নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_২৪ (১ম অংশ)
লেখায়_জারিন
১৩৫.
ভোর ৪ টা। আর কিছুক্ষণ পরেই ফজরের আযান দিবে। নক্ষত্র ল্যাপটপ…ফাইলপত্র সব গুছিয়ে রাখলো। ফ্রেশ হয়ে মসজিদে যাবে সে। ফজরের নামাযটা ওখানেই পড়বে আজ। আড়মোড়া ভেঙে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে।কফির মগ টা রান্নাঘরে রেখে পা বাড়ালো ইরিনের ঘরের দিকে।ওর ঘরের লাগোয়া ওয়াশরুমটাই নক্ষত্র ব্যবহার করে এ বাড়ি এলে।
ঘরে গিয়ে অবাক হলো নক্ষত্র। প্রায় অন্ধকার ঘরটায় পুতুল একা ঘুমিয়ে আছে। ইরিন নেই পাশে। এলোমেলো হয়ে পুরো বিছানাজুড়ে কেবল পুতুল শুয়েছে। নক্ষত্র ওয়াশরুমের দিকে তাকালো। আলো জ্বলছেনা ভেতরে। যার অর্থ ইরিন নেই ওখানে। ভ্রু কুচকে গেল নক্ষত্রের। কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে পা বাড়ালো ব্যালকনিতে। দরজার কাছে যেতেই খুঁজে পেল ইরিনকে। খোলা চুলে গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। শুকতারাটা এখনো মেলায়নি মেঘের আলোতে। ওটাই দেখছে বোধয় সে।
পুতুলকে একা রেখে এভাবে এ সময় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকাটা মোটেও পছন্দ হলো না নক্ষত্রের। নারাজ গলায় ইরিনকে ডাকলো সে।
‘পুতুলের আম্মু?’
ইরিন কোন জবাব দিল না।আরও মেজাজ খারাপ হলো নক্ষত্রের। কঠোর গলায় বললো,
‘এই সময় এভাবে এখানে কি করছো তুমি? তাও পুতুলকে ঘরে একা রেখে?’
‘আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা ক’রে গেছি ; যে নক্ষত্র – নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার বার দিয়ে গেছে বাঁধা
আমি তা ভুলিয়া গেছি ;
তবু এই ভালোবাসা – ধুলো আর কাদা।
_জীবনান্দ দাশ
ইরিনের মুখে কথাগুলো শুনে চমকালো নক্ষত্র। ইরিন কি কোন কারণে কষ্টে পেয়েছে নতুন করে? প্রশ্ন জাগে নক্ষত্রের মনে। নক্ষত্র উত্তর খুঁজে পায় না। ভাবনার চাকা মস্তিষ্ক ঘুরে সতর্ক করে, ইরিন কি তবে পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে করছে আবার? অতীতের সেই বিভৎস স্মৃতি, বেদনার দিনগুলি কি এখনো হুটহাট উৎপাত শুরু করে তার মন মস্তিষ্কের আঙিনায়? ভাবনাগুলো মাথায় আসতেই নক্ষত্র দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল ইরিনের কাছে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে ডাকলো, ‘পুতুলের আম্মু?’
ইরিন এবারেও জবাব দিল না। নক্ষত্র টের পেল ইরিনের শরীর মৃদুবেগে কাঁপছে। ঠিক যেমন ভেঙে চূড়ে কান্না পেলেও তা নিরবে গিলে নেওয়ার চেষ্টায় হয়। তবুও কান্না শব্দবিহীন উপচে পড়ে বাঁধভাঙা স্রোতের মতই।
নক্ষত্র এবারে দুহাতে ইরিনের বাহু চেপে ধরে একপ্রকার টেনেই নিজের দিকে ফিরালো। আজ জোছনা নেই। ভোরের আকাশ জেগে উঠতে শুরু করেছে সবেমাত্র। নিজের নৈসর্গিক রূপে ঘিরে ফেলেছে সমগ্র আকাশ। খুব স্পষ্ট না হলেও দেখতে পাওয়া যাবে এতটা আলোকিত হয়ে আছে চারপাশ। এই নৈসর্গিক মূহুর্তটায় এক অশ্রুমাখা বিদ্ধস্ত রমনীর মুখোমুখি হলো নক্ষত্র। ভেতরটায় বেশ ধারালো ভাবেই কিছু একটা খাঁমচে ধরলো তার।
ইরিনকে শেষ কাঁদতে দেখেছিল পুতুলের যেদিন জন্ম হলো সেদিন।ও.টির টেবিলে শুয়েই পিচ্চি শরীরটাকে বুকে নিয়ে খুব কেঁদেছিল সে। এরপর সামনাসামনি তাকে আর কখনো কাঁদতে দেখেনি নক্ষত্র। দূরত্ব এতটাই রেখেছিল যে দুঃখ, ব্যাথা নিয়ে মুখোমুখি হওয়া হয়নি আর কখনো তাদের। সবটাই ছিল দুজনের আঁড়ালে। কিন্তু এতকাল পরে ইরিনের এমন বিদ্ধস্ত সিক্ত চোখ মুখ দেখে পুরোনো অস্থিরতা আবার জেগে উঠলো নক্ষত্রের। ইরিনের কান্না যে কখনোই সহ্য করতে পারতো না সে।আর না আজও সে পারে!
ইরিন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁদছে নিরবে। নক্ষত্র একহাত ইরিনের গালে রেখে মুখখানি তুলে ধরলো তার মুখোমুখি। চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে…কাঁদছো কেন তুমি?’
ইরিন এবারেও কিছু বলে না। নক্ষত্রের বিচলিত অস্থির চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবে। নক্ষত্র উত্তরের অপেক্ষা করে। ইরিনের চোখের দিকে তাকিয়ে তার মন পড়ার চেষ্টা করে।
কিন্তু, সেসবের কিছুই হলো না। ইরিন আচমকা নক্ষত্রের বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সজোরে কেঁদে ফেলে। নক্ষত্র ঘাবড়ে যায় সহসা ইরিনের এমন আচরণে। পুতুলের এ পৃথিবীতে আসার খবর পাওয়ার পর থেকে এমনভাবে আর কখনো কাউকে স্পর্শ করা হয়নি তাদের।
নক্ষত্র নিজের সাথে হওয়া ছলনার অপরাধে স্ত্রীর মর্যাদা ও নিজের উপর ব্যক্তিগত সকল অধিকার থেকে ত্যাজ্য করেছে ইরিনকে। সেদিনের পর থেকে ইরিন কেবল দায়িত্বের খাতিরে স্বামী নামক মানুষটিকেই নিজের জন্য পেয়েছে। এমন স্পর্শ…ভালোবাসা..আদর থেকে তাকে দূরে করে দিয়েছিল নক্ষত্র। প্রবল অপরাধবোধ ইরিনকেও আর সাহস দেয়নি নক্ষত্রের সান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টা অবধি করতে।
একদিকে নক্ষত্রের কড়া নিষেধ অন্যদিকে ইরিনের নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। দূরত্ব বেড়েছে শরীরের, স্পর্শের,গভীর ভালোবাসার। তারা কেবল দায়িত্বের খাতিরে স্বামী স্ত্রী ও পুতুলের বাবা মা হয়েই কাটিয়েছে বিগত পাঁচটা বছর। তবে, মনের দূরত্ব কি আদৌ কখনো তৈরী অবধি হয়েছিল তাদের? নক্ষত্র প্রশ্নের জবাব খোঁজে না কখনো। অতীত আঁকড়ে ধরতে নেই ঠিক ; কিন্তু শিক্ষাটুকু আজীবনে স্মরণে রাখতে হয়। এই দূরত্ব ইরিনের শাস্তি ও শিক্ষা দুটোই নক্ষত্রের তরফ থেকে।
কিন্তু, এতকাল পরে এই অবেলায় ইরিনের এমন আচরণ আঁচড় কাটলো নক্ষত্রের হৃদপিঞ্জরের দরজায়। অনুভূতিরা সজাগ হয়ে ছটফট শুরু করলো। অস্থির গলায় নক্ষত্র প্রশ্ন করলো, ‘এই…পুতুলের আম্মু? সমস্যা কি? কাঁদছো কেন তুমি? না বললে বুঝবো কিভাবে কিছু আমি?? এইই..’
‘আপনি আমাকে এখনো মাফ করতে পারেননাই, তাই না পুতুলের বাবাই? ‘ কাঁদতে কাঁদতেই বললো ইরিন।
ইরিনের কথায় এবার চিন্তার ভাঁজ মিলিয়ে গেল নক্ষত্রের। একটু আগের নিজের অস্থিরতার প্রতি তাচ্ছিল্য করে কিঞ্চিৎ হাসলো সে নিরবেই। ভীষণ শান্ত গলায় বললো, ‘ কিসের জন্য মাফ করবো তোমাকে? মাফ করার মত কিছু কি করেছো তুমি? ‘
নক্ষত্রের ইংগিতটা বুঝতে পেরে এবার কষ্টে আরও বেশি কেঁদে ফেললো ইরিন। কান্না জড়ানো গলায় বললো, ‘আমি জানি আমাকে মাফ করা যায় না, কিন্তু তাও বিশ্বাস করেন পুতুলের বাবাই….আমার আর কিচ্ছু চাই না। শুধু আপনার ঘৃণা,অবিশ্বাসের পিঞ্জর থেকে মুক্তি চাই আমার।তারপর এই পৃথিবী থেকেও। আমার যে এভাবে মরে মরে বেঁচে থাকা খুব কঠিন লাগে। কষ্ট হয় অনেক। ‘
‘আমি তো বলেছিলামই, যতদিন না আল্লাহ তোমাকে মুক্তি দিবে আমি দায়িত্ব নিয়ে বাঁচায় রাখবো তোমাকে। আমার মেয়েটা মা ছাড়া বড় হচ্ছে হোক, মা হিসেবে তোমার এ দায়িত্ব তুমি পালন করতে চাওনি এটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু,জেনে বুঝে আমার মেয়েকে মা হারা হয়ে বড় হওয়ার সুযোগ আমি দিব না। ছাড়ো আমাকে। এভাবে টাচ করার অধিকার তোমার নেই আর। ‘
‘অধিকার নেই বলছেন তাহলে একেবারে মুক্তি কেন দিচ্ছেন না আমাকে? কেন স্ত্রীর মর্যাদা না দিয়েও স্ত্রীর জায়গায় ব্যবহার করছেন আমাকে?’ নক্ষত্রের কথায় তাকে ছেঁড়ে দিয়ে ফুঁসে উঠে বললো ইরিন।
‘আস্তে! পুতুল ঘুমাচ্ছে কিন্তু ঘরে। ‘ ইরিনকে সতর্ক করে দিয়ে বললো নক্ষত্র। একপলক জানলা দিয়ে ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে নিল পুতুলকে। শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে সে।
তাকে ঘুমাতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললো নক্ষত্র। ইরিনের দিকে ফিরে ঝাঁঝালো গলায় বললো,
‘ কি যেন বললি তুই? তোকে স্ত্রীর জায়গায় ব্যবহার করতেছি আমি? আরেএএ ব্যবহার তো তুই আমাকে করছিলি স্ত্রীর জায়গা ফিরে পাওয়ার জন্য। ভুলে গেছিস সব? আমি কিন্তু ভুলিনাই কিছুই। শুধু আমাকে কেন…আমার মেয়েটাকেও হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে ছাড়িস নাই তুই নিজের জন্য। তাই এখন ওর জন্যই তুই ওর বৈধ মা হয়েই থাকবি। সারাজীবন আমার স্ত্রী হিসাবেই পুতুলের মায়ের পরিচয় দিবি তুই। এইটাই তোর শাস্তি। তোরে মাফ করার কোন অপশন তুই রাখিস নাই আমার জন্য। আমি আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিছি সব অনেক আগেই। কিন্তু, এই শাস্তিটুকু থেকে তোর রেহাই নাই।’
তারপর, সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো নক্ষত্র। কিন্তু, পারলো না। পূর্বেই স্বরেই বললো, ‘ পুতুলের মা হয়ে আছিস থাক। ওর মা হিসেবে যেটুকু সম্মান অধিকার তোকে দেই তা নিয়েই খুশি থাক। এর বেশি কিছু চাইতে আসলে ভালো কিছু যে কখনোই পাবিনা সেটা মাথায় রাখিস।’
কথা শেষ করে দ্রুতপায়ে ব্যালকোনি থেকে চলে গেল নক্ষত্র। ইরিন ধম পরে বসে পড়লো মেঝেতে। অনুতাপ, আত্মদহনের উত্তাপে..যন্ত্রণায় ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো সে। এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি কি তার আদৌও হবে না কখনো?
ওয়াশরুমে দরজা আটকে মেঝেতে বসে আছে নক্ষত্র। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।কিছু সময়ের মধ্যেই আযানের ধ্বনি শুনতে সে। গভীর এক শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সে।তারপর, অযু করে তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল মসজিদের উদ্দেশ্যে। এখন এই অশান্ত মন, পুরোনো ক্ষতর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ কেবল তার রবের দরবারে গিয়েই সম্ভব। তার কাছে নিজেকে সঁপে দিলেই অযাচিত সব দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে সে। এই জায়গা যে পরম শান্তির। পরম নিশ্চিন্তের!
১৩৬.
নামায শেষ করে অনেকটা সময় নিয়ে মসজিদে বসেই দোয়া কালাম পড়লো নক্ষত্র। মন ভীষণ ভার হয়ে আছে তার।যদিও মোনাজাতে সে অনেক করে দোয়া করেছে তার এ অশান্ত মনের কষ্টগুলো লাঘব করে দেওয়ার জন্য। ইরিনের মনের শান্তি, সুখী জীবনের জন্যও দোয়া করেছে সে। নক্ষত্র জানে ইরিন তাকেই ভালোবাসে, নিজেকে তার অপরাধী ভাবে, কষ্ট পায়। কিন্তু নক্ষত্র পারে না। সে পারে না নিজের সাথে হওয়া ছলনাটুকু ভুলতে। ইরিনের সব ভুল মাফ করে দিলেও এই কষ্টটুকুর দায় থেকে তাকে মুক্তি দিতে পারে না নক্ষত্র।
সন্তান তো স্বামী স্ত্রীর মাধ্যকার দৃঢ় সেতুবন্ধ। তাকে ঘিরেই দুটো মানুষের সম্পর্ক নতুন জন্ম লাভ করে। স্বামী স্ত্রীকে বৈধভাবে বাবা মা হওয়ার স্বাদ দেয়। যার জন্য স্বামী স্ত্রী একে অন্যের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। ভালোবাসা গভীর হয় তাদের। বিশ্বাস ভরসা বাড়ে। অথচ ইরিন সেই সন্তানকে ব্যবহার করেছে নিজের জায়গা ফিরে পেতে। নক্ষত্র সব জেনে বুঝেও বাঁধা দেয়নি। কেবল তাকে রাজাহীন রাণী করে রেখেছে। সমাজের কাছে ইরিনের পরিচয় নক্ষত্রের স্ত্রী এবং তার সন্তানের মা। কিন্তু নক্ষত্র তাকে দিয়েছেন কেবল পুতুলের মা হওয়ার পরিচয়..দায়িত্ব ও অধিকার।স্ত্রীর জায়গাটায় থেকেও পায়নি তার অধিকার কিংবা মর্যাদা।
সারাদিনের ক্লান্তি নিয়েও গত রাতে ঘুমানো হয়নি নক্ষত্রের। ভারাক্রান্ত মনের সাথে ঘুম, ক্লান্তিও এবার জেঁকে বসেছে শরীরে। দোয়া কালাম শেষ করে একসময় মসজিদের মেঝেতেই এককোণায় শুয়ে পড়লো নক্ষত্র। লম্বা করে পা মেলিয়ে দিয়ে এক হাত মাথার নীচে দিয়ে শুয়ে রইলো সে।সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আজ ভোর রাতের কথাগুলো মস্তিষ্কে কড়া নাড়তে শুরু করলো। নক্ষত্র হতাশ হয়ে ক্লান্তির শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো। তার বন্ধ চোখে…মস্তিষ্কের স্মৃতিপটে ধীরে ধীরে ভীড় করতে থাকলো অতীতের কিছু খন্ড খন্ড চিত্রপট।
১৩৭.
ইরিনের আত্মহত্যা করার চেষ্টার ঘটনাটার পর পেরিয়েছে আরও তিনমাস। এর মাঝে অনেক কিছুই বদলে গেছে। সেদিনের পর থেকে নক্ষত্র প্রয়োজন ছাড়া ইরিনের সাথে কথা বলে না। ইরিনের কাছেও ঘেঁষে না খুব একটা। শুরুর দিকে যেমন ইরিন একটু নাড়াচাড়া করলেই অস্থির হয়ে ছুটে যেত, তার কিছু লাগবে কিনা…ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করতো এখন আর করে না। কেবল স্বামীর দায়িত্ব হিসেবে অসুস্থ ইরিনের খেয়াল রাখে।সেবা করে….যত্ন নেয়। ইরিনও বুঝে এসব কেবলই দায়িত্ব হিসেবে করে নক্ষত্র। ভালোবাসা কিংবা যৎসামান্য সহানুভূতিও মিশে থাকে না সেসবে।
তবে এত সব কিছুর পরেও ইরিন এখন প্রায় সুস্থই। শরীরের ক্ষতগুলো শুকিয়ে গেছে। তবে মনের ক্ষতগুলো তখনো তাজা। নক্ষত্রের নিগূঢ় সেবা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে ইরিন এখন নিজ পায়েই আবারও হাঁটতে সক্ষম।যদিও ডাক্তার এখনো খুব একটা নাড়াচাড়া করার অনুমতি দেয়নি। এখনো নক্ষত্র ধরে ধরে নিয়ে হাঁটায়। ঘরের ভেতর, বাগানেই চলে ইরিনের হাঁটাচলা। ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছাড়া বাইরে যাওয়া হয় না ইরিনের। রিতুকে আবারও নিয়ে আসা হয়েছে শেখ ভিলায়। ভাই বোনেরা যোগাযোগ, খোঁজ খবর না রাখলেও আম্বিয়া খাতুন মাঝে মধ্যে এসে দেখা করে যান দুই মেয়ের সাথে।
এমনই একদিন আম্বিয়া খাতুন আসেন শেখ ভিলায়। ইরিনের সাথে কথা বলার সময় কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেন।
‘হ্যাঁ রে ইরিন…অনেকদিন তো হইলো, তুইও মোটামুটি সুস্থ এখন। তা…আরেকটা বাচ্চা কাচ্চার ব্যাপারে ভাবছিস কিছু?’
ইরিন এ কথা শুনে প্রথমে চমকালেও পরে হাসে। তাচ্ছিল্য করেই হাসে। তাকে এভাবে হাসতে দেখে আম্বিয়া খাতুন চিন্তিত স্বরে বলেন, ‘কি রে হাসিস ক্যান এম্নে? আমি কি ভুল কিছু বলছি নাকি!’
‘তোমার কি মনে হয় আম্মা…উনি কি মানুষ না? এত কিছুর পরেও যে তোমার মেয়েকে উনি রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলেনাই, ঘরে তুলছে…এত সেবা যত্ন করতেছে এটা তো তোমার মেয়ের সাত জন্মের কপাল।তাই বলে যে উনি আমাকে মাফ করে দিছেন এমন ভাবার ভুল করো না তোমরা। ‘
‘নক্ষত্র বাবাজি ছেলে হিসেবে অনন্য। ওর সাথে অন্যদের তুলনা করিস না। সে যে তোরে কতটা ভালোবাসে সেটা আমরা সবাই বুঝি। নইলে এত কিছুর পরেও সে তোরে নিজের কাছে রাখতো না। তুই যা করছিস তোরে মাফ করা উচিৎই না আসলে। কিন্তু, তাও যখন সংসার করতেছিস এটারে ধইরা রাখ। স্বামীর মন যুগায় চল। দেখবি একদিন না একদিন ঠিকই মাফ কইরা দিবে সে তোরে।’ মেয়েকে বুঝিয়ে বললেন আম্বিয়া খাতুন।
‘উনি আমাকে সাফ সাফ বলছেন আম্মা….আমাকে স্ত্রীর পরিচয় দিলেও…আমার প্রতি দায়িত্ব পালন করলেও, উনার স্ত্রীর মর্যাদা আর অধিকার আমি পাবো না আর কখনো। উনি আমাকে আর ভালোবাসেন না আম্মা।এমনকি গত ৩ মাস ধরে প্রয়োজন ছাড়া একেবারেই কথা বলেন না আমার সাথে। আমাকে আগের মত আগলায়াও রাখেন না। শুধু দায়িত্বের খাতিরে আমি উনার স্ত্রী হয়ে গেছি। ‘ কান্না জড়ানো ব্যাথিত কন্ঠে বললো ইরিন।
আম্বিয়া খাতুনও ব্যাথিত হলেন মনে মনে মেয়ের এমন করুন দশা শুনে। খানিক ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘শোন ইরিন….পুরুষ মানুষের মনে একবার আঘাত দিলে এরা সহজে ভুলে না সেইটা। যারে সত্যিকারে ভালোবাসে তার আঘাত বড় কঠিন আঘাত তাদের জন্য।আমরা মেয়ে মানুষেরা নরম মনের হই। ভালোবাসার মানুষ একটু আদর সোহাগ দিলেই মন গইলা যায়। মাফ কইরা দেই। কিন্তু, পুরুষ মানুষ এত সহজে সেইটা পারে না।
আর তুই নক্ষত্র রে যে কষ্ট দিছিস সেটা অনেক বেশি। তাও তোরে বলি , তুই তার মন ফিরানোর চেষ্টা কর। আরেকটা বাচ্চা নে। পুরুষ মানুষ যতই কঠিন হইক না ক্যান, তাদের একটা দূর্বলতা কিন্তু মাইয়া মানুষের টান। তুই তারে আদর সোহাগ দিয়া বানতে(বাঁধতে) পারলে সে তোরে ফিরাইতে পারবো না। তাও আবার সে তোরে ভালোবাসে। তুই কাছে টানলে ফিরাইবো না দেখিস। আর বাচ্চা কাচ্চা হইলো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সেতুবন্ধন। দুইজনরে একলগে বাইন্ধা রাখে। একখান বাচ্চা আইলেই দেখবি জামাই বাবাজি আবার আগের মত সোহাগ করবো তোরে। যত যাই হোইক, তার সন্তানের মা রে তো আর অবহেলা করবো না সে। ‘
ইরিন অবাক হয়ে শুনলো আম্বিয়া খাতুনের কথাগুলো। গ্রামের মানুষের ধ্যান ধারণা হিসেবে তার মায়ের যুক্তিগুলো ভুল না। কিন্তু, ইরিন জানে নক্ষত্রের মন কতটা কঠিন। প্রায় দেড় বছর সে এই মানুষটার সাথে আছে। খুব অল্প সময়ে অনেক ভালো খারাপ ভিন্ন ভিন্ন সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে তাদের বিবাহিত জীবন। সামনে এসেছে অনেক অজানা অতীত। নক্ষত্রকে নতুন করে জেনেছে সে। আবিষ্কার অন্ধকারের গভীরে জেগে থাকা এক অনন্য নক্ষত্রের। যার ভালোবাসা, স্নেহ, দায়িত্বশীলতা আবার শাসনের মত ভিন্ন ভিন্ন রূপের মায়ায় জড়িয়েছিল সে। অথচ, সেসব বুঝতে না পেরে মনের বিভ্রান্তিতে পড়ে কি বড় ভুলটাই না করেছে সে। কতটা কষ্ট দিয়েছে সে নক্ষত্রকে। এসব ভাবলেই এখন দমবন্ধ লাগে ইরিনের। মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু, সেদিনের চেষ্টার পর নক্ষত্রের যে রূপ তার সামনে এসেছে এরপর আর সাহস হয়নি নিজ থেকে মরতে চাওয়ার।
হতাশা গলায় ইরিন বললো, ‘সব পুরুষ এক হয় না আম্মা। যে পুরুষ ভালোবাসে সে শরীর নিয়া টানা হ্যাঁচড়া করে না।লোভ করে না। ভালোবেসে কাছে টানে। আর উনার মনে আমার জন্য ভালোবাসাটাই শেষ হইয়া গেছে। আমার এই সংসার আমার শাস্তি আম্মা। উনি আমাকে ছাড়বেন না কিন্তু কাছেও টানবেন না। এইসব বাচ্চা কাচ্চা নতুন জীবন সব কেবলই কল্পনা ।যেইটা কোনদিন বাস্তব হবে না আমার জীবনে। ‘
‘তুই একবার চেষ্টা তো কইরা দেখ…একটা বাচ্চা হইলেই দেখবি জামাইয়ের মন নরম হইবো। তোরে সে ভালোবাসে। তুই কাছে টানলে কতক্ষণ আর দূরে থাকবো সে?এক না এক সময় ধরা দিবোই।’
‘উনি আমাকে ছুঁবেনও না আম্মা। আর না আমি পারবো এই নোংরা শরীরে উনার মত পবিত্র মানুষের আরশ রে জায়গা দিতে। তুমি আর এইসব কথা বইলো না। ‘
‘শোন রে মা…..তুই ভুল করছিস, শাস্তিও তুই পাইছিস। কিন্তু এইভাবে কি জীবন চলবে? তোর জন্য কি জামাই বাবা হওয়ার স্বাদটুকুও পাবে না?’
‘আমি তারে বলছিলাম আম্মা, আমাকে ডিভোর্স দিতে। উনি আমাকে আবারও চড় মারছিল।এই নিয়া দুই দুইবার চড় মারছেন উনি আমাকে । ‘ ব্যাথিত অভিমানী গলায় বললো ইরিন।
‘ভালো করছেন। তোর সাহস ক্যাম্নে হয় তালাক চাওয়ার? নিজ হাতে নিজের সর্বনাশ করতে চাস ছ্যামড়ি, তোরে তো আরও কয়েকটা চড় মারতাম আমি হইলে। ‘ ঝাঁঝালো গলায় বললেন আম্বিয়া খাতুন।
‘আম্মাআআ…!!’ আহত স্বরে বলে ইরিন।
‘কিসের আম্মা? যা বলতেছি শোন। আরেকটা বাচ্চা নে। সংসার কর মন দিয়া। এমন ভাগ্য সবার হয় না রে ইরিন। তুই যে কি ভাগ্য নিয়া এমন স্বামীর পাইছিস আল্লাহ মালুম। এইটারে যত্ন কইরা ধইরা রাখ। নইলে যা হইছে, আমি হইলে তোরে বিষ খাওয়ায় মাইরা ফেলতাম। অথচ নক্ষত্র তোরে নিয়া সংসার করতেছে এখনো।’
‘আচ্ছা…দেখি। ‘ দ্বিধা জড়িত গলায় বললো ইরিন।
‘জলদি করিস। পুরুষ মানুষ যতই ভালো হইক, সুযোগ মত মন ঘুরতে সময় লাগে না।।দুইজনের মাঝে এমন দূরত্ব রাখিস না যে কোন দিক দিয়া সে মন বদলায় ফেলবো আর তুই টেরও পাবি না। হাজার হইক, আমি তো মা। মেয়ের সংসার ক্যাম্নে টিকবো এই চিন্তা আমারও কম না। ‘ নিজের জায়গা থেকে বুঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে বললেন আম্বিয়া খাতুন।
ইরিন ভাবনায় পড়ে গেল তার কথাগুলো নিয়ে। প্রথমে মন পাত্তা না দিলেও নক্ষত্রকে ফিরে পাওয়ার লোভাতুর মনটা তাকে খুঁচাখুঁচি করতে শুরু করে দিয়েছে আম্বিয়ার কথায় সায় দিতে। ইরিন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। মন বলে, নক্ষত্র বাবা হতে চায়।এই সুখটুকু যদি সে দিতে পারে নক্ষত্রকে তবে কি তার ভুলের কিঞ্চিৎ হলেও ক্ষমা মিলবে? যদি মিলে যায়? একটা সুযোগ তো নেওয়াই যায়। একটা বাচ্চা আর এমন কি? সে নিজেও তো নক্ষত্রের সন্তানের মা হতে চেয়েছিল। নওরিনকে গর্ভে ঠাই দিয়েছিল। আরেকবার কি সেটুকু করা যায় না? এর জন্য হলেও নক্ষত্র যদি তাকে আবার ভালোবাসে…ক্ষতি কি!!
১৩৮.
দিন কয়েক পরের ঘটনা।ইরিন এ ক’দিন অনেক ভেবেছে। আম্বিয়া খাতুনের বাতলে দেওয়া পথটায় একবার হাঁটলে কি খুব বেশি খারাপ হবে? ইরিনের মন বারবার একই উত্তর দেয়, চেষ্টা করতে দোষ কি। নক্ষত্র তো এমনিতেও ইরিনকে সবভাবে নিজের থেকে দূরে করে দিয়েছে। এবার যদি রাগ হয় বেশি কি আর করবে….মারবে? নয় তো ডিভোর্স দিবে তাকে। কিন্তু, ভালো থাকার জন্য এটুকু চেষ্টা তো সে করতেই পারে। তারপর যা হওয়ার হোক। সে মেনে নিবে সবটাই। তবুও নক্ষত্রের খুশির জন্য এটুকু সে করবেই!
একরাতে ইরিন প্রস্তুত করলো নিজেকে। নক্ষত্রের কাছে নতুন করে নিজেকে সঁপে দেওয়ার জন্য। সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে নারীরা কত কিছুই না করে! ইরিন না হয় একটু বেহায়াই হলো। নিজের পঁচে যাওয়া শরীর দিয়েই নক্ষত্রকে কাছে পাওয়ার চেষ্টা করুক সে।
রাতে শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল নক্ষত্র। বিছানা ঠিকঠাক করে শুতে যাবে সেই মূহুর্ত ইরিন এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। নক্ষত্র চমকালো প্রথমে হঠাৎ ইরিনের এমন আচরণে। কারণ গত ছয় মাসে ইরিন নিজকে বেশ গুটিয়ে নিয়েছিল নক্ষত্রের থেকে। নক্ষত্রের সামান্য স্পর্শেও অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে থাকতো।তবুও কেবল অসহায়ত্বের কারণে নক্ষত্রের কাছে নিজেকে ছাড়তে হয়েছে ইরিনকে। তাছাড়া আত্মহত্যার চেষ্টার পর থেকে নক্ষত্রও খুব একটা কাছে যায়নি তার।কাঁদলেও আগলে নেয়নি নিজের বুকে।
তাই আজ হঠাৎ ইরিনের এই আচরণ তার জন্য চমকই বটে।
‘কি সমস্যা? ‘ ইরিনের হাত সরিয়ে দিয়ে বিরক্তির স্বরে বললো নক্ষত্র।
ইরিন এতে মন খারাপ করলো না। সে জানেই এমন আচরণ তার জন্য স্বাভাবিক। সে হাল ছাড়লো না। এবার সরাসরি নক্ষত্রের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে চোখ তুলে তাকালো নক্ষত্রের মুখপানে। নক্ষত্র খেয়াল করলো ইরিনের পড়নে বাসর রাতের সেই কালো লেহেঙ্গা। সেই গয়নাগুলোই যেগুলো নক্ষত্র নিজে পছন্দ করে তার জন্য কিনে ছিল। একদম সেদিনের মত করেই সেজেছে ইরিন তার জন্য। যে রূপের প্রেমে পড়েছিল সে বাসররাতেই।অথচ ভালোবেসে কাছে টানতে পারেনি তার নব্য বিবাহিত স্ত্রীকেই। মনের সংশয় সেদিন সেই অধিকারে লাগাম টেনেছিল আর আজ মনের ক্ষততে এই রূপ…এই নারী বিক্ষিপ্ত চিত্রপট।
‘আমি ঠিক কি করলে আপনি আমাকে মাফ করবেন বলবেন প্লিজ?’ বেশ সাহস নিয়ে অনুতপ্ত গলায় বললো ইরিন।
এতক্ষণে নক্ষত্রের কাছে ইরিনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হলো। ইরিনকে আগাগোড়া আরেকবার ভালো করে দেখে বাঁকা হাসলো সে। ইরিন বিভ্রান্ত চোখ মুখে সে হাসির রহস্যে ডুবে গেল। কিন্তু কিছু উদ্ধার করতে পারলো না। নক্ষত্র বললো,
‘কি চাই তোমার ইরিন?’
‘আমি নিজ ভুলে যা হারিয়েছি। ‘
‘তুমি ঠিক কি হারিয়েছো সেটাই তো তুমি জানো না। অথচ ফেরত পাওয়ার আশা করছো।’
‘আপনি কি আমাকে আর একটুও বিশ্বাস করেন না?’
‘পুরোপুরি অবিশ্বাস করিনা।’
‘তাহলে যদি বলি আমি আপনাকে ভালোবাসি….বিশ্বাস করবেন আপনি?’
‘ভুলেও অবিশ্বাস করবো না। আমার অনুভূতি এতটাও ভুল হওয়ার নয়। আগেই বলেছিলাম তুমি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো। কিন্তু, আমি তোমাকে ভালোবাসি না আর। তোমার সাথে এখন আমার কেবল দায়িত্বে সম্পর্ক। ‘
‘নক্ষত্র……প্লিইইইজজজ!!’
‘দেখি সরো..শুতে দাও। রাত বিরাতে আর নাটক করো না। ঘুমাও।’ কথাটা বলে ইরিনকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় নক্ষত্র। বিছানার কাছে যেতেই ইরিনের কথায় থমকে দাঁড়ায় সে।অনেকটা কঠিন স্বরে ইরিন বলে,
‘দায়িত্বের সম্পর্ক তাহলে দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কেন?’
‘মানে?’ বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করে নক্ষত্র।
‘স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব কি শুধুই অর্থ সম্পদের? তার অন্যসব চাহিদা মেটানোর দায় কি নেই আপনার?’
নক্ষত্র ইরিনের কথার ধরণে রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। ইরিন একরোখা, জেদি বলে সে জানলেও নক্ষত্রের সাথে এমন কঠিন গলায় কথা বলার সাহস সে করেনি কখনো। নক্ষত্র মিনিট খানিক সময় নিয়ে ভাবলো কিছু একটা। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ইরিনের দিকে। ইরিন কাঁদছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। নক্ষত্র তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক হাতে তার থুতনিতে ধরে মুখ হালকা উঁচু করে ধরলো। ইরিন কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। একবার যখন সাহস করে এগিয়েছেই যত যাই হোক এই পথ সে পাড়ি দিয়েই ছাড়বে।
‘আমার দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলছো তুমি? জবাবটা সহ্য করতে পারবে তো ইরিন? সেই ক্ষমতাটুকু নিয়েই প্রশ্ন তুলেছো তো??! ‘একদম ঠান্ডা গলায় হুমকির মত করে বললো নক্ষত্র।
ইরিনও নিজের জেদ থেকে নড়লো না। শক্ত গলায় বললো, ‘সহ্য না করতে পারলে শেষ হয়ে যাবো। তবুও আপনার অপরাগতার অভিযোগ তো আর থাকবে না। প্রশ্নও উঠবে না।’
‘বেশ।’ ইরিনের চোখে চোখ রেখে বললো নক্ষত্র। কথা শেষ করে এক মূহুর্তও দেরি করলো না নক্ষত্র। ইরিনের ঘাড়ের পেছন দিয়ে হাত নিয়ে চুলের ভাজে আঙুল ডুবালো। শক্ত করে চেপে ধরলো তাকে। চুলে টান পড়ায় ব্যাথায় চোখ মুখ খিঁচে গেল ইরিনের। তবুও টু শব্দটি না করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নক্ষত্র অন্য হাতটা তার কোমড়ে রেখে শক্ত হাতে কোমড় চেপে কাঁছে টেনে আনলো তাকে। মিশিয়ে নিল নিজের সাথে। সি সেকশনের ধাক্কাটা এখনো পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি ইরিন। ভারী কোন কাজ করতে পারে না। চাপ সহ্য করতে পারে না। ব্যাথা হয় প্রচুর। নক্ষত্রের এমন শক্ত হাতের চাপে ব্যাথায় ঝনঝন করে উঠলো সমস্ত শরীর। তবু সে সহ্য করে দাঁড়িয়ে রইলো।
নক্ষত্র কয়েকমুহূর্ত ইরিনের কঠিন মুখখানা তাকিয়ে দেখলো। কালোর গভীরতার মাঝে নারীর কঠিন মুখখানি এক অনন্য রূপের প্রতিচ্ছবি। এরূপ প্রেমে ফেলতে বাধ্য। হিংস্র হতে বাধ্য করার মত। নিজের কামনাকে অবলীলায় লাগামহীন করার জন্য যথেষ্ট।
নক্ষত্র সময় নষ্ট করলো না। পাঁজকোলা করে কোলে তুলে নিল ইরিনকে। অতঃপর, স্বামীর দায়িত্ব পালন হলো।নিজের অপরাগতার অভিযোগও মিথ্যা করে দিল নক্ষত্র। বিপরীতে,বিদঘুটে কালো আঁধার রাতে আরও একটা ভুলের সাক্ষী হলো ইরিনের বিদ্ধস্ত শরীর -মন।
চলবে…