নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে #পর্ব_১২,১৩

0
1065

#নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে
#পর্ব_১২,১৩
#আতিয়া_আদিবা
পর্ব_১২

সকালের বাতাসে ভিটামিন আছে। কিন্তু এবাড়ির ছাদে সেই ভিটামিনের পরিমাণ দ্বিগুণ। সম্প্রতি এরকমটা মনে করছেন হেফাজত করিম। কেননা, বাড়ির ছাদে বেশ কিছু সবজির গাছ লাগানো হয়েছে। আর সবজি হলো নানাবিধ ভিটামিনের উৎস। এর প্রভাব এ বাড়ির ছাদের বাতাসে রয়েছে। বাতাসে ভিটামিন ভেসে বেড়ায়।

এজাতীয় আবিষ্কার সম্প্রতি হওয়ার কারণ হেফাজতের ছাদে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস ছিলো না। দিন কয়েক ধরে তিনি ছাদে হাঁটছেন। নিয়ম করে হাঁটলে শরীর-মন দুটোই ভালো থাকে। ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথা তিনি চড়কির মত ঘুরেন। আর ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলেন। ঘেমে জবজবে অবস্থায় নিচে ফিরে আসেন। তারপর খালি পেটে এক গ্লাস চিরতার পানি পান করেন। এই পর্বে তাকে রুমানা এবং ঈর্ষা সংগ দেয়। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে নয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে। প্রথম দিন ঈর্ষা অর্ধেক গ্লাস চিরতার পানি পান করে মুখ চাপিয়ে মিনিট পাঁচেক বসে রইলো। তারপর বাথরুমের দিকে ছুটে গেলো। চোখ বড় বড় করে হড়হড় করে বমি করে ঘরে ফিরে এলো। হেফাজত নির্বিকার। বললেন,
প্রথম প্রথম এডজাস্ট করতে সমস্যা হবে। পরবর্তীতে আর হবে না। কথায় আছে না? ‘শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাও তাহাই সয়’। আজ বমি হয়েছে। আগামীকাল হবে না।
ঈর্ষা গোমড়া মুখে বলল,
বাবা আমি শরীরে চিরতার পানি সহাতে চাইছি না।
হেফাজত শান্ত গলায় বললেন,
আমি দুঃখিত। এক্ষেত্রে তোমাকে সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা দেওয়া হয় নি। আমি যেহেতু বলেছি প্রতিদিন খালি পেটে চিরতার পানি খেতে হবে। তার মানে খেতেই হবে।
রুমানা নিচু স্বরে বলল,
মেয়ে যখন চাইছে না কি দরকার জোর করে খাওয়ানোর?
দরকার আছে। অবশ্যই দরকার আছে। চিরতা হলো মহৌষধ। তুমি জানো চিরতার আদি নিবাস কোথায়?
রুমানা বলল, না।
চিরতার আদিনিবাস হলো ভারতে। এর উৎপত্তিস্থল হলো হিমালয়ের পদতলে। প্রাচীণকাল থেকেই ভারতে চিরতা ব্যবহার করা হয় গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ হিসেবে। কত বড় বড় রোগ চিরতার কাছে বাচ্চার সমতুল্য জানো?

না। আজ জানলাম।

ঈর্ষা বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলল,
চিরতা অত্যাধিক তিতকুটে।

ভালো জিনিস তিতকুটেই হয়। যেমন ধর চিরতা তিতা। এটি তিতা বলেই এর আয়ুর্বেদিক নাম কিরাততিক্তা। করল্লাও তিতা। আবার সত্যি কথা বলা ভালো অথচ সত্য শুনতেও তিতা লাগে।

এটুকু বলে হেফাজত করিম হো হো করে উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন। যেনো সে মজার কোনো কথা বলে ফেলেছেন।

ঈর্ষা মনে মনে দোয়া করছে তার বর্ষা আপা যেনো দ্রুত ফিরে আসে। তার বিশ্বাস আপা ফিরে এলে বাবার এসব পাগলামি বন্ধ হবে। তবে আপা কবে ফিরবে তা ঠাহর করা যাচ্ছে না। আপা কই গিয়েছে তাও পরিবারের কেউ জানে না। মাকে চিন্তিত দেখায়। রোজ জায়নামাজে বসে চোখের জল ফেলেন। হেফাজত বিরক্ত হোন। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলেন,
এত কান্নাকাটি করার কি আছে? কেউ কি মারা গিয়েছে?
রুমানা ভাঙ্গা গলায় বলেন,
মেয়েটা কই গেলো, কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই জানি না অথচ তুমি একটু খোঁজও নিলে না। কিভাবে এত নিশ্চিন্তে বসে আছো? কেমন বাবা তুমি?

বাবাদের আবার প্রকারভেদ আছে নাকি?

আছে। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে থানা পুলিশ করে ফেলতো।

আমার একটা মান সম্মান আছে। এই বয়সে এসে থানা পুলিশ করবো?

মেয়ের জীবনের থেকে মান সম্মান তোমার কাছে বড়?

এর উত্তর তুমি জানো রুমানা। খামোখা প্রশ্ন করো না। মন খারাপ হবে।

রুমানার ভেজা চোখ আরো ভিজে ওঠে। বিস্মিত চোখে স্বামীর দিকে তাঁকিয়ে থাকে সে। তার চোখে মুখে চিন্তার অত্যল্প পরিমাণও নেই! সে আছে তার সংসারে নতুন নতুন বিধান জারি করায়। সকালে নিয়ম করে হাঁটা, চিরতার পানি পান করা, বারোটার মাঝে দুপুরের খাবার শেষ করা, রাতের খাবারের ম্যানু পরিবর্তন করা ইত্যাদি!
সে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চান,
ইয়া আল্লাহ! আমার মেয়েটা যেখানেই থাকুক তাকে তুমি সুস্থ রেখো। ভালো রেখো।

রেহনুমা সাধারণত শিহাবের ঘরে আসেনা। তবে মাসের বিশেষ একটি দিনে তিনি এ বাড়ির প্রতিটি ঘরের আনাচে কানাচে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে পরিদর্শন করেন। এই বিশেষ একটি দিন তার বাড়ি পরিষ্কার করা হয়। গ্রাম থেকে কমলার মাকে খবর দিয়ে আনা হয়। জানালার গ্রিল মোছা হয়। থাই গ্লাস পরিষ্কার করা হয়। ছাদের বাগানের আগাছা ফেলে দেওয়া হয়। পুরো বাড়ি একদম নতুনের মত লাগে। ঝকঝকে তকতকে।

আজকে সেই বিশেষ দিন। রেহনুমা প্রতিটি ঘর পরিদর্শনের পর শিহাবের ঘরে ঢুকলো। ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল। কোথাও ময়লা ছিটেফোঁটা আছে কিনা। কিন্তু না প্রতিবারের মতোই কমলার মা তাকে হতাশ করেনি।
ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সে হঠাৎ লক্ষ্য করল বিছানার পাশের টেবিলে একটি বই রাখা।
শিহাবের বই পড়ার অভ্যাস নেই। তার অবসর কাটে কার্টুন দেখে। তাহলে কিসের বই রাখা?
মনে কৌতুহল নিয়ে রেহনুমা টি টেবিলের কাছে গেল। অবাক হয়ে দেখল সেখানে বাংলা ব্যাকরণের বই রাখা আছে!
শিহাবের ঘরে বাংলা ব্যাকরণ বই কি করছে তা রেহনুমার বোধগম্য হলো না। তার ছেলের বাংলা শেখার প্রতি কোন আগ্রহ আছে বলে তো কখনো মনে হয়নি। এছাড়া ভাল চাকরি-বাকরি করতে আমাদের দেশে ইংরেজির ব্যাপক প্রসার। ভালো করে দু চারটি ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেই চাকরির বাজারে ব্যাপক ডিমান্ড!
এসব চিন্তা করেই না তিনি ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়েছেন। এর মাথায় নতুন করে বাংলা শেখার ভূত কবে থেকে চাপল?

আচমকা রেহনুমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। সাথে মাথা চরকির মতো ঘুরতে লাগলো। তার মনে হচ্ছে, শিহাব বদলে যাচ্ছে। তার মাঝে বেশ কদিন ধরেই পরিবর্তন লক্ষণীয়। কিন্তু কেন?

রেহনুমা ঠিক করলো শিহাব বাড়ি ফিরলে এ বিষয়ে তার সাথে কথা বলবে।
সে তার ঘরে ফিরে জানালার ভারী পর্দা গুলো টেনে দিলো। দিনের আলো পর্দাগুলো ভেদ করে খুব একটা ঢুকতে পারে না। তাই পুরো ঘরে আবছা আলো আবছা অন্ধকার। রেহনুমা দরজা ভিরিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার ক্লান্ত লাগছিল কিন্তু ঘুম এলো না। বারবার একটি কথাই মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল,
তার ছেলেটা কি সত্যি পাল্টে যাচ্ছে? যদি পাল্টেও বা যায় তবে তা কার সংস্পর্শে এসে?

সখিপুরের তক্তারচালা এলাকাটি আজ বেশ উত্তাল। সকাল থেকে রাজনৈতিক দুটি দলের মাঝে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলছে। চলছে ইটপাথর ছোঁড়াছুঁড়ি। ঠিক সেসময়ই অফিসের গাড়ি নিয়ে শিহাব নিয়াজ করিমের ফার্ম হাউজে আসছিল। রাস্তায় কোথা থেকে একটি ইট উড়ে এসে অফিসের গাড়ির গ্লাস ভেঙ্গে সোজা শিহাবের মাথায় লাগলো। ঘটনার আকস্মিকতায় শিহাব বোকা বনে গেলো। খুব গভীর ক্ষত সৃষ্টি না হলেও বেশ রক্তপাত হয়।
ভাগ্যিস ড্রাইভার তুফান গাড়িটা তুফানের গতিতেই দিয়েছিল এক টান! নয়তো আরো চার পাঁচটি ইট পাথর গ্লাস ভেঙ্গে গাড়িতে এসে পড়তো।
বর্ষা বাড়ির সামনে পাটিতে বসে গল্পের বই পড়ছিল। এমন সময় ফারুক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। বর্ষা বিস্মিত স্বরে বলল,
আপনি এভাবে হাঁপাচ্ছেন কেন? আপনার হাঁপানি রোগ আছে নাকি?
ফারুক বলল,
না আপা। হাঁপানি রোগ নাই। শিহাব স্যার আসছেন। কপালে রক্ত। গল গল করে পড়তেছে।
কী বলছেন এসব?
সত্যি বলতেছি। আপনি আসেন আমার সাথে।

বর্ষা ফারুকের সাথে এগিয়ে গেল। কিছুদুর যাওয়ার পর দেখল শিহাবের অফিসের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচ ভাঙ্গা। পাশেই হালকা আকাশি রংয়ের ফরমাল শার্টে শিহাব দাঁড়িয়ে আছে। একটি রুমাল কপালে চেপে রেখেছে। রুমালটি লাল রঙের। ভেজা। সম্ভবত রক্তে ভিজে গেছে। বর্ষাকে দেখে শিহাব হাসার চেষ্টা করে বলল,
বাড়িতে ফার্স্ট এইড বক্স আছে? আসলে অনেক ব্লিডিং হচ্ছে তো।
বর্ষা বলল,
আছে। আসুন আমার সাথে।
শিহাব বর্ষার পিছে পিছে হাঁটতে লাগলো।
বর্ষা বলল,
আজকের দিনটায় এদিকে এসে ভালো করেন নি। সামনে ইলেকশন। এই এলাকা ভালো না। শুনেছি ইলেকশনের আগে দু চারটি লাশও ফেলে দেয়।
শিহাব আঁৎকে উঠলো,
বলেন কি? ডিরেক্ট মার্ডার?
হু। মার্ডার। এর মাঝে আসার কি প্রয়োজন ছিলো?
শিহাব অসহায় ভঙ্গিতে বলল,
মিস্টার নিয়াজকে রাজী না করাতে পারলে আমার জব চলে যাবে। I don’t want to lose my job. That’s why, I started learning Bangla.

শিহাবের কথা শুনে বর্ষার মায়া লাগলো। মজার ছলে ছেলেটার সাথে অন্যায় করা হচ্ছে কিনা তা নিয়েও সে খানিকটা চিন্তায় পরে গেলো।

চলবে…

#পর্ব_১৩
#আতিয়া_আদিবা
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলল। ফার্মহাউজের শীতের বিকেলটা সুন্দর। অন্যরকম সুন্দর। এই সৌন্দর্যের সাথে শহরের ব্যস্ততম বিকালের কোনো সদৃশতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। শহরের অলিতে গলিতে এ সময় বাচ্চারা খেলায় মেতে ওঠে। সামান্য খালি জায়গা পেলো তো কাজ হলো! ব্যাডমিন্টনের কোর্ট কেটে ফেলে। আয়োজন করে লাইট লাগানো হয়। সন্ধায় সেই লাইটগুলো জ্বলে ওঠে। ধূলো মাখা রাস্তার পাশে গায়ে চাদর জড়িয়ে ধোঁয়া ওঠা চিতই বিক্রি করে নারী অথবা পুরুষ। সাথে কয়েক পদের ঝাল বাটা। নারিকেল আর গুড়ের পুর মিশিয়ে অনেকে বিক্রি করে ভাপা পিঠা। স্কুল, কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের আড্ডার ছলে শহর যেনো ভিন্নরকমের পিঠা উৎসবে মেতে ওঠে।

শিহাব উঠানে বসে আছে। কিচির মিচির শব্দে মুখরিত চারিদিক। জায়গাটি বেশ খোলামেলা হওয়ায় সেই কিচির মিচির শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অবিরত। সূর্যটা মেঘের আড়ালে থাকলেও আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। যতদূর পর্যন্ত চক্ষু মেলা যায় সিল্কের পর্দার মত কুয়াশা আস্তরণ ।

শিহাব আজ ফিরতে পারে নি। দুপুরের দিকে তক্তার চালার অবস্থা চলে যায় নিয়ন্ত্রনের বাইরে।
ক্ষণিককাল আগে রাজনৈতিক দুই দলের মাঝে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। গোলাগোলির শব্দও পাওয়া গিয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশ অত্র এলাকায় দায়িত্ব পালন করতে ছুটে আসে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। তবে,
বাজার ঘাট সব বন্ধ করে ফেলা হয়েছে। রাস্তায় কোনো জনমানব নেই। শুধু এলাকার কুকুরগুলো রাজকীয় ভঙ্গিতে শূন্য রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ অবস্থায় গাড়ি নিয়ে ফিরে যাওয়া মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়, সাথে শিহাবের বোকামি এখনো বাটখারা পেরোতে পারে নি। তাই সে আজ নিয়াজ করিমের ফার্ম হাউজে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এত ঝামেলার মাঝেও খুশির সংবাদ বলতে শেষ অব্দি নিয়াজ করিম তার ফার্মহাউজে টাওয়ার বসাতে রাজী হয়েছেন। তিনি স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছেন নাকি বর্ষার অনুরোধে রাজি হয়েছেন তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না।
এমন খোলামেলা স্থানে শীত একদম জেঁকে বসে। শিহাবের পরনে শুধুমাত্র ফর্মাল একখানা শার্ট। বেচারা কাঁপতে শুরু করলো। কপালটাও ব্যাথায় টনটন করছে। যদিও সেসময় ড্রেসিং করে নিওস্ট্রিপ লাগিয়ে নিয়েছে সে। তবে বোঝা যাচ্ছে, রাত যত গভীর হবে ব্যাথাও তত বাড়তে শুরু করবে। জ্বরও আসতে পারে। তুফানকে আশে পাশে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত ফারুকের সাথে আছে। গল্পগুজব করছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের মাঝে বেশ ভাব জমে উঠেছে। মোবাইল ফোনে চার্জ নেই। চার্জারও সাথে করে আনা হয় নি। ব্যাটারি শেষ হয়ে গিয়েছে। শিহাবের ফোন বন্ধ। মা নিশ্চয়ই চিন্তা করবে! তাকে ফোন করে সবটা জানানো প্রয়োজন। এ বাড়িতে কারো মোবাইল ফোন আছে বলে মনে হয় না। তবুও বর্ষার কাছে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। দীর্ঘসময় ধরে মেয়েটার কোনো খোঁজ নেই। ফার্স্ট এইড বক্সটা হাতে ধরিয়ে সেই যে উধাও হয়ে গেলো! মধ্যাহ্নভোজের সময়ও তার দেখে মেলে নি।

বর্ষা লম্বা সময় ঘুমিয়ে উঠলো। জ্বর থেকে আরোগ্য লাভ করলেও তার শরীরটা দুর্বল। জাগনা পেয়েই সে পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভব করলো। উঠে রান্নাঘরে গেলো। অবেলা করেই চারটে ভাত খেলো। মালা জিজ্ঞেস করলো,
আফা, চা খাবেন? চা বানায়ে দিমু?
না। চা খাবো না। কফি খাবো। কফি আছে?
জ্বি আফা। কপি আছে।
কপি না মালা। ক-ফি। বলো ক-ফি?
ক-পি।
‘প’ না। ‘ফ’ উচ্চারণ করবে। বলো ‘ফি’।
মালা দুই তিনবার চেষ্টা করলো। কিন্তু তাতে তার উচ্চারণে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো না। কফি কে সে কপিই বলতে লাগলো। বর্ষা হাল ছেড়ে দিলো। মালাকে দুই মগ কফি বানাতে বলে সে বেরিয়ে আসলো।

শিহাব এখনো আগের জায়গাতেই বসে আছে। বর্ষাকে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো।
বর্ষা হেসে বলল,
আমি কি মন্ত্রী মিনিস্টার? আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াতে হবে কেনো?
শিহাব কোনো উত্তর দিলো না। হেসে পুনরায় চেয়ারে বসলো। বর্ষা অন্য চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
আপনি গেস্ট রুম বাদ দিয়ে এখানে কি করছেন?
রুমে থাকতে ভালো লাগছিলো না। This place is wonderful! ভাবলাম একটু এক্সপ্লোর করি।
বর্ষা হেসে ফেললো। বললো,
উঠোনে বসে বসে ‘এক্সপ্লোর’ করছেন?
শিহাব বলল,
আসলে আমি তো পুরো জায়গা চিনি না। এক্সপ্লোর করতে গিয়ে যদি হারিয়ে যাই?

বর্ষা শিহাবের কথা শুনে বোকা বনে গেলো। হারিয়ে যাবে মানে! সে বিস্মিত জিজ্ঞেস করলো,
এই জায়গায় আপনি হারাবেন কেনো?
This place is unknown to me! হোয়াট ইফ ঘুরতে ঘুরতে অন্য কোথাও চলে গেলাম। আর ফেরার রাস্তা খুঁজে পেলাম না। My god! It would be a horrible experience.

বর্ষা ক্ষণিককাল বড় বড় চোখ করে তাঁকিয়ে রইলো। এই যুগের ছেলে এত গাধা কিভাবে হতে পারে। গাধাও এতটা গাধা বলে বর্ষা মনে করে না!
বর্ষা আগ্রহ ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
আপনি এত ভম্বল কেনো বলবেন?
শিহাব আরোও অবাক হলো। বলল,
ভম্বল মানে টা কি?
বর্ষা হেসে বলল,
কিছু না। আপনার শীত করছে?
শিহাব কিছুটা লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়লো।
আসলে সকালে যখন বের হয়েছি ইট ওয়াজ এ ব্রাইট সানি ডে! এখানে এসে এমন অবস্থা হবে বুঝতে পারি নি। তাই সাথে কিছু নিয়ে আসা হয় নি।

তো বলেন নি কেনো শীত করছে? বললে বুঝি আপনার গলা টিপে ধরতাম?

সেটা তো বলি নি! আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

করুন।

আপনি কি আমাকে অনেক অপচ্ছন্দ করেন।

অনেক অপচ্ছন্দ করি না। আবার পচ্ছন্দও করি না। উত্তর পেয়েছেন?

হু। থ্যাংক ইউ।

ওয়েলকাম। আপনি একটু বসুন আমি আসছি।

বর্ষা ঘরে ফিরে গেলো। নিজের একটি মোটা চাদর নিয়ে ফিরে এলো। চাদরটি যত্নের সহিত শিহাবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
নিন। এটা গায়ে জড়িয়ে থাকুন। শীত কম লাগবে।
শিহাব অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে চাদরটি নিলো। গায়ে জড়িয়ে মুচকি হেসে বর্ষার দিকে তাকালো। এই মুচকি হাসির অর্থ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

কালো রঙের দুটো মগে মালা কফি নিয়ে এসেছে। ধোঁয়া গুলো কুয়াশার সাথে মিশে যাচ্ছে। বর্ষা একটি মগ শিহাবকে দিলো। আরেকটি মগ নিজের কাছে রাখলো। চায়ের বদলে কফি দেখে শিহাব জিজ্ঞাসু চোখে বর্ষার দিকে তাকালো। বর্ষা বিষয়টা বুঝতে পারলো। কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। শান্ত কণ্ঠে বললো,
চলুন হাঁটি। হেটে হেটে পুরো ফার্মহাউজ ঘুরে দেখাই। ‘এক্সপ্লোর’ করি। আশা করি, আমি সাথে থাকলে হারিয়ে যাওয়ার ভয়টা আর পাবেন না।
শিহাব মাথা নেড়ে বলল,
অবশ্যই না।
বর্ষা আঙুল দিয়ে সামনের দিকটা দেখিয়ে বলল,
এসময় ওদিকের লণ্ঠনগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ভীষণ সুন্দর লাগে দেখতে। চলুন ওদিকটায় এগোই।

প্রথম যেদিন এসেছিলাম ওই লাইটস গুলো দেখে আই ওয়াজ সারপ্রাইজড! ভাবছিলাম, এসব কেনো ঝুলিয়ে রেখেছে।

আরেকটা ইন্টারেস্টিং বিষয় আছে।

কি সেটা?

জোনাকি পোকা চিনেন?

নাম শুনেছি। ওদেরও লাইটস আছে।

বর্ষা হেসে বলল,
হ্যা। খুব সুন্দর করে জ্বলে ও নিভে। রাত গভীর হলে ফার্মহাউজের এসব লণ্ঠন নিভিয়ে রাখা হয়। তখন সেই জোনাকি পোকাগুলো কই থেকে যেনো এদিকটায় আসে! সবুজ রঙে আলোকিত হয়ে যায় চারিদিক।

আসলেই বিষয়টা অনেক ইন্টারেস্টিং তো!

হুম। চলুন হাঁটি। মনে হয় লণ্ঠন জ্বালানো শুরু করে দিয়েছে।

বর্ষা আর শিহাব পাশাপাশি হাঁটছে। বিকেলটাও প্রস্থানের পথে। যে পাখিগুলো পুরো বিকেল জুড়ে বিরামহীন ডেকে যাচ্ছিলো তারা যেনো নীড়ে ফিরে গিয়েছে। সন্ধ্যে নেমে আসছে। দক্ষিণ দিক থেকে শীতল বাতাস ভেসে আসছে। নির্জনতা আশ্রয় নিয়েছে। ফারুক আর তুফানের দেখা মিললো। কিছু দূরেই তারা আনন্দ নিয়ে লণ্ঠন জ্বালাচ্ছে। আর এর মাঝ দিয়েই হেটে যাচ্ছে তারা দুজন!
শিহাবের অজ্ঞাতসারে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
আচ্ছা বর্ষা, আমাদের বিয়েটা হলে কি খারাপ হতো?
বর্ষা কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,
বিপরীতমুখী দুজন মানুষ আমরা। হয়তো হতো। ঝুঁকি নেয়ার কি প্রয়োজন?

এমনি জিজ্ঞেস করলাম। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।
আপনার সাথে আমার আর দেখা হবে না। তাই মাইন্ড করি নি। নচেৎ করতাম।

কেনো আমাদের আর দেখা হবে না কেনো?

দাদাজান, টাওয়ার বসাতে রাজি হয়েছে। আপনার কাজ শেষ। আগামীকাল ফিরে যাবেন। দেখা হবে কিভাবে?

রাইট। ভুলে গিয়েছিলাম।

শিহাবের মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারলো না। কিছু কিছু অনুভূতি কখনো প্রকাশ করা যায় না। শুধুমাত্র অনুভব করা যায়। অথচ অনুভুতির শুরুটা বেশ আগের থেকে হলেও, তা অনুধাবনে ঢের সময় লেগে যায়!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here