নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_২৯ দ্বিতীয়াংশ শেষ

0
735

নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_২৯ দ্বিতীয়াংশ শেষ
লেখায়_জারিন

১৬৭.

আজ দুদিন হলো ওয়াসিফ রিমান্ডে। এখন পর্যন্ত কিছু স্বীকার করেনি সে। এই দুদিন কর্মরত অফিসার আলম সরকার অনেকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কিছুই স্বীকার করাতে পারেননি। আজ শেষ দিন। আগামীকাল ওয়াসিফকে কোর্টে পেশ করা হবে আবারও। ইতোমধ্যে আলম সরকারের হাতে ছবির পরীক্ষণের রিপোর্ট এসেছে যা প্রমাণ করছে যে ছবিটা সত্যি। এছাড়াও তিনি আগের তদন্তকারী অফিসার এস.আই খালিদের সাথেও কথা বলেছেন এ ব্যাপারে। তার মুখে ইরিনের ও ঘটনা বর্ণনা শুনে ভীষণ খারাপ লেগেছে তারও।

যতই তারা আইনের লোক হিসেবে এমন কেস অহরহ দেখুক, মানুষ তো তারাও। একজন গর্ভবতীর সাথে এমন নির্মম আচরণ মানা যায় না। তাই তিনিও কেসটি খুব গুরুত্বের সাথে দেখছেন। অথচ এত সব প্রমাণের পরেও আজকের মধ্যে যদি স্বীকারোক্তি না নিতে পারে ব্যাপারটা তার ব্যর্থতা প্রমাণ করবে।যেটা তিনি একদমই চাননা।

দুদিন ধরে ওয়াসিফের উকিল রিমান্ডরুমের বাইরে উপস্থিত থাকছেন প্রায় সময়। কাঁচ ঘেরা সাদৃশ্য রিমান্ড রুমের বাইরে থেকে জিজ্ঞাসাবাদের পুরোটাই উনি দেখেন। আজ তাকেই টার্গেট করলেন আলম সরকার। আরও একদফা জিজ্ঞাসাবাদের পরেও যখন আজও কিছু স্বীকার করলো না মেজাজ খিঁচে গেল অফিসারের। যদিও রিমান্ডে থাকা অবস্থায় কোন আসামীকে আঘাত করা নিষেধ তবুও তিনি উঠে গিয়ে ওয়াসিফের চুলের মুঠি টেনে ধরলেন।

রাগে গমগমে স্বরে বললেন, ‘শালা রেস্পিট! গন্ডারের চামড়া নিয়া ঘুরিস? ভয়ডর কিছু লাগে না, নাহ? থার্ড ডিগ্রি চিনস? দুই এক ঘা পড়লেই গলগলায়া সব বইলা দিতি। নিয়মের দায়ে পড়ে ভদ্রতা দেখাইতেছি বলে ভাল্লাগাতেছে না তোর। যাহ…আর দেখাবো না ভদ্রতা। আধাঘণ্টা সময় দিলাম। চিন্তাভাবনা কর। ভালোই ভালোই স্বীকারক্তি দিলে ভালো…নইলে জামাই আদরের জন্য তৈরী হ। ‘

কথা শেষ করে ওয়াসিফের চুলের মুঠি ছেড়ে দিলেন আলম সরকার। ওয়াসিফকে ভাবার সময় দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ওয়াসিফ বললো, ‘রিমান্ডে নেওয়া আসামীর ফিজিক্যাল বা মেন্টাল কোন ক্ষতি হলে আপনিই কিন্তু ফেঁসে যাবেন অফিসার। সো, এসব জামাই আদর আপনি ওই অশিক্ষিত ছিচকে চোর, খুনি, কিডন্যাপারদের জন্য তুলে রাখুন বরং। আর হ্যাঁ, আমার লয়ারকে কাইন্ডলি একটু ভেতরে পাঠান। জরুরি কথা আছে।’

ওয়াসিফের এমন গা ছাড়া আচরণে রাগের পারদ তরতর করে বাড়লো আলম সরকারের। উনি তেড়ে এসে ওয়াদিফের গাল শক্ত করে চেপে ধরে বললেন, ‘জামাই আদরের নিয়ম বোধয় এখনো ঠিকঠাক জানা নাই তোর।এমন আদর দিবো না…যে মেডিকেল টেস্টে তো ধরা পড়বেই না তুইও শালা সত্যি বলবি গড়গড়ায়া। ‘

ওয়াসিফ আলতো হাসলো অফিসারের কথায়, যা অফিসারের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল এক নিমিষেই। ওয়াসিফকে ফেলে রেখে বেরিয়ে গেলেন তিনি। যাওয়ার সময় বাইরে ব্যারিস্টার খানকে দেখে বললেন, ‘কি খবর মি. খান?’

‘এই তো।কিন্তু, আমার ক্লাইন্টের সাথে একটু আগে আপনি যে আচরণটা করলেন তার জন্য যে আমি আপনার নামে কোর্টে কমপ্লেইন করতে পারি এটা জানেন আপনি?’

‘প্রমাণ দেখান।’

‘মানে?’ ভড়কে গিয়ে প্রশ্ন করলো মি. খান।

‘আপনার ক্লাইন্টকে টর্চার করেছি বলে কমপ্লেইন করবেন বললেন না? ওটার প্রমাণ চাইছি। কোর্ট তো প্রমাণ ছাড়া কিছুই দেখেনা। কারণ আইনের চোখ তো জন্ম থেকেই মেকি অন্ধ। প্রমাণ ছাড়া সে চোখ খুলে কিছুই দেখতে চায় না। তা এটুকু কি আপনি ভিডিও করেছেন? ‘

‘না।’ বোকাস্বরে বললেন মি. খান।

অফিসার হাসলেন তার উত্তরে। তারপর, বুঝ দেওয়ার মত করে বললেন, ‘একটা ভালো সাজেশন দেই। আপনি তার সাথে গিয়ে দেখা করুন। ভদ্রমত স্বীকারোক্তি দিতে বলুন। নইলে এমন থেরাপি আর কেস ঠুকে দিবো না যে সোজা ফাঁসির দঁড়িতে ঝুলবে আপনার ক্লাইন্ট। স্বীকারক্তি না দিলে আবার রিমান্ডে নিবো।কিন্তু শাস্তি তো তার হবেই। এখন যা ভালো মনে হয় করুন, যান। আমি লাঞ্চ শেষ করে আবার আসবো। আর এবার জামাই আদরের বন্দোবস্ত সমেত আসবো। মাইন্ড ইট।’ কথাগুলো বলে উনাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন অফিসার। মি. খান এবার সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেলেন। কি করবেন না করবেন ভাবতে ভাবতেই পা বাড়ালেন ওয়াসিফের সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য।

১৬৮.

‘সো…মি. ওয়াসিফ রায়হান চৌধুরী, কি ভাবলেন? কি করবেন এখন?’

‘আই উইল কনফেস। আপনি কনফেশন নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।’

‘বাহ! একেই বলে কান টানলে মাথা এমনিতেই চলে আসে। ঢিল তবে জায়গামতই পড়েছে। ‘ বিদ্রুপ করে হেসে বললেন অফিসার আলম। তারপর, উপস্থিত কন্সটেবলকে উচ্চস্বরে ডেকে বললেন,

‘এই হাবিব সাব.. যান খাতা পত্র আর রেকর্ডার নিয়া আসেন। আসামী জবানবন্দি দিবে। যান জলদি।’

‘জ্বী, স্যার।’ কথাটা বলেই কন্সটেবল হাবিব ছুটে গেলেন জিনিসপত্র আনতে। সেই সময়ে অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, ‘হঠাৎ মত বদল করলেন যে?’

‘থাবা দেওয়ার আগে দু কদম পিছিয়ে আসাটাই বাঘের আক্রমণাত্মক নীতি। ‘

‘আপনি নিজেকে বাঘ মনে করেন?’ ব্যাঙ্গ করার স্বরে প্রশ্ন করে অফিসার।

‘বাঘ তো নিজেকে বাঘই মনে করবে, অফিসার।এটাই তো স্বাভাবিক। ‘

‘যাক তাও ভালো, আপনি নিজেকে মানুষ মনে করেন না। তবে পশু হিসেবে বাঘও আপনি নন। আপনাকে শুয়রের সাথে তুলনা করলেও বোধয় ওটার অপমান করা হবে।এতটাই নিম্নমানের জানোয়ার আপনি।’ প্রথমে বিদ্রুপের স্বরে বললে শেষে রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন অফিসার।

তার এমন কথায় সজোরে হেসে উঠলো ওয়াসিফ। হাসতে হাসতেই বললো, ‘আপনি যাই মনে করুন না কেন অফিসার,আই ওয়াজ দি কিং অফ দ্যা গেম এন্ড আই উইল বি দ্যা কিং এ্যাট দ্যা এন্ড! ডু হোয়াট এভার ইউ অল ক্যান ডু।আই ডোন্ট কেয়ার এ্যাাট অল।’

ওয়াসিফের এমন ধরণের কথায় মেজাজ আরও খিঁচে গেল অফিসারের। কিন্তু, এখন মেজাজ গরম করা যাবে না। ঠান্ডা মাথায় স্বীকারক্তি নিয়ে কেস সাজাতে হবে। তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, সর্বোচ্চ কঠিন শাস্তি পাওয়ার মত করেই কেস সাজাবেন। যাতে আলাদত সর্বোচ্চ শাস্তিটাই ওয়াসিফের জন্য নির্ধারণ করে।

‘স্যার, সব রেডি। ‘ পেছন থেকে কন্সটেবল হাবিব বললো অফিসারকে।
অফিসার রেকর্ডার অন করে কন্সটেবলকে স্বীকারোক্তি লিখিতভাবে নেওয়ার জন্য বললেন।তারপর, তিনি নিজে চেয়ার টেনে ওয়াসিফের মুখোমুখি বসে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন।

‘মিসেস. ইরিনের সাথে আপনার কি কোন পূর্ব শত্রুতা ছিল?’

‘না।’

‘তাহলে তার ধর্ষণ করে তাকে খুন কেন করতে চেয়েছিলেন?’

‘ইরিনের রেপ বা মার্ডার কোনটাই করার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না। হুট করেই হয়ে গেছে।’

‘কারণ?’

‘আমার আদৃতকে পছন্দ ছিল না ছোট বেলা থেকেই। ওর জন্য ওর দাদী ফরিদা শেখ কখনোই আমাকে আদর করতো না। অথচ আমিও তার মেয়ের একমাত্র ছেলে ছিলাম। ‘

‘তাহলে মি. আদৃতর প্রতি প্রতিশোধ প্রবণ হয়েই এই কাজ করেছেন আপনি?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু, মিসেস. ইরিন নিজের বয়ানে বলেছেন আপনি আপনার মায়ের প্রোরচনায় প্রতিশোধ প্রবণ হয়ে দুজনে মিলে ওসব প্ল্যান করেছিলেন?’

‘মিথ্যা বলেছে। আমার মা এসব কিছুর সাথে জড়িত নয়। ‘

‘তো এত বড় ঘটনা উনি মিথ্যামিথ্যি বানিয়ে বলেছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘মিথ্যা আপনি বলছেন ওয়াসিফ। ইরিনের আপনার মায়ের সাথে কোন শত্রুতা নেই যে তাকে নিয়ে এভাবে মিথ্যা বলবেন তিনি।’ রাগে চেঁচিয়ে বললো অফিসার।

‘ইরিন আমার প্রতি প্রতিশোধ নিতেই আমার মাকে জড়িয়েছে। সে এবং বাকিরাও খুব ভালো করেই জানে আমার মাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। বলতে পারেন একদম মাম্মাস বয় আমি।’

‘এক্স্যাক্টলি! টেবিলে সজোরে থাবা দিয়ে উৎফুল্ল স্বরে বললেন অফিসার।’

‘হোয়াট? ‘

‘আপনি আপনার মায়ের বাধ্যগত ছেলে। তো হতেই তো পারে তাকে বাঁচানোর জন্য আপনি মিথ্যা বলছেন।’

‘আমি মিথ্যা বলছিনা। মা সত্যিই এসবের সাথে ইনভলভড নয়। তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণও পাওয়া যায়নি। সো, কিপ হার আউট ফ্রম অল দিস ননসেন্স। ‘

‘ওকে..ফাইন। তাকে না জড়ালাম। এরপর বাকিটা বলুন। কেন ইরিনের রেপ করেছিলেন? আর তাকে খুন করতে চাওয়ার উদ্দেশ্য কি ছিল?’

‘বললাম তো, আদৃতকে আমার কখনোই পছন্দ ছিল না।আর ইরিনকে ও খুব ভালোবাসতো। কিন্তু, ইরিন ওকে ভালোবাসা তো দূর ওকে পছন্দ পর্যন্ত ছিন না ইরিনের।ফ্যামিলির চাপে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিল। আমি এটাকেই ইউজ করি। ইরিন আমাকে পছন্দ করতো মনে মনে। ছাই চাপা আগুণের মত। আমি সেটা আন্দাজ করতে পেরে হাওয়া দেওয়ার কাজটা করি জাস্ট। ইরিন আদৃতকে ছেড়ে আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি রাজি হই। তারপর,লন্ডনে ফিরে যাওয়ার কয়েকমাস আমাদের সম্পর্ক চলতে থাকে। কিন্তু, শালী বেড শেয়ার করে একজনের সাথে অথচ আমাকে টাচ করতে পর্যন্ত দিতো না। ‘

‘এটাই আপনার উনার প্রতি রাগের করাণ?’

‘হ্যাঁ।’

‘এই জন্যই রেপ করেছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘মিথ্যা বলে লাভ নেই মি. ওয়াসিফ। উল্টা আরও বাজেভাবে ফেঁসে যেতে পারেন। আপনার লয়ার বলেছেন নিশ্চয় এ ব্যাপারে আপনাকে?’ শান্ত গলায় হুশিয়ারি দিয়ে বললেন অফিসার।

‘আ’ম নট লায়িং।’ নির্বিকার স্বরে বললো ওয়াসিফ।

‘ইয়েস…ইউ আর।’ চেঁচিয়ে বললেন অফিসার।তারপর আবার বললেন,

‘ভদ্রভাবে মুখ সত্যি বলুন ওয়াসিফ। নয়তো পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টার চার্জ লাগিয়ে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিতে অসুবিধা হবে না আমার।’

‘ওকে…কুল ডাউন। বলুন, কি সত্যি জানতে চান?’আপোষের স্বরে বলে ওয়াসিফ।

‘মিসেস. ইরিন যা বলেছেন সব সত্যি?’

‘নট কমপ্লিটলি। ‘

‘ভণিতা বাদ দিয়ে সরাসরি বলুন সবটা।’

‘ইরিন প্রেগন্যান্ট এটা আমার সহ্য হয়নি।আমি চেয়েছিলাম বাচ্চাটা এবোর্ট করতে কিন্তু ইরিন রাজি হয়নি। বাচ্চাটাকে আদৃতর কাছে রেখে যেতে চেয়েছিল। আদৃতর বাচ্চার ভীষণ শখ ছিল। সে তখনো আমার আর ইরিনের সম্পর্কের আর অতসব প্ল্যানিং এর কথা কিছুই জানতো না। আমি চাইনি ইরিন কোন পিছুটান রেখে যাক। আদৃতর জন্য ও আমাকে এভোয়েড করছিল। তাই ডিসাইড করি ওকে একেবারে আমার সাথে লন্ডন নিয়ে যাবো।’

‘তারপর?’

‘ইরিন রাজি না হওয়ায় আমি ওর কথা মেনে নেওয়ার ভান করি। শর্ত হিসেবে ডিভোর্স পেপার সাইন করাই। তারপর, প্ল্যান মোতাবেক ওর খাবারে স্লিপিং মেডিসিন মিশিয়ে দেই। ও বমি করার কার সবটা ফেলে দেয়। কিন্তু ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যায় আমার রুমেই। আমি এই চান্সে ওকে হাই ডোজের ঘুমের ইনজেকশন পুশ করি। একর্ডিং টু মাই প্ল্যান, মেডিকাল ইস্যুতে ওকে আমার সাথে লন্ডন নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি। কিন্তু, যেদিন যাওয়ার কথা সেদিন আমার ভুলের কারণে ইরিনের লাস্ট ডোজের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয় না। ইরিনের ঘুম ভেঙে যায়। ফোনে জ্যাকের সাথে লন্ডন কিভাবে যাবো এবং পরবর্তি প্ল্যান কি হবে সেটা ডিসকাস করার সময় ও শুনে নেয়। আমার সাথে কথাকাটাকাটি হয়।সেই থেকেই আমার রাগ উঠে যায় আর আমি ওর রেপ করি। ‘

‘শালা জানোয়ার তুই! একটা প্রেগন্যান্ট মহিলাকে রেপ করার সময় বাচ্চাটার কথাও মাথায় আসে নাই তোর?’ রাগে চেঁচিয়ে বললেন অফিসার।

‘না। আমি তো চেয়েইছিলাম বাচ্চাটা না জন্মাক। সো, যার মরার কথা সে যেভাবেই মরুক তাতে আমার কি! আর এমনিতেও আমি বাচ্চাটার কোন ক্ষতি করিনি। এক্সিডেন্টলি ডেথ হয়েছিল বাচ্চাটার। ইরিন ফ্লোরে পড়ে গেছিল।’

অফিসারের আর সহ্য হলো না ওয়াদিফের এমন নির্বিকার ভাবে মিথ্যা বলে যাওয়া। রেকর্ডার পজ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ওয়াসিফের সামনে দাঁড়িয়ে এক হাতে চুলের মুঠি ধরে অন্য হাতে গাল চেপে ধরে বললেন, ‘কুত্তাও এত অধম না রে!বাঘ বলছিলি না তুই নিজেকে, শালা শুয়োর…বাঘও এত হিংস্র হয়ে শিকারের ওপর ঝাপায় না।আর তুই তো জন্মগত মানুষ। ক্যাম্নে পারলি এমন করতে!!’

ওয়াসিফ তীব্র ব্যাথায় চোখ কুচকে ফেললেও বাইরে কিছুই প্রকাশ করলো না। কোন উত্তর না পেয়ে অফিসারের রাগের মাত্রা বাড়লো। দুই চারটা চড় দিলেন রাগের মাথায়। তাতেও ওয়াসিফ টু শব্দটি করলো না। অফিসার নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। ওয়াসিফকে বললেন, ‘সত্যি স্বীকার করুন ওয়াসিফ। নইলে মি. রাফিদ যে লেভেলের উকিল আপনার মাকে যে কোন মিথ্যা কেসে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা উনি রাখেন। আমিও এ ব্যাপারে উনাকে হেল্প করতে পিছপা হবো না। নিজের মাকে যদি সেফ রাখতে চান তো সত্যি বলুন। ‘

‘হুমকি দিচ্ছেন?’

‘সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে সতর্ক করছি।এত কিছুর পরেও যখন এত বছর পরে আপনাকে রিমান্ডে পাঠিয়েছেন তখন সে কেমন ভেবে দেখুন একবার।’

ওয়াসিফ এবার সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেল। মিনিট দুই ভেবে বললো, ‘ডোন্ট ডেয়ার টু হ্যারাস মাই মাদার। আই উইল কনফেস এভরিথিং।’

‘গুড।’ মুচকি হেসে বললেন অফিসার।

এরপর ওয়াসিফ একে একে হোটেল রুমে ঘটা ঘটনা এবং বাকি সব কাজের বর্ণনা দিয়ে নিজের স্বীকারোক্তি দেয়। এই লোমহর্ষ ঘটনা শুনতে গিয়ে কখনো ওয়াসিফের প্রতি রাগ হয়েছে তার ,তো কখনো ইরিনের করুণ পরিণতির প্রতি সহানুভূতি জেগেছে। তবে ইরিনের দোষকেও তিনি এড়িয়ে যাননি। রাগ ইরিনের প্রতিও হয়েছে। কিন্তু যত যাই হোক, ইরিন এমন নির্মম পরিণতির প্রাপ্য ছিল না বলে মনে করেন তিনিও।

চার্জশিট সই করার পর অফিসার চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ পেছন ঘুরে ওয়াসিফকে বললেন, ‘আপনি একটা মানসিক রোগী ওয়াসিফ। মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তার ঋণ পৃথবীর কোন কিছু দিয়েই শোধ করা সম্ভব না, এও জানি। কিন্তু তার প্রতি এমন অন্ধ ভালোবাসা, তার ভুল প্রোরচনা আপনাকে আজ কোথায় এনে ছেড়েছে দেখুন। আমি জানি আপনি নিজের মাকে বাঁচাতেই সত্যি ঘুরিয়ে বলেছেন। সব দোষ একা নিজের ভাগে নিয়েছেন। কিন্তু, ইরিনের সাথে যেটা করেছেন সেটা সম্পূর্ণ অসুস্থ ও বিকৃত মস্তিষ্কের কাজ। আদালত আপনাকে কি শাস্তি দিবে জানি না। কিন্তু, আপনার যেন সর্বোচ্চ সাজা হয় সেটা নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা আমার থাকবে। বেস্ট অব লাক মি. ওয়াসিফ। ‘

কথা শেষ করে অফিসার বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। ওয়াসিফ কেবল মুচকি হাসলো তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে।

১৬৯.

তিনদিনের রিমান্ড শেষে আজ আবার কোর্টে হাজির করা হয়েছে ওয়াসিফকে। ওয়াসিফের জবানবন্দি ও যাবতীয় তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তাকেই প্রকৃত দোষী বলে সাবস্ত করা হয়েছে। পুলিশ জিম্মিকরণ, ধর্ষণ, খুন এবং ইরিনের খুনের চেষ্টার অভিযোগে মামলা সাজিয়ে পেশ করেছে।

সেদিন মি. খান ওয়াসিফকে পরামর্শ দেন সব স্বীকার করার। নুপুর রায়হানও এটাই চান বলে জানিয়েছিলেন তিনি। এতে করে ওয়াসিফের সাজা হলেও পরে তা কম বেশি করার চেষ্টা করার সুযোগ থাকবে। নইলে পুলিশ অন্যভাবে কেস সাজালে ধর্ষণসহ বাকি সব মামলায় পড়ে ফাঁসির হওয়ার সম্ভবনা থাকবে।

রিমান্ডে কোনপ্রকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন অবৈধ্য হলেও সত্যি স্বীকার করাতে গিয়ে অফিসারের টুকটাক খাতিদারিতে ওয়াসিফ স্বীকারক্তি দিয়েছে যে ,

‘আশরাফ মেহতাজ নামে সে চোরাকারবারির ব্যবসা করে।তাই এই নামের নকল জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধনের সনদপত্র এবং পাসপোর্টও তার। এছাড়াও, ইরিনকে চেতনানাশক ইঞ্জেকশন দিয়ে দুদিন অজ্ঞান অবস্থায় হোটেলরুমে নিজের সাথে রাখে সে। ইরিনকে নিয়ে লন্ডন যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলে তার ভুলের কারণে সময়ের আগে ইরিনের ঘুম ভেঙে যায় এবং বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তখনই কথা কাটাকাটিতে ইরিনের প্রতি রাগ হওয়ায় এবং পূর্বের আচরণের প্রতি রাগ থেকেই হুট করেই ধর্ষণের ব্যাপারটা ঘটে যায়। এরপর বাকি কয়েকদফায় সেটা হয় তার নিজ ইচ্ছায়।লালসা থেকে। ইরিনকে ধর্ষণের পর এ্যালকোহল দিয়ে তার সমস্ত শরীর পরিষ্কার করে সে। সাবান দিয়েও পরিষ্কার করে যাতে কোনভাবেই তার ডি এন এ ইরিনের শরীরে না পাওয়া যায়। এই কারণেই শুধু মাত্র ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেলেও ধর্ষকে চিহ্নিত করা যায় এমন কোন আলামত পাওয়া যায়নি। এবং ইরিনকে হত্যার চেষ্টা থেকে নয় শুধুমাত্র ধর্ষিত হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এমন বোঝাতেই ইরিনের হাতের শিরা কাটে ওয়াসিফ। অবস্থা শোচনীয় ছিল তাই মৃত্যু হলেও সেটা আত্মহত্যাই মনে হতো,তাই এই চেষ্টা।

সে লন্ডন থেকে এসেছিলই ইরিনকে নিয়ে যেতে। কিন্তু, সে চাইনি কেউ জানুক ইরিন কার সাথে গেছে। তাই আশরাফ মেহতাজের পরিচয়ে বাংলাদেশে আসে। পুলিশ কেসের সম্ভবনার কথা ভেবেই সে নিজের অবস্থান ইতালিতে তৈরী করে। প্ল্যান মোতাবেক মেডিকাল ইস্যুতে ইরিনকে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও অতসব ঘটনার পর প্ল্যান চেঞ্জ করে। ইরিনের ফোনে নিজের নাম বদলে আশরাফ লিখে। সিম ভেঙে ফেলে। তারপর, ইরিনকে রেখে সে একাই ফ্লাইটে উঠে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে দুবাই যায়। এবং দুবাই থেকে জ্যাক নামের একজনের পাসপোর্ট ব্যাবহার করে সে ইতালিতে পৌঁছায়।যা তারই একজন কর্মচারীর ছিল।এবং এটিও পূর্ব পরিকল্পিত ছিল। তারপর প্রথমে হোটেলের রেস্টুরেন্টে যায় এবং সেখান রুম পর্যন্ত। এরপর, ওয়াসিফ ও তার পিএ লারা ১০ দিনের বুকিং শেষে হোটেল থেকে চেক আউট করে।

কেবল বেশভুষার পরিবর্তনের মাধ্যমে সে বিভিন্ন ব্যক্তির পরিচয় ব্যবহার করে নিজের কাজ করতো। একসময়কার অর্থের অভাব, অবলেহা থেকে নিজে অনেক অর্থ সম্পদের মালিক হওয়ার ইচ্ছা থেকে মূল ব্যাবসার বাইরে গোপনে এই চোরাকারবারির ব্যাবসা চলাতো সে।

এসব ছাড়াও মুনিরাকে এবং আতাউর জামানকেও সে টাকা দিয়েছিল কেসের ব্যাপারগুলো নিয়ে এটাও স্বীকার করেছে ওয়াসিফ।

কিন্তু, এতসব কিছু স্বীকার করলেও নুপুর রায়হান কোনভাবে এসবের সাথে জড়িত নয় বলে দাবি করেছে ওয়াসিফ। ফলে, কোন প্রমাণও না পাওয়ায় এই মামলার অভিযোগ থেকে নুপুর রায়হানকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি দিয়েছে আদালত।

ওয়াসিফের স্বীকারোক্তি ও যাবতীয় প্রমাণের ভিত্তিতে সকল অভিযোগের জন্য ওয়াসিফকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অপরাধীকে সাহায্য করার দায়ে এবং রাজ সাক্ষী হওয়ায় মনিরাকে সাজা কমিয়ে ৬ মাসের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। ব্যারিস্টার আতাউর জামানের বিরুদ্ধে আনা রাফিদের অভিযোগগুলো নিয়ে আরও খঁতিয়ে দেখার জন্য পুলিশকে আদেশ দেয় আদালত।

১৭০.

‘কংগ্রাচুলেশনস মি. রাফিদ।’ হাসিমুখে বললো নক্ষত্র।

‘থ্যাংক্স। এন্ড কংগ্রাচুলেশনস টু উই টু মি. নক্ষত্র। ইরিন আপনাকেও অনেক অনেক অভিনন্দন। ‘ মিষ্টি হেসে বললো রাফিদ।

‘আপনাকে ধন্যবাদ দিবো না রাফিদ। দোয়া থাকবে। আল্লাহ যেন এভাবেই আপনাকে সত্যের জোরে সাফল্য দেন সবসময়। ‘ কৃতজ্ঞতায় আলতো হেসে বললো ইরিন।

‘ইন শা আল্লাহ। তবে যত যাই হোক,খরচা আর খাটনি দুটোই কিন্তু অনেক গেছে আমার। ফিস কিন্তু ডাবল নিবো আমি। ‘ ইরিনকে উদ্দেশ্য করে রসিকতা করে বললো রাফিদ। তার কথায় হেসে ফেললো সবাই। নক্ষত্র বললো,

‘সেটা দেওয়া যাবে। তবে, আপনার প্রতি যে কৃতজ্ঞাটুকু তৈরী করে দিলেন এটা অমূল্য।এটা শোধ করি কি করে বলুন তো!’

‘সব কিছুর শোধবোধ হয় না মি. নক্ষত্র। কিছু কাজ শুধুমাত্র নিজের ভেবেই করা হয়। কোন প্রতিদানের আশা ছাড়াই।’ ইরিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো রাফিদ।

নক্ষত্র সেটা দেখলোও। কিন্তু, কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। প্রসঙ্গ পাল্টে হাসি মুখে রাফিদকে বললো,

কিন্তু আপনার যে একখানা দাওয়াত পাওনা আছে। সেটা কবে উসুল করছেন বলুন? ‘

‘আপনার বাসায় তো যাবোই তবে তার আগে ইরিনের বাসায় যেতে হবে। দাওয়াত আছে। সেটা আগে উসুল করি। তারপর একদিন আপনার বাসায় গিয়েও হাজির হবো, আন্টির হাতের রান্না খেতে।’ রাফিদ বলল।

‘নিশ্চই বাবা…..চলে এসো একদিন। তবে ইরিনের রান্না খাওয়ার পরে আমার রান্না তোমার ভাল্লাগবে কিনা সেটা গ্যারান্টি দিতে পারছিনা কিন্তু। ‘ শায়লা বললে।

‘আরেএএ আন্টি, মায়ের হাতের রান্না অন্য কোন রান্নাকে বিট করতেই পারেনা। আমার তো মা নেই। মিস করি অনেক মায়ের হাতের রান্না। ‘ মলিন হেসে বললো রাফিদ।

‘তাহলে কবে আসছো বলো? ‘ শায়লা জিজ্ঞেস করলেন।

‘উমম…আগে ইরিনের বাসায় যাবো, তারপর দেখি…সময় করে একদিন আপনার কাছে এসেও ঠিক হাজির হবো। ‘

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’ মিষ্টি হেসে বললেন শায়লা।

বারেবারে ইরিনের বাসার যাওয়া নিয়ে রাফিদের এত আগ্রহ দেখে নক্ষত্র আড়চোখে ইরিনের দিকে তাকালো। ইরিন বেশ হেসে হেসে কথা বলছে রাফিদের সাথে। নক্ষত্রের মেজাজ খারাপ হলো ইরিনের প্রতি। রাফিদের সাথে বন্ধুত্ব এত বেশি ভালো হবে কেন তার? কই নক্ষত্রের সাথে যে বন্ধুত্ব করতে বললো তখন যে ফিরিয়ে দিল। নাহ..এর একটা বিহিত এবার না করলেই নয়। মনে মনে ভাবলো নক্ষত্র।

‘আজ তাহলে আসি। ভালো থাকবেন মি. নক্ষত্র। ‘ রাফিদ বললো।

‘জ্বী..আপনিও। এন্ড থ্যাংক্স এগেইন।’

রাফিদ মুচকি হাসলো নক্ষত্রের কথার প্রত্যুত্তরে। তারপর ইরিনকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘আপনি এখন বাসায় যাবেন তো,তাই না ইরিন?’

‘হ্যাঁ। ‘

‘তাহলে চলুন…একসাথে যাই। আপনাকে ড্রপ করে দিয়ে তারপর আমিও অফিস যাবো ওদিক দিয়েই। ‘

‘আ..ব…না। তার কোন দরকার নেই মি. রাফিদ। পুতুলের আম্মু আমার সাথে যাবে আজ। পুতুলের কি সব যেন শপিং করা লাগবে। তাই শেখ ভিলা থেকে পুতুলকে নিয়ে একেবারে শপিং এ যাবো আমি আর ওর আম্মু। ‘ইরিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নক্ষত্র বললো।

‘কিসের শপিং? কই পুতুল তো আমাকে কিছু বলে নাই!’
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ইরিন।

‘আমাকে বলছে তো। তুমি চলো। পুতুল ওয়েট করতেছে। ‘ তারপর রাফিদকে বললো, ‘এখন তাহলে যাই। আবার দেখা হবে ইন শা আল্লাহ।’

‘ইয়াহ…শিওর।’ আলতো হেসে বললো রাফিদ। এরপর নক্ষত্র ইরিনকে নিয়ে চলে গেল ওখান থেকে। শায়লা, নাফিজ শেখ চলে গেছেন ওদের আগেই। তাই রাফিদও পা বাড়ালো পার্কিং লটের দিকে।

১৭১.

দুপুরের শেষপ্রহর। রৌদ্রময় উজ্জ্বল চারপাশ।তবে উত্তাপ নেই রোদের। সবুজ ঘাসে মোড়ানো পার্কের পথঘাট।সেখানেই একটা বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে ইরিন আর রাফিদ। মাঝে স্বাভাবিক দূরত্ব বিদ্যমান। সেই সাথে পিনপতন নিরবতাও। রাফিদ বেশ চুপচাপ আজ। ইরিন জরুরি তলব করার পরেও প্রথমে আসতে চায়নি। পরে ইরিনের কথা ফেলতে পারেনি বলেই একপ্রকার বাধ্য হয়েই আসতে হয়েছে তাকে।

কিন্তু, রাফিদ ভেবেছিল এই বুক চাপা কষ্ট নিয়ে কি করে মুখোমুখি হবে সে ইরিনের? ইরিনই বা কি ভাববে…বলবে তাকে এভাবে দেখলে তাকে! এত বড় মানুষ এভাবে কষ্ট পাচ্ছে। রুনার উপর রাগ হচ্ছে রাফিদের। মেয়েটা ইরিনের কানে নিয়ে তুলেছে কথাটা। এখন লজ্জাও লাগছে খানিক। তাই আজ দেখা করতে আসতে চায়নি। কিন্তু, ইরিনও নাছোড়বান্দা। রাজি করিয়ে ছেড়েছে রাফিদকে এখানে আসার জন্য।

একসময় নিরবতা ভেঙে ইরিন জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন আছেন রাফিদ?’

‘ভালো। ‘ শুকনো হেসে বলল রাফিদ। কিন্তু পাল্টা প্রশ্নে জিজ্ঞেস করলো না ইরিন কেমন আছে।

ইরিন বুঝলো বেচারার অবস্থা সত্যিই বেগতিক। ইরিনই তাই কথা এগিয়ে নিল। খানিক সময় নিয়ে শান্ত গলায় সে প্রশ্ন করলো রাফিদকে, ‘আমরা তো বন্ধু, তাই না রাফিদ?’

‘হুম। ‘ আস্তে করে জবাব দেয় রাফিদ।

‘তাহলে কথাটা কি আমাকে বলা যেত না একবার?অন্যের কাছ থেকে কে জানতে হয় আমার?’ অভিমানী অভিযোগের সুরে বলে ইরিন।

‘আপনি কখনো জানতে চাননি তো। জিজ্ঞেস করেননি কখনো।’ পাল্টা অভিযোগে নিজের পক্ষ টেনে বলে রাফিদ।

‘ভুল করায় তো আমি পিএইচডিধারীনি। আপনি জানেন না এটা?’ রাফিদের কথার পিঠে রসিকতার ছলে বললো ইরিন।

ইরিনের এ কথায় নিরবেই হেসে ফেললো রাফিদ। মাথা নীচু করে সবুজ ঘাসের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনাকে আমি ভীষণ পছন্দ করি ইরিন। আমি সারাজীবন আপনাকে আমার পাশে চাই। কিন্তু… ‘

‘তাহলে আমি চাই আমাকে পাশে নিয়েই আপনি নতুন জীবনটায় পা রাখুন। সম্পর্কটা এবার পাকাপোক্ত হোক কাগজে কলমে। ‘ রাফিদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো ইরিন।

রাফিদ চমকে তাকালো ইরিনের কথায়। যেন ইরিন যা বলছে তা সত্যিই সম্ভব। অথচ সে জানে এটা সম্ভব না। তবুও, খুব করে ইচ্ছে হচ্ছে তার যেন ইরিনের কথাটা সত্যি হয়ে যায়। বিশ্বাস করতে চাইছে ইরিনের এই একটুকরো সম্ভাবনাময় আশার বুলিটুকুকেই। কিন্তু, পারছেনা। কারণ, সে জানে…সত্যি জেনে বুঝেও অবুঝ হওয়া এখন আর মানায় না তাকে।

অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কিছুসময় ইরিনের হাসিমাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো রাফিদ।তারপর, দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে নিরবেই হেসে ফেললো সে আবারও। ম্লান গলায় বললো,

‘এখন আর এটা সম্ভব না ইরিন। ‘

‘কেন? আপনার আপত্তি কিসে?’

‘আপনাকে যদি বলা হয় ভালোবাসার মানুষটির জন্য পরিবারকে চিরতরে ছেড়ে আসতে, আপনি পারবেন?’

‘কষ্ট হবে। কিন্তু, কিছু পেতে হলে তো কিছু ছাড়তেও হয়, রাফিদ।’

রাফিদ হতাশ হলো ইরিনের এমন যুক্তির বিপরীতে নিজের ভাগ্যের পরিণামের কথা ভেবে। বিষন্ন এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইরিনকে বললো, ‘তাহলে এত করে ভালোবাসার পরেও কেন অধিকার ছেড়ে দিতে হচ্ছে আমাকে? কেন অন্যকারও জন্য নিজে না চাইতেও নিজের ভালোবাসার মানুষকে পেয়েও ছাড়ছি আমি?

ইরিন রাফিদের কথার বিপরীতে সহসা কোন উত্তর দিতে পারে না। অথচ সে নিজেও জানে, না চাইতেও ভালোবাসার…নিজের প্রিয় মানুষটাকে ছেড়ে দেওয়ার যন্ত্রণা কেমন!

১৭২.

কয়েকমূহুর্ত আবারও নিরবতায় কাটলো তাদের। নিরবতা ভেঙে সজোরে কাঁচ ভাঙার শব্দের মত ইরিনের কানে ঝংকার তুললো রাফিদের শান্ত অথচ ভারী কন্ঠস্বর।

‘আজ ওর বিয়ে ইরিন। খুব করে বলেছিলাম ভালোবাসি ভীষণ। কিন্তু তার পরিবার রাজি হয়নি বলে আমাকে ছাড়তে হয়েছে ওর।’

‘পালানোর সাহস নেই এটা বলুন। পরিবার তো একটা বাহানা মাত্র।’ ইরিন বিদ্রুপ করে বললো। রাফিদ সহসা প্রতিবাদে বললো,

‘মেহের এমন নয় ইরিন। ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে ও। আমার তো ঠিকঠাকভাবে পরিবারটাও নেই বহুকাল। কিন্তু, যে পরিবারটা ওকে এতকাল আগলে রেখেছে তাদের কি করে অসম্মান করবে সে? তাই আলাদা হতে হয়েছে। আমার জন্য কেন অকারণ সে নিজের পরিবার হারাবে!’

‘পরিচয় কিভাবে হয়েছিল আপনাদের?’

‘পুরোনো কথা কেন তুলছেন ইরিন?থাক না এসব।ছাই হাতড়ে কি লাভ..শুধু শুধু হাত ময়লা হবে। ‘

‘ইউ নো হুয়াট? আমি ছেলে হলে এই মূহুর্তে আপনার সাথে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে দুঃখ বিলাস করতাম। ওর নামে দোষকীর্তন করতাম।কিন্তু সেটা..’

‘ওটা গুণকীর্তন ইরিন। ‘

ছ্যাকা দেওয়া প্রেমিক-প্রেমিকার গুণকীর্তন হয় না রাফিদ, দোষকীর্তন হয়। তাই বললাম। ‘

আপনি কি সব উদ্ভট শব্দ বলেন মাঝেমধ্যে। আলাদা ডিকশনারি হওয়া দরকার আপনার আবিষ্কৃত শব্দভান্ডার নিয়ে। নাম হবে ‘উদ্ভট শব্দ ভান্ডার। ‘ এত কষ্টের মাঝেও স্বভাবসুলভ রসিকতা করে বললো রাফিদ।

রাফিদের এমন কথায় এবার না হেসে পারলো না ইরিন।একচোট হেসে তারপর আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ…তো যা বলছিলাম আমি। সেটা যেহেতু সম্ভব হচ্ছে না তাই ওর সাথে ভালো ভালো মূহুর্তের স্মৃতিচারণ করি চলুন। এবার বলুন আপনাদের পরিচয় কিভাবে?’

‘ফেইসবুকে।ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিল ও আমাকে। নাম মেহের। বারাসাতে থাকে। মানে ভারতে। মাঝে মধ্যে কথা হতো। প্রথম প্রথম বেশির ভাগ কথা হতো আমাদের আর ওদের দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। বাংলাদেশ নিয়ে জানার ভীষণ আগ্রহ ছিল ওর।তখন ও সবে স্কুল পাশ করে কলেজে পড়ছে। মানে আমাদের এখানে ভার্সিটিতে পড়া বলে যাকে। মাঝারি বাচ্চা বলতে গেলে তখন সে।

তারপর সে আলাপচারিতার বিষয়বস্তু ধীরে ধীরে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে বিস্তার লাভ করে। আমরা নিজেদের নিয়ে কথা বলতে শুরু করি। জীবনের গল্প ভাগাভাগি করি। সেই থেকে ভালো লাগা তারপর প্রথম ভালোবাসার আহবানও আমার তরফ থেকেই ছিল। সাড়া পেতে সময় লাগেনি।

‘সম্পর্ক কতদিনের আপনাদের?’

‘চার বছর প্রায়।’

‘আচ্ছা, তারপর?’

‘আমি বেশ কয়েকবার গেছিলাম বারাসাতে, ওর সাথে দেখা করতে। এভাবেই ভালোবাসাটা দিন দিন গাঢ় হতে থাকে ওর জন্য।আমরা নিজেদের নিয়ে একসাথে একটা জীবন সাজানোর সিদ্ধান্ত নেই। ওর গ্রেজুয়েশনের অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। মাস তিনেক আগে ফাইনাল এক্সাম শেষ করেছে। এরপরই হঠাৎ করে ওর বাড়িতে বিয়ের কথা উঠে। আমার কথা জানায় ও। কিন্তু, ওর বাবার এসব আইন প্রশাসনের মানুষ পছন্দ নয়। তাছাড়া আমি বাংলাদেশী আর সে ভারতীয়। এত দূরে তিনি মেয়ে বিয়ে দিবেন না। তারওপর আবার আমার মা-বাবা নেই।একলা একটা বোন নিয়ে থাকি। এমন ছেলের কাছে মেয়ে দিবেন না তিনি।

মেহের অনেক বলার পরেও রাজি হননি। বিয়ে ঠিক করেন অন্য জায়গায়। বলেছিলাম চলে আসতে।সে পরিবার ছাড়বে না।আমিও অনেক ভেবছি। মেহেরকে অকৃতজ্ঞের খাতায় নাম লিখাতে দেই কি করে বলুন! তাই আমিই অধিকার ছেড়ে দিয়েছি। সম্পর্ক শেষ! আর আজ তো ওর বিয়েই। হয়েও গেছে বোধয় এতক্ষণে।এটুকু বলে দুঃখ হতাশায় জর্জরিত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাফিদ।

‘বর ছাড়াই? এভাবে একলা একলা কোন মেয়ের বিয়ে হয় শুনি?’

১৭৩.

পরিচিত ঝগড়াটে কন্ঠস্বরে দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকালো রাফিদ। ওর যেন চোখে ভ্রম লেগেছে এমনভাবে তাকিয়ে আছে সে। তার থেকে কিছু দূরেই ভারী লেহেঙ্গাটা দু পাশ থেকে ধরে বউ সাজে দাঁড়িয়ে আছে মেহের। ইরিন উঠে দাঁড়লো এবার। হেঁটে রাফিদের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

‘রির্টান সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো রাফিদ?’

রাফিদ এবার ঘাঁড় ঘুরিয়ে বোকা বোকা চোখে ইরিনের দিকে ফিরে তাকালো।

তার এমন হকচকিয়ে যাওয়া চেহারা দেখে হেসে ফেললো ইরিন। রাফিদ তা দেখে যেন আরও বেশি হতম্ভব হয়ে গেল। কিছু সময় পর বিস্ময় ও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভরা স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা কি সত্যি ইরিন? নাকি আমার হ্যালোসুলেশন হচ্ছে?’

‘চিমটি কাটবো?’

‘কাটলে কি হবে? ও বাস্তব হয়ে ধরা দিবে?’

ইরিন রাফিদের এমন বাচ্চাসুলভ প্রশ্নে হেসে ফেললো আবারও। তন্মধ্যেই রাফিদের সজোরে চিৎকার শোনা গেল।

‘আআআআহ’।

ইরিনের হাসি থেমে গেল। রাফিদের আচমকা চিৎকারে সেও অপ্রস্তুত হয়ে ভড়কে গেছে। রাফিদ চোখ মুখ খিঁচে বাঁ’হাতে ডানহাতের চিমটি লাগার জায়গাটায় ঘষছে। যাতে কিছুটা হলেও ব্যাথা উপশম হয়। তবে ব্যাথা বেশ ভালোই লেগেছে ওর। মেজাজ খিঁচে গেছে এক্কেবারে। পাশ ফিরে ঝাঁঝালো গলায় চিমটিদাতাকে ঝাঁড়ি মারার প্রস্তুতি নিয়ে তাকাতেই চক্ষু ছানা বড়া হলো তার। মেহের রাগী চোখে তকিয়ে আছে। তেজি গলায় বললো, ‘আমাকে অবাস্তব মনে হয় তোমার? নাকি প্রাক্তন প্রেমিকা করে রেখে এসেছো বলে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছি আমি? চিনতে কষ্ট হচ্ছে আমাকে? চিমটি দিবো আরও কয়েকটা?

‘বউ সাজে তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে মেহের। আমার এতকালের কল্পনার চাইতেও অনেক বেশি। তাই আমার কাছে তোমাকে অবাস্তব লাগছে।এই তুমি কি সত্যিই বাস্তব?’

মেহেরের ঝাঁঝালো কথার পিঠে একদম শান্ত স্বরে বাচ্চাসুলভ ভংগিতে বললো রাফিদ। রাফিদের এমন কথায় মেহেরের রাগটাই যেন এবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মায়া লাগলো তার রাফিদের জন্য। ঠিক কতটা আশাহত, ব্যাথিত হওয়ার পর হুট করেই নিজের কাঙ্খিত কিছু পাওয়ার পর মানুষ এতটা অবাক হয় যে বাস্তবকেও কল্পনা মনে করে! দ্বিধান্বিত হয়। মেহেরের হুট করেই কান্না পেয়ে গেল। চোখজোড়া ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এলো তার। সেই চোখে তাকিয়ে চমকালো রাফিদ।

পেছন থেকে স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে ইরিন বললো, ‘কল্পনার চাইতে বাস্তব অনেক বেশি সুন্দর হয় রাফিদ। মেহেরকেও তাই এত বেশি সুন্দর লাগছে আপনার। ‘

ইরিনের কথা যেন রাফিদকে দমবন্ধ করা বন্দীদশা থেকে এক তুড়িতেই মুক্ত করে দিল। রাফিদ আর এক মূহুর্তেও সময় নিল না। একপ্রকার বাচ্চাদের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরলো মেহেরকে। একেবারে ভঙ্গুরদশায় গিয়ে ঠেকার পর উঠে দাঁড়ানোর মত ভরসা পেলে কেউ সেটাকে যতটা শক্ত করে পারা যায় আঁকড়ে ধরে, ঠিক সেভাবেই মেহেরকেও নিজের বাহুবন্ধনে জড়িয়ে নিল রাফিদ। মেহের এবার না পারতে কেঁদেই ফেললো নিঃশব্দে।

ভাগ্য ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। জায়নামাজে বসে সিক্ত চোখের মোনাজাতে যাকে চেয়েছিল,শেষমেশ এত অসম্ভবেও তাকে বুঝি পাওয়া হয়েই গেল এবার।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here