নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে,১০ম_পর্ব,১১

0
953

#নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে,১০ম_পর্ব,১১
#আতিয়া_আদিবা
#১০ম_পর্ব

দূর থেকে ফারুককে আসতে দেখে নিয়াজ করিম তার নাতনিকে বললেন,
তুই বোস। আমি জামাটা পাল্টে আসি। হাজার হলেও একটি বড় কোম্পানি থেকে দেখা করতে লোক এসেছে। আমি এই জায়গার মালিক। জামাকাপড়ে একটা মালিক মালিক গন্ধ থাকা প্রয়োজন।
বর্ষা বলল,
জামাকাপড়ে আবার মালিক মালিক গন্ধ কিভাবে থাকে দাদাজান?
নিয়াজ করিম বললেন,
থাকে থাকে! জামাকাপড়ে আভিজাত্যের ছোঁয়া থাকে। কাপড়টা পাল্টে ফিরে আসি তখন দেখিস।
বর্ষা হেসে বলল,
ঠিকাছে এসো।
নিয়াজ করিম নিজের ঘরের দিকে এগোলেন।

শীতল পাটিতে যত্ন করে রেখে দেওয়া বইটি বর্ষা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ তার ভীষণ ভালো লাগে। সে বইয়ের মাঝে নাক গুঁজে বুক ভরে শ্বাস নিতে লাগলো।

ফারুক শিহাবকে নিয়ে এদিকটায় চলে এসেছে। নিয়াজ করিমকে কোথাও দেখতে না পেয়ে সে বর্ষাকে প্রশ্ন করল,
আপা স্যার কই?
বর্ষা ফারুকের দিকে না তাঁকিয়ে উত্তর দিল,
দাদাজান ভেতরে গিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। যে ভদ্রলোকের আসার কথা ছিল তিনি এসেছেন?
জি আপা। এই তো পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন।
শিহাব ক্ষীণ গলায় সালাম দিল,
আসসালামু আলাইকুম।

গলার স্বর শুনে চমকে উঠল বর্ষা। কি পরিচিত গলার স্বর! এই গলার স্বর সে আগে কোথাও শুনেছে। কিন্তু কোথায় শুনেছে?
বর্ষা মুখ তুলে তাঁকালো। শিহাব ও তার দিকে তাঁকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই দুজনের চক্ষু যেনো ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইলো।
শিহাব অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
আপনি এখানে?
বর্ষা স্বাভাবিক গলায় বলল,
এত অবাক হওয়ার কি আছে? এ ফার্ম হাউস আমার দাদার। আমি যখন খুশি আসতে পারি। এই প্রশ্ন তো আমার আপনাকে করা উচিত। আপনি এখানে কেন এসেছেন?

আমি এসেছি কোম্পানির কাজে।

বেশ তো! কাজ করে চলে যান।

না মানে। আপনার সাথে এখানে দেখা হয়ে যাবে ডিডেন্ট এক্সপেক্ট দ্যাট!

বর্ষা ফারুকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বর্ষার মুচকি হাসির অর্থ একেক সময় একেক রকম। এখন এই মুচকি হাসির অর্থ ধরা যেতে পারে – ফারুকের প্রস্থান কামনা। ফারুক বর্ষার মুচকি হাসির অর্থ ধরতে পেরেছে কিনা বোঝা গেল না। তবুও সে মাথা নিচু করে চলে গেল।

ফারুক চলে যেতেই বর্ষা আগ্রহ ভরা কন্ঠে শিহাবের কাছে জানতে চাইল,

আগে থেকে এক্সপেক্ট করলে কি করতেন? এখানে আসা ক্যানসেল করে দিতেন? নাকি পুনরায় বিয়ের প্রস্তাব দিতেন?

শিহাব ঢোঁক গিলে বলল,
না ক্যানসেল কেন করব। কোম্পানির জন্য আসতেই হত।

তাহলে এমন বলদ টাইপ চেহারা কেন বানিয়ে রেখেছেন?

না মানে! আনএক্সপেক্টেড ভাবে দেখা হয়ে গেল তো। তাই আর কি।

আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?

Not at all. ভয় কেন পাব? Is there any reason to be afraid?

বর্ষা হাসি চাপিয়ে নরম সুরে বলল,
ভাবতেই পারেন আমার দাদাও ২৪ ঘন্টার জন্য আপনার সাথে কোন এগ্রিমেন্ট যাবে কিনা!

শিহাব কিছু একটা বলতে চাইল। কিন্তু বলতে পারল না। কেননা, বর্ষার দাদা নিয়াজ করিমকে এদিকটায় আসতে দেখা গেলো।
বর্ষা ফিসফিস করে বলল,
ভয় নেই। আমার দাদা আইনের ছাত্র ছিলেন না।

এটুকু বলেই সে ক্ষান্ত হলো না। মুখ চাপিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো। শিহাব লক্ষ করল বর্ষা হাসলে বাম গালে ছোট্ট একটি টোল পরে। বেশি গভীর নয়। খুব মনোযোগ দিয়ে তার হাসি পর্যবেক্ষণ করলে এই টোলের অস্তিত্ব টের পাওয়া সম্ভব। শিহাব চোখ ফিরিয়ে নিলো।

নিয়াজ করিম এসেছেন ধুতি পাঞ্জাবি পরে। গায়ে চাদর জড়ানো। মুখে চুরুট। তার পিছে পিছে মালা এসেছে। হাতে দুটো চেয়ার। ঝাঁকড়া গাছটার কিছু দূরে চেয়ার দুটো ফেলা হলো। শিহাব নিয়াজ করিমকে সালাম দিলো। নিয়াজ করিম সালামের উত্তর দিলেন না। ভ্রুঁ কুঁচকে বললেন,
আপনার চেহারা সুরাত তো ভালোই আছে!

শিহাবকে অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
সর‍্যি স্যার?

বললাম, আপনার খোমা সুন্দর। ফেইস কাটিং। আগের বার আপনার কোম্পানি থেকে যে লোক এসেছিলো তার মুখ ছিলো ছিলা মুরগীর মতো। দাঁড়ি কামানো ছেলে সমান সমান ছিলা মুরগী।

শিহাব ছোট্ট করে ঢোক গিললো। নিয়াজ করিম চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,
দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? চেয়ারে বসেন।

শিহাব পরিপাটি ভাবে চেয়ারে বসলো। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
ভালো আছেন, স্যার?

নিয়াজ করিম ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
ভালো আছি কিনা জানি না। তবে বেঁচে আছি কিন্তু শান্তিতে নাই। দুইদিন পর পর যদি টাওয়ার বসানোর জন্য আপনাদের কোম্পানি থেকে এভাবে লোক পাঠায় কীভাবে শান্তিতে থাকবো? অথচ এই বয়সে আমার শান্তিতে থাকার কথা। হাতে একটা তসবি থাকবে। মাথায় থাকবে টুপি। বাড়ির সামনে হাঁটবো আর আল্লারে ডাকবো। অথচ এসব কিছুই করতে পারছি না। সিম কোম্পানির ঝামেলা সহ্য করতে হচ্ছে।

শিহাব বলল,
সর‍্যি স্যার! আসলে এক্টেল এর নেটওয়ার্ক এদিকটায় পাওয়া অনেক বেশি টাফ! তাই একটা টাওয়ার বসানো ইজ ব্যডলি নিডেড। আপনি যদি একটু কনসিডার করতেন!

আমার উত্তর আমি পূর্বেও জানিয়েছি, এখন আবার জানাচ্ছি। মাসে লাখ টাকার বিনিময়েও এইখানে আমি টাওয়ার বসাতে দিবো না।

শিহাব আরো কয়েকবার বিভিন্ন অফারের মাধ্যমে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করলো। ফলাফল শূন্য।
মালা ট্রেতে করে চা, বিস্কুট ও কেক নিয়ে এসেছে।
নিয়াজ বললেন,
সময় নষ্ট করে লাভ নেই বাপু। চা খেয়ে চলে যান। এই ফার্ম হাউজে কোনো টাওয়ার বসবে না।

এমন সময় ঘরের ভেতোর টেলিফোন বেজে উঠলো। নিয়াজ বিরক্ত মুখে টেলিফোন ধরতে উঠে গেলেন।
তিনি বাড়ির ভেতর ঢুকতেই বর্ষা গুটি গুটি পায়ে শিহাবের দিকে এগিয়ে আসলো।

শিহাব এতক্ষণ চায়ের কাপ স্পর্শও করেনি। বর্ষাকে দেখে কাপ হাতে নিয়ে ছোট্ট করে চুমুক দিলো।
বর্ষা হেসে বলল,
কাজ হয়েছে?

শিহাব অসহায় ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো। বর্ষা ক্ষণিককাল চুপ থেকে বলল,
আপনি চাইলে দাদাজানকে অনুরোধ করে দেখতে পারি। উনি আমার কথা ফেলতে পারবেন না।

শিহাবের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
সত্যি? আপনি রিকুয়েস্ট করবেন তাকে?

রিকুয়েস্ট করা তো আহামরি কিছু না। এতে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। করা যেতেই পারে।

এই প্রজেক্টটা ফাইনাল না করতে পারলে জবটা আমার নাও থাকতে পারে। প্লিজ হেল্প মি, বর্ষা!

শিহাবের মুখে এই প্রথম নিজের নাম শুনলো বর্ষা। অজানা এক ভালোলাগার শীতল অনুভূতি ছুঁয়ে গেলো তাকে। বেচারার জন্য কিছুটা মায়াও লাগলো।

বর্ষা গলা পরিষ্কার করে বলল,
আপনার উপকার করে আমার কি লাভ? আমি কি পাবো?

শিহাব বলল,
আপনি যা চান। হোয়াট এভার ইউ ওয়ান্ট!

বর্ষা চিন্তার ছিপ ফেললো। তার ছিপে বড় সড় সাইজের দুষ্ট বুদ্ধি আটকা পরলো। সে হাসিমুখে বলল,
ইংলিশ বাবু! আপনার ক্ষণে ক্ষণে ইংরেজি আওড়ানোটা বন্ধ করতে হবে। এরপর যখন আসবেন খাঁটি বাংলায় কথা বলতে হবে। পারবেন?

শিহাব বিস্মিত স্বরে বলল,
ইট’স নট পসিবল! আমিতো ঠিকমতো বাংলা পড়তেও জানি না।

বর্ষা হাসিমুখে বলল,
কোনো সমস্যা নেই! বাজারে অনেক বই পাওয়া যায়। ‘দশ দিনে ইংরেজিতে বাঘ’ টাইপের। আপনি ‘দশ দিনে বাংলায় সিংহ’ টাইপ বই খুঁজবেন। প্রয়োজনে ঢাকার নীলক্ষেতে যাবেন। বুঝেছেন?

শিহাব হতভম্বের মত বর্ষার দিকে তাঁকিয়ে রইলো।
বর্ষা বলল,
আবার বলদের মত চেহারা করেছেন? শোনেন, এই একটা মাত্র কন্ডিশন। ভেবে দেখুন কি করবেন। চলি, ইংলিশ বাবু! শুভ কামনা।

বর্ষা আর দেরী করলো না। উলটো ঘুরে ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ির দিকে এগুতে লাগলো।

চলবে

#পর্ব_১১
#আতিয়া_আদিবা
শিহাব নীলক্ষেতের একটি বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি অশ্লীল একটি বইয়ের দিকে। এ ধরনের বই বিক্রি করা হয় এ বিষয়ে শিহাবের ধারণা ছিল না। কাজেই তার চাহনীতে বিস্ময় ঝরে পরছে।
দোকানে উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের ভিড়। যদিও বইয়ের অভাব নেই। ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরির বই ঢালাওভাবে ছড়িয়ে রাখা আছে। তবুও ছেলেমেয়েগুলো অশ্লীল নাম লিখা বইগুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। মাঝে মাঝে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। যেন এসব বইয়ে মজার কোন গল্প লিখা আছে।

শিহাবকে বিচলিত দেখাচ্ছে। দশ দিনে বাংলায় বাঘ অথবা সিংহ হওয়া যায় এই টাইপের বই তাকে সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু এই ধরনের বইয়ের দেখা এ দোকানে মিলছে না। এই দোকানে আসার আগে বেশ কয়েকটি দোকান সে ঘুরে দেখেছে। সেসকল দোকানেও এরকম বইয়ের হদিস মিলে নি। গোটা নীলক্ষেত চষে বেড়ালেও এমন বই পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে!

দোকানদার অনেকক্ষণ ধরে শিহাবকে লক্ষ করছিলো। কোনো বই হাতে নিয়ে দেখছে না বলে সে তাকে জিজ্ঞেস করল,
ভাই কি বই নিবেন?
শিহাব অনুনয়ের সুরে বলল,
আপনার কাছে কি এমন কোন বই আছে যে বই পড়লে দশ দিনে বাংলার বাঘ হতে পারবো?

বাংলার বাঘ তো একটাই ভাই। রয়েল বেঙল টাইগার। আপনি রয়েল বেঙল টাইগার হতে চান?

না। না। আমি ভালো বাংলা শিখতে চাই।

দোকানদার ক্ষণিক কাল বিস্মিত চোখে শিহাবকে পর্যবেক্ষণ করল। তারপর বলল,
ভাই আপনিতো অনেক সুন্দর বাংলা বলতে পারেন। বাংলায় বাঘ হবার বই লাগবে কেন?

শিহাব হাসিমুখে বলল,
আমি মোটামুটি বাংলা বলতে পারি। পুরোপুরি পারিনা। That’s why I need the book.
দোকানদার মাথা চুলকে বলল,
বাঘ-সিংহ হওয়া যাইব এমন বই নাই ভাই। তবে শুদ্ধ বাংলা শিক্ষার বই আছে। নিবেন?
শিহাব বলল,
এই বইটা নিলে কাজ হবে কিনা বুঝতে পারছি না। যে আমাকে বইটা নিতে বলেছে তার কাছে শুনে তারপর জানাচ্ছি। প্রবলেম হবে?

দোকানদার অবাক দৃষ্টি মেলে বললো,
প্রবলেম হবে কেন?

থ্যাংকস।

শিহাব দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। দোকানদার সন্দেহের চোখে শিহাবের দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটার কথাবার্তা পাগলের মত। সে পাগল কিনা তা ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তবে মানুষটা যে স্বাভাবিক না এতে কোন সন্দেহ নেই। দোকানদার গলা থেকে গামছা সরিয়ে বইগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বিড় বিড় করে বললো,
পাগল-ছাগল কাস্টমার।

বর্ষা ঘরে শুয়ে ছিল। তার জ্বর এখনো পুরোপুরি সারেনি। অসুস্থতা নিয়ে বর্ষার মাঝে বিরক্তি ভাব চলে এসেছে। যতটা আগ্রহ নিয়ে সে অসুস্থ হতে চেয়েছিল, সেই আগ্রহের ছিটেফোটাও এখন তার মাঝে নেই। নিয়াজ করিম হাঁটতে বেরিয়েছেন। সাথে ফারুককে নিয়ে গেছেন। বাড়িতে মালা আছে। তাকে এক মগ গরম পানি দিয়ে যাওয়ার কথা বলতে হবে। গলা দিয়ে ফ্যাসফ্যাস শব্দ বের হচ্ছে। হালকা কুসুম গরম পানিতে নুন মিশিয়ে গরগরা করতে হবে। মালাকে ডাক দেওয়াটাও এই মুহুর্তে বর্ষার জন্য কঠিন বিষয়। সে এখন রান্নাঘরে। তাকে দিনের বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরেই পাওয়া যায়। অদ্ভুত বিষয়, কাজকর্ম শেষ করেও সে রান্নাঘরেই বসে থাকে।
বর্ষা মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করেছিল,
কিরে মালা? সারাদিন রান্না ঘরে বসে বসে কি করিস? কাজকর্ম শেষ হলে একটু এদিকটাতেও তো আসতে পারিস!
মালা হেসে উত্তর দিলো,
আমার পাকঘরে থাকতেই ভালো লাগে।
কেন?
এই বাড়ির পাকঘরের বাসনা, আর আমগো বাড়ির পাকাঘরের এর বাসনা একই রকম। নিজের বাড়ি বইলা মনে হয়।

বাড়ির কথা অনেক মনে পরে?
পরে।
তাহলে যাস না কেন? দাদাজানকে বলে কয়দিন ঘুরে আসলেই পারিস।
মালা বিষন্ন হাসি হেসে বলে,
বাড়িতে জায়গা হইলে তো যামু! সৎ মায়ের যা অত্যাচার‌, সহ্য করা যায় না। এইখানেই ভালো আছি আমি।
তোর বাবা কিছু বলেনা?
বাপে কি কইবো। ওই মহিলা তো ডাকাইত। আমারে ঘরে রাখলে ডাকাইত মহিলা বাপেরে খাবার দিব না। তাই আমিও যাই না। তাছাড়া স্যারে আমারে মেলা আদর করে। আমি এইখানেই হাসিখুশি আছি।
তোর বাবা তোকে দেখতে আসে না?
আগে প্রতিমাসে আসতো। বেতন নিবার। এখন আর আসে না। ওই ডাকাইত মহিলা বাপেরে এইখানে আসবার দেয় না। আইসা কি করব? দাদাজান আমার বেতনের টাকা ব্যাংকে রাখতেছে। কইছে এই টাকা আমার ভবিষ্যতে কামে লাগবো। টাকাও পায়না, তাই দেখবার আসে না।

বড় দাদার প্রতি শ্রদ্ধায় বর্ষার মাথা নুয়ে আসে। হয়তো নিয়াজ করিমের মন এতটা নরম ও পবিত্র বলে তার চেহারায় নূরানী ভাব আছে। বর্ষা মায়ের কাছে শুনেছে, তার দুইজন দাদা যুবক বয়স থেকেই মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে করে গেছেন। হেফাজত করিমের বাবা যখন খেতে বসতেন তখন কোন ভিখারি যদি দুয়ারে কড়া নাড়তো, তিনি তার প্লেটের অর্ধেক ভাত তাকে খেতে দিতেন।
তাদের দুই ভাইয়ের দানের হাত ছিল প্রশস্ত।

বর্ষার গলায় হালকা ব্যথা করছে। সে গরম পানির কথা মালাকে বলতে রান্নাঘরে যেতে চাইল। গায়ের চাদর শক্ত করে জড়িয়ে বিছানা থেকে নামল। ঠিক এমন সময়, টেলিফোনটা বিচ্ছিরি ক্রিংক্রিং শব্দে বেজে উঠলো। পুরোনো মডেলের টেলিফোন। বেজে উঠলে শব্দটা কানে গিয়ে লাগে। এমন অদ্ভুত শব্দে বর্ষার মেজাজ কয়েক ডিগ্রী উপরে উঠে গেল। চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে সে রিসিভার উঠালো,
আসসালামু আলাইকুম কে বলছেন?
অপর পাশ থেকে পুরুষ কন্ঠে সালামের উত্তর শোনা গেল,
বর্ষা?
জি বলছিলাম। আপনি কে?
ইয়ে মানে! আমি শিহাব।
আপনি এবাড়ির নাম্বার পেলেন কিভাবে?
অফিস থেকে কালেক্ট করেছি।
অফিস থেকে নাম্বার কালেক্ট করে ফোন দিয়েছেন? কেন মনে রং লেগেছে?
শিহাব থতমত খেয়ে গেল। সে আমতা আমতা করে বলল,
আমি আসলে একটা ইমপোরটেন্ট কথা বলতে ফোন দিয়েছিলাম।
বর্ষা বিস্মিত স্বরে বলল,
ইম্পরট্যান্ট কথা? কি ইম্পরট্যান্ট কথা। বলুন শুনি!
আপনি বলেছিলেন না ১০ দিনে বাংলার বাঘ অথবা সিংহ হওয়া যায় এমন বই কিনতে? আমি আজ ভোরবেলায় বইটা কিনতে ঢাকায় এসেছি। নীলক্ষেতে। Trust me ! I could not find any book with this name here! দোকানদার অন্য একটা বইয়ের কথা বলল। what did he say ‘শুদ্ধ বাংলা শেখা’ নাকি কি জানি এমন বইয়ের কথা বলল। কি করব বল দেখি?

শিহাবের করুণ কণ্ঠে এমন প্রশ্ন শুনে বর্ষা রাগতে গিয়েও হেসে ফেললো। তার মেজাজ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ফিরে এলো। মুখ চাপিয়ে খানিকক্ষণ সে হেসেও নিল।
তারপর গলায় গম্ভীরতা ফিরিয়ে এনে বলল,
আপনি কি দোকানে দাঁড়িয়ে আমাকে ফোন করছেন?

শিহাব আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ফোন করেছি।

আপনি দোকানে যান। দোকানদারের সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দিন। আমি তাকে বুঝিয়ে বলছি। কোন বই দিতে হবে।

শিহাবের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে আপ্লুত গলায় বলল,
থ্যাংকস বর্ষা।
বর্ষা হাসল মাত্র।

দোকানদারকে ফোন দেওয়ার পর বর্ষা তাকে জিজ্ঞেস করল,
আপনার কি মনে হয় না আপনার সামনে যে কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে তার মাথায় সমস্যা আছে?
দোকানদার শিহাবের দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থেকে বলল,
হ আফা। মনে হচ্ছে।
শোনেন, আমি তার চিকিৎসক। একটি বিশেষ ট্রিটমেন্ট করছি। আপনার দোকানে সবচেয়ে কঠিন যে বাংলা শিক্ষার বই আছে তা উনাকে দিন। কঠিন উপায় বাংলা শিখিয়ে তার মস্তিষ্ক কে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এটি চিকিৎসার অংশ। বুঝেছেন?
জ্বী আফা বুঝেছি।
বইটা উনাকে দিয়ে বলবেন এই বইটি বাংলা শেখার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। ঠিক আছে?
জ্বী আফা ঠিক আছে।

দোকানদার শিহাবকে ফোন ফিরিয়ে দিল। সে ফোন কানে নিয়ে বলল,
সরি বর্ষা। তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম।
বর্ষা মুখে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলল,
কোনো ব্যাপার নয়, ইংলিশ বাবু। শুভকামনা রইল।
শিহাব ফোন রেখে দিল।
দোকানদার ভেতর থেকে ধুলো ঝেড়ে মোটা একটি বই নিয়ে এলো। শিহাবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
এই বই পড়লে আপনার মস্তিষ্কে শুধুমাত্র বাংলায় ইন আর ইংলিশ আউট হয়ে যাবে। ডোস বেশি পড়লে ব্রেনই আউট হয়ে যাবে। হে হে। এইটা নিয়া যান।

শিহাব দোকানদারের কথার মানে বুঝতে পারলো না। হাসিমুখে তাকে টাকা দিয়ে বই হাতে নিয়ে বের হয়ে এলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here