নিভৃতে_যতনে Part_23,24

0
1747

নিভৃতে_যতনে
Part_23,24
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_23

বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেলো সাজেক থেকে ফিরেছি আমরা। সাজেক থেকে ঢাকায় আসার পর মুহূর্তেই যেন সকলকে ঘিরে ধরে ব্যস্ততা। সকলের পায়ে লেগে যায় যান্ত্রিক জীবনের শিকল। রোয়েনও আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায় আর আমি বন্দী হয়ে যাই চারদেয়ালের মাঝে। সারাদিন ঘরে বসেই দিন কাটে আমার। ভার্সিটি খুলতে এখনো এক-দেড় মাস বাকি। হাতে এখনো অফুরন্ত সময়। মোবাইল আর টিভি নিয়েই এই সময় পাড় করে ফেলি। মাঝে মধ্যে পলি আন্টির সাথে গল্পের আসর জমে কিন্তু কাজের তাড়া থাকায় তা বেশিক্ষণ স্থির হয়না। বিকেলের দিকে ছাদেই ঘন্টাখানিক সময় কাটে আমার। এরপর বাকিটা সময় রোয়েনের সাথে কেটে যায়। বলা বাহুল্য, রোয়েন আর আমার সম্পর্কের একটা গতি হয়েছে। বন্ধুত্বটা জিনিসটা ভালো মতই ছেঁয়ে গিয়েছে আমাদের মাঝে। কিন্তু তাই বলে যে উনি ত্যাড়ামি ছেড়ে দিয়েছে তা কিন্তু নয়। আমার সাথে তাঁর ত্যাড়ামি চলেই। স্বাদেই কি বলি ব্যাটা ঘাড়ত্যাড়া?

হেমন্তের রেশ কাটিয়ে চলে এসেছে শৈত্যপ্রবাহ। উত্তরা বাতাস বইছে। হিম হিম ভাব ছেঁয়ে আছে চারদিকে। ছাদের একপাশে থাকা প্রশস্ত বিস্তৃত কালো দোলনাটায় বসে দোল খাচ্ছি আমি। ক্ষণে ক্ষণে চোখ বুলাচ্ছি চারদিকে। এই বিল্ডিং এর ছাদটা বেশ সুন্দর। একপাশে রয়েছে নানান রকমের ফুলের গাছ। রক্তগোলাপ, রক্তজবা যেন এই ছাদের আসল সৌন্দর্য আর মনমাতানো সুবাসের রাণী হয়ে আছে বেলী, রজনীগন্ধা, হাসনাহেনা। তাদের মাঝেই এক কোনে উঁকি দিচ্ছে লজ্জাবতী গাছ। এইদিকটায় চোখ গেলেই যেন চোখ জুড়িয়ে আসে। ক্ষণেকের মাঝেই কিছু বাচ্চাপাটির দল এসে হামলে পড়ে ছাদে। মেতে উঠে চোর-পুলিশ ও কানামাছির খেলায়। আমি উৎসুক চোখে তাদের খেলা দেখছি ঠিক এমন সময় একটা চার বছর বয়সী বাচ্চা মেয়ে আমার সামনে বলে,

— এই আন্টি শুনো!

হঠাৎ ছোট বাচ্চার মুখে ‘আন্টি’ সম্মোধনটা শুনে আমি ভড়কে যাই। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি বাচ্চাটার দিকে। বুঝার চেষ্টা করি আমাকে কোন দিক দিয়ে আন্টি লাগে? ভার্সিটিতেও উঠলাম না ভাই। এর আগেই আন্টি হয়ে গেলাম? হাও? মনের মাঝে যখন এইসব প্রশ্নের ছক কষছি তখন পুনরায় পিচ্চি মেয়েটা বলে উঠে,

— এই আন্টি! আন্টি!

বলে তার ছোট ছোট হাত দিয়ে আমার পা ধাক্কাতে থাকে। আমি পিচ্চিটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলি,

— কি?

সে তার আমার দিকে দুই হাত উঁচু করে বলে,

— আমিও দোলনায় উঠবো।

আমি হালকা হেসে ওকে কোলে তুলে নিয়ে আমার পাশে বসিয়ে দেই। সে খুশি হয়ে বলে,

— থেংকিউ আন্টি।

‘আন্টি’ শব্দটা শুনে চোখ-মুখ ঘুচে এলো। এত আন্টি আন্টি করে কেন মাইয়া? আমাকে দেখতে মহিলা লাগে? আমি তেঁতো কন্ঠে বলে উঠি,

— আমাকে দেখতে তোমার আন্টি লাগে? আপু বলবে আমায়।

সে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,

— আচ্ছা। কিন্তু তোমার নাম কি?

— সিয়াশা, তোমার?

— মুসকান।

আমি ওর গোলগাল গালগুলো হালকা টেনে দিয়ে বলি,

— খুব মিষ্টি নাম তো তোমার।

— জানি। তা তুমি এইখানেই থাকো?

— হ্যাঁ কেন?

— এমনি৷ জানো আমিও এখানেই থাকি।

আমি আর কিছু বলতে যাবো তার আগে কিছু বাচ্চা এসে মুসকানকে খেলার জন্য বলে। মুসকানও জানায় সে খেলবে তাই আমাকে বলে নামিয়ে দিতে। আমি ওকে নামিয়ে দিতেই ও আমায় বলে,

— আসো তুমিও খেলবে আমাদের।

আমি অবাক হয়ে বলি,

— আমি?

সে মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলে এবং আমার হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দেয়। তার দেখাদেখি বাকি বাচ্চারাও এসে আমায় ঝাপটে ধরে। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আমি রাজি হয়ে যাই। সকলে মিলে কানামাছি খেলতে থাকি। একসময় খেলতে খেলতে তাদের সাথে আমিও বাচ্চা হয়ে যাই। প্রাণবন্ত হয়ে উঠি। বেশ কিছুক্ষণ পর পলি আন্টি ছাদে এসে আমায় নিচে ডেকে নিয়ে যায়। আমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে বলে। আমিও সকলকে বায় বলে নিচে চলে আসি। বাসায় আসতে আমি পলি আন্টিকে জিজ্ঞেস করি,

— কি হয়েছে পলি আন্টি?

পলি আন্টি ইতস্তত করতে করতে বলেন,

— আফা আমার না কয়েকদিনে ছুটি লাগবো।

— হঠাৎ!

— আমার মার নাকি কঠিন অসুখ হইসে। কেমন যেন করতাসে। হয়তো বেশিদিন বাঁচবো না।বাপজান আমারে ফোন কইরা দেশে যাইতে কইতাসে।

আমি নিরদ্বিধায় বলি,

— তাহলে অপেক্ষা করছো কেন? এখনই রওনা দাও।

— না মানে আফা….

কথাটা বলতে সে বার বার ইতস্ততবোধ করছে। কেমন জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলি,

— কি বেতন লাগবে?

পলি আন্টি মাথা নিচু করে বলে,

— হো আফা।

— আচ্ছা দাঁড়াও আমি দেখছি।

কথাটা বলে আমি রুমের দিকে অগ্রসর হলাম। হাতে ফোন নিয়ে রোয়েনের নাম্বারে ডায়াল করলাম। বেশ কিছুক্ষণ রিং হবার পর রোয়েন ফোন রিসিভ করেন। তাকে সব খুলে বলতেই তিনি বললেন কাবার্ডের ড্রয়ারে কিছু ক্যাশ রাখা আছে। আমি যাতে সেখান থেকে পলি আন্টিকে বেতনটা আর সেই সাথে এক্সট্রা কিছু টাকাও দিয়ে দেই। কথাটা বলে তিনি ফোন রেখে দিলেন। আমিও রোয়েনের কথা কাবার্ড থেকে ক্যাশ বের করে পলি আন্টিকে দিয়ে দিলাম। বেতনের পাশাপাশি এক্সট্রা কিছু টাকা দেখে সে প্রায় কেঁদেই দিল। আমাকে আর রোয়েনকে অসংখ্যবার ধন্যবাদ দিতে থাকলো। হঠাৎই রোয়েনের প্রতি আমার সম্মানটা বেড়ে যায়। কেন না রোয়েন আজ তাকে যে সাহায্যটা করেছে তা কতজনেই বা করে? কিছু কিছু মানুষ আছে যারা অন্যের বিপদ হয়েছে শুনেও না শুনার ভাণ করে। নিজের প্রাপ্য বা সাহায্য চাইলেও অনেকে ইনিয়েবিনিয়ে দেয় তো দেয় না। সেখানে রোয়েনের মানবতা আর কর্মকাণ্ড জ্ঞান দেখে সত্যি আজ আমি গর্বিত

____________________

সন্ধ্যার সময় রোয়েন আসার আগে আমি তার কাপড়গুলো খাটের উপর গুছিয়ে রাখি। নিজ হাতে তাঁর জন্য কফি বানাই। কেন জানি না আজ আমার তার জন্য কিছু একটা করতে ইচ্ছে করছে। পলি আন্টি রাতের খাবার রেঁধে না গেলে হয়তো আজ আমি নিজ হাতেই তার জন্য রান্নাটা করতাম। আমি গ্যাস অফ করে রুমের দিকে যেতেই কলিংবেল বেজে উঠে। দরজা খুলতেই রোয়েনের মলিন চেহেরা ভেসে উঠে। মুখশ্রী দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেশ ক্লান্ত উনি। আমি পাশে সরে দাঁড়াতেই রোয়েন জুতো খুলে নিজের গলার টাই ঢিলা করতে করতে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে। টেবিলের উপর একটা পলিথিনের প্যাকেট রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় রুমে দিকে। আমি দরজা লাগিয়ে টেবিলের উপর থেকে ব্যাগটা হাতে নিয়ে খুলে দেখি তাতে আজও এক প্যাকেট ফুচকা আর এক বাটি চকলেট আইসক্রিম। আমি আনমনে এক মিষ্টি হেসে ফেলি৷ তাঁর এইসব ছোট ছোট লেয়ারগুলাই যথেষ্ট আমার মুখের হাসি ফুটানোর জন্য। হয়তো দামী দামী গিফটের মাঝেও এই সুখ পাওয়া যাবে না যেগুলো এই ছোট ছোট খুশির মাঝে পাওয়া যায়। আমি ফুচকা প্যাকেটটা রান্নাঘরে আর আইসক্রিমের বাটটা ফ্রিজে রেখে কফিটা পুনরায় হালকা গরম কাপে ঢেলে নিলাম। অতঃপর অগ্রসর হলাম রুমের দিকে। রুমে এসে দেখি রোয়েন এখনো ওয়াশরুমে। আমি খাটের পাশে সাইড টেবিলের উপর কাপটা রেখে বিছানা থেকে রোয়েনের ঘামযুক্ত শার্ট,টাইটা তুলে নিয়ে বারান্দায় মেলে দিলাম। পুনরায় রুমে বাকি জিনিসগুলো ঠিক করে নিলাম। কিছু প্রহর অতিক্রম হতেই রোয়েন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। নিজের চুলগুলো মুছে টাওয়ালটা বারান্দায় মেলে দিয়ে আসতেই আমি কফিটা এগিয়ে তাঁর দিকে। তা দেখা মাত্র সে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। অতঃপর কফিটা হাতে নিয়ে হালকা হেসে বলেন,

— আজ সত্যি মনে হচ্ছে আমি বিবাহিত আর আমারও একটা বউ আছে।

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— মানে?

তিনি কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বিছানায় গিয়ে বসলেন। স্বাভাবিক কন্ঠেই বললেন,

— আজ তোমার কাজগুলো বউদের মত লাগছে।

আমি দুই হাত কোমরে রেখে বলি,

— তো বাকিদিন গুলোতে কি আমার কাজ পাশের বাসার ভাবীর মত লাগে?

কথাটা শুনে রোয়েন নিঃশব্দে হেসে উঠেন। এই প্রথম মনে হয় তাকে এতটা মন খুলে হাসতে দেখছি। একদম স্বচ্ছ এই হাসিটি। ঠোঁটের দুই কোনে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে গজদাঁত দুইটি। যা ক্ষণেই হাসিটাকে করে তুলছে অমায়িক আর প্রাণবন্ত। আমি বেশ কিছুক্ষণ তাঁর হাসির পানে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নেই। কেন না, তাঁর হাসি যে অস্ত্রধারী। হোক সেটা মুচকি অথবা প্রাণবন্ত হাসি, তাঁর হাসির মাধুর্যতাই যথেষ্ট আমায় বারংবার খুন করতে। বেশকিছু প্রহর পর উনি একটু স্বগতোক্তি সুরেই বললেন,

— বউ বউ ভাব কিন্তু তাও বউয়ের অভাব।

আমি বিস্মিত কন্ঠে বলি,

— মানে?

সে হেসেই বলে,

— আসলেই তুমি ডাফার!

আমি ফুঁসে উঠে বলি,

— আরেকবার যদি ডাফার ডেকেছেন তাহলে দেখিয়েন আমি কি করি।

সে কৌতুকের সুরেই বলে উঠে,

— তো কি ডাকবো মিস বুঁচি?

— একদম না৷ আমার নাক অনেক কিউট বুঝেছেন? একে অপমান করার অধিকার আপনার নেই৷

— তো কার আছে?

— কারো নাই। হুহ!

বলেই আমি গটগট করে রুম থেকে বেরিয়ে আসি। রাগে ফুঁসে উঠছি আমি। মনে মনে বলতে থাকি, “পেয়েছাটা কি হ্যাঁ? আমার নাক একটু চ্যাপ্টা বলে বার বার বুঁচি বলবে? একে যে আমি কি করবো।”
কথাটা ভাবতে ভাবতেই রান্নাঘরে চলে আসি আমি। তখন নজরে ফুচকার প্যাকেটটা নজরেই পড়তে আমার মাথায় শয়তানি বুদ্ধি এসে ভর করে আর ঠোঁটের কোন ফুটে উঠে পৈচাশিক হাসি। আমি দ্রুত ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করে একটা বাটিতে নিয়ে নেই। অতঃপর ফুচকার প্যাকেটটা খুলে তার থেকে তেঁতুলের টকটা বের করে আইসক্রিমের সাথে খানিকটা মিশিয়ে নেই। এরপর উপর দিয়ে আরেকটু ভালো আইসক্রিম দিয়ে দেই। আরেকটা বাটিতে নিজের জন্য কিছুটা আইসক্রিম নিয়ে নেই। অতঃপর দুইটা বাটি নিয়েই রুমে চলে যাই। রোয়েন বিছানার দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে মোবাইল টিপছে। আমি কিছু না বলে হাসি চেপে গিয়ে গোমড়া মুখ তাঁর সামনে টক মিশানো আইসক্রিমের বাটিটা এগিয়ে দেই। রোয়েন একবার আমার দিকে তাকিয়ে বাটিটার দিকে তাকালো। আইসক্রিম তারও পছন্দের তাই সেটা দেখে তিনি আর আপত্তি করলো না। এক হাতে মোবাইলটা রেখে অন্য হাতে বাটিটা নিয়ে নিলেন। রোয়েন হাতে বাটিটা নিতেই আমার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে সরু হাসির রেখা। মনে মনে বলি,

— আমাকে বুঁচি বলা তাই তো। এইবার বুঝুন ঠ্যালা।

রোয়েন কিছুক্ষণ মোবাইল স্ক্রোল করে পাশে রেখে দিল। অতঃপর এক চামচ আইসক্রিম মুখে দিতেই মুহুর্তেই তার চোখ-মুখ কুঁচকে হাসে। মুহূর্তেই তিনি ফিক করে মুখ থেকে আইসক্রিমটা বাটিতে ফালিয়ে দেন। বিস্ময়কর কন্ঠে বলে উঠেন,

— ইয়াক! এইটা কি?

কথা শুনে আমি হেসে কুটু কুটু হয়ে যাই। দম ফেটে হাসি উপচে পড়ে। আমি হাসতে হাসতে বলি,

— আমাকে বুঁচি বলার শাস্তি। আরও বলেন আমাকে বুঁচি।

রোয়েন মুখ-চোখ ঘুচিয়ে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— তাহলে যাকে আমি উপাধিটা দিয়েছি সেও তো এই শাস্তির ভাগিদার। আফটার অল নাম তো তাকেই দেওয়া।

কথাটা আমি বুঝার আগেই রোয়েন আমার মুখেও এক চামচ টকযুক্ত ওই আইসক্রিম ঢুকিয়ে দেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ভড়কে যাই আর ভুলবশত আইসক্রিমটা খেয়ে ফেলি। এখন তো আমার প্রায় বমি আসার অতিক্রম। ইয়াক! এত বাজে টেস্ট। গলা ধরে গেলো আমার। আমি আমার হাতের বাটিটা সাইড টেবিলে রেখে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যাই কুলি করার জন্য। তা দেখে পিছ থেকে রোয়েন বলে উঠেন,

— তা মিস বুঁচি, কেমন লাগলো তোমার বানানো স্পেশাল আইসক্রিমের টেস্ট? অসাধারণ না?

___________________

রাতেরবেলা রোয়েনের সাথে এক চোট ঝগড়া করে ক্ষান্ত হই আমি। রোয়েনের সাথে না পেরে উঠার কষ্টে দুঃখে আগেই গাল ফুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি আমি। কিন্তু তাও যেন ঘুমের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমি। ঘড়িতে যখন সকাল দশটা ছুঁই ছুঁই তখনও আমি গভীর ঘুমে। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কোন কিছুর টুংটাং আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় আমার। একটু এপাশ-ওপাশ ঘুরে আধো আধো করে চোখ খুলে ঘড়ির দিকে নজর বুলাই। অতঃপর ঘড়ির দশটায় এসে ঠেকেছে দেখে ঘুম ছুটে যায় আমার। লাফিয়ে উঠি আমি। আজ পলি আন্টি না আসবে নাই নাস্তা বানানোর কথা। অথচ আমিই আজ এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছি? চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে রোয়েনকে দেখতে না পেয়ে বিছানা থেকে চট-জলদি নেমে পড়ি আমি। ক্ষণেই কর্ণধারে টুংটাং আওয়াজ প্রতিফলিত হতেই ভ্রু কুঁচকে আসে আমার। মূহুর্তেই শব্দটা কোথা থেকে আসছে তা জানার কৌতুহল সৃষ্টি হয়ে যায় আমার মাঝে। আমি রুম থেকে বেরিয়ে আসতে বুঝতে পারি আওয়াজ রান্নাঘর থেকে আসছে। সাথে সাথে আমার ভ্রু কুঁচকে আসে৷ আজ তো পলি আন্টি নেই তাহলে রান্নাঘরে কে? আমি ধীর পায়ে এগিয়ে যাই রান্নাঘরের দিকে। অতঃপর রান্নাঘরের সামনে এসে রোয়েন রান্না করতে দেখে আমার চোখ চড়কগাছ। বিস্ময়ে অভিভূত আমি।

চলবে
#নিভৃতে_যতনে
#Part_24
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

রোয়েনকে রান্না করতে দেখে আমার চোখ চড়কগাছ। বিস্ময়ে অভিভূত আমি। অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে থাকি সামনে। স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলে উঠি,

— আপনি রান্না জানেন?

আমার কন্ঠ শুনে রোয়েন মাথা তুলে আমার দিকে তাকান। ভ্রুকুটি কুঁচকে বলেন,

— রান্না না জানলে কি রান্নাঘরে আসতাম?

কথাটা শোনা মাত্র আমি থমথম খেয়ে যাই। অস্ফুটস্বরে বলি,

— না মানে ছেলেদের কখনো রান্না করতে দেখিনি তো তাই একটু…

আমার কথার মাঝে রোয়েন ফোঁড়ন দিয়ে বলে,

— রেস্টুরেন্টে তো দেখছ নাকি?

আমি কিছুক্ষণ ভেবে মাথা দুলিয়ে বলি,

— হ্যাঁ।

— রেস্টুরেন্টে কিন্তু রান্না থেকে শুরু করে থালাবাসন ধোঁয়া, খাবার সার্ভ করা, টেবিল ও ফ্লোর পরিষ্কার করা সবই ছেলেরা করে। তখন কিন্তু তাদের দেখে কারো অবাক লাগে বরং স্বাভাবিকই লাগে। অথচ এই একই কাজই যদি ছেলেরা বাসায় করে তাহলে সকলে যেন অবাকের শেষ চূড়ায় চলে যায়। ব্যাপারটা অদ্ভুত না?

আমি এতক্ষণ রোয়েনের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। রোয়েনের কথা শেষে কথাগুলো যেন আমার মস্তিষ্কেও টনক নাড়ে। আসলেই তাই তো! আমি রোয়েনের দিকে থমথম দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলে,

— এর মূল কারণ কি জানো? আমাদের সমাজ। তারা আমাদের সকলের মধ্যে একটা চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, মেয়েরা ঘরের কাজের জন্য আর ছেলেরা বাহিরের কাজের জন্য তৈরি। আর এই চিন্তা পোষণ করেই তো সকলের চিন্তা ধারা এমন হয়েছে যে, যে কাজ বাহিরে ছেলেদের জন্য সম্মান সেটাই ঘরের চারদেয়ালে অসম্মান।

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— কথাটা ভুল বলেন নি। কিন্তু কতজনেই বা ভাবে এইভাবে?

— যে কয়জন ভাবেই তাতেই হবে।

— সে যাই হোক! আপনি রান্না কিভাবে শিখলেন?

রোয়েন চপিং বোর্ডে শসা কাটতে কাটতে বলে,

— জব পাওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যাচেলর বাসায় থেকেছি আমি। তো সেই সুবাদে রান্না-বান্নাটা রপ্ত করতে হয়েছিল।

— আপনি ব্যাচেলর বাসায় থাকতেন?

— হুম।

— আচ্ছা আপনি যান বাকিটা আমি করে নিচ্ছি৷

— আরেহ হয়েই গিয়েছে সব।

— তাও আপনাকে রান্নাঘরে দেখতে অস্বস্তি লাগছে আমার।

রোয়েন আমার মুখ পানে তাকিয়ে বলে,

— সংসার যেহেতু দুইজনের সেহেতু দায়িত্বও দুইজনেরই। তুমি করো আর আমি করি একই কথা।

আমি ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে বলি,

— তাহলে এরপরের শিফট আমার।

— আচ্ছা।

____________________________

আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় চারদিক আজ বেশ নীরব। তেমন কোন সোরগোল নেই।দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে আমি বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই নিয়ে বসি আর আমার পাশেই বসে রোয়েন ল্যাপটপ চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি বেশ ক্ষানিকটা সময় এইভাবেই বইয়ের পাতা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে রেখে দেই। কেন জানি না বইয়ের পাতায় মন ঠেকছে না আজ। ঘরের মাঝে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। বার বার বাহির থেকে ঘুরে আসতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি একবার রোয়েনের দিকে তাকাই। উনি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি গলা ঝেড়ে বলি,

— এই যে শুনছেন?

উনি ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন,

— হুম বলো।

— বাসায় ভালো লাগছে না। দমবন্ধ হয়ে আসছে।

রোয়েন আমার দিকে শীতল চাহনিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,

— বাহিরে যেতে চাও?

আমি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেই। তা দেখে রোয়েন ল্যাপটপে কিছু একটা করে অফ করে দেন। বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেন,

— যাও! তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।

_________________

দেখতে দেখতে আরও বেশ কিছু সময় চলে গেল। শীত এসে পড়লো সপ্তপর্ণে। কুয়াশার চাদর লেপ্টে গেল শহরের আনাচেকানাচে। সেই সাথে ভারী হলো ঘুমের পাল্লা। শীত সকালের মিষ্টি ঘুম ছেঁড়ে উঠতে উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেলো আমার। যার ফলে শেষের দিকে তাড়াহুড়ো লেগে গেল আমার। আজ রোয়েনের এক কাজিনের বিয়ে। সম্ভবত শুভ ভাইয়ার।দুপুর একটার মধ্যে থাকতে তাঁদের বাসায়। সেখান থেকে বরযাত্রী বের হবে এক সাথে। আত্মীয়তা বেশ ভালো বলে গ্রাম থেকে বাবা-মাও চলে এসেছে এই বিয়ে খাওয়ার জন্য। আপাতত তাঁরা শুভ ভাইয়ার বাসাতেই আছে। গতকাল বিকেলে এক কাজে তাদের শুভ ভাইয়াদের বাসায় যেতে হয়েছিল। এরপর কাজ শেষ হতে বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় শুভ ভাইয়ার বাসায়ই থেকে যান তাঁরা। তাই রোয়েন সকালেই তাঁদের কাপড় পাঠিয়ে দিয়েছেন যাতে তাঁদের অসুবিধা না হয়।

আমি বেশ তাড়াহুড়ো করছি কিন্তু তাও দেরি হয়েই যাচ্ছে৷ এর মূল কারণ শাড়ি৷ শুভ ভাইয়ার বাসা থেকে আমাকে একটা শাড়ি দেওয়া হয়েছে এবং বলে দেওয়া হয়েছে বিয়েতে আমি যেন এইটাই পড়ি৷ যার জন্য না চাওয়া সত্ত্বেও বাধ্য শাড়ি পড়তে হচ্ছে আমার। এক তো হাতে সময় কম তাঁর উপর এই শাড়ি। ঝামেলা আর ঝামেলা। কথায় আছে না, তারাহুরো করলে কোন কাজ ঠিকভাবে হয় না। আমার সাথেও আজ ঠিক তাই হচ্ছে। আমি বারংবার শাড়ির কুঁচি ঠিক করার চেষ্টা করছি কিন্তু বার বারই তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিছুটেই ঠিক হচ্ছে না। আমি যখন এই শাড়ির কুঁচি নিয়ে একদফা যুদ্ধ করছি ঠিক তখনই রোয়েন রুমে এসে বলে,
— কি হয়নি তোমার।

সাথে সাথে আমি পিছনে ঘুরে চেঁচিয়ে বলি,

— এই আপনি! নক করে আসতে পারেন না। আমি শাড়ি পড়ছি তো।

রোয়েন নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলে,

— সেটা তো বিগত এক ঘন্টা ধরেই পড়ছো।

আমি কোনোমতে ভাঁজ করা শাড়ির আঁচলটা ছেড়ে দিয়ে অর্ধেক কুঁচি করা শাড়ির ভাঁজগুলো হাতে নিয়ে রোয়েনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলি,

— কুঁচিগুলোই তো হচ্ছে না। কি করবো আমি?

রোয়েন অন্যদিকে তাকিয়ে বলেন,

— আমি কি জানি?

আমি নতজানু হয়ে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলি,

— একটু সাহায্য করেন।

রোয়েন একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে৷ অতঃপর আমার সামনে হাটু গেঁড়ে বসে বলে,

— তুমি উপর দিয়ে কুঁচি ঠিক করো আমি নিচ দিয়ে ঠিক করে দিচ্ছি৷

আমি মাথা দুলিয়ে কুঁচি করতে মন দিলাম। অবশেষে গিয়ে কুঁচিগুলো ঠিক হলো। উনি নিজ দিয়ে কুঁচি ঠিক করে দাঁড়িয়ে পড়েন। আমি তাঁর দিকে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলি,

— থেংক ইউ!

উনি আমার সামনে এসে কানের কাছে ঝুঁকে শীতল কন্ঠে বলেন,

— সে শুধু আমার হাতটি সামলে নিক বাকি আজীবন আমি তার কুঁচি সামলে নিব।

কথাটা বলেই তিনি দুই-তিন কদম পিছিয়ে গেলেন। আমার দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি কন্ঠে বলেন,

— তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। আর হ্যাঁ, শাড়িতে পিনআপ ভালো মত করবে। বিয়ে-শাদির মহল সবসময় তোমার দিকে নজর রাখা সম্ভব না।

কথাটা বলেই তিনি দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যান আর আমি হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি তাঁর যাওয়ার দিকে। মুখে নেই রা। ঠোঁট যুগল আমার কিঞ্চিৎ ফাঁক। আমি দরজার পানে তাকিয়ে থেকে আনমনেই বলে উঠি, ‘লোকটা এমন অদ্ভুত কেন? একে বুঝা বড় দায়।’

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here