নতুন জীবন শেষ পর্ব

0
3466

নতুন জীবন শেষ পর্ব
#শ্রুতি_হাসান

অতীত ভাবতে ভাবতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে আদিবা।
হঠাৎ করেই স্বপ্নের মাঝে একটা মুখ ওর চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠে।
উঁহু,এ তো আদিব নয়।তবে কে?
এ হচ্ছে রঙ্গন।যার জন্য আদিবা এক সময় পাগল ছিলো।রঙ্গনও আদিবাকে পাগলের মত ভালবাসতো।কিন্তু আদিবা ওর মা বাবার জন্য নিজের ভালবাসা বিসর্জন দিয়েছে।
ছেলেটা বিদায় বেলায়ও বলেছিলো,তোমার জন্য আমার দরজা সারাজীবনের জন্য খোলা।যেদিন ইচ্ছে হয় চলে এসো।আমি অপেক্ষা করবো।

-আমি যদি বেবী নিয়ে চলে আসি কখনো?
-আমি ওকে নিজের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করে নিবো।

আদিবা ঘুমোচ্ছে।আর রঙ্গনের সাথে কাটানো মূহুর্ত গুলো একের পর এক চোখের সামনে ভাসছে,স্বপ্ন গুলো যেন একের পর এক চোখ জুড়ে যাচ্ছে।
আদিবা জানে ও স্বপ্ন দেখছে,তবুও চোখ খুলছেনা।যদি রঙ্গনের মুখটা চোখের সামনে থেকে সরে যায়,এই ভেবে।

রঙ্গনকে ও আজো ভালবাসে।আদিবের সাথে বিয়ে হবার পরো রঙ্গনকে আদিবা ভুলতে পারেনি।পারবেই বা কি করে,প্রথম ভালবাসা বা সত্যিকারের ভালবাসা নাকি কোন দিন ভোলা যায়না।তাই হয়তো আদিবাও পারেনি ওর রঙ্গনকে ভুলতে।

চোখ বন্ধ করেই আদিবা ভাবছে,আচ্ছা রঙ্গনের কথা আজ আমার এত বেশি মনে পড়ছে কেন?ও ভালো আছে তো?আচ্ছা ও কি বিয়ে করেছে?ওর বউ কি ওকে আমার মতই ভালবাসে?খুব কি আদর করে?আচ্ছা ও কি ভুলে গেছে আমায়?

চোখ খুলে ফেলে আদিবা।আদিবার চোখ ভিজে যাচ্ছে।
হঠাৎ করে আদিবার মা আদিবার রুমে আসে।
-মা উঠেছিস?
-হ্যাঁ আম্মু।
-কাঁদছিস কেন?
-না এমনি,ও কিছুনা।
-আমি আর তোর বাবা তোর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম তাইনারে?
-এ কথা বলছো কেন?আমার ভাগ্যে যা ছিলো তাই হয়েছে।ভাগ্যের বেশি তো আর কেউ দিতে পারবেনা।
-রঙ্গনকে তুই খুব ভালবাসতি তাইনা?
-বাদ দাও তো ওসব কথা।
-রঙ্গনও তোকে খুব ভালবাসে।যদি ওর কাছেই তোকে বিয়ে দিতাম।তবে হয়তো আজ…. (কেঁদে)
-বাদ দিবে আম্মু?কি বলছো আজ হঠাৎ এগুলো?চুপ করো।
-রঙ্গন এসেছিলো।
-মানে?কখন?কোথায়?কি বলছো তুমি?
-হ্যাঁ।ও কিছু দিন হয় দেশে এসেছে।তুই ঘুমোচ্ছিলি তাই তোকে ডাকতে বারণ করলো।দূর থেকে তোর মুখ টা দেখে নিজের চোখ দুটো হাত দিয়ে মুছতে মুছতে চলে গেলো।
-কি বলছো আম্মু?কেন তুমি আমায় ডাকলেনা?আমি ওর মুখটা একবার দেখতাম।এ জনমে তো হয়তো আর দেখা হবেনা ওকে।তুমি কেন ডাকলেনা আমায়?ও কখন গেছে আম্মু?কখন বের হয়েছে?প্লিজ বলো।
-২০ মিনিট হয় বের হয়েছে।আমাদের জেলায়ই আছে এখনো হয়তো।গিয়ে সারতে পারেনি এখনো।
-মা আমি ওর সাথে একটু দেখা করতে যাচ্ছি।প্লিজ পথ আটকিও না…

এই বলে মোবাইল টা নিয়েই এক দৌড়ে রাস্তায় বের হয়ে গেলো আদিবা।
রঙ্গন এর মোবাইলে বার বার ফোন দিচ্ছে আদিবা।
বার বার উচ্চারিত হচ্ছে,
“এই মূহুর্তে আপনার কাংখিত নাম্বারে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছেনা।
অনুগ্রহ করে কিছু ক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন।ধন্যবাদ”

আদিবা কাঁদছে আর বলছে,
আল্লাহ্‌ জাস্ট একটা বার ওর মুখ টা দেখার সুযোগ করে দাও।
একটা বার।আর কিছু চাইবোনা আমি তোমার কাছে।

আদিবা কখনোই বাসে উঠেনা।বাসে উঠলেই ওর মাথা ঘুরে।তবুও আজ সে বাসে উঠে রওনা হয়েছে।যদিই রাস্তায় দেখা হয়ে যায় রঙ্গনের সাথে।এই প্রথম ও একা এত দূরের পথে যাত্রা শুরু করেছে।তাও আবার অজানা গন্তব্যে।ও নিজেও জানেনা রঙ্গন এখন কোথায় আছে।
আর বার বার মোবাইলে ট্রাই করে যাচ্ছে।
কিছু ক্ষণ পর রঙ্গনের মোবাইলে কল ঢুকে।রিং বাজতেই রঙ্গন ফোন রিসিভ করে।
রঙ্গন কিছু বলে উঠার আগেই আদিবা বলে উঠে,কই তুমি?
তাড়াতাড়ি বলো কোথায় তুমি?প্লিজ বলো।
-আমিতো এখানকার কোন জায়গারই নাম জানিনা।
-প্লিজ তাড়াতাড়ি আশে পাশের কাউকে জিজ্ঞেস করো।জায়গার নাম কি?
-আচ্ছা জিজ্ঞেস করছি ওয়েট।
-তাড়াতাড়ি প্লিজ।
-জায়গার নাম……
-আমি তো এ জায়গা চিনিনা।কোথায় চলে গেছো তুমি?এটা তো অন্য থানায় পৌছে গেছো তুমি।
-তাহলে এখন?
-আচ্ছা তুমি ওখানেই থামো।নেমে যাও গাড়ী থেকে।আমি আসছি।
-আচ্ছা ঠিকাছে।কিন্তু রাত হয়ে যাচ্ছে আদিবা। তুমি ভয় পাবেনা?
-আর ভয়,এখন আর আমি কোন কিছু ভয় পাইনা।তুমি দাঁড়াও আমি আসছি।

আদিবা বাসের ড্রাইভারকে বলে বলে,বাস চেঞ্জ করে রঙ্গনের বলা ঠিকানায় পৌছে যায়।শুধু মাত্র একটা নজর রঙ্গনকে দেখতে।হয়তো এটাই শেষ দেখা।

গাড়ী থেকে নামতেই দেখতে পায় রঙ্গন দাঁড়িয়ে আছে।
খুব ইচ্ছে করছে আদিবার,রঙ্গনকে একটু জরিয়ে ধরতে।কিন্তু সেই অধিকার সে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে হয়তো।
দুজনের চোখেই জল।

-কেমন আছো?
-এই তো বেঁচে আছি।
-এত দূর এসে আমাকে দেখে গেলে,অথচ একটা বার ডাকলেনা যে?আমার কি তোমায় দেখতে ইচ্ছে করেনা?
-তুমি ঘুমোচ্ছিলে।
-তাতে কি?আমি তো ঘুমেও কেন যেন আজ তোমাকেই দেখছিলাম।ভাবিনি সামনাসামনিও দেখতে পাবো।বিয়ে করেছো?
-না কিছু দিন হয় দেশে ফিরেছি।বিয়ে করবো কয়েক দিনের মধ্যেই।

কেন যেন আদিবার বুকের ভেতর আচমকা এক ব্যথা অনুভূত হচ্ছে।
-ওহ আচ্ছা।মেয়ের ছবি আছে?দেখতাম আরকি।
-হ্যাঁ আছে।এই যে।

রঙ্গন মোবাইলে সেল্ফি ক্যামারা এনে আদিবার হাতে দিলো।
আদিবা চমকে গিয়ে রঙ্গনের হাতে মোবাইল দিয়ে দিলো।

-মাথা ঠিক আছে তোমার?তুমি কিছুই জানোনা আমার সম্পর্কে।
-সবই জানি।জানি তুমি ডিভোর্সি।
-না সব জানোনা,আমি শুধু ডিভোর্সি না।আমি…

কথা টা শেষ করার আগেই রঙ্গন আদিবার মুখ টা ওর হাত দিয়ে চেপে ধরে।
-কিচ্ছু বলতে হবেনা।সব কিছুই জানি আমি।আম্মু আমাকে বলেছেন।
-সব কিছু জেনেও তুমি?
-আগেও বলেছি,এখনো বলছি,আমি শুধু তোমার শরীর টাকে ভালবাসিনা।আমি তোমার সব কিছু ভালবাসি।তোমার পুরোটাই।মন আত্মা,হৃদয়,সব।
-রঙ্গন।আমি তোমার যোগ্য নই।
-চুপ।একদম চুপ,মনে আছে আমি একদিন বলেছিলাম?তুমি আমার বউ।আর তুমি আমার কাছে সারাজীবন পবিত্র।ভালবাসি আমার লক্ষীটা।
-ভালবাসি।

এই বলে আদিবা কাঁদতে কাঁদতে রঙ্গনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

-এই পাগলী।কাঁদলে কিন্তু ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো।এই ঠোঁটে হাসি ফোটাতে বুকে জরিয়ে নিয়েছি।চোখে পদ্মা যমুনা বইতে নয়।
-তাহলে আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছিলে কেন?
-চলে যাচ্ছিলাম না।মা বাবাকে আনতে যাচ্ছিলাম।আগামীকালই হাজির হতাম আপনার বাসায় তাদের নিয়ে।
কিন্তু আমি কি জানি?আমার বউটার আমার বাসায় যাবার খুব বেশিই তাড়া।
-যাও সরো,বলেছি আমি এ কথা?
-ওরে আমার লজ্জাবতী বউরে।
-ওরে আমার লাজুক বর রে।
-ওই আমি লাজুক?
-হুউউম,আমি লজ্জাবতী বউ হলে আপনিতো লাজুক বর ই।
-আচ্ছা ঠিকাছে চলুন এবার।বাড়ীর বউ বাড়ী নিয়ে যাই।
-কিন্তু আব্বু আম্মু?
-ধুত তোর আব্বু আম্মু।আমার বউ আমি বাড়ী নিয়ে যাবো,এখানে আম্মু আব্বুর কি?তাছাড়া আম্মু আব্বুর সাথে আমি আমি কথা বলে নিয়েছি।আমারো আর আপনারও।সো আপনার চিন্তা করতে হবেনা।তাদের অমত নেই।
চলুন এবার।নাকি আমি একাই চলে যাবো?
-নায়ায়া আমিও যাবো আমার বরের সাথে।
-পাগলীটা,উম্মাহ। (কপালে)

এতটা ঝড় তুফানের পর রঙ্গন আর আদিবা আবার এক হয়ে গেলো।
তারা বিয়ে করে সংসার করতে লাগলো।রঙ্গনের ভালবাসায় মুছে গেলো আদিবার স্মৃতি থেকে ভয়ংকর অতীত।ফিরে পেলো নতুন জীবন।
আদিবা এখন আট মাসের প্রেগন্যান্ট।কিছু দিন পরই রঙ্গন এবং আদিবা একটা ফুটফুটে বাচ্চার মা,বাবা হবে।
কিন্তু এখন তাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়।ঝগড়া টা হচ্ছে এই নিয়ে যে,
বেবীটা কার মত হবে?রঙ্গনের মত নাকি আদিবার মত।
যাইহোক,আর কিছু দিন পরই বোঝা যাবে বেবীটা কার মত হয়েছে।
আই উইশ,বেবীটা দুজনের মতই হোক।
বাবার মত চোখ, চুল আর হাসি হোক।
আর মায়ের মত ঠোঁট আর গলুমলু হোক।
আর ওদের সংসার টা অনেক অনেক সুখময় হোক।সুন্দর হোক নতুন জীবন।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here