নাইওরি,পর্ব ১০,১১

0
426

নাইওরি,পর্ব ১০,১১
মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১০

ছোটবেলা থেকেই জেসমিন কিছুটা আলসে। কোহিনূর বানু বকাবকি করে তাকে দিয়ে সব কাজই শিখিয়েছে কিন্তু নিয়মিত করাতে পারেনি। যখন থেকে ভাবিরা এসেছে তখন থেকে তো সে রান্নাঘরের মাটিও মাড়ায়নি। কোহিনূর বানু বলতেন, ঘোরা দেখে খোঁড়া হয়েছে মেয়ে! সেই মেয়েকে কিনা শ্বশুরবাড়ি এসে এখন মসলা বাটতে হচ্ছে! রাতে বাড়িতে কুটুম আসবে। তাই বাহারী রান্নার আয়োজন হচ্ছে। সকালের নাস্তার পরেই কতগুলো করে আদা, রসুন, জিরা, ধনিয়া, হলুদ ও মরিচ বাটতে দিয়েছে শাশুড়ি। জেসমিন যখন এসব বাটছে তখন রান্নাঘরে এলো রঞ্জু। জেসমিনের পাশে বসে বলল,
“তোমার কষ্ট হচ্ছে ফুল?”
জেসমিন হেসে বলল,
“সব কামেই কষ্ট আছে। তয় শাশুড়ি যখন কাম দিছে করতে তো হইবেই। মায় দিলে না কইরা পারা যায়।”
“ইশ আমি বুঝতে পারছি তোমার কষ্টটা! আমাদের বাড়িতে এসব করার কত লোক আছে। মা তোমাকে কেন দিল?”
“তোমাগো বাড়িতে কেউ নাই। হেরা পাশের বাড়িত্যা আহে কাম করতে। আইজ আইতে পারবেনা কেউ। এল্লিগা আমারে দিছে।”
“আমার পড়া শেষ হলে যখন চাকরি করব তখন তোমাকে ঢাকা নিয়ে যাব। তখন আর তোমার এত কষ্ট করা লাগবে না।”
“ঢাকা গেলে বুঝি এইসব করা লাগবে না? আরও বেশি করা লাগবে। সবই একলার করা লাগবে হেকালে।”
“যেসব রান্না করতে মসলা বাটা লাগে তার কোনোটাই আমরা খাব না।”
জেসমিম হেসে বলল,
“বাডা মসল্লা ছাড়া কোনো রান্নাই হয় না। এত কষ্ট বুঝলে বাইট্যা দাও।”
“আচ্ছা বেটেই দেই বরং। তুমি দরজায় পাহাড়া দাও। মা যদি দেখে তোমাকে মসলা বেটে দিচ্ছি, তুফান নামাবে।”
জেসমিন ফিক করে হেসে বলল,
“মায় এহন আইবেনা। তবু পাহাড়া দেই। নাইলে যদি দেইখ্যা হালায় আমারে দজ্জাল বউ কইবে।”
রঞ্জু হেসে দিল। জেসমিন আবার বলল,
“মরিচ বাডা লাগবে না। হাত জ্বলবে। আমি পরে বাডমু। তুমি অন্যগুলান বাডো যেদ্দুর পারো।”
“তোমার হাত জ্বলবেনা?”
“আমি তো আগেও বাডছি। টেকনিক জানি ক্যামনে হাত না লাগাইয়া বাডতে অয়। আর জ্বললেও সহ্য করতে পারমু। তুমি পারবা না।”
জেসমিম উঠে গেল। পাশে বসে দরজায় পাহাড়া দিল। রঞ্জু সত্যিই সত্যিই মসলা বাটতে শুরু করে দিল।

জেসমিন রঞ্জুর বিয়ের পর তিন চার মাস সময় নিলেন হারুন ব্যাপারী। ততদিনে রঞ্জুর ইউনিভার্সিটি খুলে গেছে। সে ঢাকা যাবে, যাওয়ার আগে জেসমিন তার বাপের বাড়িতে নাইওর যাবে। রঞ্জুই দিয়ে আসতে চেয়েছিল যাতে রঞ্জু চলে গেলে তার একা না লাগে। কিন্তু জেসমিন কেঁদেকেটে একাকার করলো। সে জানালো রঞ্জু যতক্ষণ আছে, সে ততক্ষণ কোথাও যাবে না। রঞ্জু ঢাকা যাওয়ার পর সে শ্বশুরের সাথে বাপেরবাড়ি যাবে।
রঞ্জু চলে যাওয়ার পর হারুন ব্যাপারী জেসমিনকে নিয়ে কেশবপুর গেলেন। জেসমিনকে দেখামাত্র তার ভাবিরা খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো, আমাগো নাইওরী আইছে!

হারুন ব্যাপারীর আতিথেয়তার জন্য বিরাট আয়োজন করা হলো। খাওয়াদাওয়ার পর তারা যখন বাহির বারান্দায় পান নিয়ে বসলনে তখন হারুন ব্যাপারী কথাটা তুললেন,
“চেয়ারম্যান সাহেব কালিসুরির জমিটার কী করবেন? কতগুলা নগদ টাকা দিয়া জমি কিনেছিলাম! আপনি বিচক্ষণ মানুষ, এখন আবার পরম আত্মীয়। আশা করি আপনি ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন।”
মুহূর্তের মধ্যেই টনক নড়ল জয়নাল মির্জার। এবার সে বুঝতে পারলো সে যে চিন্তা করে জেসমিন রঞ্জুর বিয়েতে খুশি হয়েছিলেন ঠিক একই চিন্তা করে হারুন ব্যাপারীও বিয়ের প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে সে হারুন ব্যাপারীর ফাঁদে পড়েছেন। ইচ্ছে করেই কি সে জেসমিনের পেছনে তার ছেলেকে লেলিয়ে দিয়েছিল? জয়নাল মির্জার মেজাজ তখন সপ্তম আসমানে। সে বলল,
“ব্যাপারী কি এই কারণেই ছেলে বিয়া করাইয়া আত্মীয়তা করছেন?”
হারুন ব্যাপারী হেসে বললেন,
“কী যে বলেন চেয়ারম্যান সাহেব! ছেলে-মেয়ের ভালোবাসার মর্জাদা দেয়ার জন্যই তো এই বিয়ে। ছেলেমেয়ের ভালোবাসা আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যার সাথে জড়ানোর কথা চিন্তাও করতে পারিনা।”
“চিন্তা কইরেনও না। ভুলেও না। ছেলে-মেয়েরে আমরা তাদের জায়গায় রাখি আর নিজেগো নিজের জায়গায়। এতেই তারা এবং আমরা ভালো থাকমু। এইসব জমিজিরাতের ভেজালে তাগোরে আইন্যা তাগোর বিপদ ডাকনের দরকার কী?”
চেয়ারম্যানের সুক্ষ্ম হুমকি সাথে করে বাড়ি ফিরলেন হারুন ব্যাপারী। তিনি আজ এটা বুঝে গেলেন যে, জেসমিন রঞ্জুর বিয়ে তার একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি যেই চিন্তা করে এই বিয়ে দিয়েছিলেন সেটা সম্ভব নয়।

চলবে…

নাইওরি
মৌরি মরিয়ম

পর্ব ১১

পটুয়াখালী জজ কোর্টের জাঁদরেল উকিল আলমগীর মৃধা। জনশ্রুতি আছে ফাঁসির আসামিকেও নির্দোষ প্রমাণ করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরত নিয়ে এসেছেন তিনি। হারুন ব্যাপারী তার শরণাপন্ন হয়ে মামলা করেছেন জয়নাল মির্জার নামে। তিনি তার জমি পুনরুদ্ধারের জন্য আর্জি দাখিলের পর জয়নাল মির্জার নামে একটি সমন জারি হলো।
সমনপত্র গ্রহন করে কাচারি ঘরে বসে আছেন জয়নাল মির্জা। জালাল বাড়ি নেই। জব্বার আছে সাথে। সে বলল,
“দেখলেন তো আব্বা। আমি কইছিলাম হারুন ব্যাপারীর মতলব ভালো না। আমি হেরে উকিলের কাছে যাইতে দেখছি হেই কতাখানও কইছিলাম। আমনে তো আমার কতা আমলেই লন নাই।”
“কিন্তু জব্বার তুমি হেরে উকিলের কাছে যাইতে দ্যাখছো আরও ৪/৫ মাস আগে। হেকালে মামলা না কইরা এহন করলো ক্যা কও দেহি?”
“হেইয়া আমি ক্যামনে কমু?”
“এই ঘিলু লইয়া রাজনীতি করবা?”
জব্বার মুখ কুচকে ফেলল। পান থেকে চুন খসলেই বাবা তাকে এই খোটাখানা দেয়। যা তার একেবারেই অপছন্দ। জয়নাল মির্জা পানের পিক ফেলে বললেন,
“হারুন ব্যাপারী তহন মামলা করনের লাইগা যায় নাই। হে গেছে তথ্য জোগাড় করতে। মামলা করার প্রস্তুতি নিতেছিল। মাঝখান দিয়া রঞ্জু জেসমিনের ঘটনা আসায় সে ভাবছিল আত্মীয়তা কইরা ঝামেলা মিটাইবে। এইজন্যে এতদিন থাইমা আছিল। কিন্তু এহন যহন দ্যাখলো আত্মীয়তা কামে লাগান যাইতেয়াছেনা, অমনে যাইয়া মামলা দিল।”
“আব্বা আমনে কি আগেইত্যাই জানতেন হে মামলা দেবে?”
“জানতাম। কইতে পারো আমি অপেক্ষাই করতেয়াছিলাম। কারণ সে মামলা না দিলে আমি আমার চাল ডা দিতে পারতেয়াছিলাম না।”
“তহেলে জেসমিনরে ওইবাড়ি বিয়া দেলেন ক্যা?”
“ভাবছিলাম আত্মীয়তা কইরা ঝামেলা মিটামু, ব্যাপারীও যে একই চিন্তা করছে হেইয়া তো আমি বোজতে পারিনাই।”
“আব্বা অরা যদি জেসমিনরে অত্যাচার করে?”
“মাইয়া আমার ধানি মরিচ। অরে কেউ অত্যাচার করতে পারবে না। রঞ্জু জেসমিন আশা করি নিজেগো সামলাইয়া লইতে পারবে। রঞ্জুর মত জামাই লাখে একটা, আশেপাশের চাইর গেরামেও এমন শিক্ষিত পোলা নাই এই কথা সত্য। হেরপরেও সমেস্যা অইলে বিবাহ ভাঙতে কতক্ষণ? জেসমিনরে শহরে নিয়া আরও ভালো আরও শিক্ষিত পোলার লগে বিবাহ দিমু। এই বয়সী পোলাপানের প্রেম ভাঙা মুশকিল, আবেগ বেশি। কিন্তু বিবাহ হইলেই আবেগটা কইম্যা যায়। বিবাহ ভাঙা কোনো বিষয় না। চুলদাড়ি তো বাতাসে পাকে নাই বাজান।”

আলমগীর মৃধার চেম্বারে বসে আছেন জয়নাল মির্জা। তিনি গোপনীয়তা চান। চেম্বারের সকলকে বের করে দিলেন আলমগীর মৃধা। জয়নাল মির্জা বললেন,
“হারুন ব্যাপারী কত দিছে? আমি তার চেয়ে বেশি দিমু। মামলায় আমারে জিতাইয়া দিবেন।”
আলমগীর মৃধা হেসে বললেন,
“হারুন ব্যাপারী কত দিছে জাইন্যা আমনে কী করবেন? আমনে ৫ হাজার দেবেন। আমি কেস এমনভাবে সাজামু যাতে আমি হারি, আমনের উকিল জেতে। ব্যাপারডা বোজ্জেন?”
টাকার অংক শুনে জয়নাল মির্জার মেজাজ বিগড়ে গেছে। বিরক্তমুখে সে বলল,
“উকিলসাব আমনের কি মাতা আউলাইয়া গ্যাছে? ৫ হাজার টাহা কি ভাইস্যা আহে?”
“টাহা ক্যামনে আইবে হেইডা আমনের বিষয়। না দেতারলে বাড়ি যান। এ কেস আমনে এমনেও হারবেন। সমন পাইয়াও কোর্টে আহেন না। ওদিকে বাদীপক্ষ নিয়মিত কোর্টে আহে। তথ্য প্রমাণ সব আমনের বিপক্ষে নেওয়া আমার দুই মিনিটের কাম। আমনের দারে যে একখান জাল দলিল আছে হেইয়া কোর্টে পেশ করলে আমনের উল্টা জেল হবে। আমনের বাঁচার একমাত্র উপায় আমার ইচ্ছাকৃত হারা। কেস হারলে হেইডা আমার রেপুটেশনের ব্যাপার। ৫ হাজার না হইলে পোষায় না। ”
জয়নাল মির্জা আর কথা বাড়ালো না। এই সামান্য কাজে ৫ হাজার টাকা খরচ করার কোনো মানেই হয় না। এরচেয়ে সহজ সমাধান তার জানা আছে।

রঞ্জু ক্লাস করে হলে ফিরতেই জেসমিনের চিঠি পেল। রুম পর্যন্ত যাওয়ার ধৈর্য নেই। হলের সামনেই মাঠে বসে চিঠি খুলল।

প্রিয় রঞ্জুসাহেব,
কেমন আছো? আশা করি আল্লাহর রহমতে তুমি ভালো আছো। আমিও ভালো আছি।
পর সমাচার এই যে, আমি এখনো আমাদের বাড়িতেই আছি। বাবা বলতেছেন, তোমাদের বাড়িতে একা গিয়ে কী করব, তুমি আসলে যেন যাই। মাঝে আমার আব্বাকে না জানিয়ে একদিন তোমাদের বাড়ি গেছিলাম। বাবা মায়ের সাথে দেখা করে আসছি। আমি যাওয়াতে তারা খুব খুশি হইছিলেন। কামিনী ফুলের গাছটার কাছেও গেছিলাম। ওই গাছে এখন আর ফুল ফুটে না। আমি জিগাইলাম, কী গো কামিনী ফুল দেও না ক্যা? কামিনী কইলো, তোমরা নাই তাই ফুল দেইনা। তোমরা আসো, ভালোবাসায় ভরায়া রাখো এই ঘরখান। তোমাদের ভালোবাসার সুবাস আবার যখন পাব তখনই ফুল দিব।
এক মাস হইয়া গেল তোমারে দেখি না। আর কতদিন না দেখে থাকতে হবে? তুমি কবে ফিরবা? তোমার ওই পাষাণ মন কি কাঁদে না তোমার ফুলের জন্য? পড়াশোনা বাদ দিয়া চইলা আসো। নাইলে আমারে ঢাকা নিয়া যাও। তোমারে ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারমু না আর। বাড়ি আসো। বাড়ি আসো। বাড়ি আসো। বাড়ি আসো। বাড়ি আসো। আমার নাইওর আর শেষ হয় না।
ইতি তোমার ফুল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here