নিভৃতে_যতনে Part_09,10

0
1980

নিভৃতে_যতনে
Part_09,10
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_09

কফি হাতে নিয়ে রোয়েনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ। কিন্তু সে? সে তো এখনো ঘুমে কাঁদা। ঘড়িতে দশটা বেজে সতেরো মিনিট। বাইরে সকলই ইতিমধ্যে উঠে রোয়েনের খোঁজ নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। তাও খোঁজ নিচ্ছে কার কাছে? আমার কাছে। তাদের ভাব এমন যেন আমি তাকে সাথে নিয়ে নিয়ে ঘুরছি। আমাকে তার কথা জিজ্ঞেস করার সাথে সাথে ঠাস করে উত্তর দিয়ে দিব। যতসব!
অতঃপর না আমায় ডেকে রোয়েনের জন্য কফি ধরিয়ে দেয় আর বলে রোয়েনকে দিয়ে আসতে। আমি আর কিছু না বলে মুখ ফুলিয়ে চলে আসি রুমে। এসে দেখি মাননীয় আমার বর মহাশয় এখনো ঘুম থেকেই উঠেনি। আমি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে রোয়েনকে ডাকতে থাকতাম। কিন্তু না তার কোন সাড়া নেই। আবার ডাকতে গেলেই রোয়েন খ্যাঁক করে ধমকে উঠে অতঃপর আমার গভীর ঘুমিয়ে তলিয়ে যায়৷
মেজাজ আমার আপাতত ফোরটি নাইন হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে এই গরম কফির মধ্যে একে ডুবিয়ে ভূত বানিয়ে ফেলি৷ কিন্তু সব ইচ্ছে কি আর পূরণ হয়? আমি দাঁতে দাঁত চেপে রোয়েনকে ডাকতে থাকি।

— এই যে মিস্টার খাটাশ শুনছেন? উঠবেন নাকি বিছানায় লেপ্টে থেকে শহীদ হওয়ার ইচ্ছে আছে?

কিন্তু নো রেসপন্স। এই ব্যাটার ঘুম দেখি কাঁঠালের আঠার মত। একবার লাগলে উঠতেই চায় না। আমি এইবার একটু উঁচু স্বরেই ডাকতে থাকি। একসময় রোয়েনের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে আর সে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে তাকায়। তা দেখে আমার স্বস্তির নিঃশ্বাস নেই। রোয়েন উঠে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে বলে,

— হোয়াট?

আমি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলি,

— হোয়াট-ফোয়াট ছাড়েন আর উঠেন। কয়টা বাজে সেই খবর আছে? আপনাকে উঠাতে গিয়ে আমি শহীদ হয়ে গিয়েছি। মানুষ এত ঘুমে বিভোর কিভাবে হয়? হাও?

সে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,

— আমার ও জানা ছিল না মানুষ ভাঙ্গা রেডিও এর মত বাজতে পারে। হেডেক ম্যান!

বলেই সে বিছানা ছেড়ে উঠে পরে আর ফ্রেশ হতে চলে যায়। আমি সেইদিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে থাকি। বিরবির করে বলি,

— এই ব্যাটা আস্ত এক ঘাড়ত্যাড়া৷

_____________________

খাবার টেবিলে সবাই বসে আছি। সকলেই যে যার মত খাচ্ছে। আমিও এক সাইডে চুপচাপ বসে খাচ্ছি। এমন সময় ওসমান সাহেব বলে উঠে,

— রোয়েন বাবা শুনো!

রোয়েনও চুপচাপ খাচ্ছিল। ওসমান সাহেবের কন্ঠ শুনে সে মাথা তুলে তাকায়। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

— জ্বী বলুন।

— রীতি অনুযায়ী আজ তোমায় বাজার করতে হবে। তা তুমি বাজার করতে পারবে তো।

রোয়েন আবার খাবারের দিকে মনোযোগ দিয়ে বলে,

— জ্বী পারবো।

কথাটা শুনে ওসমান সাহেব কিছু টাকা এগিয়ে দিয়ে বলেন,

— তা এই টাকা গুলো নাও আর একটু ভাইজানের সাথে বের হয়ে যেও।

কথাটা শুনে আমি চকিতে তাকাই। রোয়েনও মাথা তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অতঃপর বলে,

— টাকা কিসের জন্য?

কথাটা শুনে ওসমান সাহেব থমথমে খেয়ে বললেন,

— বাজারের জন্য।

রোয়েব একটু গম্ভীর গলায় বলে উঠে,

— বাজারটা যেহেতু আমায় করতে হবে তাই আমি চাই পুরো খরচটা আমি একাই বহন করতে।

— কিন্তু বাবা..

ওসমান সাহেবকে কিছু বলতে না দিয়ে রোয়েন বলে উঠে,

— আমি নিজ থেকে বাজারটা করতে চাচ্ছি। আর কিছুই না। আশা করি এতে কারো কোন ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা না।

কথাটা বলেই রোয়েন আবার খাবারের দিকে মনোযোগ দেয়। কথাটা শুনে ওসমান সাহেব একটু অপমানিতবোধ করেন কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বললেন না। চুপচাপ নিজের হাত গুটিয়ে নিলেন। সকলে কিছুক্ষণ রোয়েনের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে ফেলে। আর এইদিকে ওসমান সাহেবের চেহেরা দেখে আমার মনে প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেল। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো সুরু হাসি। ভিতরে ভিতরে কি যে খুশি লাগছে আমার আজ। মন চাচ্ছে বাচ্চাদের মত উড়াধুরা লুঙ্গি ডান্স দেই৷ কথা না বললেই নয়, আজ প্রথমবারের মত রোয়েনকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে আমার। সে যা করেছে তা যে আমার জন্য মানসিক প্রশান্তি।

_________________

আজ প্রায় দু’দিন হতে চললো সেই বাসা থেকে এসেছি। আসার সময় তেমন কোন ঝামেলা হয় নি। ভালোয় ভালোয় এসে পড়েছি আমরা। এইখানে আসার পর রোয়েনের বাবা-মাকে আপন করে নিতে শুরু করেছি৷ তাদের সাথে মিশতে শুরু করেছি। আর করবোই না কেন? তারা যে আমার অনেক খেয়াল রাখছে। দু’দিনের মধ্যেই মায়ের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে উঠেছে। বাবার সাথেও মোটামুটি। শুধুমাত্র এই খাটাশ ব্যাটার সাথেই আমি সুবিধা কর‍তে পারছি না৷ আর পারবো বা কিভাবে? ঘাড়ত্যাড়া মানুষের সাথে কি সোজা ভাষায় কথা বলা যায়? আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যাকে অসহ্য লাগে তার সাথে ভাব জমায় কিভাবে মানুষ? হাও? আমি তো ভাই পারি না আর পারতে চাইও না। হুহ।

বিকেলে রুমে বসে বসে ফেসবুকিং করছি আর পাশেই রোয়েন বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। কিছুক্ষণ পর রোয়েন ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

— সিয়াশা শুনো!

রোয়েনের ডাক শুনে যেন আমি আকাশ থেকে পড়ি৷ গোলগোল চোখে তার দিকে তাকাই। বুঝার চেষ্টা কথাটা কি তিনি নিজেই বলেছে নাকি কোন ভূত-প্রেত বলেছে। কেন না এই পর্যন্ত যতবার আমাদের কথাবার্তা হয়েছে তা আমি শুরু করেছি আর তিনি আমার কথার পিঠে উত্তর দিয়েছেন। এছাড়া তো বোমা মারলেও উনার মুখ দিয়ে বলি ফুটানো যায় না। আর সে নাকি আজ নিজ থেকে কথা বলছে। আদৌ বিশ্বাস করা যায়? আমি আমতা আমতা করে বলি,

— আমায় কি ডেকেছিলেন?

উনি আমার কথা শুনে মাথা তুলে আমার দিকে তাকায়। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে,

— এইখানে তুমি বাদে দ্বিতীয় সিয়াশা বলে কেউ আছে নাকি?

আমি থমথম গলায় বলি,

— না।

রোয়েন পুনরায় ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে,

— কালকে সকালে রেডি থেক।

— কেন?

— বেরুবো!

আমি ভ্রু কুঞ্চিত করে বলি,

— আপনি বের হলে হবেন,তো আমাকে কেন রেডি হতে হবে?

রোয়েন এক রাশ বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— তোমাকে নিয়েই বের হবো। ষ্টুপিড!

কথাটা শুনে আমার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে। আমি দৃঢ় গলায় বলি,

— আমাকে নিয়ে? কোথায়?

— কোচিং এ ভর্তি করাতে। সামনে না তোমার এডমিশন টেস্ট?

আমি থমথম গলায় বলি,

— হুম কিন্তু আমি আর পড়তে চাই না। তাই এইসব কোচিং টোচিং এ ভর্তি করানোর কোন প্রয়োজন নেই।

রোয়েন ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টি আরও প্রখর হয়ে আসে। সে গম্ভীর গলায় বলে,

— পড়তে চাও না মানে কি?

আমি স্বাভাবিক কন্ঠে বলি,

— চাই মানে চাই না। আর বিয়ে-শাদির পর আর কিসের পড়ালেখা? এখন তো আমায় সংসার এই সামলাতে হবে। মেইনলি যেটার জন্য আপনি আমায় বিয়ে করেছেন।

রোয়েন এইবার আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাগান্বিত কন্ঠে বলে,

— ঠাডিয়ে দিব এক! এক ডিগ্রি বেশি না বুঝলে হয় না? আমি বলেছি সংসার সামলাতে বা বাসার কেউ বলেছে?

আমি থমথম গলায় বলি,

— না কিন্তু….

আমার কথার মাঝে রোয়েন ফোড়ন দিয়ে বলেন,

— কিন্তু কি? যদি ভেবে থাকো তুমি সারাজীবন আমার টাকায় চলবে তাহলে সে গুড়ের বালি। আমি তোমাকে সারাজীবন ঘরে বসিয়ে খাওয়াবো না। তোমাকে পড়ালেখা করতে হবে এবং নিজে আয় করে খেতে হবে।

আমি কাঠ কাঠ গলায় বলি,

— পারবো না আমি। আপনি আমায় খাওয়ান আর নাই খাওয়ান সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু আমি আর পড়ালেখা করবো না। পড়ালেখা করার ইচ্ছেটাই এখন আর নেই আমার মধ্যে।

— তুমি পড়বে না মানে তোমার ঘাড় ও পড়বে। আমার ওয়াইফ যেহেতু হয়েছ সেহেতু পড়ালেখা তো তোমায় করতেই হবে।

আমি এইবার রেগে গিয়ে বলি,

— কোন জোড়াজুড়ি আছে নাকি?

রোয়েন নিজের কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে আমার এক বাহুতে টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে আসে। গম্ভীর গলায় বলে,

— স্বামী যেহেতু আমাকেই মেনেছ সেহেতু তার কথাও তোমার মানতে হবে। এখন সেটা যাই হোক। রাগী না বলে এই না আমি রাগতে জানি না। আমি রাগলে কিন্তু এর পরিনতি খুব খারাপ হবে। তাই বলছি তুমি পড়বে মানে পড়বে। নো মোর আরগিউমেন্টস।

কথাটা বলেই রোয়েন আমায় ছেড়ে দেয় আর রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আমি একবার রোয়েনের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেলি।মস্তিষ্কের মাঝে বিচরণ করতে থাকে একটাই ধ্বনি,

— “তোমার উপর টাকা খরচ করাই মানে অপচয়। আমি আর এক টাকাও তোমার উপর অপচয় করতে পারবো না।”

উক্তিটি আমার জন্য ওসমান সাহেবের পক্ষ থেকেই ছিল। আর সেই উক্তিটি যেন আমার মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে৷ তাই তো আমি আর চাই না কেউ তার টাকা আর আমার উপর অপচয় করুক। হোক সে আপন অথবা পর। কিন্তু ভাগ্য কি আর তা মানে?

_____________________

সকালে নাস্তার টেবিলে বসে আছি। সকলে মিলে একসাথে নাস্তা করছি। এমন সময় সালমা বলে উঠেন,

— রোয়েন তোর আর কত ছুটি আছে??

রোয়েন খেতে খেতে বলে,

— আছে পাঁচ-ছয় দিনের মত।

সালমা বেগম তা শুনে বলেন,

— যেহেতু ছুটি হাতে আছে সেহেতু সিয়াশাকে নিয়ে কোথাও থেকে না হয় ঘুরে আয়।

কথাটা শুনার সাথে সাথে আমি বিষম খেয়ে যাই। শ্বাশুড়ি আমার কোন দিকে ইঙ্গিত করেছে তা আমার বুঝতে দেরি নাই। মা তারাতাড়ি উঠে এসে আমায় পানি দেন আর পিঠ বুলিয়ে দেন। একটু পর স্বাভাবিক হতেই রোয়েন বলে উঠে,

— এই বিষয় নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আপাতত সিয়াশার সামনে এডমিশন এক্সাম তাই আজ ওকে কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দিতে যাচ্ছি।

সালমা বলে উঠেন,

— এইটার কথা তো মনেই ছিল না আমার। তা আজ ভর্তি করাবি?

রোয়েন ছোট করে “হুম” বলে খেতে থাকে। তৌফিক সাহেব হঠাৎ বলে উঠেন,

— দায়িত্বটা যেহেতু নিয়েছিস ঠিক মত পালন করিস।

কথাটা বলেই তিনি উঠে গেলেন। সালমা বেগম সেদিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ করে বলেন,

— বিকেলে তাহলে বাসায় ফোন করে তোমার বইগুলো দিয়ে যেতে বলো।

আমি কিছু না বলে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাই। খাওয়া-দাওয়া শেষে রোয়েন আমায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ফার্মগেটের উদ্দেশ্যে৷

চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_10
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

রাত প্রায় নয়টা ছুঁই ছুঁই৷ আমি বিছানায় গালে এক হাত দিয়ে বসে আছি৷ সামনে বই আর কতগুলো শিটের ছড়াছড়ি। এদের মাঝেই কলম, পেন্সিল ও রাবারের লুকোচুরি খেলা। পাশেই রোয়েন ল্যাপটপে কি যেন করছে। আমি একবার আড়চোখে রোয়েনকে দেখছি আরেকবার বইখাতা গুলোর দিকে। মাঝে মধ্যে দুই একটা বই নেড়ে চেড়ে দেখছি। কিন্তু বুঝতেই পারছি না পড়াটা শুরু করবো আসলে কোথা থেকে? যাই দেখছি সব নতুন লাগছে। এমনকি ডেবিট ক্রেডিটের বিষয়টাও নতুন লাগছে। ফিন্যান্সের সাধারণ সুদ আসলের সূত্র ও যেন এখন জাগাখিচুড়ি লাগছে। মনে হচ্ছে যেন এইগুলো আমি জীবনে চোখেই দেখিনি। করা তো দূরের কথা। এইগুলো এখন কিভাবে কভার আপ করবো? হাও?
মাঝে মাত্র ১ মাস গ্যাপ গিয়েছে আর এতেই আমার অবস্থা যাচ্ছে তা। অবশ্য এই এক মাসে আমার উপর দিয়ে কম ধকল যায়নি৷ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক চাপে ছিলাম, ডিপ্রেসড ছিলাম। তার উপর এই বিয়ে৷ এক কথায় এইসবের মাঝে পড়ালেখা আমার পিছনের জানালা দিয়ে পালিয়ে চান্দের দেশে চলে গিয়েছে কিন্তু এখন আমার কি হবে? এত মোটামোটা বই, শিট আমি আড়াই মাসের মধ্যে কিভাবে শেষ করবো? হাওওওও? হৃদিপুকে এখন উল্টিয়ে পিটাতে ইচ্ছে করছে। কে বলেছিল আমার এক কথাই বিকেলের দিকেই বইগুলো পাঠিয়ে দেওয়ার? বই যদি আজ না পাঠাতো তাহলে এটলিস্ট আজ এই খাটাশ ব্যাটা জোর করে আমায় পড়াতে বসাতে পারতো না৷ হুহ!

কথাগুলো ভেবেই আমার ভিতরের সকল দুঃখ উপচে পড়ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি ঠুস করে চোখ চিরে দুঃখ বেরুবো আর ঠাস করে গালে ছাপ বসাবে। কিন্তু এই প্রসেস চালু করার আগেই রোয়েন ফুল স্টোপ লাগিয়ে দিয়ে বলে,

— বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে বুঝি পড়া হয়ে যায়?

কথাটা শুনে আমি রোয়েনের দিকে তাকাই। দাঁতে দাঁত চেপে বলি,

— আমি বলেছি পড়া হয়ে যায়?

রোয়েন আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— তাহলে এইভাবে উল্লুকের মত বইগুলোর দিকে তাকিয়ে আছো কেন? পড়া শুরু করো।

শেষের কথাটা তিনি আদেশের সুরেই বললেন। আমি রোয়েনের কথা শুনে ব্যঙ্গ করে বলি,

— পড়া শুরু করো! বললেই হয় নাকি? আরেহ ভাই আমার আগে তো বুঝতে হবে কোথা থেকে শুরু করবো।

উনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

— আমি তোমার ভাই লাগি?

আমি একটু ভেবে বলি,

— হ্যাঁ লাগেন এই তো। জামাই ভাই!

কথাটা শুনে রোয়েনের ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়ে আসে৷ সে একটু গম্ভীর গলায় বলে,

— হোয়াট রাবিশ! জামাই ভাই কি আবার?

আমি আমতা আমতা করে বলি,

— সংজ্ঞা আপাতত জানি না। জেনে বলবো নে।

রোয়েন এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,

— জেনে আমাকে উদ্ধার করিও৷ এখন পড়া শুরু করো।

আমি মুখ ফুলিয়ে আগে ফিন্যান্স বইটা হাতে নিলাম। তা দেখে রোয়েন বলে,

— আগে সহজ কোন সাবজেক্ট থেকে পড়া শুরু করো। লাইক বাংলা, ইংরেজি ওর ম্যানেজমেন্ট।

আমি উনার দিকে সুরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— কোন খুশিতে?

উনি নিজের ল্যাপটপে দিকে মনোযোগ দিয়ে বলেন,

— প্রথমেই সহজ কোন সাবজেক্ট দিয়ে পড়া শুরু করতে হয়। এতে ব্রেনে চাপ কম সৃষ্টি হয় আর সহজেই পড়া মনে রাখতে পারে। সেই সাথে মনোযোগ ও সৃষ্টি হয়৷ যার ফলে পরবর্তীতে হার্ড সাবজেক্টগুলো বুঝতে বেগ পেতে হয় না। ডাফার! না সরি তুমি তো আবার বুঁচি।

আমি নাক ফুলিয়ে হুট করে উনার নাক টেনে ধরে বলি,

— আরেকবার যদি বুঁচি বলেছেন না আপনার নাক আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। আমি মোটেও বুঁচি না। হুহ!

আমার এই এহেন কান্ডে রোয়েন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। উনি আমার দিকে গোলগোল চোখে তাকায়। অতঃপর এক ঝাটকায় আমার হাত সরিয়ে টান দিয়ে আমায় একদম তার কাছে নিয়ে যান। অতঃপর শীতল কন্ঠে বলেন,

— তোমার সাহস কিভাবে হয় আমার নাক ধরার? আর বুঁচিকে বুঁচি বলবো না তো কি বলবো ডাইনি?

প্রথমে তার এত কাছে চলে আসায় আমি ভড়কে যাই। তার থেকে সরে আসার চেষ্টা করি কিন্তু পরক্ষণেই তার কথা শুনে আমি কটমট চোখে তাকাই। কাঠ কাঠ গলায় বলি,

— আমার নাক বুঁচা না বুঝলেন। একদম কিউট একটা নাক আমার। একে অপমান করার কোন অধিকার নাই আপনার।

আমার কথা শুনে রোনের ঠোঁটের এক কোনে সুরু এক হাসির রেখা ফুটে উঠে৷ উনি আমার মুখের দিকে একটু ঝুঁকে বলে,

— তাই নাকি?

উনি আমার এত কাছে চলে আসায় আমি ভড়কে যাই। সেই সাথে মুহূর্তেই আমার বুক কিঞ্চিৎ ধক করে উঠে। প্রায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা আমার। নয়ন দুইটি চঞ্চল হয়ে আসে আর ঠোঁট ও গলা শুকিয়ে আসে। আমি কোন মতে জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট যুগল ভিজিয়ে নিয়ে আমতা আমতা করে বলি,

— হু..ম! এ..খন স..ড়ু…ন প্লি..জ!

কথাটা বলেই আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। চোখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম তার নয়ন দু’টি মাধুর্য বেশ গভীর। কিছু তো একটা আছে এই নয়ন যুগলের মাঝে। যা আমাকে গভীর ভাবে এক ঘোরের মাঝে ফেলে দিচ্ছে। আগে জানতাম মেয়েদের চোখ নাকি সর্বনাশী চোখ হয়৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ছেলেদের চোখও সর্বনাশী হয়। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের লিখা গানের দুটো’ লাইন মস্তিষ্কে টনক নেড়ে উঠে,

” প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস—
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”

আমার তার প্রতি এমন চাহনি দেখে উনার ভ্রু কুটি কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়ে আসে। উনি আমার নাক টেনে দিতেই আমি ঘোর থেকে বেরিয়ে আসি আর আমি তার থেকে ছিটকে দূরে এসে পড়ি। রোয়েন নিজের কাজের দিকে মন দিয়ে বলে,

— পড়া শুরু করো মিস বুঁচি।

কথাটা শুনে রাগ হলেও আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ ম্যানেজমেন্ট বইটা নিয়ে জোড়ে জোড়ে পড়া শুরু করলাম। মূল উদ্দেশ্য রোয়েনকে জ্বালানো। মায়ের কাছে শুনিছি তিনি নাকি কাজের সময় শব্দ পছন্দ করেন না। তো আমি সেই সুযোগের সৎ ব্যবহার করছি। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অতিক্রম হওয়ার পরও যখন রোয়েনের কোন প্রতিক্রিয়া পেলাম না তখন পাশে ঘুরে দেখি খাটাশ মহাশয় কানে হেডফোন লাগিয়ে কাজ করছে। সেটা দেখার সাথে সাথে আমি নিজের কপালে চাপড় মেরে বিরবির করে বলি,

— ভুলে যাস কেন এই ব্যাটা একটা আস্ত খাটাশ। একে সায়েস্তা করা এত সোজা না।

কথাটা বলে পাশে তাকিয়ে দেখি রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখ ‘প’ টাইপ উচ্চারণ করতেই নিবে তার আগেই আমি বলি,

— উফফ! পড়ছি তো ভাই। এতবার বলা লাগে?

কথাটা বলে বইয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। এমন একভাব করলাম যে, এখনই আমি টুপ করে বইয়ের ভিতর ঢুকে যাব।

_____________________

সকালে আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছি এমন সময় রোয়েন তাড়া দিয়ে বলে,

— সময় কি তোমার জন্য বসে থাকে?

আমি আয়নার মধ্য দিয়েই রোয়েনের দিকে তাকিয়ে বলি,

— মানে?

— কয়টা বাজে খেয়াল আছে? ১০ টায় ক্লাস তোমার আর এইখানে অলরেডি নয়টা বাজে। রাস্তায় যে কি পরিমাণ জ্যাম থাকে সেইদিকে খেয়াল আছে?

আমি নাক ফুলিয়ে বলি,

— হয়েই গিয়েছে।

কথাটা বলে মিনিট পাঁচেকের মাঝেই ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে একবারে পরিপাটি হয়ে গেলাম। রোয়েন আমার দিকে একবার তাকিয়ে বাইরে বের হয়ে যায়৷ আমিও তার পিছু পিছু বেরিয়ে আসি। বাবা-মাকে বলে রওনা দিয়ে দেই।

পার্কিং এরিয়াতে এসে দাঁড়াতেই দেখি রোয়েন কোথাও যেন চলে যায়। অতঃপর মিনিট দুয়েকের মাঝেই উনি এক বাইক নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়৷ বাইক দেখে আমি তার দিকে বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাই। অস্ফুটস্বরে বলে উঠি,

— এইটা কোথা থেকে টপকালো?

রোয়েন হাতে থাকা দুইটা হেলমেট খুলতে খুলতে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়৷ শীতল কন্ঠে বলেন,

— মানে?

— বাইকটা কার?

উনি বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলে,

— চালাচ্ছি যেহেতু আমি সেহেতু কার হওয়ার কথা এইটা?

আমি তার উত্তর শুনে থমথম খেয়ে বলি,

— আপনারই। কিন্তু এতদিন দেখলাম না যে?

— সার্ভিসিং এ ছিল।

হঠাৎ মুখ ফোসকে বেরিয়ে আসে,

— কিন্তু আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার মত খাটাশের বাইকও থাকতে পারে।

কথাটা বলেই আমি অস্বস্তিতে পরে যাই। নয়ন দুটি আমার চঞ্চল ভঙ্গিতে এইদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এইদিকে রোয়েনের আমার দিকে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। অতঃপর আমার দিকে একটা হেলমেট এগিয়ে দিয়ে বলে,

— উঠো!

রোয়েনের কথা শুনে আমি আরেক দফা বিপাকে পড়ে যাই। কেন না এর আগে আমি বাইকে উঠি নি। কিভাবে উঠে তাও জানি না। আমি তাকে ইতস্তত সুরে বলি,

— আমি বাইকে উঠতে পারি না।

সে আমার কথা শুনে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণের মত করে উঠে। অতঃপর এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,

— তা পারবে কেন? পারো তো খালি আমার মাথা খেতে। ডিসগাস্টিং!

কথাটা বলেই তিনি আমায় আগে হেলমেট পড়তে বললেন এবং বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে উঠতে হবে৷ আমিও তার কথা মত হেলমেট পড়ে উঠে পড়ি বাইকে। সেই সাথে রোয়েনের কোমড়ের দিকে শার্ট আঁকড়ে ধরি। রোয়েন একবার কিছু বলতে গিয়ে বললো না। চুপচাপ বাইক স্টার্ট দিয়ে দিল।

_________________________

দেখতেই দেখতে চার দিন কেটে যায়। আজ বাবা-মা দেশের বাড়ি চলে গিয়েছেন। বেশ খারাপই লাগছে। কেন না এই কয়েকদিনে তাদের সাথে অনেক ভালো এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমার। যে ভালবাসাটা আমি ওই বাসায় পায়নি তা তাদের কাছে পাচ্ছিলাম। বাবার ভালোবাসাটাও আমি পেয়েছে শ্বশুর নামক বাবাটির কাছ থেকে। এক মায়ের ভালোবাসা তো পেয়েছিলামই এইখানে এসে দ্বিতীয় মায়েরও ভালোবাসা পেয়েছিলাম। বলতে গেলে দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম তাদের উপর। এখন তাদের চলে যাওয়ায় বুকের ভিতর চাপা এক কষ্ট অনুভব হচ্ছে। কিন্তু তা মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারছি না।

পড়ন্ত বিকেলের সময়। আকাশ আজ সমুদ্রের নীলের মত স্বচ্ছ। সেই স্বচ্ছ আকাশের বুকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে তুলোর মত পেঁজো পেঁজো মেঘ। রোয়েনদের বাসা রাস্তার ধারে না হওয়ায় পরিবেশটা বেশ নিরব। বারান্দার কার্নিশের উপর বসে এক জোড়া চড়ুই পাখি সুরে তুলতে বিভোর। আমি বারান্দার এক কিনারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি বাইরে। উদ্দেশ্য প্রকৃতির মাঝে থেকে নিজের মনের বিষন্নতা দূর করার। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে একটা ফ্রেশ মুড নিয়ে রুমে চলে আসি। রুমে এসে মোবাইল নিয়ে গেম খেলতে বসে পড়ি। মিনিট দশেক যেতে না যেতেই রোয়েন হাতে একটা কাগজ নিয়ে রুমে ভিতর প্রবেশ করে। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এরপর অতি গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,

— হোয়াট ইজ অল দিস সিয়াশা?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here