নিভৃতে_যতনে Part_11,12

0
1844

নিভৃতে_যতনে
Part_11,12
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_11

— হোয়াট ইজ অল দিস সিয়াশা?

কথাটা শুনার সাথে সাথে আমি ভড়কে যাই। অস্ফুট দৃষ্টিতে রোয়েনের দিকে তাকাই। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ দেখে আমি আমতা আমতা সুরে বলি,

— মানে কি?

রোয়েন আমার কোলে একটা কাগজ ছুঁড়ে মেরে বলে,

— এইটা কি?

আমি রোয়েনের দিকে একবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে কাগজটা হাতে নেই। ভাঁজ খুলেই বুঝতে পারি যে এইটা আসলে আমার একাউন্টিং এক্সামের খাতা। খাতার বা দিকটায় মোটা লাল কালি দিয়ে ২০/৬০ লিখাটা যেন জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠেছে। প্রেপারেশন ভালো ছিল না বিধায় এই রেজাল্ট। আমি খাতাটা দেখার পর কিঞ্চিৎ রোয়েনের দিকে তাকাই। ঠোঁটের কোনে সুরু এক হাসির রেখা ফুটানোর বৃথা চেষ্টা করে অস্ফুট স্বরে বলি,

— একাউন্টিং এর খাতা।

রোয়েন এইবার রুদ্ধদ্বার কন্ঠে বলে উঠে,

— কত পেয়েছ একবার দেখেছ? ষাটের মধ্যে মাত্র বিশ। এইটা কোন নাম্বার হলো? এই নাম্বার নিয়ে তুমি পাবলিক ভার্সিটিতে এক্সাম দিবে? লাইক সিরিয়াসলি?

আমি থমথম গলায় বলি,

— ইয়ে মানে..

উনি তার অগ্নি দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে বলেন,

— ডু ইউ ইভেন নো? পাবলিক ভার্সিটির এভারেজ নাম্বারও কত? জাস্ট এক নাম্বারের জন্য মানুষ শত জনের পিছে পড়ে যায়, চান্স পায় না। আর তুমি তো এখনো কোটি মাইল দূরে।

আমি মিনমিনে গলায় বলি,

— তো কি করবো?

আমার এই কথায় যেন রোয়েন আরও রেগে যায়। সে রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠে,

— কি করবে মানে কি? ইউ হ্যাভ টু ওয়ার্ক মোর হার্ড। কোচিং এর সব এক্সামে এভারেজে হলেও ষাটের মধ্যে পঞ্চান্ন উঠাতে হবে।

কথাটা শুনার সাথে সাথে মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমি গোলগোল চোখে তাকিয়ে রই। এই ব্যাটা কি পাগল? ষাটের মধ্যে পঞ্চান্ন? কেমনে কি ভাই? ওভার ডেট কিছু খেয়ে কথা বলছে নাকি? আমি অস্ফুটে সুরে বলে উঠি,

— ষাটের মধ্যে মানুষ পঞ্চান্ন কিভাবে পায়? হাও? আমি জীবনেও পারবো না।

— তুমি পারবে মানে সাথে তোমার ঘাড়ও পারবে। আর যদি তা না পেরেছ তোমার খাওয়া-দাওয়া সব অফ।

রোয়েনের কথা শুনার সাথে সাথে আমার ঠোঁট যুগলের মাঝে কিঞ্চিৎ দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। আমি অস্ফুটে স্বরে বলে উঠি,

— এইটা তো শিশু নির্যাতন।

কথাটা শুনে রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— এইখানে শিশু কে?

আমি কিঞ্চিৎ বলে উঠি,

— কেন আমি!

কথা বলে আমি নিজেই ব্যাক্কল বনে গেলাম। বোকা চোখে তাকিয়ে রইলাম রোয়েনের দিকে। আমি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে উঠে। এই প্রথম আমি রোয়েনকে হাসতে দেখছি। এর আগে কখনো তাকে হাসতে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না আমার। হাসার ফলে তার দুই ধারে থাকা গেজ দাঁত ফুটে উঠেছে। গেজ দাঁত দুইটি একদম ভ্যাম্পায়ারের দাঁতের মত। উঁচু, ধারালো আর সুক্ষ্ম। হাসিরটার প্রাণ হিসাবে যেন সেই গেজ দাঁত গুলো পালন করছে। কথাটা না বললেই নয়, তাকে হাসলে কিন্তু মারাত্মক লাগে।
আমি স্নিগ্ধ চোখে তার হাসির দিকে তাকিয়ে আছি। সে হেসেই আমাকে বলে,

— তুমি শিশু? লাইক সিরিয়াসলি? তা শিশুদের বুঝি বিয়ে হয়?

উনার কথা শুনে আমি ভড়কে যাই। আমতা আমতা করে বলি,

— ইয়ে মানে.. শিশুর জায়গায় নারী হবে। আর এইভাবেও শিশু হোক আর নারী হোক নির্যাতন তো নির্যাতন এই৷ হুহ!

রোয়েন হালকা হেসে বলে,

— তা নির্যাতনটা তকমাটা যখন লেগেই গিয়েছে তাহলে সেটার সৎ ব্যবহার করা যাক কি বলো?

আমি পুনরায় ভড়কে গিয়ে বলি,

— মানে?

উনি সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পকেটে নিজের দুই হাত গুঁজে বলে,

— এখন থেকে আমি তোমায় পড়াবো প্লাস তুমি পড়া না পারলে শাস্তিও দিব।

কথাটা শুনে আমার ঠোঁট যুগল আপন শক্তিতে নিজের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে নেয়। অস্ফুট স্বরে বলে উঠি,

— অ্যাহ!

রোয়েন কিছু না বলে চুপচাপ নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়। আমি চটজলদি বলে উঠি,

— আপনি না সায়েন্সের স্টুডেন্ট? আমাকে কিভাবে পড়াবেন? আপনি তো কমার্সের পড়া জানেন এই না।

সে ভ্রু কুঁচকে বলে,

— কে বলেছে আমি সায়েন্সের স্টুডেন্ট?

আমি মিনমিনে গলায় বলি,

— তো কমার্স নিয়ে পড়তে বলেছিল কে? সায়েন্স বা আর্টস নিয়ে পড়লে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?

— হ্যাঁ যেত।

আমি তীক্ষ্ণ গলায় বলি,

— আমি পড়বো না আপনার কাছে।

— লেটস সি৷

কথাটা বলেই তিনি রুম থেকে বেরিয়ে যান। আর নিজের কাপালে চাঁপড় মেরে বলি,

— এই ছিল তোর কপালে বুঝলি সিয়াশা। খাটাশ জামাই তো জামাই, এখন খাটাশ টিউটারও সে। হায় কপাল!

____________________________

রাত প্রায় আটটা ছুঁইছুঁই। আমি রুমের মধ্য ভাগে এক পায়ে কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আপ্রাণ চেষ্টা করছি নিজেকে ব্যালেন্স করার। কিন্তু তেমন ব্যালেন্স রাখতে পারছি না। রাখতে পারবো কিভাবে? জীবনে এইভাবে কানে ধরেছি নাকি? আজ জীবনে প্রথম এই খাটাশ ব্যাটাটার জন্য ধরতে হচ্ছে। তাও সাধারণ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি বলে। তাও প্রশ্ন কি ছিল? “স্বতন্ত্র অংশীদারী আইন পাশ হয় কত সালে?” আরেহ ভাই এর থেকে কত ইমপোর্টেন্ট ইমপোর্টেন্ট সাল আছে তাই মনে রাখা যায় না। সেখানে এইটা মনে রাখি কিভাবে? কিন্তু এই খাটাশকে তা কে বুঝায়? আমি রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে আর আমার বইয়ে কি যেন আঁকিবুঁকি করছে। তা দেখে আমি অস্ফুট স্বরে বলে উঠি,

— আর কতক্ষণ? পা ভেঙ্গে যাচ্ছে আমার৷

সে ভাবলেশহীন গলায় বলে উঠে,

— যতক্ষণ না তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ।

আমি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলি,

— জানি না তো। আর তার উপর এইটা এত ইমপোর্টেন্ট ও না যে মনে রাখতেই হবে।

আমার কথা শুনে সে কিঞ্চিৎ আমার দিকে চায়। অতঃপর গম্ভীর গলায় বলে,

— ছোট ছোট ধূলিকণা থেকেই কিন্তু এক স্তুপ সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে টিলা এরপর ধীরে ধীরে পাহাড়। তাই কখনো ছোট খাটো জিনিস কে অবহেলা করতে নেই। তাদের কে কম ইমপোর্টেন্ট বুঝতে নেই। বুঝেছ?

আমি গাল ফুলিয়ে মাথায় দুলাই। কিন্তু মনে মনে ঠিকই তার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলি৷ সে মিনিট দুয়েক পর আমাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বলেন এবং তার হাতের বইটা আমার হাতে দিয়ে বলে,

— নাও এখন এইটা পড়ো আর আমি যে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম সেটার উত্তর ও খুঁজে বের করো। না পারলে এরপরের বার পানিসমেন্ট ডাবল হবে।

আমি কিছু না বলে চুপচাপ বইটা নিয়ে মন দিয়ে পড়া শুরু করে দেই৷ কেন না এতক্ষণে আমি তাকে চিনে গিয়েছি। শাস্তি যেহেতু ডাবল দিবে বলেছে তার মানে দিবেই আর আমাকে নাস্তানাবুদ করেই ছাড়বে। স্বাদে কি খাটাশ বলি? হুহ!

___________________________

দেখতেই দেখতে এক সপ্তাহ চলে গেল। রোয়েনের ছুটিও ফুরিয়ে আসলো। তিন-চারদিন হতে চললো সে পুনরায় অফিসে নিয়োজিত হয়েছে। সকালে আমাকে কোচিং এ নামিয়ে দিয়ে সে অফিসে চলে যায়। বাকি আসার সময় আমায় একাই আসতে হয়। একা আসতে হয় বললে ভুল হবে, আসার সময় আমি এক সঙ্গী পেয়েছি৷ নাম তার সুরাইয়া। আমার সাথেই পড়ে এবং আমাদের এলাকাতেই থাকে। আমি থাকি ধানমন্ডি ‘নাইন এ’ নাম্বার রোডে আর ও থাকে পনেরো নাম্বার রোডে। তাই যাতায়াতে তেমন আর সমস্যা হয় না।
প্রথম দিকে ভেবেছিলাম খাটাশটা অফিসে গেলে হয়তো বা আমাকে আর পড়াতে পারবে না। তার হাত থেকে নিস্তার পাবো। কিন্তু সে যে গুড়ের বালি। তার অফিস টাইম শেষ হয় ছয়টা। সাতটা কি সাড়ে সাতটায় সে বাসায় এসে হাজির। এরপর ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে রাত নয়টা শুরু হয় আমার ক্লাস। যা চলে রাত এগারোটা অব্দি। এরপর পরেরদিনের জন্য এক গাদা পড়া ঝুলিয়ে দেয় গলায়৷ সেই সাথে পড়া না পড়লে শাস্তি তো আছেই। মানে সে না থাকলে আমায় পড়তেই হয়। পড়া থেকে আর নিস্তার নেই আমার।

কিছু দিন আগেই ম্যানেজমেন্টের উপর ষাট মার্কের পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তারই রেজাল্ট দিয়েছে আজ। ষাটের মধ্যে তিপ্পান্ন পেয়েছি। সেই সাথে এই পরীক্ষায় হায়েস্ট নাম্বারও আমি এনেছি। ভাবা যায়? সবই হচ্ছে মিস্টার খাটাশ ব্যাটার কামাল। যে হাড় খাটুনি আমাকে দিয়ে করাচ্ছে এমন নাম্বার পাবো না তো কি পাবো? ইতিমধ্যে ক্লাসে বেশির ভাগ সকলেই আমাকে নিয়ে টুকিটাকি কথা বলতে ব্যস্ত। বিষয়টা বেশ ভালোই লাগছিল। টপার টপার ফিলিং আসছিল৷ হিহিহি!
ক্লাস শেষে আমি নিজের ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে আসতে নেই তখন সুরাইয়া এসে বলে,

— ট্রিট দে।

আমি ভ্রু কুঁচকে বলি,।

— কোন খুশিতে?

সুরাইয়া দাঁত কেলিয়ে বলে,

— বাহ রে! এত ভালো রেজাল্ট করেছিস ট্রিট দিবি না? ট্রিট না দেওয়া পর্যন্ত আজ তোকে ছাড়ছি না। হুহ!

আমি এক গাল হেসে বলি,

— আচ্ছা যা এক প্লেট ফুচকা খাওয়াবো নে।

সুরাইয়া হালকা হেসে বলে,

— ওকে ডান! বাট আগে বসুন্ধরা যাব একটু। আমার কিছু কিনার আছে।

— আচ্ছা। চল এইবার।

কথা শেষ হতেই দুইজনে বেরিয়ে পড়লাম বসুন্ধরার উদ্দেশ্যে।

চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_12
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

বাসায় এসে আগেই আমি ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ফ্রেশ হয়ে আমি এগিয়ে গেলাম ডাইনিং এর দিকে। পলি আন্টিকে ডেকে বললাম খাবার দিতে। পলি আন্টি এই বাসায় কাজ করে। সকালে আসে আর যায় একদম সন্ধ্যায়। ঘর গুছানো থেকে শুরু করে রান্না-বান্নার সকল কাজ তিনি একাই করে। পলি আন্টি আমায় খাবার দিয়ে যেতেই আমি তাকে জিজ্ঞেস করি,

— তুমি খেয়েছ?

সে পিকে রাঙ্গা লাল ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,

— হো আফা খাইসি।

— আচ্ছা।

কথাটা বলেই আমি খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে আমি রুমে এসে পড়ি। কলেজ ব্যাগটার দিকে নজর যেতেই আমি সেদিকে এগিয়ে যাই। ব্যাগের প্রথম সারির চেইনটা খুলে তার মধ্য থেকে আলতো হাতে একটা বক্স বের করি। বক্সটা হাতে নিয়ে সেটা খুলে দেখতে থাকি। বক্সে ভিতর একটি জেন্টস ওয়াচ। ঘড়িটা ব্ল্যাক চেইনের মধ্যে। ঘড়ির ভিতরে সংখ্যা গুলো কেমন একটু পেঁচানো ধরনের যা দেখতে বেশ আকর্ষণীয়। সেই সাথে এর উপর দিকটা একটু গ্লেজ দেয়। ঘড়িটা সাধারণ হলেও চোখে পড়ার মতন।
আমি ঘড়িটার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি দুপুরের কথা। ক্লাস শেষে সুরাইয়ার সাথে বসুন্ধরা যাই। বসুন্ধরা যেতেই সে ঢুকে পরে ঘড়ির দোকান গুলোর দিকে। আমিও ওর পিছু পিছু যাই। সুরাইয়া নিজের জন্য ঘড়ি দেখতে থাকে আর আমি পাশে দাঁড়িয়েই চারদিকে চোখ বুলাতে থাকি। তখনই এই ঘড়িটা নজর কাড়ে। আমি চটজলদি সেটা বের করে দেখাতে বলি। কি ভেবে জানি না কিন্তু ঘড়িটা আমি কিনে ফেলি। কিনার পর সুরাইয়া জিজ্ঞেস করে উঠে, “ঘড়িটা আমি কিনলাম কার জন্য? তাও আবার ছেলেদের ঘড়ি।” তখন কথাটা শুনে আমিও নিজেও থমথম খেয়ে যাই। নিজেও বুঝতে পারছিলাম না আসলে ঘড়িটা আমি কার জন্য কিনলাম? আমি সুরাইয়াকে কোন উত্তর না দিয়ে অতি সাবধানে কথা কাটিয়ে গেলাম।

কিছুক্ষণ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে নিরবে ঘড়িটা অতি যত্নে কাবার্ডে উঠিয়ে রাখলাম। অতঃপর বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই পারি দিলাম তন্দ্রার রাজ্যে।

_______________________

বিছানায় মুখ ভার করে বসে আছি। সামনেই রোয়েন দাঁড়িয়ে আছে আর আমার দিকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। ডান হাতেই তার আমার ম্যানেজমেন্টের খাতাটি। উনি গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

— ষাটের মধ্যে তোমাকে আমি এভারেজে কত পেতে বলেছিলাম?

আমি থমথম গলায় বলি,

— পঞ্চান্ন!

কথাটা বলে একটু বিরতি নেই। অতঃপর নিজের কন্ঠ একটু শক্ত করে বলি,

— তো কি হয়েছে? ষাটের মধ্যে পঞ্চান্ন না পেলেও তেপান্ন পেয়েছি। হুহ! তেপান্ন পাওয়া কি মুখের কথা নাকি?

সে আরও গম্ভীর হয়ে বললো,

— ষাটে ষাট পেতে তাহলে না মানতাম এইটা পাওয়া মুখের কথা না। কিন্তু পেয়েছ কত? তেপান্ন! ডু ইউ ইভেন নো, এই এক-দুই নাম্বারের জন্য কত পিছিয়ে পড়তে হয়? অনেকের তো সিলেকশনই হয় না। পাবলিক ভার্সিটি কোন হেলায় নেওয়ার জিনিস নয়।

— দোষ কিন্তু আমার না। আমি ভালো মতই পড়ালেখা করেছি। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এখন দুই কম আসলে আমি কি করবো?

— আরও হার্ড ওয়ার্ক করবে। যেখানে দুই ঘন্টা পড়ো সেখানে তিন ঘন্টা পড়বে। নিজের লাইফে ভালো কিছু করতে চাইলে এই কয়েকটা মাস কষ্ট করতেই হবে।

— বলা সহজ করা না।

— করাও সহজ। মনের জোর থাকলেই হয়। তোমার মধ্যে মনের জোর আছে কিন্তু তুমি তা হেলায় নাও। আর এইটার জন্যই তুমি পিছিয়ে যাও। মনে রাখবে, ইম্পসিবল বলে কিছু নেই। তুমি চাইলে সব করতে পারবে আর তুমি না চাইলে কিচ্ছু না। অল ডিপেন্ডস অন ইউ।

আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলি,

— আপনার না মোটিভিশন স্পিকার হওয়ার উচিৎ ছিল। কথায় কথায় খালি জ্ঞান দেন।

রোয়েন এইবার কাঠ কাঠ গলায় বলে,

— তুমি কথায় বুঝার মানুষ না। শাস্তি পেলেই ঠিক হবে। তা তোমার শাস্তি হচ্ছে তুমি এখনই আমাকে ৪টা আর্থিক অবস্থার বিবরনী করে দেখাবে। তাও ১ ঘন্টায়।

আমি ঠোঁট উল্টিয়ে বলি,

— মাথা গেসে আপনার? ২ টাই একঘন্টায় করা যায় না সেখানে ৪ টা?

রোয়েন আমার কথা শুনে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে ট্রাউজারের পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে বলে,

— ওকে দ্যান! ম্যাথ যেহেতু করবে সেহেতু আরেকটা অপশন দেই। এক ঘন্টা এক পায়ে কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে৷ এখন হয় ম্যাথ করো না-হয় কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকো। নাও দ্যা চয়েস ইজ ইউরস।

আমি গাল ফুলিয়ে বলি,

— কোনটাই করবো না, হুহ!

রোয়েন এইবার ম্যানেজমেন্টের খাতাটা বিছানায় রেখে আমার দিকে ঝুঁকে আসে। এক হাত আমার পাশ দিয়ে রেখে মুখের সামনে চলে আসে। এরপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলেই,

— করতে তোমায় হবেই। বাই হুক ওর বাই কুক।

রোয়েন এত সামনে চলে আসতেই আমি থতমত খেয়ে যাই। নড়তেই যেন ভুলে যাই আমি। শ্বাসরুদ্ধ প্রায় অবস্থা আমার। হুট করেই হৃদয় আমার তার সর্বোচ্চ গতিতে চলাচল শুরু করে দেয়। এত জোরেই চলাচল শুরু করে যে এর প্রতিধ্বনি হয়তো রোয়েন নিজেও শুনতে পাবে৷ বার বার নাকে কেমন এক মিষ্টি সুবাস এসে বারি খাচ্ছে। বুঝতে দেরি নি এইটা রোয়েনের শরীর থেকেই আসছে। মাত্র শাওয়ার নিয়ে এসেছে বিধায় হয়তো সুবাসটা আসছে। সব মিলিয়ে আমার যায় যায় অবস্থা। আমি কোনমতে নিজেকে সামলে একটু পিছে গিয়ে বলি,

— পিঠে যে সমস্যা আছে তার প্রমাণ বার বার দিতে হবে না। সোজা হয়ে দাঁড়ান, করছি আমি ম্যাথ।

সে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে পাশে পড়ে থাকা তার মোবাইলটা উঠিয়ে নেয়। অতঃপর সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

— আমাকে নিয়ে এত না ভেবে পড়ায় মনোযোগ দাও। তোমার কাছে কিন্তু শুধু ১ ঘন্টাই টাইম আছে।

কথাটা বলেই তিনি যেন কাকে ফোন করলেন এরপর কথা বলার জন্য বারান্দায় চলে গেলেন। আমি সেদিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে উঠি,

— আসলেই ব্যাটা আস্ত খাটাশ। জীবনটা আমার ত্যানা ত্যানা করে দিলো।

_____________________

সাপ্তাহিক ছুটির দিন আজ। সকাল প্রায় এগারোটা ছুঁই ছুঁই। আমি এখনো বিছানায় গুটি মেরে শুয়ে আছি। সজাগই আমি কিন্তু তাও পেট জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ঠোঁট চেপে শুয়ে আছি। মেজাজ প্রচন্ড খারাপ। সবকিছুই আজ আমার অসহ্য লাগছে। এমনকি নিজেকেই নিজের অসহ্য লাগছে। মনের মধ্যে জাগছে দুনিয়ার সব আজগুবী বাসনা। ইচ্ছে করছে দুনিয়ায় দারি ধ্বংস করে দিতে৷ এই দুনিয়া ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যেতে। আবার মাঝে মধ্যে প্রচুর কান্না করতে ইচ্ছে করছে। মনে চাচ্ছে কান্না করে দুনিয়া ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু আফসোস কোনটার একটাও আমি করতে পাচ্ছি না। উফফ! অসহ্য।

মিনিট পাঁচেকের মাথায় রোয়েন রুমে আসে৷ আমাকে এইভাবে শুয়ে থাকতে তার ভ্রু যুগল এক হয়ে আসে৷ সে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

— নাস্তা করলে না যে?

আমি নিজের চেহেরা বালিশে গুঁজে চাপা স্বরে জবাব দেই,

— ইচ্ছে নেই৷

সে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

— তুমি ঠিক আছো?

কথাটা শুনার সাথে সাথে আমার যেন খুব কান্না পেল। আমি নিজেকে কোন মতে সামলে ঠোঁট উল্টিয়ে বলি,

— আছি!

সে দৃঢ় গলায় বলে,

— কোন প্রবলেম হলে বলতে পারো।

আমি নিজের মুখ বালিশে আরও গুঁজে নিয়ে মিনমিনে স্বরে বলি,

— পেট ব্যাথা।

রোয়েন আমার কন্ঠ শুনলো কিনা জানি না। কিন্তু সে চুপ করে রইলো৷ অতঃপর স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে,

— আমি বাহিরে যাচ্ছি৷

কথাটা বলে সে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়। তার যাওয়ার পর পরই আমার যেন খুব কান্না পেলো। হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করলো। কেন পেল জানি না। ক্ষণেকের মধ্যে আমি আবার রেগে যাই। তখন ইচ্ছে করলো রোয়েন নামক ব্যক্তিকে ধরে বেঁধে প্রচন্ড পিটাতে। কিন্তু কিছু না করতে পেরে বালিশ খামছে ধরলাম। চুপচাপ পড়ে রইলাম বিছানায়।

মিনিট দশকের মাঝে রোয়েন আবার রুমে আসে। তার অস্তিত্ব আমি বুঝতে পেরেও চুপ করে রই। কিছুক্ষণ পর মিষ্টি সুরে একটা ডাক কানে এসে বারি খায়।

— এই তুমি কি ঘুমে?

পরপর দুইবার একই প্রশ্ন প্রতিফলিত হওয়ার পর আমি জবাব দেই,

— উঁহু!

এইবার সে বলে উঠে,

— তাহলে একটু উঠো।

আমি তাও উঠলাম না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। কিন্তু বেশ কয়েকবার ডাক পড়ায় অবশেষে উঠতে হলো আমায়। আমি উঠেই তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠি,

— কি সমস্যা? এতবার ডাকছেন কেন?

সে আমার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে একটা পলিথিনের প্যাকেট এগিয়ে দেয়। প্যাকেটটা দেখার সাথে সাথে আমার ভ্রু কুঁচকে আসে। আমি কিছুক্ষণ প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে থেকে রোয়েনের দিকে তাকাই। সে আমার চাহনি দেখে ভাবলেশহীন গলায় বলে,

— নাও।

আমি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুলে দেখি তাতে একটা কাগজে মুড়ানো জিনিস আছে আর কিছু চকলেট ও আইস্ক্রিম। সেই সাথে একটা পিন কিলারও আছে। এইগুলা দেখার সাথে সাথে আমার ভ্রু কুঁচকে আসে। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই পলি আন্টি হটব্যাগ নিয়ে রুমে আসে। অতঃপর রোয়েনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

— বাবাজান এই লোন আপনার গরম পানি।

রোয়েন সেটা নিয়ে তাকে চলে যেতে বলে অতঃপর হটব্যাগটা বিছানার এক পাশে রেখে বলে,

— নিজের দরকার নিজের বুঝে নিতে হয়।

কথাটা বলে সে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আর আমি সেইদিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকি। আনমনেই ভেবে উঠি,
মানুষটা এমন অপ্রকাশিত কেন? তার কর্মকাণ্ড, কথাবার্তা সবই অপ্রকাশিত। যেন সে নিভৃতে গড়া। অতি যতনে, অতি নিরবে। যার সন্ধান মিলে শুধু তারই নীড়ে।

আমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে প্যাকেটটার দিকে তাকাই। তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ ঠোঁটের কোনে ফুটে এক চিলতে হাসি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here