#নতুন_কন্ঠে_ভালোবাসুক,পর্ব ২
#সমুদ্রিত_সুমি
বাবা চলে যেতেই সকল আত্মীয় স্বজনরা নিজেদের মতো করে নিজেদের উপস্থাপন করলো। কিন্তু কেউ আমাদের পাশে দাঁড়ালো না। সবাই নিজেদের মতো করে পরামর্শ ফ্রি-তে দিয়ে গেলো। কথায় আছে যদি তুমি সাহায্য চাও! একজনও দিবে কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু যদি তুমি পরামর্শ চাও,তাহলে সবাই দিতে রাজি আছে। কয়েকদিনেই সকলকে চেনা হয়ে গেলো। বুঝে নিলাম আমাকেই নিতে হবে সকল দায়িত্ব। মা,দুই বোন আর এক ভাইয়ের দায়িত্ব। নিজেকে দেখে রাখার মতো কিছু নেই! সবাইকে ভালো রাখতে হলে তো আমাকে ভালো থাকতেই হবে! কারণ বেঁচে থাকতে হলে তো অন্ন মুখে দিতেই হবে। সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে চাকরিতে জয়েন করলাম। গুছিয়ে নিয়ে সংসারের দায়িত্বগুলো হাসিমুখে পালন করতে রইলাম। পছন্দ করা মানুষটাও এক সময় আমার হাত ছেড়ে দিলো। কারণ সে আমার দায়িত্ব নিবে আমার পরিবারের নয়। আজ এই ছুতো,তো কাল ওই ছুতো। একদিন জানতে পারলাম সে বিয়ে করে নিয়েছে। বাহ্ এমন সুসংবাদ আমার জীবনের দ্বিতীয়টি নেই। চার বছরের সম্পর্ক ইতি টেনে সে দিব্যি সংসার নামের ঘর বাঁধলো অন্য কারো সাথে। বেস তো ভালোই হলো। আমার আর কোন পিছু রইলো না। এখন আমার একটাই লক্ষ পরিবারকে সুখে রাখার। আমার পরে আমার ভাই স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠেছে। ছোট দুই জমজবোন নাইনে পড়ছে। বাবা মা-রা যেতেই মায়ের শরীরে রোগ বাসা বেঁধেছে। সকল দায়িত্ব পালন করতে আমি হিমশিম খেতে রইলাম। তবুও, তবুও আমাকে পারতে হবে। সারাদিন অফিস শেষ করে যখন বাড়ি ফিরে নিজেদের পরিবারের মুখে হাসি দেখতাম! ভালোই লাগতো। সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যেতো। এভাবেই দিন ফুরিয়ে রাত,আর মাস গড়িয়ে বছর পার হয়ে গেলো। চাকরির উন্নতি হলো! ভাই বোনেরা বড় হলো। বোনদের বিয়ে দিলাম। ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখলাম। কিন্তু ভাই বেঁকে বসলো বিয়ে করবে না বলে। কারণ জানতে চাইলে আমতাআমতা করে এই কথাটাই বলে উঠলো। আমার বিয়ে দিবে তারপর সে বিয়ে করবে। নিজের বয়সের কথা চিন্তা করে যখন না বললাম! তখন বলে উঠলো —
_যখন তোমার আরো বয়স বাড়বে কে দেখবে তোমায়! মাকে এমনই আমাদের টানতে হবে। তাঁর সাথে যদি তোমাকেও টানতে হয়! তাহলে আমাদের ভবিষ্যত কি হবে?
আমি তো চাকরিটা এখনো করছি! সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে ভাই আমার কথাটা বলে দিলো আজ। সত্যি যদি আমি কখনো অচল হয়ে পড়ি সেদিন কি হবে আমার? কিন্তু অন্য কেউ কেন সেদিন আমার দায়িত্ব নিতে যাবে! যেখানে আমার কাছের মানুষগুলো আমি সচ্ছল থাকার পরে-ও আমার দায়িত্ব নিতে চাইছে না। যাঁদের জন্য আমি এতো কিছু করলাম। নিজের বয়স বারিয়ে আজ পঁয়ত্রিশে গিয়ে ঠেকালাম! আপনজনেরাই যদি বেঈমানী করে, তাঁরা যে করবে না তাঁর কি গ্যারান্টি আছে। তবুও আমি ওদের সাথে পেরে উঠলাম না। ওদের সাথে মা-ও যোগ হলো। মা-ও বললো–।
_শুরু করনা নতুন করে। শুরু করতে দোষ কোথায়। জীবন সব সময়ই যে বেঈমানী করবে এমনও তো নয়। জীবন তো কখনো কখনো অনেক কিছুই দেয়। জীবনের ওই ফেলে আসা অতীত ভুলে যা।
কিন্তু আমি মা’কে বোঝাতে পারলাম না! চাইলেও সব ভোলা যায় না। চার বছরের সম্পর্ক,চৌদ্দ বছরের দায়িত্ব, আর বাবা হারানোর শোক কোনটাই আমি ভুলিনি! আর না কখনো ভুলতে পারবো। কিন্তু মুখে শুধু বললাম।
_ সঙ সেজে কারো সামনে যাওয়ার মতো বয়স আমার নেই। কেউ যদি আমায় বিয়ে করতেই চায়! সে যেন আমার ঘরে এসে একাই দেখে যায়। কারণ এই বুড়ি বয়সে কারো উপহাসের সম্মুখীন আমি হতে পারবো না! সে পর হোক বা নিজের কেউ।
মা রাজি হলো। তোরজোর চললো পাত্র খোঁজার। অবশেষে একজন পাত্র পাওয়াও গেলো। কিন্তু ডির্ভোসী। কথাটা শোনার পর নিজের উপর নিজের খুব হাসি পেলো। এটাই জীবনের আসল মানে। আমি বারন করিনি ওদের। কারণ ওদের ভালো-খারাপ সিদ্ধান্ত নেওয়া এই আমি যে আজ বড্ড ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। তাই ওদের সঠিক সিদ্ধান্তেই এই আমাকে মেনে নিতে হলো। আমার পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তো আর আমি অবিবাহিত পুরুষের আশা করতে পারি না। যেখানে নিজেই এক বুড়ি,সেখানে একজন ডির্ভোসী ছেলেই আমার জন্য সঠিক। কারণ আমার স্বপ্ন দেখা অনেক আগেই বারন হয়ে গেছে। রাতের খাবার টেবিলে ভাই বলে দিলো। আগামীকাল ছেলে, ছেলের বোন এবং মা আসবে আমায় দেখতে। আমি কিছু বলতে নিলে ভাই আমায় থামিয়ে দিয়ে বললো।
_ চিন্তা করো না আপু,ছেলে তোমার ঘরে গিয়েই তোমায় দেখবে! ছেলের বোন বা মা তাঁরা শুধু সমাজ রক্ষা করার জন্যই আসছে,আর কিছু না। তাঁদের ছেলে তোমায় পছন্দ করলেই তাঁরা তোমায় ঘরে তুলে নিবে। আমি জানি আপু তুমি আমার উপর রাগ করে আছো! কিন্তু বিশ্বাস করো কখনো কখনো ছোট হয়েও বড়দের ভালোর জন্য কঠিন হতে হয়। সারাজীবন তো আমাদের জন্য ভাবলে আজ না-হয় আমরাই তোমার কথা ভাবি। শুধু মনে রেখো, তোমার দায়িত্বে যেমন আমরা কখনো খুঁত ধরতে পারিনি! আল্লাহ চাইলে তুমিও কখনো আমার এই সিদ্ধান্তে আফসোস বোধ করবে না ইনশাআল্লাহ।
এই কথা গুলো বলেই ভাই আমার খাবার টেবিলে ছেড়ে উঠে গেলো। মা চোখের জল মুছে বললো।
আমরা চাই তুই ভালো থাক। আমাদের জন্য যে সুখ গুলো তুই বিসর্জন দিয়েছিস! তা নতুন করে তোর জীবনে ফিরে আসুক। তুই নতুন করে নতুন ভাবে আবারও শুরু কর। বলা তো যায় না কোন সুখের রাজ্য তোর অপেক্ষায় আছে।
যে সুখের বয়স আমি পার করে এসেছি! এটা এই বয়সে এসে যে ধরা দেবে কে বললো? কিন্তু আমার বোকা ভাইবোন আর মা’কে কে বোঝাবে। আমার তো এই ভালোবাসার সম্পর্কের উপর বিশ্বাস নেই। মিথ্যা মায়াজাল , অভিনয় এই সম্পর্ক গুলোর মাঝেই বেশি লুকিয়ে থাকে। যেদিন জানতে পেরেছি শ্রাবণ বিয়ে করেছে! সেদিন আমার পাগল পাগল অবস্থা। কখনো ভাবতেই পারেনি এই মানুষটা আমায় ঠকাতে পারে। আমার দিনরাত খেয়াল রাখা মানুষটা এভাবে আমাকে পর করে দূরে সরে যাবে। শেষ যখন ওকে ফোন করে আকুতি করেছিলাম একবার দেখা করো। কিন্তু ও বিনিময়ে বলেছিলো। আজ আমি আমার বউকে নিয়ে ঘুরতে যাবো! কোন ফালতু মানুষের জন্য আমি আমার এই সুন্দর সময়টাকে নষ্ট করতে চাই না। আমি ফালতু মানুষ! হ্যা ফালতু না হলে কি আর একজন সর্দবিবাহিত দম্পতিকে আলাদা করতে চাইতাম। সেদিন নিজের বোকামির জন্য আরেক দফা অবাক হলাম। তারপর আর তাঁর সাথে দেখা হয়নি বা কথা । কিন্তু আমি তাঁকে কখনোই ব্লক করিনি। কেন করিনি জানি না। শুধু জানি আমি পারিনি ব্লক করতে। এই না পারার জন্যই হয়তো সাত বছর পর একটা মেসেজ এসেছিলো তাঁর নাম্বার থেকে। খুব ছোট্ট একটা মেসেজ! কিন্তু সেখানে লেখা ছিলো কারো কষ্টে কথা। সেখানে লেখা ছিলো? “তোমার কষ্টের প্রতিটা দীর্ঘশ্বাস হয়তো আমায় অভিশাপ দিয়েছে! যে অভিশাপে আমার জীবনটা তচনচ হয়ে গেছে। একটা ছোট্ট এক্সিডেন্ট সারাজীবনের জন্য আমার বাবা হওয়ার ক্ষমতা কেঁড়ে নিয়ে গেছে। যাঁর জন্য তোমাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম, আজ সে আমার অক্ষমতার জন্য আমায় ছেড়ে গেছে। আজ হয়তো ওর জায়গায় তুমি হলে এমনটা হতো না। প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দিও।”
মেসেজটা দেখে আমি কষ্ট পাবো নাকি আফসোস বুঝতে পারিনি। শুধু বুঝেছিলাম প্রকৃতি কখনো কাউকে ছাড়ে না। আল্লাহ ছাড় দেয় ছেড়ে দেয় না। তবুও মন থেকে বলেছিলাম ভালো থাকুক বেঈমান মানুষ গুলো। ভালো থাকুক চোখের জল যাঁদের জন্য ঝড়েছে সেই মানুষ গুলো। ভালো থাকুক আমাদের সাথে অন্যায় করা মানুষ গুলো। ভালো থাকুক তাঁরা, যাঁদের জন্য আমি মুখ বুঁজে কান্না আঁটকে রেখেছিলাম বালিশের মাঝে মুখ গুঁজে। শ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো কষ্ট হয়েছিলো যাঁদের জন্য। সব শেষে ভালো থাকুক ভালোবাসার মানুষ গুলো।
চলবে,,