নাম_সমাপ্তি_কোথায়?,(২য় শেষ অংশ)
অক্ষর_অঙ্কনে_মিমি
জনরা_ভৌতিক
?
মানুষের জীবনে কোথায় কি হয়ে যায় তা নাকি এই তিন আঙুল পরিমাণ ললাটের অবিস্তীর্ণ সীমানায় লিখা থাকে৷ তবে এ শৈলপ্রান্তের কিছু লিখন এমনও হয় যা বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন। যে লিখন ঠিক কণ্ঠনালির বরাবর এক বিশেষ জায়গায় এমন রূপে বিধে যায় যেন নিঃশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হয়। আরিশ এই টুকু বলে থেমে গিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা নোনা জল মুছে নিলো। বন্ধ রুমটার দিকে একবার তাকালো। সারা এখনোও ঘুমাচ্ছে। আরিশের প্রতিটা চালচলন নোট ডাউন করছে দিব্য। তার পাশেই ক্যামেরায় সবটা রেকর্ড হচ্ছে। আরিশ দিব্যকে বললো,
—- কিছু মনে করবেন না। আমি একটু ওদেরকে দেখে আসতে চাই। মানে আমার স্ত্রী আর সন্তানকে। আমি একটু দেখে আসতে চাই তারা ঠিক আছে কি-না।
দিব্য আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাক করে রইলো আরিশের দিকে। দুটো জীবন্ত মানব ঘুমোচ্ছে। এতে এতো চিন্তা করার কিছু নেই। মনে মনে ভাবলো কেইসটা সাইকোলজিক্যাল কন্ডিশন এর আওতায়। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো,
—- জ্বি অবশ্যই।
আরিশ উঠে গেলো রুমের ভেতর। দিব্য তাকিয়ে রইলো তার দিকে যতক্ষণ তাকে দেখা যায়। হাতের ঘড়িটার দিকে একবার তাকালো। সন্ধ্যের আগে তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। ঘরের বাকি আসবাবপত্রের দিকে আবার চোখ বুলালো। ঘরটা সাজানো গোছানো থাকলে বেশ শৌখিন মানুষের ঘরই বলা যেত। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আরিশ ফিরে এলো। আগের স্থান দখল করে বসে বললো,
—- আপনাকে দেরি করানোর জন্য দুঃখিত।
—- না না সমস্যা নেই৷ এটা আমার কাজ। বরং আপনি আমাকে সময় দিচ্ছেন এতেই অনেক।
—- আমিও বাধ্য হয়েই দিচ্ছি। যদি কোন হাল বের হয়।
—- আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। বাকিটা বলুন।
আরিশ আবার গম্ভীর হয়ে গেলো। ভেতরে কেমন কামড়ে ওঠার মতো যন্ত্রণা। সে দিন কি ভুলার মতো?
সেদিন সারা বাড়ির কাজে বেশ ব্যস্ত ছিলো। সাইফ আর সাঈদ নিজের মনে সারাদিন খেলা করে। সারাকে তেমন বিরক্ত করতো না তার দুই সন্তান। তখন নিচ তলায় থাকতো তারা। দু জমজ সন্তানের মধ্যে সাইফ বড়। বয়সে ২০ মাস তখন। বাসার পাশেই রাস্তায় একটা সরু ড্রেন। ড্রেনের পাশে একটা চিকন বড়ই গাছ। সাইফ আর সাঈদ প্রায়ই সেই গাছটার নিচে বসে একসাথে খেলতো। বিশেষ করে দুপুরের দিকে। প্রায় দুপুরেই সারা নিজের হাতের কাজ শেষ করে তার দু সন্তানকে সেখান থেকে ঘরে এনে গোসল করিয়ে দিতো। সারা একা থাকতো তার ঘরে। আরিশের পরিবারের অন্য কেউ তাদের সাথে থাকতো না। কাজেই ঘরের কাজ করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে বেখেয়ালি হয়ে পড়তো সন্তানদের দিকে। সেদিনও সারা ঘরের কোন একটা কাজে বেশ ব্যস্ত। ছেলে দুটো বরাবরই সেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে খেলছে। ড্রেনের পাশের একটা দিক অনেকটা ভাঙা। সেই ভাঙা অংশ দিয়ে ড্রেনের উপরিতলে অনুচ্চ উঁচুতে বয়ে চলেছে নোংরা পানি। তবে পানির উচ্চতা নেই। কেউ সেই পানিতে দাড়ালে হয়তো সর্বোচ্চ পায়ের গোড়ালি অবদি ছুঁয়ে দিবে। বেলা প্রায় মধ্যদুপুর। মানুষের আনাগোনা তেমন নেই সারা বেশ তাড়াহুড়ো করছিলো যন হাতের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। হঠাৎ সারা তারা ছোট ছেলের চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেলো। দ্বিগুণ গতিতে কান্না করছে আর চিৎকার করে অর্ধের অর্ধেক বলেছে, “ছ, ছাইফ বাইয়া। ছাইফ বাইয়া।” সারা দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। ড্রেনের কাছে যেতেই আঁতকে উঠল সে। পা যেন কিছু মুহুর্তের জন্য জমে গেলো। এরপর আচমকাই চিৎকার দিয়ে এগিয়ে গেলো,
—- সাইফ।
দেড় বছরের বাচ্চাটার ড্রেনের ভাঙা অংশ দিয়ে ভেতরে পরে গিয়েছে। তবে তা সাধারণভাবে নয়। মাথাটা ড্রেনের ভেতরকার শক্ত আবরণের ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। পা দুটো উপরের দিকে। পা দুটো নেড়ে বাচ্চাটা ছটফট ছটফট করছে। সারা নিজের দৃষ্টিশক্তির ওপর যেন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। দৌড়ে এসে ড্রেনে নেমে গেলো৷ সন্তানকে জড়িয়ে ধরে ওপরের দিকে টানতে লাগলো। আর চিৎকার করতে লাগলো,
—- কেউ আছেন? আমাকে একটু সাহায্য করুন। কে আছেন?
সারার মনে হচ্ছিলো তার চেয়ে চৌগুন সম্পন্ন শক্তিধর কেউ তার বিপরীতে সাইফকে নিচের দিকে টানছে। বাচ্চাটা হাত পা নেড়েচেড়ে বাঁচার আপ্রাণ প্রয়াস করতে লাগলো। সারার চিৎকার চেচামেচিতে লোকজন জমা হতে লাগলো। দু একজন পুরুষও সারার সঙ্গে নেমেছিলো সাইফকে বাঁচাতে। সবাই হতবাক হয়ে দেখছিলো এক মায়ের আহাজারি। কোন কাদা মাটিও নেই সেখানে। শক্ত এক মেঝেতে সেদিন দেড় বছরের বাচ্চাটার মাথা দেবে গিয়েছিল। সাঈদ পাশে দাঁড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বলছিলো,
—- বাইয়া, সাপ। বাইয়া, বাইয়া সাপ।
সেই বাচ্চার চোখে কি ধরা দিয়েছিলো কে জানে? কয়েক মিনিটের মাঝেই বাচ্চার হাত পা নড়ানো বন্ধ হয়ে গেলো। সারা বুক কেঁপে উঠলো অনিশ্চয়তায়। একজন দৌড়ে গিয়ে একটা ভাড়ি হাতল নিয়ে আসলো। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। অনেক। সারাও যেন মৃত লাশে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। পাড়ার বাকি মহিলারা তাকে টেনে বের করে আনে সেই ড্রেনের ভাঙা গর্ত থেকে৷ ড্রেনের মেঝে খুঁড়ে একটু পর উদ্ধার করা হয় সারার গর্ভের সন্তান সাইফকে। বাচ্চাটার মুখ কালচে বেগুনি রঙের হয়ে গিয়েছিলো। সাইফকে বের করে এনে এক পাতলা মাদুরের ওপর শুয়িয়ে দেয়। বাড়ি ভরে যায় মানুষের বিস্তৃত সমারোহে। তাদের কানেও পৌছে ছিলো সেই অদ্ভুত মৃত্যুর সংবাদ। নিজের দেড় বছরের বাচ্চাটাকে প্রাণহীন হয়ে পড়ে থাকার যন্ত্রণা বোঝার ক্ষমতা সেদিন আর কারো ছিলো না৷ মানুষ আসে সারার পাশে কয়েক মুহুর্ত বসে সান্ত্বনা দিয়ে ফের চলে যায়। সন্তানের সারা শরীরে সারা তার কোমল হাত বুলালো। কেমন গরম এখনও তার শরীর। মৃদু কণ্ঠে ডেকেছিলো কয়েকবার।
—- সাইফ। সাইফ বাবা৷ বাবা তাকা একবার।
পাগলের মতো চিৎকার করছিলো সেদিন। বারবার জ্ঞান হারিয়েছিলো আরিশের বুকে। ক্লান্ত চোখে যখন মানুষের ভিড়ে চোখ বুলাচ্ছিলো হঠাৎ এক ভয়ংকর প্রতিকৃতির দিকে তার চোখ থমকে গেলো। গোঙাতে লাগলো সে। এতো সেই দিনের অবয়বটা। সারার দিকে তাকিয়ে বিকট স্বরে হাসছে। ঠোঁটের কোণ থেকে গলগল করে ঝরছে তাজা রক্ত। সাইফের দিকে একবার তাকালো সারা। পুরো শরীরে বিষাক্ত কোন জন্তুর আঁচড়ের দাগ। সেদিনের বলে কথা গুলো সারা মনে পড়ে গেলো। সারা সেই দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে আরিশকে অস্পষ্টভাবে বললো,
—- ওই ই মেরে আমার সাইফকে। দেখেন কেমন দাঁড়িয়ে হাসছে। আরিশ আপনি দেখছেন ওকে? আমার ছেলেকে ও মেরেছে।
আরিশ সহ সবাই ভিরের দিকে তাকালো। কেউ নেই। সারা পাগলের ন্যয় আচরণ করতে লাগলো। অবয়বটা হাসতে হাসতে সাঈদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—- আয়। আয়।
সাঈদও যেন দেখতে পেয়েছিলো তাকে। সারার কোল থেকে নেমে সে যেতে চাচ্ছিলো সেই অবয়বের দিকে। সারা সাঈদকে শক্ত করে চেপে ধরলো নিজের বুকের সাথে। ভয়! ভয় তাকে দাবিয়ে দিয়েছে ভেতর থেকে। সারার পাগলামি দেখে আরিশ বাস্তুহারার মতো কাঁদতে লাগলো। স্ত্রীকে যে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। ধীরে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো সে অবয়ব। সাইফকে নিয়ে যাওয়া হলো গোসলের জন্য। সারা সেখান থেকে এক চুলও নড়ে নি। ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলো। অবয়বটা কখনো তার একদম কাছ ঘেঁষে বসেছিলো। আবার চোখের পলকেই নিঃশেষ। সাঈদকে গোসল করিয়ে কাফন পড়িয়ে এনে যখন খাটে রাখা হয় তখন ঘটে যায় এক লোমহর্ষক বাস্তবতা। তার কাফনের নিচ থেকে টপ টপ করে গাঢ় কালাও রক্ত গড়িয়ে পড়ছিলো। ঠিক তার মাথার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো সেই অবয়ব। সারা সবটা দেখছিলো। তবে খাটের নিচ থেকে যে রক্তস্রোত বয়ে যাচ্ছিলো সবাই দেখেছে। অনেকে ক্যামেরায় ভিডিও পর্যন্ত করেছে। এই ঘটনা দেখার পর কেউ একজন দ্রুত ইমামকে খবর দেয়। তবে তিনি আসার পর ঘটনাটা আরো এক মোড় নেয়। সাইফের গায়ের কাফনে এক ফোটা রক্তও ছিলো না। তাহলে এই রক্ত! ইমাম এসে তবুও সাইফের গায়ের কাফন খোলে। শরীরে আঁচড়ের দাগ থাকলেও সেগুলো থেকে রক্ত পড়ছিলো না। ইমাম সাহেব সিদ্ধান্ত দিলেন,
—- বাচ্চার লাশ বেশিক্ষণ রাখা ঠিক হবে না। দাফনের ব্যবস্থা করুন জলদি।
সিদ্ধান্তে আরিশ সহ সবাই মত দিলো। নিজের চাঁদের টুকরো ছেলেকে মুখ বাধার আগে মন ভরে দেখে নিলো আরিশ আর সারা। অফিস শেষ করে বাসায় ফেরার পর এখন থেকে দুটো শরীর তার ওপর ঝাপিয়ে পড়বে না। বাবা হিসেবে নিজেকে বড় অযোগ্য মনে হয়েছিলো তার। সব কার্য শেষ হওয়ার পর সবাই খাটের কাছে উপস্থিত হলো কবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তবে যেই খাট ওঠাতে নিলো মনে হলো এতে কোন বাচ্চা না, বরং একই খাটে কয়েকজন মানুষ শুয়ে আছে। একটা বাচ্চার শরীরের এতো ওজন? কেউ খাটটাকে যেন উঠিয়ে এক মিনিটের জন্যও ভার বইতে পারলো না। ইমাম সহ বাকিরা সবাই দু’য়া পড়তে লাগলো। অবশেষে লাশের ভার বইতে না পেরে ট্রাক দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক কষ্ট করে লাশটাকে ট্রাকের ওপর তোলা হয়৷ আরিশও ছিলো সেখানে। ট্রাকে মজুদ সবাই খেয়াল করলো আবার খাটের নিচ থেকে আবার রক্ত পড়ছে। এবার কাফনের কাপড়ও ভিজে গেলো রক্তে। ট্রাকের উপরের মেঝেও রক্তাক্ত হয়ে গেলো। কিছু সময়ের মাঝেই কবরস্থানে পৌছে গেলো। অবশেষে কবর খুঁড়ে লাশটাকে মাটিতে৷ শুইয়ে দেওয়া হয়। সাইফের সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল রক্তে সিক্ত হয়ে গিয়েছিলো। ছেলের এমন পরিণতি দেখে ক’জন বাবা টিকে থাকতে পারে? নিজ হাতে সেই দেড় বছরের ছোট্ট শরীরটাকে মাটি চাপা দিয়ে এসেছিলো নিজ হাতে। সবাই ফিরে এসেছিল। কেবল আরিশ বসে ছিলো ছেলের কবরের পাশে। এর কিছুদিন পর সারা সিদ্ধান্ত নেয় তার ছোট সন্তানের জন্য দু’য়া করার জন্য গ্রামের বাচ্চাদের এক বেলা ভোজন করাবে। আয়োজনও হয়। সারা এ কয়দিন আর সেই অবয়বটাকে দেখে নি। তবে বাচ্চারা যখন একসাথে বসে খাচ্ছিলো তখন সেই বাচ্চাগুলোর দুপাশে সারা আবার সেই অবয়বকে দেখতে পায়। একই রকম দুটো অবয়ব। সারা সেদিনও পাগলের মতো আরিশকে দেখিয়ে বলেছিলো,
—- ওই দেখো দাঁড়িয়ে আছে। ও আমার সাঈদকেও নিতে চায়।
ছেলে হারানোর কাতরতায় মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছে ভেবে আরিশ তাকে টেনে বাড়ি নিয়ে যায়।
দিব্য এতক্ষণ আরিশের মুখে এসব শুনতে শুনতে কখন যে নিজের চোখ ভিজে এসেছি বুঝে ওঠে নি। আরিশকে সন্তানের জন্য এমন কাতরাতে দেখে তার ভেতরটাও মোচড় দিয়ে উঠেছিল। নিজ আগ্রহে জানতে চাইলো,
—- এরপর?
—- এরপর সারা প্রায়ই সেই অবয়বটাকে আমাদের ঘরে দেখতে পেতো। তাকে ঘুমোতে দেয় না। স্বপ্নে এসে খুব কুরুচিপূর্ণ জিনিস দেখিয়ে যেতো। বার বার বলতো সে সাঈদকে নিতে চায়। সন্তানকে হারিয়ে আর সারা এমন পাগলের মতো দেখে আমি অতিষ্ট হয়ে উঠি। একদিন সারা বিকেলে ঘুমোচ্ছিলো। আমিও তার পাশেই ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ সারার ঘুম ভেঙে যায়। মিটমিট চোখে তাকিয়ে দেখে আমার জায়গায় আমি নেই৷ যেই ভয়ংকর অবয়ব এক বিষাক্ত চাহনিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। গরগর শব্দ করে বললো,
“তোর ছোট পোলাডা কই?”
সারা শোয়া থেকে উঠে উন্মাদের মতো চিৎকার করছিলো আমার নাম ধরে। আমি পাশ থেকে উঠে যাই। উঠে দেখি “সাঈদ” “সাঈদ” করে চিৎকার করছিলো। সাঈদকে দেখার আগ পর্যন্ত কোনমতেই শান্ত হচ্ছিলো না। মা তো। মায়ের মনকি সহজে মানে? এর কিছুদিন পর শোনা গেলো গ্রামের তিনটা বাচ্চাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আর অদ্ভুত ভাবে সে তিনটে বাচ্চাই আমাদের বাসায় খেতে এসেছিলো সেদিন। এর কিছুদিন পর থেকে আমিও সেই আজব অবয়বটাকে দেখি। স্বচক্ষে বা স্বপ্নে। আমাকে শুধু বলতো আমার সাথে যেকোনভাবে জড়িত কোন বাচ্চাকেই সে জীবিত রাখবে না৷ প্রথম প্রথম আমিও ভ্রম মনে করতাম। তারপর দেখলাম কিছুদিন পর পরই এখানে ছোট বাচ্চা মারা যাচ্ছিলো। এরা সবাই আমার বাড়িতে এসেছিলো খেতে। কখনো ড্রেনের জলে ভেসে, কখনো উঁচু গাছে ঝোলানো আবার কখনো নদীতে পাওয়া যেতে লাগলো তাদের মৃত দেহ। ধীরে ধীরে সবাই ভয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে লাগলো। রয়ে গেলাম এই মৃত্যুপুরে আমরা একা। শুধু এই ভয়ে যাই নি যেন আমাদের কারণে নতুন কারো জান দিতে না হয়।
দিব্য নিরব থেকে প্রশ্ন করলো,
—- আপনি এখনো তাকে দেখেন।
—- দেখি। একটু আগেও আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলো।
দিব্য সভয়ে চমকে পেছনে তাকালো। কিছু নেই। একটা নিঃশ্বাস ফেললো সে। আরিশ বললো,
—- ভয় পাবেন না।
—- এর সমাপ্তি কোথায়?
—- জানা নেই। ছেলেটাকে সবসময় চোখে চোখে রাখি। ভয় করে। মা বাবার জীবনই তো আসলে সন্তানদের জন্য উৎসর্গ করে কাটিয়ে দিতে হয়। আমিও না হয় বন্দী জীবন কাটালাম ছেলেটার মুখে তাকিয়ে।
দিব্য অনুমতি আজ্ঞা স্বরূপ বললো,
—- কিছু মনে না করলে আমি একবার স্ত্রী আর ছেলেকে দেখতে পারি?
আরিশ উঠে দাঁড়ায়। দিব্যকে ইশারা দিলো তার পেছনে যেতে। সাবধানে রুমে গেলো দুজন। ক্লান্ত বিষাক্ত জীবনের ছাপ মুখে পড়েছিলো। দিব্য দু’মুহুর্ত দেখে বেরিয়ে গেলো আরিশকে বিদায় জানিয়ে। বলে গেলো এর সমাধান খোঁজার চেষ্টা সে করবে। সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে ভাবলো মানুষের জীবন কতো বিচিত্র। বাড়িটা থেকে বের হয়ে একবার পেছনে ঘুরে তাকালো। এরপর নিজের গাড়িতে উঠে বসলো। স্টার্ট দেওয়ার আগে হঠাৎ দিব্যের ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা তার বাড়ি থেকে করেছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে দিব্যের মা পাগল কণ্ঠে বললো,
—- দিব্য। দিব্য জলদি বাড়ি আয়। তোর বউ সিড়ি থেকে আচমকা পড়ে গিয়েছে। খুব খারাপ অবস্থা। আমরা হাসপাতাল যাচ্ছি।
দিব্যের কান থেকে ফোনটা খসে পড়ে গেলো। তার অনাগত সন্তান আর তার স্ত্রীর হাসিমাখা মুখিটাই চোখে ভাসছিলো। সারা শরীর যেন কাঁপছে। বেখেয়ালি চোখ গাড়ির সামনে চোখ গেলো। দিব্যের মনে হলো তার গাড়ির পাশেই এক অদ্ভুত অবয়ব দাঁড়িয়ে দিব্যের দিকে তাকিয়ে বিকট স্বরে হাসছে।
শেষ