নিভৃতে_যতনে Part_21,22

0
1867

নিভৃতে_যতনে
Part_21,22
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_21

নীলাভ আকাশে ছড়িয়ে আছে সোনালী রৌদ্দুরের আলতো ছোঁয়া। সবুজ পাহাড়ের ধার ঘেষে দূর-দিগন্তে ছুটে চলেছে পেঁজো পেঁজো মেঘ। বাতাসে চষে বেড়াচ্ছে পাহাড়ি বুনোফুলের গন্ধ। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে গায়ে রোদ মাখছি আর চুলগুলো চিরুনী করছি৷ চোখের সামনে এখনো ভাসছে মেঘালয় সূর্যোদয়ের সেই দৃশ্য। অনুভূতিগুলো কড়া নাড়তে ভিতরটা বার বার শিহরণ দিয়ে উঠছে। মেঘ তো নয় এ যেন হাওয়াই মিঠাই। আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতেই মিইয়ে যাচ্ছিল মূহুর্তেই। জলীয়বাষ্প হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছিল হাতের তর্জনীসহ আরও অঙ্গ। উফফ! সে কি যে অনুভূতি। রোয়েন আজ আমায় যে অনুভূতির সাথে অবগত করিয়েছে তা ভুলার মত নয়। এর জন্য তাকে হাজার শুকরিয়া দিয়েও স্থির হওয়া যাবে না। আমি চিরুনী করা শেষে রুমে এসে পড়ি। ব্যাগ থেকে শুভ্র রঙ্গের একটা কামিজ বের করে তা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেই। আমি যখন প্রায় তৈরি তখন রোয়েন রুমে এসে হাজির হন। আমি রুমে তাঁর অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরে পিছে ঘুরে দাঁড়াই। তাঁকে দেখেই আমি সৌজন্যমূলক এক হাসি উপহার দেই। উনি একবার আমাকে ভালো মত পরক্ষ করে নিয়ে আমার দিকে ভ্রুকুঞ্চন দৃষ্টিতে তাকান। কিছু প্রহর অতিক্রম হতেই সে গম্ভীর গলায় বলে উঠেন,

— যাও চেঞ্জ করে আসো।

কথাটা শ্রবণ হওয়া মাত্র আমার হাসি মিইয়ে যায়। নয়ন যুগলে ফুটে উঠে বিস্ময়। আমি অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করি,

— কেন?

তিনি অকপটে জবাব দেন,

— আমি বলছি তাই৷

— কিন্তু এই ড্রেসে সমস্যা কোথায়? আমাকে কি বাজে লাগছে এই ড্রেসে?

উনি কিছু না বলে বেশ কিছুক্ষণ আমার মুখ পানে তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসেন। তিনি আমার একদম কাছে চলে আসতেই আমি আড়ষ্টতায় এক কদম পিছিয়ে যাই। উনি আমার দিকে একটু ঝুঁকে আমার কানের পাশে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে,

— সে রঙকে প্রাণ দেয়, রঙ তাকে নয়।

কথাটা বলেই তিনি দুই কদম পিছিয়ে যান আর আমি কথাটার অর্থ বুঝতে না পেরে বেশ কিছুক্ষণ তাঁর দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। অতঃপর কথাটার অর্থ বোধগম্য হতেই আমি স্থির হয়ে যাই। কিছু প্রহর পেরুতেই আমার চর্বিযুক্ত গাল দুইটির মাঝে ফুটে উঠে লালাভ আভা৷ কেউ যে এইভাবেও কারো প্রশংসা করতে পারে তা হয়তো রোয়েনকে না দেখলে জানাই হতো না। তাঁর প্রশংসাও লুকানো কথার ভাঁজে। আমি যখন নিজের গায়ে লজ্জার চাদর মোড়াতে ব্যস্ত ঠিক তখনই রোয়েন নরম সুরে বলে উঠেন,

— চেঞ্জ করে কিন্তু গাঢ় রঙের ড্রেস পড়বে৷ শুভ্র রঙগুলো পাহাড়ের চূড়ায় মানায়, পাহাড়ের গহীনে নয়।

কথা বলেই সে রুম থেকে বেরিয়ে যান। বস্তুত, কথাটা আমার বোধগম্য না হলেও আমি রোয়েনের কথাটা ফেললাম না। চুপচাপ ড্রেস চেঞ্জ করে নিলাম। কেন না এতদিনে যতটুকু তাকে চিনেছি,বুঝেছি উনি কখনোই কোন কথা এইভাবে বলেন না। এর আড়ালে কোন এক পাকাপোক্ত কারণ অবশ্যই থাকে।

______________________

সকালের নাস্তা সাবাড় করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম কংলাক ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। হ্যালিপেড পাহাড়ে যাওয়ার পথে ঠিক ডান দিকে নেমে গিয়েছে একটি ঢাল৷ সেই ঢালের শেষ প্রান্তেই অবস্থিত কংলাক ঝর্ণা। প্রথমে ইট সিমেন্টে বাঁধানো পাকা রাস্তা হলেও পরবর্তীতে জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করতেই কাঁচা মাটির সরু রাস্তার দেখা যায়। জঙ্গলের এই সরু পথের ধার ঘেঁষে গতানুগতিক নিচের দিকে হেটে চলেছি আমরা। আমাদের পথ নির্দেশনা দেওয়ার জন্য সামনেই আছে একজন গাইড। তাকেই অনুসরণ করে হেটে চলেছি আমরা৷ সংখ্যায় আমরা খুব বেশি নই। বিশ থেকে ত্রিশজন বৈকি। বেশির ভাগ সকলেই যুবক-যুবতী আর নবদম্পতি। মধ্যবয়স্ক কেউ নেই বললেই চলে। এর মুখ্য কারণ কংলাক ঝর্ণা পর্যন্ত যাওয়া পথটি খুব কষ্টকর। তাই এইখানকার এলাকাবাসী পরামর্শ দেয়, হার্টের রোগী বা দূর্বল প্রকৃতি লোকেরা যাতে এই পথ পারি দেওয়ার চেষ্টা না করে। এতে দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। তো সেই ভয়ে বেশিরভাগ মানুষই কংলাক ঝর্ণা যাওয়ার জন্য নাকচ করে দেন আর থেকে যান রিসোর্টে। সরু পথের দুইধারে ঘন জঙ্গল। নাম না জানা অসংখ্য ঝোপঝাড়, লতাপাতা দিয়ে পরিপূর্ণ পরিবেশ। উপরে তাকালেই দেখা যায় আকাশ জুড়ে বিস্তৃত সবুজ রাঙ্গা প্রলেপ আর সেই প্রলেপ ভেদ করেই ভূপৃষ্ঠের মাটি ছুঁয়ে দিচ্ছে টুকরো টুকরো রোদ। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বাহারি ফুলের সুবাস। আহা কি মনোরম পরিবেশ। আমি ডান হাতে বাঁশ নিয়ে গটগট করে নিচের দিকে নেমে চলেছি। যেহেতু পাহাড়ি পথ সেহেতু নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য সকলের হাতেই একটি করে বাঁশ। আমার পাশেই রোয়েন ভাবলেশহীন ভাবে হেটে চলেছেন। আমি নামছি আর আড়চোখে তাঁকে পর্যবেক্ষণ করছি৷ কাঁধে ছোট একটি ব্যাগ ঝুলানো। গায়ে ব্লু কালার টি-শার্ট আর ব্ল্যাক ট্রাউজার। লম্বা হয়ে আসা চুলগুলো কপালে এসে পড়েছে। মাঝে মধ্যে তার উপর দিয়ে সোনালী রোদেরা খেলা করে যেতেই তার মুখশ্রীতে উপচে পড়ছে মায়া। আমি নিজের চোখ সরিয়ে নিয়ে মনে মনে বলি,

— এই মায়াজালে না জানি আমি কবে আটকা পড়ে যাই৷

______________________

প্রায় চল্লিশ মিনিট হাটার পর যখন আমরা চোরাবালির পথটা অতিক্রম করি ঠিক তখনই কানে ভেসে আসে পানির থৈ থৈ শব্দ। পদচারণ করার সাথে সাথে প্রগাঢ় হয়ে আসছে ঝর্ণার ডাক। সকলের কর্ণধারে এই মধুর ধ্বনি পৌঁছাতেই সকলের মন যেন পুলকিত হয়ে যায়। নিমিষেই সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া জোশ ফিরে আসে আর দ্রুত হয় পায়ের গতি। মাত্র পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে আমরা গিয়ে পৌঁছাই কংলাক ঝর্ণায়। বিস্তৃত সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ জলের ধারা। যা ক্ষণে ক্ষণে তুলছে তীব্র ঝংকার৷ বড় বড় পাথরের বুকে আঁচড়ে পড়ে তৈরি করছে স্রোতধারা৷ এঁকেবেঁকে যাওয়া পথকে বানিয়ে নিচ্ছে নিজের রাস্তা। ঝর্ণার দেখা মিলতেই যুবকরা হামলে পড়ে সেখানে। গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে যায় স্বচ্ছ পানির ধারায়। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় আরও অনেকে। যোগ দেয় যুবতীর দল। ক্ষণেই প্রকৃতির হাক মিলিয়ে যায় কয়েক জোড়া উৎফুল্ল কন্ঠের মাঝে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে হৈ-হুল্লোড়ের নিরুক্ত শব্দ। আমি নিজের পায়ের জুতো জোড়া খুলে খুব আলতো ভাবে স্বচ্ছ পানির স্রোতে নিজের পা ডুবিয়ে দেই। অতি শীতল এর ছোঁয়া। যা ক্ষণেই সর্বাঙ্গে কাঁপন সৃষ্টি করে দিচ্ছে৷ আমি একটু সামনে এগোতে নিলেই কেউ আমার হাত আলতো ভাবে চেপে ধরে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকায়েই দেখি রোয়েন মুখ চোখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার দিকে কৌতহল দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি শীতল কণ্ঠে বলে উঠেন,

— এখন না।

কথাটা বোধগম্য হতেই আমি তাঁর দিকে গোলগাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— কিন্তু কেন?

— সামনে তাকাও বুঝে যাবে।

আমি রোয়েনের কথা মত সামনে তাকিয়ে সকলকে দেখতে থাকি। সকলে মিলে একদম গাদাগাদি পরিবেশ। কেউ কেউ ছবি তুলছে তো কেউ পানির নিচে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঠান্ডা করছে। কেউ বা এদিক সেদিক সাঁতার কাটছে। কোথাও বিন্দু মাত্র জায়গায় নেই। তার উপর মেয়েদের চেয়ে ছেলের সংখ্যাই বেশি। এখন এদের মাঝে গেলে হয়তো অপ্রীতিকর কিছু ঘটতেও পারে। কথাটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে আমার। আমি দমে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াতেই রোয়েন আমায় টেনে নিয়ে এসে একটা পাথরের উপর এসে বসে। আমিও স্থির হয়ে তার পাশে বসে থাকি৷ বেশ কিছু প্রহর অতিক্রম হতেই হঠাৎ টনক নাড়ে,” প্রকৃতির এত গহীনে এসেও কি এর স্বাদ নিবো না?” আমি রোয়েনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— তাহলে আমাদের এইখানে আসাটাই কি বৃথা?

রোয়েন শীতল কন্ঠেই বলে,

— চুপচাপ বসে থাকো।

আমি আর কিছু না বলে গাল ফুলিয়ে বসে থাকি। ঝর্ণার এত কাছে এসে বলে একে একটু ছুঁয়েও দেখতে পারবো না। এইটা কোন কথা? আমার দুঃখে কষ্টে এই খাটাশ ব্যাটার মাথার ফাটাতে ইচ্ছে হচ্ছে। ঝর্ণার ধারেই যদি যেতে না পারি তাহলে এতটা পথ পারি দিয়ে আসার মানে কি? হুহ! আমি অসহায় চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ চোখ চলে যায় ঝর্ণার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মেয়ের দিকে। গায়ে তাদের হালকা জমিন রঙ্গের জামা। পানিতে ভেজার ফলে গায়ের সাথে তাদের জামা লেপ্টে আছে যা দেখতে বরাবরই আপত্তিকর লাগছে৷ আমি পাশে চোখ ঘুরিয়ে নিতেই দেখি কিছু ছেলে এই মেয়েদের দিকে কেমন অপ্রীতিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দৃশ্যটা দেখা মাত্র আমার গা ঘিন ঘিন করে উঠে। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিতেই ক্ষণেই সকালের ঘটনাটা আমার মস্তিষ্কে টনক নাড়ে৷ ধীরে ধীরে রোয়েনের হালকা রঙ পড়ার নিষেধাজ্ঞা জারি করার ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে আসে। আমি চটজলদি রোয়েনের দিকে তাকাতেই দেখি রোয়েন নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। তা দেখা মাত্র ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে প্রশস্ত হাসি। মনে মনে বলে উঠি,

— চাই না আমি প্রকৃতির স্বাদ, শুধু চাই তাঁর এই হাত।

___________________

বেশ কিছু প্রহর অতিবাহিত হতেই একেক করে সকলেই পানি থেকে বেরিয়ে আসে। যে যার মত গা থেকে ভেজা পোশাক ছাড়িয়ে নিয়ে শুকনো পোশাক পড়ে নেয়। এর মাঝে তাঁরা পানিতে থাকাকালীন অনেকেই আমাদের পানিতে নামতে বলেন এবং তাদের সাথে যোগ দিতে বলেন। কিন্তু রোয়েন প্রতিবারই খুব সুন্দরভাবে নাকচ করে কথা কাটিয়ে গিয়েছেন। অতঃপর আর কেউ আসেও নি। কিছুক্ষণের মাঝেই সকলে আবার ফিরে যাওয়ার জন্য রওনা হয়। আমিও রওনা হওয়ার জন্য নামতেই রোয়েন আমার হাত চেপে ধরে। নিজের ব্যাগ পাথরের উপর রেখে ছোট করে বলে,

— আসো আমার সাথে।

কথাটা বলে আমার হাত শক্ত করে ধরে নিয়ে যায় ঝর্ণার কাছে। আমি চারদিকে চোখ বুলাতেই দেখি এইদিকটা এখন প্রায় মানবশূন্য। কাউকে তেমন চোখে পড়ছে না। আমি রোয়েনকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব তার আগেই উনি বলে উঠেন,

— নীরব পরিবেশেই নির্মল প্রকৃতির আসল স্বাদ পাওয়া যায়।

কথাটা বলেই তিনি আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। জায়গাটা পিচ্ছিল হাওয়ায় হয়তো তিনি আমার পরে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত। তাইতো আমার হাত তিনি এইভাবে শক্ত করে ধরে রেখেছেন। আমি তাঁর চোখের দিকে তাকাতেই তিনি তাঁর নয়ন যুগল দিয়ে আমায় ইশারা করলেন ঝর্ণার মাঝে গিয়ে দাঁড়াতেই। কথাটা বুঝতে দেরি হলেও কর্মে দেরি নেই। ঝর্ণাধারার মধ্যে দাঁড়াতেই তা এক পলশা বৃষ্টির মত বর্ষিত হয় আমার উপর। পানির একেকটা ফোটা যেন আমার নিকট হয়ে উঠে শৈত্যকণার শীতল ছোঁয়া৷ সর্বাঙ্গে বয়ে যায় প্রশান্তির হাওয়া। আমি যখন এই শৈত্যকণার ধারায় নিজেকে বিলীন করতে ব্যস্ত তখন এক পুরুষালী কন্ঠ কম্পিত হয় প্রকৃতির বুকে,

— যার নীড় আমার তীরে সে কেন প্রদর্শিত হবে অন্যের তীরে?

কথাটার অর্থ আমি বুঝতে না পেরে রোয়েনের দিকে ঘুরে তাকাই। প্রশ্নবোধক চাহনি তার দিকে নিক্ষেপ করতেই তিনি বলে উঠেন,

— ব্যক্তিগত তাকে দেখার অধিকার শুধুই আমার। একান্তই আমার।

চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_22
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি আমি৷ তাকিয়ে আছি ধূসর রাঙ্গা আকাশে দিকে। আকাশের বুকে ভীড় করেছে একরাশ বিষন্নতা। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। সেই বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে এলোমেলো হয়ে উড়ে চলেছে আমার অবাদ্ধ চুলগুলো। আমি স্বযত্নে সেগুলো আগলে কানে পিঠে গুঁজে দিচ্ছি। মনের দুয়ারে বার বার উঁকি দিচ্ছে কংলাক ঝর্ণার স্মৃতিগুলো। তখন রোয়েনের কথার পিঠে আমি কিছু বলতে পারি নি। বরং লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। যতক্ষণ সেখানে ছিলাম নতজানু হয়েছিলাম। লজ্জায় আর আড়ষ্টতার প্রবলে তার সাথে কথা বলা তো দূরে থাক চোখে চোখও রাখতে পারি নি আমি। বস্তুত, তার সাথে থাকাকালীন আমার লজ্জা যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এত লজ্জা কোথা থেকে আসে আল্লাহই জানে। এই যে এখনো তার কথা ভেবে লজ্জা পাচ্ছি। চোখে-মুখে ছেঁয়ে আছে রক্তিম লালাভ আভা। মনের ভিতর বইছে ভালোলাগা হাওয়া। মনের অজান্তেই জন্ম নিচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতির অজস্র কণা। আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলিয়ে নেই। বিষন্ন প্রকৃতির দিকে চোখ যেতেই দৃষ্টি স্থির হয় আমার। আনমনেই গুনগুন করতে থাকি,

“এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনাতো মন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ?”

ক্ষণেই পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে আমি গান গাওয়া বন্ধ করে দেই৷ তৎক্ষনাৎ পিছে ঘুরে দাঁড়াতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে কাঙ্ক্ষিত চেহেরাটি। তাঁর শ্যামবর্ণ মুখশ্রী আজ দেখতে বড্ড সরল। চুলগুলো বাতাসের দোলে দুলতে দুলতে কপালে এসে পড়েছে। তাঁর অদ্ভুত নয়ন দুইটি আমাতেই নিবদ্ধ। আকস্মিকভাবে চারটি চোখ এক হতেই আমি দৃষ্টি সরিয়ে নেই। নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তাঁর এই চোখে তাকানোর শক্তি আমার নেই। রোয়েন ধীর পায়ে আমার দিকে আসে। আমার পাশে এসে একটু বেঁকে কাঠের রেলিং এর উপর দুই হাত রেখে নিজের ভর ছেড়ে দেন। অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলেন,

— গান আর কথা কখনো অসম্পূর্ণ রাখতে নেই। এতে অতৃপ্তি ছাড়া কিছুই মিলে না।

কথাটা শোনে আমি রোয়েনের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাই। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলি,

— না মানে..

আমার কথার মাঝে তিনি ফোঁড়ন দিয়ে বলে উঠেন,

— আমার সামনে নিজেকে গুটিয়ে রাখার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি যেমন তেমনই থাকো। আমাকে জীবনসঙ্গী হিসাবে না দেখে বন্ধুর চোখে দেখো। দেখবে সম্পর্কটা দুইজনের কাছেই সহজ হয়ে যাবে।

আমি রোয়েনের দিকে তাকিয়ে সরু হাসির রেখা টেনে বলি,

— আর আপনি গুটিয়ে থাকলে বুঝি সম্পর্ক সহজ হবে? ফ্রি হতে হলে দুইজনকেই হতে হবে। একা আমি আর কত দূর এগুতে পারবো? আপনাকেও তো ফ্রি হতে হবে নাকি?

রোয়েন আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— চেষ্টা তো করছি এই।

— আন্ডা করচ্ছেন! একে চেষ্টা করা বলে? হুহ! আমাকে যা বললেন তা নিজের উপরও এপ্লাই করুন মিস্টার। বন্ধুত্বটা শুধু আমার দিক দিয়ে হবে কেন? দুইজনের দিক দিয়েই হতে হবে।

আমার কথাগুলো শুনে রোয়েন কিছুক্ষণ আমার পানে তাকিয়ে থাকলো। অতঃপর হালকা হেসে বলে,

— আচ্ছা।

তাঁর হাসি চোখে পড়তেই আমি স্থির হয়ে যাই। কি স্নিগ্ধ তাঁর হাসি। হালকা হাসির মাঝেও তাঁর গজদাঁত প্রদর্শিত। যা তার হাসির মাধুর্যতা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমি কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের পানে তাকাই। মানুষটিকে পূর্ণভাবে দেখার অধিকার আমার আছে কিন্তু তাও কোথাও যে একটা ‘কিন্তু’ থেকেই যায়। যা ক্ষণেই আমায় দৃষ্টি সরিয়ে নিতে বাধ্য করে। কিছুক্ষণ বাদেই কানে ভেসে আসে অনুভূতিপ্রবণ কিছু টুকরো টুকরো বাক্য,

— আকাশটা আজ বিষন্ন যে,
মেঘ করেছে কালো-
বিষন্নতায় মন ভরেছে
ক্যামনে লাগে ভালো?

কথাটা শুনে আমি রোয়েনের দিকে চকিতে চাই। রোয়েনের এই রুপ থেকে সম্পূর্ণভাবে অবগত আমি। তিনি আকাশের পানে তাকিয়ে আনমনা হয়ে বলেন,

– যার মিষ্টি কন্ঠে এতক্ষণ কাটছিল বিষন্নতা সে কি পারে না কাটাতে সম্পূর্ণ বিষন্নতা?

আমি রোয়েনের কথা অর্থ বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মানুষটার আবদার করার ধরণও নিরালা। আমি মুচকি হেসে সম্মতি জানিয়ে গলা ঝেড়ে গানের সুর তুলে বিষন্নতাকে চলে যাওয়ার আহ্বান জানাই।

____________________

আজ সাজেকে আমাদের শেষ দিন। কাল ভোরেই রওনা দিবো আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে। পুনরায় সকলের পায়েই লেগে যাবে যান্ত্রিক জীবনের শিকল। ব্যস্ততায় ঢুবে যাবে সকলে। তাই সকলেই আজকের দিনটা মন খুলে উপভোগ করার চেষ্টা করছে। প্রকৃতির এক অপার ক্ষমতা হলো সে নিমিষেই সকলের ক্লান্তি চুষে নিয়ে উপহার দিতে পারে এক ঝাঁক প্রশান্তি। মানসিক প্রশান্তি৷ যা মানুষকে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করার শক্তি দেয়।

আজ আমাদের শেষ গন্তব্য হলো কংলাক পাহাড়। উঁচু ঢালের উঁচু-নিচু এঁকেবেঁকে যাওয়া পথের শেষ সীমানায় এর আসল সৌন্দর্য নিহিত। আর সেই সৌন্দর্য দেখার লোভেই ছুটেছি আমরা সকলে। হাতে এক মাঝারি সাইজের কচি বাঁশ নিয়ে যে যার মত উপরের দিকে উঠে চলেছি। অনেকে আবার একটু দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিয়ে পানি পান করছে তো কেউ মুঠোফোনে এই সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে বন্দী করছে। আমিও হাতে মুঠোফোন নিয়ে হাতের তর্জনী দিয়ে সমানতালে তুলে চলেছি নির্মল প্রকৃতির ছবি। নিজেকে এই প্রকৃতির মাঝে বন্দী করার চেয়ে প্রকৃতিকে নিজের কাছে বন্দী করতে চাইছি। আমি প্রকৃতির মাঝে এতটাই বিভোর ছিলাম যে কখন আমার শুভ্র রঙ্গের ওড়নাটি মাটির সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে নিজের রঙ বদল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তা টেরই পাইনি। হঠাৎ ওড়নায় টান পড়তে স্থির হয়ে যাই আমি। এক হাত দিয়ে নিজের ওড়না টেনে ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে পুছে তাকাতেই দিকে রোয়েনের হাতের ভাজে আমার ওড়নার এক অংশ৷ আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনি বলে উঠেন,

— ওড়নাও ঠিক মত সামলাতে পারো না। ডাফার!

কথাটা বলেই তিনি নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে স্বযত্নে আমার ওড়নার এক অংশে লেগে থাকা ময়লাগুলো পরিষ্কার করে দিতে থাকেন। যা দেখা মাত্র মুহূর্তেই আমার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে প্রশস্ত হাসি। কখন যে নিজের অজান্তেই মুঠোফোনটি উঁচু করে দৃশ্যটি এর মাঝে বন্দী করে ফেলি কে জানে? রোয়েন নিজের কাজ শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— ওড়না ঠিক করে নাও।

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা দুলিয়ে ওড়নাটা টেনে নেই। আশেপাশে চোখ যেতেই দেখি অনেকেই আমাদের দেখে মিটিমিটি করে হাসছে। দূরেই কিছু মেয়ে রোয়েনকে দেখিয়ে তাঁর সঙ্গীকে শাসানো ভঙ্গিতে কিছু একটা বলছে। বিষয়টা যেন আমার মধ্যে এক গৌরবময় আনন্দ বয়ে আনছে। আমি ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই নজরে পড়ে রক্তজবার একটি গাছ। যাতে ফুটে আছে রক্তিম লাল জবার দল। আমি সেদিকে কিছু প্রহর তাকিয়ে থেকে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে মিইয়ে গলায় বলি,

— শুনেন!

রোয়েন আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই আমি আড়ষ্ট কন্ঠে বলি,

— ওইখান থেকে কি একটা জবাফুল নেওয়া যাবে?

কথাটা বলেই আমি হাতের তর্জনী দিয়ে সেদিকে ইশারা করলাম। রোয়েন আমার হাতের তর্জনীর দিকটার অনুসরণ সামনে তাকিয়ে অকপটে বলেন,

— না।

কথাটা বলে তিনি আমার দিকে তাকান। স্বাভাবিক কন্ঠেই বলেন,

— প্রকৃতির সৌন্দর্য হরণ করা অন্যায়। যেখানে যার থাকা উচিৎ সেখানেই তাকে মানায় বেশি।

কথা কর্ণপাত হওয়া মত আমার চোখ-মুখে ছেঁয়ে যায় কালো মেঘ। আমি আর কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। অতঃপর বিরতি শেষে সকলের সাথে পুনরায় হাটা শুরু করি। বেশ কিছুক্ষণ হাটার পর হাতে টান অনুভব করি। আমি পিছে ঘুরে তাকিয়ে রোয়েনকে দেখতে পেয়ে বলি,

— কি হয়েছে?

রোয়েন কিছু না বলে ধীর পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ান। অতঃপর কিছু বুঝার আগেই তাঁর হাতে থাকা রক্তজবাটি খুবই সপ্তপর্ণে আমার কানে গুঁজে দেন তিনি। সাথে সাথে আমার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে মিষ্টি হাসি৷ তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হালকা হেসে বলেন,

— তাঁর মুখে এই মিষ্টি হাসিটা ফুটাতে মাঝেমধ্যে এমন অন্যায় করতে দোষ নেই।

___________________

কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় এসে দাঁড়াতেই এক ঝাঁক শীতল বায়ুর দল ছুঁয়ে দিল মন। উপরে প্রগাঢ় নীলাভ আকাশ আর নিচে উঁচু নিচু ছোট বড় পাহাড়ের সারি প্রিয় সবুজ চাদরে মোড়ানো। তাদের ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘবালিকাদের দল। মেঘদলের উপরে হাসছে সূর্য। রোদ ঠিকরে পড়ছে মেঘের গায়ে। কি অপরুপ সেই সৌন্দর্য। সকলেই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যখন ছবি তুলতে ব্যস্ত তখন রোয়েন আমায় নিয়ে বসে আছে টঙ ঘরের ছাওনিতে। দুইজনের হাতেই বেম্বো টি। সরু বাঁশের নলের ভিতর আসে এই চা। দেখতে আকর্ষণীয় হলেও স্বাদ অন্যান্য সাধারণ চায়ের মতই। চা খাওয়া শেষে রোয়েন নিয়ে আসে এক হালি পেয়ারা। আমাকে দুটো দিয়ে বাকি দুটো উনি নিয়ে নেন। আমি একটা পেয়ারে নিয়ে কামড় দিতেই দেখি পেয়ারার ভিতরে অংশ সম্পূর্ণ গোলাপি। দৃশ্যটি দেখামাত্র আমি ভড়কে যাই। অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করি,

— এমন কেন এইটা?

রোয়েন স্বাভাবিক কন্ঠে বলেন,

— এইগুলো এমনই হয়। তাই এত ভাবার কিছু নেই।

কথাটা বলে তিনি পেয়ারা খাওয়ায় মন দিলেন। আমিও আর কিছু না বলে আমার হাতে থাকা পেয়ারায় কামড় বসাই।

________________________

ভোর হতে না হতেই আমরা রওনা দেই ঢাকার উদ্দেশ্যে। তাও সকাল প্রায় নয়টার বেশি বেজে যায় খাগড়াছড়ি আসতে। খাগড়াছড়ি এসে আমার সকালের নাস্তাটা শেষ করেই উঠে পড়ি বাসে। বাস চলছে আপন গতিতে। বাসের মধ্যে চলছে হৈচৈ। নীলয় নামের ছেলেটি হাতে গিটার। সে হাতের তর্জনী তুলছে সুর। তারই সাথে কয়েক জোড়া পুরুষালী আর মেয়েলী কন্ঠ একত্রি হয়ে গাইছে গান। বাতাসে ভাসছি সেই গানের সুর।

“ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে
আমার মনের ঘরে চাঁন্দের আলো চুইয়া চুইয়া পড়ে
পুষে রাখবো রাখবো রে বন্ধু তোমায় যতনে
ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে”

গানটা কেন জানি না কিন্তু আমার বুকে গিয়ে বিঁধছিল। গানের প্রত্যেকটা লাইন সপ্তপর্ণে ছুঁয়ে যাচ্ছিল আমার মন ও হৃদয়। ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিলাম আমি। হঠাৎ ঘোর থেকে বেরুতেই আমি রোয়েনের দিকে দৃষ্টি স্থির করি৷ তখন কর্ণধারে ভেসে আসে দ্বিতীয় সুর,

” দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা
আঁচল দিয়া ঢাইকা রাইখো চোখ যেন পড়ে না
দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা
আঁচল দিয়া ঢাইকা রাইখো চোখ যেন পড়ে না

আমি প্রথম দেখে পাগল হইলাম
মন তো আর মানে না

কাছে আইসো আইসো রে বন্ধু প্রেমের কারণে
ভালোবাইসো বাইসোরে বন্ধু আমায় যতনে”

ক্ষণেই রোয়েনের দৃষ্টি স্থির হয় আমার মাঝে। চার চোখ এক হতেই আমি প্রত্যেকবারের মত দৃষ্টি সরিয়ে নেই৷ শূন্য দৃষ্টিতে তাকাই আকাশের পানে। কেন না তাঁর সেই নয়ন যুগলে তাকিয়ে থাকার ক্ষমতা আমার নেই। একদম নেই!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here