নাইওরি,পর্ব ৬,৭

0
300

নাইওরি,পর্ব ৬,৭
মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৬

মিনু বহুদিন পর বাপের বাড়ি এলো। নতুন অতিথি আসার খবর পেয়ে মিনুর বাবা ইয়াসিন আলী মেয়েকে নাইওর নিতে গিয়েছিলেন। তিনি মেয়ের সাথে জেসমিনকেও বেড়াতে আনতে চাইলেন। জেসমিনের ইচ্ছা না থাকা স্বত্বেও জয়নাল মির্জার হুকুমে তাকে কুটুমবাড়ি আসতে হয়েছে। এমনিতে সে এবাড়িতে আসতে পছন্দ করে। মিনুর ছোট ছোট ভাই-বোন থাকায়, তাদের সাথে খেলে জেসমিনের সময় অনেক ভালো কাটে। কিন্তু এবার মন টিকছে না। রঞ্জুর জন্য অস্থির লাগছে। একটা খবরও দিয়ে আসতে পারে নি। এই ছেলেটা জীবনে আসার পর থেকে সবকিছুতেই তার অস্থির লাগে! এ কী ভয়ংকর অসুখ!

মিনুর মা ছালেহা রান্নাঘরে বসে তাল গোলাচ্ছেন। কলাপাতায় তালের পিঠা তৈরি হবে। তার হাতের এই পিঠা জেসমিনের অতি পছন্দের খানা। প্রতি বর্ষায় নিয়মিত এ বাড়ি থেকে তালের পিঠা যায় তার জন্য। আর সে এ বাড়ি বেড়াতে এলে তো তালের পিঠা বানানো আবশ্যক। জেসমিন রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে ছালেহার তাল গোলা দেখছে। ঠিক সেই সময়ে আচমকা রঞ্জুর গলা শুনতে পেল। পিলে চমকে গেল জেসমিনের। রঞ্জুর মত কন্ঠ, ডাকছেও রঞ্জুকে। বাড়ির পাশে রাস্তা। শব্দটা রাস্তার দিক থেকেই আসছে এবং অনেকটাই দূরে। কিন্তু জেসমিন তো এই গলাটা চেনে। রঞ্জুর তো এখানে আসার কথা নয়, আসা সম্ভবও নয়। মতির মাধ্যমে খবর নিতে পারে যে সে বেড়াতে এসেছে কিন্তু এ বাড়ির ঠিকানা তো পাওয়া সম্ভব না। তবে কি সে ভুল শুনেছে? ভুল শোনাটা অস্বাভাবিক নয়। হ্যাঁ ভুলই হয়তো শুনেছে। সত্যি হলে তো সালেহাও শুনতেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই ডাকটা আবার শুনতে পেল জেসমিন। রঞ্জু রঞ্জুকেই ডাকছে। এটা ভুল হতে পারে না। রঞ্জু এসেছে! কীভাবে এসেছে সে জানেনা তবে রঞ্জু এসেছে। রাস্তায় যে কেউ যে কাউকে ডাকতে পারে তাই হয়তো ব্যাপারটা আমলে নেন নি ছালেহা। তিনি তার কাজ করে যাচ্ছেন। জেসমিন অস্থির হয়ে পড়লো। যে করেই হোক তাকে রাস্তায় যেতে হবে।

জেসমিন ঘরে ঢুকলো। সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে সোজা রাস্তার দিকে চলে গেল। রাস্তার কাছেকাছি গিয়ে দেখে রঞ্জু আর মানিক দাঁড়িয়ে আছে। রঞ্জু আশেপাশে সবদিকে তাকিয়ে জেসমিনকে খুঁজছিল। তাই জেসমিন রাস্তায় উঠতেই রঞ্জু তাকে দেখে এগিয়ে গেল। জেসমিনের চোখে চোখ পড়তেই রঞ্জু হাসলো। জেসমিন হাসির উত্তর দিল না। তাকে ইশারা দিয়ে বাড়ির পাশের বাঁশ বাগানে যেতে বলে সে আবার বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। রঞ্জু বাঁশ বাগানে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। মানিক রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেসমিন এলো। এবার সে রঞ্জুর হাসির উত্তরটা দিল। বলল,
“আমি যে এহেনে হেই কতা কেমনে জানলা?”
রঞ্জু হেসে বলল,
“মতি ডাকপিওন!”
“কিন্তু এই বাড়ি তো মতি চেনে না। ঠিকানা কোতায় পাইছো?”
“মানিক জোগাড় করেছে। আমি তো এদিকের কিছুই চিনিনা। মানিকই নিয়ে এসেছে।”
“সে কই?”
“রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছে।”
“তোমার ডর লাগলো না আইতে?”
“কীসের ভয়?”
“ভিনগাঁয়ে দেহা করতে আইয়া যদি ধরা খাও?”
“তোমাকে দেখা এত জরুরি ছিল যে এসব মাথায়ও আসে নি।”
জেসমিন হেসে বলল,
“এই না হইলে প্রেমিক!”

জেসমিন রঞ্জুকে নিয়ে মিত্তির দিঘির দিকে গেল। দিঘিতে মিনুদের দুটি ডোঙা নৌকা বাঁধা। এই ডোঙা দুটিতে করে মিনুর ভাইবোনেরা দিঘিতে মাছ ধরতে যায়, শাপলা তুলতে যায়। জেসমিন এলে তাদের সাথে সে-ও যায়। তালগাছের কাণ্ড দিয়ে এই নৌকা বানানো হয়। ডোঙ্গা বেশ টেকসই। তাল গাছের কাণ্ড সহজে পঁচে না বলে একটি ডোঙা বেশ কয়েক বছর ব্যবহার করা যায়। তবে তালগাছের প্রস্থ কম হওয়াতে একসাথে বেশি মানুষজন ওঠা বিপজ্জনক। ডোঙায় যদি দুজন ওঠে তবে দুজনই বৈঠা বাইতে পারলে ভালো। জেসমিন রঞ্জুকে সাথে নিয়ে একটি ডোঙা ভাসালো। দুজনের হাতে দুটি বৈঠা। কিছুদূর যেতেই রঞ্জু বলল,
“তুমি আমাকে কিছু না জানিয়ে বেড়াতে এসেছ শুনে হঠাৎ করে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। অন্তত মতির কাছে একটা চিঠি দিয়ে আসতে পারতা।”
জেসমিন বৈঠা বাইতে বাইতে বলছিল,
“সুযোগ আছিল না। তালোইসাব আচুক্কা আইয়া পড়ছিল। চিডি একখান লেখছিলাম, কিন্তু মতির কাছে যাইতে পারি নাই।”
“তোমাকে না পেয়ে একটা অজানা ভয় কাজ করছিল।”
“যেকালে তোমার ইনভার্সিটি খুইল্যা যাইবে, হেকালে কী করবা?”
“তখন তো জেনেই ঢাকা যাব যে এতদিন দেখা হবে না। মানসিক প্রস্তুতি থাকবে।”
“এহ নিজে যাওনের সমায় এক্কালে ষোলো আনা। আর মাইনষের বেলায় এক আনাও না।”
রঞ্জু হেসে বলল,
“আচ্ছা যাও। পুরা ষোলো আনাই তোমার।”
জেসমিনের মুখে এবার হাসি ফুটলো। বলল,
“আচ্ছা এই দিঘির একখান কাহিনী আছে। হুনবা?”
“বলো।”
“এই গেরামের যত মাইনষের বিয়া লাগতো, বিয়ায় খাওনের সব থালাবাসন হাড়িপাতিল দিত এই মিত্তির দিঘি।”
রঞ্জু কৌতূহলী কন্ঠে জানতে চাইলো,
“কীভাবে?”
“কারো বিয়া লাগলে পাত্রপাত্রীর বাপ মা এহেনে আইয়া কইত, অমুক দিন আমার মাইয়ার বিয়া। পোলার বাপেরা কইত আমার পোলার বিয়া। আমারে কিছু থালাবাসন হাড়িপাতিল দাও গো মিত্তির দিঘি। পরদিন বেইন্যাকালে দিঘিরপাড়ে পিতলের হাড়িপাতিল আর সোনা রূপার থালাবাসন পাওন যাইত। বিয়া মিট্যা গেলে থালাবাসন হাড়িপাতিল গুলা আবার মাইজ্যা ধুইয়া দিঘিরপাড়ে থুইয়া দিতে হইত। দিঘি রাইতেরবেলা ফেরত নিয়া নিত। একবার হইলো কি এক ব্যাডা হের মাইয়ার বিয়ার লাইগা থালাবাসন নিলো। বিয়ার কাম শ্যাষ হইতেই সব আবার মাইজ্যা ধুইয়া দিঘিরপাড়ে থুইয়া গেল। কিন্তু পরদিন দেখে থালাবাসন পাড়েই রইসে। দিঘি ফেরত নেয় নাই। এমনে আরও একদিন এক রাইত গেল। থালাবাসন পাড়েই পইড়া রইছে। ব্যাডায় তো ম্যালা দুশ্চিন্তায় পইড়া গেল। দিঘি থালাবাসন নিতাছে না এইডা তো ভালো লক্ষন না। হেইদিন রাইতেই হে স্বপ্নে দেখলো থালাবাসন সব যায় নাই। এর লাইগ্যা দিঘি ফেরত নিতাছে না। কি সর্বনাইশা কথা! মিত্তির দিঘির জিনিস চুরি! শ্যাষম্যাশ ব্যাডা বাড়ির বেবাকটিরে ডাইক্যা কইলো কেউ কিছু চুরি করলে রাইতে জায়গামত রাইখা আইতে। আর নাইলে এই বংশ ধ্বংস হইয়া যাইব। আসলে ওই ব্যাডার পোলার বউ এত সুন্দর নকশা করা সোনা রূপার থালাবাসন দেইখা লোভে পইড়া একটা বাটি পলাইয়া রাখছিল। যাই হোক, পরে বৌ ওই রাইতেই বাটিটা ফেরত রাইখা আইছিল। হেই যে হেই দিন রাইতে দিঘি সব থালাবাসন নিল, এরপর আর কোনোদিন কাউরে দেয় নাই। কত মানুষ চাইলো! দিঘির পাড়ে আর থালাবাসন আহে না।”
রঞ্জু হেসে বলল,
“এটা তোমার বানানো গল্প তাইনা?”
জেসমিন রেগে গেল,
“বানাইন্যা হইবে ক্যা? তুমি এই গেরামের মিত্তির দিঘির কথা যে কাউরে জিগাও গা যাইয়া, সবাই জানে। এই জেসমিন মিছা কথা কয় না।”
রঞ্জু কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই তীরের দিক থেকে একটা হুংকার শোনা গেল,
“এই… ডোঙায় তোমরা কার পোলা? কার মাইয়া?”
সাথে সাথে আরেকজনের গলা পাওয়া গেল,
“মাইয়ার তো চেহারা দেহা যায় না। পোলাউজ্ঞারে ত দেইক্কা মনে হয় না এই গেরামের।”
“কি সর্বনাশ জোয়ান মাইয়াপোলা একলগে ডোঙা বায়! দ্যাশটা তো এক্কালে রসাতলে গেল।”
রঞ্জু সেদিকে তাকালো। জেসমিন একজনের গলা শুনে চিনতে পারলো। এটা ইয়াসিন আলীর গলা। তারা জেসমিনের পেছন দিকে। সে আর পেছনে তাকালো না। রঞ্জুকে বলল,
“এই তুমি ওইদিক চাইয়ো না। শ্যাষের জন আমার তালোই। তাড়াতাড়ি ডোঙা বাও। এদিক থিকা পলাইতে হইব। আমার চেহারা দেহান যাইবো না।”
ইয়াসিন আলীর গলা আবারও শোনা গেল। তবে আগের মত চেঁচিয়ে না বলায় বোঝা গেল না।
রঞ্জু বলল,
“সর্বনাশ। ওরা একটা নৌকায় উঠেছে। এদিকেই আসছে।”
“নৌকা না ডোঙা?”
“নৌকা।”
“ডোঙা বাইয়া নৌকার লগে জীবনেও পারমু না। তুমি সাতার জানো?”
“জানি।”
“তয় এহনই লাফ দাও। সাঁতরাইয়া পলাইতে হইবো।”
রঞ্জু জেসমিনের হাত ধরে দিঘিতে লাফ দিলো। জেসমিন খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ডুবসাঁতার দিয়ে দুজনে যে কোনদিকে গেল, ইয়াসিন আলীরা আর খুঁজে পেলেন না।

জেসমিন চোরের মত পেছন দিকের রাস্তা দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। লুকিয়ে ঘরে ঢুকে দ্রুত কাপড়টা পালটে ফেলল। এর কিছুক্ষণ বাদেই মিনু এসে বলল,
“জেসমিন তুমি কাইল সকালে বাড়িত চইলা যাও। আমাগো বাড়ি বইয়া ধরা খাইলে বিপদের ভাগিদার আমরাও হমু। আমি আমার বাপেরে এই বয়সে বিপদে ফালাইতে চাই না।”
মিনু জেসমিনের উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেল। রাতে খাবারের সময় মিনু ইয়াসিন আলীকে বলল, “আব্বা জেসমিন বাড়ি যাইতে চায়। কাইল ব্যানে(সকালে) আমনে অর যাওনের ব্যবস্থা করেন।”
ইয়াসিন আলী বিচলিত হয়ে বললেন,
“ক্যা মা কী অইছে? আম্মাজানের কি কোনো সমেস্যা অইতেয়াছে এহেনে?”
“এত ভাইবেন না আব্বা। সে বড় হইছে। যাইতে যখন চায় যাওনের ব্যবস্থা করেন।”
জেসমিনকে কিছু বলারই সুযোগ দিল না মিনু। অবশ্য জেসমিনের বলারও কিছু নেই। যেতে পারলে বরং ভালো।
“আচ্ছা বেইন্যাকালে আমি লইয়া যামু।”
ইয়াসিন আলী এ কথা বলে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। মিনু যখন এভাবে বলছে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।
রাতেই জেসমিনের জ্বর এলো। দিঘিতে অনেকক্ষণ সাঁতরানোর ফলে ঠান্ডা লেগে জ্বর। খুব বেশি জ্বর নয় যদিও। সে ব্যাপারটা কাউকেই বুঝতে দিল না। বাড়ি চলে এলো। অসুস্থ অবস্থায় অনেকটা পথ নৌকা করে আসায় জ্বর বেড়ে গেল। নৌকার ঘাটে দেখা হয়ে গেল মানিকের সাথে। ইয়াসিন আলী নৌকার ভাড়া মেটানোর সময় জেসমিন মানিকের কাছে গিয়ে বলল,
“কী মানিক ভাই বন্ধুরে তালাক দিতে পারলেন না? ভিন গায়ে গেলেন গিয়া তার প্রেমিকার কুটুমবাড়ি চিনাইতে!”
মানিক বলল,
“তালাক ক্যান দিমু? সে আমার বন্ধু। তারে ভালমন্দের বুঝ দেওন দায়িত্ব ছিল তাই দিসি। তার ভালোর লগে যেমন থাকি মন্দের লগেও থাকি৷ তাই আছি। লাগলে তার লাইগা জান দিমু। কুটুমবাড়ি চিনানো তো কিছুই না।”
“আমার ব্যাপারটাও এমনই হইয়া গেছে মানিক ভাই। লাগলে জান দিতে পারমু কিন্তু তারে ছাড়া থাকতে পারমু না।”
মানিক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। ইয়াসিন আলী আসার আগেই জেসমিন মানিকের কাছ থেকে সরে গেল।

রাত তখন অনেক। জানালায় দুটো টোকা পড়ল। মতিকে বলা আছে জরুরি প্রয়োজনে এসে যদি জানালা বন্ধ পায় তাহলে হালকাভাবে দুটো টোকা দেবে। তখনই জেসমিন বুঝবে মতি এসেছে। জ্বর নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে কষ্ট হলো জেসমিনের। তবুও সে উঠলো। নিশ্চয়ই রঞ্জুর কোনো খবর হবে। জানালা খুলতেই চমকে উঠল জেসমিন। রঞ্জু দাঁড়িয়ে! ফিসফিসিয়ে বলল,
“তুমি এত রাইতে এহেনে?”
“তোমার জ্বর খবর পেয়ে এলাম। জ্বর বাধালে কী করে? সাঁতার কেটে?”
“মনে হয়। আইনকা পানি তো। কিন্তু তুমি খবর পাইলা কেমনে?”
“মানিকের কাছে। খেয়াঘাটে নাকি দেখা হয়েছিল।”
“ও। জানো একটা গন্ডগোল হইয়া গেছে।”
“কী গন্ডগোল?”
“ছোট ভাবির কাছে ধরা খাইয়া গেছি।”
“সর্বনাশ। কীভাবে?”
“তা জানি না। ভাবির লগে এই বিষয়ে আর আলাপ করার সাহস পাইতাছিলাম না।”
“যদি তোমার বাবাকে বলে দেয়?”
“তা কইবে না। সে তার নিজের আব্বারেও কয় নাই।”
“আচ্ছা।”
জেসমিন আচমকাই বলে উঠলো,
“কপালে হাত দিয়া জ্বর দেখতে মনে চায় এইটা মুখে কইতে ডরাও? ক্যামন পুরুষ তুমি?”
রঞ্জু হেসে বলল,
“তুমি কীভাবে মন পড়তে পারো জেসমিন?”
“মন পড়তে হইলে চক্ষু লাগে। আর হেইডা আমার আছে।”
জেসমিন জানালার একদম কাছে চলে গেল। রঞ্জু কপালে হাত রাখলো। জেসমিন কেঁপে উঠলো। মনে হলো বরফের হাত বসেছে তার কপালে। এই হাত তার প্রিয় মানুষষের হাত! সে চোখটা বন্ধ করে প্রার্থনা করে নিল, এই হাত যেন আজন্মকাল তার কপাল ছোঁয়ার অধিকার পায়।

চলবে…

নাইওরি
মৌরি মরিয়ম

পর্ব ৭

দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে চলেছে। রঞ্জুকে উঠোনে একটা গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। উঠোন ভর্তি লোকজন। সালিশ বসবে একটু পরেই। শুধু চেয়ারম্যান সাহেবের অপেক্ষা। গ্রামের অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও এসে পড়েছেন। মাঝরাতে রঞ্জুকে জেসমিনের জানালার সামনে থেকে ধরে আনা হয়েছে, সারারাত সে এই গাছের সাথেই বাঁধা। কাঠফাটা রোদে মগজ গলে পড়ছিল যেন। এখন রোদটা মরে এসেছে। কিন্তু প্রচন্ড ক্ষুদায় কাতর সে, শরীরের সব শক্তি শেষ।

মানিক টের পেয়েছে দুপুরে। কিন্তু রঞ্জু সবার চোখের সামনেই। পাহাড়াও দেয়া হচ্ছে তাই ধারেকাছেও যেতে পারেনি সে। তাই সে এখন রঞ্জুর বাবার কাছে যাচ্ছে খবর দিতে। চেয়ারম্যানের ভয়ংকর কোনো শাস্তির হাত থেকে হয়তো একমাত্র উনিই বাঁচাতে পারবেন রঞ্জুকে।
যেহেতু রাতে ধরা পড়েছে সেহেতু সালিশ সকালেও হতে পারতো। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব নাকি আজকে কঠিন ব্যস্ত। মেয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কি কিছু থাকতে পারে? মানিক ভালোভাবেই জানে, ব্যস্ততা আসলে কিছুই না। অপরাধীকে যাতে সালিশ হবার আগেই অভুক্ত অবস্থায় বেশিক্ষণ বেঁধে রেখে কষ্ট দেয়া যায় তাই এই ব্যস্ততার নাটক। এই নাটক শুধু সে নয় গ্রামের অনেকেই বোঝে কিন্তু কিছু করার নেই। বড় বড় মানুষের বড় বড় ব্যাপার। গরীবের না আছে কিছু বলার ক্ষমতা, না আছে কিছু করার ক্ষমতা। গরিব সর্বক্ষেত্রেই অক্ষম!

রঞ্জু ধরা খাওয়ার পর থেকে জেসমিনকে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। জেসমিন কেঁদেকেটে একাকার করেছে। ঘরের ভেতর থেকেই বারবার রঞ্জুকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করেছে সে। কেউ তেমন একটা গায়ে মাখেনি। তবে কোহিনুর বানু একবার এলেন। জানালা খুলে ঠান্ডা গলায় বললেন, “বেশি চিল্লাইলে গরম শিক আইন্যা গলায় ঢুকাই দিমু।”
জেসমিন ফুসে উঠলো,
“দেও। আমারে মাইরা হালাও। খালি রঞ্জুরে ছাইড়া দিতে কও মা। আল্লাহর দোহাই লাগে।”
“পোড়াকপালি! পিরিত মারানির আগে মনে আছিলো না কী অইতে পারে? তোর আহ্লাদির ঠেলায় জোয়ান পোলাডার জীবন দিতে অইবে এহন।”
জেসমিন পা দাপিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“মাফ কইরা দেও মাগো, মাফ কইরা দেও।”
“আমার বাপে আইলেও তোর বাপেরে আইজকা আটকাইতে পারবে না লো সর্বনাশী ছেড়ি৷ যে সর্বনাশ তুই করছোস, হেইয়া এহন চক্ষু মেইল্যা দ্যাকতে অইবে।”

জয়নাল মির্জা সালিশে যাওয়ার আগে জেসমিনের ঘরে ঢুকলেন। জেসমিন বিছানায় বসে ছিল। বাবাকে দেখে নেমে এলো। তবে বাবাকে সে ভীষণ ভয় পায়। তার মুখের উপর কোনোদিন কথা বলেনি। জয়নাল মির্জা বললেন,
“কী বলি মনোযোগ দিয়া শোনো মা। সালিশে তোমারে ডাকা হবে। ছেলে যাই বলুক তুমি বলবা এই ছেলে তোমারে পছন্দ করে, তবে তুমি কখনই তার ডাকে সাড়া দাও নাই। এই কথার যেন নড়চড় না হয়। তার জীবনে সর্বনাশ ডাইকা আনবা না আশা করি।”
জেসমিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

সালিশ শুরু হবার আগেই রঞ্জুর বাবা এসে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে জয়নাল মির্জার মাথায় চক্কর দিয়ে উঠলো। কারণ রঞ্জুর বাবা হারুন ব্যাপারী। এই ছেলে যে হারুন ব্যাপারীর ছেলে সেটা যদি তিনি আগে জানতেন তবে খেলার চাল ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। ঘুনাক্ষরেও সালিশ ডাকতেন না। এই ছেলেকে তুরুপের তাস বানিয়ে জমির ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলতে পারতেন।
তিনি সবসময় ভেবেচিন্তে প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করেন। সেই হিসেবে তার প্রথমে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল ছেলেটির বাবা কে? কিন্তু এইক্ষেত্রে নিজের মেয়ের প্রণয়ের সম্পর্ক ধরা পড়ায় তার মাথা আউলে গিয়েছিল। ছেলেটিকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার জন্য গায়ের রক্ত টগবগ করে ফুটছিল। সেইজন্যই সালিশ ডেকে বসলেন।

কেশবপুরের সকল সালিশে সাধারণত চেয়ারম্যান জয়নাল মির্জা, মেম্বার কাশেম মোল্লা, কেশবপুর বাজারের একমাত্র ডাক্তার প্রনব সাহা, কেশবপুর হাই স্কুলের হেডমাস্টার নাসেরউদ্দিনসহ গ্রামের প্রভাবশালী অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও আসেন। সকলের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যেহেতু ভিকটিম চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যা সেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর। সকলেই এসেছেন। যে ছেলে চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যাকে রাতবিরাতে উত্যক্ত করতে পারে, অবশ্যই সেই ছেলের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।
প্রথমেই জেসমিনকে ডাকা হলো। সে যেহেতু ভিকটিম তার কথাই আগে শুনতে হবে। জেসমিনের গায়ে জ্বর, শরীর কাঁপছে। তাকে ধরে আনলেন কোহিনূর বানু। রঞ্জু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সালিশ শুরুর আগে অবশ্য তার বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেবের পুত্রদ্বয় পাশেই দাঁড়ানো। হারুন ব্যাপারী অন্য গ্রামের হলেও প্রভাবশালী এবং সম্মানীয় লোক। তাই অপরাধীর বাবা হওয়া স্বত্তেও তাকে বিচারকারীদের সাথেই বসতে দেয়া হয়েছে। তিনি কোনো কথা বলছেন না, চুপচাপ দেখছেন। খবর পেয়ে এখানে আসতে আসতেই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিকল্পনা করে ফেলেছেন তিনি তবে তার আগে জেসমিনের বক্তব্য শোনা দরকার। জেসমিন এবং রঞ্জুর বক্তব্যের উপর নির্ভর করছে তার পরিকল্পনা কাজে লাগানো যাবে নাকি যাবে না।
সকল সালিশ চেয়ারম্যান সাহেবই শুরু করেন তবে এই সালিশ শুরু করার দায়িত্ব তিনি দিয়েছেন মেম্বার কাশেম মোল্লাকে। প্রয়োজনে তিনি তার বক্তব্য পেশ করবেন। কাশেম মোল্লা জেসমিনকে জিজ্ঞেস করলেন,
“বলো মা, এই ছেলে কবে থেইক্যা তোমারে উত্যক্ত করে?”
জেসমিন কিছু বলার আগেই প্রণব সাহা বললেন,
“আগে গতকাল রাইতের ঘটনাটা জেনে নিলে ভাল হয় না?”
আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিল না জেসমিন। সে দৃঢ় গলায় বলল,
“সে আমারে উত্যক্ত করে নাই। আমি তারে ভালোবাসি, সেও আমারে ভালোবাসে। আমার জ্বর হইছে সেই খবর পাইয়া সে আমারে দেখতে আসছিল। আমি ঘরে, সে বাইরে। জানলা দিয়া কথা কইতাছিলাম আমরা। তখনই বড় ভাইজান দেইখ্যা ফালায়। তারে ধইরা নিয়া বাইন্ধা রাখে। সে যদি অপরাধ করে তাইলে আমিও অপরাধ করসি।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here