#নতুন_কন্ঠে_ভালোবাসুক
(সূচনা পর্ব ১)
#সমুদ্রিত_সুমি
আমার বয়সটা যখন চৌত্রিশ শেষে পঁয়ত্রিশের ঘরে পা দিলো! ঠিক তখন আমার ছোট ভাই বোনেরা ঠিক করলো আমায় বিয়ে দেবে। কিন্তু আমি তাঁদের বোঝাতে ব্যর্থ হলাম। কুড়িতেই বুড়ি হওয়া এই আমিকে আজ কে বিয়ে করবে? কিন্তু আমার এই কথা শুনে ছোট ভাই বোনেরা যা বললো তা আমি কখনো ভাবতে পারিনি। ওরা বললো–
_ যখন তোমার আরো বয়স বাড়বে কে দেখবে তোমায়! মাকে এমনই আমাদের টানতে হবে। তাঁর সাথে যদি তোমাকেও টানতে হয়! তাহলে আমাদের ভবিষ্যত কি হবে?
ওদের ওই কথায় আমি অবাক হয়নি! কারণ এমনটা কোন একদিন হবে সেটা আমি জানতাম,কিন্তু কখনো মানিনি। আজ মেনে নিলাম। জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভুলেই গেছি। আজ ছোট ভাইবোনেরা না মনে করালে,হয়তো মনেও পরতো না। একদিন বাবা সব দায় আমার উপর সঁপে দিয়ে পরপারে পাড়ি জমালেন। পাঁচজনের সংসার পুরোপুরি তখন আমার কাঁধে এসে পড়লো। সেদিন শক্ত হাতে আমাকেই নিতে হয়েছিল এই সংসারের দায়িত্বগুলো। মা সেদিন আমার মাথায় হাত রেখে বললো–
_ তোর যেদিন জন্ম হয়, সেদিন তোর বাবা তোকে কোলে নিয়ে বলেছিলো! আমার জীবনের অনেক বড় চিন্তা আজ দূর হলো। আমার ঘরে আল্লাহর রহমত এলো। আমি তাঁকে বুক ভরে দোয়া করলাম সে জীবনে অনেক বড় হবে।
হ্যা বড় হয়েছি। তাই তো সকল দায়িত্ব নিতেও শিখে গেছি। অর্নাস সেকেন্ড ইয়ারে থাকতেই যখন আমি চাকরির জন্য চেষ্টা করতে থাকি! তাঁর কিছুদিন পরই আমি চাকরি পেয়ে যাই। খুশি মনে বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে ফিরতেই আমার পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছিলো সেদিন। কারণ বাবা-র লাশটা তখন আমারি চোখের সামনে। মিষ্টির পেকেট হাত থেকে পড়ে গেলো! চোখ বেয়ে ঠান্ডা শীতল জল গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটাতে শুরু করলো যেন কেউ। ঠিক তখনই মা কোথা থেকে দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বললো —
— নেই’রে মোনা,তোর বাবা আর এই দুনিয়ায় নেই। আমাদের এই কঠিন পৃথিবীতে নিঃস্ব করে তিনি চলে গেছেন।
কথাটা শেষ করতে পারেনি মা ! তাঁর আগেই ঢলে পড়লো আমার বুকে। ছোট ভাইবোনেরা চিৎকার করে উঠলো মা’কে পড়ে যেতে দেখে। কিন্তু আমি খুব স্বাভাবিক। মা’কে ধরে এক চাচিকে ইশারা করলাম মা’কে নিয়ে যেতে। ব্যাগ থেকে বের করলাম এই মাসের পাওয়া টিউশনির টাকা। আলি চাচার হাতে তুলে দিয়ে বললাম! এখানে পাঁচ হাজার আছে চাচা। যদি আরো দরকার হয়, দিবো! সব কিছুর ব্যবস্থা করুন। আমার এমন কঠিন রূপ কেউ আশা করেনি। বাবার আদরের বড় মেয়ে আমি। তিনবেলা বাবা-র হাতে ভাত খেয়ে বড় হওয়া মোনা আজ বাবা হারানোর ব্যথা প্রকাশই করলো না! বিষয়টা লোকচক্ষু একটু খারাপই ছিলো। কিন্তু আমি তোয়াক্কা করিনি সেসবের। সব গুছানো হতেই আমাকে সবাই বললো বাবাকে শেষ দেখাটুকু দেখে নিতে। আমি এগিয়ে গেলাম বাবা-র খাটিয়ার কাছে। সাদা আবরণে বাবাকে বড্ড সিগ্ধ লাগছে। বাবা-র নাকে পোড়া তুলোটুকু আমাকে আমারও জানান দিলো বাবা নেই! আমার বাবা নেই। ধুপ করে বাবা-র খাটিয়ার পাশে বসে পড়লাম। আস্তে আস্তে বললাম।
_ এভাবে একা না করেও যেতে পারতে বাবা! কে এখন আমাকে মুখে তুলে তিনবেলা খাবার খাওয়াবে। আমি না খেতে পেড়ে যদি মরে যাই কি হবে তখন? আমার জীবনের সব থেকে খুশির দিনই কেন তুমি এভাবে আমাকে দুঃসংবাদ উপহার দিলে। পৃথিবীতে একজন মেয়ের কাছে তাঁর বাবা-র মৃত্যু সংবাদ আর মৃত মুখ কতোটা ভয়ংকর সেটা তুমি কেন বুঝতে চাইলে না বাবা। আমি কীভাবে এই শোক সংবাদ নিজের মনকে বিশ্বাস করাবো। এভাবে এক তরফা বিচার কেন করলে বাবা? এমনটা কী খুব প্রয়োজন ছিলো? কেন এই কঠিন নিয়ম গুলো তৈরি হলো! আর তৈরি যখন হলো কেন সেটা সইতে এতো কষ্ট হয়। কেন এটা মানতে নারাজ আমি, তুমি আর নেই! বাবা তুমি কি আমায় দেখতে পাচ্ছো। শুনতে পারছো আমার প্রতিটা কথা। বাবা আমি কীভাবে থাকবো তুমি ছাড়া। এতো বড় পৃথিবীর বুকে, ওই উত্তাপ সূর্যের তাপে আমি যে ঝলসে যাবো। কে বটবৃক্ষ হয়ে আমায় ছায়া দিবে। তুমি নেই কেউ আর আমাকে আগলে রাখবে না! কেউ খোঁজ নিবে না আমি খেয়েছি কিনা। কেউ বুঝবে না আমি রাতে ঘুমিয়েছি কিনা? কারণ চোখের নিচে পড়া কালো দাগগুলো সবার চোখে ধরা দেয় না যে বাবা। আমার কথার প্রলেপ শেষ হয়নি, তখনই আমার মাথায় হাত দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো আলি চাচা। বললো–
_ সময় হয়ে গেছে মা’রে! এবার বাবাকে ছেড়ে দে। ক্ষমা করে দে। পৃথিবীর সকল মায়া থেকে তাঁকে যে বিদায় নিতে হবে।
আমি চাচার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললাম।
_ চাচা, আমি একটু ছুঁয়ে দেখবো বাবাকে? খুব দেরি হবে কী বাবাকে যদি আমি একটু ছুঁয়ে দেই। বাবা-র ওই শীতল মুখখানায় একটু হাত বুলালে কী আমার অনেক পাপ হবে চাচা। সকাল,বিকাল,রাতে, দিনের চব্বিশ ঘন্টা যাঁর মুখখানা দেখে আমার দিন শুরু আর শেষ হতো! তাঁকে আর কখনো না দেখে কীভাবে থাকবো আমি চাচা। একটু ছুঁয়ে দেখি? চাচা আমার হাত ধরে নিজে থেকেই বাবা-র মুখে রাখলেন। শিরশির করে উঠলো আমার সারাশরীর। বাবার শরীরখানা বড্ড বেশিই শীতল ছিলো। তাইতো আমার শরীর সেটা নিতে পারেনি! তাই হুঁশ হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিলো মাটির বুকে। চারিদিকে তখন হৈচৈ শুরু হলো। সবাই হয়তো বলতে রইলো।
_ পারলো না’রে নিজেকে শক্ত রাখতে! অবশেষে শোক তাঁকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে। বাবা হারানোর কষ্টটা কি যাই তাই নাকি! যাঁর গেছে সেই বুঝেছে।
বাবাকে ওরা নিয়ে গেলো! কেউ আমার বারন শুনলো না। আমার করুন চোখদুটো বাবা-র যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। হারানোর সুর কতটা ভয়ংকর সেদিন আমি টের পেলাম। আমাকে সবাই তুলে নিয়ে বারান্দায় শোয়ালো । মাথায় পানি দিয়ে চোখে মুখে পানি ছিঁটানো হলো! কিন্তু তাতেও আমার জ্ঞান ফেরার নাম নিলো না। আমি তখন একটা অন্ধকার রুমে আঁটকে ছিলাম। চারিদিকে তাকিয়ে শুধু বাবাকেই খুঁজতে রইলাম। কিন্তু আমার বাবা নেই! কোথাও নেই। হঠাৎ এক তিব্র আলো আমার চোখে পড়তেই আমি সেদিকে তাকালাম। দেখতে পেলাম আমার বাবাকে। ছুটে যেতে নিলেই কেউ আমার হাত দু’টো আঁটকে দিলো। আমি বাবা,বাবা বলে চিৎকার করতে রইলাম। কিন্তু কেউ আমার হাত ছাড়লো না। ওদের বললাম। ওরে তোরা আমায় ছেড়ে দে,আমার বাবা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ওরা তোরা ছাড় আমায় আমি বাবা-র কাছে যাবো। ও বাবা ওদের বলো আমায় ছেড়ে দিতে,আমি যে তোমার কাছে যাবো। কি করে থাকবো আমি তোমায় ছাড়া। বাবা তুমি ওদের বলো না আমায় ছেড়ে দিতে! তুমি বললে ঠিক ওরা ছেড়ে দিবে। কিন্তু বাবা ওসব কিছুই বললো না! বললো–
_ আমার সকল দায়িত্ব আজ তোকে সঁপে দিয়ে গেলাম মা। আজ থেকে তুই এই পরিবারের বটবৃক্ষ হয়ে থাকবি। তুই ছাড়া কেউ এই ভেঙে যাওয়া পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারবে না। তুই পারবি এই পরিবারকে আগলে রাখতে।
এই কথা গুলো ব’লেই বাবা মিলিয়ে গেলো। আমি চিৎকার করে বাবা বলে উঠলাম। বাবা নেই কোথাও নেই। আমার বাবা নেই,ডানে, বামে কোথাও না। খুব জোড়ে চিৎকার দিয়ে উঠতেই নিজেকে নিজের ঘরে দেখলাম। আমাকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো সবাই দেখছে বাবা-র আদরের মেয়েটা বাবা হারাতে কেমন পাগলামি করছে। কিন্তু তাঁরা শুধু আমার পাগলামি গুলো দেখেছে আমার ভেতর থেকে ভেঙে যাওয়া দেখলো না। ছোট্ট সেই মোনা আজ ভেতর বাহির পুরোটাই শূন্য অনুভব করলো কেউ সেটা বুঝলো না। আজ-ও সেই ব্যথায় মোনা ব্যথা পায়। ক্ষতটা যে আজ-ও বুকের মাঝে তরতাজা,সেটায় যে কেউ মলম লাগালো না।
চলবে,,,