নক্ষত্র_বন্দনা,পর্ব_৩০ শেষাংশ_শেষভাগ
লেখায়_জারিন
ইরিন নক্ষত্রের পুনরায় এক হবার গল্প শেষ করতে গিয়ে রাত প্রায় ১২ টা বাজিয়েছে ওরা। এরপর, রুনা, কনক, রিতু, পুতুল, ইরিন আর নক্ষত্র মিলে রাফিদ ও মেহেরকে বাসর ঘরে রেখে গেছে। এর জন্য অবশ্য মোটা অংকের টাকাও খসিয়েছে ওরা রাফিদের কাছ থেকে। ওদের কথা ৫ লাখ টাকা নগদ মোহরানায় বিয়ে করা বউয়ের মুখ দেখতে গেলে কিছু নাজরানা (উপহার) তো তাদেরও প্রাপ্য। রাফিদ কোন কৃপণতা করেনি। তবে সামান্য চালাকি করেছে। দশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল ধরিয়ে দিয়েছে ইরিনের হাতে। বলেছে, ভাগ বাটোয়ারার দায়িত্ব তার। কারণ রাফিদ জানে এখন যেমন তার পকেট কাটা যাচ্ছে একটু পরে নক্ষত্রেরও যাবে। তাই মোটের ওপর ভাগাভাগির কাজটা ইরিনই করে দিক। সে ঝামেলা বিহীন বাসর করুক।
এখন রাত ১২: ২০ বাজে। বাসর রাতের নফল নামায আদায়ের পর ফুলে ফুলে সজ্জিত বিছনায় কোলে বালিশ নিয়ে বসে আছে মেহের। ভাবছে সে কিছু একটা। রাফিদ বিছানায় ছড়ানো ফুলগুলোকে ঝেড়ে মেহেরের পাশে বসতে বসতে বললো, ‘কি ভাবতেছে মেহেরজান?’
‘এটা কি হলো বলো তো রাফিদ? ‘হতাশা ও মন খারাপের সুরে বললো মেহের।
‘কোনটা?’
‘এই যে ভাবী যে শুধু তাকে নক্ষত্রবাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথাটাই বললো, মিল কিভাবে হলো সেটা তো বিস্তারিত বললো না। সোজা ‘বাকিটা ব্যক্তিগত ’ ট্যাগ লাগিয়ে গল্প শেষ করে দিল।’
‘কিছু করার নেই মেহের। ইরিন বরাবরই নিজের ব্যক্তিগত মূহুর্তের কথা কাট করে গল্প শোনায়। ‘ইরিনের পরিচিত স্বভাবে হতাশ হয়ে বললো রাফিদ।
‘তাহলে কাহিনী কি দাঁড়ালো? ‘ হিসেব মিলানোর মত করে প্রশ্ন করে মেহের।
‘কি আর!ভাই তাকে মিথ্যা বলে নক্ষত্রবাড়ি নিয়ে গেছিল। আর সেখানে গিয়ে এমন কিছু ভাই ঘটিয়েছে যেটার কাছে টিকতে না পেরে বন্ধু আমার সারেন্ডার করে দিয়েছে। তবে যত যাই বলো, ভাই কিন্তু আমার এ ব্যাপারে মাশাল্লাহ, ব্যাপক ট্যালেন্ডেট! ‘ খুশিতে গদগদ হয়ে বললো রাফিদ।
তার এ কথায় ভ্রু কুচকে ফেললো মেহের। অবুঝ গলায় প্রশ্ন করলো, ‘কোন ব্যাপারে?’
তার প্রশ্নে রাফিদের খুশি খুশি ভাবটা মূহুর্তেই ফুঁটে যাওয়া বেলুনের মত ফুস হয়ে গেল। হতাশ গলায় বললো, ‘পুরো গল্পই তো জানো। তারপরেও বুঝো না?’
‘না। কোন ব্যাপারে বলো তো?’ সরল স্বীকারক্তি মেহেরের। এটা দেখে চরম হতাশ হলো রাফিদ। পুরো গল্প জেনে যখন কেউ প্রশ্ন করে, সীতা কার বাপ? তখন হতাশ হওয়া ছাড়া আর উপায় কি!
মেহের তাড়া দিল। ‘ এই, বলো না কোন ব্যাপারে নক্ষত্র ভাইয়া এত ট্যালেন্টেড? ‘
‘বউ বশীকরণ। ‘ বিরস গলায় বললো রাফিদ।
‘মানে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মেহের।
‘বুঝো নাই এখনো?’ কঠিন স্বরে প্রশ্ন করে রাফিদ।
‘উহু।’ মেহের অসহায় স্বরে নিজের অপারগতা স্বীকার করে। এটা দেখে রাফিদের এবার হাসি পেল। কিন্তু, সে হাসি চেপে গেল। হাল না ছাড়ার মত করে বললো,
‘আচ্ছা….আসো আমার মেহেরজান, তোমাকে হাতে কলমে বুঝিয়ে দেই। ‘ কথা শেষ করে রাফিদ আর একমূহুর্তও দেরি করলো না। একহাতে মেহেরের কোমড় চেপে তাকে কাছে টেনে নিল। তারপর, অন্যহাতে ঘরের মৃদু আলোটুকুও নিভিয়ে দিল।
১৮১.
‘মাত্র দশ হাজার? এটা কিছু হইলো ভাইয়া?’ নারাজ গলায় বললো কনক।
‘এই পুচকের দল, একটু আগেই তো রাফিদের পকেট কেটে দশ হাজার টাকা খসিয়ে আনলি…আমার থেকেও নিচ্ছিস। এত টাকা দিয়ে করবিটা কি তোরা?’
‘বাবাই শপিং কব্বো। আন্নি, ফুপ্পি বলেছে তুমি টাকা দিলে ওরা আমাকে বেড়ু করতে নিয়ে যাবে। চকলেট আর ডল কিনে দিবে। তুমি টাকা দাও তো বাবাই।’ বাবার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে এসে বলে পুতুল।
‘এরা তোমাকে শেষমেশ ঘুষ দিচ্ছে, পুতুল আম্মু?’ নক্ষত্র বললো।
‘এই…এটাকে ঘুষ বলো ক্যান ভাইয়া…এটা তো নাজরানা। খুশি মনে উজাড় করে দিতে হয়। ‘ রিতু বললো পুতুলের হয়ে।
‘হ্যাঁ….আর এই যে দেখো তোমার পুরান বিয়ের জন্য কেমন নতুন করে বাসরঘর সাজিয়ে দিয়েছি আমরা।এর জন্য খুশি হয়ে এমনিতেই তো বেশি বেশি দিবা তুমি। কিপটামি করো কেন?’রিতুর কথায় সঙ্গ দিয়ে বললো কনক।
রুনা আর ইরিন সবটা দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে। নক্ষত্র বেচারা হার মানলো এই বোন ব্যাটিলিয়ানের কাছে। আরও দশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল ধরিয়ে দিল পুতুলের হাতে। মিষ্টি হেসে বললো, ‘এই নেন আম্মু…আপনাদের নাজরানা। ‘
পুতুল নক্ষত্রকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘থ্যাংক ইউ বাবাই।’
নক্ষত্র মেয়েকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিল। এরপর, সব এক এক করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তারা যেতেই নক্ষত্র দরজা আটকে দিয়ে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে এসে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লো।
ইরিন দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা দূরে খাটের এক কোণা বরাবর। ক্লান্ত নক্ষত্রকে দেখে ঘড়ি দেখলো সে । রাত ১২: ১৯ বাজে। আজ প্রায় দুদিন, বেশ ধকল গেছে নক্ষত্রের। তারও যে আজ কম ধকল গেছে তাও নয়। কিন্তু, ওর মনে অন্য কিছু চলছে। নক্ষত্রকে বলবে কি বলবে না ভাবতে ভাবতেই নক্ষত্র তার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ডোন্ট ওয়্যারি, ইরিন। নফল নামাযটা পড়বো আজও। যাও তুমি শাড়ি চেঞ্জ করে অযু করে আসো। আমি একটু রেস্ট করে তারপর যাই।’
নক্ষত্রের এমন কথায় ইরিন অবাক স্বরে প্রশ্ন করে, ‘আপনি বুঝলেন কি করে আমি এটা বলতে চাইছিলাম?’
‘ বন্ধুত্ব করেছি, মনের কথা বুঝবো না বলো? ক্লান্ত মুখেও মিষ্টি হেসে বললো নক্ষত্র।
ইরিনের মুখের ফুঁটে উঠলো প্রশান্তির হাসি। মনে মনে সৃষ্টিকর্তা ও রাফিদের প্রতি কৃতজ্ঞা প্রকাশ করলো। একই সাথে হৃদয়ে ভালোবাসার গভীরতায় আরও নিবিড়ভাবে জায়গা করে নিল তার জীবনের রাত দিনের নক্ষত্র।
১৮২.
‘আজকে কি দো’য়া করলা?’ -নামায শেষে জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে প্রশ্ন করলো নক্ষত্র।
ইরিন অবুঝ স্বরে পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘মানে?’
‘না….মানে আগের বার তো আমাদের ম্যারিড লাইফ নিয়ে একটুও দোয়া করো নাই। কারণ, তখন তো আমাকে তোমার পছন্দই ছিল না। তা এবার তো সোজা ভালোবেসেই বিয়ে করলে। তাই জিজ্ঞেস করছি…আজকে আমাদের ম্যারিড লাইফের জন্য কি দোয়া করলে?’ ইরিনকে ভেঙে চূড়ে বুঝিয়ে বললো নক্ষত্র।
ইরিন চোখ ছোট ছোট করে তাকালো নক্ষত্রের কথায়। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করলো, ‘আগেরবার কোন দো’য়া করিনি, এ কথা কে বললো আপনাকে?’
‘রাফিদ বলেছে।’ সোজাসাপটা উত্তর দেয় নক্ষত্র।
ইরিন পুরো বোকা বনে যায় তার জবাবে। রাফিদের উপর মেজাজ খারাপ হয়। এই লোক কি তার মান সম্মান কিছু রাখেনাই নাকি! সবই কি বলে দিয়েছে নক্ষত্রকে? মনের প্রশ্নটা চট করেই নক্ষত্রের কাছেও করে ফেললো সে।
‘আর কি কি বলেছেন রাফিদ?’
‘বলেছে তো অনেক কিছুই। আমার অলক্ষ্যে রয়ে যাওয়া ইরিনকে চিনিয়েছে আমাকে। আল্লাহর রহমতে ওর উছিলায়ই আমি আমার ভালোবাসাকে আবার ডানা মেলে উড়তে দিতে সক্ষম হয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ…আমার পরীকে আবার তার নক্ষত্রের কাছে নিয়ে আসতে পেরেছি আজীবনের জন্য।’ মায়া চোখে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো নক্ষত্র।
ইরিনের মন ভিজে উঠলো নক্ষত্রের এমন সরল স্বীকারক্তি আর মায়া চাহনীতে। এ চাহনীতে কেবল ইরিনের জন্য হৃদয় নিঙড়ানো মায়া আর ভালোবাসা দেখতে পায় ইরিন। সব বিভৎস অতীত, কষ্ট যন্ত্রণার উর্ধ্বে তখন নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী মনে হয় তার। এ যেন তার হৃদয়ের পরিশুদ্ধতার….নক্ষত্র বন্দনারই পরম পাওয়া।
স্মিত হাসে ইরিন।এগিয়ে যায় নক্ষত্রের দিকে। নক্ষত্র বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। ইরিন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তার পানে মুখ তুলে চাইলো নক্ষত্র। স্মিত হাসলো সেও। ইরিন তার চোখে চোখ রাখলো। তারপর ঝুঁকে তার কপালের মাঝ বরাবর ছুঁইয়ে দিল তার নিগূঢ় ভালোবাসা। অতঃপর নক্ষত্রকে বললো,
‘আমি আল্লাহকে বলেছি আমার জীবনের অন্তিত প্রহর পর্যন্ত যেন আমি এই নক্ষত্রের ছত্রছায়ায় থাকতে পারি এবং পরপারে গিয়েও যেন নক্ষত্রকে নিজের মাঝে ধারণ করে তার হয়েই থাকতে পারি।এই যেন তৌফিক তিনি আমাকে দেন।’
‘বাহ! কি স্বার্থপর গো তুমি!’
আচমকা নক্ষত্রের এমন কথায় থতমত খেয়ে গেল ইরিন। অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো, ‘কেন?’
‘এই যে সব শুধু নিজের জন্য চাইলে। নক্ষত্রেরও তো তার পরীকে লাগবে আমৃত্যু। সেটার কথা একবারও ভাবলে না তুমি? ছিঃ ইরিন। ইউ আর ভেরি সেলফিশ।’ মেকি অভিমান দেখিয়ে বললো নক্ষত্র।
তার এ কথায় ফিক করে হেসে ফেললো ইরিন। নক্ষত্র ভ্রু কুচকে তাকালো। ইরিন তার চুলগুলোয় আঙুল চালাতে চালাতে বললো, ‘এমন স্বার্থপর হয়ে যদি এপার -ওপার সব জীবনেই নক্ষত্রকে নিজের জন্য পাওয়া যায় তবে আমি স্বার্থপরই ভালো। বাকি পরীকে চাওয়ার আর নিজের করে রাখার দায়িত্বটা নক্ষত্রের হোক। ‘
নক্ষত্রও এবার হেসে ফেললো ইরিনের কথায়। হাসি জড়ানো মুখে ইরিনের কোমড় ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। ইরিনের মুখপানে চেয়ে বললো, ‘জো আপকি মার্জি মেরি, পারী।’
ইরিন মিষ্টি করে হাসলো তার কথায়। নক্ষত্র এবার বললো, ‘আমার বাসররাতের গিফট কই?’
ইরিনের হাসি মিলিয়ে গেল। এ কি বলে নক্ষত্র! সে কোন গিফট আনা তো দূর এভাবে নতুন করে বিয়ে, বাসররাতের জন্যও প্রস্তুত ছিল না। অথচ নক্ষত্র নিজ থেকে গিফট চাইছে। নিজ থেকে খুব কমই কিছু চেয়েছে সে আজ পর্যন্ত ইরিনের কাছে। কিন্তু এখন কি বলবে সে? কি দিবে তাকে?
ইরিন আমতা আমতা করে বললো, ‘গিফট তো নেই।’
‘প্রথম বাসরেও কিন্তু দাওনি কিছুই।’ চট করেই তাকে খোঁচা মেরে বলে বসলো নক্ষত্র। ইরিন এবার সত্যি সত্যি লজ্জায় পড়ে গেল। নিজেকে লজ্জা থেকে উদ্ধারের জন্য বললো, ‘আ..আমি তো আসলে জানতাম না….এভাবে এসব কিছু হবে।তাই গিফটও এরেঞ্জ করা হয়নি কিছু। ‘
‘তাহলে একটা কাজ করি চলো। দুজনে মিলে গিফট এরেঞ্জ করি।’ ইরিনকে এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের উপায় হিসেবে বললো নক্ষত্র।
ইরিন বিভ্রান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিভাবে?’
নক্ষত্র ইরিনকে কোলে বসিয়ে কানে কানে কিছু বললো। ইরিন পুরো তাজ্জব বনে গেল নক্ষত্র গিফটের আইডিয়া শুনে। আপত্তি জানিয়ে বললো, ‘আইডিয়া খুবই বাজে। আর তাছাড়া এটা কোন গিফট হইতে পারেনা। আমি অন্য কিছু দিয়ে দিবো পরে আপনাকে।’
‘অন্যকিছু চাইনা আমার। এটাই লাগবে। দিবা না?কষ্ট কি বেশি হয়ে যাবে তোমার, ইরিন?’
ইরিন এবার ভীষণ অসহায়বোধ করলো। নক্ষত্রকে এই উপহার দেওয়ার সক্ষমতা ওর সত্যিই এখনো আর আছে কি না জানা নেই তার। তবে, নক্ষত্রের এমন চাওয়াকে উপেক্ষা করতেও তার কষ্ট হবে ভীষণ। ইরিন ভাবলো এই নিয়ে।
জীবন সামন্য ভুলের শাস্তিও কত সময় কত নিষ্ঠুরতার সাথে দেয় যা জীবন ভর বয়ে বেড়াতে হয়। পুতুলের জন্মের পর অনিয়মিত পিরিয়ড সহ বেশ কিছু সমস্যার জন্য যখন ড. সুব্রতর শরণাপন্ন হয় ইরিন,ডক্টর তখন রিপোর্ট দেখে জানায়
বিভিন্ন শারিরীর জটিলতায় ইরিনের সন্তান ধারণের ক্ষমতা কমে গেছে। যদি কন্সিভ করেও পুনরায় সন্তান জন্মদানও অনেক কষ্টকর হবে। এটা নক্ষত্র জানেনা। তাই আজ এতগুলো বছর পর অজ্ঞাত নক্ষত্র দ্বিতীয় সন্তান চাইছে।
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। তারপরও,মুখে মিষ্টি হাসি জিড়িয়ে নক্ষত্রের উৎসুক চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘উহু। আল্লাহ চাইলে ইন শা আল্লাহ এটাই হবে আপনার উপহার।’
‘খুব ভালোবাসো আমাকে?’
‘বলতে পারছিনা। ভালোবাসার পরিমাপ তো করতে জানি না।’
‘আমি এমনি বলেছি। লাগবে না আমার এমন উপহার যেটার জন্য তোমাকে কষ্ট পেতে হবে। তাছাড়া, পুতুল তো আছেই। ‘
‘কিন্তু, আমিও যে এখন এটাই দিতে চাই। নক্ষত্রের অংশ আরেকটা নক্ষত্র! ‘
‘তুমি শিওর?’
‘ইচ্ছা যখন দুজনেরই তখন চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।’ স্মিত হেসে বললো ইরিন।
‘কিন্তু তার আগে প্রস্তুতি নেওয়া লাগবে।আমি গতবারের মত ভুল করার রিক্স নিবো না আর। আচ্ছা, যাই হোক…এখন চলো তো।’
‘কই যাবো?’
‘ছাদে।’
ইরিন ঘড়িতে সময় দেখলো। রাত দেড়টা প্রায়। অবাক গলায় বললো, ‘এত রাতে ছাদে কেন? এই না তখন এলাম ছাদে থেকে।’
‘শুনেছি ভরা পূর্ণিমায় পরী নেমে আসে ছাদে।আমার ভীষণ শখ পরীর সাথে একটা রাত গল্প করে কাটাবো।’
‘মানে কি? কি সব বলতেছেন পুতুলের বাবাই?’
নক্ষত্র ইরিনের প্রশ্নের কোন জবাব দিল না।বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে ঘরের দরজা খুললো। ইরিন কি হচ্ছে তা বুঝার চেষ্টা করছে। তাকে অবাক করে দিয়ে নক্ষত্র তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে বললো, ‘আমার ব্যক্তিগত পরী থাকতে পরপরীর সাথে গল্প করাটা অন্যায় হয়ে যায়। কিন্তু, শখ যখন হয়েছেই সেটা পূরণ তো করাই লাগে নাকি?! So…lets go.’
ইরিন প্রথমে অবাক হলেও নক্ষত্রের এমন পাগলামোতে হেসে ফেললো সে। নক্ষত্রের গলা জড়িয়ে ধরতেই নক্ষত্র পা বাড়ালো ছাদের দিকে।
১৮৩.
৪ বছর পর,
‘ভাবী…..তুমি কি শেষবার একবার ছুঁয়ে দেখবা না ভাইয়াকে? তাকে কিন্তু একটু পরেই নিয়ে যাবে। এই ভাবী…’
মেহের কথায় বিমূঢ় ইরিন একপলক তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। নিজের পেটের উপর হাত রেখে সামনে রাখা খাটিয়ার দিকে তাকালো।সাদা ধবধবে কাফনের কাপড় জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে নক্ষত্র। ক্ষত বিক্ষত মুখটাই দেখা যাচ্ছে শুধু। আজ আবারও এই শ্বেতশুভ্র এ রঙে নক্ষত্রকে দেখে ভয় হলো তার। বুকের ভেতর অনবরত কামড়ে যাচ্ছে কিছু একটা। যেন খুবলে খুবলে খাচ্ছে তাকে। কিছু দূরেই দু বছর বয়সী ছোট্ট ছেলেটার গলাফাটানো চিৎকার শুনতে পাচ্ছে ইরিন।বাড়িভর্তি এমন পরিবেশ আর এত মানুষ দেখে ভয় পাচ্ছে সে। মাকে খুঁজছে। কিন্তু, কেউ তাকে তার মায়ের কাছে যেতে দিচ্ছে না। রিতু পুতুলকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে এক কোণায়। শায়লা হিমশিম খাচ্ছেন বাচ্চাটাকে সামলাতে।
দেড় বছরের চেষ্টা ও চিকিৎসার পর আবারও মা হয়েছে ইরিন।দুই সন্তানের পর, পুনঃরায় তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা এখন সে।।নক্ষত্রকে জানানো হয়নি এ কথা। এই তো দুদিন আগেই জানতে পেরেছে সে। নক্ষত্র দেশের বাইরে ছিল।ভেবেছিল বাড়ি ফিরলে জানাবে তাকে।
গতকাল দেশে ফিরেছিল। কিন্তু, ফেরা হয়নি ঘরে। নিজের পরিবারের কাছে। জানা হয়নি অনাগত সন্তানের কথা। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি দূর্ঘটনার শিকার হয়।একটা ট্রাক খুব বাজেভাবে ধাক্কা দেয় তার গাড়িটিকে। ড্রাইভারের স্পট ডেথ। নক্ষত্রকে যতক্ষণে উদ্ধ্বার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হয়। ডাক্তাদের অনেক চেষ্টার পরেও ৮ ঘন্টা পর সে মারা যায়। শেষ সময় ইরিন ছিল কাছে। কিন্তু, দূরে দরজার বাইরে। নক্ষত্রের জ্ঞান ফিরেছিল কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু,কথা বলার অবস্থা ছিল না তার। শুধু ইরিনকে দেখেছিল নিস্তেজ চোখে। এই ছিল তাদের শেষ দৃষ্টি বিনিময়।
নক্ষত্র নেই এক কথাটা জানার পর থেকে একদম চুপ হয়ে গেছে ইরিন। মেহের বা কেউ কোনভাবেই কথা বলাতে পারছেনা তাকে দিয়ে। নক্ষত্রকে বাড়ি আনার পরেও একবারও তাকে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেনি ইরিন। নক্ষত্রকে নিয়ে যাওয়া হবে একটু পরেই। মেহের, রিতু, আম্বিয়া অনেক বলে কয়েও কিছুই বলাতে পারেনি তাকে। মেহের এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইরিন স্বাভাবিক হচ্ছে না কিছুতেই। সে সব দেখছে, শুনছে, বুঝতে পারছে কিন্তু কেউ যেন তাকে অবশ করে রেখেছে। গলা চেপে ধরেছে। টু শব্দটাও বের হচ্ছে না।
______________
‘লাশ তো নিয়ে যাবে এখনি। ওর গয়নাগাটি খুলো।সাদা শাড়ি পড়াও। আর কত এই সাজে বইসা থাকবে?’ ইরিনের বড় খালা শাশুড়ি বললেন। ইরিন তা শুনলো কিন্তু তাও কিছু বললো না। ওর মনে পড়ে গেল নক্ষত্রের বলা কথাটা।
নুপুরের স্বামী যখন মারা যায়….সম্পর্ক ছিন্ন করতে না পারার দায়ে তারা ও বাড়ি যায়। তখন নুপুরের বিধবা সাজ দেখে বাড়ি ফিরে সে ইরিনকে বলেছিল, ‘ইরিন….ফুপুকে যেভাবে বিধবা সাজানো হয়েছে এমন কোন নিয়ম কিন্তু ইসলামে নেই। এসব নাকফুল, চুড়ি খুলে ফেলা, সাদা শাড়ি পড়ার কোন বাধ্যকতা নেই ইসলামে। জীবনে এমন কোন পরিস্থিতি আসলে তুমি কিন্তু কখনোই এমন কু সংস্কার মানবে না। এখন যেমন আছো তেমনই থাকবা। তোমার সাজ সজ্জায় যেন কখনো মলিনতা না ছোঁয় তোমাকে।’
ইরিন সেদিন খুব রাগ করেছিল নক্ষত্রের কথায়। কিন্তু, এমন দিন, এমন পরিস্থিতি যে সত্যিই তার জীবনেও আসবে ভুলেও কখনো কল্পনা করেনি সে। অথচ আজ তাকেও কুসংস্কারে কূপে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
একজন মহিলা এসে ইরিনের চুড়িতে হাত দিয়েই নিরবেই হাত সরিয়ে নিল ইরিন। মহিলা বললো,
‘এগুলা খুলো বউ। এখন আর এসব পড়ার নিয়ম নাই। বিধবা হইছো….স্বামীর মান রাখো। ‘
‘আপনি এসব কি কথা বলতেছেন আন্টি? ইসলামে এমন কোন নিয়ম নাই। ‘ মেহের বাঁধা দিয়ে বললো।
‘তুমি দুইদিনের বাচ্চা মেয়ে তুমি কি জানো এসবের? ‘
‘ সঠিকটা জানার জন্য দুই দিন বা দুইশ দিন লাগে না আন্টি। ইসলামের যা নিয়ম তা সবার জন্য শুরু থেকেই এক। আপনারা সমাজ সংস্কারের নামে এগুলাকে বিকৃত করে ফেলছেন। ‘
‘মেয়ে তুমি কিন্ত..’
‘মেহের ঠিকই বলছে আপা। ইরিনের গয়না খোলার দরকার নাই। সাদা কাপড়ও ও পড়বে না। নক্ষত্র এসব মানতো না। ‘ কঠিন গলায় বললেন শায়লা।
তাদের কথার মাঝেই ইরিন আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। দূর্বল শরীরে এগিয়ে গেল খাটিয়ার কাছে। রাফিদ তাকে ধরে নক্ষত্রের মাথার কাছে বসিয়ে দিল। মাথার কাছে সেলাই, চোখের কাছেও সেলাই পড়েছে। ঠোঁট কেটেছে। এছাড়াও সমস্ত শরীরে কম বেশি বেশ কিছু ক্ষত আছে। কাফনে মোড়ানো থাকায় কেবল মুখটাই দেখা যাচ্ছে। ইরিন হাত বাড়িয়ে নক্ষত্রের মুখটা ছুঁয়ে দিল আলতো করে। কপালে ছুঁয়ে দিল ভালোবাসাময় শেষ চুম্বন। কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বললো,
‘শুনতে পাচ্ছেন নক্ষত্র? আরেক টুকরো নক্ষত্র আসছে আমাদের প্রেম জমিনে। খুশি হয়েছেন আপনি? শুনতে পাচ্ছেন তো আমার কথা? নক্ষত্র? এই নক্ষত্র….পুতুলের বাবাই….শুনতে পাচ্ছেন না আপনি?? কিছু বলছেন না কেন? এই নক্ষত্র? আপনার সন্তান আসছে….আপনি খুশি হয়নি? এপর্যায়ে প্রায় ফুঁপিয়ে উঠা কান্না তার আর্তনাদে রূপ নিল। চিৎকার করে ডাকতে থাকলো সে নক্ষত্রকে। মেহের ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
কনক, শায়লাও এবার আর নিজেদের ধরে রাখতে পারলো। ইরিনের মুখে তার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কথা যেন মূহুর্তেই বজ্রাহত করে দিয়েছে তাদের নতুন করে। রিতু পুতুলকে জড়িয়ে কাঁদছে। পুতুল ভয়ে গুটিসুটি মেরে রিতুর বুকে মুখ লুকিয়েছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।রাফিদ কি করবে বুঝতে পারছে না। নক্ষত্রকে হারানোর কষ্ট তারও যে কম নয়।
গত মাসে ওয়াসিফ জেলে আত্মহত্যা করে। নক্ষত্র, রাফিদ ওই বাড়ি যাওয়ার পর নুপুর অনেক আজেবাজে কথা বলেছে তাদের। নক্ষত্রের উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিল সে। রাফিদের ধারণা নক্ষত্রের এমন এক্সিডেন্টের পেছনে নুপুর রায়হান জড়িত। যদিও কোন প্রমাণ নেই। তবুও, এক্সিডেন্টের ধরণ স্বাভাবিক নয় বলেই জানিয়েছে পুলিশ। ইরিনকে বলেনি এই কথা। তাকে এই কষ্টে দেখেই তার সহ্য হচ্ছে না তার। সত্যি জানলে সামলাবে কি করে সে নিজেকে?এই ভেবেই বলেনি। এত কষ্টেও দায়িত্ব থেকে পিছু সরে আসতে পারলো না সে। নক্ষত্রকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল।
______________
পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন মূহুর্ত, কষ্টের হচ্ছে বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ।নাফিজ শেখ সারাজীবন নক্ষত্রের সাথে থেকেও বাবা ছেলের সাবলিল সম্পর্ক গড়তে পারেননি। একটা সূক্ষ ও স্পষ্ট দূরত্ব বরাবরই ছিল তাদের মাঝে। নাফিজ শেখ নিজের অপরাগতায় অনুতপ্ত হয়েও কখনো ক্ষমা চাওয়ার সাহস করে উঠতে পারেননি নক্ষত্রের কাছে। তবুও, সম্পর্ক ও দায়িত্বের খাতিরে নক্ষত্র তাকে বাবার সম্মান ও অধিকার সবটা দিয়েছে। কেবল দেয়নি ভালোবাসাটুকু। শেষে একটা অপূর্ণ সম্পর্ক রেখেই ওপারের পথে পা রেখতে হয়েছে নক্ষত্রকে।
আজ নাফিজ শেখ ভাবেন, যদি একটাবার তার অহংকে পেছনে ফেলে নক্ষত্রের কাছে ক্ষমা চাইতো, তাকে কাছে টানার চেষ্টা করতো আজ হয় তো এতটা আফসোস নিয়ে ছেলেকে কবরের অন্ধকারে রেখে আসতে হতো না। এই জন্যই বলে সময় গেলে সাধন হয় না। স্রোতের মত সময়….তবুও বড্ড দামী এই সময়!
নক্ষত্রকে যখন নিয়ে যাওয়া হলো ইরিন তখন জ্ঞানহীন হয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়েছিল। তার জীবনের নক্ষত্রকে শেষ যাত্রায় দেখা হয়নি তার। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই আরও বেশি নিরবতা যেন জাপটে ধরেছিল তাকে।
রাফিদ, মেহের অনেক বুঝিয়ে স্বাবাবিক করেছে তাকে কিছুটা। কিন্তু, অতিরিক্ত স্ট্রেস…শারীরিক দূর্বলতা এবং হরমোনজনিত সমস্যার কারণে মাস গড়াতেই এক রাতে প্রবল রক্ত ধারায় মিশে বাচ্চাটাও মিসক্যারেজ হয়ে যায়।
নক্ষত্রের শেষ চিহ্নকে আগলে রাখতে পারার ব্যর্থতায় নিজেকে দায়ী করে নতুন শোকে জড়ায় সে। ডিপ্রেশন, শারীরিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে অসুস্থ থাকে দীর্ঘদিন। এ সময়টা মেহের, রিতু , রাফিদ, শায়লা মিলে সামলেছে তাকে। তার দুই সন্তানকে।
পৃথিবীতে মা এমন একটা স্বত্তা যে কখনো হার মানে না। সব বিপদ, দুঃখ কাটিয়ে ফিরে আসে সন্তানের টানে। ইরিনও নক্ষত্রের শোক নিয়েই ধীরে ধীরে তার রেখে যাওয়া অস্তিত্বদের জন্য নিজেকে সামলে নিয়ে জীবন যুদ্ধে নেমে যায়। পারিবারিক ব্যবসা সামলে, সন্তানদের আদর স্নেহে বড় করেছে।
সময়ের সাথে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন নাফিজ শেখ। শায়লাও বয়সের সাথে সাথে, সময়ের দেওয়া আঘাতে নুইয়ে গেছেন অনেকটা। তবুও, জীবন জীর্ণতা ঠেলে এগিয়ে গেছে স্রোতের মতই।
১৮৩.
১৩ বছর পর, এক সন্ধ্যায়…
‘আম্মুউউ!! তুমি এখনো এটা নিয়ে বসে আছো? নীচে সবাই ওয়েট করতেছে তোমার জন্য। তোমাকে ছাড়া তারা তো ফাংশন স্টার্ট করতে পারছেনা। নীচে চলো। ‘
ইরিনকে ডাকতে এসেছে ধ্রুব। ছেলের কথায় তার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো ইরিন। ডায়রির পাতাটায় কলম গুঁজে দিয়ে বন্ধ করলো ওটা। আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে। ছেলের নির্লিপ্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময়। মুখটা অবিকল বাবার মতই মায়ায় ভরা। চোখজোড়া যেন তার বাবার চোখের ছাঁচে গড়া। হাসিটাও নক্ষত্রের মতই উজ্জ্বল সর্বদা। কেবল গায়ের রংটা যদি ইরিনের মত না পেত তবে তাকে দ্বিতীয় নক্ষত্রই বলা যেত অনায়াসেই। ইরিনকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব আবারও তাড়া দিল।
‘আম্মু চলো না। মেহের চাচী ডাকতেছে তোমাকে।’তাড়া দিল ধ্রুব।
‘আমার ছেলেটাকে মাশাল্লাহ খুব হ্যান্ডসাম লাগছে।’ ইরিন বললো।
‘ বাবার মত?’
ছেলের এমন প্রশ্নে চোখে প্রাচীন বিষাদ ভিড় জমাতে শুরু করলো ইরিনের। কিন্তু, ছেলের উচ্ছ্বাসিত মুখের দিকে তাকিয়ে তাতে অবরোধে টানলো সে। মুখের হাসিটা বিস্তৃত করে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
‘হ্যাঁ, আব্বু। একদম বাবার মত।’
ধ্রুব স্মিত হাসলো মায়ের কথায়। খুব অল্প সময় বাবাকে নিজের জীবনে পেয়েছে সে।বাবার স্মৃতি মনেও নেই ঠিকঠাক মত কিছুই। তবুও বাবার প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। এ ভালোবাসা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায় যখন সে রাফিদের কাছে তার বাবা মায়ের জীবনের গল্পটা শুনে। আর আজ সেই কাহিনীটাই ছাপা অক্ষরে বইয়ের পাতায় চড়ে পৌঁছে যাবে অন্য আরও অনেক মানুষের কাছে।
____
কয়েকমাস আগে পুতুলের খুব কাছের বন্ধু সৌরভ তার মুখে নিজের বাবা মায়ের ভালোবাসার গল্প শুনে সেটাকে বই আকারে প্রকাশ করতে চায়। সৌরভের বাবা একজন প্রকাশক। সেই সূত্রে সে কাহিনী নিয়ে হাজির হয় তার বাবার কাছে। উনি ছেলের ইচ্ছেতে সায় দেন। সৌরভ আসে ইরিনের কাছে। ইরিন রাজি হয় না।
পুতুলের সাথে তার বন্ধুর মত সম্পর্ক বিধায় তার জীবনের ছোট বড় সব কথাই কম বেশি শেয়ার করে পুতুলের সাথে। নক্ষত্রের ছত্রছায়া যেন এই পুতুল। তবে,এ বিষয়ে এভাবে অন্য কারও সাথে শেয়ার করায় ভীষণ নারাজ হয় ইরিন পুতুলের ওপর।
কিন্তু, সৌরভ নাছোড়বান্দা। তারভাষ্য মতে এমন একটা কাহিনী কোন অমর প্রেম কাহিনীর চাইতে কম নয়। জীবন আমাদের অনেক কিছু শেখায়। যা আমরা নিজের ক্ষেত্রে জেনেও বুঝিনা, অন্যের দৃষ্টিতে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইরিন নক্ষত্রের বিবাহিত জীবনের গল্পটাও ঠিক তেমনই। এটা মানুষের কাছে তুলে ধরা উচিৎ। ইরিনও কম জেদি নয়। রাজি হয় না।
সৌরভ হাল ছাড়ে না। এভাবেই একদিন ধ্রুব সবটা জানতে পেরে ইরিনকে খুব করে অনুরোধ করে। ইরিন ধ্রুবর মায়া মায়া চোখের দিকে তাকিয়ে তার আকুল আবেদন ফেলতে পারে না আর। রাজি হয়।
লিখতে শুরু করে তার নক্ষত্র বন্দনার গল্প। আজ তারই মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠান।
_________
‘আম্মু, তোমার হয় নাই? সবাই নীচে ডাকছে তো..কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকেই থমকে গেল পুতুল।
রূপালী পাড়ের কালো বেনারসি, রূপার গয়না, কালো হিজাবে জড়ানো ফর্সা একটা মুখ। কাজলটানা টলমলে চোখ।এই নারীটিকে দেখে অনায়াসে একটা দুটো হার্টবিট মিস করে গেল পুতুল। মাঝে মাঝে তার মনে এত সাদা মাটা হয়েও এত নিখুঁত সৌন্দর্য্যের অধিকারী কেউ কিভাবে হয়! সে চাইলেও কখনো এত সুন্দর হতে পারবে না কখনোই। অবশ্য সেই চেষ্টাও যে সে করে তাও না।
তার মনে পড়ে, একবার একজন বলেছিল সে দেখতে কালো। মায়ের মত সুন্দর হয়নি সে। বয়স তখন সাত বছর তার। বাড়ি এসে খুব কান্না কাটি করে এই নিয়ে। তার অভিযোগ ছিল কেন সে তার মায়ের মত সুন্দর নয়। নক্ষত্র তখন তাকে বলেছিল , ‘তুমি কি কখনো পরী দেখেছো, পুতুল আম্মু? ‘
কান্নারত পুতুল তখন চুপ হয়ে অবাক স্বরে বলেছিল, ‘না তো। পরী কি সত্যি সত্যি হয় বাবাই?’
‘হ্যাঁ, হয় তো সোনা। এই যে তোমার আম্মু হচ্ছে একটা পরী। নক্ষত্র রাজ্যের পরী। তোমার যখনই পরী দেখতে ইচ্ছে করবে তুমি তোমার আম্মুকে দেখবা, কেমন?’
বিস্মিত পুতুল তখন জিজ্ঞেস করেছিল , ‘আম্মু পরী হয় কি করে বাবাই? আম্মুর তো ডানা নেই।পরীর মত সাজেও না আম্মু।’
নক্ষত্র তখন হেসে বলেছিল, ‘জমিনের পরীদের ডানা থাকে না আম্মু। কিন্তু, তাও ওরা ডানাওয়ালা পরীদের থেকেও বেশি সুন্দর হয়। ওদের খুব বেশি সাজতেও হয় না। একটুতেই অনেক বেশি সুন্দর লাগে।’
‘আম্মু কি ম্যাজিক জানে বাবাই? আম্মুর ম্যাজিক স্টিক কই?’
‘জমিনের পরীদের স্টিক থাকে না, পুতুলসোনা। তোমার আম্মুরও নেই। কিন্তু, তোমার আম্মুও ম্যাজিক করতে জানে।’
‘ওয়াও…আম্মু, সত্যিই ম্যাজিক জানে? কি ম্যাজিক বাবাই?’
‘আম্মু ভালোবাসতে জানে, পুতুলসোনা। ভালোবাসা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যাজিক। এটা দিয়ে যাই করবা তাই সুন্দর হবে।’
‘ আমি তো আম্মুর মত সুন্দর না বাবাই।তাহলে আমি কি পরী না, বাবাই?’
‘কে বলেছে তুমি সুন্দর না?’
‘বলেছে তো। এই যে দেখ আমি আম্মুর মত ফর্সা না। ‘
মেয়ের কথায় সেদিন খুব হেসেছিল নক্ষত্র। তাকে আদর করে বলেছিল, ‘ফর্সা কালো দিয়ে কেউ কখনো সুন্দর হয় না পুতুলসোনা। মানুষ সুন্দর হয় তার সুন্দর মন দিয়ে। চিন্তা দিয়ে। আর, তুমি হচ্ছো সবচেয়ে সুন্দর একটা পুতুল। তোমার আম্মু আর বাবাইয়ের ভালোবাসায় গড়া পুতুল।এটাকে যে সুন্দর বলবে না সে একটা ভূত। সুন্দর চিনে না।’
নক্ষত্রের কথায় পুতুল খিলখিলিয়ে হেসেছিল সেদিন। তারপর থেকে নিজের রূপ রঙ নিয়ে আর কখনো মন খারাপ হয়নি তার। নক্ষত্রের কথা স্মরণে রেখেই পরীর পুতুল হয়ে গড়ে তুলেছে নিজেকে। ইরিনও তাকে নক্ষত্রের ছত্রছায়ায় রূপ দিয়েছে। তাদের ভালোবাসার প্রথম পূর্ণ অস্তিত্ব যে এই পুতুলই!
__________
‘এই তো আম্মু। আমি রেডিই আছি। নীচেই আসতেছিলাম। ধ্রুবও ডাকতেই আসছিল।’ ইরিনের কথায় ভাবনাচুত্য হলো পুতুল। মিষ্টি করে হেসে বললো, ‘মাশাল্লাহ…কি সুন্দর লাগতেছে আম্মু তোমাকে! একদম নক্ষত্ররাজ্যের পরীর মত।’
ধ্রুবর সামনে এভাবে বলায় ঈষৎ লজ্জা পেয়ে গেল ইরিন। একদম বাবার মতই তাকে লজ্জায় ফেলতে ওস্তাদ এই মেয়ে।
মেয়েকে কপট শাসন করে বললো, ‘হয়েছে…একদম বেশি বলা শিখছো। ‘
‘আপ্পাই মোটেও বেশি বলছে না আম্মু। তুমি সত্যিই নক্ষত্ররাজ্যের পরী।’ ধ্রুব পুতুলের কথায় সায় দিয়ে বললো।
ইরিন মলিন হাসলো। এই রূপ সৌন্দর্যই বা আর কত দিন। এই তো ক’দিন পরেই ক্যামো থেরাপি শুরু হবে। চুল পড়ে যাবে।রেডিও থেরাপিতে চামড়া পুড়বে। তখনও কি তাকে পরী বলবে এরা?
জরায়ুর ক্যান্সারে ভুগছে সে। তৃতীয় ধাপের শেষ পর্যায়ে আছে এখন। চিকিৎসার পরেও কতদিন বাঁচবে জানা নেই। তবুও, সন্তানদের একটা সুন্দর ভবিষ্যতের ব্যবস্থা না করে দেওয়া পর্যন্ত এ লড়াই করতে হবে তাকে। বাকি হায়াত মউত সবই তো সৃষ্টি কর্তার ইচ্ছা।যদিও ইরিনের ধারণা সৌরভের সাথেই পুতুলের ভবিষ্যৎ জড়াবে। সৌরভকেও পছন্দ তার। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।
ধ্রুব এখনো কিছুই জানে না। বয়স মাত্র ১৫ বছর। এত কঠিন সত্যি মানতে কষ্ট হবে ওর। কেবল পুতুল, রিতু, মেহের আর রাফিদ জানে। নক্ষত্রের ভাই না হলেও ভাইয়ের মতই দায়িত্ব পালন করেছে সে। ইরিনের প্রতি বন্ধুত্ব পালন করেছে নিষ্ঠার সাথে। তার সন্তানদের আদর স্নেহ দিয়েছে, আগলে রেখেছে। মেহের নিজের বোনের মত ভালোবাসে ইরিনকে। রিতুকে নক্ষত্র যেভাবে আগলে রেখেছিল রাফিদ, মেহেরও সেভাবেই স্নেহ করেছে তাকে। নক্ষত্র তাকে ছেড়ে গেছে ঠিকই কিন্তু তৈরী করে রেখে গেছে অনেকগুলো সুন্দর সম্পর্ক আর এমন একটা পরিবার।
‘নীচে চলো আম্মু। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ মায়ের মলিন হাসির অর্থ বুঝতে পেরে পরিস্থিতি সামলে নিতে পুতুল তাড়া দিল।ইরিন মাথা নাড়িয়ে সাই দিল। তারপর, দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে নীচে নেমে গেল।
___________
নক্ষত্রবাড়ি আজ আরও বেশি আলোয় ঝলমল করছে। নীচের পুরো জায়গাটা জুড়ে আয়োজন করা হয়েছে অনুষ্ঠানের। নক্ষত্রের মৃত্যুর পর থেকে রিতু আর দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে এখানেই নতুন জীবন শুরু করে সে। রাফিদ, মেহেরও এখানেই থাকে। রিতুর বিয়ে হয়েছে তিন বছর। স্বামীর সাথে ঢাকা থাকে। এখানেও আসে প্রায়ই।আজও এসেছে স্বামী সন্তান নিয়ে।
ইরিন নীচে আসতেই রাফিদ তাকে খোঁচা মেরে বললো, ‘এতক্ষণে আসার সময় হলো আপনার ভাবীসাহেবা? আমি তো ভেবেছিলাম আজও বইখানা পড়ারই সুযোগ হবে না আমার।’
‘তো আপনাকে কে বলেছিল, এতসময় অপেক্ষা করতে? পাণ্ডুলিপি তো দিয়েইছিলাম পড়ার জন্য। আপনিই তো বেঁকে বসলেন, বই এলে তবেই পড়বেন। ‘
‘ছাপা অক্ষরের মলাটবদ্ধ গল্প পড়ার স্বাদই আলাদা। সে আপনি বুঝবেন না।’
‘গল্প তো আপনার জানাই। খোলা বই আমি আর নক্ষত্র আপনার কাছে। ‘
ইরিনের এ কথায় স্মিত হাসলো রাফিদ। মেহের এসে বললো, ‘ভাবী…মাহিন সাহেব স্টেজে যেতে বলেছেন। আসো। ‘
‘হ্যাঁ, চলো।’ ইরিন বললো।
———
এনাউন্সমেন্টের পর কালো ফিতায় বাঁধা, কালো যার্পিং পেপারে মোড়ানো বইটা তুলে দেওয়া হলো ইরিনের হাতে। ইরিন সেটা খুলতেই কালো মলাটের একটা বই বেরিয়ে এলো। একটি মেয়ের নক্ষত্র ছোঁয়ার ছবি আঁকা তাতে। সাদা কালির অক্ষরে বড় বড় করে লিখা, ‘ নক্ষত্র বন্দনা।’ নামটির ঠিক নীচেই ছোট করে লিখা, ‘প্রাপ্তি থেকে অর্জনের গল্পকথা।’ লেখিকার নাম, ‘ইয়াসিন রাওনাফ ইরিন।’
ইরিন পরম ভালোবাসায় হাত বুলিয়ে দিল নামটার উপর। টলমলে চোখের তারায় ভেসে উঠে মনে গাঁথা নক্ষত্রের মায়া মায়া মুখোয়ব। ইরিন মৃদু স্বরে আউড়ায়,
‘আমি ছুঁয়ে দেখিনি তার
গভীর তম কোনো অসুখের কথা,
দেখি শুধু তার অভিমানী নিষ্প্রাণ চোখে
না থাকার বোধ;
আমি কথা দেই তাকে বিশাখার মাঝ রাতে;
যখন সে ঘুমাবে শেষে, আমিও ঘুমাবো তার সাথে।’
(নক্ষত্র বন্দনা)
(মেঘদূত)
(সমাপ্ত)