নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_৩০ শেষাংশ (প্রথমভাগ)
লেখায়_জারিন
১৭৪.
‘ আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি রাফিদ। তুমি আমাকে এভাবে টাচ করতে পারো না।’ নিজেকে সামলে নিয়ে কড়া গলায় বললো মেহের। তার এই কথা যেন ঝটকায় রাফিদকে বাস্তবের মূলে ফিরিয়ে আনলো। তড়িৎ গতিতে মেহেরকে ছেড়ে দিয়ে তার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো সে। বিচলিত এবং অস্থির গলায় প্রশ্ন করলো মেহেরকে।
‘এই আজকে না তোমার বিয়ে?
‘হ্যাঁ তো!’ হাসি হাসি মুখে জবাব দেয় মেহের।
‘তাহলে তুমি এখানে কি করছো?’
‘দাঁড়িয়ে আছি।কেন দেখতে পাচ্ছো না?’ রসিকতার স্বরে বললো মেহের। ইরিন রাফিদের পেছনে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে আর মিটমিটিয়ে হাসছে।
‘হ্যাঁ, তা পাচ্ছি। কিন্তু,না মানে বিয়ে তো…এখানে কিভাবে এলে তুমি?’ কনফিউজ হয়ে প্রশ্ন করলো রাফিদ।
‘নক্ষত্র ভাইয়ার সাথে এসেছি। ফ্লাইটে করে। ‘সাবলিল ভংগিতে বললো মেহের।
‘নক্ষত্র ভাইয়া?! ‘ অবাক স্বরে প্রশ্ন করে রাফিদ।
‘হু’। মাথা উপরনীচ করে নাড়িয়ে বলে মেহের।
‘মি. নক্ষত্রের কথা বলছো তুমি?’
মেহের পুনরায় মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় রাফিদের কথায়। তারপর বললো, ‘বিশ্বাস না হলে ভাবীকে জিজ্ঞেস করতে পারো। ভাবী জানে সবটা।’
‘কোন ভাবী?’
রাফিদের প্রশ্নে মেহের আঙুল উঁচিয়ে ইশারায় ইরিনকে দেখালো। রাফিদ মেহেরের ইশারা অনুসরণ করে পেছনে তাকিয়ে ইরিনকে দেখে বোকা বনে গেল। সামনে ফিরে অবাক স্বরে মেহেরকে প্রশ্ন করলো, ‘ইরিন তোমার ভাবী হয় কি করে? ‘
‘তোমার ভাইয়ের বউ…তোমার ভাবী। তো….আমারও তো ভাবীই হবে তাই না?’
রাফিদ এবারে চরম বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল মেহেরের কথায়। চমকের গোলকধাঁধাঁ আটকা পড়ে এখন মস্তিষ্কও কাজ করার ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি চাইছে যেন। রাফিদ যখন গোলকধাঁধাঁর গোলযোগে নাজেহাল, আশেপাশে তাকিয়ে ভাবছে এসব নিয়ে…ঠিক তখনই কিছুটা দূরে চোখ গেল তার। চমক যেন এবার তার আকাশচুম্বী হলো।
১৭৫.
পড়নে জিন্স, শার্ট, ব্লেজার, পায়ে কালো জুতা। চোখে কালো সানগ্লাস। কানে ফোন ঠেকিয়ে একদম হিরোদের স্টাইলে কথা বলতে বলতে হেঁটে আসছে নক্ষত্র।রাফিদের কাছে তাকে আগে থেকেই তামিল হিরোদের মত লাগে। গায়ের রঙ কালো হলে কি হবে! চৌকস বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ, তাতেও একটা অন্যরকম মায়া মায়া ভাব।একদম টানটান শক্তপোক্ত শারিরীক গঠনের কারণে ভীষণ সুন্দর দেখতে মানুষটাকে। উপরন্তু তার কর্মঠ ও চমৎকার ব্যক্তিত্ব তার এ সৌন্দর্যকে যেন গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে তার চেহারায়। রাফিদের মাঝে মাঝে অফসোস হয়, ইরিন তো সেই এই মুখ..এই মানুষটার প্রেমেই পড়লো, মায়ায় জড়ালো..ভালোওবাসলো। তাহলে শুরুতে এসব হলে কি হতো! ভাগ্যের ফের বোঝা সত্যিই ভীষণ দায়।
নক্ষত্র বেঞ্চের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে ইতোমধ্যে। তখনো ফোনে কথা বলছে সে। সেই কথোপকথন শুনেও আরেকদফা টাসকি খেলো রাফিদ।
‘হ্যাঁ….বোঝান উনাকে। রাজী হতে বলুন।নইলে আমাকেই নিজের বোনসম মেয়ের উকিল বাবা হতে হবে। তারপর, এই বয়সে এসে মেয়ের বয়সী নাতবউয়ের দাদা শশুড় হয়ে ঘুরবেন উনি। ‘
‘…….’
‘আপনি হাসছেন, আম্মু?’
‘…..’
‘হ্যাঁ….প্লিজ। এটুকু ম্যানেজ করে দিন একটু।’
‘………’
‘হ্যাঁ, এই তো রওনা দিবো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই।’
‘আচ্ছা,ঠিক আছে। লাভ ইউ আম্মু। ‘
মিষ্টি হেসে বললো নক্ষত্র। তারপর ফোন পকেটে রেখে সানগ্লাসটা খুলে ব্লেজারের পকেটে গুঁজে দিতে দিতে ইরিনের পাশে এসে দাঁড়ালো সে। হাসিমুখে রাফিদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি অবস্থা মি. রাফিদ? ‘
রাফিদ নক্ষত্রের এ প্রশ্ন যেন শুনেও শুনলই না। অবাক গলায় প্রশ্ন করলো, ‘মি. নক্ষত্র..আপনি মেহেরকে এখানে এনেছেন?
‘হ্যাঁ।’
‘কিভাবে? ‘
‘তুলে এনেছি।’ একদম সাবলিল গলায় বললো নক্ষত্র। যেন বিয়ের কনেকে বিয়ে বাড়ি থেকে তুলে আনাটা খুব স্বাবাবিক ব্যাপার। কিন্তু বিপরীতে রাফিদ চেঁচালো।
‘কিহ!আবার?’
‘এই আবার মানে? তোমার কি আরও কারও সাথে রিলেশন ছিল নাকি? কজনকে তুলে আনছেন উনি তোমার জন্য?’
নক্ষত্র রাফিদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই অবাক হয়ে অস্থির, বিচলিত গলায় প্রশ্ন করলো মেহের।
‘এই না…আমার আর কারও সাথে রিলেশন নাই। মানে ছিলই না কখনো। আমি তো….তোমার কথা শুনে ভয় পাইছি…না..মানে…তোমার কথা শুনে না….মানে উনার কথা শুনে টাসকি খেয়েছি বোধয়… না মানে…ধুর!!’ কি দিয়ে কি বললে সেটাও গুলিয়ে যাচ্ছে রাফিদের।
‘উনি শুধু তোমাকেই ভালোবাসেন মেহের। পুতুলের বাবাই মজা করে বলেছেন এমন। ডোন্ট ওয়্যারি।’ ইরিন হেসে বললো।
‘তোমার রিটার্ন সারপ্রাইজ দেওয়া হলে এবার চলি এখান থেকে? শেখ ভিলায় সবাই অপেক্ষা করছে। আম্মু কল দিয়ে বলেছেন, সব আয়োজন শেষ।’ নক্ষত্র বললো ইরিনকে।
‘হ্যাঁ, চলুন। রাফিদ, মেহের এখন সব কথা থাক। চলুন আগে বিয়ের কাজটা শেষ করি। শুভ কাজে দেরি করতে নাই।’ তাদের উদ্দেশ্য করে বললো ইরিন।
‘কার বিয়ে?’ রাফিদ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
‘আপনার আর মেহেরের। ‘ হাসিমুখে বলে ইরিন।
‘কিন্তু, এসব কিভাবে কি হচ্ছে…আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। ‘ বিভ্রান্ত হয়ে অস্থির স্বরে বললো রাফিদ।
‘পরে বলি?’ ইরিন বললো।
‘না…এখুনি। আমার মাথা কাজ করছে না। মেহের নিজের বিয়ের দিন এখানে…মি. নক্ষত্র বলছেন তুলে এনেছেন। কাহিনী কি ভাই?!’ অস্থির গলায় বললো রাফিদ।
‘আমার বউয়ের ইচ্ছা হয়েছিল আপনাকে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ কিছু গিফট করবে।প্রথমে তা কোন ইউজেবল প্রোডাক্ট হলেও পরে ওর বাসায় দাওয়াতে গিয়ে রুনার কাছে আপনার আর মেহেরের কথা শুনে সে। তারপরেই তা আপনাদের শুভ পরিণয়ের..মানে বিয়ের আইডিয়াতে বদলে গেল। উনি আমার কাছে বায়না করলেন মেহেরকে এনে দিতে। আমি বেচারা আর কি করি ভাই! একটা মাত্র বউ আমার। শখ করেছে তার বন্ধুকে সারপ্রাইজ দিবে, ব্যবস্থা তো কিছু একটা করতেই হতো।
তাই গতকাল রুনার দেওয়া ঠিকানা নিয়ে বারাসাত পৌঁছাই। মেহেরের বাসায়। ওর বাবার সাথে কথা বলি। উনি ভাই আমার বউয়ের চাইতেও ঘাঁড়ত্যাড়া লোক। মানলেনই না আমার কথা। অগত্যা আমার মেহেরকে ধরতে হলো। ও নিজেও আরও একবার চেষ্টা করেও তা বিফল হলো। ওর বাবা জানিয়ে দিলেন, বিয়ে করলে তার ঠিক করা পাত্রকেই করবে নয় তো মেহের তার জন্য মৃত। বাবার এমন কথার পর মেহের আর নিজের অনিচ্ছাকৃত সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারলো না। পার্লার থেকে একাই বেরিয়ে এসে সোজা আমার গাড়িতে উঠে বসে, প্ল্যান মত। তারপর, বারাসাত থেকে কোলকাতা, এরপর ফ্লাইটে করে সোজা বাংলাদেশে। ‘ বেশ উচ্ছ্বসিত স্বরে হেসে বললো নক্ষত্র।
রাফিদ পুরো হা হয়ে গিললো তার বলা কথাগুলো শুনে। তারপর কিছুটা সময় চুপ করে ভাবলো কিছু একটা। পাশ ফিরে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কাজটা কি ঠিক হলো মেহের? ‘
‘ভুল হয়েছে? হোক! যে বাবা জন্ম দিয়ে আদর স্নেহে বড় করার প্রতিদানে আমার সুখের বলিদান চায় তাকে কি করে সম্মান দিতে নিজের সুখ সঁপে দেই? বাবা মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় অবলীলায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া যায় রাফিদ। জীবন দিলেও অতি তুচ্ছ সেটা। কিন্তু প্রতিদান চাইলে তা স্বার্থপরতা হয়ে ওঠে। বাবার কথাই তো মেনে নিয়েছিলাম, তারপরেও নক্ষত্র ভাইয়া যখন গেলেন ভাবলাম হয় তো এবার সে মানবে। কিন্তু, না। সে তার ইগো বাঁচাতে আমাকে মৃত বলে মানতেও যখন দ্বিধা করবে না, তো তাই হোক। যার কাছে সন্তানের ন্যায্য সুখের চাইতে নিজের জেদ বেশি মূল্যবান তার কাছে আমি মৃতই ভালো।
এখন তুমি বলো, তুমি আমাকে বিয়ে করবা নাকি আমি সত্যি সত্যি মরবো?’ মেহের বললো কাঁদোকাঁদো গলায়।
‘থাপ্পড় চিনো? দুই চারটা থাপ্পড় পড়লে মুখে দ্বিতীয়বার আর এই কথা আনার সাহস করব না,ফাজিল মেয়ে।’
রাগীস্বরে বললো রাফিদ। তারপর নক্ষত্রকে বললো, ‘মি. নক্ষত্র…চলুন তো প্লিজ। আগে বিয়েটা করে নেই। তারপর, এর মাথা থেকে এসব উল্টাপাল্টা চিন্তার ভূত নামানোর ব্যবস্থা করবো।’
‘হ্যাঁ…চলুন। ‘হাসতে হাসতে বললো নক্ষত্র। পেছন ঘুরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রাফিদ আবার চেঁচালো।
‘এই…এক মিনিট।
তার কথায় নক্ষত্র ইরিন পেছন ফিরে তাকাতেই অস্থির গলায় রাফিস বললো, ‘আপনি একটু আগে ইরিনকে এত আদর সোহাগ দেখিয়ে বউ বলছিলেন কেন?’ আপনাদের না ডিভোর্স হচ্ছে?’
আচমকা রাফিদের চেঁচানোতে বাকিরা সহসা ভড়কে গেল একপ্রকার।ব্যাপারটা ঠিক কি সেটা বুঝতে কয়েকসেকেন্ড সময় নিল তারা। তারপর, বিরস গলায় ইরিন বললো, ‘ডিভোর্স আর ইচ্ছে কই! উনি ক্যান্সেল করিয়ে ছেড়েছেন।’
‘মানে?’ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো রাফিদ।
‘আমাদের ডিভোর্স হচ্ছে না রাফিদ। পরী ফিরে এসেছে তার নক্ষত্রত্রের কাছে। ‘ শেষ কথাটা ইরিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো নক্ষত্র। নক্ষত্রের চোখে চোখ পড়তেই ইরিনও লাজুক মুখে মাথানত করে মুচকি হাসলো।
ইরিনের এমন হাসি আর নক্ষত্রের কথায় দুয়ে দুয়ে চার মিলাতে আর অসুবিধা হলো না রাফিদের। আজ যেন তার চমকের রেশ কাটছেই না। সুখ প্রজাতিরা যেন অবাধ ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে তার মনের আকাশে।
আনন্দে উত্তেজনায় অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘ওও…আল্লাহ!!! কখন কিভাবে কি হইলো? আমাকে কেউ কিছু বললো না। কি অকৃতজ্ঞ সবাই! শেষবাক্যে অভিমানী অভিযোগের সুর ঢেলে বললো রাফিদ। তার কথায় হেসে ফেললো নক্ষত্র-ইরিন। মেহের কিছু বুঝতে না পেরে কৌতুহল চেপে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো রাফিদের পাশে।
‘এটাকে আপনার বিয়ের সারপ্রাইজ গিফট দিতে চেয়েছিল ইরিন । তাই বলেনি আগে কিছুই।আপনাদের বিয়ের পর বলে দিত আপনাকে । যতযাই হোক এর পেছনে আপনার অবদানটাই বেশি। Which make me grateful to you too!’ মুচকি হেসে বললো নক্ষত্র। তারপর তাড়া দিয়ে বললো, ‘বাকি কথা পরে হবে। এখন যাওয়া যাক, চলুন।
রাফিদ হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মত্তি দিল। তারপর,সবাই রওনা হলো শেখ ভিলার উদ্দেশ্যে।
১৭৬.
রাত নয়টা একুশ…..
ঘরোয়া ভাবে হলেও বেশ ভালোই আয়োজন করা হয়েছে শেখ ভিলায়। ঘরে বাইরের সাজে মানুষের আনাগোনায় একদম বিয়ে বাড়ির আমেজ তৈরী হয়েছে এখানে। রাফিদের আত্মীয়স্বজন বলতে কারও সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। তাই রাফিদের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ওর ছোটবোন রুনা, মারিয়া, ইরিনের মা,রিতু এবং নক্ষত্রের পরিবারের কয়েকজন মিলেই এই ঘরোয়া বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে।
মেহেরকে নতুন করে বউ সাজানো হয়েছে। শেখ ভিলায় আসার আগে রাফিদ নতুন করে শপিং করেছে। তার কথা অন্যের দেওয়া শাড়ি গয়নায় কেন মেহের তার বউ হবে! অগ্যতা নতুন করে সব কেনাকাটা করতে হয়েছে। আপাদত বিয়েতে যা যতটা লাগে তাই করেছে পরে বিয়ের রিসিপশনে ভালোভাবে সব আয়োজন করবে বলেছে রাফিদ।
গোল্ডেন কালার জরি পাথরের কাজ করা লেহেঙ্গায় সাথে ম্যাচিং সোনা ও হীরার নানান গয়নায় একদম সোনাবউ লাগছে যেন মেহেরকে। রাফিদ কালোর উপর গোল্ডেন সুতোর কারুকাজের শেরওয়ানি পড়েছে।
ইসলামিক নিয়মে বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছে। এবার রেজিস্ট্রি পেপারে সই করার পালা। রাফিদ ও মেহের সই করার পর কাজী সাহেব বললেন, ‘ছেলে মেয়ের পক্ষ থেকে এবার সাক্ষীরা সই করুন। ‘
রাফিদের পক্ষ থেকে শেখ দম্পতি সাক্ষী হলেন। মেহেরের অভিভাবক হয়ে সাক্ষী হলেন তার মামা। মেহেরকে ভীষণ স্নেহ করেন তিনি। রাফিদকেও তার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু, বোন জামাইয়ের সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু বলতে পারেননি। যতই হোক মেয়ে তো উনারই। তাই মেহেরের সিদ্ধান্ত বদলের পর তার অনুরোধেই উনিও ইমার্জেন্সি টিকিট করে সন্ধ্যা নাগাদ এসেছেন এখানে।
রাফিদ ইরিনের বিয়েটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হলো। নক্ষত্র রাফিদকে মিষ্টি খাইয়ে দিয়ে বললো, ‘কংগ্রাচুলেশনস মি. রাফিদ। এট লাস্ট ইউ আলসো গট ম্যারিড। ‘
নক্ষত্রের কথার বিপরীতে হুট করেই তাকে জড়িয়ে ধরলো রাফিদ। ভরাট গলায় বললো, ‘থ্যাংক ইউ ভাই। বড় ভাই না থাকার কমতি ফিল হতো মাঝেমধ্যে। কিন্তু আজ বুঝলাম আমার আর কখনো বড় ভাইয়ের কমতি অনুভব হবে না এ জীবনে। থ্যাংক ইউ সো মাচ ভাই।’
নক্ষত্র প্রথমে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও পরে হেসে ফেললো রাফিদের কথায়। নিজেও জড়িয়ে ধরলো তাকে। পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো, ‘ভাই কখনো ভাইকে ধন্যবাদ দেয় না, রাফিদ। তাদের বন্ডিংটাই এমন, যেখানে ধন্যবাদ বলে কোন শব্দ খাটে না। ভালোবাসা খাটে। আল্লাহ তোমাকে ভালো রাখুক ইন শা আল্লাহ। নতুন জীবন সুন্দর হোক। আর হ্যাঁ, ভাই যেহেতু মানছোই তাহলে এবার থেকে তুমি করে বলবা আমাকে। ওকে?’
‘ইন শা আল্লাহ।’ নক্ষত্রকে ছেড়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হেসে বললো রাফিদ।
১৭৭.
কাজী সাহেবকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকা হলে উনি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই রাফিদ বললো, ‘কাজী সাহেব…বসুন আরেকটু। আরেকটা বিয়ে পড়ানো বাকি। ‘
রাফিদের এমন কথায় উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে। নক্ষত্র জিজ্ঞেস করলো, ‘ কার বিয়ে?’
‘আমার ভাই আর প্রিয় বন্ধুর।’
নক্ষত্র ভ্রু কুচকে তাকালে রাফিদ এগিয়ে গিয়ে তাকে হাত ধরে টেনে এনে সোফায় বসালো।তারপর, মেহেরকে ইশারা করতেই সে ইরিনকে এনে নক্ষত্রের মুখোমুখি সোফায় বসিয়ে দিল। কনক শায়লার বিয়ের লাল ওড়নাটা এনে ইরিনের মাথা দিয়ে তা মুখ পর্যন্ত টেনে দিল। পাতলা লাল ওড়ানাটা ভেদ করে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে ইরিনের মুখটা। নক্ষত্র আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখলো সেটা। মুগ্ধা খেলে গেল তার চোখের তারায়। ‘মাশাল্লাহ’ বলে মুচকি হাসলো সে। ইরিন লজ্জায় মাথা নীচু করে বসে আছে।
এরপর, রাফিদ কাজী সাহেবকে বললো, ‘কোন কাগজি ঝামেলা নেই। কেবল ইসলামিক নিয়মে এদের কবুল বলিয়ে বিয়ে পড়ান কাজি সাহেব।’
‘কিন্তু, এরা তো বিবাহিত, তাই না বাবা?’ কাজী সাহেন বিভ্রান্ত স্বরে প্রশ্ন করেন।
‘হ্যাঁ। কিন্তু, তখন আমি ছিলাম না। বড় ভাইয়ের বিয়েতে ছোট ভাই থাকবে না, এটা কখনো হয়? নিন.. আপনি বিয়ে পড়ান।’
মারিয়াও এতে সায় দিয়ে জোর গলায় বললো, ‘হ্যাঁ…একদম ঠিক। আমিও ছিলাম না সে সময়।আমিও মিস করেছি বান্ধুবীর বিয়ে। এবার যখন সুযোগ পেয়েছি মিস করতে চাই না। ‘
কাজী সাহেব রাফিদ বা মারিয়ার কথার মারপ্যাঁচ কিছুই বুঝলেন না। বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে দেখলেন চারপাশের সবাইকে। নক্ষত্র-ইরিনও কিছু বলছে না। তারাও বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বসে আছে। শায়লা, কনক মিটমিটিয়ে হাসছে। তারা তো আগে থেকেই জানতো রাফিদের এই পরিকল্পনার কথা।
‘নিন…নিন…শুরু করুন। অনেক রাত হয়ে গেছে অলরেডি ।’ কাজী সাহেবকে তাড়া দিল রাফিদ। নক্ষত্র এবার মুখ খুললো।
‘নতুন করে বিয়ে পড়ানোর কি আছে মি. রাফিদ? কোন দরকার নেই এসবের।’
‘আহ…..নক্ষত্র। এমন হলেই বা সমস্যা কি! জাস্ট কবুলই তো বলবা দুজনে।’ শায়লা বললেন।
‘কিন্তু, আম্মু…’ ইরিন কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু রাফিদ সুযোগ দিল না। কাজি সাহেবকে তাড়া দিল আবার। অগ্যতা কাজী সাহেব আবারও বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন।
সকলের সামনে মৌখিকভাবে নক্ষত্রের সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণার পর ১ টাকা মোহরানায় কাজী সাহেব প্রথমে ইরিনের সম্মতি চেয়ে কবুল বলতে বললেন।
ইরিনের কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। প্রথমবার নক্ষত্রের সাথে বিয়েতে যেমন কষ্ট আর ভয় হয়েছিল, এবার সেরকম কোন অনুভূতি হচ্ছে না। বরং কেমন শান্তি শান্তি, সুখানুভূতি হচ্ছে।লজ্জায় উত্তেজনায় বুকের ভেতর দামাডোল বাজাচ্ছে যেন কেউ। চুপ করে আছে সে। সেটা দেখে পেছনে দাঁড়ানো রাফিদ কিছুটা ঝুঁকে এলো ইরিনের কানের কাছে। আস্তে করে বললো,
‘আগেরবার তো কবুল বললেও সেখানে প্রাপ্তি ছিল কেবল। এবার নক্ষত্র বন্দনার অর্জন হিসেবে খুশি মনে কবুল করুন তাকে। ‘ রাফিদের কথায় ইরিন ছলছল চোখে তার দিকে তাকাতেই রাফিদ মিষ্টি করে হেসে চোখের ইশারায় সায় দিল। ইরিন আর সময় নিল না। চোখে জল ঠোঁটে হাসি মেখে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। আস্তে করে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল…কবুল..কবুল।’
নক্ষত্রের বেলায় কাজী সাহেবের এক মূহুর্তেও সময় লাগেনি। তবে নক্ষত্র ইরিনের মুখোমুখি নয়, একদম তার পাশে বসে ইরিনের হাতনিজের হাতে মুঠো বন্দি করে নিয়ে ঝটপট আলহামদুলিল্লাহ বলে তিন কবুল বলে ফেলেছে।
ইরিন আজও কেঁদেছে। তবে, সেটা তার ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসা দিয়েই নিজের করে অর্জনের খুশিতে।
নক্ষত্রও শক্ত করে তার হাত ধরে আছে। হঠাৎ কানের কাছে মুখ নিয়ে সবার অগোচরে বললো, ‘কাঁদে না পরী। তোমার নক্ষত্র বন্দনা তো সার্থক। এবার আমার পালা। আমার প্রাপ্তিকে আমার আজীবনের অর্জন করে নেওয়া।আমি পারবো তো, না?’
ইরিন কিছু বলে না বিপরীতে। নক্ষত্রের চোখে চোখ রেখে মিষ্টি করে হাসে কেবল। যে হাসি জানান দেয় প্রবল ঝড়বৃষ্টি শেষে ছেয়ে যাওয়া হিমেল হাওয়ার মত স্বস্তির। ভরসা করে নিজের সবকিছু নক্ষত্রের কাছে উজাড় করে দেওয়ার সম্মতি। যে হাসিতে মিশে আছে আজীবন পরম নিষ্ঠার সাথে নক্ষত্রকে ভালোবেসে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি।
চলবে…