নিভৃতে_যতনে Part_07,08

0
1711

নিভৃতে_যতনে
Part_07,08
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_07

জৈষ্ঠ্য মাসের পনেরো তারিখ আজ। তপ্ত এক সকাল। গুমোট এক ভাব চারদিকে। এই তপ্ত গরমের মাঝেই আমি আর রোয়েন জ্যামে আটকে আছি আধাঘন্টা যাবৎ ধরে। সিগন্যালের জ্যাম নাকি কি-না তা আমার জানা নেই। একে তো গরম তার উপর জ্যাম। আমার তো প্রায় যায় যায় অবস্থা। রিকশায় আছি বিধায় বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের বিষাক্ত গ্যাস নাকে মুখে এসে বারি খাচ্ছে। তার উপর মাথার উপর তীক্ষ্ণ রোদের ছায়া। রোয়েনের কাছ থেকে দূরত্ব বুঝিয়ে রাখার জন্যই রিকশার হুটটা অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খোলা রাখতে হয়েছে। সব মিলিয়ে আমার অবস্থা নাজেহাল। ভিতরটা আমার বার বার গুলিয়ে আসছে। কিন্তু কোন মতে নিজেকে সামলে রেখেছি। রোয়েনের অবস্থা বুঝার জন্য আমি আড়চোখে তার দিকে তাকাই। এক চিলতে রোদ এসে বারি খাচ্ছে তার মুখের উপর। ব্রাশ করার চুলের উপর ছড়িয়ে দিচ্ছে সোনালী আভা। কিন্তু সেদিকে কি তার ভাবান্তর আছে? সে তাই ভাবলেশহীন ভাবে বসে এক হাত দিয়ে মোবাইল স্ক্রোল করেই চলেছে। দেখে মনে হচ্ছে তার যেন গরমই লাগছে না। গরম বলতে এই পৃথিবীতে কিছুই নেই। অথচ গায়ের শার্ট ঘামে ভিজে একাকার। এই খাটাশ ব্যাটা যে কি দিয়ে তৈরি আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানে। কিন্তু যত যাই হোক, মানুষ না।

আমি গরমে হাই-হুতাশ করতে করতে নিজেকে শ’খানেক বকা দিয়ে নেই। নিজেই নিজেকে বলি,

— ইউ ডাফার! কে বলেছিল মাত্তব্বোরি করতে? ভালোয় ভালোয় তো রোয়েন উবার বুক করছিল তুই মাঝে কাবাব ম্যায় হাড্ডি কেন হতে গেলি? রিকশার অতৃপ্ত আত্মা ভর করেছিল নাকি তোর উপর? যে রিকশা ছাড়া এক চুলও নড়তে রাজি হলি না তুই? এইবার গরমে জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হো।

কথাটা ভেবেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম। রোয়েনের কাছ থেকে আরেকটু সরে বসার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম৷ যাতে কোন ভাবেই তার শরীরের সাথে আমার স্পর্শ না লাগে। কিন্তু রিকশায় কি তা আদৌ সম্ভব? হঠাৎ রোয়েন বলে উঠে,

— গরমে বারবিকিউ হয়ে এইবার মন ভরেছে তো?

আমি তার কথা শুনে কটমট দৃষ্টিতে তাকাই। কাঠ কাঠ গলায় বলি,

— মন আমার। সো সেটা ভরেছে কি-না সেটা নিয়ে আপনার এত ভাবতে হবে না।

সে ভাব নিয়ে বা হাত দিয়ে নিজের চুল ঠিক করতে করতে বলে,

— কাল পর্যন্ত জানতাম তুমি বুঁচি প্যাঁচি। আজ দেখছি তুমি মাথামোটা ও। নিজের পায়ে কোড়ল মারা কেউ তোমার থেকে শিখুক।

আমি তার কথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে বলি,

— এট লিস্ট মানুষ আমার থেকে কিছু শিখতে তো পারবে, আপনার বেলায় তো তাও পারবে না। একটা খাটাশ মার্কা রোবট থেকে কি বাই আর শিখা যায়?

সে আমার কথা শুনে তার বিশ্ব বিখ্যাত ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে বলেন,

— ডু ইউ ইভেন নো, আমার আন্ডারে প্রায় দেড়শো জন কাজ করে?

আমি তার কথায় থমথম থেকে বলি,

— করতেই পারে,তো?

সে আমার কথা শুনে চোখ ছোট ছোট করে চায় অতঃপর বিরবির করে বলে উঠে,

— ডাফার!

কথাটা আমি শুনেও না শুনার ভাণ করলাম। আমি আরেকটু চেপে বসতে যাব তখনই জ্যাম ছেড়ে দেয় আর রিকশাচালক একটান দেন। তাতে আমার ব্যালেন্স কিছুটা নড়বড় হয়ে যায় আর আমি পড়ে যেতে নেই। ঠিক এমন সময় রোয়েন আমার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে আমাকে এক টান দিয়ে আমাকে তার সাথে মিশিয়ে নেন। সাথে সাথে আমি ভড়কে যাই। বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকাই। মূহুর্তেই সরে আসতে নিলেও সে আমায় ছাড়ে না। বরং আগের ন্যায় আমার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে বসে থাকে৷ আমি কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— এইটা কি ধরনের অসভ্যতা?

রোয়েন একবার আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় মোবাইল স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টি নত করে বলে,

— হসপিটালে ভর্তি হওয়ার এত ইচ্ছা থাকলে যখন আমি আশেপাশে থাকবো না তখন পূরণ করে নিও। এইসব দৌড়াদৌড়ির কাজ নিতান্তই অসহ্যকর।

আমি তার কথার মর্ম প্রথমে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রই। কথাটা বুঝতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়। অতঃপর কথাটা বুঝতে পেরে আমি ফুঁসে উঠি। কাঠ কাঠ গলায় বলি,

— আমি কি বলেছি আপনাকে আমায় নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে? আমাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না আপনার। কিছু হলে একা একাই হসপিটাল চলে যেতে পারবো। হুহ!

সে ভাবলেশহীন ভাবেই বলে,

— ইউ আর নাও মাই রেসপনসেবলিটি। সো আমার সাথে থাকাকালীন তোমার দায়িত্ব আমারই। এর মধ্যে তোমার কিছু হলে এর দায়ভার আমাকেই পোহাতে হবে। আর যেটা আমি চাই না। গট ইট?

আমি কিছু না বলে কটমট দৃষ্টিতে তাকালাম। এর সাথে কথা বলাই বেকার।

______________________

বাসায় আসতে না আসতেই আমার সব কাজিনরা রোয়েনকে চেপে ধরে। আপ্যায়নে ভরে দেয়। সেই সাথে দুই একটা আন্ডা পিচ্চি ঝুলে পড়ে রোয়েনের গলায়। বড় ছোট সকলেই এই সেই জিজ্ঞেস করে চলেছে তাকে। আর সে খালি হু হা করে জবাব দিচ্ছে। মুখ একদম বাংলা প্যাঁচার মত করে আছে। ভাবসাব এমন যে, “ছেঁড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি।” যেহেতু আমাকে নিয়ে কাউরো মাতামাতি নেই সেহেতু আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে রোয়েনের অবস্থা দেখছি আর মিটিমিটি হাসছি। বুঝতেই পারছি যে, সে না পারছে সইতে, না পারছে কিছু বলতে। জীবনে এই প্রথমবারের মত আমার কাজিনদের নিয়ে গর্ববোধ করতে ইচ্ছে করছে। মনে চাচ্ছে সবগুলোকে একটা বড়সড় পার্টি দেই। কত সুন্দর রোয়েনকে জ্বালিয়ে মারছে।আহা! কি শান্তি! শান্তি!

হঠাৎ আমার দিকে রোয়েনের নজর পড়তে সে ইশারায় আমায় কিছু বলে। আমি প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝি সে আমাকে এইখান থেকে উদ্ধার করতে বলছে। কথা বুঝার সাথে সাথে আমার মুখে পৈচাশিক হাসি ফুটে উঠে৷ আমি মনে মনে বলি,

— আমাকে বুঁচি বলা হয়েছিল না কাল। এইবার বুঝবেন ঠ্যালা।

কথাটা ভেবেই আমি মুখ ঘুরিয়ে গুনগুন করতে করতে হৃদিপুর রুমে দিকে চলে গেলাম। ছেড়ে দিলাম তাকে আমার কাজিনদের কাছে। কেন না আমি চিনি আমার কাজিনদের। তারা একবার কারো পিছে পড়লে তার অবস্থা নাজেহাল করে ছাড়ে। যেমন এখন রোয়েনের করবে৷ আহা! বাতাসটা এত স্নিগ্ধ কেন?
হৃদিপুর রুমের সামনে আসতেই হৃদিপু দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে। আপ্লূত সুরে বলে,

— সিয়া তুই এসেছিস?

আমি দুষ্টুমির সুরে বলি,

— না আমার অতৃপ্ত আত্মা এসেছে। ভাওওও!

হৃদিপু আমায় ছেড়ে দিয়ে কানে হাতে দিয়ে বলে,

— ইউ খবিশ! কানের পোকার নাড়িভুঁড়িও মেরে দিলি।

আমি কিছু না বলে হু হু করে হেসে উঠি। হৃদিপু আর কিছু না বলে আমায় টেনে তার রুমে নিয়ে যায়। এরপর জুড়ে দেয় দুনিয়ার গল্প। একসময় গল্পের মাঝেই হৃদিপু গম্ভীর হয়ে যায়। মিহিয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে উঠে,

— সিয়া একটা কথা বলি?

— হ্যাঁ বলো। না করেছে কে?

— উফফ মজা না।

আমি এইবার নড়েচড়ে বসে বলি,

— ওকে। বলো!

— তুই কি বিয়েটা মেনে নিয়েছিস সিয়া?

কথাটা শুনেই আমি চুপ হয়ে যাই। কোন উত্তর দেই না। হৃদিপু কিছুক্ষণ আমার উত্তরের আশায় আমার মুখ পানে চেয়ে থাকে। কিন্তু কোন উত্তর না পেয়ে বলে,

— দেখ! যেভাবেই হোক বিয়েটা হয়ে গিয়েছে। হোক সেটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত। হয়েছে তো? তার উপর যতটুকু তোর থেকে শুনলাম, না তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন খারাপ আর না ভাইয়া। তাই বলছি কি লাইফটাকে একটা চান্স দে। নিজের সবটা দিয়ে তাদের ভালবেসেই দেখ না। আশা করি এইবার নিরাশ হবি না। তোর প্রাপ্যটা এইবার তুই পাবি।

আমি হৃদিপুর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলি,

— আমার ভিতরে আর বাকি আছেটা কি?

হৃদিপু আমার হাত তার কোলে নিয়ে বলে,

— এখনো অনেক কিছু আছে বুঝলি। অনেক কিছু জানার আছে,বুঝার আছে। তাই বলছি এই বিয়েটা মেনে নে। সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দে।

আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। হৃদিপু আবার বলে,

— কিছু তো বল?

— ভালো লাগছে না এই বিষয়টা। বাদ দাও তো।

— কিন্তু..

আমি হৃদিপুর কথার মাঝে ফোঁড়ন দিয়ে বলি,

— তুমি থাক আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।

কথাটা বলেই রুম থেকে বেরিয়ে আসি। চলে যাই নিজের রুমে। মাথা ভিতরটা কেমন এলোমেলো লাগছে। অসহ্য লাগছে সব। শাওয়ার নেওয়ার দরকার। আমি কার্বাড থেকে এক সেট জামা নিয়ে ঢুকে পড়ি ওয়াশরুমে।

চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_08
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

গোধূলির লগ্ন। পশ্চিম আকাশের বুকে হেলে পড়েছে সূয্যিমামা। আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে রক্ত জবার রক্তিম আভা। কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘের মাঝে কোথাও নীল, কোথাও বা হলুদ রঙের লুকোচুরি খেলা। ঝিরিঝিরি বাতাসে জানালার পর্দাগুলো দুলছেন। বিছানার পাশে জানালাটা হওয়া সুবাদে বাতাসের স্নিগ্ধ পরশ ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ জুড়ে। আমি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছি আর লবণ মরিচ দিয়ে মাখা কাঁচা আম চিবুচ্ছি। মাঝে মধ্যে আড়চোখে বারান্দার দিকে তাকাচ্ছি আর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় গুনছি। পাক্কা এক ঘন্টা দুই মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড পর হৃদিপু নিজের ফোনালাপ থুরি প্রেমালাপ শেষ করে রুমের ভিতরে আসে। হৃদিপুকে রুমে আসতে দেখে আমি ক্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে সুর টেনে বলি,

— অহহহ হোওওওওও!!

আমি এমন শব্দ করতেই হৃদিপু আমার দিকে সুরু দৃষ্টিতে তাকায়। অতঃপর বলে,

— কি?

আমি কাঁচা আম চিবুতে চিবুতে বলি,

— আহা এত প্রেম! আগে জানতাম না তো। আচ্ছা, বাসার সবাই কি জানে তাদের অতি ভদ্র মেয়ে তলে তলে টেম্পো চালাচ্ছে?

হৃদিপু সাথে সাথে বলে উঠে,

— আস্তাগফিরুল্লাহ! আমাকে জুতা,ঝাড়ু নিয়া দৌড়ানি মারবে।

আমি নিজের মধ্যে দুঃখী দুঃখী ভাব এনে বলি,

— আজ তোমায় দেখে মনে হচ্ছে জীবনে করলামটা কি? আসলেই আমি আজ প্রমাণ পেলাম, কচ্ছপের দৌড় বহুত দূর।

হৃদিপু আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

— মানে?

আমি সোজা হয়ে বসে বলি,

— মানে হচ্ছে ছোট থেকেই আমি চঞ্চল আর তুমি শান্ত। একদম খরগোশ আর কচ্ছপের ঝুটি আমাদের। তো সেই হিসাবে প্রেম করার কথা আমার আর বিয়ে বসার কথা তোমার। কিন্তু লাস্টে দেখা গেল এর উল্টোই হয়ে গেল। প্রেম করলা তুমি, বিয়ে করলাম আমি। ইশশ! ফিলিং বহুত দুঃখ।

হৃদিপু আমার কথা শুনে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলে,

— ইউ খবিশ! আমাকে তুই খোটা দিচ্ছিস? লজ্জা করে না বড় বোনকে এইসব বলতে?

বলে আমার কাছে এসে পিঠের উপর ধপ করে কিল বসিয়ে দিল। আমি ব্যথায় উঁহু উঁহু করে বলি,

— ইউ বেয়াদব মহিলা! মুখে কথা বলা যায় না, হাত পা চলে কেন এত?

হৃদিপু মুখ ভেঙচি কেটে বলে,

— আর তোর মুখ এত কেন চলে?

— তাতে তোমার এত কেন জ্বলে?

হৃদিপু আমার দিকে তীক্ষ্ণ দিকে তাকিয়ে থেকে ছুঁ মেরে কাঁচা আমের বাটি নিয়ে আম খাওয়া শুরু করলো। আমি সেদিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলি,

— আমি রাগ করেছি।

হৃদিপু আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— আম নিয়ে নেওয়ার জন্য?

আমার মাথা না সূচক দুলিয়ে বলি,

— উঁহু! তুমি আমার দুলাভাইয়ের ব্যপারে এখনো বিস্তারিত কিছু বলো নি বলে তাই। কবে থেকে ঘুরিয়েই যাচ্ছ। বেয়াদব মহিলা একটা। আজ না বললে তোমার ব্রেকাপ নিশ্চিত। হুহ!

হৃদিপু হু হু করে হেসে উঠে বলে,

— কি জানতে চাস বল।

— সব!

— সময় হোক জানতে পারবি। আপাতত এতটুকু জেনে রাখ উনি প্রবাসী। টোকিওতে আছে বর্তমানে।

— বাবা গো! তোমার দৌড় দেখি আসলেই বহুত দূর। ব্যাপার-স্যাপার দেখি সাংঘাতিক।

হৃদিপু এখন গম্ভীর গলায় বলে,

— থামবি তুই এইবার?

আমি মুখ ভেঙচি কেটে বলি,

— হুহ! ভালা মানুষের দাম নাই।

কথাটা বলেই আমি রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। মায়ের রুমের সামনে দিয়ে যেতেই ওসমান সাহেব আমাকে গম্ভীর কন্ঠে ডেকে উঠলেন।

— সিয়াশা!

ওসমান সাহেবের কন্ঠ শুনেই আমি থমকে গেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে রুমের দিকে উঁকি দিলাম। দেখলাম সে খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আমি ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকাতেই সে পুনরায় আমার নাম ধরে ডেকে উঠে,

— সিয়াশা! এইদিকে এসো।

আমি ভ্রু কুটি কুঞ্চিত রেখেই তার রুমে প্রবেশ করি৷ তাচ্ছিল্যের সুরে বলি,

— আজ সূর্য কোন দিক দিয়ে উঠেছে যে আপনি স্বয়ং নিজ থেকে আমায় ডাকছেন?

সে গম্ভীর গলায় বলে উঠে,

— অকারণে ডাকি নি তোমায়। এই প্যাকেট গুলো দেওয়ার জন্য তোমায় ডেকেছি।

— প্যাকেটে কি?

— তোমার আর জামাই এর জন্য কিছু জামা কাপড় আছে এতে আর এই খামে কিছু টাকা আছে। জামাই বাজারের জন্য।

আমি শক্ত করে বলি,

— আর আপনি এইগুলো দিচ্ছেন কোন হিসাবে?

সে বিষ্ময়কর কন্ঠে বলে উঠে,

— মানে?

আমি ভাবলেশহীনভাবে বলে উঠি,

— আমার জানা মতে এইসব নিয়ম-রীতি কনের বাবা করে। কিন্তু আপনি তো আমার বাবা নন। আমি কি বলেছিলাম ভুলে গিয়েছেন? কবুল বলার সাথে সাথেই আপনার সাথে আমার সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। সো এইসব নিয়ম-রীতি আর আপনাকে মানতে হবে না।

— সেটা তোমার হিসাব! আমি শুধু আমার দায়িত্ব পূরণ করছি৷

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলি,

— জীবনে আমার প্রতি কোন দায়িত্বটা পালন করেছেন যে এখন দায়িত্ব গিরি দেখাতে এসেছেন? এসব আপনার প্রাণ প্রিয় মেয়েটাকে গিয়ে দেখান আমাকে না। সেই সাথে আমার কুনজর থেকে বাঁচিয়ে রাখুন। যেভাবে এতটা বছর বাঁচিয়ে এসেছেন।

হঠাৎ ওসমান সাহেব হালকা চেঁচিয়ে উঠেন,

— সিয়াশা!

— চিল্লাবেন না। বাধ্য হয়ে এসেছি এই বাসায়। অন্যথায় এই বাসায় পা রাখারও বিন্দু মাত্র ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু নিশ্চিন্তে থাকুন, এই শেষ আসছি এই বাসায়। আর আসবো না।

পিছন থেকে তখন নাসরিন বেগম বলে উঠে,

— তোর মত মাইয়ারে বুঝি আমরা ঘরে আনবার ও চাই?

আমি পিছনে ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলি,

— আসতে কে চায়?

নাসরিন বেগম তেতে উঠে বলে,

— আবার মুখে মুখে কথা কস। অপয়া জানি কোনহানকার।

— নতুন কিছু বলুন। একই কথা শুনতে শুনতে কানটা খুলে পড়ে গেল।

— দেখছোস ওসমান! মাইয়ার সাহচ দেখছোস নি?

আমি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলি,

— তামাশা করার জন্য ডেকেছেন আমায়?

ওসমান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,

— তামাশা তুমি করছো আমরা না।

আমি তাচ্ছিল্যের সুরে বলি,

— অহ সরি! ভুলে গিয়েছিলাম তামাশা তো শুধু আমি এই করি। মানুষের জীবন ধ্বংস ও আমি এই করি। অন্ধকার নিয়ে আসি সবার জীবনে। ঘোর অন্ধকার! যেমন আপনার মেয়ের জীবনে নিয়ে এসেছি। আপনার পরিবারের উপর নিয়ে এসেছি।

বলে হু হু করে হেসে উঠি। নাসরিন বেগম তেতে উঠে বলে,

— তুই বার বার কথার মাঝে আমার নাতিনটারে টাইন্না আনোস কেন? আমার নাতিনটার সুখ তোর বুঝি সহ্য হয় না? এহন তো নিজের বদনজর থেইক্কা রেহাই দে ওরে। শান্তিতে থাকবার দে।

আমি নাসরিন বেগমের দিকে তাকিয়ে বলি,

— আমি তো সুখেই আছি তাহলে অন্যের সুখ দেখে আমি জ্বলবো কেন? বরং আমার মনে হয় আমার সুখ দেখে আপনার জ্বলে।

নাসরিন বেগম কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওসমান সাহেব বলেন,

— থামো তো মা। আর সিয়াশা তুমি কি চাও এখন তা বলো।

আমি নির্মল চোখে তাকিয়ে বলি,

— আমি কি চাইবো?

— এইগুলো তুমি নিবে কি না?

— প্রশ্নই আসে না।

— ঠিক আছে। তুমি এখন আসতে পারো।

আমি আর কিছু না বলে সোজা রুমে চলে আসি৷ রুমে এসে চুপচাপ দরজা লাগিয়ে বসে রই। মাথাটা ব্যথা করছে। ঠোঁট দুইটি শুকিয়ে এসেছে। গলা বার বার ধরে আসছে। মনে হচ্ছে যেন গলার মাঝে কোন কাঁটা বিঁধে আছে যা ক্ষণে ক্ষণে আমায় পিড়া দিচ্ছে। গাল নাক গরম হয়ে এসেছে। হয়তো লালও হয়ে এসেছে। নয়ন জোড়া যেন আজ অবাধ্য হয়ে উঠেছে। কিছুতেই কথা শুনছে না। আমি দ্রুত ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে থাকলাম। কল ছেড়ে মাথায় পানি দিয়ে নিলাম। বেশকিছুক্ষণ মাথায় পানি দেওয়ার পর বেরিয়ে আসলাম। ইতি মধ্যে সারা গা পানিতে ভিজে একাকার। আমি কোন মতে চেঞ্জ করে মাথা মুছতে মুছতে বারান্দায় চলে গেলাম। চারদিকে গুমোট অন্ধকার। আকাশের বুকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শুভ্র আলোর ছড়াছড়ি। কোথাও হয়তো হাসনাহেনা ফুলটি ফুটেছে। তারই তীব্র ঘ্রাণ বাতাসে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি আকাশের পানে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকি। বেশ কিছুক্ষণ পর বারান্দায় রাখা বেতের মোড়াতে বসে পড়ি। দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নি। ভালো লাগছে এখন।

____________________

ঘন্টা খানিক যেতেই দরজায় করাঘাত পড়ে। দুই একবার দরজায় করাঘাত পড়তেই আমার মস্তিষ্ক সচল হয়ে যায়। আমি চোখ খুলে উঠে দাঁড়াই। অগ্রসর হই রুমের দিকে। দরজার খুলতেই দেখতে পাই রোয়েনের ক্লান্ত মুখখানি। কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘান। সারা গা ঘামে ভেজা। আমি দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়াতেই সে দ্রুত রুমে ঢুকে পড়ে। নিজের ব্যাগ থেকে একসেট জামা আর টাওয়াল নিয়ে ঢুকে পড়ে ওয়াশরুমে। আর আমি বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসে পড়ি। মিনিট দশকের মধ্যেই তিনি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে। আমি তার দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— কোথায় ছিলেন?

সে আমার দিকে বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে বলে,

— তোমার কাজিনরা আমায় কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের প্রাপ্য ট্রিট আদায় করার জন্য। ডিসগাস্টিং!

আমি শান্ত কন্ঠে বলি,

— এতক্ষণ তাহলে আপনি বাসায় ছিলেন না?

সে বিরক্তিকর কন্ঠে বলে,

— না!

আমি আর কিছু না বলে চুপ করে থাকি। সে নিজের মুখ হাত মুছতে মুছতে চলে যায় বারান্দার দিকে।

_____________________

সকালে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছি। মা আলতোভাবে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মনের মাঝে কেমন এক শান্তি কাজ করছে। আসলেই মা মানে শান্তির ঠিকানা। তার নীড়েই সকল সমস্যার সমাধান। সকল ক্লান্তির অবসান। মা আমায় এইটা সেটা নিয়ে জিজ্ঞেস করছে। আমিও ভালো মত তার সকল প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। একসময় মা কাজ আছে বলে উঠে চলে যায় আর আমি চুপচাপ সোফায় বসে মোবাইলে গেম খেলতে থাকি। বাসায় এখনো তেমন কেউ উঠে নি। তাই মোটামুটি নীরব পরিবেশ। হয়তো আর একটু পর সোরগোল লেগে যাবে। আমি গেম খেলছি এর মধ্যেই হৃদিপু আমার পাশে এসে বসে। গম্ভীর মুখ নিয়ে বলে,

— সিয়া শুন! তোর সাথে কিছু কথা আছে। কথাটা বলবো বলবো বলেও ভুলে গিয়েছিলাম কাল।

আমি গেম খেলতে খেলতে বলি,

— এখন বলে ফেলো৷

— এডমিশন টেস্ট নিয়ে কিছু ভেবেছিস? এখন যদি কোন কোচিং এ ভর্তি না হোস তাহলে পিছিয়ে পড়বি তো।

আমি গেমের দিকেই মনোযোগ দিয়ে বলি,
— আমি এডমিশন টেস্ট দিচ্ছি না। আমার আর লেখাপড়া করার প্রতি ইন্টারেস্ট নেই।

হৃদিপুর বিষ্ময়ে চোখ বড় হয়ে আসে। সে অবিশ্বাস্য সুরে বলে,

— পাগল হয়েছিস? পড়ালেখার প্রতি ইন্টারেস্ট নেই মানে কি?

আমি গেম শেষ করে মোবাইল অফ করতে করতে বলি,

— নেই মানে নেই।

— তোর না হাইয়ার স্টাডিস নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল? নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রবল ইচ্ছা ছিল? সেগুলো গেল কোথায়?

আমি নির্মল চোখে তাকিয়ে বলি,

— স্বপ্ন হচ্ছেই ভাঙ্গার জন্য। আমারটাও ভেঙ্গে গেছে। আর তার উপর আমি যদি পড়তে চাইও তাহলে আমাকে পড়াবে কে শুনি? খরচ দিবে কে আমার? তোমার চাচা?

— কেন ভাইয়া পড়াবে। তুমি বলবি তুই আরও পড়তে চাস।

— ইচ্ছা থাকলে না হয় বলবো। ইচ্ছাটাই তো নেই আর। তোমার চাচা যে সকল স্বপ্ন, ইচ্ছেকে মেরে ফেলেছে।

— কিন্তু….

আমি হৃদিপুকে বলতে না দিয়ে বলি,

— আমাকে নিয়ে এত টেনশন করো না তো। মানিয়ে নিয়েছি আমি সবকিছুর সাথে। সেই সাথে সম্পর্কটাকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি। তাই যেভাবে যা চলতে চাচ্ছে চলতে দাও।

কথাটা বলেই আমি হৃদিপুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। মিনমিনিয়ে বললাম,

— মাথায় হাত বুলিয়ে দাও তো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here