#নতুন_কন্ঠে_ভালোবাসুক,পর্ব ৩
#সমুদ্রিত_সুমি
একটা খয়েরী রঙের থ্রিপিছ পড়ে আয়নার সামনে বসে আছি। মুখের অদলে হাত রেখে খুঁজলাম আমার মুখের সৌন্দর্য! কিন্তু সেটা বয়সের ছাপে ঢেকে গেছে অনেক আগেই। চোখের নিচে কালি জমেছে, মুখের ভাজ গুলো স্পষ্ট। আর এই বয়সে কিনা আমি বিয়ের পিরিতে বসবো ভাবা যায়। লোকজন হাসবে আর বলবে! বুড়ি বয়সে শখ কত? এই কথা গুলো কতটা ধারালো হতে পারে তা আমি জানি। তবুও আমি মেনে নিলাম। জীবনের কিছু মুহূর্ত থাকে, যা না চাইলেও মেনে নিতে হয় আমাদের। আমাকে এই থ্রিপিছে দেখে মা একটু বকাবকি করলেন! বললো–
_এই রঙে তোকে মানায়নি একদম। একটু উজ্জ্বল কিছু পরতি।
আমি মুচকি হেঁসেছি শুধু, মায়ের কথায়। কারো বয়সের ছাপ কোন রঙ ঢাখতে পারে না। কিন্তু মা’কে কে বোঝাবে এই কথা? মা চলে গেলেন, সেই থেকে এখনো আমি আয়নার সামনে বসে আছি। বহুকাল হলো আয়না দেখা হয় না। আমার সেই বাঁকা চোখে কাজল দেওয়া হয় না। শুঁকনো ঠোঁটে দেওয়া হয় না লিপস্টিক। মুখে মাখা হয়নি কোন দামি ব্রান্ডের স্নো। তবুও তো বেস ছিলাম আমার এই সাদাসিধা জীবনকে নিয়ে। কি দরকার ছিলো,এতো আয়োজন করে আমাকে মনে করিয়ে দেওয়ার! আমার জীবনের একটা অধ্যায় এখনো আমার পাওনা রয়েছে। কি হবে সেই অধ্যায়ে নাম লিখিয়ে,যাতে সুখের থেকে অবহেলা পেতে হবে বেশি। আমার এই ভাবনার মাঝেই ড্রইংরুম থেকে সোরগোলের আওয়াজ ভেসে এলো। মনে হয় তাঁরা এসে গেছে। আমার হাত পা হঠাৎ করেই ঠান্ডা হয়ে গেলো। মাথার উপর চলতে থাকা ফ্যানের আওয়াজটা অসয্য লাগতে রইলো। কপাল বেয়ে নেমেছে শীতল জল। তা মুছে আমি উঠে দাঁড়াতে চাইলে! আমার পা দু’টো শক্ত হয়ে রইলো। এই বয়সে এসে কিনা সেই কিশোরী মেয়েটির মতো কোন পুরুষের সামনে দাঁড়াবো। এই কথা ভাবতেই কষ্ট যেন বুকটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো। কেন আজ আমার এই নিয়তি।
—————-
আমার ছোট্ট ঘরে আমি ছাড়া সব জিনিসগুলোর বয়স খুব কম। আমার বিলাসীতা পছন্দ নয়! তাই আমার ঘরে তেমন কিছুই নেই। যা আছে তা শুধুমাত্র প্রয়োজনের জন্য কেনা হয়েছে। খাটের এক কোণে আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। আর আমার সামনে চেয়ারে বসে আছে একজন সুদর্শন যুবক। তাঁকে দেখলে কেউ বলবে না! তাঁর বয়স আটত্রিশ চলছে। এবার ভাবছেন আমি কীভাবে জানলাম? সে নিজেই বলেছে। তাঁর পরিবারে ক’জন আছে, সে কি করে এবং তাঁর বয়স কত? আমি সব কিছু নিরবে শুনে হু,হা উত্তর দিয়েছি। আমি একবারের জন্যও তাঁর দিকে তাকায়নি। তাঁকে যখন ভাই ঘরে নিয়ে এলো এক পলক শুধু চোখে পড়লো তাঁর চেহারা অদলখানায়। মানুষটা একটু বেশিই সুন্দর, আচ্ছা তাহলে তাঁর ডির্ভোস কেন হলো? যতোদূর শুনলাম ভালো চাকরিও করে তাহলে কি সমস্যা?
_ উঁহুম,আপনি শুনতে পাচ্ছেন আমায়।
হঠাৎ আমার তাঁর কথায় খেয়াল ফিরলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম।
_ জ্বি
_ বলছি আপনি আমায় শুনতে পারছেন।
_ হু
_ যদি শুনতে পেয়েই থাকেন! তাহলে আপনার কিছু জানার নেই আমার বিষয়ে।
_ না
_ কেন?
আমি এবার সামান্য মুখটা উঁচু করে বললাম।
_ যা জানার দরকার, তা তো নিশ্চয়ই আমার ভাই জেনে নিয়েছে। আমার নতুন করে কিছু জানার নেই।
_ আচ্ছা, আমাকে মোহন বলেছিলো আপনি এমনটাই বলবেন আমায়! কিন্তু আমার একটু বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে। আপনার মতো একজন শিক্ষিত মেয়ে এমন ভাবে সব চুপচাপ মেনে নিবে,এটা আমি ভাবিনি। কিন্তু আমার ভাবনা তো মিথ্যা প্রমাণ হলো।
এই বয়সে এসে বিয়ে করবো এটাই তো মানতে কষ্ট হচ্ছে সেখানে আগবাড়িয়ে কিছু জানতে চাওয়া বোকামি। কথা গুলো মনে মনে আওড়ালাম। মুখে বললাম।
_ তেমন কিছু না,ঠিক আছে।
_ বুঝতে পেরেছি আপনি নিজে থেকে কিছুই জানতে চাইবেন না! আমিই বলছি। আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম একটা মেয়েকে। তখন আমার বয়স সাতাশ বছর। এখোনের মতো এতো ভালো পজিশনে ছিলাম না। তবুও সুখে ছিলাম। দিনশেষে রাতে মায়ের হাতের রান্না যখন তৃপ্তি নিয়ে খেতাম, তখন খুব সুখ,সুখ অনুভব হতো। লতা ছিলো আমার এক কাজিনের রিলেটিভ। একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমার ওর সাথে দেখা। এরপর কথা, প্রেম, বিয়ে। কিন্তু বিয়ের আগে ওকে আমি যেমন দেখেছি বিয়ের পরে বুঝতে পারলাম আসলে ও সেটা নয়। ওর চাহিদা ছিলো আকাশ কুসুম। কিন্তু আমার পক্ষে তখন ওগুলো পূর্ণ করা প্রায় চাঁদ ছোঁয়ার মতো। তারপর আর কি অশান্তি লেগেই থাকতো সংসারে। কাজ সেরে বাড়ি ফিরতেই তাঁর হাজারখানেক অভিযোগ। আমার মা ভালো না,আমার বোনেরা তাঁকে জ্বালায় আরো কত কি? এক সময় সিদ্ধান্ত নিলাম ওকে নিয়ে আলাদা থাকবো। থাকলামও,কিন্তু এতে ওর সাহস আরো বেড়ে গেলো। ফোনে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি হলো কারো সাথে। আমি চলে যেতেই শুরু হতো তাঁদের প্রেম আলাপ! তারপর একদিন আমার কাছে ধরা পড়ে গেলো। সব জানাজানি হওয়ার পরেও ওর ভেতরে কোন অনুশোচনা ছিলো না। তবুও আমি মেনে নিলাম! বয়স অল্প এক সময় ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ওকে পেলাম না। পেলাম ওর রেখে যাওয়া চিঠি। যেখানে সে স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলো আমার সাথে সে ভালো নেই। এরপর একদিন দুপুরের কলিং বেল বাজিয়ে একজন ডেলিভারিবয় এলো। হাতে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। হাতে নিয়ে কাগজ খুলে সেখানে আবিষ্কার করলাম ডির্ভোস পেপার। বেস তারপর আর কি? যা হবার তাই হলো। আমাদের তিন বছরের সংসার ছিলো। আমি অনেক চেষ্টা করেছি ওকে নিজের করে রাখার! কিন্তু আমি ব্যর্থ। তারপর আর নতুন করে কোন সম্পর্কে জড়াতে ইচ্ছে করেনি। কিন্তু মা বোনদের জোড়াজুড়িতে আজ আপনার সামনে আমি। সত্যি কথা বলতে প্রায়শই আপনার কথা আপনার ভাই আমাকে বলতো! আমার ভালোই লাগতো একজন মেয়ে যুদ্ধার গল্প শুনতে। কিন্তু কখনো ভাবিনি সেই মেয়েকে নিজের করে পাওয়ার মতো সৌভাগ্য আমার হবে। অবশ্য এখনো হয়নি,হবে যদি আপনি অনুমতি দেন তবে হবে। আমার আপনাকে বেস লেগেছে। আপনি যদি রাজি থাকেন,তাহলে বিয়ের কথা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের পরিবার। আমাকে একটু ছেঁচড়া আপনার মনে হতেই পারে! সব কথা কেমন গটগট করে বলে দিলাম। আসলে মোনা, লজ্জা পাওয়ার বয়সটা আমি বহুআগে পার করে এসেছি। এই লজ্জার জন্যই একদিন কারো মিথ্যা অভিযোগ নিজের মাথায় তুলে নিয়েছিলাম। আজও সেই লজ্জা নিজের মাঝে রেখে আপনার মতো একজন মানুষকে হারাতে পারবো না। আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি। আপনাকে আমার ততোটাই ভালো লেগেছে, যতোটা বিয়ের আগে একজন মেয়েকে লাগলে সংসার করা যায়। আরো একটি কারণ আছে,কিন্তু সেটা আমি আজ নয় বিয়ের পর বলবো। মনে করছি আপনি সবটাই শুনেছেন। কারণ আমি বাঁচালের মতো যেভাবে কথা বলেছি,তাতে আমার মনে হয়! শুধু আপনি না আপনার ঘরের প্রতিটা দেয়াল শুনেছে। আজ উঠি,ভালো থাকবেন আল্লাহ হাফেজ।
মানুষটা গটগট পায়ে চলে গেলো। আমি শুধু অবাক হয়ে তাঁর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ করেই আমার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো নিজের অজান্তেই। মানুষটা সত্যি একটু আলাদা।
_ কিরে ওভাবে পাগলের মতো হাসছিস কেন?
আমাকে হাসতে দেখে মা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো কথাটা। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম।
_ এমনই
_ সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু ছেলেকে কেমন দেখলি। আমার তো ছেলের পরিবারকে বেস লেগেছে। তুই কি বলিস।
_ আমি যদি না বলি, তোমরা কি শুনবে মা আমার কথা। তাহলে শুধু শুধু জিজ্ঞেস করছো কেন?
_ তবুও বল কেমন লেগেছে।
_ মা, তোমাদের যা ইচ্ছে তাই করো আমার কোন মতামত নেই।
_ আবারও হেয়ালি করছিস
_ কোথায় হেয়ালি করছি মা।
_ তাহলে বল সামনে আগাবো।
_ তোমাদের যা খুশি।
এই কথা বলেই আমি ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। কেমন যেন সেই আঠারো ঊনিশ বছর মেয়েদের মতো লজ্জা লাগছে। আচ্ছা অনুভূতি কি এমনই হয়। খাপছাড়া,বাঁধনহারা জলের মতো।
চলবে,