নাইওরি,পর্ব ২,৩

0
364

নাইওরি,পর্ব ২,৩
মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২

আষাঢ় মাস। ভরা বর্ষায় টলমল জলে ভরে উঠেছে পুকুর। ঝরে পড়া অজস্র সোনালু ফুল পুকুরের জলে ভাসছে। জেসমিন সেই পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটলায় বসে ভাতিজা, ভাইঝিদের সাথে নিয়ে আধাপাকা আমের ভর্তা বানাচ্ছে। ভর্তা আবার দুই পদে বানানো হচ্ছে। বাচ্চাদের জন্য ঝাল ছাড়া, বড়দের জন্য ঝাল দিয়ে।
আউশ ধান উঠেছে। মির্জা বাড়ির বউরা সকাল থেকে বড় বড় পাতিলে সেই ধান সেদ্ধ করছে। চুলার পাশে বড় হোগলা বিছানো। পাতিলের ধান প্রথমে সেই হোগলায় ঢেলে ফেলা হয়। বাড়তি পানিটুকু ঝড়ে গেলে সেই ধান ডালা ভরে নিয়ে উঠানে অন্য শুকনো হোগলার উপর ঢালা হয়। আমন ধানের সময় অবশ্য সরাসরি উঠানেই ধান শুকানো হয়। প্রথমে উঠানটা গোবর দিয়ে লেপে নেয়া হয়, এতে মাটি শক্ত হয়, ধান উঠানোর সময় আলগা মাটি উঠে আসেনা। কিন্তু আউশ ধানের সময় হুটহাট বৃষ্টি নেমে পড়ে বলে হোগলার উপর শুকানো হয় যাতে বৃষ্টি নামলে দ্রুত তুলে ফেলা যায়। কোহিনূর বানু বড় বউ আসমাকে নিয়ে ধান সেদ্ধ করছেন। আসমা ভূতের মত কাজ করতে পারে। জনশ্রুতি আছে, কেশবপুরের এতবড় পালের দিঘি নাকি এক রাতে কেটেছিল ভূতেরা। সেই দিঘি কাটার গল্প একেকজনের মুখে একেক রকম। আসমা তেমনি এক দিনে মনকে মন ধান সেদ্ধ করে ফেলতে পারে। আসমা সাথে থাকলে তার তেমন বিশেষ কোনো কষ্ট হয় না।
একজন কাজের মহিলা ডালা ভরে ধান উঠানে নিচ্ছে। ছোট বউ মিনু আরেকজন কাজের মহিলাকে নিয়ে সেই ধান আউলে দিচ্ছে। ইদানীং মিনুকে বেশি কষ্টের কাজ তিনি দিচ্ছেন না। কারণ তার ধারণা মিনু পোয়াতী হয়েছে। কিন্তু বান্দর মেয়েছেলে এত গুরুত্বপূর্ণ কথা তার কাছে কেন এখনো গোপন রেখেছে বুঝতে পারছে না!
যে পরিমাণ ধান সেদ্ধ করতে হবে তাতে এই ক’জন হিমশিম খাচ্ছে। আরও লোক দরকার কিন্তু আর কাউকে এই মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছেনা। এমতাবস্থায় জেসমিনের বাচ্চাদের সাথে বসে আম ভর্তা বানানোটা গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

কোহিনূর বানু এই গেরস্ত বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন ৯ বছর বয়সে। তখনও সাবালক হননি। তার শাশুড়ি করিমন বিবির ছিল মাথার ব্যামো। এই ব্যামো শুধুশুধু হয়নি। এর পেছনে আছে বিরাট ইতিহাস। করিমন বিবি প্রায়ই স্বপ্নে দেখতেন, সাতটি মটকা ভরা কাচা টাকা। ঢাকনাগুলো ওঠে নামে। ভেতরে টাকা দেখা যায়। একটা গায়েবি আওয়াজ বলে, “এই সব টাকা তোর।”
করিমন বিবি যক্ষের ধনের কথা শুনেছেন তবে তার সাথে এমন কিছু হবে বিশ্বাস করতে পারতেন না।
এরপর একদিন সেই গায়েবি আওয়াজ তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। তাকে বলল, “ওঠ করিমন, দেখ তোর উগুইরতলার (চাল ডালের মটকা মাটিতে রাখলে নষ্ট হয়ে যায়, সেসব রাখার জন্য কাঠের তৈরি উঁচু তাকের মত জিনিস) নিচে সাতটা মটকা ভরা টাকা। সব তোর। আওলা মাটি(পুকুরে পানির নিচের ভেজা মাটি) দিয়ে ঘরবাড়ি সারাবাড়ি লেপে গোসল করে আসবি। তারপর পানিতে একফোঁটা গোবর দিয়ে তাতে মটকা থেকে কিছু কাচা টাকা নিয়ে জ্বাল দিলেই সব টাকা তোর হয়ে যাবে। কেউ দেখার আগে সব কাজ শেষ করবি।”
করিমন বিবি বিছানা থেকে নেমে উগুইরতলায় মটকাগুলো দেখতে পেলেন। ঢাকনা তুলে দেখলেন সবগুলো মটকা ভরা কাচা টাকা। সে দ্রুত পুকুর থেকে আওলা মাটি তুলে ঘর লেপেপুছে পরিস্কার করলেন। এরপর গোসল করে এসে চুলা ধরালেন। এসবই দূর থেকে লক্ষ্য করলেন তার বড় জা জমিলা বিবি। তার বড় সন্দেহ হয়। এতরাতে করিমন কেন ঘর লেপে! সে বিষয়টা বোঝার জন্য এগিয়ে যায়। করিমন একটা হাড়িতে পানি ও একফোঁটা গোবর দিয়ে চুলায় বসালেন। ঘরে আসবেন টাকা নিতে তার আগেই জমিলা বিবি নাপাক শরীরে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
“তোমাগো আগুন তাওয়াডা কই গো করিমন?”
আগেকার দিনে আগুন বড় সহজলভ্য ছিল না। সারারাত মাটির পাত্রে তুষের ভেতর জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে এক বিশেষ পদ্ধতিতে আগুন সংরক্ষণ করা হত। সেই পাত্রের নাম ছিল আগুন তাওয়া। সেই আগুন তাওয়ার ছুঁতোয় যেইনা জমিলা বিবির নাপাক শরীরে ঘরে পা দিল অমনি টাকা ভরা সাতটা মটকা গড়গড়িয়ে নেমে গেল পানিতে। এরপর উধাও। সেই থেকেই যক্ষের ধনের শোকে করিমন বিবি পাগল। প্রবাদ আছে, যারে ধরে যক্ষা, তার নাই রক্ষা। করিমন বিবিরও রক্ষা হয় নি। তিনি এমন বদ্ধ পাগল ছিলেন যে তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। গেরস্ত বাড়ির সকল কাজের সাথে পাগল শাশুড়ির সেবা, সবই কোহিনূর বানুকে বড় জায়ের সাথে ভাগে করতে হতো সেই ৯ বছর বয়স থেকে। জেসমিনটা যেরকম কামচোর হয়েছে যদি এরকম কোনো বাড়ি গিয়ে পড়ে কীভাবে সামলাবে কে জানে!
কোহিনূর বানু রান্নাঘর থেকেই হাঁক ছাড়লেন, “ও লো নবাবের বেডি, আর কত গায়ে বাতাস লাগাইয়া চলবি? আসমার লগে একটু ধানের পাতিলডা ধরলেও তো পারোস।”
জেসমিন পুকুরপাড় থেকেই বলল, “অতবড় পাতিল আমি জাগাইতে পারি?”
“পারবি না ক্যা? ভাত খাও না তুই? পরের বাড়ি যাইয়া কেমনে করবি?”
“যহন পরের বাড়ি যামু তখন ঠিকই পারমু। দুই চক্কু দিয়া তো দেখতেইয়াছি কোন কাম ক্যামনে করে।”
কোহিনূর বানু বললেন, “এত বড় বড় বয়ান না দিয়া মিনুর লগে ধান আউলা গিয়া। পাতিল জাগাইতে পারবি না বুঝলাম। ধান আউলাইতে তো পারবি। হেইডা কইরা আমারে উদ্ধার করো।”
“না, ধানও আউলাইতে পারমু না। বাপের বাড়ি বইয়াও কাম করমু, পরের বাড়ি যাইয়াও কাম করমু। সারাজনম কি কাম কইরা কাটামু? ও ছোট ভাবি, তুমি কও দেহি বাপের বাড়ি থাকতে কি তুমি কোনো কাম করতা?”
মিনু হাসলো শুধু, কিছু বলল না। কোহিনূর বানু জানতেন এ মেয়ের সাথে কথা বলে লাভ নেই। তবুও বলার কাজ বললেন। বউরা বলতে তো পারবে না যে তিনি মেয়েকে কাজ করতে না বলে শুধু বউদের দিয়েই কাজ করান!

আমভর্তা বানানো শেষ হলে কলাপাতায় করে সেই ভর্তা বাড়ির সকলের কাছে পৌঁছানো হলো। সবাইকে দিয়ে তারপর জেসমিন খাওয়া শুরু করলো। আম কুচি কুচি করে কেটে তাতে লবন, মরিচ পোড়া, সরিষাবাটা আর লেবুপাতা দিয়ে মেখেছে। এ যেন অমৃত!
বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। আশেপাশে সবাই সব কাজ ফেলে ধান তুলতে দৌড়ে এলো শুধুমাত্র জেসমিন ছাড়া। বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল রঞ্জু ও তার বন্ধু মানিক। এ বাড়ির ধান ভিজে যাচ্ছে বলে তারা দৌড়ে এসে ধানের হোগলা তুলতে লাগলো।
এবার কোহিনূর বানু রীতিমতো রেগে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, “নবাবের বেডি তোর ঠ্যাং যদি আমি আইজ না ভাঙছি! বিষ্টি নাইম্যা গেল। অন্য বাড়ির পোলারা আইয়া ধান উডায় তাও তুই ধরোনা? তোরে পয়দা করছিলাম ক্যা আমি?”
সর্বনাশ! অন্য বাড়ির ছেলেরা আবার কেন আসলো! তোরা পথ দিয়ে যাচ্ছিলি যা না বাবা। অযথা ঘরে আগুন লাগাতে কেন এলি? এসব ভাবতে ভাবতেই জেসমিন গিয়ে ধানের হোগলা ধরলো। রঞ্জু ধান ঘরে তুলতে তুলতে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল, স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো পরী তার হোগলার উল্টোপাশের দিকটা ধরলো। একটা ছাপাশাড়ি প্যাঁচ দিয়ে পরা। লম্বা চুলগুলো লাল ফিতেয় কলাবেনী করা। গায়ের রঙ দুধে আলতা, গালের রগগুলো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটে চোরা হাসি। পরী তার দিকে তাকালো না।

কেশবপুর গ্রাম থেকে বের হতে না হতেই ঝুমবৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। কাচা রাস্তা কাদামাটিতে মাখামাখি হয়ে আছে। হাঁটতে গিয়ে পা গেঁথে যাচ্ছে।
মানিক বলল, “ভুল অইয়া গেল রে ব্যাডা।”
রঞ্জু তখনো একটা ঘোরের মধ্যে। পরিটাকে সে কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না। ঘোরের মধ্যেই সে মানিকের কাছে জানতে চাইল, “কী ভুল?”
“বৃষ্টি থামা পর্যন্ত চেয়ারম্যানবাড়ি থাকা উচিত আছিল।”
রঞ্জু এবার আচমকা বলল, “ঠিক বলছিস। আরও কিছুক্ষণ থাকা উচিত ছিল। পরিটারে আরও দেখতে পারতাম তাহলে।”
“এ রঞ্জু তোর কী অইছে? পরি কই পাইলি? হাবিজাবি কী কস?”
“যে মেয়েটা আমার সাথে ধানের হোগলা ধরল তার কথা বলি। পরির মত সুন্দর। কালকে আবার আসব ওকে দেখতে।”
মানিক এবার আঁৎকে উঠলো, “সর্বনাশ। এইসব চিন্তা একদম বাদ দিয়া দে। জেসমিন কার মাইয়া জানোস?”
“বাহ ওর নাম জেসমিন! কামিনী ফুল!”
“রঞ্জু জেসমিন চেয়ারম্যানের মাইয়া। জানতে পারলে খুন করব তোরে।”
“রাখে আল্লাহ মারে কে?”
এ কথা বলে হেসে ফেলল রঞ্জু।

চলবে…

নাইওরি
মৌরি মরিয়ম

পর্ব ৩

হুক্কা সাজানো হচ্ছে। কাজটি করছে কুদ্দুস। সে মির্জা বাড়ির কামলা। বয়স ত্রিশের ঘরে। সব রকম কাজই সে করে। তবে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার প্রধান কাজ হচ্ছে চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য হুক্কা সাজানো। কিছুক্ষণ আগেই হুক্কার পানি বদল করে এনেছে সে। খেজুরের রস নষ্ট হয়ে গেলে সেই রস পুড়িয়ে চিটা গুড় বানানো হয়। এই গুড় হুক্কার তামাক মাখার কাজে ব্যবহৃত হয়। তামাক পাতা কুচি করে কেটে চিটা গুড় দিয়ে বিশেষ কায়দায় মাখাতে হয়। এই কাজটায় খুব দক্ষ কুদ্দুস। অন্যকারো হুক্কা সাজানো পছন্দ হয় না চেয়ারম্যান সাহেবের। তামাক পাতা মাখানো হয়ে গেলে তা হুক্কার কলকিতে দিল কুদ্দুস। তার উপরে জলন্ত কয়লা। অমনি হুক্কা প্রস্তুত। চেয়ারম্যান সাহেবের হাতে হুক্কার নল ধরিয়ে দিয়ে কাচারিঘর থেকে বের হয়ে গেল সে। কাচারিঘরে চেয়ারম্যান সাহেব ছেলেদের নিয়ে বসলে সেখানে অন্য কারো থাকার নিয়ম নেই।
জালাল জব্বার দুই ভাই জয়নাল মির্জার সামনে বসে আছে। তিনি হুক্কায় টান দিয়ে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কও কী তোমাগো জরুরি কথা?”
“আব্বা হারুন ব্যাপারীর ভাবসাব ভালো না।”
“ব্যাপারীরে লইয়া এত ঘামাইস না জব্বার। তোরে আগেও মানা করছি।”
জালাল বলল, “জব্বারের মাথাডা গেছে আব্বা। অরে আমি কইসি যে বিষয়টা আব্বা আমাগো চেয়ে ভালো বোঝে।”
জব্বার বলল, “আব্বা আমার কথাখান শোনেন। আইজ একখান খারাপ খবর আছে।”
“কী খবর?”
“কালিশুরির জমির দলিল লইয়া হারুন ব্যাপারী টাউনের এক উকিলের কাছে গেছিল।”
“যাউক। তার কি টাউনে যাওনের আগে তোমার অনুমতি নেওয়া লাগবে?”
“আব্বা আমনে ব্যাপারডা একটু আমলে লন। হারুন ব্যাপারী আগেও ওই উকিলের কাছে গেছে। শেষে না আবার জমিখান হাতছাড়া হয়। কতবড় জমি!”
“জব্বার তুমি এইসব ছোডোখাডো বিষয় লইয়া আমারে বিরক্ত করবা না। জালাল তোমার ছোট ভাইরে বুঝাও। এইসব ছোডোখাডো বিষয়ে এত মাথা ঘামাইলে ভবিষ্যতে রাজনীতি কেমনে করবা তোমরা?”
এ কথার পর জব্বারের আর কিছু বলার সাহস হলো না। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তার দুশ্চিন্তা কাটলো না।

সত্যি সত্যি প্রতিদিন রঞ্জু জেসমিনদের বাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করে। ঘুরে ঘুরে সে জেসমিনদের পুরো বাড়িটাই মুখস্ত করে ফেলল। জেসমিনের ঘর কোনদিকে তাও আবিস্কার করল। কোনো কোনোদিন জেসমিনকে না দেখেই ফিরে যেতে হয় তাকে। তবে সে এটা ঠাহর করতে পেরেছে যে প্রতিদিন বিকেলে জেসমিন তাদের বাড়ির দক্ষিনের ভিটায় প্রতিবেশী ছেলেপুলে ও ভাতিজা ভাতিজিদের সাথে খেলতে যায়। নানান রকম খেলা খেলে তারা। কখনো বৌছি, কখনো সাতচারা, কখনোবা আবার গোল্লাছুট। পাশেই খাল, মাছ ধরার ছুঁতোয় খালে বরশি পেতে বসে থাকে রঞ্জু। চোরা চোখে দেখে জেসমিনকে। ভেবে অবাক হয় সে! এত রূপ কী করে আল্লাহ একটি মানুষের মধ্যে দিল? যাকে একবার দেখে চোখ ফেরানো যায় না। বারবার দেখতে ইচ্ছা করে।
কিছুদিন যাওয়ার পর মাঝে একদিন রঞ্জু দেখে জেসমিন খেলছে না। চুপচাপ বসে আছে। সেদিন সে উপলব্ধি করলো শুধু জেসমিনের সৌন্দর্যেই মুগ্ধ না, সে জেসমিনের উচ্ছলতায়ও মুগ্ধ।

জেসমিন সন্ধ্যার আগে আগে খেলা শেষ করে হাত-পা ধুয়ে ঘরে ঢুকলো। কোহিনূর বানু ছরতা দিয়ে সুপারি কাটছিলেন।
জেসমিনকে দেখেই বললেন, “এত ডালে ডালে ঘুরোস ক্যা লো ছেড়ি? ডাকতে ডাকতে মইরা গেলেও তোরে পাওন যায় না।”
জেসমিন খুব অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “ডালে ডালে কই ঘুরলাম মা? দক্ষিনের ভিডায় খেলছি। হেই ভিডা তো আমাগোই। তার মানে বাড়ির বাইরে যাই নাই। কোনো দরকার থাকলে তুমি কাউরে খবর দিয়া পাডাইতা।”
“এ দামড়া ছেড়ি খেলার কথা কইতে শরম করেনা? খেলার বয়স আছে তোর?”
“আছে দেইক্কাই তো খেলি। কী এমন বয়স অইছে আমার?”
“তোর বয়সে পোলা পয়দা কইরা মা অইসি আমি।”
“আমার তো আর বিয়া হয়নাই। কেমনে পোলা পয়দা করমু?”
কোহিনূর বানু এবার ভীষণ রেগে গেলেন। বললেন, “তোর বাপে আহুক খাঁড়া। বিয়া দিয়া এই আপদ যদি বিদায় না করছি! তোর মত মাইয়া সামলাইন্যা আমার কাম না।”
“কওগা যাইয়া।”
জেসমিন মুখ ঝামটা দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। সন্ধ্যা হতেই পোকামাকড় ঢুকবে তাই সবার আগে জানালা লাগিয়ে দিল। পরনের শাড়িটায় কাদা লেগেছে, ঝটপট শাড়িটা পালটে ফেলল। তারপর হেরিকেন জ্বালালো, ঘরের ভেতর তেমন আলো ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল সে। পা নাচাতে নাচাতে চুলের বেনী খুলছিল, ঠিক তখনই টেবিলের উপর বইখাতার ভেতর একটা খাম দেখতে পেল। এই খামটা তো এখানে ছিল না। এটা কোত্থেকে এলো? জেসমিন খামটা খুলে দেখে ভেতরে একটা ভাঁজ করা কাগজ আর কিছু কামিনী ফুল। সে কাগজটা তুলে ভাঁজ খুললো। ভেতরে লেখা…

কোথাও কি এমন কলি হয়?
যে কলিতে ফুটলে ফুল
শুকাবে না তার পাঁপড়িগুলো
ঘ্রাণ রবে অক্ষয়?

প্রিয় জেসমিন,
এমন ঘ্রাণফুলের সাধ জেগেছে তোমাকে দেখার পর।
সাথে জাগলো মনে, এইতো প্রথম কিছু হারানোর ভয়।
ইতি রঞ্জু।

চিঠিটা কে দিল না জানা পর্যন্ত কোথাও কোনো শান্তি নেই জেসমিনের। হ্যাঁ চিঠির শেষে নাম লেখা আছে বটে, রঞ্জু। কিন্তু রঞ্জুটা কে? সে তো রঞ্জু বলে কাউকে চেনে না! পুরো কেশবপুরে কোনো রঞ্জু আছে বলেও শোনে নি কখনো। জেসমিনের মাথা ভালো। চিঠির মর্মার্থ বুঝতে তার কোনো সমস্যা হয়নি। বরং খুব ভালোভাবে বুঝেছে। এজন্য আরও বেশি অস্থির লাগছে। এমন আকুতি নিয়ে কে লিখলো তাকে?
খামের ভেতরের কামিনী ফুলের ঘ্রাণ নিলো সে। কামিনী ফুলের ইংরেজি নাম অরেঞ্জ জেসমিন। স্কুলের ইংরেজি স্যার বলেছিলেন, মনে আছে তার। সেটা জেনেই কি অচেনা মানুষটা তাকে কামিনী ফুল দিয়েছে? নাকি কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে?
জেসমিন এই নিয়ে চিঠিটা ২৯ বার পড়েছে। হাতের লেখাটাও মন কাড়া! আরও একবার পড়ে ৩০ পূরণ করলো। এরপর ভাঁজ করে বালিশের তলায় রেখে দিল।
জেসমিন খোলা চুলগুলো আঁচড়ে আবার বেঁধে নিল। তারপর পড়তে বসলো। কিন্তু কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারলো না। পত্রদাতা মনের ভেতর ঢুকে খুব বিরক্ত করছে! মানুষটা যে চিঠিটা টেবিলের উপর রেখে গেছে এতেই বোঝা যাচ্ছে জানালা দিয়ে রেখেছে। এত বোকামি কেউ করে? চিঠিটা যদি অন্যকারো হাতে পড়তো? এমন অনেক প্রশ্ন মনের ভেতর ঘুরছে।
পরদিন জেসমিন সারাদিন কোথাও বের হলো না। নিজেকে ঘরবন্দী করে অপেক্ষায় রইলো। মানুষটা যদি চিঠি দিতে আবার আসে, অমনি তাকে ধরে ফেলবে! আচ্ছা সে এভাবে কেন চিঠি দিচ্ছে? জেসমিনের উত্তর দেয়ার তো কোনো সুযোগ নেই। একতরফাভাবে চিঠি দিয়ে কী লাভ?
আচ্ছা মানুষটার বয়স কেমন হবে? দেখতে কেমন সে? তাকে দেখে যদি জেসমিনের ভালো না লাগে? ভালো না লাগলে এই সুন্দর হাতের লেখার সুন্দর চিঠিটার জন্য তার ভীষণ মন খারাপ হবে!

সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেল। চিঠি দিতে কেউ এলো না। জেসমিন আশা ছেড়ে দিল। ভাবলো বুঝি কেউ দুষ্টুমি করে চিঠিটা দিয়েছিল। অথচ সে বোকার মত সব বিশ্বাস করেছে!
তারপর এক বিকেলে জেসমিন আবার খেলতে গেল। অবাক কান্ড হচ্ছে তাদের খেলায় যাকে দুধভাত বানানো হয় সেই মতি খেলা শেষে ফেরার সময় একটা খাম দিল। খামটা দেখে ঘটনা বুঝতে বাকি রইলো না জেসমিনের।
সে খামটা হাতে নিয়ে জানতে চাইলো, “খামডা কেডা দিছে মতি?
মতি ঘার নেড়ে জবাব দিল, “চিনি না।”
জেসমিন ধমক দিয়ে বলল, “না চিনলে আনছোস ক্যা?”
মতি ঠোঁট উলটে বলল, “কইলো যে অনেক জরুলি কাম।”
“যে দিছে হে কি ব্যাডা না ছ্যামড়া?”
“ছ্যামড়া।”
“ধলা না কালা?”
“ধলা।”
“লম্বা না বাট্টু?”
“কইতারিনা।”
জেসমিন বিরক্ত মুখে বলল, “আচ্ছা যা তুই এহন।”
শাড়ির প্যাঁচের ভেতর খামটি লুকিয়ে বাড়ি ফিরলো সে। ইচ্ছে করেই খামটি খুললো না তখন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পর দরজায় খিল দিয়ে হারিকেনের আলো বাড়িয়ে খামটা খুললো। যথারীতি ভেতরে কামিনী ফুল এবং একটি চিঠি। আজকের চিঠি বেশ বড়। জেসমিন পড়া শুরু করলো,

আমার এলোমেলো মনের কারণ খুঁজতে গিয়ে
অহর্নিশি ভাবি তোমায়
নিত্য সন্ধ্যার শীতল কোমল আঁধার
স্পর্শ করে যায় আমায়
নিশুতি রাতের বুকে গলানো আকাশ ঝরে
চেয়ে থাকি অসীম এক প্রত্যাশায়
কখনো দেখি ঝড়ের আকাশে উড়ন্ত কোনো বিহঙ্গ
ডানা ঝাপটায় অচেনা কোনো সুখে,
মেঘের পরে মেঘ ছুটে যায় বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে
আমিও ছুটে যাই দুই ক্রোশ দূরে
দেখব বলে তোমায় বৃষ্টিস্নাত মুখে।
অথচ জানালায় দেখি বসে আছো একাকী অন্ধকার ঘরে
তখন আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে হয়
প্রেয়সী, তুমি কি মেঘ ভয়ে আছো ভীত?

প্রিয় জেসমিন,
গত সাত দিন তুমি ঘর থেকে বের হও নাই। জানিনা কেন সারাটা দিন জানালার কাছে বসে ছিলে। আমাকে হাতেনাতে ধরবে বলে নয়তো? তুমি জানালায় বসে ছিলে বলেই সেদিকে যাওয়ার আর সাহস করে উঠতে পারি নাই। আচ্ছা, তুমি এখন আর খেলতে যাওনা কেন? জানো, তোমার উচ্ছলতা আমাকে উচ্ছসিত করে! প্রতিদিন এত দূর থেকে তোমার সেই উচ্ছলতা দেখতে ছুটে যাই।
জানি তুমি ভাবছ কেন এভাবে লুকিয়ে চিঠি দিচ্ছি? সামনে কেন আসিনা? সামনে আসার মত সাহস নাই, যদি প্রত্যাখান করো? জানিনা তোমার মধ্যে কী আছে! শুধু জানি, প্রথম দেখায় তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমার কামিনী ফুল।
ইতি রঞ্জু।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here