নাইওরি,পর্ব ৪,৫
মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৪
আজ আরও বেশি মেজাজ খারাপ হলো জেসমিনের। প্রেম নিবেদন করে বসেছে বাছাধন কিন্তু নিজের পরিচয় দেয়নি। দুই ক্রোশ দূর থেকে আসে উল্লেখ করেছে তার মানে দুই এক গ্রাম পার হয়ে তার বাড়ি। এর বেশি কিছুই জানার উপায় নেই। একতরফাভাবে চিঠি দিয়ে যাচ্ছে। কোনো উত্তর লাগবেনা তার? এ কোন রামবলদ?
জেসমিন এবার একটা দুই লাইনের চিঠি লিখলো। চিঠিটা এমন…
ভীতু রঞ্জুসাহেব,
সামনে আসার সাহস না থাকলে আর চিঠি দিয়েন না। ভীতুরা এই কামিনী ফুলের চোখের বালি।
ইতি জেসমিন।
পরদিন জেসমিন চিঠিটা মতির হাতে দিয়ে বলল, “যে আমারে চিডি দিছিল হে আবার আইলে এইডা হ্যারে দিবি।”
মতি ঠোঁট উলটে বলল,
“ক্যা দিমু?”
জেসমিন কটমট করে বলল,
“হ্যার চিডি আমারে ক্যা দিছিলি?”
“হে আমারে হাটের থিকা নারকলি আর বাদামের সন্দেশ কিন্যা দিছে।”
জেসমিন ভ্রুকুটি করলো। বাচ্চা ছেলেটাকে ঘুষ দিয়ে নষ্ট করছে লোকটা! সে বলল,
“আমারটা তারে দিলে আমি তোরে আমাগো খেলায় লমু। তোর আর দুধভাত থাহা লাগবে না।”
মতি দাঁত বের করে হেসে বলল,
“হাছা কইছো জেসমিন বু?”
“আল্লাহর কিরা।”
জেসমিন চোখ দুখানি বড় করে ফেলল। যেন তাকে অবিশ্বাস করা মতির মস্ত বড় অপরাধ।
জেসমিনের চিঠি পড়ে হেসে ফেলল রঞ্জু। তার এখন আর ঢাকা যাওয়ার জন্য কোনো হুতাশ নেই। বরং না যেতে পারলে সে বাঁচে। প্রতিদিন জেসমিনকে দেখতে যায়। মাঝে একদিন বাড়িতে কাজ থাকায় যেতে পারেনি। সেদিন যে কতটা অস্থিরতায় কেটেছে তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য না। আজ যেতেই মতি এই চিঠিটা দিল। রঞ্জু সাথে করে আনা চিঠিটা আর দিল না, নতুন করে চিঠি লিখতে হবে। সে মতির কাছ থেকে কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে পারতো অবশ্য। কিন্তু সে গভীর রাতে বারান্দায় বা জানালার ধারে বসে যে চিঠি লিখবে সেই চিঠিতে যতটা আবেগ, যত্ন মিশিয়ে দিতে পারবে তা কি এখন পারবে? অসম্ভব! বিশেষ মানুষটার জন্য সবকিছুই বিশেষ হওয়া চাই।
পরদিন জয়নাল মির্জা বাড়িতে থাকায় খেলতে যেতে পারেনি জেসমিন। সন্ধ্যার পর যখন জেসমিন পড়তে বসেছে তখন মতি বন্ধ জানালার ধারে এসে ডাক দিল,
“ও জেসমিন বু, আছো এহেনে?”
জেসমিন জানালা খুলে বলল,
“কী অইছে? তুই এত রাইতে আইছোস ক্যা?”
“রাইত কিয়ের? সন্ধ্যা অইছে হপায়। তুমি তো আইজ খেলতে আহো নাই তাই আইছি কি আর করমু? এই নেও তোমার চিডি।”
জেসমিন খামটা হাতে নিয়ে বলল,
“আইজ কী দিছে তোরে?”
মতি দাঁত বের করে বলল,
“কাইল হাটে লইয়া যাইব।”
“হাটে যাওনের আগে আমার লগে দেহা কইরা চিডি লইয়া যাইস।”
“আইচ্ছা বু।”
জেসমিন খামটা খুললো। কিছু কামিনী ফুলের পাশ থেকে চিঠিটা তুলে নিল।
প্রিয় জেসমিন,
তোমার কি কাঁচের চুড়ি পছন্দ? সেদিন যখন খেলছিলে, তোমার দু’হাতের চুড়িগুলো রিনিঝিনি করে বাজছিল। এর আগে কখনোই উপলব্ধি করতে পারি নাই কাচের চুড়ি জিনিসটা যে এত সুন্দর। নাকি তোমার হাতে উঠেছে বলেই তার মাধুর্য বেড়ে গেছে? সূর্যমনির হাটে সুন্দর কাঁচের চুড়ি ওঠে। হ্যাঁ ঠিক ধরেছ আমি সূর্যমনি গ্রামের ছেলে।
সুর্যমনিতে আমাদের বাড়ির দোতলায় আমার একলার রাজত্ব। ঘরের সামনেই বারান্দা। কিছুদিন আগে বারান্দায় একটা কাঠের চারকোনা টব বানিয়েছি নিজ হাতে। সেই টবে কামিনী ফুলের গাছ লাগিয়েছি। জানিনা ফুল কবে ফুটবে। আচ্ছা এই কামিনী গাছে পানি দেয়ার দায়িত্বটা কি তুমি নিবা ফুল?
তোমার চোখের বালি না। তোমার চোখের মণি হতে চাই। কখন কোথায় আসব বলে দাও। বান্দা সময়মতো হাজির হয়ে যাবে।
ইতি রঞ্জু।
চিঠি পড়তে পড়তেই জেসমিনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে দেখা টা করবে কোথায়? কেউ দেখে ফেললে কেলেংকারি হয়ে যাবে। অন্তত কেশবপুরের মধ্যে কোথাও দেখা করা যাবে না। তাহলে উপায়?
জেসমিন রঞ্জুর প্রথম দেখা হলো মতিদের পানের বরে। মানিক পুরোটা সময় তাদেরকে পাহাড়া দিল। জেসমিন রঞ্জু দুজনের কারও কোনো ভয় নেই কিন্তু সে ভয়ে তটস্থ। এই সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে কী হতে পারে সে ধারণা তার আছে। কারণ সে চেয়ারম্যানকে চেনে। চেয়ারম্যান হিসেবে লোক ভালো তবে স্বার্থে ঊনিশ-বিশ হলে সে অতি ভয়ংকর। রঞ্জুকে শত বুঝিয়েও লাভ হয়নি। ওদিকে জেসমিন যে দাপুটে মেয়ে, একবার স্কুলে এক ছেলে ওর চুলের বেনী ধরে টান দিয়েছিল বলে মেয়ে হয়েও সেই ছেলেকে যে ধোলাই দিয়েছিল, ভীর জমিয়ে দেখেছিল লোকে। সেই ঘটনা মুখে মুখে রটে গিয়েছিল। এরপর থেকে আর কোনো ছেলে চোখ তুলে তাকাতে সাহস পায়নি। আজ সেই মেয়ে রঞ্জুর চিঠি পড়ে পাগল হয়ে দেখা করতে এলো! কী এমন লিখেছে রঞ্জু!
রঞ্জুকে দেখে মাথা ঘুরছে জেসমিনের। এত সুদর্শন ছেলে এ তল্লাটে সে কখনো দেখেনি। জামাকাপড়, চালচলন, কথাবার্তা সবকিছুতেই একটা শহুরে ভাব। জেসমিনের সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে তার স্বভাবতই রঞ্জুকে সেসব বুঝতে দিতে চাইছে না। তাকে চুপ দেখে রঞ্জু বলল,
“কী ব্যাপার চিঠিতে তো খুব কথা শোনানো হয় আমাকে। এখন যে একদম চুপ?”
জেসমিন হেসে বলল,
“অত সুন্দর কইরা কথা কইতে পারিনা।”
“বেশি সুন্দর মানুষের অত সুন্দর কথা না বললেও চলে।”
“আপনে কি শহরে থাকেন?”
“আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। সেখানকার হলে থাকি। ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলে গ্রামে থাকি।”
“এহন কি ইনভার্সিটি বন্ধ?”
“হ্যাঁ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। কিছু গন্ডগোল চলছে। তাই বাড়ি এসেছি।”
“তারমানে আমনে আবার ঢাকা যাইবেন গিয়া?”
“ইউনিভার্সিটি খুললে যাব।”
“আচ্ছা আমনের গ্রাম না সূর্যমনি? তাইলে কেশবপুরে কেমনে আইলেন আর আমারেই বা কেমনে পাইলেন?”
রঞ্জু প্রথম দেখার ঘটনাটা বিস্তারিত বলতেই জেসমিন চোখ পাকিয়ে বলল,
“ও! আমনেই হেই লোক, যার জন্য মায় আমারে গাইলাইছিল!”
রঞ্জুর ঘটনাটা মনে পড়ায় সে হেসে ফেললো। জেসমিন বলল,
“হাইসেন না। আমনেরে একখান কথা আগেই কইয়া রাখি, আমি কিন্তু কামচোর। আমারে দিয়া কোনো কাম করাইতে পারবেন না। ওই গাছে পানি দেওন পর্যন্তই।”
রঞ্জু হেসে ফেলল। এই মেয়েটি সবার থেকে আলাদা। এই মেয়েটিকে তার নিজের করে লাগবেই লাগবে।
তাদের পত্র আদান-প্রদান চলমান রইলো। দুই পক্ষেই ফিস বাড়িয়েছে মতি ডাকপিয়ন। ইদানীং বেশ বড় বড় আবদার করে বসে সে রঞ্জুর কাছে। রঞ্জুও হাসিমুখে সেই আবদার পূরণ করে। এই ডাকপিয়ন হারালে যোগাযোগ বন্ধ। এরচেয়ে বিস্বস্ত ডাকপিয়ন আর হয় না। দেখা খুব কমই হয়, তবে হয়। কখনো উত্তরের শাপলার বিলে, কখনো কালিশুরির মেহগনি বাগানে, কখনো মতিদের পানের বরে।
চলবে…
নাইওরি
মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৫
হারাধন চক্রবর্তী উত্তরাধিকার সূত্রে বাপ দাদার অনেক জমিজমা পেয়েছিলেন। কিন্তু তার নগদ অর্থ ছিল না। তিনি অলস ও ভীরু প্রকৃতির হওয়াতে নিজে চাষবাস করতে পারতেন না। বর্গা দিয়ে দিতেন। পাকিস্তান আমলে একবার তার স্ত্রীর কঠিন অসুখ হয়। চিকিৎসার জন্য ভারত যেতে হবে। প্রচুর নগদ অর্থ প্রয়োজন। তিনি ছুটে গেলেন বিত্তশালী জয়নাল মির্জার কাছে। হারাধন চক্রবর্তীর জমিজমা সব এক দাগে কালিশুরিতে। এই কারণেই জয়নাল মির্জা কিনে নিতে চাইলেন। কিন্তু হারাধন চক্রবর্তী বিক্রি করতে নারাজ। তিনি জমি বন্ধকী দিয়ে কিছু টাকা নিতে চান। জয়নাল মির্জা বন্ধকী দলিলে হারাধন চক্রবর্তীর টিপসই নিয়ে টাকা দিলেন। জয়নাল মির্জা সেই জায়গা ভোগদখল করতে শুরু করলেন। বছর কয়েক বাদে হারাধন চক্রবর্তী টাকা ফেরত দিতে এলেন।
জয়নাল মির্জা বললেন, “আরে মিয়া রাখো তোমার টাকা। এই টাকার লগে আরো কিছু দেই আমি। জমি আমার ধারে বেইচা দাও। এমনেও এই জমি তুমি কামে লাগাও না। বর্গা দিয়া রাহো। তারচেয়ে নগদ ট্যাকা পাইলে তোমার কামে লাগব।”
হারাধন চক্রবর্তী আতংকিত হয়ে বললেন,
“জয়নাল ভাই, আমার টাকার অনেক দরকার আছিল তখন এই কথা সত্য। আমনের কাছে আমি ঋণী। কিন্তু বাপ দাদার জমি আমি বেচতে চাইনা দেইখাই বন্ধক রাখছিলাম। আমারে ক্ষ্যামা করেন।”
কিন্তু লাভ হয়নি। জয়নাল মির্জা টাকাও নেননি। জমির দখলও ছাড়েননি। এই জমির জন্য হারাধন চক্রবর্তী অনেক ঘুরেছেন জয়নাল মির্জার পেছনে। স্বাধীনতার পর তিনি চেয়ারম্যান হলেন। তার ক্ষমতা আরও বেড়ে গেল। কিছুতেই তার সাথে পেরে উঠলেন না হারাধন চক্রবর্তী। অবশেষে ভাবলেন জমি বিক্রিই করে দিবেন। কিন্তু জয়নাল মির্জা দাম বলেন নিতান্তই কম। ১০ ভাগের এক ভাগ। তারপর বিভিন্ন ধরনের হুমকিধামকি তো আছেই।
এরমধ্যেই হারাধনের পরিচয় হয় হারুন ব্যাপারীর সাথে। সে ঢাকার লোক। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। এখানে তার এক বন্ধু ছিলেন তিনিই তখন থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে থাকতে থাকতে এই জায়গার প্রতি তার প্রগাঢ় এক মায়া জন্ম নেয়। তিনি এখানেই স্থায়ী হতে চান। ঢাকা শহরের বাড়ি বিক্রি করে আসায় তার কাছে ম্যালা নগদ অর্থ। এখানে ভিটাবাড়িসহ কিছু জমিজমা ক্রয় করতে ইচ্ছুক। হারাধন চক্রবর্তী খবর পেয়ে তার ভিটাবাড়ি সব বিক্রি করে পাকাপাকিভাবে ভারত চলে গেলেন। সেখানে তার নানাবাড়ি।
হারুণ ব্যাপারী হারাধনের ভিটেবাড়িতে উঠলেন। সেখানে কোনো সমস্যা হলো না। কিন্তু ভেজালটা লাগলো কালিশুরির জমির বেলায়। জমিদখল নিতে এলে জয়নাল মির্জা হারাধনের টিপসই দেয়া দলিল বের করলেন। দলিলে স্পষ্ট যে ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক জয়নাল মির্জা। হারাধন লোক ছিল সোজা, পড়াশোনা জানতেন না। জয়নাল মির্জাকে বিশ্বাস করে দলিলে টিপসই দিয়েছিলেন। তার স্ত্রী তখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন তাই যাচাই বাছাইয়ের সময়ও তার ছিল না।
অন্যদিকে হারুণ ব্যাপারীর কাছেও ক্রয়সূত্রে পাওয়া দলিল রয়েছে। হারাধন চক্রবর্তীর সাথে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে হারাধনের বন্ধুর কাছ থেকে হারুণ ব্যাপারী জয়নাল মির্জার কারসাজির কথা জানতে পেরেছিলেন। তারপর থেকেই জয়নাল মির্জার সাথে হারুন ব্যাপারীর বিরোধ। সামনাসামনি তাদের সম্পর্ক মধুর। ভাবখানা এমন যে দুজনেই একই ব্যক্তি দ্বারা ঠকেছেন। তবে হারুন ব্যাপারীও ঝানু লোক। সে তার নগদ অর্থে কেনা জমি এত সহজে ছাড়বেন না।
মানিক গরিব ঘরের ছেলে। অল্প বয়স থেকেই সে খেয়াঘাটের মাঝি। প্রথমে বর্গা নৌকা চালাতো৷ বছরখানেক হলো নিজের নৌকা হয়েছে। বাপ বর্গাচাষী ছিল। এখন অসুস্থতার জন্য তিনি কাজ করতে পারেন না। ছোট ছোট ৫ ভাইবোন। সুতরাং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মানিক। দিন আনি দিন খাই অবস্থা। জেসমিন রঞ্জুর প্রত্যেকবার দেখা করার সময় পাহাড়াদার হিসেবে থাকতে হয় তার। গরিবের ক্ষমতা সীমিত তাই ভয় অধিক। মানিকও তার ব্যতিক্রম নয়। চেয়ারম্যান সাহেব জানতে পারলে রঞ্জুর সাথে সাথে তার পরাণ টাও যাবে।
জেসমিন আজ ক্লাস না করে স্কুলের পেছনের খেয়াঘাট থেকে মানিকের নৌকায় উঠেছে। নৌকা কেশবপুরের সীমানার বাইরে যাওয়ার পর রঞ্জু নৌকায় উঠবে। এমনই পরিকল্পনা হয়েছে চিঠিতে।। মানিক দ্রুতহাতে বৈঠা বেয়ে পাড় থেকে দূরে চলে গেল। তবে এরজন্য বেশ কসরত করতে হলো। কারণ এখন ভাটার সময়। স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড় টানতে হচ্ছে। তার জীবনের কোনোকিছুই স্রোতের অনুকূলে থাকেনা। আর এ তো নদীর স্রোত। এ আর কী!
জেসমিন গুনগুন করে কোনো একটা গান গাইছিল বোধহয়। রঞ্জু নৌকায় ওঠার আগেই মানিকের কথা সেড়ে ফেলা উচিত। জেসমিন বয়সে তারচেয়ে অনেক ছোট। তার ছোটবোনের সাথে এক ক্লাসে পড়ে। একই গ্রামের বাসিন্দা। কাছাকাছি বাড়ি। ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে।
আচমকাই কথা শুরু করল মানিক,
“জেসমিন তোর ডর লাগে না?”
জেসমিন খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল,
“ইট্টু সাহস না থাকলে তো প্রেমে ডুব দিতাম না মানিক ভাই।”
মানিকের চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল জেসমিন। যেন এমন প্রশ্ন আসতে পারে জেনে উত্তরটা তৈরি রেখেছিল সে। এমন দৃঢ় দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। মানিক এমনিতেও মেয়েছেলের দিকে তাকাতে অস্বস্তিবোধ করে। সে নদীর পানে চেয়ে দাঁড় বাইতে বাইতে বলল,
“সাহস ভালো। তয় সবকিছুতে না। লোক জানাজানি হইলে কেলেঙ্কারি লাগবে, তোর বদনাম হইবে জেসমিন।”
জেসমিন খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। মানিক বিরক্ত মুখে তাকালো। জেসমিন হাসতে হাসতেই বলল,
“চান্দেরও কলঙ্ক থাকে মানিক ভাই। আমিও তো চান্দের লাহান সুন্দর। আমার একটু কলঙ্ক না থাকলে কেমনে হয় কন ত?”
আজকের সূর্যের বড় তেজ। মানিকের ঘিলু যেন গলে পড়বে মনে হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় আজ সে গামছা আনতে ভুলে গেছে। গামছা আনলে মাথাটা ঢেকে নিতে পারত। সে কিছুটা বিরক্ত মুখে বলল,
“তোগো দুইডার একটারও ডর ভয় বইলা কিছু নাই। একবার ভাবছোস চেয়ারম্যান চাচা জানতে পারলে কী হইব?”
“আমনে এক কাজ করেন মানিক ভাই। বন্ধুরে তালাক দিয়া দেন। তাইলে আর আপনের ফাঁসার চান্স নাই। যা যাইবো আমাগো উপর দিয়া যাইবো।”
মানিক জবাব দিল না। সে এমনিতেও কথা কম বলে।
নৌকা নদীর পাড়ে ভেড়ালো মানিক। রঞ্জুকে সেখানে একটা গাছের শেকড়ের উপর বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। নৌকা ভিরতেই রঞ্জু দ্রুত নৌকায় উঠে সোজা ছইয়ের ভেতর চলে গেল। মানিক নিজের মাথায় একটু পানি দিলো। তারপর আবার নৌকা ভাসালো। বৈঠা বাইতে শুরু করলো অজানার উদ্দেশ্যে। তার হাতে এখন অফুরন্ত সময়, যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। স্কুল ছুটির সময় হলে রঞ্জুকে আবার এখানে নামিয়ে তারা ফিরে যাবে। এই সময়টায় তার যা আয় হত তা রঞ্জু দিয়ে দেবে।
জেসমিন নৌকায় উঠেই শাড়ির আঁচল দিয়ে লম্বা ঘোমটা দিয়ে ফেলেছিল, যাতে বাইরে থেকে দেখলে কেউ চিনে না ফেলে। রঞ্জু তাকে এভাবে দেখে বলল,
“তোমাকে কিন্তু নতুন বউয়ের মত লাগছে ফুল।”
জেসমিন মুখ টিপে হেসে বলল,
“তাইলে বাড়ি লইয়া লও।”
“তুমি কি এখনই যেতে চাও? তাহলে বাবাকে বলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই?”
জেসমিন চোখ বড় বড় করে বলল,
“তুমি কি পাগল? আমি এমনেই তামশা করছি। আমার আব্বা এইসব টের পাইলে কাইট্টা ফালাইব।”
“ওমা তাহলে কি আমরা সারাজীবন এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করে যাব?”
“না, আগে কাজকাম করো। বেকার পোলার কাছে আমার বাপে মাইয়া দেবে না।”
“দাঁড়াও দ্রুত বেকারত্ব ঘোচাচ্ছি। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করব। তার আগ পর্যন্ত বাবার সাথে ব্যবসায় কাজ করি।”
রঞ্জু সত্যি সত্যিই তার বাবার সাথে ব্যবসায় কাজ করা শুরু করলো। তার বাবার বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে। যখনই ছেলে কাজ করতে চাইলো তিনি ভীষণ খুশি হয়ে ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিলেন।
চলবে…