#নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে,পর্বঃ ৮,৯
#আতিয়া_আদিবা
পর্বঃ ৮
লণ্ঠন হাতে নিয়াজ করিম দাঁড়িয়ে আছে। এই ফার্ম হাউজে কোনো ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা নেই। ইচ্ছে করে রাখা হয়নি। সন্ধ্যে হলে চার পাঁচটে গাছ পর পর ঝুলে থাকা লণ্ঠন জ্বলে ওঠে। সেগুলোও রাত নয়টার পর নিভিয়ে রাখা হয়। কারণ, রাত নয়টা হলো জোনাকিদের আগমনের সময়। রাত নয়টা থেকে দশটা এই এক ঘণ্টা জোনাকিরা এদিক সেদিক উড়ে বেড়ায়। টিমটিম করে জ্বলে। কেমন রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
ঠিক দশটার সময় জোনকিগুলো ছুটে যায় প্রস্থানের পথে। আশেপাশে কোনো জংলা নেই। তবুও জোনাকিগুলো কোথা থেকে আসে আবার কোথায় হারিয়ে যায় কেউ জানে না!
নিয়াজ করিম লণ্ঠন হাতে বাড়ির সামনে পায়চারি করছেন। আজ তার নাতনী বর্ষার আসার কথা। হিসেব মতো এতক্ষণে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে গেছে। গাড়ি পাঠানো হয়েছে। ড্রাইভার হাসিবের সাথে ফারুককেও পাঠানো হয়েছে। ফারুক বিশ্বস্ত লোক। দীর্ঘদিন ধরে নাজিমের সাথে আছে। এ যুগে বিশ্বস্ত লোক পাওয়া দুরূহ।
এই ফার্ম হাউজের বাড়িটি অতি সাধারণ। পাকা বাড়ি তবে বাড়ির ছাদ চালের। আকাশী রঙের চাল। বারান্দায় লাল রঙের গ্রীল। বাড়ির পেছোনে ছোট একটি পুকুর। এই পুকুরে মাছ চাষ করা হয়। বাড়ির সামনে সাড়ে আটশ ডেসিমলের মতো জায়গা। একপাশে সবজি চাষ করা হয়। আরেক পাশ খোলামেলা। ফুলগাছ আছে। বসার জায়গা আছে। তবে বেশ কয়েকমাস ধরে একটি সীম কোম্পানি জায়গাটায় টাওয়ার বসাতে চাচ্ছে। নিয়াজ সাহেব নিমরাজি। পুরোপুরি রাজি হতে পারছেন না। তবুও আগামীকাল কোম্পানি থেকে লোক পাঠানো হবে। এবিষয়ে আলাপ আলোচনা করা হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দেখা যাক! কি হয়।
বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে চুরুট ধরালেন নিয়াজ। রান্নাঘর থেকে শুটকি মাছের বিশ্রি গন্ধ আসছে। শুটকি মাছ বর্ষার পচ্ছন্দ। তার জন্যই এই আয়োজন করা হচ্ছে। ছোট আলু আর টমেটো দিয়ে শুটকির ঝোল। বেশ মাখা মাখা করে। রন্ধনশিল্পী মালা। মেয়েটা অল্পবয়স্ক কিন্তু নিদারুণ রান্নার হাত! যাই রাঁধে স্বাদে মনে হয় অমৃত। জানালার কাছে রেডিও রাখা। নিয়াজ সাহেব রেডিও ছাড়লেন। ফ্রিকোয়েন্সি ধরা কষ্টসাধ্য। অনেক চেষ্টার পর দু একটি চ্যানেল যাও ধরা যায়, তবে ঝিরঝির শব্দ সমেত।
রেডিওতে একটি মেয়ে খবর পড়ছে। সন্ধ্যে সাতটার খবর। খবর শুনতে শুনতে নিয়াজ সাহেবের ঝিমুনি চলে এলো।
ক্ষণিককাল বাদে তার ঝিমুনি কেটে গেলো গাড়ির হর্ণ শুনে। তিনি পুনরায় লন্ঠন হাতে বাড়ির বাইরে এলেন। আমগাছটার পাশে গাড়ি থেমেছে। ঘোলা চোখে নিয়াজ সাহেব দেখলেন, শাড়ি পরা কোনো রমণী গাড়ি থেকে নামলো। ফারুক তাকে এক হাতে ধরে রেখেছে।
মেয়েটা ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। দু কদম ফেলে নেতিয়ে যাচ্ছে।
নিয়াজ সাহেব দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন। অস্থির হয়ে বললেন,
কি হয়েছে? কি হয়েছে আমার নাতনির?
ফারুক ভয়ার্ত গলায় জবাব দিলো,
স্যার, বর্ষা আপার জ্বর। অনেক জ্বর।
নিয়াজ সাহেব বর্ষার গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন,
একিরে! জ্বরে গা পুরে যাচ্ছে। সর্বনাশ করেছিস। মাথায় পানি ঢালতে হবে। জ্বর বাঁধালি কিভাবে?
বর্ষা স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলো,
ইচ্ছে করে বাধিয়েছি। অনেকদিন অসুস্থ হই না। আজকে হতে ইচ্ছে হলো।
নিয়াজ বললেন,
তোর পাগলাটে স্বভাব কি যাবে না?
বর্ষা ফ্যাকাসে হাসলো।
তাকে দ্রুত ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। মাথায় পানি ঢালা হলো। নিয়াজ করিম ভেবেছিলেন নাতনি কে নিয়ে আজ জোনাকিদের মেলা দেখবেন। কিন্তু প্রচন্ড জ্বরে বর্ষা অচেতন প্রায়। চোখ মেলতে পারলো না। সেদিন রাতে ফার্ম হাউজের লণ্ঠনও নেভানো হলো না। জোনাকি পোকারাও আসলো না।
শিহাবের প্রতিটি কাজকর্ম বাচ্চাদের মতো হলেও সিগারেট খাওয়ার মাঝে ভিন্নতা আছে। অন্যমনস্ক হয়ে হালকা বাদামী ঠোঁটে সিগারেট ছুঁইয়ে ফরফর করে ধোঁয়া ছাড়ে।
এখনো ফিলিং স্টেশনের পাশে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে সে।
গাড়িতে গ্যাস ভরা হচ্ছে। অফিসের গাড়ি। তাকে সখীপুর পাঠানো হচ্ছে। এক্টেল এর নেটওয়ার্ক খুব ঝামেলা করে এদিকটায়। টাওয়ার বসানো আবশ্যক। সে বিষয়েই কথা বলতে যাওয়া হচ্ছে। এক ভদ্রলোকের বিশাল বড় ফার্ম হাউজ আছে। সেখানেই টাওয়ার বসানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু ভদ্রলোক রাজি হচ্ছে না। কিঞ্চিৎ জায়গার জন্যেও মাসে মাসে চল্লিশ হাজার টাকা দিতে চাইছে কোম্পানি। তবুও ভদ্রলোকের কোনো আগ্রহ নেই। আজ শিহাবকে পাঠানো হচ্ছে। ক্লাইন্টদের বশে আনার জাদুকরী ক্ষমতা এই ছেলেটার আছে। দেখা যাক, আলোচনাসূত্রে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় কিনা!
গ্যাস নিয়ে গাড়ি পুনরায় ছুটতে শুরু করলো নির্ধারিত গন্তব্যে।
ড্রাইভারের নাম তুফান। তার নাম নিয়ে শিহাবের বিস্ময়ের সীমা নেই। কৌতুহল মেটাতে একদিন জিজ্ঞাসা করলো,
ভাই আপনার নাম তুফান কেনো?
ড্রাইভার তৃপ্তির হাসি হেসে উত্তর দিলো,
আমি জন্মানোর পর আম্মায় স্বপ্ন দেখছিলো তুফানের নাগালা প্লেন উড়াইতেছি। হের লেইগা নাম রাখছে তুফান। তয় প্লেন তো উড়াবার পারি না। তুফানের নাগাল গাড়ি ছোটাই। ছুটামু?
শিহাব বলল,
ছুটান দেখি।
ড্রাইভার গাড়ির দ্রুত গতিতে চালাতে লাগলো। এত দ্রুত যেনো পাখা লাগিয়ে দিলেই গাড়ি উড়তে শুরু করবে!
শিহাব ভড়কে গেলো। এর পর থেকে ড্রাইভার তুফান গাড়ি চালালেই শিহাব ভয়ে আঁটসাঁট হয়ে বসে থাকে।
এখনো শিহাব সীটের সাথে একেবারে সেঁটে বসে আছে। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো,
গান শুনবেন ভাই?
না। এখন গান শুনতে ইচ্ছে করছে না। আমাদের পৌঁছাতে আর কতক্ষণ সময় লাগতে পারে?
আধা ঘণ্টার মতন।
খুব ভালো।
শিহাব পকেট থেকে মাউথ ফ্রেশনার বের করলো। দুটো পাফ নিলো।
তুফান লুকিং গ্লাসের দিকে তাঁকিয়ে অবাক চোখে বলল,
ও ভাই। গতরের জিনিস মুখে লন ক্যান?
শিহাব নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
গতর! গতর কি জিনিস? হোয়াট ইজ দ্যাট!
গতর মানে অইলো শইল। শইলের জিনিস মুখে দ্যান ক্যান? ইস্প্রেরে মানুষ শইলে দেয় না। নইলে গন্ধ করে।
ও আচ্ছে! এটা মাউথ ফ্রেশনার। এটা মুখের স্প্রে।
এইডা দিয়ে কি হয়?
এই যে একটু আগে সিগারেট খেলাম, এটা দিলে মুখে সিগারেটের গন্ধটা থাকবে না।
ও! আইচ্ছা।
তুফান ক্ষণিককাল চুপ করে রইলো। তারপর ইতস্তত করে বলল,
ভাই একডা কতা কই?
জ্বি বলেন।
কথাডা অবশ্য লজ্জার। কিন্তু আপনি তো ভাই মানুষ কওয়াই যায় তাই না?
শিহাব বলল,
জ্বি।
ড্রাইভার হতাশ গলায় বলল,
আমার বউডা কাছে গেলেই কয় মুখ দিয়া বিড়ির গন্ধ করে। এইডা দিলে তো আর করবো না তাইনা?
শিহাব বলল,
না।
তাইলে আমি একডা কিনুম।
শিহাব হেসে ফেললো।
চলবে…
#৯ম_পর্ব
#আতিয়া_আদিবা
সূর্যের সরু আলো ঝাঁকড়া গাছটির পাতার ফাঁক দিয়ে লম্বালম্বি এসে মাটি স্পর্শ করছে। সেই ঝাকড়া গাছটার নিচে বর্ষা বসে আছে। শীতল পাটি পেতে। গায়ে এখনো হালকা জ্বর আছে। নিয়াজ সাহেব নাতনির পাশে বসে বই পড়ছে। চোখে সোনালি রঙের চশমা। বর্ষা তাঁর দিকে তাঁকিয়ে আছে অপলক। লোকটি তার আপন দাদা নয়। বাবার বড় চাচা। কিন্তু বর্ষাকে প্রচন্ড আদর করেন। তার নিজের দাদা তাকে এতটা আদর করতেন কিনা কে জানে!
ধবধবে ফর্সা শরীর নিয়াজ করিমের। চামড়া এ জায়গায়, ও জায়গায় ঝুলে গেছে। তবুও কি পবিত্র শুভ্রতা ছড়িয়ে আছে চোখে মুখে।
বর্ষা দাদুর বুকে মাথা রাখলো। নিয়াজ নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আচমকা বর্ষার ভীষণ কান্না পেলো। সে ভাবলো, এ মানুষটার বুকে মাথা রেখে ক্ষণিককাল আয়েশ করে কেঁদে নেওয়া যাক।
বর্ষার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগলো। সূর্যের আলোয় সেই অশ্রুজল চিকচিক করছে। নিয়াজ করিমের সাদা গেঞ্জি ভিজতে শুরু করছে। তিনি বুঝলেন। বর্ষা কাঁদছে। বইটার মাঝে ফিতা গুঁজে পাশে রেখে দিলেন। নাতনিতে পরম আবেগে জড়িয়ে ধরলেন। মেয়েটা কাঁদুক।
তার বুকে মাথা রেখেই তো মেয়েটা মনের সব কষ্ট উজাড় করে কাঁদার সাহস পায়!
পরম মমতায় মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে নিয়াজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
হ্যা রে! তোর মূর্খ বাপ আবার কিছু বলেছে?
বর্ষা মাথা নাড়ালো। বলল,
হু বলেছে। আচ্ছা দাদাজান, আমি কি খুব খারাপ?
নিয়াজ বললেন,
মোটেও না। তুই খারাপ হবি কেনো?
স্কুলের গন্ডি পেরোতে না পেরোতেই একজন ভুল মানুষকে ভালোবাসলাম। ভালোবেসে হারিয়েও ফেললাম। বিষয়টা নিয়ে জানাজানি হলো। পরিবারের সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিলাম। ওইটুকুন বয়সে কেউ প্রেম করে? আমি খারাপ না?
প্রেমের কি বয়স আছে রে? প্রেম হলো এক পবিত্র অনুভূতি। এমন এক অনুভূতি যা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এই অনুভূতি বয়স, ধর্ম, বর্ণ কিচ্ছুটি মানেনা! আপন গতিতে এগিয়ে চলে। জাগ্রত নদীর স্রোতের মত বাঁধাহীন ভাবে এগিয়ে চলে। কল কল। কল কল। কল কল।
ছেলেটার কথা এখনো মনে পরে?
বর্ষা নরম গলায় বলল,
পরে।
কতগুলো বছর পেরিয়ে গেলো! এখনো ভুলতে পারিস নি।
বর্ষা দুদিকে মাথা নাড়ালো। এর মানে হলো না। সে এখনো ভুলতে পারে নি।
নিয়াজ করিম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
আর কতদিন এই বুড়োর বুকে মাথা রেখে চোখের জল ফেলবি? আমার সময় ঘনিয়ে আসছে। তোকে যদি ভালো কোনো মানুষের হাতে তুলে দিতে পারতাম। শেষ নিশ্বাস শান্তিতে ফেলতে পারতাম!
বর্ষা চুপ করে রইলো।
শেষ যেবার হেফাজতের সাথে কথা হলো, কোন এক পাত্রর কথা যেনো বলেছিলো। বড় এক কোম্পানিতে চাকরি করে। দেখতে শুনতে ভালো।
হু। বাংলিশ পাত্র।
বাংলিশ পাত্র মানে?
মানে ছেলে বাঙ্গালী কিন্তু ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র। বাংলা শব্দ উচ্চারণ করতে দাঁত কপাটি যেনো খুলে আসে।
নিয়াজ করিম নাতনির কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন,
তোর পচ্ছন্দ হয়নি?
না।
বাংলিশ ছেলে বলে পচ্ছন্দ হয় নি? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
ছেলে বাছুর প্রকৃতির।
বাছুর প্রকৃতির!
বয়স অল্প দেখে বাছুর বললাম। আরেকটু বড় হলে সোজা গরু বলতাম।
সে আমি বুঝতে পেরেছি। তোর বাবার পচ্ছন্দ হয়েছে মানে একই গোত্রের হবে। গরু গোত্রের। কথায় আছে না? মানিকে মানিক চিনে, রতনে চিনে রতন।
ঠিক বলেছো, দাদাজান।
দাদা আর নাতনি দুজনেই হেসে উঠলো।
একটু দূরে ফারুক দাঁড়িয়ে আছে। সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। সীম কোম্পানি থেকে লোক এসেছে। স্যারের সাথে কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু এই মুহুর্তে তার কাছে যাওয়াটা তিনি পচ্ছন্দ করবেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না।
উপায় না পেয়ে, খানিকটা ইতস্তত করে ফারুক এগিয়ে গেলো। নিয়াজ করিম চশমা ঠিক করে বললেন,
কিছু বলবে ফারুক?
জ্বি স্যার।
বলে ফেলো। জ্বি স্যার বলে বাঁশের মত দাঁড়িয়ে আছো কেনো?
স্যার, সীম কোম্পানি থেকে লোক এসেছে।
আবার?
জ্বি স্যার। খুব অনুরোধ করছে। আপনার সাথে একটিবার কথা বলতে চায়।
নিয়াজ করিম ক্ষণিককাল চুপ করে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বললেন,
ঠিকাছে পাঠিয়ে দেও।
এখানে পাঠিয়ে দিবো স্যার?
হ্যাঁ। কেনো? কোনো সমস্যা আছে?
ফারুক একবার আঁড়চোখে বর্ষার দিকে তাঁকিয়ে বলল,
না স্যার। কোনো সমস্যা নেই।
ঠিকাছে যাও। আর শোনো। কথায় কথায় স্যার বলবে না। খুবই বিশ্রি শোনায়। শব্দের গাঁথুনি হবে শ্রুতিমধুর। তোমার শব্দের গাঁথুনি বিশ্রি। বুঝেছো?
বুঝেছি স্যার।
নিয়াজ করিম হতাশ ভঙ্গিতে বর্ষার দিকে তাঁকালো। বর্ষা ফিঁক করে হেসে ফেললো।
শিহাব গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল বড় জায়গা। কত ধরনের সারি সারি গাছ। তিন চার গাছ পর পর আবার লণ্ঠন ঝুলছে। চারিদিকে পাখিদের কিচির মিচির শব্দ। কিছুদূরে সুন্দর গোলাকার উঁচু সিমেন্টের বেদি। উপরে ছাতার মত টিনের চাল। বৃষ্টির সময় নিশ্চয়ই ভীষণ সুন্দর টুপ টুপ শব্দ হয়!
এখানে টাওয়ার বসানো নিয়ে মালিকের অনাগ্রহী হওয়ার কারণ কিছুটা আঁচ করা গেলো। এ জায়গার দাম চোখ বন্ধ করে কয়েক কোটি টাকা হবে। সে পঞ্চাশ হাজার টাকার বিনিময়ে অবশ্যই এ জায়গার সৌন্দর্য নষ্ট করতে চাইবেন না।
তবুও তাকে চেষ্টা করতে হবে।
ফারুককে আসতে দেখা গেলো। শিহাব নড়েচড়ে উঠলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলো। ফারুক হাসিমুখে বলল,
স্যার, বাড়ির বাইরে বসে রোদ তাপাচ্ছে।
শিহাব রোদ তাপানোর মানে বুঝলো না। তবুও তার ভঙ্গিমায় বোঝালো বিষয়টা তার বোধগম্য হয়েছে। সে প্রশ্ন করলো,
তার রোদ তাপানো শেষ হওয়া পর্যন্ত উই হ্যাভ টু ওয়েট রাইট?
ফারুক ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে। ইংরেজীতে ভীষণ কাচা। তবুও বুক ফুলিয়ে দু চারটে ভুল ইংলিশ আওড়াতে সে ভালোবাসে। সামনে আপাদমস্তক বাংলিশ বাবু দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। দাঁত কপাটি বের করে বলল,
হোয়াই লেট? স্যার এক্ষুণি আমার সাথে আপনাকে যেতে বলেছে। নো সমস্যা। উই গো নাউ।
শিহাব হেসে বলল,
অলরাইট।
ফারুক শিহাবকে পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। কিছুদূর যাওয়ার পর শিহাব জিজ্ঞেস করলো,
প্রতিটি গাছে লাইট লাগানো দেখলাম। ডেকোরেশনের জন্য?
ওগুলা লণ্ঠন স্যার।
লণ্ঠন? এটা কি জিনিস?
স্যার কেরোসিন তেল দিয়া ধরাইতে হয়। আমাদের এখানে ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা নাই।
ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা নেই? কেনো!
স্যারের ইচ্ছা। এই জায়গার সে মালিক। মালিকের ইচ্ছা মতোই সব হয়। উনার অন্ধকার বেশি পচ্ছন্দ।
শিহাব চোখ বড় বড় করে বলল,
ইটস হরিবল। উনার ছেলে মেয়ে নেই?
একটা ছেলে আছে। দেশের বাইরে পড়তে পাঠাইছিলো। এরপর আর যোগাযোগ করে নাই। মেয়েটা ক্যান্সারে মারা গেছে অনেক বছর আগে।
স্যাড।
তবে উনার একটা নাতনি আছে। সে মাঝে মাঝে এসে থাকে। দিন কয়েক থেকে চলে যায়।
আই সি!
আমরা প্রায় চলে আসছি। স্যারের সাথে নরম গলায় কথা বলবেন।
অফ কোর্স। বলবো।
আর স্যারের সামনে তার নাতনির দিকে ভুলেও তাঁকাবেন না।
শিহাব ভড়কে গিয়ে বলল,
তার নাতনি এখানে আছে নাকি?
জ্বি। গতকাল রাতে আসছে। উনার দিকে তাঁকাবেন না। তাঁকাইলে ভাববে আপনার চরিত্রে দোষ আছে। আর চরিত্র দোষ আছে এমন মানুষ স্যার দেখতে পারেন না।
শিহাব বলল,
নো। না। আই ওন্ট লুক এট হিজ গ্র্যান্ড ডটার।
ফারুক তৃপ্তির হাসি হেসে বলল,
গুড। ভেরি গুড। আপনার তো ভেরি গুড চরিত্র। ভেরি গুড চরিত্র!
চলবে