নবযাত্রা,অন্তিম পর্ব

0
1222

নবযাত্রা,অন্তিম পর্ব
~আরিফুর রহমান মিনহাজ

মায়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর খাদিজা বেশ একলা হয়ে পড়ে। বয়াতিও দিনকয়েকের জন্য কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়৷ শোকসন্তপ্ত দিনগুলোকে দীর্ঘায়িত না করে আবারো কাজে মশগুল হয়ে পড়ে সে। আশুই সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়। শুধু,মাতৃহীন শূন্যতাটা ওর অভ্যন্তরীণ জগতের প্রতিটি মুহূর্তকে কেমন বিভীষিকাময় করে তুলেছে। ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে রাকিব দিনে একবার করে ওর একলা ঘরে দর্শন দিয়ে যায়। অল্প সময়ের জন্য হলেও মেয়েটার ঘুণেধরা মনটাকে মেরামত করে দিতে চায়। আজও তেমনভাবে দর্শদানের পর রাকিব ওর খড়িওঠা রুক্ষ মুখে নিখাঁদ হাসির রেখা টেনে বলল,
– কী রে,কী খবর?
খাদিজা কোনো জবাব না দিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালে রাকিব ভেতরে ঢুকল। ওর মুখে তখনো হাসি লেপ্টে আছে। কিন্তু খাদিজা গম্ভীর হয়ে বলল,
– তুই কি এমনিতেই আসতে থাকবি? লোকে কী কইবে ক তো?
রাকিব তাচ্ছিল্যভরে হাত নাড়ল,
– লোকে কী ক’বে তা দিয়ে আমার কীরে? আমি লোকের খাই না পরি?
– তারপরও…
– হুহ্। চল্ না সামনের শুক্কুরবার বানিজ্য মেলাত্তে ঘুইরা আসি? বিরাট মেলা হইতেছে। তর ভাল্লাগপি।
খাদিজা চোখ তুলে চায়,
– কী কিইনা দিবি আমারে?
– যেইটা তুই চাইবি সেইটাই দিমু।
– না যামুনা,এমনিই কইলাম।
– যাবি না মানে,একশবার যাবি। নাগরদোলায় বসবি আমার লগে। কামিনীসুলভ প্রশ্রয়ের হাসিতে পাতলা টেপা ঠোঁটজোড়া বেঁকে উঠল খাদিজার,
– কী শখ! – তোগো সাকিবরে দেখলাম ওইদিন। মার্কেটে ওর বউয়ের লগে।
রাকিব দুঃখের ভান করে বলল,
– হ,বড় ভাইয়ের আগে ছোটভাই কাম সাইরা ফেলছে। এত বিষ রাখবার জায়গা পাচ্চিল না তাই। শালা হারামির বাচ্চা।
– বড় ভাই আকাইম্মা হলে কী করবো তাইলে? তারে কি কেউ ধরে রাখছে? না মানা করছে?
খাদিজা সহজ হয়ে আসে আস্তে আস্তে। ওর বুকের ওপর চেপে থাকা শূন্যতাটা দূরন্ত বাতাসে কালো মেঘের পালের মতো সরে পড়ে। রাকিব বলে,
– কী আর করমু ক। মাছ কাটইন্নেরে কেউ বিয়া করতি চায় না৷ বলে,হারাদিন মাছের গন্ধ আইব৷ এইটা কোনো কথা?
– তুই একটা…. ৷ অন্য কাম করলিই তো হয়। এই কাম আমার ভাল্লাগে না৷
– তোর ভাল্লাগন দিয়া কী অইবো? তরে বিয়া করতিছি নাকি?
খাদিজার চোখজোড়া কৃত্রিম রোষে জ্বলে উঠে,
– বের হ ঘর থিকা৷ যা। এইখান আইচিস ক্যান তাইলে? চিনেজোঁক কোনঠাঁইকার।
রাকিব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,
– এমন কইরা যদি তর বাপেরে বাইর করতি তাইলে তোর মা বিনে চিকিস্সেয় মইরতো না।
কথাটা বলে ফেলেই রাকিবের বুকটা দুরুদুরু করে উঠে। মনে মনে জিভ কেটে সে শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায় খাদিজার দিকে৷ খাদিজার চোখ তখন মধ্যআষাঢ়ের পদ্মার মতো কানায় কানায় ভরে উঠেছে। একটু হলেই দুকূল প্লাবিত হয়ে উপচে পড়বে। দুঃখিত হয়ে রাকিব এগিয়ে গেল সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু খাদিজা অশ্রু-টলটলে চোখে তাকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দিয়ে মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিল। বস্তির মহিলারা কোমরে হাত দিয়ে দৃশ্যটা উপভোগ করতে করতে চোখ ঠারাঠারি করে মিটিমিটি হাসতে লাগল। তাদের উদ্দেশ্য করে রাকিব চেঁচিয়ে উঠল,
– কী? নাটক দেহ খাড়ায়া খাড়ায়া? কাম কাইজ নাই নাকি?
অনেককিছু বলেও সে দরজা আর খোলানো গেল না৷ শেষমেশ আক্রোশে ফেটে পড়ে আটকানো দোরে এক ঘা লাথি কষে বলে গেল,‘হাঁচা কতা কইলে বেবাক লোকেরই মন্দ লাগে। আইলাম না তর ঘরে। আমার ঠেকা পড়ছে।’

দিনকয়েক পর একটা বিরাট লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেল বাজারে। বলাবাহুল্য, সপ্তাহে একটা দিন স্থানীয় প্রভাবশালী একজন নেতার নামে চাঁদা উঠে পুরো বাজারে। বাজারে স্থায়ীভাবে দোকান নিয়ে বসা প্রত্যেক বিক্রেতারা এই চাঁদা দিতে কখনো বিমুখতা দেখান না। কিন্তু বিপত্তি ঘটল এই সপ্তাহের চাঁদা উঠানোর সময়। সপ্তাহান্তে যে লোকটি তেলতেলে হেসে দোকানে দোকানে চাঁদা উঠিয়ে থাকে সে লোকটির সঙ্গে এবার জনাকয়েক চ্যালাগোছের ছেলেকে দেখা গেল। ছেলেগুলো দোকানে দোকানে গিয়ে কীসের যেন আয়োজনের কথা বলে ডাবল চাঁদা আদায় করছিল। যথারীতি মাছ-কাটুরেদের ডেরায় এলে সবার হয়ে রাকিব শুধালো,
– ডাবল চাঁদা কীসের?
রাকিবের প্রতিনিধিত্বমূলক ভাবসাবকে বোধহয় চ্যালাগুলো হুমকিস্বরূপ দেখেছিল। একজন ক্ষেপে উঠে বলল,
– জনে জনে কইতেছিলাম শুনসনাই?
রাকিব বলল,
– শুনিনাই আবার কন।
বলা হলো। কিন্তু রাকিব বলল,
– ডাবল চাঁন্দা ক্যান,এক টাকাও দিমু না৷ দোকান ভাড়া দিই না আমরা? এরপরেও কীয়ের চান্দা?… ওই কেউ চান্দা দিবি না।
ওর সঙ্গে সমর্থিত হয়ে আশেপাশের কয়েকজন জওয়ান মাছবিক্রেতাও হাঁহাঁ করে বলল,তারাও চাঁদা দিবে না। প্রবীণরা ভুরু কুঁচকে আন্দাজ করল, খারাপ কিছু হতে চলেছে।
এদিকে বড় একটা বিরোধীপক্ষ দাঁড়িয়ে যাওয়ায় চ্যালাচামুণ্ডারা বোধবুদ্ধি হারিয়ে রাকিবের ওপর চড়াও হলো। ওর শার্টের কলার চেপে ধরে শাসানোর চেষ্টা করতেই রক্তগরম তরুণদের সেটা বরদাশত হলো না। ফলশ্রুতিতে একটা বিষম মারামারি,হাতাহাতি লেগে গেল। নেতাসাহেবের বিশ্বস্ত চামুণ্ডাদের হাতের কাছে পেয়ে সাধারণ মানুষও এতে অংশ নিয়ে আচ্ছামত প্যাঁদিয়ে নিল। দিনশেষে রাকিবসহ আরো কয়েকজন সহকর্মীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। কিশোরগ্যাং এর মামলা দেওয়া হলো রাকিবকে। কীভাবে কীভাবে যেন কোর্টে প্রমাণিত হলো রাকিব কিশোর গ্যাং এর লিডার। তার নেতৃত্বে হরতালের সময় গাড়িভাংচুর সহ নানান নাশকতার চালানো হয়েছে নগরের বিভিন্ন জায়গায়। আরো তথ্য হাসিল করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে দশদিনের রিমান্ড চাওয়া হলে কোর্ট পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পাঁচদিন যাবত কথা বের করার নামে চলল অহেতুক নির্যাতন। কোনো কথা বের হলো না। রাকিব নিজেও জানতে পারল না তাকে নিয়ে এত আয়োজন কেন? পুলিশের কি আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে সামান্য একটা মারামারিকে এতদূর গড়িয়ে নিয়ে যাবে? যাহোক,রিমান্ডে বেশিকিছু না পেয়ে আদালত তাকে দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ শুনিয়ে দিল।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রাকিবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে খাদিজা। অনেক কষ্ট করে,নানাজনের দ্বারস্থ হয়ে অনুনয়-বিনয় করে অবশেষে আজ সে দেখা করার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত হয়েছে। আজ প্রায় মাস হতে চলল এই ছেলেটির মুখদর্শন অবধি করেনি সে। একেকটা দিন কী যে যন্ত্রণার মধ্যদিয়ে গেছে তা কেবল সে নিজেই জানে৷ সে-ই যে মনোমালিন্য হয়েছিল, এর পরপরই তো এই কাণ্ড!
কারাগারের সাক্ষাতের জায়গাটায় প্রচণ্ড রকমের ভিড়ভাট্টা আর কোলাহল। দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েদি আর সাক্ষাৎ-প্রত্যাশীরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে একে-অপররের সঙ্গে। খাদিজা গরাদের শিক দু-হাতে আঁকড়ে ধরে উঁকিঝুঁকি দিতে দিতে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে এপাড়ে। কোথায় গেল?…হ্যাঁ, ওইযে আসছে। অবশেষে দেখা মিলল। ক্লিষ্ট-মলিন মুখটা দেখেই ওর ভেতরটা কেমন মুচড়িয়ে উঠল। হৃদয়ের তলানি থেকে এক আকস্মিক জলোচ্ছ্বাস পাঁক খেয়ে উঠে বাষ্পীভূত হয়ে উঠল চোখযুগল। ওকে দেখে রাকিবের মুখে নির্মল হাসি ফুটে উঠল,
– তুই?
– আছিস কেমন?
– ভালাই। তুই?
খাদিজা অস্থিরভাবে বলল,
– আমি ভালা না। কী থিকা কী হয়া গেল ক তো?
– হু,আমি এগুলা কিছু করিনাই।
– আমি জানি।
– আর কেউ আসেনাই?
বলে আশান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল রাকিব। খাদিজার মুখ শক্ত হয়ে উঠল,
– আর কে আইবে? তোমার ভাই বউ নিয়া ঘরে উঠছে। বউ তো না আস্ত মাগী। বস্তির বেবাক বেডার লগে ফষ্টিনষ্টি করে। সে কাউরে আয়তে দিতে চায় না। কয়,সন্ত্রাসীর লগে কীয়ের সম্পর্ক।
রাকিবের ঠোঁটের কোণে একটা খেলো বিদ্রূপের হাসি জেগে উঠে পরক্ষণেই থিতিয়ে যায়। নির্ভার গলায় বলে,
– আচ্ছা। চিন্তা নাই। দুই বছরই তো।
– কম সময় নাকি?
– তোর এত চিন্তা ক্যান?… মাইয়্যা মানুষ একলা থাকা ভালো না। কখন দেখবি তোর বাপ এসে হাজির। এরচেয়ে ভালো বিয়াসাদী কইরা সংসারী হ। ঝামেলা চুইকা গেল।
খাদিজা ডাঁটো ঝগড়াটে গলায় বলল,
– আমারে নিয়া তর ভাবার দরকার নাই। তুই পারলে নিজের খেয়াল রাখ৷
সময় শেষ হয়ে গেল। কর্তব্যরত সেপাইরা তাড়া দিল। যেতে যেতে পেছনে ফিরে তাকায় খাদিজা,হাত নেড়ে বিদায় জানায়৷ চেঁচিয়ে বলে,আবার আইমুনে? রাকিব সুবোধ বালকের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেয়।


একবছরের মাথায় একদিন স্বাধীনতা দিবসে রকিব কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে। তার মুক্তির খবর আগে থেকে কাউকেই জানানো হয়নি৷ অপরাধ আর কারাগারে সুশৃঙ্খলতা বজায় রেখে চলা আসামিদের বিবেচনা করে প্রতিবছরই স্বাধীনতা দিবসে মুক্তি দেওয়া হয় অনেক আসামিকে। রাকিবও সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। দীর্ঘ এক বছর পর মুক্ত বাতাসের সংস্পর্শে এসে প্রথমেই সে ছুটে গেল বাজারে৷ সেখানে কিছুই আগের মতোন নেই। একসময় বাজারে যে অংশটা তাদের হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে থাকত এখন সেখানে আছে অন্য একদল অচেনা তরুণ। ওরাও মাছ কাটছে।খদ্দের বিদেয় করছে। একই পদ্ধতিতে, একই দ্রুত ও অখণ্ড নিমগ্নতার সাথে। পরিচিত অনেকেই যেন তাকে চিনতে পারছে না। প্রবীণ দু’একজন কেবল নিদেন চোখাচোখি হয়ে যাওয়ায় দায়সারাভাবে শুধালো, কীরে রাকিব না? ছাড়া পাইলি কবে?
অস্পষ্টভাবে ঠোঁট নেড়ে রাকিব বলে,এইতো আইজই।

দুপুরনাগাদ তার সঙ্গে মামলার প্যাঁচে জড়িয়ে পড়া ভাইবেরাদরদের খোঁজখবর নিল সে। এরপর সূর্য যখন মধ্যগগনে সগৌরবে বিরাজ করে পুড়িয়ে দিতে শুরু করল এই চরাচর তখন রাকিব বস্তির পথ ধরল। বস্তুত ওপথে পা মাড়ানোর ইচ্ছে সঞ্চয় করতে তার এতক্ষণ সময় লাগছিল। খাদিজার মুখে টুকরো টুকরো যা শুনেছে তাতে ওই ছরকট ঘরটায় যাবার ইচ্ছে তার একেবারেই মরে গেছে। কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই।

বস্তিতে প্রবেশ করতেই আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই অবাক হয়ে গেল রাকিবকে দেখে। কেউবা কুশল-বৃত্তান্ত জানতে চাইল আবার কেউবা অক্ষিকোটরের বিস্ময় জাগিয়ে শুধু চেয়েই রইল। শেষমাথায় নিজের ঘরটায় কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছতেই দেখা মিলল শরমিন বেগমের। ছেলেকে দেখেই তিনি আত্মবিস্মৃত হয়ে চেঁচিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরলেন। এরপর সুর ধরে লাগিয়ে দিলেন মরা কান্না। ছোট বোনগুলো মায়ের ক্রন্দন দেখে চোখ মুছে ভাইয়ের কাছাকাছি ঘুরঘুর করতে লাগল। পরিবেশ যখন শান্ত হলো,রাকিব চোখ তুলে চেয়ে দেখল সুমুখেই দাঁড়িয়ে একজন অপরিচিত স্বাস্থ্যবতী যুবতী রমণী। পরনে শাড়ি। গায়ের রং লালচে-ফরসা। ডবডবে চোখ-মুখসহ সারা দেহে গায়ে জ্বালা ধরানো ঔদ্ধত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শরমিন বেগম নিচু গলায় বললেন,
– সাকিবের বউ।—সালাম কর্ বউ। তোর ভাসুর।
বউ তো সালাম করলই না বরং বিশ্রীভাবে জঘন আর বুক দুলিয়ে ঘুরে প্রস্থান করতে করতে বলল,
– পারমুনা। আমার কাজ আছে।
রাকিব ভোঁতা হেসে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
– কেমন লাগতিছে মা নতুন বউয়ের সংসার?
শরমিন বেগম একপলক অসন্তুষ্ট চাহনি মেলে ধরে পরক্ষণেই মুখ গোঁজ করলেন,
– ছিনালের বেটী আমার পোলার মাথা খাইছে।
রাকিব শুধু বলল,
– দোষ তোমার পোলারও আছে। সব খবর আমার আছে।

বিকালে কাজ থেকে ফিরে বস্তিতে রাকিবকে দেখে খুশিতে অজ্ঞান হয়ে যাবার উপক্রম হলো খাদিজার। রাকিবকে চৌকাঠের ওপার থেকে দু’হাতে টেনে নিজের ঘরে ঢুকিয়ে অসংযতভাবে জাপটে জড়িয়ে ধরল সে। কেঁদে উঠল ভ্যাঁকভ্যাক করে। পরমুহূর্তেই হুঁশে ফিরে লজ্জিত ভঙ্গিতে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়ে দুই করতলে মুখ চেপে ধরে ধাতস্থ হয়ে বলল,
– তুই ঘরেই থাক। রাতে এখানে খাবি৷ আমি রাঁধব আর তুই আমার পাশে বইসা গল্প করবি ঠিক আছে?
– ঠিক আছে৷
রাকিব সত্যি সত্যিই গল্প জুড়ে দিল। জেলখানার বিবিধ রোমাঞ্চকর গল্প। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কুদ্দুসের পালানোর সময় পাগলাঘন্টাটার চিৎকারে কীভাবে ঘুম ভেঙেছিল সেই গল্প। বলতে বলতে যেন ফুরোয় না। দিনভর মেহনতের পর খাদিজা নানান পদের রান্না করে আর অমৃতবাণীর শ্রবণের তৃপ্তি নিয়ে শুনে কারাগারের গল্প। কারাগারের গল্প শেষ হতে না হতেই খাদিজা নিজেই জুড়ে দেয় বস্তির গল্প। গত একবছরে এই বিশাল বস্তিবাসীর জীবনে ঘটে যাওয়া মুখ্য ঘটনাগুলো তুলে ধরে একে একে। তুলে ধরে,সাকিবের বউয়ের বেলাল্লাপনা আর জাহেলিয়াতের কথা৷ একবার তো নিতান্ত সামান্য বিষয়ে খাদিজার সঙ্গেও বাঁধতে বসেছিল। ভাগ্যিস, ওই মেয়েলোকটির স্বভাবের কথা সে বিশেষভাবে অবগত ছিল,নয়তো সেইদিন একহাত হয়ে যেতে পারত। ঘটনা তেমন কিছু না। মায়ের মরণের পর, রাকিবের কারাবাসের পর খাদিজা যখন একটু সঙ্গলব্ধতার জন্য শরমিন বেগমের কাছে যায় সেটি তার সহ্য হতো না। একথা-সেকথা বলে খোঁচাখুঁচি করতো।

রান্নাবান্না শেষ হলে গল্পেরও পরিসমাপ্তি টানা হলো। ওরা দু’জনে একসাথে বসে পেট পুরে খেল। খাবারের এঁটোগুলো রান্নাঘরে দুমড়েমুচড়ে রেখে এসে খাদিজা আবার বসল রাকিবের সুমুখে। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
– এখন কী করবি?
রাকিব ঠোঁট বাঁকিয়ে নির্লিপ্ত হয়ে বলল,
– ভাবিনাই।
-জমাজাতি আচে কিচু?
অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চাইল খাদিজা৷ রাকিব পা টানটান করে বসে একটি সিগারেট ধরিয়ে বলল,
– আছে। দেহি কী করণ যায়। ওই বাজারে আর কাম করুম না। ভাবতিছি মফস্বলে চইলা যাব। কামাই কম হলিও ঝামেলা নাই।
খাদিজা মুখটা একটু পানসে করে নরমভাবে বলল,
– তারচে এইখানে ছোটখাটো দোকান-টোকান…
– না ওইসব অলস কাম হবি না আমার দারা। খাটতি না পারলি আমার শরীর খারাপ করে। তোর ভাবনের দরকার নাই। ব্যবস্থা হয়া যাবেনে।
খাদিজা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না৷ মুখটা ঘুরিয়ে একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল শুধু।

সপ্তাহ গত হয়ে গেল। রাকিব বুঝতে পারল, জেল থেকে আসার পর ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের সাথে তার ঠিক বনছে না। ভাই আগে যে তাকে সমীহ করে চলত তার লেশমাত্রও এখন তার আচার-আচরণে দেখা যায় না। বউয়ের কথা তো বলাই বাহুল্য। ওটির মতো বেয়াদব মেয়ে জগতে দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। যতক্ষণ ঘরে থাকে ততক্ষণ ছেনালিসুলভ আচরণ করে করে রাকিবের সাথে। ক্ষণে ক্ষণে খসে পড়ে গায়ের আচল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অলক্ষ্যে উদ্ধত বুকের খাঁজ দেখিয়ে, ঠোঁটের বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে কটাক্ষ হানে শকুনীর মতো। ডোবা থেকে স্নান সেরে এসে ভেজা কাপড়ে ঘুরঘুর করে সারা ঘরে, বলে, কনে যে রাখলাম কাপড়টা…। রাকিবের সারাশরীর হিম হয়ে আসে। মতলব কি কেজানে!মাঝে মাঝে রাকিবের ইচ্ছে করে ওটাকে গলাটিপে মেরে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে পড়ে। কিন্তু না৷ এটা করা যাবে না৷ ওর লুচ্চা ভাই কাউকে না জানিয়ে এমনতর বউ পছন্দ করার পরিণাম ভোগ করবে তবেই না শান্তি।
এরিমধ্যে এক জায়গায় কথা বলে নিয়েছে রাকিব। শহর থেকে অনেক ভেতরে মোটামুটি বড় একটা মাছবাজারে একটা জায়গা পাকা করে নিয়েছে সে। দিন-দুই পরেই সে বস্তি ছেড়ে চলে যাবে। সবকিছু বাঁধাছাঁদা শেষ। ওখানে থাকার জায়গাও ঠিক। এখন সবাই থেকে বিদায় নিয়ে এই বস্তি ছাড়তে পারলেই বাঁচোয়া। পরিবারের ভার রইল সাকিবের ওপরে। সে তো সংসার চালাচ্ছেই,রাকিবও ভাইবোনদের জন্য মায়ের হাতে দিবে মাসে মাসে। তবুও শুধুমাত্র ওই বেহায়া বউটার জন্য একসঙ্গে থাকা আর হচ্ছে না মনে করে শরমিন বেগম বেজায় হা-হুতাশ করছেন। মিনিটে মিনিটে ঝগড়া লাগিয়ে দিচ্ছেন পুত্রবধূর সাথে। বউটি ঝাগড়াতে দারুণ পারদর্শী। এমন এমন কথা বলে শ্বাশুড়ির মুখ এঁটে দেন যে বেচারি শরমিন বেগম লানত দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না৷ আবার সেই লানতের বিপরীতে পুত্রবধূ মুখটা এমন বিশ্রীভাবে বাঁকিয়ে বুড়ো আঙুল দেখান যে দেখলেই ঘেন্না হয়।

এমনি একটা সময়ে হঠাৎ একদিন ঘরে ফিরে এসে খাদিজা দেখল তার বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে আছে তার পিতৃদেব।
– তুমি! তুমি ঘরে ঢুকছ ক্যামনে?
– হেহেহেহে চাবি ছিল একটা। এইখানে থাকি কয়েকদিন!
– না। এক মিনিটও না। বের হও। বের হবা নাকি রাকিবরে ডাকুম?
বয়াতি এখন সম্পূর্ণ হুঁশে আছে। সে হুড়মুড় খেয়ে এসে খাদিজার পা জড়িয়ে ধরে বলল,
– আম্মা,আম্মা। রাকিবরে ডাকিস না। দুইদিন ধরে কিছু খাই না আম্মা। চাইট্টা ভাত দে।
খাদিজা নিমেষে টলে গেল। মনে পড়ে গেল, কোন সুদূর অতীতে গাঁয়ের মেলায় সে আর তার বাবা হাত ধরাধরি করে ঘুরছে। সেই বাবার সঙ্গে এই বাবার বাহ্যিক এবং চারিত্রিক কোনো মিল না থাকলেও খাদিজা টলল। মিনমিন করে বলল,
– ভাত খেয়েই চইলে যাবা।
– না আম্মা। থাকমু দুইটা দিন।
কাঁধের ব্যাগটা ফেলে,বোরখা খুলে ভাত রাঁধতে গেল খাদিজা। ক্লান্ত মনটা তার শ্রাবণধারায় মুহ্যমান স্রোতস্বিনীর মতো টলটলে ও আদ্র হয়ে গেল হঠাৎ। মনে পড়তে লাগল মা’কে। যে মা’টা কখনো সুখের মুখ দেখেনি৷ ওঘরে বসে আছে যে বাবা,হারামখোর। যে মা’কে কখনো দুদণ্ড শান্তির অবকাশ দেয়নি। বিয়ের বছর না যেতেই যখন খাদিজার জন্ম হলো, সেই থেকেই মা’র দিকে আর ফিরেও তাকাতো না বাবা। রাতভর থাকতো জুয়ার আসরে। কখনো সর্বস্ব হারিয়ে পাঁড় মাতাল হয়ে নিঃস্ব হয়ে আসতো আবার কখনো বা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ফুরফুরে মেজাজে আসতো। প্রতিটা রাত ভীতসন্ত্রস্ত হতে থাকতো মা। এই বুঝি তার ওপর গজব নেমে এলো। বাইরের স্ত্রীলোকের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা ছিল বাবার,সে নিয়ে নরমভাবে কিছু বলতে গেলেও মায়ের ললাটে জুটত অমানুষিক অত্যাচার। এরপর তো একদিন কার বউ ভাগিয়ে নিয়ে তাদের নিষ্কৃতি দিয়ে গেল। মা-মেয়ে ভেবেছিল,আপদ বিদেয় হলো। কিন্তু না। এই আপদ এতো সহজে বিদেয় হবার নয়। দু-চোখ বোজার আগপর্যন্ত এই আপদটা তাদের জীবনে বিষফোঁড়ার মতো হয়ে থাকবে বলে পণ করেছিল যেন।
একবুক অনিচ্ছা নিয়ে বাপের জন্য ভাত বাড়তে বাড়তে খাদিজা একবার ভাবল, ইন্দুরের বিষ মিশিয়ে দেয় এই ভাতে।খেয়ে পাতিইন্দুরের মতো জিভ কামড়ে ম’রে প’ড়ে থাকুক। সমস্ত ক্লেশের অবসান হয়ে যাক।

টকটকটক করে জালানার পাল্লায় কে যেন টোকা দিল। রাকিবের চোখ লেগে এসেছিল এইমাত্র। ধড়ফড় করে উঠে বসল সে। আবার টোকা দিল,এবার যেন হাতের আঙুলগুলোর অন্তহীন অস্থিরতা পরিস্ফুট হলো। সামনের ঘরটাতেই থাকে রাকিব। সেই ঘরে গলিমুখী একটা ছোট জালানা করা আছে৷ রাকিব তাড়াতাড়ি জানালা খুলল। আনকো আলোয় ভূতের মতো উদ্ভাসিত হলো খাদিজার মুখখানা। সেই মুখে যমের মুখদর্শনের মতো মূর্তিমান আতঙ্ক। অধীরচিত্তে ডানেবামে তাকিয়ে ও বলল,
– রাকিব, বের হ তাড়াতাড়ি।
– কী…কী হইছে? এরাম করতিছিস ক্যান?
– কেমনে বুঝামু তরে৷ বের হ না বাল।
রাকিব ঝটিকার বেগে বের এলো ঘর থেকে। পরনের লুঙ্গিটা ওর ঢিলে হয়ে আছে। চলতে চলতেই সেটি পুনরায় গেরো দিয়ে বলল,
– ক দেহিন,কী অইছে?
বলতে না বলতেই রাকিব দেখল, খাদিজা কাঁপছে ঠকঠক করে। ওর বিস্ফারিত চোখে ভাষাহীন আতঙ্ক। একটুক্ষণ পর পাতলা ঠোঁটজোড়া ঈষৎ কেঁপে উঠল, ফ্যাসফ্যাসে চাপা কণ্ঠস্বর ফুটল অসহ্য পিনপতন নীরবতা ভঙ্গ করে,
– মাইরে ফেলছি,মাইরে ফেলছি।
বলতে বলতে খাদিজা থরথর করে কাঁপতে থাকা দুটি রক্তেভেজা হাত তুলে ধরল। রাকিবের হৃৎস্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে গেল।
– কী! কী কস এগুলা! কারে মারছস?
– আব্বারে মাইরে ফেলছি!
রাকিব লাফিয়ে এগিয়ে গিয়ে খাদিজার মুখ চেপে ধরল। শঙ্কিত দৃষ্টিতে চাইল চারিধারে।
– চুপ চুপ৷ কেউ হুনব!

টুটুল বয়াতির রক্তাক্ত মৃত দেহটা পড়ে আছে ঘরের মেঝেতে। তার মাথার মাঝখানে আড়াআড়িভাবে গেঁথে আছে একটি দা। বিরাট স্ফীত ক্ষতস্থানটি থেকে মাথার দুই প্রান্তে রক্তের ফোয়ারা নেমে এসে ভিজিয়ে দিয়েছে সারা মুখমণ্ডল। এরমাঝে রক্তজমাট প্রাণহীন চোখদুটো খোলা! মাথাটা যেখানে বেঁকে কাত হয়ে পড়ে রয়েছে সেখানটায় তাজা খুনের থান বসেছে। গায়ে জামাকাপড় নেই বয়াতির, একেবারে উলঙ্গ। রাকিব উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাল খাদিজার দিকে,
– এটা কী করিছিস তুই!
খাদিজা রোরুদ্যমান কণ্ঠে যা জানাল তাতে রাকিব হতভম্ব হয়ে গেল। রাতে খেয়েদেয়ে খাদিজা শুয়ে পড়েছিল। পাশের ঘরেই বসে বসে মদ গিলছিল আর তারস্বরে গান করছিল বয়াতি। ঘুম আসছিল না। একসময় গান থেমে গেলে খাদিজার চোখ লেগে আসে। কিন্তু হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙে গিয়ে সে আবিষ্কার করে একটা জন্তুবৎ মানুষ জান্তব পাষণ্ডতা নিয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দানোর মতো বল তার শরীরে। গা-গুলানো মদের গন্ধের কারণে মানুষটাকে চিনতে অসুবিধা হলো না খাদিজার৷ তারই জন্মদাতা বাবা! মাতাল হয়ে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে যৌন ক্ষুধা চরিতার্থ করতে এসেছে স্বয়ং মেয়ের কাছে! ঘুমন্ত খাদিজার সারাদেহে হস্তচালনা করতে করতে জামাকাপড় খোলার চেষ্টা করছে। অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তির পর খাদিজা লাথি মেরে সরিয়ে দিল বয়াতিকে৷ পড়িমরি করে নেমে এলো
বিছানা থেকে। জ্বালালো লাইট৷ গলায় অস্বাভাবিক গোঙানির মতো বিভৎস শব্দ করে, রক্তলাল চোখ করে আবার ছুটে এলো বয়াতি। একহাতে খাদিজার টুটি চেপে ধরে অন্যহাতে জামায় হাত দিতেই ঘরের এককোনায় অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা দা’টির অতিউত্তম ব্যবহার করে নিল খাদিজা। বাঁ হাতে আস্তে আস্তে টেনে নিয়ে বয়াতির গায়ে একটা ঝাঁকি দিয়ে, ঈষৎ সামনে এসে ঝপ করে বসিয়ে দিল কোপ। একেবারে মাথা বরাবর। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে সারা ঘরময় রক্তগঙ্গা বয়ে গেল যেন! সমস্তটা বলার পর খাদিজা হেঁচকি তুলে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। রাকিব দাঁতে দাঁত চেপে অনেকক্ষণ কর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইল।
– চল। সময় নষ্ট করন যাবে না।
– কই? যেখানেই যাই। পুলিশে ধইরা ফেলব।
রাকিব থমকালো। পুলিশি প্যাঁচে পড়ার অভিজ্ঞতা তার আছে। কথায় আছে,পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। অথচ রাকিবের বিবেকবোধ বলছে না খাদিজা পুলিশে ধরা খাওয়ার মতো কিছু করেছে। যা করেছে,বেশ করেছে। তবুও পুলিশ তো ছাড়বে না। বস্তিতেও খাদিজার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দেবার মতো প্রতিহিংসাপরায়ণ লোকের অভাব নেই৷ ঠোঁট কামড়ে ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে পড়ল সে। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ল ওর। আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
– একটা যাইগা আছে…
– কই?
– আমাদের চরে। চর খিদিরপুর গাঁ তো আর নাই। শুনছি পাশে আরেকটা ছোট চর জাগছে। ওইখানে…চল তাড়াতাড়ি যা কিছু নেওয়ার লিয়া লে।

সে নির্জন রাতেই ওরা দু’জনে অলংকার বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ঢাকাগামী একটি বাসে উঠে পড়ল। পরদিন সকালে ঢাকায় নেমে সেখান থেকে সোজা রাজশাহী শহরে। রাজশাহী শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে পদ্মার পাড়ে চরখিদিরপুর গ্রাম। সেই চরের পাশেই উন্মত্ত পদ্মার বুকে জেগেছে আরেকটি চর, যেখানে এখনো জনবসতি গড়ে উঠেনি। এই বর্ষা মৌসুম শেষে শুষ্ক মৌসুমে আশেপাশের চরগুলোতে ভাঙনের কবলে পড়া লোকজন এখানেও বসতি গড়ে তুলবে বলে ধারণা করছে রাকিব৷

একটা যন্ত্রচালিত নৌকা ভাড়া করে চরটা খুঁজে পেতে পেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল ওদের। মাঝিটা এই ঘাটে নতুন বলে চিনতে পারছিল না নতুন চরটা ঠিক কোথায়। ঘুরতে ঘুরতে বেচারার ইঞ্জিনের তেল ফুরিয়ে এলো প্রায়। তেলবাবদ কিছু টাকা বাড়তি দিয়ে নৌকা থেকে নেমে এলো ওরা। রাকিব মাঝিকে পইপই করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করল ওদের আগমনের সংবাদ যেন কোনভাবেই কাউকে না জানায়। উপরন্তু,একটা নৌকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেছে রাকিব,সেই নৌকা ক্রয় থেকেও কিছুটা লাভ সে ঘুষ হিসেবে মাঝিকে দেবে। এতকিছুর পরে সহজসরল, স্বল্পভাষী মাঝি যেচেপড়ে প্যাঁচ লাগাতে যাবে বলেও মনে হয় না। যাহোক, ইঞ্জিনের ধোঁয়া উড়িয়ে মাঝি যখন ওই দূর নদীর মোহনায় লীন হয়ে গেল তখন এই সুবিস্তীর্ণ জনমানবহীন চরের মধ্যে গা ছমছমে নীরবতা প্রকটিত হয়ে উঠল। অস্তাচলগামী সূর্যের প্রাস্থানিক শেষ রক্তিম আঁচড় ধোঁয়াটে আকাশের ইতিউতি ছড়িয়ে আছে। একটি-দুটি পাখি তখনো ডাটা ঝাপটিয়ে উড়ে যাচ্ছে নীড়ে। ওরা যেখানে নেমেছিল সেখানটায় একহাত প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা। সুমুখে ধূধূ করছে বিস্তীর্ণ তেপান্তর। পেছনে চোখের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া অসীম জলরাশি সন্ধ্যার মিঠে আলোয় থমথম করছে। চারিদিক থেকে অন্ধকারের চাদর গুটিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। ওরা কাদা মাড়িয়ে কিছুটা উঁচু এবং শুকনো ভূমিতে উঠে এলো। কারো মুখে কথা নেই। রাকিব স্বাভাবিক, কিন্তু খাদিজাকে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। সে বলল,
– আমি এইখানে একলা কেমনে থাকমু!
রাকিব অবাক হয়ে বলল,
– একলা কই? আমি আছি না?
– তুই আর কয়দিন থাকবি?
– শহরে গিয়ে আমার আর কাম কী? ভাবতিছি এইখানেই থাইকা যামু। ওইই…যে চরের মাইজখানে একটা ঘর করুম। সেই ঘরে তুই আর আমি…
– তুই আর আমি কী?
– থাকমু আরকি।
– ন্‌নাহ,আমার আলাদা ঘর৷
– আলাদা ক্যান? তর ডর লাগব না?
খাদিজা চুপ। এতক্ষণ বসে ছিল ওরা। প্রথমে রাকিব এরপর তার দেখাদেখি খাদিজাও ক্লান্ত দেহটা আলগোছে এলিয়ে দিল চরের ঈষদোত্তপ্ত বালুকাবেলায়। আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ হেসে উঠল। রূপালী থালার মতো মস্ত সেই চাঁদের জোছনা ঝরে ঝরে পড়তে লাগল এই বিরান ভূমিতে,ওই উর্মি-চঞ্চল উত্তাল পদ্মার বুকে। রাকিব বুকভরা সাহস সঞ্চয় করে ধীরে ধীরে খাদিজার হাত ধরল। খাদিজার নির্বাক,নিশ্চল। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মাথা কাত করে চেয়ে রইল শুধু। রাকিব বলল,
– খাদিজা! বিয়া করবি আমারে?
খাদিজা মুখ ফিরিয়ে নিল,
– আমি তো খুনি!
– ধুরু, যারে মারছস হেয় কি মানুষনেহি? জন্তুজানোয়ার মরলে এতো দু্ক্কু করার কিছু নাই। সারাডা পথ কী বুঝাইলাম তরে?
খাদিজা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ অন্যরকম সুরে বলল,
– ঠিক আছে। কিন্তু… সাক্ষী,কাজী এগুলা তো নাই।
– মাঝি নৌকা নিয়া আইলি পরে ওরে কমু। সে ব্যবস্থা কইরা দিবেনে।

পরেরদিন ভোরে ঘুম ভাঙতে খাদিজা নিজেকে রাকিবের বুকে আবিষ্কার করল। মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল,বিগত বিনিদ্র রজনীর সুখস্মৃতিগুলো। ঠোঁটের কোণে একটা প্রশান্তির হাসি খেলে গেল। মনের রুদ্ধ অলিতে-গলিতে বয়ে গেল হিমেল হাওয়া। পিটপিট করে চোখ মেলেই সে দেখতে পেল, রাকিব তখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আকাশে চড়েছে চনমনে রোদ। চোখের তারায় ভাসছে দিগন্তবিস্তৃত নির্জন বেলাভূমির শেষে সবুজ বনরেখা। সেখানে গাছের মাথায় মাথায় পাখপাখালির নিরবিচ্ছিন্ন কিচিরমিচির…। নিমেষেই খাদিজা ঠিক করে ফেলল,ওই ওখানেই হবে তাদের ঘর। রাকিব তার জমানো টাকা দিয়ে বড় একটা নৌকা কিনবে,জাল কিনবে। আর খাদিজার তার জমানো টাকা দিয়ে কিনবে একটা গাভী,কিছু হাঁসমুরগি। সপ্তাহান্তে একটা দিন ওরা হাটে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনবে। এভাবেই তাদের ক্ষণস্থায়ী একজীবন কেটে যাবে,সন্দেহ নেই। শহুরে কলুষিত যান্ত্রিক জীবনের থেকে এ নদীকেন্দ্রীক জীবন উৎকৃষ্ট হবে এতেও সন্দেহ নেই।
রাকিব জেগে গেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু স্বপ্নের ঘোর থেকে খাদিজা তখনো উত্থিত হতে পারেনি। রাকিবের সমস্ত চেতনাকে বিলুপ্ত করে দিয়ে সে মোহিনীর মতো চেয়ে আছে অদূর-ভবিষ্যতের পানে। আর রাকিব চেয়ে থাকে খাদিজার অমেয় মধুর স্বপ্নকাতর মুখের পানে।
মাঝি এসে যায় কখন। নৌকা চরে ভিড়িয়ে নোঙর করে নেমে এসে দাঁড়ায় ওদের কাছে। গলা খাঁকারি দেয়। ওরা চমকে উঠে বসে। খাদিজা অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি ওড়না টানে বুকে। রাকিব উঠে আড়মোড়া ভেঙে মাঝির উদ্দেশ্যে বলে,
– আইলানি মাঝি! তোমার কাম কিন্তু বাইরা গেছে। আমরা বিয়া করুম। সংসার বাঁধুম চরে। ছাওয়ালপাওয়ালে ভরায়া ফালামু গোটা চর। বুঝলানি?
রাকিবের বেহায়াপনায় খাদিজা লজ্জায় মরে যায়৷ মাঝি খাদিজা আর রাকিবের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকিয়ে আকর্ণ হেসে বন্ধুসুলভ গলায় বলে,
– এতো খুবি ভালা কথা। লন,ঘর বাঁন্ধার জিনিসপাতি লিয়া আহি৷ ভালা কামে দেরি করতে নাই।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here