থেকে কোন অংশে কম আদর স্নেহ করে না সেও রিতুকে।

ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দেখছিল নক্ষত্র। ইরিন চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘আপনার চা। ‘

‘তুমি কি জানতে যে আমি না খেয়ে আসবো?’ চায়ের কাপটা হাতে নিতে নিতে বললো নক্ষত্র।

‘এটা কেমন কথা?’ কিছুটা চোরা গলায় প্রশ্ন করলো ইরিন।

‘পুতুলের জ্বর। এমনিতেই অনেক সময় দিতে হচ্ছে তোমাকে ওর পেছনে। এই অবস্থায় মুড়িঘণ্টর ঝামেলাটা না করলেই পারতে। অহেতুক এত কষ্ট করার কোন মানে ছিল না।’ চা’য়ে চুমুক দিয়ে বললো নক্ষত্র। ইরিন যে ইচ্ছে করেই তার জন্য মুড়িঘণ্ট রান্না করেছে সেটা সে ঠিকই বুঝছে। নয় তো নক্ষত্র ছাড়া ঐ খাবার আর কেউ খায় না এ বাসায়।

‘এতকিছুর মাঝে রসমালাইটাও না আনলেও চলতো। অহেতুক আলাদা করে এটা আনার কোন মানে ছিল না।’ নক্ষত্রের কথার পালটা জবাব দিয়ে ওখান থেকে পালানোর ধান্ধায় ঘরের দিকে পা বাড়ালো ইরিন। সে জানেই এই জবাবের পর এখানে এক মূহুর্ত দাঁড়ানো মানে ৯ নম্বর বিপদ সংকেত বৈ আর কিছুই না।

কিন্তু, পালানো আর হলো কই! তার আগেই হাতে টান পড়লো ইরিনের। মূহুর্তেই সে গিয়ে হাজির হলো নক্ষত্রের রক্তচুক্ষু চাহনীর সম্মুখে। ইরিন হাতে প্যাঁচানো বকুল ফুলের মালাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো নক্ষত্র। ইরিনের চোখের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘তোমার জন্য আলাদা করে কিছু করবো এটা ভাবাও তোমার বোকামি। ফুলগুলো তোমার জন্য আনা হয়নি। হাতে পড়ে ঘুরছো কেন? ফুলদানিতে পানি দিয়ে রেখে দাও। যেন তাজা থাকে। যাওয়ার সময় নিয়ে যাবো আমি। ‘

কথা শেষ করে ইরিনের হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল নক্ষত্র। ইরিন অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ মুখ ভিজিয়ে ফেললো মূহুর্তেই। নক্ষত্রকে ভালোবাসার পর থেকে এই এক জ্বালা হয়েছে তার। নক্ষত্র রাগ দেখিয়ে সামান্য কিছু বললেও অভিমান জেগে উঠে। কান্নায় চোখ ভিজে। ইরিন জানে এসব তার প্রাপ্য। কিন্তু তবুও নক্ষত্রের কড়া কথা সে সহ্য করতে পারে না।

ইরিন আর এক মূহুর্তেও দেরি করলো না। নক্ষত্রের আনা ফুলগুলো ফুলদানিতে সাজিয়ে টেবিলের উপর নক্ষত্রের সামনে নিয়ে রেখে এলো। নক্ষত্র নিউজ ফিড স্ক্রল করছিল। ইরিনের কান্ড দেখে অবাক চোখে তার দিকে তাকাতেই ইরিন অভিমানী কন্ঠে বললো, ‘সবগুলো গুছিয়ে দিয়েছি। যাওয়ার সময় মনে করে নিয়ে যাবেন আপনার ফুলগুলো। চাইলে গুণে দেখতে পারেন। একটা মালা বাদে আর একটাও কম নেই। হুহ!’

কথাশেষ করে নক্ষত্রকে ভেংচি কেটে ভেতর ঘরে চলে গেল ইরিন। নক্ষত্র তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে ফেললো। দুই বাচ্চার মা হয়েও ইরিনের বাচ্চাদের মত অভিমান দেখানোর এসব ছেলেমানুষি কাজগুলো আর গেল না স্বভাব থেকে। অবশ্য ইরিনের গম্ভীর নারী চরিত্রের বাইরে এসব ছোটখাটো ছেলে মানুষির প্রেমে পড়ে নক্ষত্র বারেবার। কিন্তু, রাগ…অভিমান সেই প্রেমকে অংকুর থেকে ভালোবাসার প্রস্ফুটিত ফুলে রূপ নিতে দেয় না।

নক্ষত্র অংকুর জমায় মনের রুক্ষ ময়দানে। যেখানে ইরিনের নামের সকল অনুভূতি বন্দী দশায় থাকে।তবুও মাঝে মধ্যেই তারা সুযোগ পেলেই ডানা মেলে দেয়। নক্ষত্র না চাইতেও ইরিনকে নিয়ে ভাবে। তার খেয়াল রাখে। ইরিন অন্যকোন পুরুষের সাথে সামান্য হেসে কথা বললেও তা নক্ষত্রের মন খারাপের কারণ হয়। ইরিনের অভিমানী মুখটা হৃদয়ের গহীনে একটা সূক্ষ সুখানুভূতির জন্ম দেয়। চোখের কার্ণিশে জড় হওয়া নোনাজল তাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় এই নারীটির হৃদয়ে একমাত্র নক্ষত্রের বসবাস। তার দেওয়া বিশাল বিশাল আঘাত সে হাসি মুখে সয়ে নিলেও তার ভালোবাসায় সামান্য আঁচড় লাগলেও অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলে এই নারীটি।

নক্ষত্র ভুল ছিল না। ইরিন সত্যিই তাকে ভালোবেসেছিল।শুধু মনের বিভ্রান্তির কবলে পড়ে ভালোবাসাটাকে বুঝতে পারেনি। নক্ষত্রের ভালোবাসার জোরেই হয়তো অবচেতন মন তাকে সায় দেয়নি নওরিনকে নিয়ে চলে যেতে।হয় তো সব ঠিক থাকলে…নওরিন তাদের মাঝে এলে ইরিনের মন সত্যিই বদলে যেত। কিন্তু, ভাগ্য সেই সুন্দর সম্ভাবনাকে কতটা জটিল করে দিয়েছে! দুটো মানুষ দুজনকে ভালোবেসেও অভিমানে আলাদা হয়ে আছে। এ দূরত্ব আজীবনে মিটবে বলে মনে হয় না নক্ষত্রের। সুখ পায়রা ডানা ঝাপটায় কিন্তু সে পুরোনো ক্ষোভ আর ভীষণ অভিমানের বশে হৃদপিঞ্জর খুলে তাকে ঠাই দেয় না। আহ…অভিমান! পিছু না ফেরার নাম।

১২৫.

‘না…তুমি যাবেনা।আম্মু আর আমার সাথে থাকবে। ‘ জেদি স্বরে পুতুলের একরোখা আবদার।

‘পুতুলসোনা…এমন করেনা মা। দেখো,তুমি তো জানোই বাবাই আর আম্মু এখন একসাথে থাকি না। এমন জেদ করেনা,সোনা ।’ মেয়েকে বুঝানোর চেষ্টা করে বললো নক্ষত্র।

মাত্র ৪ বছর বয়স হলেও নক্ষত্র এখন থেকেই তাকে সত্যি মেনে নিতে শিখাচ্ছে। ইরিন আর সে একসাথে থাকে না এটাও তাকে বোঝানো হয়েছে। পুতুল হয় তো বোঝে না এতকাল দুজনকে একসাথে পেয়েও এখন কেন পায় না। কেন তারা আলাদা বাড়িতে থাকে। কেন সে নিজের বাবা মায়ের মাঝে শুয়ে ঘুমাতে পারে না আগের মত। কেউ জিজ্ঞেস করলে কেন তাকে এই সত্যিটাই বলতে হয় যে তার বাবা মা একসাথে থাকে না। অথচ তার প্রতি দায়িত্বগুলো ঠিকই পালান করে দুজনেই। নক্ষত্র তাকে বলেছে সে বড় হলে তাকে কারণ জানাবে। কিন্তু,তাকে এটাই মানতে হবে যে তার বাবা মা একসাথে থাকে না।

‘ওওওও….আম্মু! তুমি বলো না বাবাইকে আমাদের সাথে থাকতে। তারপর তো আমিও চলে যাবো।’ প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো পুতুল। মেয়েটা বাবার মতই যথেষ্ট বুঝদার।কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সব জেদ ধরে যে না মেনেও পারা যায় না। যদিও সেসব জেদ কখনোই অন্যায্য হয় না। তবে চাইলেও তো সবসময় সব ন্যায্য বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া যায় না।

‘পুতুউউললল….এমন করে না, মা। বাবাইয়ের কালকে অফিস আছে তো। আর দাদুমনিও তো ওয়েট করছে বাবাইয়ের জন্য। না গেলে সে মন খারাপ করবে না?’ ইরিন বোঝানোর চেষ্টায় বললো।

‘না। কব্বে না মন খারাপ। বাবা যখন থাকে না, অফিসের কাজে যায়…তখন তো দাদুমণি মন খারাপ করে না। বাবা ফোন করে দিলেই দাদুমণি কিছু বলবে না।’ মায়ের কথার বিপক্ষে কাঁদতে কাঁদতে বললো পুতুল।

এই অসুস্থ শরীরে মেয়েটার এই সামান্য চাওয়া নিয়ে কান্না আর সহ্য হলো না নক্ষত্রের। ইরিনের মতামত ছাড়াই বললো, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। বাবাই থাকবে। এখন আর কাঁদে না..মা। দেখি, আসো এদিকে..তোমার জ্বরটা মেপে দেখি। ‘

নক্ষত্রের এমন কথায় ফট করেই কান্না থেমে গেল পুতুলের। খুশিতে ডগমগ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাবার কোলে। নক্ষত্রও পরম স্নেহের সাথে আগলে নিল মেয়েকে। পুতুলকে কোলে নিয়ে আড়চোখে একবার ইরিনকে দেখলো সে। চোখমুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে আছে। যার অর্থ তার সে খুশি নয় নক্ষত্রের এই একপাক্ষিক সিদ্ধান্তে। নক্ষত্র এটা বুঝতে পেরে চুপচাপ কেটে পড়লো পুতুলকে নিয়ে। ইরিনের এই গম্ভীর রূপ সহ্য করা তার কম্ম নয়…কেটে পড়াই ভালো।

১২৬.

ড্রয়িংরুমের সোফায় থমথমে মুখে বসে আছে ইরিন আর নক্ষত্র। রিতু আর পুতুল ব্যস্ত তাদের হাসি ঠাট্টা আর খেলা নিয়ে। ৮ বছরের ছোট বড় হলেও এরা খালা-ভাগ্নি কম বন্ধু বেশি। পুতুলের এই নামটাও রিতুর রাখা। প্রথম যেদিন নক্ষত্রের কোলে তোয়ালেতে মোড়ানো ছোট্ট প্রাণটাকে পুতুলের মত বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিল, ৮ বছর বয়সী রিতু বলেছিল এটা তার নতুন পুতুল। ব্যাস!নক্ষত্রও তার আদরের বোনের নামটাই মেয়ের জন্য রেখেছে। ইরিন অবশ্য বাবার সাথে মিলিয়ে নাম দিয়েছে আদৃতা রাওনাফ। সব মিলিয়ে পুতুল মেয়েটা রিতুর কাছে জ্যান্ত এক পুতুল। তার সবচেয়ে প্রিয় খেলার সাথী।

তবে, ইরিন নক্ষত্রের থম ধরে বসে থাকার কারণ, কিছুক্ষণ আগে ড্রাইভার এসে বড় সাইজের একটা ব্যাগ দিয়ে গেছে ইরিনের বাসায়। শায়লা পাঠিয়েছেন। নক্ষত্র ফোন করে বলেছিল যেন রাতে বাসায় পড়ার আর সকালে অফিস যাওয়ার জন্য দুইসেট কাপড় ও প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস পাঠিয়ে দেয় ইরিনের বাসায়। আজ রাতে সে এখানেই থাকবে। শায়লা এই সুযোগের পুরো ফায়দা তুলে পুরো ২ দিনের জামাকাপড় ও নক্ষত্রের ব্যবহার্য জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন।

নক্ষত্র এর জন্য ফোন করলে তিনি বলেছেন পুতুল সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যেন ইরিনের বাসাতেই থাকে। যদি রাত বিরাতে কোন ইমার্জেন্সি হয়ে যায়! ইরিন একা মেয়ে মানুষ কি করে সামলাবে? তাই নক্ষত্র যেন ওখানেই থাকে। নক্ষত্র জানে এটা কেবল তার আম্মুর বাহানা। পুতুলের হালকা পাতলা জ্বর। সিজনাল ফ্লু যাকে বলে। দু তিনদিনে এমনিতেই সেরে যাবে। তাও শায়লা ইচ্ছে করেই এমনটা করেছেন।

এই রাত বিরাতে এই নিয়ে আর কথা বাড়ালো না নক্ষত্র। পুতুল শুতে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে। দুইটা বেডরুম আর একটা এটাচড ডাইনিং ও ড্রয়িংরুম নিয়ে ইরিনের ছোট্ট বাসা। একরুমে ইরিন থাকে আর অন্যটায় রিতু। আম্বিয়া মাঝেমধ্যে এলে রিতুর ঘরেই থাকেন। আজ নক্ষত্র থাকবে বলে ইরিন ভেবে রেখেছিল রিতু, পুতুলকে নিয়ে সে নিজের ঘরে থাকবে আর নক্ষত্রকে রিতুর ঘরে পাঠিয়ে দিবে। কিন্তু, এখন পুতুল জেদ ধরেছে সে তার বাবা মায়ের সাথেই থাকবে।

‘তো..তুমি আমার সাথে থাকো না আম্মু, তাহলেই তো হয়।’ নক্ষত্র বললো।

‘না, আমি আম্মু আর তোমার সাথেই থাকবো। চলো না বাবাই,আমার ঘুমু পাচ্ছে।’ ঘুমে চোখ ডলতে ডলতে বললো পুতুল।

‘এখন কিন্তু বেশি হচ্ছে পুতুলমণি। তুমি জানো বাবাই আর আম্মু একসাথে থাকে না এখন আর। তুমি আমার আর আন্নির সাথে থাকবে। চলো ঘুম পাড়িয়ে দেই। ‘ মেয়েকে শাসন করে কড়া গলায় বললো ইরিন।

‘না রে ছোটোপা। আমার কাল এক্সাম আছে স্কুলে। রাত জেগে পড়বো। লাইট অন থাকবে, তোদের ডিস্টার্ব হবে ঘুমের। আর পুতুলও তো অসুস্থ। তোরা তোদের ঘরে থাক, আমি বরং যাই। অনেক পড়া বাকি। ঘুমও পাচ্ছে আবার। তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করে ঘুমাবো। সকালে স্কুলও তো আছে। ‘কথাগুলো বলতে বলতেই মস্তবড় এক হাই তুলে আলগোছে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো রিতু।

‘এই…দাঁড়া, কাল তোর কিসের এক্সাম? এক্সাম তো এতক্ষণ এখানে কি করছিলি পড়তে না গিয়ে?’ সন্দেহের বশে জেরা করে বললো ইরিন।

ইরিনের কড়া গলা শুনে ছোটখাটো ঢুক গিললো রিতু মনে মনে। তারপরেও সাহস হারালো না সে।

‘আজকে ভাইয়া আসছে না? কত্তদিন পরে আসলো। একটু গল্প করতাম না, এমন হয় বলো?’ আর আমি তো রাত জেগে পড়বো বলেই তো এই যে এখন যাচ্ছি!’ ক্যাবলা হেসে বললো রিতু। মাত্র ১২ বছর বয়স হলেও বেশ চতুর মস্তিষ্ক ও চটপটে স্বভাবের সে।

তারপর সে পুতুলকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘এইই পুতুল, যা তোর না ঘুম পাচ্ছে। বাবাই আর আম্মুকে নিয়ে শুতে যা। অসুখ শরীরে রাত জাগিস না। আমি গেলাম রে।’ এই বলে সুন্দর মত নিজের ঘরে চলে গেল। দরজায় হাত রাখতেই নক্ষত্র পিছু ডাকলো। রিতু ভয়ে ভয়ে পিছু তাকালো। কারণ নক্ষত্র মিথ্যা পছন্দ করে না। আদর করার বেলায় তার যেমন জুড়ি নেই তেমনি ভুল করলে শাস্তি থেকেও রেহাই নেই।

‘কিছু বলবা ভাইয়া?’ মেকি হেসে বললো রিতু।

নক্ষত্র এগিয়ে এলো চুপচাপ। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেল রিতুর মুখোমুখি। রিতুর অভ্যন্তরীণ ভয়ার্তক মন নিয়েও মুখে কপট হাসি লেপ্টে রইলো।

‘বেশি রাত জাগিস না। দ্রুত পড়া শেষ করে ঘুমিয়ে যাস। কাল ওয়েট করিস…আমি নিয়ে যাবো স্কুলে, ঠিক আছে?’
রিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো নক্ষত্র। তার স্নেহময় স্পর্শে আলতো করে মিষ্টি হাসলো রিতু। বাবার কথা স্মৃতিতে নেই, তবে এই মানুষটা বাবা আর ভাই দুটোই তার জন্য। নিজের ভাইরাও এতটা স্নেহভরে মাথায় হাত রাখেনি কোনদিন। অথচ গত ৬ বছরে এই মানুষটা নিজের সন্তানের মত আগলে রেখেছে তাকে। প্রচন্ড ভালোবাসে সে এই মানুষটাকে। অগাধ শ্রদ্ধা করে। অথচ ইরিন যে কি জন্য তাকে ছেড়ে একলা থাকছে বুঝে না সে। এই জন্য অবশ্য কিঞ্চিৎ রাগ আছে তার ইরিনের উপর। তার জন্যই তো তাকে পুতুলকে ছেড়ে থাকতে হচ্ছে! এমন পুতুল পুতুল মিষ্টি মেয়েটাকে ছাড়া বুঝি তার কষ্ট হয় না? কিন্তু, এই বাচ্চা মনের কষ্ট কেউ বুঝে কই!এসব ভেবে হতাশ হয়ে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেললো রিতু।

‘আচ্ছা। তবে, কালকেও কিন্তু থাকবা তুমি। নইলে তোমার সাথে কোথাও যাওয়াযাওয়ি নাই আমার।’

‘আচ্ছা, সেটা কালকেরটা কাল দেখা যাবে। এখন যা, পড়া শেষ কর। ‘

‘আচ্ছা।গুড নাইট।

‘গুড নাইট, বুড়ি।’ মিষ্টি হেসে বললো নক্ষত্র।

১২৭.

‘আপনি এত বোকা কবে থেকে হলেন পুতুলের বাবা? ‘ ফুঁসে উঠে বললো ইরিন।

‘৬ বছর আগে থেকে।’ পুতুলকে বিছানা ঠিক করে দিতে দিতে বললো।

‘মানে??’ চেঁচালো ইরিন।

‘সমস্যা কি পুতুলের আম্মু?’ ক্লান্ত গলায় প্রশ্ন করলো নক্ষত্র।

‘রিতু যে ইচ্ছে করে এটা করেছে সেটা বুঝেননি আপনি?’

‘বুঝেছি। ‘ নির্বিকার স্বরে জবাব দেয় নক্ষত্র।

‘বুঝেছেন মানে?’ তাও কেন কিছু বলেননি ওকে?’

‘বুড়ি পুতুলের মন রাখতে এটা করেছে সেটা কেন বুঝো না তুমি? দুই বাচ্চার মা হয়েও বোধ বুদ্ধি কিছুই হলো না তোমার।’ যথাসম্ভব রাগ চেপে শান্ত গলায় বললো নক্ষত্র।
পুতুলের সামনে রাগ দেখাতে চাইছে না সে।

‘কিন্তু তাই বলে… ইরিন কিছু বলতে চাচ্ছিল তার মাঝেই পুতুল খুনখুন শুরু করলো, ‘আম্মু ঘুমু। ‘

ইরিন বিরক্তি চেপে পুতুলকে কাছে টেনে নিল। বিছনার একপাশে শুইয়ে দিয়ে বললো, তুমি ঘুমাও সোনা। ‘

পুতুল নক্ষত্রকে ডাকলো, ‘বাবাই আসো?’

‘হু…আসছি। ‘ নক্ষত্র বিছানায় উঠতেই যাচ্ছিল ইরিন চেঁচালো।

‘এই আপনি এখানে ঘুমাবেন?’

‘তোমার বাড়িতে এক্সট্রা রুম আর বিছানা থাকলে তুমি গিয়ে সেখানে ঘুমাও। আমি আমার মেয়ের সাথেই ঘুমাবো।’
ঝরঝরে গলায় বললো নক্ষত্র।

‘আমি আম্মুকে ছাড়া ঘুমাবো না।’ পুতুল ব্যাগড়া দিয়ে বললো।

‘তাহলে আর কি! তুমি তোমার আম্মুর কাছেই ঘুমাও। আমিই চলে যাই বাসায়।’ কপট মন খারাপের সুরে বললো নক্ষত্র।

‘আমার বাবাই লাগবে আম্মু।’ ইরিনের দিকে তাকিয়ে আবদারের স্বরে বললো পুতুল।

‘এই খাটে তিনজন জায়গা হবে না,মা…তুমি বাবার সাথে ঘুমাও, আমি আন্নির সাথে থাকি আজকে!’

‘উহু। আমার বাবাই আম্মু দুইটাই লাগবে। ‘ কাঁদোকাঁদো গলায় বললো পুতুল।

মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখে নক্ষত্র আর চুপ থাকতে পারলো না। পুতুলকে বললো, ‘দেখি পুতুলসোনা তুমি ওই সাইডে গিয়ে শোও। ‘

‘পুতুল ওই সাইডে শুবে মানে?’ আতঅংকিত গলায় বললো ইরিন।

‘তুমি মাঝে শুবে। আমি খাটের বাইরের সাইডে শুবো। নয়তো পুতুল কিংবা ওর আম্মুকে সকালে বিছানায় পাওয়া যাবে না। মেঝে থেকে উদ্ধ্বার করা লাগবে।’

ইরিন বুঝলো নক্ষত্র কি বলতে চাইছে। ইরিন ও পুতুল দুজনেরই যে হাত পা ছুড়ার অভ্যাস তা নক্ষত্র ভালোই জানে।তাদের কেউ বাইরের সাইডে শুলে দেখা যাবে রাতে সে গড়িয়ে নীচে পড়ে গেছে এই ডাবল বেডে এডজাস্ট করতে না পেরে। তারপরেও ইরিন একরোখা স্বরে আপত্তি জানিয়ে বললো, ‘আ….আমি শুবো না এভাবে।’

‘এছাড়া আর উপায় নেই। ‘

‘আপনি ঘুমান পুতুলের কাছে। আমি রিতুর ঘরে চলে যাই। ‘

ইরিনের এমন একরোখা কথায় এবারে নক্ষত্রের সত্যি সত্যি রাগ উঠে গেল। আড়চোখে পুতুলকে একবার দেখে ইরিনের হাত ধরে টেনে দরজার দিকে টেনে নিয়ে গেল। নীচু গলায় প্রশ্ন করলো, ‘সমস্যা কি তোর? এমন করতেছিস কেন?’

ইরিনের বুঝতে বাকি নেই নক্ষত্র রেগে গেছে ভীষণ। শুকনো ঢুক গিললো সে। আমত আমতা করে বললো, ‘আ..আ..আমাদের ডিভোর্স হবে। এখন এভাবে থাকা মানায় না। ‘

নক্ষত্রের রাগ এবার সীমানা অতিক্রম করে গেল। চাপা গলায় ক্ষোভ ঝেড়ে বললো, ‘ডু হেল উইথ ইউর ব্ল্যাডি ডিভোর্স।বহুবার বলছি, আমি তোকে ছাড়বো না এত সহজে। আমার বাচ্চার মা হতে চাইছিলি, হইছিস। এখন ওর মা হয়েই আমার স্ত্রীর বেশেই থাকতে হবে তোর আজীবন। আমার মেয়ের লাইফে ব্রোকেন ফ্যামিলির ট্যাগ আমি লাগতে দিবো না কখনোই। বুঝছিস তুই?’

‘আম্মু…ঘুমু। ‘ পুতুল তাড়া দেয় আবারও।

নক্ষত্র এবার ইরিনকে একপলক দেখে পুতুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আম্মুনি জায়গা দাও। আজকে আম্মু তোমার আর বাবাইয়ের মাঝখানে ঘুমাবে।’

নক্ষত্রের কথা শুনে ইরিনের চোখ কপালে উঠে গেল। মৃদু স্বরে চেঁচালো সে, ‘এই না…কি বলেন এগুলা।’

নক্ষত্র ইরিনের কথায় পাত্তা দিল না। এক হাতে ইরিনের হাত ধরে অন্য হাতে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজার পাশেই থাকা সুইচবোর্ডের সুইচ টিপে ঘরের আলোও নিভিয়ে দিল। ড্রিম লাইটের মৃদু আলো রয়ে গেল কেবল ঘরজুড়ে।

ইরিন এসবের প্রতিবাদ করে কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিল তার আগেই নক্ষত্র তাকে পাঁজকোলা করে তুলে নিল। ইরিন পুরো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল আকস্মিক এ ঘটনায়। ভালোভাবে কিছু বুঝে উঠার আগেই নক্ষত্র তাকে পুতুলের পাশে বিছানার মাঝ বরাবর শুইয়ে দিল। পুতুলকে বললো, ‘নাও এবার ঘুমাও, মা। ‘

কথা শেষ করে নক্ষত্রও আর দেরি করলনা।বিছনার সংকীর্ণ জায়গাটায় চেপেচুপে ইরিনের পাশে শুয়ে পড়লো। ইরিনকে পুতুলের মুখোমুখি কাত করে ঘুরিয়ে দিয়ে নিজের এক পা তুলে দিল ইরিনের উপর। যাতে সে উঠে যেতে না পারে। ইরিন থতমত খেয়ে গেল নক্ষত্রের আকস্মিক এ কাজে। এরই মাঝে পুতুল তার ছোট্ট হাতখানা দিয়ে মায়ের কোমড় পেঁচিয়ে ধরে বিড়াল ছানার মত মুখ গুঁজে দিয়েছে মায়ের বুকে।

ইরিন মূহুর্ত কয়েক সবটা অবলোকন করার পর এবার ঘাঁড় ঘুরিয়ে নক্ষত্রকে দেখলো। নক্ষত্র তার পিঠের দিকে মুখ করে এক হাত পেটের কাছে ভাঁজ করে শুয়ে আছে। যাতে চাপাচাপি করে শুলেও ঠিকভাবে শোয়া যায়। চোখ বন্ধ তার। তবে নিঃশ্বাসের গতি জানান দিচ্ছে সে ঘুমায়নি এখনো।

ইরিনের তপ্ত নিঃশ্বাসের উষ্ণতার আভাস পেতেই ফট করে চোখ খুলে চাইলো নক্ষত্র। ইরিন বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল এতে।নক্ষত্র বিশেষ কোন ভাবান্তর দেখালো না এ বিষয়ে।হাত বাড়িয়ে ইরিনের মাথাটা পুতুলের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে নীচু গলায় বললো, ‘ডোন্ট গেট স্ট্রেস্টড। পুতুল ঘুমালে উঠে চলে যাবো আমি। ঘুমাও তুমি।’

ইরিনও এবার নীচু গলায় প্রশ্ন করে, ‘আপনার যাওয়ার দরকার নেই। আমি রিতুর ঘরে চলে যাবো। আপনি পুতুলের সাথেই থাকুন। ‘

নক্ষত্র আর কথা বাড়ালো না। আস্তে করে পা নামিয়ে নিল ইরিনের পায়ের উপর থেকে। পুতুল ঘুমিয়ে গেছে। এখন আর এখানে থাকার দরকার নেই। কিন্তু নক্ষত্র বিছানা ছাড়তে গিয়েও নামতে পারলো না। পুতুল তার টি শার্টের কোণা আঁকড়ে ধরেছে অভ্যাস মত। সেটাও বেশ শক্ত করেই। নক্ষত্র সেটা ছুটানোর চেষ্টা করলো। ইরিন সেটা খেয়াল করে বললো, ‘থাক। এখানেই ঘুমান আজ।’

নক্ষত্র সেটা শুনলো ঠিকই কিন্তু কিছু বললো না। পুতুলের নরম হাতের আঙুলগুলো ধরে ধরে একটু একটু করে ছাড়িয়ে নিল আঁকড়ে ধরে রাখা টি-শার্টের কোণাটা। চুপচাপ বিছানা থেকে নেমে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যেখানে ইরিনের সম্মতি নেই সেখানে থেকে যাওয়া নেহাতই বেহায়াপনা নক্ষত্রের কাছে। আবার সে নিজেই যখন স্ত্রীর মর্যাদা দেয় না তো ইরিনের অসম্মতিকে অসম্মান করাও তার সাজে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here